ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৬

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৬
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই

শিকদারদের বাগানবাড়ির বেসমেন্টের একটি গোপন কক্ষে খুবই গম্ভীর আলোচনা চলছে কয়েকজন ব্যক্তির মধ্যে। সবার মুখে ভাব গম্ভীর। তাদের মধ্যে থেকে শুদ্ধ এক ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
— “তাহলে সবাই দেখি রাজার হালেই আছেন!”
তাদের মধ্যে একজন বলল,
— “এখন তো সব ঠিকঠাকই আছে।”
তাই একটু আনন্দ ফুর্তি করছি।
মেয়ে টাকা কোন কিছুরই অভাব নেই তাহলে দুঃখে কেন থাকবো।
শুদ্ধ চিৎকার করে উঠল,
— “ঠিকঠাক? মাই ফুট! কিছুই ঠিক নেই! সারাদিন ঘরে মেয়ে নিয়ে দরজা বন্ধ করে থাকলে কি আর দেখা যায় ?”
অন্য একজন বলল,

— “কোনো তো সমস্যা নেই।!”যে ঝাল বিছিয়ে রেখেছিস সে জাল থেকে প্রণয় শিকদার এই জনমেও ছাড় পাবে না বলে কুটিল হাসি দিলো।
শুদ্ধ ভ্রু কুঁচকে বলল,
— “কতটা চেনো তুমি তাকে? আর কী বললে? কোন সমস্যা নেই ?”
সে ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠল। উপস্থিত সবাই ভ্রু কুঁচকালো। শুদ্ধ তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে তাদের মধ্যে একজনের দিকে ইশারা করে বলল,
— “তুমি খুব চালাক ভাবো নিজেকে ? প্রনয় সিকদার যে কি জিনিস তোমার তো বুঝা উচিত ছিল কিন্তু আফসোস এতদিনে বুঝতে ও পারলে না ছে !”
সে আবার ও দাত পিষে বলল তোমরা কি পারো ভালো মতো নজরটা ও ত রাখতে পারো না।
এমন ভাবে বেশিদিন চালাতে পারবে না তোমাদের রাজত্ব ।
সে আবার আগের জনের দিকে তাকিয়ে বলল কেমন চলছে দিন কাল নিজের দিকটা তো ভালই বুজে নিছো এতো গুলো গাধার মাজে তুমিই একমাত্র জাকে বরসা করা জায়
সে ও তাচ্ছিল্যের হেসে বলল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— “তুমি ও এমনি এমনি কিছু করোনি। তোমারও তো ততটাই স্বার্থ ছিল, যতটা আমার!”
সে আবারও হাসল।
শুদ্ধ ,
— ” আবারও হেসে বলল আমি ভালোই জানি, তোমরা একেকটা কাল সাপ! নিজেদের ভাগ ভালই বুঝে নিয়ছো
!
তোমাদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য যা কিছু করতে পারো
তোমাদের কে বিশ্বাস নেই তাই আমাকেও তো আমার ভাগ বুঝে নিতে হবে!”
অন্যজনের দিকে তাকিয়ে বলল,
— “আর কত অপেক্ষা করবো আমি?”
লোকটি বলল,

— “তুমি যা চাও, এখন সেটা দেওয়া সম্ভব নয়। না হলে আমাদের সবাইকে প্রানে মারা পড়তে হবে!”
শুদ্ধ চেয়ারে লাথি দিয়ে বলল,
— “এইসব আমি আর শুনবো না!”
আমার এখুনি চাই।
আরেকজন বলে উঠল,
— “শান্ত হও! প্রণয় পুরোপুরি জালে ফেঁসে আছে মানে এই নয় যে সে কিছুই করতে পারবে না!”
— ” আহত বাঘকে না খোঁচানোই ভালো, নাহলে বেগড়ে মারা পড়তে হবে! সে কতটা ভয়ংকর সেটা তো তোমার অজানা নয় আর তার প্রাণভোমরায় হাত দিলে সবাইকে বেঘরে মারা পড়তে হবে আরো ২-১ বছর অপেক্ষা করো, সব হবে।”
শুদ্ধের রাগে সারা শরীর জ্বলছে , রাগে কাঁপতে কাঁপতে সে বল আমার ভাগ যদি আমি না পাই তাহলে তোদেরকে আমিই মেরে ফেলবো।
পেছন ফিরে দু’জন চাকরকে উদ্দেশ্য করে বলল,

— “তোরা আরো ভালোভাবে নজর রাখবি! সাবধান! প্রণয় শিকদারের দুইটা চোখ আর দুইটা কান এক্সট্রা ধরা পড়ে যদি আমাদের নাম বলিস, তাহলে তোদের বংশে বাতি জ্বালানোর জন্য কাউকে রাখবো না Mind it !”
এই বলে বাঁকা হাসল শুদ্ধ। মনে মনে বলল,
— “প্রণয়, তোকে এত সহজে আমি মরতে দেব না! তোই ধুকে ধুকে মরবি, বেঁচে থাকবি মররার মতো! সব থেকেও তোর কিছুই থাকবে না !”
তোর জীবন থেকে সমস্ত সুখ আমি কেড়ে নিয়েছি খুব তাড়াতাড়ি বেঁচে থাকা শেষ সম্বল ও কেড়ে নেব আর তুই কিচ্ছু করতে পারবি না।
বিকেল চারটা। গরমের সবার অবস্থা খারাপ গ্রামবাসীদের খাওয়া-দাওয়া শেষ। আসরের আজানের মধুর ধ্বনি বেসে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বর আসবে। সব মেয়ে ও মহিলারা প্রীতার ঘরে ভিড় করে আছে। মেকআপ আর্টিস্ট প্রীতাকে সাজাচ্ছেন। বরের ইচ্ছে অনুযায়ী মেরুন রঙের বেনারসিতে মেয়েটিকে ভীষণ মোহনীয় লাগছে।
পরী!
টিটকারি মেরে বলল,

— “মেঝো আপু, আজকে তো দুলাভাই শেষ!”
তোমাকে দেখেই ফিদা হয়ে যাবে
চিত্রা দুষ্টু হেসে বলল,
— “আপু, তোমার রূপের আগুনে দুলাভাই নিশ্চিত কালো হয়ে যাবে!”
পূর্ণতা বলল,
— “আপু, একটা কথা… তুমি কিন্তু কাজটা মোটে ও ঠিক করোনি?”
পূর্ণতার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে সায়রা বলল,
— “সে আর বলতে! বোনু, আমার কত শখ ছিল! আমরা দু’জন এক বাড়িতে বউ হয়ে যাবো! কিন্তু ও কী করল?”
বলে নাক-মুখ কুঁচকালো।
স্বেতা বলল,

— “আহা! তোমরা আর অভিযোগ করো না! তো কী সুন্দর লাগছে তোমাকে, আপু!”
প্রীতা লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে।
প্রিয়তা বলল,
— “তুমি খুব খুশি, তাই না, আপু? নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে পেয়ে?”
প্রীতা ভাবল, সত্যি তো! সে শুধু খুশি নয়, বরং অনেক সুখী!
এরকম সুখ সবার কপালে থাকে না।
প্রীতা বলল,
— “হ্যাঁ, আমি খুব খুশি!”
প্রিয়তা খুশি হলো। সে নিজে ভঙ্গুর, কিন্তু অন্যদের পূর্ণতা দেখলে তার মন ভালো লাগায় চেয়ে জায়
প্রিয়তা আপুর ঘর থেকে বেরিয়ে বড়োছাদে গেল। আজকে আকাশে চাঁদ নেই। নিকষ কালো অন্ধকার। হয়তো অমাবস্যা।

ছাদের লাগানো লাইটের নিয়ন আলো ছাড়া অন্য কোনো আলো নেই।
প্রিয়তা সেই নিকষ কালো অন্ধকারের দিকে চোখ রেখে এক বছর আগের অতীতে ডুব দিলো…
১৪ বছরের কিশোরী কন্যা । বড়ই দুরন্ত!
বয়ঃসন্ধির কালে নারী-পুরুষের দেহ ও মনের পরিবর্তন বিশেষভাবে লক্ষণীয় । ছেলে-মেয়েরা জীবনকে অন্য দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে শুরু করে।
প্রেম, ভালোবাসা—সহ নতুন কিছু অনুভূতির সাথে পরিচয় হয়। আবেগের বয়স তাকে তাদের ।
প্রিয়তা ও তার ব্যতিক্রম ছিল না।
বুঝতে শেখার পর থেকে একজন মাত্র পুরুষের প্রতি সে কি ভীষণভাবে আসক্ত !
যখন সে ভালোবাসা শব্দটার অর্থও বুঝত না, তখন থেকেই… এই পুরুষটি তার মন মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরনে বাস করতো ।

ভালোবাসার অনুভূতির সাগরে জোয়ার প্রথম কবে এসেছিল, সেটা জানা নেই প্রিয়তার…
প্রিয়তা শুধু জানে, এই স্বল্পভাষী মানুষটার প্রতি সে ভীষণ দুর্বল। প্রিয়তা জন্মের পর থেকেই দেখে আসছে এই মানুষটাকে। মানুষটার কথা বলার ধরন থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি কাজই সুনিপুন ওই বাদামী বর্ণের চোখ জোড়া থাকে সব থেকে বেশি আকর্ষণ করত। তার ভালোবাসা অন্যদের মতো ছিলো না । সে রাগী , কিন্তু প্রিয়তার প্রতি ভীষণ দায়িত্ববান। ছোট থেকে এই মানুষটাই প্রিয়তাকে সবচেয়ে বেশি আদর যত্নে মানুষ করেছে।
জন্মের পর থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত তাকে কেউ যদি জিজ্ঞাসা করত সে কালকে সব থেকে বেশি ভালোবাসে তাহলে সে যে কোন বয়সেই চোখ বন্ধ করে বলে দিতো প্রনয় ভাইয়া।
শিকদার বাড়িতে ছেলেমেয়েদের সংখ্যা নিহাতি কম নয় , এত জনের মধ্যে কর্তা গিন্নিরা কাউকে আলাদা নজরে দেখতেন না তাদের কাছে সবাই সমান ।

মূলত শিকদারদের টাকা-পয়সা, আভিজাত্য মান-মর্যাদার কোনো কমতি ছিলো না। তাই এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, শিকদার বাড়ির প্রত্যেক ছেলে-মেয়েই সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছে। কখনো কিছু চেয়েছে আর পায়নি, এমন দিন আসেনি। তারা নিজেদের মতোই বড় হয়েছে, তাই আলাদা করে কাউকে নজর দেওয়ার প্রয়োজন হতো না।
প্রিয়তা ভীষণ অভিমানী প্রকৃতির মেয়ে তার ছোট থেকেই টাকা-পয়সা, অভিজাত্য, দামি জিনিসপত্র—এসবের প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। সে খুব সাধারণ জিনিসে খুশি হয়ে যেত তার কাছে এসবের থেকে ভালোবাসা আদর যত্ন আর আহ্লাদের দাম অনেক বেশি ছিল । তা প্রণয় ব্যথিত, অন্য কেউ বুঝত না। প্রণয় একমাত্র ব্যক্তি, যে প্রিয়তার চোখ দেখেই বুঝতে পারত, সে কী চায়। দৃষ্টি পড়ে নিতে তার দুই সেকেন্ড লাগত মাত্র।

এত ভাই-বোনের মধ্যে প্রিয়তা ভালোবাসার উষ্ণতা ওই মানুষটার বক্ষে খুঁজে পেত। সে আদর, শাসন, ভালোবাসা, যত্ন—কোনো কিছুর অভাব বোধ করেনি। প্রিয়তাকে, মানুষটা বকলে, ওর ভীষণ কষ্ট হতো। অভিমানে বুক ভার হয়ে যেত । কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবার যখন প্রনয় বুকে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে, আদুরে সরে দু-একটা বাক্য বলতো, সে বরফ গলা পানির মতো ঠাণ্ডা হয়ে যেত।
প্রনয়ের অতি আদরে গড়ে তোলা এক ছোট্ট পুতুল ছিল সে। এভাবেই সে বড় হতে লাগলো।
প্রিয়তা যখন দশ পেরিয়ে এগারোতে পা দিল, তখন থেকেই তার অনুভূতিগুলো পাল্টাতে লাগল। সে বুঝতে পারতো না ওর এমন লাগে কেন! এই অনুভূতির কোনো নাম সে দিতে পারতো না। প্রণয়ের আদর-যত্নে আর ভালোবাসায় আরও কয়েক বছর পার হয়ে গেলো !

তারপর সে ফাইনালি নিজের প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেলো
আবেগের বয়সে সে ভালোবেসে ফেলেছে। কী সাংঘাতিক! নিজের থেকে তেরো বছরের বড় চাচাতো ভাইয়ের প্রেমে খুব বাজেভাবে ফেঁসে গেছে সে, যদিও তার ভালোবাসাটা একতরফা ছিল। প্রণয় তাকে ভালোবাসে কিনা, এই বিষয়ে সে কিছুই জানে না। তার মনে হয়, তার মতো এমন দুধের শিশুকে প্রণয় কোনোদিনও ভালোবাসবে না।
কিন্তু সে তো বাসে! সত্যি ভীষণ ভালোবাসে! তাই চেষ্টা করবে প্রণয়কে নিজের করে রাখার। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, সে যথেষ্ট সুন্দরী। প্রণয় যদি তাকে এখন ভালো না-ও বাসে, একসময় ঠিক তার জন্য প্রণয়ের মনে জায়গা করে নেবে। তখন থেকে প্রিয়তা অনেক সেজেগুজে থাকত সবসময় প্রণয়কে পটানোর জন্য।
কিন্তু কয়েক মাস পর হঠাৎ করে আসা ঝড়ে প্রিয়তার জীবনটাই পাল্টে গেল । জীবনের হিসেব উলটপালট হয়ে গেল। ছোট্ট কিশোরীর মন ভেঙে গেল। আবেগের বয়সে পাওয়া ধাক্কাটা ভীষণ ভারী ছিল প্রিয়তার জন্য। কিছুদিনের মধ্যেই প্রিয়তার জীবন থেকে আদর ভালোবাসা শাসন বারণ যত্ন সব হারিয়ে গেল । ভালোবাসায় গড়া পুতুলটাকে অবহেলার খাদে ছুড়ে মারা হলো।

কখনো কষ্ট না পাওয়া প্রিয়তা হাবুডুবু খেতে লাগলো তার কষ্টের কারণ এটা নয় যে প্রণয় তাকে আগের মতন যত্ন করে না ভালোবাসে না বরং তার যন্ত্রণা তো এখানে হতো যখন সে প্রনয় কে অন্যের সাথে দেখতো
কি ভীষণ যন্ত্রণায় মেয়েটা রাতের পর রাত ছটফট করেছে কিশোরীদের মনে আবেগ বেশি থাকে আর প্রথম ভালোবাসা হারিয়ে যাওয়ার যন্ত্রনা সে সহ্য করতে পারত না কোনদিনও প্রণয় তাকে এক চোল পরিমাণ কষ্ট পেতে দিত না কিন্তু দিনশেষে সেই প্রিয়তা কে কষ্টের সব থেকে বড় সাগরে ছুড়ে মেরেছে
কতবার যে কত আপত্তিকর মুহূর্তে সাক্ষী হয়েছে প্রিয়তা তার কোন হিসাব নেই প্রথম প্রথম সেই সব মেনে নিতে পারত না কিন্তু সময়ের সাথে সাথে যন্ত্রণা গুলো বুকের ভিতরে গোপন রাখতে সে শেষ শিখে গেছে
তার এই গোপন যন্ত্রণার কথা সে কখনো কাউকে জানাতে চায় না। হুট করে প্রণয় পাল্টে যায় । সে আর প্রিয়তাকে হাসায় না, তার কথা মন দিয়ে শোনে না, চোখের দিকে তাকিয়ে মনের ইচ্ছেগুলো পূরণ করে না। প্রণয়ের চোখের দিকে তাকালে প্রিয়তা নিজেকে সামলাতে পারত না তাই এরপর থেকে প্রিয়তা আর কখনো তার চোখের দিকে তাকাতে চায় না !

প্রিয়তা যে প্রণয়কে ভোলার চেষ্টা করেনি, এমনটা নয়। প্রথম প্রথম ভীষণ চেষ্টা করত ভুলে যাওয়ার। কিন্তু এটা করলে তার আরও বেশি বেশি কষ্ট হতো। শেষমেশ সে উপলব্ধি করল—সে প্রণয়কে কখনোই ভুলে যেতে পারবে না ! কিছু মানুষ আছে, যাদের সারাদিন অন্তত একবার চোখের সামনে না দেখলে প্রাণটা ছটফট করে।
সে বুঝল, প্রণয় ওর প্রতিটা রক্তের কণায় কণায় বহমান। সে তাকে কোনোদিন ভুলতে পারবে না। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত ভুলতে পারবে না।
তবে তার মানে এই নয়, যে সে তাদের মাঝে আছে। সে তাদের মাঝে কোথাও নেই! নিজের মনের ভালোবাসা কিংবা যন্ত্রণা—পুরোটাই তার নিজের একার।
প্রিয়তা নিজের মনকে বুঝিয়ে নিয়েছে—ভালোবাসার মানুষ অন্যের হয়ে গেছে, এটা তার সমস্যা আমার নয়। “আমি না-হয় আজীবন দূর থেকেই ভালোবাসব। আমার প্রত্যাশার কিছুই নেই।”

এসব ভাবতে ভাবতেই প্রিয়তার ভিতর চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। গাল বেয়ে নেমে গেল কয়েক ফোঁটা নোনা পানির স্রোত।
পেছন থেকে কেউ একজন ডেকে উঠল—
“হে, বিউটিফুল লেডি!”
প্রিয়তা গাল মুছে পেছনে ফিরে চাইল। শুদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে।
শুদ্ধ বলল, “এমন অন্ধকারে ও তোমার রূপ ঝলক দিচ্ছে! এত সুন্দরী কেন তুমি? কেন বলো তো? এই রাতের আধারও তোমার রূপের কাছে হার মানতে বাধ্য হচ্ছে । তোমার মতো অনিন্দ্য সুন্দরী আমি আমার জীবনে আর একটাও দেখিনি!”

বলতে বলতে প্রিয়তার সামনে এসে দাঁড়াল।
প্রিয়তার অস্বস্তি হলো। এমন কথায় সে বলল, “ভাইয়া, আপনি এখানে?”
শুদ্ধ বলল, “হ্যাঁ, এত আলো আর ভালো লাগে না! আমি অন্ধকারের মানুষ, তাই অন্ধকার খুঁজতে আসলাম। কিন্তু এখানে ও তো আলো! যেমন তেমন আলো না, চোখ জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো! যে আলোয় বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না!”
প্রিয়তার অস্বস্তি বাড়ল। সে বলল, “আপুর বিয়ে হয়তো শুরু হয়ে গেছে, তাই নিচে যাচ্ছি। ভাইয়া, আপনি ও আসুন।”

শুদ্ধ বলল, “হ্যাঁ, যাও।”
প্রিয়তা চলে গেল।
শুদ্ধ বাঁকা হেসে বলল, “তোমাকে দেখলেই আমার মাথা নষ্ট হয়ে যায়, সুন্দরী! কী আছে তোমার মাঝে?”
পরিনীতা সকাল থেকে আবিদকে খুঁজছে, কিন্তু কোথাও পাচ্ছে না।
পরিনীতা মনে মনে ভাবলো, “কোথায় গেল মানুষটা?”
এদিক-ওদিক খুঁজতে খুঁজতে, হঠাৎ করেই সদাফ চলে এলো।
জিজ্ঞেস করলো, “কি ব্যাপার ফুলপরী, কিছু খুঁজছো?”
পরিনীতা হেসে বললো, “না ভাইয়া!”
সদাফ আবার বললো, “আমি আসার সময় সবার জন্য গিফট এনেছিলাম, তোমার জন্যও এনেছি। কিন্তু দেওয়ার সুযোগই হলো না!”
পরিনীতা হেসে বললো, “এসবের কি প্রয়োজন ছিল ভাইয়া?”
সদাফ চোখ ছোট ছোট করে বললো, “ফরমালিটিস করছো?”
পরিনীতা আবার হেসে বললো, “না না ভাইয়া! আচ্ছা দাও।”
সদাফ স্মিত হেসে পকেট থেকে একটা পেনডেন্টসহ চেইন বের করলো।
পরিনীতা অবাক হয়ে বললো, “এটা কি?”
সদাফ বললো, “গিফট!”

পরিনীতা বললো, “সরি ভাইয়া, আমি এটা নিতে পারবো না!”
সদাফ জিজ্ঞেস করলো, “কেন?”
পরী বললো, “এতো দামী গিফট!”
সদাফ পরীকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজেই বললো,
“শুনো পরী, তোমার কাছে এটা খুবই তুচ্ছ আর সামান্য!
তুমি যদি নিতে না চাও, তাহলে ফেলে দিও!”
বলে চেইনটা পরিনীতার হাতে দিয়ে চলে গেল।
পরিনীতা বুঝলো, লোকটা রাগ করেছে!
সে এখন ফ্যাসাদে পড়লো—কি করবে?
সবকিছু একপাশে রেখে, আবিদকে কল করতে লাগলো।
এবার পরিনীতা বিরক্ত হয়ে শিকদার বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আবার কল করলো।
এবার আবিদ রিসিভ করলো!

যে মিষ্টভাষী পরিনীতা কারো সাথে জোর গলায় কথা পর্যন্ত বলে না , সেই পরিনীতা ঝাড়ি দিয়ে বললো,
“কোথায় আপনি?
এখনই আমার সাথে পুকুর পাড়ে দেখা করবেন !
আমি অপেক্ষায় আছি!”
বলে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোনটা কেটে দিল!
সে রীতিমতো প্রচণ্ড রেগে আছে!
কি পেয়েছে এই লোক তাকে—
আজকে আসলেই সত্যি সত্যি এই পুকুরেই ফেলবে!

পৃথম পা টিপে টিপে বোনের ঘরে ঢুকলো, কারণ সে মাত্রই তার বোনকে বিয়ের আসরে দেখে এসেছে।
কিছুক্ষণ আগেই পৃথার বর সাদিক এসে গেছে!
সব মেয়ে মিলে প্রণয় কুঞ্জের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে পাত্রপক্ষের সাথে ঝগড়া লাগিয়ে দিয়েছে!
মূলত ইনায়া, চৈত্রা, সায়রা, পূর্ণতা, কুহুরা ঝগড়া করছে —
প্রিয়তা,পরিনিতা,আর প্রেরণা তাদের সব কথায়
“হ্যাঁ, হ্যাঁ” করে সায় দিচ্ছে!
কারণ সিকদার বাড়ির সকল মেয়েই মিষ্টবাসী —
তারা ঝগড়া-কেচাল করতে পারে না!
ইনায়া বললো,

— “বেয়াই সাহেব, ১ লাখ টাকা কম হলে ঢুকতে দেবো!”
সাদিকের চাচাতো ভাই সিহাব বললো,
— “এতো সুন্দর বিয়ান সাহেব এর জন্য শুধু ১ লাখ টাকা কেন?
গোটা জীবনটাই মঞ্জুর!”
সবাই হেসে উঠলো!
সিহাব আবার বললো,
— “বিয়ানসাব শুধু ১ লাখ টাকা নিয়ে চলে যাবেন?
একটু মিষ্টিমুখ করান!”
এইভাবে হাসি-তামাশা করতে গিয়ে, পুরো জুসের গ্লাসটা ইনায়ার ড্রেসে পড়ে গেল!
পৃথম বোনের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল!
ইনায়া রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে নিজের পছন্দের ড্রেসটা চেঞ্জ করে, অন্য একটা ড্রেস পরে নিল।
ঠোঁটে ম্যাচিং লিপস্টিক দিতেই—

পিছন থেকে দরজা বন্ধ করার শব্দে লাফিয়ে উঠলো!
পিছনে ফিরে পৃথমকে দেখে, তার কলিজাটা পানি আসলো!
ইনায়া বললো,
— “উফফ! পেয়ারেলাল!
আরেকটু হলে হার্ট অ্যাটাক করতাম!”
পৃথম ডেভিল হাসি দিয়ে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
— “রসগোল্লা!
এখন তুমি এমনি-তেও হার্ট অ্যাটাক করবে!”
ইনায়া কিছু একটা ভেবে চটফটিয়ে উঠে পালানোর চেষ্টা করলো!
কিন্তু দৌড় দেওয়ার আগেই পৃথম ধরে, এক টানে বুকের সাথে মিশিয়ে নিল!
বললো,

— “কোথায় পালাচ্ছো, রসগোল্লা?”
— “জানো না, আমার রসগোল্লাটা ফেভারিট?”
— “একটু তো টেস্ট করতেই হবে!”
খাওয়ার জন্য মনটা আকুলি-বিকুলি করছে!
লজ্জায় ইনায়ার গাল রক্তবর্ণ ধারণ করলো!
লজ্জামিশ্রিত স্বরে বললো,
— “আপনার মিষ্টি পছন্দ না!”
পৃথম বললো,
— “So what?
— গোলুমোলু রসগোল্লা আমার খুব পছন্দ!”
— “Trust me, এমন রসগোল্লা খেয়ে যদি ডায়াবেটিক হয়ে ওপরে চলে যাই,
— তবুও দুঃখ নেই!”
ইনায়া কিছু বলবে,

তার আগেই পৃথম ওর অধরে অধর মিলিয়ে দিল!
ইনায়ার চোখ গোল গোল হয়ে গেল!
সারা শরীর শিরশিরিয়ে উঠলো!
এমনিতেই এই মানুষটা স্পর্শ করলেই হৃদযন্ত্রটা অসহ্যভাবে কাঁপে!
৫ মিনিট পর…
ইনায়া চটফট করে উঠলো!
পৃথম বিরক্ত হলো!
কয়েক সেকেন্ডের জন্য ঠোঁট সরালো!
ইনায়া জুড়ে জুড়ে বিশ্বাস নিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার আগেই,
লাল হয়ে যাওয়া ঠোঁট দেখে, পৃথমের আবার নেশা ধরে গেল!
আবারও ওর অধর , নিজের আওতায় নিয়ে নিল!
পরিনীতা ২০ মিনিট অপেক্ষা করার পর…

অনুভব করলো কেউ এসে পাশে বসেছে!
মিষ্টোভাষী পরিণীতা কিছু কড়া কথা শুনানোর জন্য তৈরি ছিল, কিন্তু আবিদ-এর লাল মুখটা দেখে বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠলো। চশমার আড়ালে চোখ দুটি লাল, ঠোঁট শুকিয়ে গেছে, মাথার চুল এলোমেলো। শ্যামবর্ণের মুখে বিষণ্ণতার ছাপ স্পষ্ট। গায়ে একটা নরমাল টি-শার্ট আর ট্রাউজার। কেমন চোখ দুটো জল জল করছে!
পরিণীতা কপালে হাত দিয়ে চমকে উঠলো, জিজ্ঞেস করলো, “এতো জ্বর! আপনি কেমন করে এসেছেন, মাস্টার মশাই?”

আবিদ উত্তর না দিয়ে কিছুক্ষণ সামনে বসা রমণীর সুশ্রী মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। হঠাৎ করে পরিণীতার বুকে মাথা রেখে কোমর জড়িয়ে ধরলো।
পরিণীতা শিউরে উঠলো! কারণ শরীরটা এতটাই গরম যে সেই উষ্ণতায় পরিণীতার গা জ্বলে যাচ্ছিল। তার চেয়েও বেশি জ্বলছিল মন! নিজের প্রাণের পুরুষের এই অবস্থা দেখে পরিণীতার চোখে পানি টলমল করে উঠলো।
আবিদ বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করলো। আসলেই তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। এখন একটু স্বস্তি বোধ করল। আসার সময় মনে হচ্ছিল, এখুনি মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাবে। ভাঙা ভাঙা গলায় বললো, “অ্যাঞ্জেল…”
পরিণীতা কাঁপা গলায় বললো, “হুম…”

পরিণীতার গলায় মুখ গুঁজে দিয়ে আবিদ বললো, “এটার চেয়ে হাজার গুণ বেশি কষ্ট কখন পেয়েছি জানো তখন পেয়েছিলাম, যখন দেখলাম অন্য পুরুষ তোমাকে চোখে দেখছিল প্রিয় নামে ডাকছিল .. তোমার চুলে সযত্নে ফুল গেঁথে দিচ্ছিল … এর চেয়েও বেশি কষ্ট পেয়েছি তখন, যখন দেখলাম তুমি কিছু বলছ না, উল্টো খুশি হচ্ছ!”
আবিদের অতিরিক্ত ভারী গরম নিঃশ্বাস পরিণীতার গলায় আঁচড়ে পড়ছিল।
আবিদ আবার বললো, “তোমাকে যদি আমি অন্য কারো সাথে দেখি, তাহলে সত্যি বলছি প্রিয়তমা, আমি বাঁচতে পারবো না। আমার সহ্যই হবে না! তোমাকে অন্যের সাথে দেখার চেয়ে নিজেকে শেষ করে দেওয়াই ভালো।”
সে আরও জোরে জড়িয়ে ধরে জ্বরের ঘুরে বিড়বিড় করে বললো, “তুমি শুধু আমার! তোমাকে শুধু আমি ছোঁবো, আদর করবো, ভালোবাসবো! অন্য কেউ নয়! না হলে হয় তোমাকে শেষ করবো, না হলে আমি মরবো… মনে রেখো!”

এইসব বলেই চুপ হয়ে গেল।
পরিণীতা বুঝলো, আবিদ ঘুমিয়ে পড়েছে। আবিদ-এর মাথাটা নিজের বুকে আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরলো। মাথার চুলে চুমু দিয়ে বললো, “এত ভালোবাসো আমাকে? কই কখনো তো বলো না! হুঁশে থাকলে শুধু বকা আর ধমক দাও!”
পরিণীতার বুকটা ব্যথায় ভারী হয়ে আসলো। কারণ, আবিদ-এর জ্বরটা বাড়ছে। সে এখন কী করবে? এই অবস্থায় যদি কেউ দেখে ফেলে, সর্বনাশ হয়ে যাবে!
পরিণীতা একে একে ইনায়া, পূর্ণতা আর প্রিয়তাকে ফোন করে চুপি চুপি পুকুর পারে আসতে বলল।
কাক-পক্ষী পর্যন্ত যেন টের না পায়!
তারা তিনজন পুকুর ঘাটে এসে উক্ত দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে গেল!
পূর্ণতা ও প্রিয়তা মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো, তারপর একসাথে বললো, “মাস্টার মশাই তোর সাথে কেন?”
পরিণীতা উত্তেজিত হয়ে বললো, “পরে সব বলবো, আগে উনাকে বাড়ি নিয়ে যেতে হবে! উনি ঘুমিয়ে পড়েছেন!”
ওরা বললো, “আমরা কীভাবে নিয়ে যাবো?”

প্রিয়তা বললো, “পুরুষ মানুষের সাহায্য নিতে হবে!”
ইনায়া বললো, “শিকদারদের ভুলেও জানানো যাবে না, না হলে অনেক প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে!”
পরিণীতা বললো, “সিহাব ভাইয়া আর সামিম ভাইয়াকে চুপি চুপি ডেকে নিয়ে আয়!”
ইনায়া গেল ডাকতে।
পূর্ণতা ছুটে এসে বললো, “কি হয়েছে উনার?”
পরিণীতা বললো, “অনেক জ্বর!”
পূর্ণতা কপালে হাত দিতে নিতেই পরিণীতা চেঁচিয়ে বললো, “ছুঁবি না উনাকে!”
পূর্ণতা চোখ ছোট ছোট করলো।

এর মধ্যেই সিহাব আর সামিম এলো। এসব দেখে তারা অবাক হয়ে গেল!
প্রিয়তা মিষ্টি করে গুছিয়ে বললো, “ভাইয়া, উনাকে একটু বাড়ি পৌঁছে দিতে পারবেন?”
সিহাব গলে পানি পানি হয়ে বললো, “হ্যাঁ, নিশ্চয়ই!”
এটা বলেই তারা দুজন আবিদ-কে ধরে নিয়ে গেল।
একজন কাজের লোককে বলে দিল, আবিদ-এর বাড়ি চিনিয়ে দিতে।
ভীষণ অস্থির হয়ে আছে পরিণীতা!
এই পুরো ব্যাপারটাই দূর থেকে দেখলো শুদ্ধ !
বাঁকা হেসে মনে মনে বললো, “এই পুরো খানদানটাই মিথ্যেবাদী আর চিটিংবাজ! বড় বড় করে লেখা এই বংশে প্রেম করা বারণ! অথচ সবাই প্রেম করে! ভালোই হলো, খেলতে অনেক মজা হবে!”
এটা বলে আবার বাঁকা হেসে চলে গেল।
বাড়ির ছেলেরা বরযাত্রী আপ্যায়নে ব্যস্ত।

বরযাত্রীরা খেতে বসে পড়েছে, সবাই পরিবেশন করছে।
খাওয়া-দাওয়ার পার্ট শেষ হতেই কাজী সাহেব বিয়ে পড়ানোর জন্য তাড়া দিলেন।
সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
বর আর বউ-এর মাঝে পাতলা একটা সাদা কাপড়।
নিচে একটা কাসার বড় পাত্রে পানি রাখা, যেখানে বর আর বউ-এর প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে।
চিত্রা দুষ্টু হেসে সাদিক-কে জিজ্ঞেস করলো, “কি দেখতে পাচ্ছেন, দুলাভাই?”
সাদিক তৃপ্তির হাসি দিয়ে বললো, “আমার পরবর্তী ৬০ বছর!”
সবাই হেসে উঠলো।
সায়রা প্রীথা জিজ্ঞেস করলো, “তুই কী দেখতে পাচ্ছিস?”
প্রীথা বললো, “আমার জান্নাত!”

সবাই “আলহামদুলিল্লাহ” বললো।
কাজী সাহেব প্রথমে প্রীথাকে কবুল বলতে বললেন।
প্রীথা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো, খালিদ শিকদার-এর হাতটা জড়িয়ে ধরলো।
খালিদ শিকদার মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন, “তুই সারাজীবন আমার মেয়ে হয়েই থাকবি!”
প্রীথা তিনবার “কবুল” বলে দিলো।
সবাই আবার বললো, “আলহামদুলিল্লাহ!”
এরপর সাদিক-কে কবুল বলতে বললেন।
সে নির্দ্বিধায় কবুল বলে দিলো।
শিকদার বাড়ির কর্তা গিন্নির মনটা বিষণ্ণ।
যে সন্তানকে ছোট থেকে কোলে-পিঠে বড় করা হয়, সেই সন্তান যখন এক বাক্যের বিনিময়ে পর হয়ে যায়, তখন বাবা-মায়ের প্রাণে কি আর সয়?
বিয়ে শেষ।
কাল সকালে বিদায় হবে।

এক রাত এখানেই থাকতে হবে, এটাই শিকদার বাড়ির নিয়ম!
প্রীথার সব কাজিনরা বাসরঘর সাজানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
প্রণয় আজকে অনেক ক্লান্ত।
তার মন আর শরীর এত চাপ নিতে পারছে না।
উপায় থাকলে সে কবেই দূরে, অজানায় হারিয়ে যেত!
যেখানে থাকবে না কোনো যন্ত্রণা!
বা এমন কোনো ইরেজার যদি থাকতো, যা দিয়ে মনের ভিতরের সবকিছু মুছে ফেলা যেত!
প্রহেলিকা আশেপাশে কোথাও নেই!
প্রণয় ওয়ারড্রোব থেকে একটা পোলো টি-শার্ট আর ট্রাউজার নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো।
গায়ের কালো শার্টের বোতামে হাত দিতেই ফোনটা বেজে উঠলো।
তাই সে বাইরে এসে ফোন ধরলো।

ওপাশের কথা শুনে তার মুখের রক্ত উড়ে গেল!
মনে হলো কলিজাটা ধরে কেউ ছিঁড়ে নিয়ে গেছে!
প্রণয়ের হাত পা অসার হয়ে আসছে ভিতরটা অজানা ভয়ে আতঙ্কে জমে যাচ্ছে
প্রণয় উন্মাদের মতো বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল…
আজ তার আশেপাশের সবকিছুই যেন অদৃশ্য। ছেলেটা মুহূর্তেই পাগলের মতো বেরিয়ে গেল। সবাই প্রণয়কে এভাবে বেরিয়ে যেতে দেখে অবাক হলে।
কোন বিশেষ কাজে বেরিয়েছে ভেবে তেমন আমলে নিল না কেউ।
সুধু শুদ্ধ ব্রু কুচকে তাকিয়ে ছিল প্রণয় যাওয়ার পানে,,

প্রণয় পাগলের মতো গাড়ি নিয়ে ৪০ মিনিটের পথ ১০ মিনিটেই পারি দিল। দরদর করে ঘামের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। বুকের বা পাশটায় ছড়িয়ে পড়ছে অসহ্য যন্ত্রণা। হাই স্পিডে রায়পুরের শেষ সীমায় এসে পৌঁছালো, যেখান থেকে জঙ্গল শুরু। প্রণয় দ্রুত গিয়ে দেখলো দু’জন লোক প্রায় আধমরা অবস্থায় পড়ে আছে।
প্রণয় একটা কলার ঝাঁকিয়ে তুলে বললো, “আমার রক্তজবা কুথায় ?”
লোকগুলো কিছু বলার অবস্থায় নেই। প্রণয় বন্দুক বের করে একটার পায়ে শুট করলো। বাঘের মতো গর্জন দিয়ে কয়েকটা বিশ্রী গালি দিয়ে বললো, “বল, নাহলে এখানেই মেরে ফেলবো!”
লোকটা কাঁপতে কাঁপতে সামনে জঙ্গলের দিকে ইশারা করলো।

প্রণয় ওকে ফেলে ছুট লাগালো। প্রতিটা ধাপে মনে হচ্ছে তার আয়ু ফুরিয়ে আসছে, প্রাণটা এখনই বেরিয়ে যাবে । বুকটা অসহ্য যন্ত্রণায় ছেঁকে ধরলো। গভীর অরণ্যে কোথায় খুঁজবে সে তার রক্তজবাকে?
প্রণয় ওপরে তাকিয়ে চিৎকার দিয়ে বললো, “হে আল্লাহ! তুমি তো আমার কাছ থেকে সবই কেড়ে নিয়েছো, আমার মানসিক শান্তি বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য ভালোবাসা সব কিছু কেড়ে নিয়েছো ” কিন্তু আমার প্রান ভোমরার যদি কিছু হয় আমি আব্রার শিকদার প্রনয় সব কিছু জালিয়ে দেবো।।
কাউকে জীবিত রাখব না আমার মৃত্যুর আগের সবাই মরবে বলে জোরে আর্তনাদ করে উঠলো।
পুরুষরা নাকি কাঁদে না? বিশেষ করে আবরার শিকদার প্রণয় তো কাঁদতেই পারে না! তার জীবনে কত ঝড় বয়ে গেছে ! কিছু নিকৃষ্ট নরপিশাচদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে সে আর তার ভালোবাসা এদের জন্য তাকে হারাতে হয়েছে ভালোবাসা। সে কাউকেই ভয় পায় না তার কাছে ভালোবাসার একটাই অর্থ ছিল একটা ছোট্ট সুন্দর পুতুল তার জন্য সে গোটা পৃথিবীকে উলটপালট করে দিতে পারতো। ভীষণ ভালোবেসে যে তাকে ভালোবেসে যাকে বুকের পাঁজরে লুকিয়ে রাখতো।

যার গায়ে কোনদিন একটা ফুলের টোকাও লাগতে দেয়নি সে খানে তার প্রাণ পাখিটাকে তারই জন্য দিনের পর দিন কি ভিশন যন্ত্রনায় কাতরাতে দেখেছে।
তার প্রাণ পাখিটাকে কষ্ট পেতে দেখে তার ভিতরটা জ্বলে যেত কিন্তু তার হাত-পা বিষলতারা এমন ভাবে পেছিয়ে ধরেছিল যে তার কিছুই করার ছিল না তার রক্ত জবা কে কষ্ট পেতে দেখে তার থেকে হাজারগুন বেশি যন্ত্রণা নিজের বুকে অনুভব করতো।
ভীষণ ইচ্ছে করতো নিজের প্রাণটাকে বুকে আগলে নিয়ে আদর করে বলতে আমি তো তোমারই আছি।
কিন্তু সে সেটা করতে পারতো না।

অসহায়ত্ব তাকে এমনভাবে ঝেঁকে ধরে রেখেছে যে যার প্রতি ভালোবাসা নেই দিনের পর দিন তার সাথে ভালোবাসার অভিনয় করতে হচ্ছে। তার বুকের ভেতর হৃদয়ের সবটা জুড়ে একজনের বাস হয়া সত্বেও গভীর রাতে অন্য নারীর আছড়ে পড়ার দীর্ঘ নিঃশ্বাস যখন তার বুকে পড়তো , বুকের ভেতর কাঁটার মতো ফুঁড়ে উঠতো প্রতিক্ষণ। কিন্তু সেই বিষও সে প্রতিনিয়ত হজম করে নিচ্ছে। এটাই তার নিয়তি সে ও মেনে নিয়েছিলো।
নিকষ কালো অন্ধকারে দূরদূরান্ত পর্যন্ত কিছু দেখা যাচ্ছে না। বন্যপ্রাণীর ডাক সহ বড় বড় গাছের ছায়ায় পরিবেশটা ভুতুড়ে হয়ে উঠেছে প্রনয়ের চোখের কার্নিশ বেয়ে অঝোর দ্বারা গড়িয়ে পড়ছে নোনা জল ।

শরীর ও মনের যন্ত্রণায় দেহ অবশ হয়ে আসছে আরো কিছুটা এগিয়ে যেতে তার পায়ে কিছু একটা ফুটলো হাতে নিয়ে দেখলো হোয়াইট ক্রিস্টাল বসানো একটি বড় ঝুমকা।যেটা সে আজকে প্রিয়তার কানে দেখেছিল। প্রিয় তা কখন কি পরে কখন কি করে তার প্রত্যেকটা বিষয় প্রনয় এর মুখস্ত তাই এটা চিনতে ভুল হলো না
ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে নিচে তাকাতেই দেখলো মাটিতে কিছু টেনে নিয়ে যাওয়ার দাগ স্পষ্ট!
প্রণয়ের চোখেমুখে হিংস্রতা ফুটে উঠলো!
ঘড়ির কাটা রাত ১২টা বাজিয়ে দিলো।
প্রিয়তা গভীর জঙ্গলের মাঝখানে একটি পুরোনো বাড়িতে চেয়ারে হাত-পা বেঁধে, মুখে টেপ লাগিয়ে রেখেছে
নীলাভ চোখ দুটি উপচে পড়ছে নুনাজল!

একটা পুরো গেং থাকে কিডন্যাপ করে এখানে নিয়ে এসেছে
কয়েকটা ছেলে বিশ্রী মন্তব্য করছে।
প্রথম ছেলেটা বললো, “কি খাসা মাল দেখেছিস! নিজেকে কন্ট্রোল করা দায়!”
দ্বিতীয় ছেলেটা বললো, “এই মালটাকে এখনই খেয়ে দিতাম, কিন্তু ওকে এত তাড়াতাড়ি খাওয়া বারণ! আগে একটু পেটাতে হবে!”
এসব নোংরা কথাবার্তা শুনে প্রিয় তার গা ঘিনঘিন করে উঠলো। সে যে এখান থেকে তার ইজ্জত নিয়ে ফিরে যেতে পারবে না সেটা সে বুঝে গেছে। এরপর হয়তো তার মৃত্যু নিশ্চিত কিন্তু সে মৃত্যুকে ভয় পায় না। সম্মান হারানোর ভয়ে সে কুকড়ে আছে
প্রিয়তা চোখ বন্ধ করে প্রণয়ের সুদর্শন মুখটা মনে করলো।
তার বুকটা ভীষণ পোড়ছে!

মন বলছে, “তুই আর তাকে কোনোদিনও দেখতে পাবি না!” রে।
প্রথম ছেলেটা বেল্ট খুলে প্রিয়তার পিঠ বরাবর একটা বাড়ি দিলো! নীল চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো এক ফোঁটা তরল,,
তুলতুলে দেহটা মনে হলো চিরে গিয়ে, রক্ত বেরিয়ে এলো!
মুখ বন্ধ থাকায় মনে হলো সেই নীল চোখ দুটো চিৎকার করে উঠছে!
দ্বিতীয় ছেলেটা বললো, “এবার আমি!”
আরেকটা বাড়ি মারলো!
তৃতীয়বার আঘাত করার আগেই একটা গুলি এসে হাত ভেদ করে চলে গেলো !
ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোতে লাগলো!
সবাই একসাথে দরজার দিকে তাকালো!
প্রণয়ের চোখ অসম্ভব লাল!
মনে হচ্ছে রক্ত গড়িয়ে পড়বে এখনই!

মুখাবয়ব কঠিন, সুদর্শন চেহারাটা বিভৎস ভয়ংকর লাগছে!
বাদামি বর্ণের চোখ দুটোর দিকে দেখেই বুকের রক্ত জমে যাওয়ার উপক্রম হবে!
প্রিয়তা ক্লান্ত, নীলাভ চোখে দৃষ্টি দিয়ে সামনে তাকালো!
তার বিশ্বাস হচ্ছে না!
এই মানুষটা তার সামনে আছে!
মনে হচ্ছে এটা কোনো স্বপ্ন!
ছেলেগুলো প্রণয়ের দিকে এগিয়ে এলো।
প্রণয় এখনই ওদের মেরে ফেলতে চায় না!
এদের স্পেশাল ট্রিটমেন্ট সে নিজের হাতে দেবে তাই
একটার নাক বরাবর পাঁচটা ঘুষি মারলো!
নাক ভেঙে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে!

প্রণয় একের পর এক সব কটার হাতে-পায়ে শুট করে দিলো!
সামনে তাকাতেই তার হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে গেল!
ভেতরের প্রাণ পাখিটা ছলাত করে উঠলো।
তার প্রাণভোমরা প্রায় নিস্তেজ, নিভু নিভু!
অবিশ্বাসের চোখে সে তাকিয়ে রইলো!
সে দেখতে পলো
ওই নীলাভ চোখে হাজার অভিযোগ আর অভিমান!
সঠিক সময় না আসার জন্য!

প্রণয় এক পা, দুই পা করে প্রিয়তার সামনে গিয়ে বসলো! প্রিয়তার নীলাভ ও চোখে চোখ রেখে
ক্ষীণ স্বরে বললো, “রক্তজবা, এই জানপাখি! আমার দিকে চাও! এই দেখো, আমি চলে এসেছি!তোমার আর কোন ভয় নেই আমি এসে গেছি !”
বলে কাঁপা হাতে মুখ থেকে টেপটা খুলে দিলো!
হাত-পায়ের বাঁধন খুলতে খুলতে বলো আমি সরি জান আমি সরি আমি আসতে অনেক দেরি করে ফেলেছি আমাকে তুই জা শাস্তি দিবে আমি মাথা পেতে নেব। বলে প্রিয়তাকে নিজের প্রশস্ত বুকে ঝাপটে ধরল সারা মুখে চোখে উন্মাদের মতো অসংখ্য চুমু দিতে লাগলো এত জোরে বুকের সাথে চেপে ধরেছে যেন এক্ষুনি বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলবে।

প্রিয়তা চেয়ে আছে, অবাক চোখে!
মানুষটাকে এখানে তার অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে না !
আর না বিশ্বাস হচ্ছে মানুষটার বলা কথাগুলো।
প্রিয়তা নিজের দুর্বল শরীরটা নিয়ে প্রণয়ের বুকে আরেকটু সেটে গেল।
কিছু সময়ের মধ্যেই প্রিয়তা জ্ঞান হারালো!
প্রণয়ের বুকটা একটু শান্ত হলো!

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৫

মাথা ঘুরিয়ে হিংস্র দৃষ্টিতে ছেলেগুলোর দিকে তাকালো!
তাতেই যেন ওদের প্রাণ পাখি ফুরুত হয়ে যাওয়ার উপক্রম।
প্রণয় প্রিয়তার নিস্তেজ ছোট কোমল দেহটাকে কোলে তুলে নিল।

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৭