ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৫৮
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই
টানা এক সপ্তাহ ঝড়-বৃষ্টির পর ডেনমার্কের আবহাওয়া আজ ভীষণ সুন্দর। গত রাতের তীব্র ভারী বর্ষণের ছাপ একটুও নেই, বরং নতুন এক রৌদ্রজ্জ্বল দিনের সূচনা। প্রণয় ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট মিক্স কম্বিনেশনের ফর্মাল ড্রেসআপে একদম রেডি। সে গায়ে Clive Christian No. 1 for Men পারফিউমটা স্প্রে করতে করতে কণ্ঠে বিরক্তি টেনে বলল,
“কি জাভেদ, তখন থেকে পেছন পেছন ঘুর ঘুর করছো কেন? কি মতলব?”
জাভেদ প্রণয়ের পেছনে দাঁড়িয়ে ফাঁকা একটা ঢোঁক গিললো। তার পেটের ভেতর কিছু কথা পাক দিয়ে গলায় উঠে আসলো, তবে সে কথা মুখে আসলেও ঠোঁটে আসছে না। কথাগুলো সাজিয়ে বলতে নিলেই আপনা-আপনি জড়িয়ে যাচ্ছে। তাই নিজের ইতস্তত ভাবটা চেপে যাওয়ার ভান করে বললো,
“অফিস যাচ্ছেন, স্যার?”
প্রণয় হাতে ঘড়ি পরতে পরতে এক বাক্যে জবাব দিল,
“হুম।”
জাভেদ কিছুক্ষণ হাবলার মতো দাঁড়িয়ে রইলো। অতঃপর দাঁত দিয়ে নখ কাটতে কাটতে আবারো কিছু বলার চেষ্টা করে বললো,
“ইয়ে মানে স্যার…জি স্যার…ঐ মানে… আমি আসলে বলছিলাম…”
প্রণয় ওর ‘ইয়ে মানে’, ‘হে মানে’ কে বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে নিজের ফোন আর ওয়ালেট নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
স্যার চলে যাচ্ছেন দেখে লাফিয়ে উঠলো জাভেদ। নিজেই নিজের মাথায় চাটি মেরে প্রণয়ের পেছনে ছুটলো।
প্রণয় বাইরে পার্কিং লটে চলে এলো। নিজের BMW-র দরজাটা খুলতেই পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠলো জাভেদ,
“স্যাএএএএএএএএএএর!!!”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বিকট চিৎকারের শব্দে থেমে গেল প্রণয়। একদম শান্ত ভঙ্গিতে পুনরায় গাড়ির দরজায় ধাক্কা মেরে বন্ধ করে দিলো। পেছন ঘুরে শীতল চোখে তাকালো জাভেদের দিকে।
জাভেদ এক দৌড়ে প্রণয়ের সামনে চলে এলো। বুকে এক সমুদ্র সাহস জমিয়ে চোখ কুঁচকে বন্ধ করে নিলো, কম্পিত হাতে মিষ্টির বাক্সটা ধরলো প্রণয়ের মুখের সামনে।
প্রণয় ভ্রু কুচকে দৃষ্টি নামালো। একবার মিষ্টির প্যাকেটটা দেখে পুনরায় চোখ রাখল জাভেদের আতঙ্কিত মুখের পানে।
জাভেদ ভায়ার্ত কণ্ঠে বললো,
“যাওয়ার আগে অন্তত একটা মিষ্টি খেয়ে যান, স্যার, প্লিজ। আমি জানি আপনি মিষ্টি খান না, তারপরও আজকের দিনের জন্য, স্যার…”
প্রণয় কয়েক সেকেন্ড ওর অনুনয়-বিনয় দেখে শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“হঠাৎ মিষ্টি কেন?”
স্যারের প্রশ্নে জাভেদ একটু সটান হয়ে দাঁড়ালো, বুক ফুলিয়ে মনে আরেকটু সাহস যুগিয়ে প্রণয়ের দিকে না তাকিয়েই বললো,
“ঐ মানে স্যার, আজ ভোর বেলায় আমার জমজ মেয়ে হয়েছে। তাই… আপনি আমার গুরুজন, আমার অন্নদাতা… আপনি যদি একটু মিষ্টি মুখ করে আমার মেয়েদের দোয়া করে দিতেন…”
জাভেদের কথায় প্রণয়ের সকল বিরক্তি উবে গেল। ক্ষীণ হাসির রেখা দেখা গেল তার অধরকোণে। সে আলতো হেসে জাভেদের কাঁধে হাত রাখলো, মিষ্টির বাক্স থেকে এক টুকরো মিষ্টি মুখে দিয়ে বললো,
“তোমার মেয়ে হয়েছে?”
জাভেদ নিচু মস্তকে উপর-নিচ ঝাঁকালো।
প্রণয় পুনরায় ওর দিকে তাকিয়ে হালকা বিরক্তি নিয়ে বলল,
“এটা তো খুব ভালো খবর। এটা বলার জন্য এত ‘হ্যাঁ মানে’, ‘না মানে’, ‘ইয়ে মানে’ করছিলে কেন? এত ভয় পাওয়ার কি আছে?”
জাভেদ এবার একদম রোবটের মতো স্থির হয়ে গেল। পুনরায় শুকনো ঢোঁক গিলে মনে মনে বললো,
“ভয় পাই আপনার দু-মুখো স্বভাবের জন্য। আপনার এই ঠান্ডা, এই গরম… এত মুড সুইং তো প্রেগন্যান্ট মহিলাদেরও হয় না যতটা আপনার হয়! আর আপনার আগে আমি বাবা হয়ে গেছি — এটা শোনার পর আপনি কি রিঅ্যাকশন দিতেন সেটা তো আপনি আর খোদা তালা ছাড়া কেউ জানতো না।”
প্রণয় ওকে আবারো ভাবনার অতলে হারিয়ে যেতে দেখে চরম বিরক্ত হলো। নাক কুঁচকে গাড়িতে উঠে চলে যেতে যেতে বললো,
“তুমি আর ভালো হলে না।”
বলেই হুশ করে চলে গেল।
গাড়ি চলে যাওয়ার শব্দে ধ্যান ভাঙলো জাভেদের। সে লাফিয়ে উঠে গাড়ির পেছন পেছন দৌড়াতে দৌড়াতে বললো,
“দারান স্যার! আমি ও তো যাবো, ও স্যার! একটু!”
কিন্তু ততক্ষণে BMW-কারটা দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেছে।
প্রণয় চলে গেছে দেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো জাভেদ। যেন সে এতক্ষণ এটারই অপেক্ষা করছিলো। আর স্যারকে যা দেখিয়েছে, তা তো অভিনয় মাত্র।
আজ অফিস যেতে হবে না ভেবে আনন্দে ডিগবাজি দিতে মন চাচ্ছে জাভেদের। সে ব্যাঙের মতো লম্ফঝম্প করতে করতে নিজের গেস্ট হাউজের দিকে যেতে যেতে মনের সুখে গেয়ে উঠলো,
“পাঞ্চি বানু, উড়তি ফিরু, মাস্ত গাগান মে, আজ মে আজাদ হু দুনিয়াকি চামান মে…”
তাকে এমন লাফাতে লাফাতে যেতে দেখে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা গার্ডগুলো চোখ বড় বড় করে ফেললো। এমন বেসুর গলায় গান শুনে তাদের যেন কান দিয়ে রক্ত উঠে আসার যোগাড়।
জাভেদ গান গাইতে গাইতে তাদের একজনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ভ্রু বাকিয়ে গার্ডটার মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে বললো,
“কিরে কালুয়া, এমনে চাইয়া কি দেখস?”
আফ্রিকান গার্ডটা জাভেদের কথায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। কথার মর্মার্থ বুঝতে না পেরে বললো,
“What sir? I didn’t understand.”
গার্ডটার কথায় জাভেদের মুখ তেতো হল। সে নাকের পাটায় ফুলিয়ে বললো,
“তা বুঝবি কী করে? সারাদিন তো কোথায় কাকে মেরে বালি চাপা দেওয়া যায়, সেই ধান্দায় থাকিস!”
গার্ডটা এবারও কিছু না বুঝে বোকার মতো তাকিয়ে রইলো।
জাভেদের এর মধ্যে থেকে থেকে বউয়ের জন্য মনটা মুচড়ে উঠলো। তাই আবারো নাচতে নাচতে গেস্ট হাউজের দিকে যাত্রা করলো।
লাফাতে লাফাতে গাইলো,
“আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে, মম চিত্তে নীতি নৃত্যে, কে যে নাচে তাতা থৈ থৈ, তাতা থৈ থৈ, তাতা থৈ থৈ!”
এসব দেখে নেপোলিয়ন গার্ডটা আফ্রিকান গার্ডটার উদ্দেশ্যেই বললো,
“I just don’t get what the boss saw in this crazy guy to make him his assistant.”
“অস্ট্রেলিয়ান এক্সেলেন্স ইন মেডিকেল লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড ২০২৫”
গ্র্যান্ড ফেলিসিটেশন সেরিমনি
স্থানঃ রয়্যাল প্রিন্স আলফ্রেড হাসপাতাল অডিটোরিয়াম
তারিখঃ ১৯শে জুলাই, ২০২৫
সময়ঃ দুপুর ২:৩০টা
দুপুরের তেজস্ক্রিয় আলো তখনও জানালার পাতলা সিল্কের পর্দা গলিয়ে অডিটোরিয়ামের অভ্যন্তরে এসে পড়ছে। বাইরের হালকা রোদ আর ভেতরের হালকা সোনালি আলোর মিশেলে যেন একটা নরম, স্নিগ্ধ, শান্ত আবরণ ছড়িয়ে দিয়েছে চারপাশে। অডিটোরিয়ামের বিস্তৃত সফেদ রঙা ছাদজুড়ে ঝুলে থাকা বিশাল আকৃতির ক্রিস্টাল ঝাড়বাতিগুলো নিভু নিভু জ্বলছে, তার নিচে একেবারে প্রথম সারির সিটে বসে আছেন বিশিষ্ট অতিথিরা—নরম মখমলি কুশনে পেছনে হেলান দিয়ে।
মঞ্চের চারপাশ সাজানো সাদা অর্কিড আর স্নিগ্ধ সুরভীত গোলাপি লিলি ফুলে সজ্জিত। বর্তমানে উপস্থিত সকলের উচ্ছ্বাসিত নিরব দৃষ্টি মঞ্চের বিশাল এলইডি স্ক্রিনের উপর, যেখানে বড় বড় অক্ষরে ভেসে উঠছে—
> “AUSTRALIAN EXCELLENCE IN MEDICAL LEADERSHIP AWARD – ২০২৫” (অস্ট্রেলিয়ান এক্সেলেন্স ইন মেডিকেল লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড – ২০২৫)
মঞ্চের নিচের দিকে একেবারে প্রথম সারিতে বসেছেন জাতীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের সদস্যরা—ডঃ মারিয়া এলউড (ডেপুটি চীফ মেডিকেল অফিসার), ডঃ জোনাথন মুইর (সিডনির বিশিষ্ট নিউরোসার্জন), প্রফেসর ইলাইন কার্টার (প্রেসিডেন্ট, অস্ট্রেলিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন)।
তাঁদের পাশেই বিশেষ সম্মানীয়ভাবে বসানো হয়েছে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (WHO)-এর একচেটিয়া ডেলিগেশন টিম, যাঁরা এই অনুষ্ঠানটির প্রধান আয়োজকঃ
ডঃ ক্যারোলিন হিউজেস, চেয়ারপারসন, WHO
প্রফেসর ইউকি নাকামুরা, এক্সিকিউটিভ মেম্বার, WHO পাবলিক হেলথ ডিভিশন
ডঃ ইমানুয়েল ওকেকে, WHO প্রতিনিধি, সাউথ-ইস্ট এশিয়া
ডঃ সিলভিয়া নরবার্গ, বোর্ড মেম্বার, WHO মেডিকেল ইনোভেশন
ডঃ আহমেদ আল-জাহির, হেড অফ WHO এমার্জেন্সি মেডিকেল রেসপন্স
প্রথম সারির ডানদিকে রেশমি শাড়ি পরা তিনজন ইন্ডিয়ান মহিলা—স্থানীয় কমিউনিটির প্রতিনিধিত্বকারী। তাঁদের চোখে উজ্জ্বল প্রশংসা, আর হাতে ধরা অর্কিড গিফট প্যাক।
দর্শক সারির ডান পাশে বসে আছেন বিভিন্ন হাসপাতালের প্রতিনিধি—সব বয়সের, সাদা স্কার্ট পরা নার্স থেকে শুরু করে স্যুট-পরা সিনিয়র ডাক্তাররা। কারো হাতে কফির কাপ, কেউবা নিঃশব্দে ক্যামেরা হাতে প্রস্তুত।
WHO টিম মেম্বারদের বা দিকের সারিতে বসে আছেন বর্তমান সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে নামকরা ও সফল ১০ জন কার্ডিও সার্জন (হার্ট সার্জান)ঃ
ডঃ আবদ্ধ চৌধুরী শুদ্ধ, ডঃ রাহি প্রসাদ শেঠি, ডঃ মেহমেত ওজ, ডঃ ম্যাগদি ইয়াকুব, ডঃ ডেন্টন এ কুলি, ডঃ আলফ্রেড ব্লালক, ডঃ মার্ক রুয়েল, ডঃ টাইরোন ডেভিড, ডঃ প্যাট্রিক ম্যাককার্থি।
—সকলের মধ্যেই কাজ করছে এক চাপা উত্তেজনা।
এর মধ্যেই মঞ্চের সামনে এসে দাঁড়ালেন উপস্থাপিকা—সিডনি মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন ডিন মিস ফেলিসিয়া গ্রান্ট। গলায় তাঁর রেশমি স্কার্ফের মধ্যে একটা নরম ল্যাভেন্ডার ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে, পুরো অডিটোরিয়ামজুড়ে।
উপস্থাপিকা ফেলিসিয়া গ্রান্ট প্রফেশনাল ভঙ্গিতে মুখে একটুকরো কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে মাইকটা হাতে তুলে নিলেন, উপস্থিত সকলের দিকে এক নজর ঘুরিয়ে বলতে শুরু করলেন—
“লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান, স্বাগতম জানাই ‘অস্ট্রেলিয়ান এক্সেলেন্স ইন মেডিকেল লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড ২০২৫’-এ। আমাদের মধ্যে উপস্থিত শত শত গুণীজনের মধ্যে আজ আমরা সম্মান জানাতে চলেছি এমন একজন মানুষকে, যাঁর প্রতিভা ছুরির ধার ছাড়িয়ে যায়—একজন দূরদর্শী, প্রতিভাবান, সহানুভূতিসম্পন্ন এবং অটল নিষ্ঠার অধিকারী মানুষ… কার্ডিও সার্জন ডক্টর আবদ্ধ চৌধুরী।”
“এবং এখন, নেতৃত্ব উদ্যাপনের এই অনুষ্ঠান শুরু করতে আমি মঞ্চে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি এমন একজনকে, যিনি সিডনিতে ডঃ চৌধুরীর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ নিউরোসার্জিক্যাল অগ্রগতিতে কাজ করেছেন—ডঃ জোনাথন মুইর।”
ডক্টর জনাথন মুইর হালকা হেসে প্রথম সারি থেকে মঞ্চে উঠে এলেন। মাইকটা ঠোঁটের কাছে নিয়ে প্রশংসনীয় হেসে বললেন—
“ডক্টর চৌধুরী তিনি শুধুই একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ বা কার্ডিও সার্জারিকাল ডাক্তার নন, তিনি একজন মানবিক সহানুভূতির বিপ্লব। তাঁর প্যালিয়েটিভ রিফর্ম পুরো আধুনিক অস্ট্রেলিয়ায় কেয়ারের সংজ্ঞা পাল্টে দিয়েছে।”
উপস্থাপিকা মৃদু হেসে পুনরায় মাইকের কাছে এগিয়ে এসে বললেন—
“ধন্যবাদ ডঃ মুইর, সত্যিই অসাধারণ বক্তব্য। এখন আমি আমন্ত্রণ জানাতে চাই অস্ট্রেলিয়ান চিকিৎসাক্ষেত্রে একজন দূরদর্শী এবং নীতিবান ব্যক্তিত্বকে—মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট, প্রফেসর ইলাইন কার্টারকে। প্রফেসর, প্লিজ, আপনাকে মূল্যবান মতামত রাখার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।”
প্রফেসর ইলাইন কার্টারও মঞ্চে উঠে এলেন। ডক্টর চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে প্রশংসনীয় কণ্ঠে বললেন—
“অস্ট্রেলিয়ার শীর্ষস্থানীয় চিকিৎসা ব্যক্তিত্বদের মধ্যে এবার টপ ফাইভে তাঁর প্রবেশ শুধুই একটা সাফল্য নয়—এটা প্রমাণ করে যে আসল শ্রেষ্ঠত্ব জন্ম নেয় বিনয়ের ভিতর থেকে, যা কিছু ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, অনুভব করে নিতে হয়।”
ফেলিসিয়া গ্রান্ট প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ধন্যবাদ প্রফেসর কার্টার, এত সুন্দর বক্তব্য আমাদের মধ্যে উপস্থাপন করার জন্য। এবার আমরা শুনবো এমন একজনের কাছ থেকে, যিনি জাতীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থায় WHO-এর সম্মুখসারিতে কাজ করেছেন। আমি বিশেষভাবে অনুরোধ করছি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার চেয়ারপারসন—ডঃ ক্যারোলিন হিউজেসকে, আমাদের মধ্যে কিছু বলার জন্য।”
উপস্থাপিকার কথার সাথে সাথেই—
চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে গেল।
মাত্র কয়েকটা হালকা নীল আলোর রশ্মি এসে থেমেছে মঞ্চের মাঝখানে।
পেছনের এলইডি স্ক্রিনে ফুটে উঠছে একের পর এক হৃদয় খোলা সার্জারির রিয়েল ফুটেজ।
সাউন্ড সিস্টেমে ধ্বনিত হচ্ছে হৃদস্পন্দনের গা ছমছমে—থাম্প… থাম্প… থাম্প… শব্দ।
এর মধ্যেই নিস্তব্ধতার বুক চিরে শোনা গেল হাই হিলের টুকটাক শব্দ।
ধীরে ধীরে আবছা থেকে স্পষ্ট হলো এক আত্মবিশ্বাসী নারী প্রতিবিম্ব। মঞ্চে উঠে এলেন ক্যারোলিন হিউজেস। মুখে একরাশ আত্মবিশ্বাস, চোখে দায়িত্বের গর্ব। তিনি মাইকটা ঠোঁটের কাছে এনে প্রফেশনাল ভঙ্গিতে বললেন—
“আজ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা WHO-এর পক্ষ থেকে, যখন আমরা বিশ্বের একজন শ্রেষ্ঠ তরুণ হার্ট সার্জনকে সম্মান জানাচ্ছি—তখন আমরা কেবল একজন মানুষকে নয়, সেই নিরবচ্ছিন্ন নিরাময়-চেতনাকেও সম্মান জানাই, যা সব সীমান্ত ছাড়িয়ে প্রতিটি হৃদয়ে পৌঁছে যায়।”
বলে তিনি একটু থামলেন, তাকালেন দর্শকদের দিকে।
পুনরায় বলতে আরম্ভ করলেন—
“ডা. চৌধুরী, কার্ডিয়াক সার্জারির জগতে এক নতুন আলোর দিশা দেখিয়েছেন। আমরা এখন দেখে নেব, তারই কিছু ঝলক।”
বলে পিছনে ফিরে তাকালেন।
সাথে সাথেই মঞ্চের লাইট নিভে গেল।
এলইডি স্ক্রিনে ভেসে উঠলো—
একটির পর একটি স্প্লিট কাট।
অপারেশন টেবিল, স্ক্যালপেল, বুক চিরে ফেলা, নার্সের উত্তেজিত কণ্ঠে চিৎকার—
“স্যার, হি’জ কোডিং!”
তবে উত্তেজনাকে দমিয়ে, ডক্টর চৌধুরী সম্পূর্ণ স্থির ও স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন—
“রিল্যাক্স, টেক আ ব্রেথ। নট আন্ডার মাই ওয়াচ।”
তৎক্ষণাৎ সিপিআর, ইনজেকশনের প্রভাবে, ধীরে ধীরে ফিরে আসে পেশেন্টের হৃদস্পন্দন।
আর এই দৃশ্যের সঙ্গেই স্ক্রিন অফ হয়ে যায়।
মঞ্চে ছেয়ে যায় নীরবতার চাদর।
ফুটেজ শেষে আবার এগিয়ে এলেন ক্যারোলিন।
গর্বিত কণ্ঠে বললেন—
“We now invite the man behind these miracles… Doctor Aboddho Chowdhury Suddha… to the stage.”
সাদা আলো ঝলসে উঠল চারপাশ।
মৃদু করতালির শব্দে মুখরিত হয় চারপাশ।
পেছনের কালো ছায়া স্পষ্ট হয় ধীরে।
পুরুষালী গৌরবে এগিয়ে আসেন, বর্তমান সময়ের বিশ্বের সব থেকে সফল ও ডিম্যান্ডিং হার্ট সার্জনদের একজন, ডক্টর আবদ্ধ চৌধুরী শুদ্ধ।
তাঁর ধূসর রঙা চোখের মনিতে নীরব আত্মবিশ্বাস।
তাঁর গায়ে নিখুঁত গাঢ় চারকোল ব্লেজার, ভেতরে কালো শার্ট, খোলা কলারের নিচে হালকা ঝুলে থাকা স্টেথোস্কোপের সিলভার টিপ।
তিনি গত চার বছর বিশ্বের সাতটি মহাদেশের মধ্যে অন্যতম উন্নত মহাদেশ অস্ট্রেলিয়াতে ডাক্তারি প্র্যাকটিস করছেন এবং অর্জন করেছেন অনেক কিছু।
তাঁর আগমনে উক্ত সকলের মধ্যে ফিসফাঁসের মৃদুগুঞ্জন থেমে যায়।
কয়েকশো জোড়া কৌতূহলী দৃষ্টি এসে আঁচড়ে পড়ে তরুণ ডক্টরের উপর।
তালির শব্দ এক সময় থেমে যায়—
ফেলিসিয়া গ্রান্ট তখন বলেন—
“লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান… প্রেজেন্টিং টু ইউ… ডঃ আবদ্ধ চৌধুরী শুদ্ধ—অস্ট্রেলিয়ার ইয়াংগেস্ট রিসিপিয়েন্ট অফ দ্য গ্লোবাল মেডিক্যাল লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড…”
ডক্টর চৌধুরী ধীরে ধীরে উঠে এলেন মঞ্চে।
চেয়ারপারসনের দিকে দৃষ্টি রাখলেন।
কৃত্রিম হাসির ছটা অধরে টেনে হ্যান্ডশেক করলেন দু’জন।
ফেলিসিয়া মৃদু হেসে সামনে এগিয়ে এলেন।
তাঁদের সামনে উন্মুক্ত করলেন একটা সাদা মখমলের কেস।
ডক্টর চৌধুরীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন—
“ডঃ চৌধুরী, দিস ইজ ইয়োর্স…”
শুদ্ধ তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো সেটির দিকে।
চোখের সামনে ঝলকে উঠলো একটা ব্লু-সিলভার মেটালিক শিল্ড, খোদাই করা—
“For Outstanding Global Contribution in Cardiac Surgery & Medical Leadership — Dr. Aboddha Chowdhury (Top 5 – 2025)”
পুরস্কারটা তাঁর হাতে তুলে দিলেন WHO-এর চেয়ারপারসন ক্যারোলিন।
চারদিক আবার করতালিতে মুখরিত হলো।
শুদ্ধ আবেগাপ্লুত দৃষ্টিতে তাকায় নিজের এত বছরের অর্জনের দিকে।
এটা কেবল তার সম্মানের প্রতীক না, এটা তার এত বছরের একাগ্রতা ও নিষ্ঠার একচ্ছত্র প্রতিফলন।
তখন ক্যারোলিন সামান্য এগিয়ে এসে প্রশ্ন করেন—
“ডঃ চৌধুরী… মাত্র ৩৩ বছর বয়সে আপনি অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় মেডিক্যাল কাউন্সিলের প্রধান, চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনারারি চেয়ার এবং বিশ্বের সবচেয়ে জটিল কার্ডিয়াক সার্জারিগুলোর দায়িত্বে। প্রতিদিন আপনি কত কত মৃত্যুকে জয় করেন।
কিন্তু দিনশেষে, আপনিও তো মানুষ—আপনার নিজের ভিতরের ভয়টা আপনি কোথায় রাখেন?”
শুদ্ধ তখন ধীরে তাকায় উৎসুক জনতার দিকে।
চোয়াল শক্ত করে, ঠোঁটের কোনায় পেশাদারিত্ব এঁটে বলে—
“ভয় তো রয়েই গেছে…”
“তবে সে ভয় আমার অস্ত্র।
ভয় না থাকলে মৃত্যুকে জয় করার তাগিদ ফুরিয়ে আসবে।
তাই সেই ভয়, শুধু ভয় নয়—মরণকে জয় করার এক দুর্ব্যব্ধ অস্ত্র, যা সঠিক সময়, হাতকে স্থির থাকতে বাধ্য করে।”
ধীর কণ্ঠের দুই একটা বাক্যে আশপাশে শান্ত হয়ে গেল।
“শুদ্ধ পুনরায় বলল—
আমি, আমার ভুল মানে—কারও জীবন থেমে যাওয়া।”
পেছনের স্ক্রিনে তখন ফুটে ওঠে একটি ছয় বছর বয়সী মেয়ের হাসিমাখা মুখ।
তার নিচে ভেসে আসে একটি লাইন—
“Dr. Aboddha Chowdhury — A name that heals beyond borders.”
ডক্টর চৌধুরীকে সম্মান প্রদর্শন শেষ হলে,
অন্য বিভাগের ডক্টরদের সম্মান প্রদর্শন শুরু হয়।
শুদ্ধ মঞ্চ থেকে নেমে আসতেই
তাকে ঘিরে ধরে এক ঝাঁক রিপোর্টার, প্রেসের লোক।
CNN-এর রিপোর্টার ছুটে এসে সবার আগে প্রশ্ন করলেন—
“ডঃ শুদ্ধ, আপনি মাত্র ৩৩ বছর বয়সে বিশ্বের সেরা ৫ জন হার্ট সার্জনদের একজন।
বিশ্বের প্রথম সফল ইনফ্যান্ট বায়োনিক ভেন্ট্রিকুলার রিকনস্ট্রাকশন—এত বড় কিছু করার পরও আপনি একটাও পাবলিক ইন্টারভিউ দেননি, কেন?”
শুদ্ধ ধীর চোখে তাকাল রিপোর্টারের দিকে।
অল্প ঝুঁকে বলল—
“আমি একজন ডাক্তার।
সিনেমার হিরো নই, যে প্রত্যেকটা অপারেশন ফর প্রেস কনফারেন্স করব।
আমার কাজ অপারেশন থিয়েটারে—কনফারেন্স হলে নয়।”
এমন বুদ্ধিদীপ্ত সরল উত্তরের আর কথা পেঁচানোর সুযোগ পেল না রিপোর্টারটা।
এবার BBC রিপোর্টার এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন—
“আপনার প্রোগ্রামের নাম দেওয়া হয়েছে Operation Resurrection। কেউ কেউ বলছেন, এটি ঈশ্বরের কাজের সাথে তুলনীয়।
আপনি কি নিজেকে ঈশ্বরের সমান মনে করেন?”
শুদ্ধ থেমে সামান্য হাসলো।
অতঃপর গম্ভীর কণ্ঠে বললো—
“আমি নিঃশ্বাস ফুরিয়ে আসা নির্জীব হৃদপিণ্ডকে পুনরায় সজীব করে তুলি।
ঈশ্বর আমি নই… তবে ঈশ্বরের দূত বলতে পারেন।”
তারপর সাংবাদিকদের ভেতর চাপা গুঞ্জন।
কেউ লিখছে, কেউ তাকিয়ে আছে স্থির চাহনিতে, কেউ রেকর্ড করছে।
কারণ এইসব নিউজই হবে কালকের তাজা খবর।
এরপর সাংবাদিকদের ভিড় ঠেলে
একজন ভারতীয় সংবাদপত্রের প্রতিনিধি সাহস করে প্রশ্ন করলেন—
“আপনার অস্ত্রোপচারের সাফল্যের হার এখন পর্যন্ত ৯৮.৭%। কীভাবে সম্ভব হচ্ছে এটা?”
শুদ্ধ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে, ঠান্ডা কণ্ঠে প্রত্যুত্তর করল—
“কারণ আমি ব্যর্থতাকে পছন্দ করি না।”
মুহূর্তে ঘরজুড়ে নীরবতা।
অতঃপর একজন তরুণ রিপোর্টার কিছুটা ব্যক্তিগত হয়ে গেলেন।
কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করলেন—
“আপনার হাসি খুব কম দেখা যায় ডঃ চৌধুরী। এত সাকসেসের পরে ও আপনি কি সুখী মানুষ নন?
এমনকি আপনার রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস এখনো আনম্যারেড।
আপনার বয়সের অনুপাতে, এতদিনে আপনার ম্যারিড হয়ে যাওয়ার কথা।”
প্রফেশনাল জায়গায় ব্যক্তিগত প্রশ্ন করাতে সামান্য বিব্রত বোধ করল শুদ্ধ।
তবু ও অযথা উদ্বেগ প্রকাশ করলো না।
কণ্ঠে স্বাভাবিক মাত্রা ধরে রেখে বলল—
“আমার সুখের সময়সীমা ৭ মিনিট।
ঠিক যতক্ষণ একজন রোগীর হৃদয় হাতে নিয়ে আমি সেটাকে পুনের প্রতিস্থাপন করতে পারি।
বাকি সময়টা আমি অপেক্ষায় থাকি—পরের মৃত হৃদয়টার জন্য।”
এই কথার পর আর কেউ কিছু জিজ্ঞেস করতে পারল না।
রয়্যাল প্রিন্স আলফ্রেড হসপিটালের সকলেরই বর্তমান অবস্থান রয়্যাল প্রিন্স আলফ্রেড অডিটোরিয়ামে।
বিদায়, ডিউটি রত গুটিকয়েক নার্স ও ওয়াট বয় ছাড়া বিশাল এই হাসপাতালের পুরোটাই জনমানবহীন, নিস্তব্ধ।
তবে বিশাল এই হাসপাতালের গা ছমছমে মর্গ রুম যেন আরো বেশি ভয়ানক ও নিস্তব্ধতার চাদরে ঢেকে আছে। নিঃশব্দ শোনশান ফাঁকা রুমের আবহাওয়ায় একটা চাপা মানুষ পচা গন্ধ, যা হঠাৎ করে নাকে না লাগলেও ধীরে ধীরে টের পাওয়া যায়। এছাড়া পুরনো ফ্যানাইলের গন্ধের সঙ্গে লাশের গন্ধ মিক্স হয়ে একটা উৎকট গন্ধের সৃষ্টি করেছে।
পুরো মর্গ রুমের এদিকে ওদিকে ধাতব স্টিলের টেবিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে, যার উপর সাদা কাপড়ে ঢাকা অগণিত মৃতদেহ, পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলে নাম্বার ট্যাগ লাগানো—যার উপর এক পলক দৃষ্টি পড়লেই বুকের রক্ত হিম হয়ে আসে।
এই মর্গটা হাসপাতালের বেসমেন্টে বিধায় কোনো জানালা বা ভেন্টিলেটর নেই। তাই বোধহয় বাহিরের এক ফোঁটা আলো-বাতাস ও ঘরে প্রবেশ করে না। কেবল মাথার উপর ঝুলছে একটা ঝাপসা সাদা আলোর বাল্ব, যা আশেপাশে একটা কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশের সৃষ্টি করেছে।
এই মর্গ কক্ষের বা দিকে লাশ কাটারও ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়াও এই হাসপাতালের মর্গ হন্টেড বলে অনেক মিথ প্রচলিত রয়েছে। তাই হাসপাতাল কর্মীরাও অতি প্রয়োজন ব্যতীত এই মর্গ রুমে আসে না।
আর এই ভয়াবহ কক্ষের মাঝখানে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে এক তরুণীকে।
ভয়ে আতঙ্কে সেই তরুণীর সেন্সলেস হওয়ার উপক্রম। সে অশরীরে প্রেতদের ভয়ে সামনে, পেছনে, ডানে, বামে কোথাও তাকাতে পারছে না। আতঙ্কে মনে হচ্ছে কলিজা লাফাতে লাফাতে মুখ দিয়ে উঠে আসবে। সে যে চিৎকার করে কাউকে ডাকবে, সেই উপায়টা ও নেই।
তাকে যে বা যারা বেঁধে রেখে গেছে, তারা মুখটাও শক্ত করে বেঁধে দিয়েছে।
ওই নিঃস্তব্ধ রুমে সামান্য কিছু একটার শব্দও বিভৎস, ভয়ঙ্কর শোনায়।
তাই মেয়েটি চোখ বন্ধ করে শুধু আল্লাহ করছে।
হায় ডার্লিং, কেমন এনজয় করছো লাশেদের সাথে?
পিছন থেকে কোনো নারী কণ্ঠস্বর কানে পৌঁছতেই বাধা অবস্থায় চমকে উঠলো মেয়েটি। ভূত ভেবে দোয়া-দরুদ পড়তে শুরু করলো।
যা দেখে ঠোঁট এলিয়ে হাসলো প্রিয়স্মিতা, ছেলেদের মতো সিস বাজাতে বাজাতে এগিয়ে এলো তুহিনার দিকে।
নিঃস্তব্ধ কক্ষে তার কটকট শব্দ তোলা পদচারণার ধ্বনি যেন কোনো অতৃপ্ত আত্মার আগমনের সংকেত।
ব্ল্যাক জিন্স, চেক শার্ট, মুখে কালো মাস্ক, হাতে কালো পুতির ব্রেসলেট—
সেই চিরাচরিত টমবয় লুকে অতিআকর্ষণীয় নীলাভ চোখ দুটো ব্যতীত আর কিছুই দৃশ্যমান নয়।
প্রিয়স্মিতা ধীর পায়ে এগিয়ে এলো তুহিনার কাছে।
তুহিনার ভীত সন্ত্রস্ত চেহারার পানে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো,
লাশ কাটার নাইফটা হাতে তুলে নিয়ে ঘুরাতে ঘুরাতে লাফিয়ে বসল তুহিনার সামনের একটা ধাতব স্টিলের টেবিলের উপর।
সাইকোদের মতো ঘাড় বাঁকিয়ে ভয়ঙ্কর হিম শীতল কণ্ঠে আদেশ করল,
চোখ খুল।
সামনের উপস্থিতি, এনার্জি কোনো অশরীরী নয়, বরং রক্ত-মাংসের মানুষ — বুঝতেই পেরে আচমকা চোখ খুলে ফেললো তুহিনা।
সাথেসাথেই তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো একজোড়া ঈগল চোখে—যে চোখের অতলে কেবল নীরব হিংস্রতা।
ওই চোখের শীতলতা দেখেই তুহিনার ভূতের ভয় শান্ত হয়ে গেলো।
প্রিয়স্মিতা, হাতের নাইফটার শার্পনেস দেখতে দেখতে বললো,
দেখতো, এইটা দিয়ে এক কোপে তোর ঘাড় থেকে মুণ্ডুটা আলাদা করে দেওয়া যাবে নাকি?
প্রিয়স্মিতার কথা বলার ধরণে স্থব্ধ হয়ে রইলো তুহিনা।
সে আটকে আছে মেয়েটার পরিচিত দুই চোখে।
তবে এটা নিয়ে বেশি ভাবতে পারলো না—তার আগেই একটা অপ্রত্যাশিত কাণ্ড ঘটিয়ে ফেললো প্রিয়স্মিতা।
নিজের হাতে থাকা নাইফটা দিয়ে এক কোপে পাশে থাকা লাশটার ঘাড় থেকে কচ কচ শব্দে মাথা আলাদা করে দিলো।
পুরনো সেই লাশটার কালচে পচা রক্তের ছিটা ছিরিত করে গিয়ে তুহিনার মুখের উপর পড়লো।
এমন নৃশংসতা দেখে ভয়ে তুহিনার চোখ দুটো টিকরে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো।
পচা রক্তের গন্ধে ঘৃণায় গা গুলিয়ে উঠলো। মুখ বাধা বিধায় কিছু বলতে পারলো না, কেবল নাক দিয়ে “উঁ উঁ” শব্দ করলো।
তুহিনার এই অবস্থা দেখে পৈশাচিক শান্তি পেলো প্রিয়স্মিতা।
ঘাড় বাঁকিয়ে ফিচেল হেসে বললো,
এই তো সাহসের ছিরি ছ্যাহ! এই সাহস নিয়ে তুই আমার এই মেহেরিমা শিখদার প্রিয়স্মিতার জিনিসে থাবা মারিস? সো ফানি!
প্রিয়স্মিতার বলার ধরনে অবাক হলো তুহিনা।
ভ্রু কুঁচকে ভাবলো, সে আবার এই মেয়েটার কী কেড়ে নিয়েছে?
প্রিয়স্মিতা ওর মনের প্রশ্নটা ঝট করে বুঝে নিলো।
বাঁকা হেসে এক টানে ওর মুখের উপর থেকে কাপরটা সরিয়ে দিলো।
তুহিনা নিজের অবাকত্ব কাটিয়ে উঠার আগেই আচমকাই তুহিনার গলায় ধারালো নাইফটা ঠেসে ধরলো প্রিয়স্মিতা।
রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালো তুহিনার দিকে।
দাঁতে দাঁত চেপে বিস্রী গালাগালি দিয়ে বললো,
You bloody bitch, তোকে যখন শুদ্ধ দু’চক্ষে দেখতে পারে না, তখন আমার শুদ্ধর আসে পাশে ঘুরঘুর করিস কেন? জানের মায়া নেই তোর?
প্রিয়স্মিতার ছুরি চেপে ধরার তীব্রতায় তুহিনার গলার চামড়া হালকা কেটে গেলো।
সে যেন প্রিয়স্মিতার কথাগুলো বিশ্বাস করতে পারছে না।
সে এটাও বুঝতে পারছে না—এই মেয়েটা আসলে কে আর তাকে এসব কেনই বা বলছে।
তুহিনাকে চুপ করে থাকতে দেখে রক্ত চেপে গেলো প্রিয়স্মিতার মাথায়।
সে এবার বাঁ হাতে শক্ত করে চেপে ধরলো তুহিনার চুলের মুঠি।
ব্যথায় কুকিয়ে “আহ” করে উঠলো তুহিনা।
প্রিয়স্মিতা দাঁতে দাঁত চেপে হিশহিশিয়ে বললো,
শালী! সস্তা পুরুষ মানুষ দেখলেই তোর গায়ে ঢলে পড়তে মন চায়? আজ তোকে ফার্স্ট আর লাস্ট ওয়ার্নিং দিলাম।
এর পর যদি আর কখনো আমার শুদ্ধর আসে পাশে তোকে দেখি, জানে মেরে ফেলবো।
And I swear — তোর লাশটা ও কেউ খুঁজে পাবে না।
প্রিয়স্মিতার চোখে মুখে ঠিকরে পড়ছে শিকদারদের বংশীয় হিংস্রতা।
উতলে ওঠা গরম রক্তে জেগে উঠছে সেই খানদানি নারকীয় পিশাচ, যার মনে মায়া দয়ার কোনো ছাপ নেই।
আর এই সত্তাকে তারা নিজেরাই কন্ট্রোল করতে পারে না।
তবে এত সবে ভয় পেয়ে গেল না তুহিনা।
তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে পড়ল।
সে প্রিয়স্মিতাকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে দিলো।
সে শুদ্ধর কাছে যাবে না — মানেটা কি?
এবার তুহিনার মাথায়ও রক্ত চেপে গেল।
গর্জে উঠে বললো,
তুই কে হস? আমাকে এসব বলার!
আর শুদ্ধ ভাই বা তর কখন হলো?
তুই কে জানি না, জানতেও চাই না। তবে নিজের সীমায় থাক!
শুদ্ধ ভাই এর দিকে নজর দিবি না, সে আমার!
এই তুহিনা চৌধুরীর একান্ত!
আমি আগে ওর কাছে যেতাম! ভবিষ্যতে ও যাব,
তুই যা পারিস করে নে!
শুদ্ধকে নিজের বলে দাবি করাতে মেজাজ হারালো প্রিয়স্মিতা।
তেড়ে এসে কষিয়ে একটা চড় বসিয়ে দিলো তুহিনার গালে।
সাথে সাথেই বাধা অবস্থায় মুখ থুবড়ে উল্টে পড়লো তুহিনা।
ব্যথায় গাল তার টনটন করে উঠলো।
কোনো মেয়ের হাত এত শক্ত হয়?
প্রিয়স্মিতা পুনরায় তেড়ে এসে ওর গলা টিপে ধরলো।
চোখ দিয়ে যেন আগুন টিকরাচ্ছে।
গলা চেপে ধরা, নিঃশ্বাস আটকে আসলো, তুহিনার চোখমুখ লাল হয়ে গেল মুহূর্তেই।
প্রিয়স্মিতা তুহিনাকে চুল ধরে সোজা করে বসালো।
শক্ত হাতে তুহিনার চোয়াল চেপে ধরে বললো,
আল্লাহর কসম!
আর খালি একবার দেখি!
তাহলেই তোকে বুঝাবো —
Who I’m!
বলে গটগট করে চলে গেলো প্রিয়স্মিতা।
তবে রিঅ্যাকশন দিতে ভুলে গেলো তুহিনা।
এই মেয়েটা কে?
আর কোথা থেকে?
কি বলে গেলো?
কিছুই তার মাথায় ঢুকলো না।
তবে এটা বেশ বুঝলো —
শুদ্ধকে পাওয়ার রাস্তা তার জন্য আরও কঠিন হয়ে গেছে।
তবে সে ও মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো —
আপনি আমারই হবেন শুদ্ধ ভাই।
আপনাকে আমার হতেই হবে!
আমি আপনার জন্য যেমন জান দিতে পারি,
তেমনি শত শত জান অনায়াসেই নিতে পারি।
আমাকে এখনো চিনতে পারেনি,
আজকের প্রত্যেকটা আঘাতের প্রতিশোধ আমি একটা একটা করে তোর কাছ থেকে নেব, সে তুই যেই হোস না কেন —
এটা এই তুহিনা চৌধুরীর প্রমিস।
এইভাবেই যেন আরো দুজনের মধ্যে অদৃশ্য আরেকটা সংঘর্ষের দামামা বেজে গেলো —
কে পাবে ভালোবাসা,
আর কে হারাবে —
তাতো সময় সাপেক্ষ।
কানাডা
বিছানার এক কোণে পড়ে থাকা ফোনটার তীক্ষ্ণ ঝাঝানো শব্দে বিরক্তি ধরে যাচ্ছে দেবীর।
রান্না ফেলে ফোন ধরতে যাওয়ার মোটেও ইচ্ছা হচ্ছে না।
তাই সেই শব্দকে বিশেষ গুরুত্ব দিলো না, অপেক্ষা করলো ফোনটা নিজে থেকে কেটে যাওয়ার।
কিন্তু ফোনের ওপারের ব্যক্তি যেন বেশ অধৈর্য, ফোনটা রিং হতে হতে একবার থামলে পুনরায় নতুন উদ্যমে বেজে উঠছে।
এভাবে অনেকক্ষণ পার হওয়ার পর
অবশেষে থামলো ফোনটা।
রান্না ছেড়ে এখন যেতে হবে না ভেবে হাফ ছাড়লো দেবী।
তবে তার স্বস্তিটুকুকে ধুলোয় মিশিয়ে, ফোনের তীক্ষ্ণ শব্দে আবারো মুখরিত হলো আশপাশ।
এবার একটু বেশি দৃঢ়, বেশি অনুরণন তোলা স্বরে।
এবার বিরক্তিতে চোখ বুঁজে দাঁড়িয়ে রইলো দেবী।
ছোট একটা নিঃশ্বাস হলে গ্যাস অফ করে দিল।
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এগিয়ে গেল বেডরুমের দিকে।
ফোনটা সেই আগের মতোই বিছানার কোণায় পড়ে আছে।
দেবী রুমে এসে আশেপাশে চোখ ঘুরালো, কিন্তু কাঙ্খিত ব্যক্তির দেখা পেল না —
আরো দুই পা এগোতেই ওয়াশরুম থেকে পানি পড়ার শব্দ শুনতে পেল।
সে ফোনটার কাছে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো।
আঙুলে আঙুল চেপে রাখলো।
এটাতো ওর ফোন নয়, তাই ধরবে কি ধরবে না, দ্বিধা কাজ করছে —
তবে ফোনের ঝঙ্কার তোলার শব্দে সেই ভাবনা বেশি দূরে এগুলো না।
খানিকটা দ্বিধা ও অস্বস্তি নিয়ে ফোনটা হাতে তুলে নিল দেবী।
স্ক্রিনে ভেসে আছে একটা আননোন নাম্বার —
দেবী ধরবে কি ধরবে না ভাবতে ভাবতেই ফোনটা ধরেই ফেললো।
মোবাইলটা কানে চেপে ধরে রিনরিনে কণ্ঠে বললো,
“হ্যালো, কে বলছেন?”
ফোনের ওপাশ থেকে ছুটে আসে নারী কন্ঠটা।
যেন শ্বেতার নরম হৃদপিণ্ডের ধারালো ছুরির আঘাত আনলো।
পানিতে টলমলে হয়ে উঠলো মায়াবী অক্ষি যুগল।
মুক্ত খোলা পরিবেশে দাঁড়িয়েও তার শ্বাসকষ্ট দেখা দিল।
ফোনের ওপাশ থেকে অনবরত ‘হ্যালো’ শব্দ ভেসে আসছে।
স্বেতা এক পর্যায়ে না পেরে ফোনটা কেটে দিলো।
কাউচের ওপর ফোনটা ছুঁড়ে মেরে নিজে এক পাশে বসে পড়ল।
বুকে পাহাড়সম ব্যথা চেপে রেখে নিঃশব্দে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগলো।
বোবা কান্নার তালে তালে তার তনু-শরীরে মৃদু কম্পনের সৃষ্টি হচ্ছে।
সে অনবরত বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে উগরে আসা কান্নাটা গিলে নেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টায় বদ্ধপরিকর।
কিন্তু কেন জানি বুকের ভারে কান্নাটা বাধ মানতে চাচ্ছে না।
তাই হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে ফুপিয়ে উঠলো।
সাথে সাথেই কাঁধে কারো আলতো স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলো শ্বেতা।
দ্রুত চোখের পানি মুছে পেছন ফিরে তাকালো।
প্রিয়তা নিলিপ্ত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
স্বেতা ছোট বোনকে দেখে চোরের মত মুখ লুকানো, মিথ্যে হাসার চেষ্টা করে বললো,
“আরে ভাবী, তুমি এখানে? ভার্সিটি থেকে কখন এলে?”
প্রিয়তা স্বেতার প্রশ্নের জবাব দিলো না।
বরং ভনিতা ছাড়াই স্পষ্ট বাক্যে বললো,
“লিভিং রুমে বসে কাঁদছো কেন আপু? কেন সবার সামনে নিজের দুর্বলতার প্রেজেন্ট করছো?”
প্রিয়তার নির্লিপ্ত কণ্ঠের কথায় চমকায় স্বেতা।
কথা কাটাতে আমতা আমতা করে বললো,
“ক-ক…কি বলছিস! কাঁদবো কেন?”
প্রিয়তা তাচ্ছিল্য করে বললো,
“তুমি কাঁদছিলে কিনা, সেটা একটা দুই বছরের বাচ্চাও বলে দেবে।
তবে কাঁদছিলে, সেটা বড় কথা নয়।
সবার জীবনে গোপন কান্না থাকে।
কিন্তু প্রকাশ্যে কাঁদার অধিকার সবার থাকে না।
তাই কাঁদার প্রয়োজন হলে, ঘরের দরজা বন্ধ করে কাঁদবে, একান্তে কাঁদবে —
যেন ঘরের চার দেয়াল ব্যতীত অন্য কেউ না দেখে।”
স্বেতা আর মিথ্যে বলতে পারলো না।
অদম্য চেষ্টায় আটকে রাখা বেদনাঅশ্রুগুলো চোখ উপচে নিঃশব্দ ধারায় গাল বেয়ে নেমে এলো।
হাত মুঠো করে ধরে নিঃশব্দে ফুপিয়ে উঠলো মেয়েটা।
স্বেতার অবস্থাটা দেখে প্রিয়তার মন পুড়লো, তবে তা চেহারায় প্রকাশিত হলো না।
সে পুনরায় স্বেতার কাঁধে হাত রেখে বললো,
“ঘরে গিয়ে কাঁদো আপু।
এই ব্যথা তোমার একার।
তোমার এই বোবা কান্না দেখে সুক পালন করার কেউ নেই।
তোমার এই কান্না একান্তই তোমার।
সমাজের ভাষ্যমতে নিষিদ্ধ, কলুষিত।
এই ব্যথা কাউকে দেখালে, সে তোমার নির্দ্বিধার ‘কলঙ্কিনী’ উপাধিতে ভূষিত করবে।
একটা দেখবে না তুমি কীভাবে বেঁচে আছো —
সে সোজা বলে দেবে, তুমি দুশ্চরিত্র, তুমি অন্যের ঘর ভাঙতে চাও।
প্রয়োজনে মরে যেও আপু।
তবুও এসব গোপন কলঙ্ক কাউকে দেখিও না।
আত্মসম্মান খুইয়ে বেঁচে থাকার থেকে মরে যাওয়া অনেক সুখের।”
শ্বেতা আর বসে থাকতে পারলো না।
ফট করে প্রিয়তার কোমর জড়িয়ে ধরলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলল প্রিয়তা ভরসার হাত রাখলো স্বেতার পিঠে।
এসব মানুষদের কিছু বলে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা থাকে না।
স্বেতা প্রিয়তাকে জড়িয়ে ধরে মৃদু আর্তনাদ করে কেঁদে উঠলো।
হেচকি তুলে বললো,
“আমি বাকিটা জীবন কীভাবে বাঁচবো ভাবী?
কিভাবে ভুলবো সেসব কথা?
কিভাবে থাকবো তাকে ছাড়া?
আমি যে তাকে খুব ভালোবাসি!
আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ভাবী।
আমি, আমি পারছি না তাকে না দেখে থাকতে।
আমি পারছি না তার পাশে অন্য কাউকে মানতে।
আমাকে বাঁচার উপায় বলে দাও ভাবী…”
স্বেতার এমন কাতর কণ্ঠের স্পষ্ট স্বীকারোক্তিতে প্রিয়তারও চোখের কোণায় পানি চিকচিক করে উঠলো।
এই ব্যথা যে আসলেই প্রাণে সহে না!
আত্মহত্যা যদি মহাপাপ না হতো, তবে কবেই প্রিয়তা নিজের মুক্তির পথ খুঁজে নিত।
কে ফোন করেছিল?
পুরুষালী কণ্ঠে ভাবনার সুতোয় টান পড়লো।
দেবীর ঘাড় বাঁকিয়ে পিছন ফিরে তাকালো —
আবির্ভাব কাঁধে ভেজা তোয়ালে ঝুলিয়ে প্রশ্ন চোখে তাকিয়ে আছে।
দেবী দৃষ্টি নত করলো।
পুনরায় ফোনটা বিছানার ওপর রেখে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
“জানি না, একটা আননোন নাম্বার থেকে অনেকক্ষণ ধরে ফোন আসছিলো, তাই রিসিভ করেছিলাম।
কিন্তু কে বলতে পারব না।”
আবির্ভাব তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,
“কি বললো?”
দেবী পুনরায় স্বাভাবিক কণ্ঠে জবাব দিল,
“কিছুই বলেনি।
অনেকবার জিজ্ঞেস করেছিলাম কে, কোনো দরকার নাকি, কিছু বলবে নাকি —
কিন্তু একটা শব্দও ও বলেনি।”
দেবীর কথায় ভ্রু কুঁচকে ফেললো আবির্ভাব।
বিছানা থেকে ফোনটা তুলে কল লিস্ট ওপেন করতেই তার কলিজাটা মুচড় দিয়ে উঠলো।
চোখ-মুখ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল মূর্তির মতো।
দেবী ব্যাপারটা লক্ষ্য করে সন্দেহান্বিত কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“কে ফোন করেছিল আপনি জানেন?”
আবির্ভাব জবাব দিলো না।
ফোনটা পকেটে গুঁজে বেরিয়ে যেতে নিলে, আশ্চর্য হলো দেবী।
ঝট করে আবির্ভাবের বাহু আঁকড়ে ধরলো।
অবাক কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,
“কোথায় যাচ্ছেন?”
“বাইরে।”
এবার আরেকটু আশ্চর্য হলো দেবী।
“খাবেন না?”
“না।”
অভিমানে চোয়াল ঝুলে গেল দেবীর।
আবির্ভাবের হাতটা একটু শক্ত করে চেপে ধরে, অভিমানি কণ্ঠে বললো,
“আমি এত কষ্ট করে আপনার জন্য রান্না করেছি, আর আপনি না খেয়েই চলে যাচ্ছেন?
আপনি খাননি, বলে দুপুর থেকে আমি ও কিছু খাইনি।
চলুন না, খেয়ে নেবেন?”
আবির্ভাব একটু থেমে পেছন ফিরে তাকালো —
দেবী অসহায় মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
আবির্ভাব আর কিছু না বলে ডাইনিং রুমের দিকে চলে গেল।
ভীষণ খুশি হলো দেবী।
তবে একটা বিষয়ে নিয়ে তার মনে সন্দেহের বীজ বপন হলো।
এলএলবি ফাইনাল ইয়ার এর স্টুডেন্ট সে —
তার চোখ ফাঁকি দেওয়া অত সহজ নয়।
সে স্পষ্ট আবির্ভাবের চোখে মুখে অন্যরকম কিছু একটা দেখেছে,
যেটা সে প্রায়ই সময় দেখতে পায়।
কিন্তু কী?
এই পরিবারে কি এমন রহস্য তার কাছে চেপে গেছে?
তবে এত হিজিবিজি ভাবনায় আর সময় নষ্ট করলো না দেবী।
স্বামীর পেছন পেছন ডাইনিং রুমের দিকে গেল।
আবির্ভাবকে খাবার বেড়ে দিতে দিতে মিষ্টি কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,
“আজ সারাদিন কেমন কাটলো আপনার?”
আবির্ভাব এক চামচ খাবার মুখে নিল।
নিলিপ্ত কণ্ঠে ছোট করে জবাব দিল,
“ভালো।”
আবির্ভাবের যেন খাবারটা গলা দিয়ে নামছে না,
তবুও কষ্টে-শিষ্টে ঠেসে-ঠুসে খাবার গিলতে লাগলো।
অস্থিরতায় ভরে উঠছে তার মন-মস্তিষ্ক।
আজ দুই বছর পর…
আর ভাবতে পারলো না আবির্ভাব —
কারো চেনা হাতের স্পর্শ নিজের মাথায় অনুভব করলো।
সাথে সাথেই ভ্রু কুঁচকে ফেললো, ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো —
একজন পঞ্চাশোর্ধ, চশমা পরা ভদ্র মহিলা মমতা মাখা চোখে তাকিয়ে আছেন তার দিকে।
ছেলের শুকিয়ে যাওয়া চোখ মুখের অবস্থা দেখে ব্যথিত হলেন পূজারিণী রায় চৌধুরী।
আহত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন,
“তুই কি খাওয়া-দাওয়া করিস না, বাবা?”
মায়ের চেহারা দেখে আর কণ্ঠ শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো আবির্ভাব।
মুহূর্তেই চোখ মুখের শীতলতা ক্রোধাগ্নিতে পরিবর্তিত হয়ে গেল।
তীব্র রাগে খাবারের প্লেট ঠেলে উঠে যেতে নিলে, পুজারিণী রায় চৌধুরী আটকে দিলেন।
ব্যথিত কণ্ঠে বললেন,
“এখনো মায়ের ওপর রেগে আছিস, বাবা?”
ওনার কথায় মমতাময়ী সুর, আর আবির্ভাব ঘৃণিত দৃষ্টিতে তাকালো ওনার দিকে।
ছেলের চোখে নিজের প্রতি এত ঘৃণা দেখে থমকে রইলেন পূজারিণী রায় চৌধুরী।
তবে থামলো না আবির্ভাব।
সে এই মহিলাকে কিছুই বলতে চায় না, আর না কোনো সম্পর্ক রাখতে চায়।
সে এঁদের সকল ঋণ নিজের জীবন দিয়ে মিটিয়ে দিয়েছে, আর দিচ্ছে ও।
পূজারিণী রায় চৌধুরী নরম কণ্ঠে বললেন,
“তুই বাংলাদেশ যাস না কেন, বাবা?
মা-বাবার ওপর এত রাগ!
আমরা কি তোর খারাপ চেয়েছিলাম বল?
আমরা যা করেছিলাম…”
এবার আর ধৈর্য ধরতে পারলো না আবির্ভাব।
গর্জে উঠলো।
এক প্রকার ভয়ংকর রাগে তার শরীর থরথর করে কাঁপছে।
তবুও নিজের ঔদ্ধত্য প্রকাশ না করে বললো,
“দেখুন, মিসেস রায় চৌধুরী,
আপনার আর আপনার হাসবেন্ডের প্রতি আমার কোনো কৃতজ্ঞতা নেই।
কারণ আপনাদের সাথে আমার যা সম্পর্ক ছিল, যার ঋণ ছিল বা যে সকল দায়বদ্ধতা ছিল —
তা দু’বছর আগেই মিটে গেছে, সকল সম্পর্ক চুকে গেছে।
আমি আপনাদের সকল ঋণ শোধ করে দিয়েছি।
তাই আপনার বা আপনার ফ্যামিলির সাথে বর্তমানে আমার আর কোনো সম্পর্ক নেই।
আর আপনারা দয়া করে সম্পর্ক পাতাতে আসবেন না।
আপনারা আপনাদের মতন থাকুন, আমাকে আমার মতন থাকতে দিন।
আপনাদের ঋণ শোধ করতে যা যা বলেছেন, করেছি।
আপনাদের জাত-ধর্ম সব অক্ষুন্ন রেখেছি।
তাহলে এখন কেন কাটা গায়ে লবণের ছিটা দিতে এসেছেন?
আপনাদের বাড়ি থেকে আসার সময় বলিনি? —
আপনারা আর আমার কেউ না।
তাহলে আমার বাড়িতে কেন এসেছেন?”
আবির্ভাবকে এত রেগে চিৎকার করতে দেখে কেঁপে কেঁপে উঠছে দেবী।
তার বিগত দুই বছরের সংসার জীবনে, সে এই মানুষটাকে কখনো এত রাগতে দেখেনি।
সে একজন ধীর স্থির ঠান্ডার মেজাজের মানুষ, অতিরিক্ত ভায়োলেন্স পছন্দ করে না।
তাহলে সে কেনই বা তার নিজের পরিবারের সাথে এমন ব্যবহার করে?
কেন নিজের বাবা-মাকেই দেখতে পারে না?
ছেলের বলা তীক্ষ্ণ অপমানজনক কটু বাক্যে, পুজারিণী রায় চৌধুরীর চোখে পানি টলমল করে উঠলো।
আবির্ভাব ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
পুজারিণী রায় চৌধুরী ধপ করে বসে পড়লেন চেয়ারে।
তবে কি দুই বছর আগের ছেলের বলা শেষ কথাগুলো অভিমানের ছিল না?
সত্যি কি একমাত্র ছেলেকে সারাজীবনের জন্য হারিয়ে ফেললেন?
সত্যিই কি তাঁর ছেলে কাছে বাবা-মায়ের চেয়ে এক অন্য জাতের মেয়ে বেশি আপন?
সত্যিই কি একটা দুই দিনের মেয়ের ভালোবাসার কাছে বাবা-মায়ের ৩১ বছরের ভালোবাসা ঠুনকো?
বাবা-মায়ের থেকে ওই অন্য জাতের মেয়েটা বেশি আপন?
“উনি এমন কেন করেন মা?
আর উনি কিসের ঋণ শোধ করার কথা বলে গেলেন?
আপনারা আমার থেকে কি লুকাচ্ছেন, মা?”
পুজারিণী রায় চৌধুরী অশ্রুশিক্ত চোখে তাকালেন দেবীর দিকে।
দেবীর চোখে হাজারো প্রশ্ন।
ছেলের বউকে কি উত্তর দেবেন — জানা নেই উনার।
দেবী অধৈর্য হলো।
পুনরায় উৎকণ্ঠা নিয়ে বললো,
“কি হলো মা? বলুন,
ওনার আপনাদের সাথে কিসের এত দেনা-পাওনার সম্পর্ক?
আমায় বলুন মা।”
পুজারিণী রায় চৌধুরী কিছুই বলতে পারলেন না।
চুপচাপ উঠে চলে গেলেন।
ছেলে তাঁদের সাথে সম্পর্ক রাখুক আর না রাখুক,
ওই মেয়ের কাছে যেন আর কখনো না ফিরে —
এর জন্য যা করা দরকার, তিনি তাই করবেন।
ছেলের সংসার কিছুতেই নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না।
প্রয়োজনে ছেলের সকল শর্ত মেনে নিয়ে, ছেলে ও বৌমার জীবন থেকে অনেক দূরে চলে যাবেন।
তবে তিনি লক্ষীমন্ত দেবীর মতো যে বৌমা এনেছেন, তাকে কখনো গৃহছাড়া হতে দেবেন না।
শাশুড়িকে এভাবে চলে যেতে দেখে আশাহত হলো দেবী।
তার মনে হাজারো প্রশ্ন।
তবে এ সকল প্রশ্নের উত্তর কে দেবে?
কার কাছে তার সকল প্রশ্নের সৎ উত্তর?
কে দেবে?
কার কাছে গেলে মিলবে সকল প্রশ্নের সমাধান?
কী এমন চুক্তি আছে তার স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির মধ্যে?
তা যে করেই হোক, তাকে জানতেই হবে।
কানাডার টরন্টো শহরে সন্ধ্যা নামে স্বপ্নের মতো।
গোধূলি বেলার ঝিম ধরা আলো-আঁধারিতে নীলচে আকাশটা তখন রক্তিম কমলা আভায় ছেয়ে গেছে। লেক অন্টারিওর পাড় ঘেঁষে বইছে হালকা শীতল মৃদু বাতাস—কখনো কখনো তা ছুঁয়ে দিচ্ছে পথচলার ক্লান্ত পথচারীদের।
চারপাশের সময় যেন থমকে গেছে—ট্রাফিক লাইট, গাড়ির শব্দ, কর্মব্যস্ত মানুষের পায়ের আওয়াজ—সবকিছুতেই যেন এক অপূর্ব স্থিরতা।
সেই নিঃশব্দ ছন্দে পাশাপাশি তাল মিলিয়ে হাঁটছে দুই তরুণী। হাতে রয়েছে Reusable Grocery Bag, গল্পের মৃদু গুঞ্জনে ডুবে তারা পথ চলছে।
লেক অন্টারিওর ধমকা হাওয়ায় প্রিয়তার লম্বা খোলা চুলগুলো উড়ে যাচ্ছে থরে থরে। সূর্যের শেষ কমলা আলো তার নীল চোখ দুটিতে পড়ে হীরের মতো ঝিলিক দিয়ে উঠছে, কিন্তু এত সৌন্দর্যের মাঝেও তার চোখে নেই কোনো মুগ্ধতা, নেই কোনো বিষণ্ণতাও—শুধু একরাশ যান্ত্রিকতা।
শ্বেতা ও হাঁটছে তার একেবারে পাশে পাশে, ব্যাগগুলোতে টুকটাক জিনিসপত্রে নড়াচড়া উপলব্ধি করা যাচ্ছে।
সন্ধ্যার আবছা আলোয় রাস্তার পাশের ক্যাফেগুলোতে একে একে আলো জ্বলে উঠছে। ফুটপাথের ল্যাম্পপোস্টগুলোর হলুদ আলো চারপাশটাকে কুয়াশাভেজা রূপে মোড়ে দিচ্ছে—আলো-ছায়ায় শহরটা যেন কোনো স্বপ্ন নগরী।
হাঁটতে হাঁটতে প্রিয়তার পায়ের পাতায় হালকা টনটন করে উঠল। একটু থেমে গিয়ে সে তাকাল আকাশের দিকে—
মাথার ওপরের আকাশটা যেন জলরঙে আঁকা—গোলাপি, কমলা, বেগুনি রঙে এক স্বপ্নের ক্যানভাস।
লেকের জলে পড়া সূর্যরশ্মি এতটাই কোমল, এতটাই জাদুকরী, যেন মুহূর্তটা চিরকাল স্থির হয়ে থাকুক। তবে এতসব সৌন্দর্য, মাধুর্য ও প্রিয়তার কাছে বিষাদময়।
আর হাঁটতে না পেরে আচমকা লেকের পাড়ের বেঞ্চে বসে পড়ল প্রিয়তা। বুক ভরে নিষিদ্ধ বাতাসটা ফুসফুসে জেনে নিল। চোখ বন্ধ করে কারো শূন্যতা অনুভব করল। যদি সে পাশে থাকতো, তাহলে আজকের সন্ধ্যাটা ও হয়তো অন্যরকম হতে পারতো।
শ্বেতা পাশে না দেখেই একা একা বকবক করতে করতে এগিয়ে চলেছে। কিছুটা দূর আসতেই তার নিজেকে একা মনে হলো। দ্রুত পাশে তাকিয়ে দেখলো আশেপাশে কেউ নেই, একটু ভড়কে গেল শ্বেতা। ঝট করে পেছন ফিরে তাকালো—
তার বেশ অনেকটা দূরে, লেকের পাড়ের বেঞ্চে বসে আছে প্রিয়তা।
দৃষ্টিটা সন্ধ্যার রাতের কালচে নীল জলের ওপর অবদ্ধ। দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো শ্বেতা, আবার ঘুরে যেতে বিড়বিড় করে বললো—
—এই মেয়েটা দিনকে দিন এতো বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে কেন!
সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুনরায় প্রিয়তার কাছে ফিরে এলো। পাশ ঘেঁসে বসে প্রিয়তার দিকে তাকিয়েই বলল,
—না বলে হুটহাট হাওয়ার মতো উবে যাচ্ছিস কেন?
প্রিয়তা কালছে জলে দৃষ্টি রেখেই হালকা হাসলো, অতঃপর হেঁয়ালিপূর্ণ গলায় বলল—
——এখনকার যুগে এমন কেউ কি আছে, যে অন্যের কন্ট্রোলে থাকতে চায়? নিজের মতো বাঁচতে চায় না? নিজের স্বাধীনতা চায় না? নিজের আত্মনির্ভরশীলতা চায় না? কারো করুণাতে বাঁচতে চায়? যার নিজের কর্তৃত্ব পছন্দ নয়?
শ্বেতা একটু আশ্চর্য হলো, তীব্র বিরোধিতা জানিয়ে বললো,
—অবশ্যই না! পাগল ছাড়া এসব উদ্ভট ভাবনা কারো মাথাতেই আসবে না। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে কেউ কেন চাইবে অন্যের হাতের পুতুল হয়ে থাকতে? পরাধীনতার শিকলে বাঁধা পড়তে কে চায়? ফ্রিডম কে না ভালোবাসে?
—আমি চাই না।
হুট করেই বলে উঠলো প্রিয়তা।
তার কথায় কপালের মাঝখানে কয়েকটি গভীর ভাঁজ পড়ল শ্বেতার। সে অবিশ্বাসী চোখে তাকিয়ে বলল,
—তোর শরীর ঠিক আছে তো? তুই তো বলতিস তোকে আত্মনির্ভর হতে হবে!
শ্বেতার কথায় ম্লান হাসল প্রিয়তা। কণ্ঠে বিষাদের মিশিয়ে বলল,
—আমি যে জীবনটা বেঁচেছি, সেই জীবনের একটাও দিন যদি তুমি বাঁচতে, তাহলে তুমিও সেই পরাধীনতার শিকলের জন্য কাঙাল হয়ে উঠতে।
এই তথাকথিত সাফল্য, স্বাধীনতা, আত্মস্বত্ত্বা—সব তোমার কাছে দমবন্ধ করা ফাঁসির দড়ি মনে হতো। তুমিও চাইতে একটা শান্ত, নির্ভেজাল পরাধীন জীবন কাটাতে। পরনির্ভরশীলতায় বাঁচতে।
প্রিয়তার কথা-বার্তা শুনে শ্বেতা আবার কনফিউজড হলো। কড়া নজরে তাকিয়ে বললো—
—কিন্তু তুই কি… বাক্য সম্পন্ন করার আগেই…
হাতে থাকা মোবাইল ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠলো। এতে হালকা কেঁপে উঠলো শ্বেতা, কথার তাল কেটে গেল সে।
ফোন স্ক্রিনটা চোখের সামনে মেলে ধরতেই হাত-পায়ে রক্ত চলকে উঠলো, গলা শুকালো সহসাই।
প্রিয়তা সামনের দিকে তাকিয়েই হালকা হাসল, হিমেল কণ্ঠে বলল,
—নিষিদ্ধ সুখে গা ভাসানোর আগে ভেবে নিও, আপু…
তবে সে কথা শ্বেতার কান অব্দি পৌঁছাল কি না, বোঝা গেল না।
তবে তার চোখের মণিতে এক চিলতে খাঁটি সুখের দেখা মিললো—অতি প্রিয় কণ্ঠটা শোনার লোভ মনে জেকে বসলো।
সে কাঁপা হাতে ফোনটা রিসিভ করতে নিলেই স্ক্রিনের উজ্জ্বল আলোটুকু হঠাৎ করেই নিভে গেলো।
সাথে সাথেই মুখ কালো হয়ে এলো শ্বেতার, একটুকরো সুখের আলো হাত ছানি দিয়ে পুনরায় মিলিয়ে গেলো।
প্রিয়তা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শ্বেতার পাশ থেকে উঠে চলে গেলো।
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমে এসেছে ধরনীতে—প্রিয়তার জন্য আরেকটা একাকী বিষণ্ণ দিনের অবসান হলো।
সে হাত দুটো পিছনে গুটিয়ে ফুটপাথ দিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে বিষন্ন কণ্ঠে সুর তুলে গেয়ে উঠলো—
**“এ জীবন শেষ হয় না, তোমায় ছাড়া ভাল্লাগে না
সবকিছু আন্ধার লাগে, বেঁচে থাকা কী যাতনা…
আমারে পড়লে মনে তুমিও কাইন্দো গোপনে
সুখে থাইকো প্রাণের প্রিয়
আমার ভালোবাসা নিয়ো
আমি এক এমন পাখি বুকেতে কষ্ট রাখি
মুখেতে দেখাই হাসি যেন আমি সুখ নিবাসী
আমি এক এমন পাখি বুকেতে কষ্ট রাখি
মুখেতে দেখাই হাসি যেন আমি সুখ নিবাসী”**
শ্বেতা চাতকের মত অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলো, যদি আবির্ভাব আর একটি বার তাকে ফোন করে, যদি একটি বার তাকে নিজের কণ্ঠ শুনার সুযোগ করে দেয়।
তার যে তৃষ্ণা আরও বেড়ে গেছে, কিন্তু এমন কিছুই হলো না।
অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরে ও সেই কাঙ্ক্ষিত নম্বর থেকে আর কোনো ফোন বা মেসেজ এলো না। সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা পেরিয়ে গেল।
অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর শ্বেতার কেন জানি নিজের উপরেই প্রচণ্ড ঘৃণা হলো।
বাম হাতের পৃষ্ঠে বেয়ে আসা পানি টুকু মুছে নিল, ঠোঁট কামড়ে নিজের কান্না সংবরণ করার চেষ্টা করে বললো—
“ছিঃ শ্বেতা! এতটা নির্লজ্জ আর বেহায়া কবে হলি তুই! ছিঃ! তুই একটা বিবাহিত পুরুষের কাছে থেকে ভালোবাসার আশা রাখিস!
যে দস্তুর মতো অন্যের স্বামী… সুখের সংসার তার, সে কেন শুধুশুধু তোকে ফোন করতে যাবে?
তুই তো ওর অতীত, যাকে সে দুই বছর আগেই ছুঁড়ে ফেলেছে ধর্ম আর পরিবার-এর অজুহাতে।
তবে তুই কেন নিজের আত্মমর্যাদার কথা ভুলে যাস বারবার! প্রিয়তা ঠিকই বলেছে—নিষিদ্ধ সুখে গা ভাসালে…”
হঠাৎ প্রিয়তার কথা মনে পড়তেই চমকে উঠলো শ্বেতা।
তড়িত্ বেগে পাশে ফিরে তাকালো, কিন্তু আশেপাশে ফাঁকা।
লেক ও প্রায় শুনশান, জনমানবহীন।
শুধু তার পাশে তাদের গ্রোসারির ব্যাগগুলো পড়ে আছে।
সে দ্রুতো বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। ছুটে গিয়ে আশেপাশে খুঁজতে লাগলো।
কিন্তু কোথাও কেউ নেই!
সে খুঁজতে খুঁজতে অনেকটা দূর এগিয়ে গেল,
তবু কোথাও একটু মানুষের ছায়া পর্যন্ত দেখতে পেল না!
ফলে একটু ঘাবড়ে গেল শ্বেতার।
প্রিয়তা কখনোই তাকে একা ফেলে চলে যাওয়ার মেয়ে নয়।
তাহলে কোথায় চলে গেল মেয়েটা?
আর এখন যদি সে একা বাড়ি ফিরে যায়, আর প্রিয়তা আশেপাশে থাকে, তখন আরেক ফ্যাসাদে পড়তে হবে!
শ্বেতা কিছুক্ষণ চিন্তা-ভাবনা করে মনে পড়লো—
ফোন করে নিলেই তো মিটে যায়!
শ্বেতা নিজেই নিজের মাথায় ঠুকা মেরে বললো—
“দিনদিন তোর মস্তিষ্ক বিকৃত দেখা দিচ্ছে, শ্বেতা! তাই আজকাল সিম্পল ভাবনাগুলোও তোর মাথায় আসেনা!”
বলে ঝটপট প্রিয়তার নাম্বার ডায়াল করলো।
ফোনটা কানে ধরতেই ওপার থেকে মেয়েলি কণ্ঠে ভেসে এলো—
“The number you have dialed is currently unavailable. Please try again later.”
(আপনি যে নম্বরে ডায়াল করেছেন, তা বর্তমানে অনুপলব্ধ। দয়া করে পরে আবার চেষ্টা করুন।)
এই বিরক্তিকর বাণী টুকু শুনতেই মেজাজ খারাপ হলো শ্বেতার।
পুনরায় নাম্বার ডায়াল করে ফোন কানে ধরলো।
কিন্তু এবারও স্রেফ সেই একই কণ্ঠে বলে উঠলো—
“The number you have dialed is currently unavailable. Please try again later.”
(আপনি যে নম্বরে ডায়াল করেছেন, তা বর্তমানে অনুপলব্ধ। দয়া করে পরে আবার চেষ্টা করুন।)
এভাবে বেশ কয়েকবার ট্রাই করার পর ও আশানুরূপ কোনো জবাব পেল না শ্বেতা।
ফলে চরম বিরক্তিতে তার কপালে বেশ কয়েকটা ভাঁজের সৃষ্টি হলো।
এবার সে আরও কিছুক্ষণ ভেবে দ্রুত কল লাগালো মেহজাবিন চৌধুরীর নম্বরে।
কিন্তু এবারও সেই একই মেয়েলি কণ্ঠে বলে উঠলো—
“Your call has been forwarded to voicemail. Please leave a message after the tone.”
এবার শ্বেতার বিশাল মেজাজ খারাপ হলো।
কাজের সময় সবার যেন ঠাটা পড়ে!
সে বেশ বিরক্তি নিয়ে মেহজাবিন চৌধুরীকে ও বেশ কয়েকবার ফোন করলো,
কিন্তু মেহজাবিন চৌধুরী একবারও রেসপন্স করলেন না।
শ্বেতা এবার বাধ্য হয়ে বাড়ির একমাত্র মেইড মিসেস জেনিফারের নম্বরে ফোন করলো।
এবার এক রিং হতেই কল রিসিভ করলেন মিসেস জেনিফার।
শ্বেতা মিসেস জেনিফারের কথা শুনে উত্তেজিত কণ্ঠে বললো—
“Mrs. Jennifer, has Miss Priyota come back home?”
স্বেতার উত্তেজিত কণ্ঠে একটু অবাক হলেন মিসেস জেনিফার।
তবে তিনি বিশেষ না ভেবে নম্র কণ্ঠে প্রত্যুত্তর করলেন—
“No, ma’am. Miss Priyota hasn’t come back yet. She went out with you for groceries earlier… and she hasn’t returned since then.”
(না ম্যাম, প্রিয়তা ম্যাডাম এখনও ফেরেননি। তখন যে আপনাদের সঙ্গে গ্রোসারি আনতে গিয়েছিলেন… তারপর থেকে আর ফেরেননি।)
Whattt
Yes mam
স্বেতা আর কিছু না শুনেই ফোন কেটে দিল।
পাগলের মতো আশেপাশে এদিক-ওদিক খুঁজতে লাগলো প্রিয়তাকে।
এতক্ষণ ভয় না করলেও এখন স্বেতার কেন যেন ভয় ভয় লাগতে শুরু করেছে।
কানাডা অনেক সেফ একটা কান্ট্রি, তার পরও বিপদ-আপদ তো আর বলে আসে না!
প্রায় ঘণ্টা-দুই এক, পুরো জায়গাটা চিরুনি তল্লাশি চালানোর পরও প্রিয়তার নাম ও নিশান দেখতে পেল না স্বেতা।
ভয়ে যেন এবার তার হাড় হিম হয়ে আসছে।
সে আরও দুই পা এগিয়ে যেতেই স্ট্রীট লাইটের আবচা আলোতে ফুটপাথের উপর কিছু একটা চকচক করতে দেখলো।
ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৫৭
জিনিসটা ভালো করে দেখতেই চমকে উঠলো শ্বেতা।
ঝট করে সেটা মাটি থেকে তুললো।
হাতের তালুতে রেখে দেখলো—
এটা সেই পিংক ডায়মন্ডের রিংটা,
যেটা গত চার বছরে প্রিয়তা একবারের জন্যও নিজের আঙুল থেকে খুলে নি।