ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৬৩
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই
হেলথ কেয়ার হাসপাতাল। রুম নাম্বার ৫৫৫।
সাদা ধবধবে বিছানায় প্রায় অর্ধমৃত নিথর শরীরটা পড়ে আছে। হাতে ক্যানুলা, মুখে অক্সিজেন মাস্ক। হুঁশ নেই আজ প্রায় ৪ দিন। আল্লাহর দয়ায় শুধু নিশ্বাস পড়ছে কোনমতে। তার মাথার দুই পাশে, চোখ বন্ধ অবস্থায় কপালে হাত চেপে বসে আছে আবির্ভাব আর শুদ্ধ। দুজনের গায়েই হসপিটাল এপ্রন। দুজনের মুখ দেখেই মনে হচ্ছে তারা ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।
একটানা কয়েক ঘণ্টা যাবৎ বসে চিন্তা করার দরুন আবির্ভাবের ঘাড়, কোমর ব্যথায় টনটন করছে। আবির্ভাব শরীর টান টান করে বসতে নিলেই আচমকা লাফিয়ে উঠলো।
খুশিতে মৃদু চিৎকার দিয়ে বললো —
“ভাই, তুই বেঁচে গেছিস!”
আবির্ভাবকে হঠাৎ চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে উঠতে দেখে ধড়ফড়িয়ে উঠলো শুদ্ধ। ভয়ার্থ কণ্ঠে চেচিয়ে বললো —
“ক-কক্কি হয়েছে?”
বলে সামনে থাকতেই সেও থমকে গেলো। খুশিতে দুই বন্ধুর চোখ চিকচিক করে উঠলো।
প্রণয়ের হালকা হালকা সেন্স ফিরেছে। সে দুর্বল চোখে দৃষ্টি মেলে তাকালো দুই বন্ধুর দিকে। ওরা টলমল চোখে তাকিয়ে আছে। দুজনকে দেখে মনে হচ্ছে চারদিন পর তারা নিজেদের প্রাণ পুনরায় ফিরে পেয়েছে। প্রণয় নিজের অবস্থান বুঝতে পারলো না। পুনরায় চোখ বন্ধ করে সব মনে করার চেষ্টা করলো। তবে মনে করার থেকে বেশি বুকের ব্যথায় নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। প্রণয়ের ব্যথার তীব্রতায় চোখমুখ বিকৃত করলো। ঘটনার আগাগোড়া সব বুঝতে পেরে দুই বন্ধুকে অকথ্য ভাষায় কিছু গালি দিল। দুর্বল কণ্ঠে থেমে থেমে বললো —
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“কোন শালায় রে আমাকে এখানে নিয়ে আসছে! শুধু একবার নামটা জানতে পারি, গুলি করে তার ৭২ লাখের খুলি উড়িয়ে দেবো, আহ্!”
এখন মরবে না, একটু পরে মরবে। তার নাই ঠিক। এমন অবস্থায়ও মুখ দিয়ে চটাং চটাং কথা বেরচ্ছে।
তবে প্রণয়ের কথা শুনে ওরা দুজনেই রেগে গেলো। তারা কিনা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই শালাকে তুলে এনেছে, আর—
আবির্ভাব নিজের মেজাজ ঠিক রাখতে পারলো না। পাশে পড়ে থাকা লোহার স্টিকটা হাতে তুলে নিলো। শুদ্ধের উদ্দেশ্যে দাঁত কিড়মিড় করে বলল —
“এই, ধরতো ধর ওই শালারে! আর ওর ৭২ লাখ যদি খুলে না নিয়েছি তবে আমার নামও আবির্ভাব নয়!”
আবির্ভাব রাগে ফুসফুস করতে করতে ডান্ডার বাড়ি মারতে নিলেই তাকে পেছন থেকে ঝাঁপটে ধরলো শুদ্ধ। মৃদু চিৎকার দিয়ে বললো —
“শান্ত হো ভাই! ওই শালা অসুস্থ। এখন মারলে মরেই যাবে।”
আবির্ভাব রেগে আগুন হয়ে বলল —
“ওই, ছাড় ছাড় বলছি! আজ ওই শালার মরার শখ গুচিয়ে দেবো। ওই শালা নাকি মরতে চায়!”
বলে প্রণয়ের পায়ে সজরে একটা বাড়ি মেরে দিলো।
বুকের ব্যথা আর পায়ের ব্যথায় চোখ কুঁচকে নিলো প্রণয়।
শুদ্ধ আবির্ভাবের হাত থেকে লোহার স্টিকটা নিয়ে ফেলে দিলো।
আবির্ভাব আবার তেড়ে গিয়ে বললো —
“ওই শালা, মরে যেতে চাস! আয়, তোকে গলা টিপে মেরে দেই! শালা, সঠিক সময় যদি না যেতাম কী হতো তোর!”
প্রণয় ঠোঁট কামড়ে হাসলো। ব্যথা গিলে নিয়ে এক কথায় জবাব দিলো —
“মরে যেতাম।”
এবার আবির্ভাবের মাথায় আগুন ধরে গেলো। শুদ্ধ অবস্থা বেগতিক দেখে কথা কাটাতে বললো —
“তুই ওকে নিয়ে পড়ে আছিস! তোর বউ অনেকবার ফোন করছিলো, তখন যা কথা বলে আয়।”
বউয়ের কথা উঠতেই শান্ত হয়ে গেলো আবির্ভাব। সিরিয়াস মুখে ফোন হাতে নিয়ে দেখলো, সত্যি তাই।
আবির্ভাব একবার দুই বন্ধুর দিকে তাকিয়ে মেসেজে লিখে দিলো —
“আমার আসতে দেরি হবে। তুমি জেগে থেকো না, খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।”
মেসেজ সেন্ড করে ফোন রেখেই কেবিন থেকে চুপচাপ বেরিয়ে গেলো আবির্ভাব।
হঠাৎ এই ভোল বদলের কারণ বুঝলো না শুদ্ধ। তবে ভারি দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো প্রণয়।
বিকেল ৩ টা।
শিখদার বাড়ির বাচ্চা-বুড়ো সবাই দল বেঁধে শপিং মল তুলে আনতে গেছে। কারণ কালকেই ঈদুল ফিতর। তাই আজকেই পুরো শপিং মল ঝেড়ে মুছে সাফ করে দেবে শিকদার বাড়ির শাহজাদ-শাহজাদীরা। তাই বাসায় বর্তমানে কেউ নেই বললেই চলে।
কেবল থেকে গেছে প্রিয়তা, ইনায়া আর এক জোড়া কপোত-কপোতী। সবাই শপিং এ যাবে শুনে অনেক খুশি হয়েছিলো ইনায়া। যাওয়ার বায়নাও ধরেছিলো। কিন্তু বরের চোখ রাঙানোতে আর যেতে পারেনি। প্রিয়তাকে অনেক তৈলমর্দন করার পরও প্রিয়তা যেতে রাজি হয়নি।
আর ৪ দিনের মধ্যে প্রেমের একটা বিরাট আর্ট এক্সিবিশন আছে। তাই প্রেমও যায়নি। অনুশ্রী বেগম যখন ঊষাকে বলেছিলেন —
“ছোট বউ, রেডি হয়ে নাও, শপিং এ যাবো।”
তখন প্রেম ভরা আসরে দাঁড়িয়ে কাটকাট জানিয়ে দেয় —
“না আম্মু, তোমরা যাও। আমার বউ আমার সাথেই থাকবে।”
বলে চুপচাপ বউয়ের হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গিয়েছিলো। ভরা সম্মুখে ছেলের এহেন কথায় লজ্জায় পড়েছিলেন চার কর্তাও চার গিন্নি। তাদের বাড়ির সব ছেলেই পরিবর্তন হয়ে গেছে, বিশেষ করে ছোট ছেলে। যে ছেলেটা একসময় স্বল্পভাষী, গম্ভীর মেজাজের ছিলো, সেই ছেলেটাই এখন ঠোঁটকাটা কথা বলে।
তবে এসব দেখে মোটেও মনঃক্ষুণ্ণ হন না অনুশ্রী বেগম। তিনি মনে মনে বড় শান্তি পান। কারণ তিনি তো এটাই চেয়েছিলেন। নামাজের শেষের সকল মোনাজাতে শুধু একটাই প্রার্থনা করতেন —
“উনার সব ছেলে-মেয়ে যেন জীবনে উপযুক্ত জীবনসঙ্গী পায়, তারা যেন সুখে থাকে, খুশিতে থাকে।”
বাড়ি ফাঁকা থাকায় নিরিবিলি, নীরব পরিবেশ।
চৈত্র বিকেলের মিঠে রোদ এসে গায়ে লাগছে।
সোনালি রোদের আভায় চকমকিয়ে উঠছে গোলাপি গালের ফর্সা চামড়া। অদূরে ইচ্ছেমতী নদীর প্রবাহিত মাতলা বাতাসে উড়ে যাচ্ছে লাল রঙা শাড়ির আঁচল। তবে সে সবের ধ্যানে নেই ঊষার। সে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে দূরের শস্যশ্যামল ধান জমির দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে।
তবে আচমকাই নিজের খেয়ালে হারানো ঊষার শরীরে খেলে গেলো এক চেনা সুখের শিহরণ।
খয়েরি ঠোঁটে ছলকে উঠলো একটুকরো দীপ্তিময় হাসি।
হালকা হালকা গরমের মধ্যে, ঘামে ভেজা শীতল কোমরে উষ্ণ হাতের স্পর্শ পেয়ে শিউরে উঠলো নারী শরীর।
কানের কাছে বাতাসের মৃদু গুঞ্জনের সাথে শোনা গেলো প্রিয় সেই কণ্ঠ—
“পড়ন্ত বিকেলে বর কে ফেলে একা একা চা খাওয়া অন্যায়, এটা কি জানেন না মিসেস স্বপ্নসুন্দরী?”
উচ্চারিত শব্দ তরঙ্গের সঙ্গে তপ্ত নিশ্বাসের গরম ভাব এসে আছড়ে পড়ল ঊষার কানের লতিতে।
পুরুষালি বলিষ্ঠ দুই হাতের বন্ধনে আদরে জড়িয়ে গেলো তার তনু শরীর।
প্রেম পা টিপে টিপে এসে পেছন থেকে জড়িয়ে নিয়েছে তার বউকে, ঊষার পিঠ ঠেকেছে প্রেমের বুকে।
প্রেম পুনরায় বলল—
“এক কাপ চায়ের সাথে আমাকেও খেতে পারো বউ।”
ঊষা চায়ের কাপটা রেলিং-এ রেখে প্রেমের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো।
দুই হাতে স্বামীর গলা জড়িয়ে ধরে সন্দিহান কণ্ঠে বললো—
“আপনি তো এমন নষ্ট পুরুষ ছিলেন না, তবে দিন দিন আপনাকে এত নষ্টামি শিখাচ্ছে কে?”
বউ-এর কথায় ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো প্রেম।
ঊষার কোমর চেপে ধরে আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ালো।
শাড়ির আঁচল সরিয়ে ফর্সা পেটে স্লাইড করতে করতে অধীর কণ্ঠে বললো—
“ঘরে এমন রসমালাই এর মতো বউ থাকতেও যে পুরুষের চরিত্র ফুলের মত পবিত্র, সেসব পুরুষদের আমি ঘেন্না করি।
তারা মূলত জটিল গোপন সমস্যায় আক্রান্ত বউ।”
প্রেমের উষ্ণতা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে ঊষার শরীরে।
ঊষা প্রেমের খোঁচা খোঁচা দাড়ি যুক্ত গালে হাত রাখলো।
প্রেমের জ-লাইন অনেক শার্প এন্ড অ্যাট্রাক্টিভ।
ঊষা চাপা কৌতূহল দেখিয়ে বললো—
“গোপন সমস্যাটা আবার কী?”
ঊষার কথায় ঠোঁট কামড়ে হাসলো প্রেম।
ঊষাকে রেলিং-এর সাথে ঠেসে দাঁড় করালো।
ঘাড়ের উপর থেকে চুল সরিয়ে সেখানে শব্দ করে চুমু খেলো।
পুনরায় সেখানে নিজের খোঁচা খোঁচা দাড়ি ঘষে দিয়ে বললো—
“তোর স্বামীরও যদি গোপন সমস্যা থাকতো তবে বুঝতে পারতেন— স্বপ্নসুন্দরী, কতো ধানে কতো চাল।”
খোঁচা খোঁচা দাড়িতে ব্যথা পাচ্ছে ঊষা, তবু ও ভালো লাগছে।
কিন্তু প্রেম এটা কী বললো!
ঊষা পুনরায় কৌতূহল নিয়ে সূধালো—
“সমস্যা গোপন রাখলেই তো সমস্যা বাড়বে, সবাইকে বললেই তো সমস্যার সমাধান হবে! আর আমার বরের গোপন সমস্যা ওপেন সমস্যা, কোনো সমস্যাই নেই বুঝলেন।”
বউ-এর কনফিডেন্স দেখে প্রেমের নিজের পুরুষত্বের ওপর বিরাট গর্ব হলো।
সে ঊষার চোখে চোখ রেখে সূধালো—
“তুমি জানো গোপন সমস্যা কী?”
ঊষা দুই পাশে পাশে না সূচক মাথা ঝাকালো।
প্রেম পুনরায় ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে বললো—
“যাদের গোপন সমস্যা আছে, তারা বড়ই অভাগারে বউ তারা চাইলেও আমার মত বউকে কান্না করাতে পারেনা।”
ঊষা সহসা ভ্রু কুঁচকালো—
“কেন?”
প্রেম উত্তর না দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলো। মাথায় তার শয়তানি বুদ্ধিতে কিল বিল করছে।
বউ তার কাল রাতে ভালোবাসতে না দিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলো— তার সুদ সে এখন তুলবে।
তাই অসংলগ্ন হাতের ছোঁয়ায় ঊষাকে একটু একটু করে পাগল করে দিতে লাগলো।
ঊষার কথার প্রতিউত্তর না করে তাকে ঘুরিয়ে দিলো।
পিঠ থেকে চুল সরিয়ে ফর্সা পিঠে টুকরো টুকরো চুমু আঁকতে লাগলো।
অবেলায় আদর পেয়ে ঊষার পেটের ভেতর প্রজাপতি উড়ছে, সুখের শিহরণ ছড়াচ্ছে রগে রগে।
প্রশ্ন-উত্তরের জটিলতা ভুলে গেছে সে সেই কবে।
একসময় ঊষার বেকুল কণ্ঠে শোনা গেলো—
“ঘরে চলো প্রেম।”
বউয়ের শ্বাস-প্রশ্বাসের ঘনত্ব আর দৃষ্টির আকুলতা দেখে বিশ্বজয়ের হাসি দিলো প্রেম।
বউয়ের চুল আঁকড়ে অস্থির অন্তিম চুমু খেয়ে বললো—
“বাই বাই বউ, রাতে দেখা হবে।”
বলে ঊষাকে ছেড়ে দিলো প্রেম। উল্টো ঘুরে চলে যেতে নিলেই, পেছন থেকে হাত টেনে ধরলো ঊষা।
লজ্জা মিশ্রিত অসহায় কণ্ঠে বললো—
“প্লিজ যেও না, I want to you…”
প্রেম পেছন ফিরলো। বউয়ের কাতর চোখদুটো দেখে প্রেমের বুকের ভেতর ধক ধক করে উঠলো।
সে আবার বউয়ের আবদার ফেলতে পারেনা।
প্রেম মনে মনে নিজের প্রতিশোধ স্পৃহাকে গালি দিয়ে বললো—
“চুলোয় যাক বালের প্রতিশোধ।”
প্রেম চিন্তা ভাবনা ছুঁড়ে ফেলে এক ছুটে এসে ঊষার কম্পিত ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো।
হার্ড কিস করতে করতে বললো—
“আর কখনো তেড়ামি করবে আমার সাথে?”
ঊষা তড়িত বেগে দুই পাশে মাথা নাড়ালো।
ঠোঁটের ভাঁজ থেকে ঠোঁট সরিয়ে অস্থির হাতে প্রেমের শার্টের বোতাম একটা একটা করে খুলতে খুলতে বললো—
“স্বামীর যা বলবে তাই আদেশ।”
প্রেম বাঁকা হেসে বললো—
“মনে থাকবে?”
ঊষা আবার উপর-নীচ মাথা ঝাকালো।
প্রেম ওর গাল টেনে দিয়ে বললো—
“Good girl।”
ঊষা শার্ট ছেড়ে প্যান্টে হাত দিতে নিলেই চোখ বড় বড় করে ফেললো প্রেম।
ঊষার হাত টেনে আটকে দিয়ে বললো—
“কন্ট্রোল বউ! কি করছো? নিজের স্বামীর ইজ্জত কি সারা দুনিয়াকে দেখাতে চাও?”
ঊষা অসহায় চোখে তাকালো।
প্রেম বাঁকা হেসে ওকে কোল তুলে নিলো।
ছাদ থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে বললো—
“নিজে থেকে আমার কাছে ধরা দিছ স্বপ্ন সুন্দরী, আজ কেঁদে ভাসিয়ে দিলেও কোন ছাড়াছাড়ি হবে না।”
ঊষা এসব শুনলো না। প্রেম ওর মাথা পুরো নষ্ট করে দিয়েছে।
প্রিয়তা গুসল সেরে টাওয়েল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো।
তার অতিরিক্ত লম্বা চুলের বেয়ে পড়া পানিতে টাইলসের মেঝে ভিজে শপ শপে হয়ে যাচ্ছে।
চুলের পানিতে মেঝে ভিজে যাচ্ছে দেখে বিরক্তিতে প্রিয়তার চোখ-মুখ বিকৃত হলো।
সে দ্রুত টাওয়েলটা ছুঁড়ে ফেলে হেয়ার-ড্রায়ার চালাতে লাগলো।
প্রিয়তার ৪ বছর আগের হাঁটু ছোঁয়া চুলগুলো এখন হাঁটু থেকে আরও এক আঙুল মতো নিচে নেমে গেছে।
আরও কিছুটা নামলেই হয়তো পায়ের গোড়ালিতে পৌঁছে যাবে।
প্রিয়তা ৪ বছর আগেই চেয়েছিলো এই হাঁটু ছোঁয়া চুল কেটে কাঁধ অবধি করে ফেলতে।
এতো বড় চুল তার কোন কালেই লাগে না।
কিন্তু এই চুলে কাঁচি চালাতে গেলে প্রিয়তার মনে হয় কাঁচিটা চুলে নয়, তার কলিজায় চালানো হচ্ছে।
প্রিয়তা বোঝে না, মায়াটা আসলে কার জন্য— চুলের জন্য, নাকি এই চুলের প্রতি আসক্ত মানুষটার জন্য কিন্তু কি লাভ।
তবে যাই হোক, এতো বড় চুল ভালো লাগে না।
এটা অন্তত আগের মতো করতেই হবে।
প্রিয়তা ভাবতে ভাবতে চুল শুকিয়ে ফেললো।
তার মধ্যেই বাহির থেকে শব্দ এলো—
“প্রিয়, আসবো।”
দরজার ওপাশে দাঁড়ানো ব্যক্তি অনুমতি চাইছে।
তাও আবার তার কাছে!
এটা ভেবেই প্রিয়তার ভ্রু কুঁচকে গেলো।
সে হেয়ার ড্রায়ার ড্রেসিং টেবিলের ওপর রেখে দরজার দিকে ফিরলো।
দরকার কাছে ইনায়া, অভিরাজের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
প্রিয়তা পুনরায় আয়নার দিকে ফিরে ব্যঙ্গ করে বললো—
“বাহ বাহ! তুই এতো ভালো হলি কবে? আবার অনুমতি ও চাইছিস? ৪ বছরে দেখি এই বাড়ির মানুষ তাদের রং পুরোই পাল্টে ফেলেছে।”
প্রিয়তার সূচালো কথার গভীরতা বেশ বুঝলো ইনায়া।
তবুও মনে দুঃখ পাওয়ার ভুল করলো না।
কারণ ওর সাথে এই বাড়ির মানুষ যা করেছে, ইনায়া হলে তো কখনোই এদের মুখদর্শন করতো না।
ইনায়া আস্তে আস্তে হেঁটে এসে প্রিয়তার বিছানায় বসে পড়লো।
এটুকু হাঁটাতেই হাঁফ ধরে গেছে মেয়েটার।
একটু জিরিয়ে নিয়ে বললো—
“অনুমতি নিতে হয়, কারণ বলা যায় না— তুই যদি বিরক্ত হোস। After all, তুই বিলেত ফেরত। এখন তো আমায় বন্ধু বলতে তোর ইজ্জতে বাধবে, এটাই স্বাভাবিক।”
ইনায়ার খোঁচা মারা কথায় প্রিয়তার ঠোঁট ঠেলে তাচ্ছিল্য বেরিয়ে এলো।
বিদ্রুপ করে বললো—
“আমি তোর জামাই আর শ্বশুরবাড়ির মতো জাতে গিরগিটি নই, যে খনে খনে নিজের রং পাল্টাবো।”
” আমার স্বামীকে খুব ঘৃণা করিস বুঝি? সে কিন্তু তোর আপন ভাই।”
“আপন ভাই?” কথাটা আওড়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো প্রিয়তা।
এভাবে সাধারণত সে কখনোই হাসে না।
প্রিয়তার এই হাসির গভীরে হাজারো দুঃখ-কষ্ট আর যন্ত্রণার মিশেলে পাহাড় সম ও অভিযোগ দেখতে পেলো ইনায়া।
ফলে বুকের কোথাও একটা চিন চিনে ব্যথা অনুভব করলো।
প্রিয়তা হাসতে হাসতে বসে পড়লো ইনায়ার পাশে।
কয়েক সেকেন্ড পর হাসি থামিয়ে লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে, কণ্ঠে চাপা ক্রোধ মিশিয়ে বললো—
“তোর জামাই আমার আপন ভাই! সিরিয়াসলি তোর লজ্জা করলো না কথাটা বলতে? আমার এই পৃথিবীতে আপন সজন কেউ নেই। তারা তাদের স্বার্থে বাঁচে, আমি আমার স্বার্থে বাঁচি।”
কথাগুলো বলতে বলতে প্রিয়তার চোখ চিক চিক করে উঠলো।
ইনায়া আর কিছু বলার মতো খুঁজে পেলো না নিজের শব্দ ভাণ্ডারে।
এই বাড়ির মানুষ যে এত অদ্ভুত আর রহস্যময়, তা এই বাড়িতে বিয়ে না হলে কখনোই জানতে পারতো না ইনায়া।
এমনকি এই বাড়ির মানুষদের বাহির থেকে যেমন মনে হয় ভেতর থেকে তারা মোটেও তেমন নয়।
প্রিয়তা কিছুক্ষণ থেমে একটু ভেবে বললো—
“এখানে আছি তো প্রায় ১৫ দিন হতে চললো, কিন্তু এই বাড়িতে মানুষ এত কম কেন?”
প্রিয়তার প্রশ্ন আসলে এটা নয়, কিন্তু কী প্রশ্ন করেছে তা ঠিক বুঝে নিয়েছে ইনায়া, তাই সে ও তাচ্ছিল্য করে বললো—
“খুব সুন্দর মতো সব দোষ চাপালি আমার জামাইয়ের ঘাড়ে। নিজেকে প্রশ্ন কর, আসলেই কি সব দোষ আমার জামাইয়ের? তোর সাথে যা হয়েছে তার জন্য আসল দোষী যে তাকে তো তুই কখনোই ঘৃণা করিস না, দিব্বি ভালোবাসিস, আবার জানতে ও চাচ্ছিস সে কোথায়।”
ইনায়ার প্রশ্নে জবাব দিলো না প্রিয়তা।
ইনায়া পুনরায় বললো—
“এতো দ্বিচারিতা করিস না প্রিয়। তোর খারাপ কেউ চায়নি। হ্যা, যা হয়েছে, তোর ইচ্ছার বিরুদ্ধে হয়েছে। কিন্তু এই সবের জন্য আসল অপরাধী কে সেটা তুই খুব ভালো মতো জানিস।”
“এত কথা তো তোর কাছে থেকে জানতে চাইনি, ইচ্ছে হলে বল আর না হলে চুপ থাক।” —বলে বিরক্তি প্রকাশ করলো প্রিয়তা।
সে এই বাড়িতে আসতে চায়নি, ঠিকই, কিন্তু এসে তো পড়েছে। আর কিভাবে এসেছে, তা ও জানতে পেরেছে। তবে এটা নিয়ে বিশেষ মাথাব্যথা নেই প্রিয়তার।
তবে একটাই আফসোস—
“কিডন্যাপ করেছিল যখন, মেরে ফেলতে পারতো, অক্ষত ছেড়ে দিলো কেন—বালের কিডন্যাপার?”
প্রিয়তা রাখঢাক না রেখে পুনরায় প্রশ্ন ছুঁড়লো—
“বড় আপু কোথায়? এই ১০ দিনে একবার ও দেখলাম না কেন?”
এই প্রশ্নে একদম চুপ মেরে গেলো ইনায়া, কী জবাব দেবে বুঝতে পারলো না।
অভিরাজ মা’য়ের পাশে বসে তখন থেকে এক দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে প্রিয়তাকে।
ছোট্ট অভিরাজের মনটা আনচান করছে ওই আন্টিটার কোলে চড়ার জন্য, কিন্তু আন্টি টার কর্কশ মেজাজ আর রাগের বহিঃপ্রকাশ দেখে ভয়ে কিছু বলতে পারছে না।
ইনায়া প্রিয়তার প্রশ্নের জবাব দিলো না। তার কাছে মিথ্যে বলার থেকে চুপ থাকা বেশি শ্রেয় মনে হলো।
অভিরাজ নিজের ইচ্ছে দমাতে পারলো না।
অজান্তেই নিজের ছোট ছোট হাতে প্রিয়তার হাত চেপে ধরলো।
কারো হাতের স্পর্শে চমকে পাশে তাকালো প্রিয়তা।
ছোট্ট ছোট্ট দুটো হাত প্রিয়তার আঙ্গুল চেপে ধরেছে।
প্রিয়তা আর প্রীতমের মতোই একদম হুবহু নীল চোখের একটা ভীষণ মিষ্টি বাচ্চা।
বোধহয় অনেকটা প্রিয়তার মতোই, কারণ অভিরাজ তার বাবা-মায়ের মতো দেখতে হয়নি।
বাচ্চাটাকে দেখে প্রিয়তার মনটা কেমন মায়া-মমতায় ভরে উঠলো।
অভিরাজ হাত বাড়িয়ে দিয়ে ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দ উচ্চারণ করল—
“আমি কোলে উঠবো।”
বাচ্চাটার দিকে তাকাতেই প্রিয়তার মনটা স্নেহ-মায়া-মমতায় পরিপূর্ণ হয়ে গেলো।
এটা প্রিয়তার ভাইয়ের ছেলে, মানে নিজের রক্তের বাচ্চা—ভাবতেই প্রিয়তার চোখ দুটো টলমল করে উঠলো।
প্রিয়তারও বাচ্চাটাকে ছুঁয়ে দেখার জন্য মন পুড়তে লাগলো।
সে চোখ মুছে দুই হাতে অভিরাজকে তুলে কোলে বসালো।
অভিরাজের টকটকে গালে টুপুস করে একটা চুমু খেয়ে বললো—
“তোমার নাম কী বাবা?”
অভিরাজ এখনও চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে।
এই আন্টির কোলে বসতে পেরে সে যেন শান্তি পেলো।
ইনায়া পাশ থেকে ধমকে বললো—
“ফুপি মনি, তোমাকে কি জিজ্ঞেস করছেন অভিরাজ।”
অভিরাজ বিস্মিত চোখে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে আধো আধো কণ্ঠে বললো—
“ফুপি মনি।”
প্রিয়তা আর নিজেকে সামলাতে পারলো না, অভিরাজকে বুকে জড়িয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো।
ভাইয়ের প্রতি তার আকাশ সমান অভিযোগ আর পাহাড় সমান ভালোবাসা—প্রিয়তা চেয়েও ভাইয়ের বুকে যেতে পারছে না, বিধায় ভাইয়ের অংশকে বুকে জড়িয়ে ভাইকে অনুভব করার চেষ্টা করছে।
ইনায়া সব বুঝে, কিন্তু প্রিয়তাকে কিছুই জানানোর স্পর্ধা তার নেই।
শুধু সে কেনো, এই বাড়ির ছোট থেকে বড় প্রত্যেকেই সব কিছু জানে।
কিন্তু কারো কিছু বলার বা প্রকাশ করার সাহস নেই।
যা হয়েছে আর যা হবে সব কিছু চুপচাপ মুখ বুজে দেখা ছাড়া কারো কোনো গতি নেই।
প্রিয়তা অভিরাজকে অনেক অনেক আদর করতে লাগলো।
অভিরাজ অনেক ইন্ট্রোভার্ট। অচেনা মানুষের সাথে সহজে মিশতে পারে না।
কিন্তু প্রিয়তার সাথে মিশে খিলখিল করে হাসছে—
এটাই হয়তো রক্তের টান।
মানুষ মুখে না বললে ও রক্ত ঠিকই চিনে নেয় কে তারা আপন আর কে তার পর।
অভিরাজ নিজের তুল তুলে হাতে প্রিয়তার গাল ছুঁয়ে ছুঁয়ে বলছে—
“পুপি, তোমাল চোকগুলো আমাল মতো, আল পাপ্পার মতো।”
এত বছর পর প্রথমবার প্রিয়তার ভীষণ ভালো লাগছে।
বেশ কিছুক্ষণ হলো ইনায়া অভিরাজকে প্রিয়তার কাছে রেখে নিজের ঘরে চলে গেছে। অনেক চেষ্টা করেও অভিরাজকে সে নিজের সাথে নিতে পারেনি। সে একেবারেই গ্লুর মতো চিপকে গেছে প্রিয়তার সাথে। ইতিমধ্যে শপিং সেরে শিখদার বাড়ির সকলে বাসায় ফিরে এসেছে।
বাড়ির গিন্নিরা চাঁদ রাতের তোড়জোড়ও শুরু করেছেন।
প্রিয়তার রুমে ভিড় জমিয়েছে অভিরাজ, অবনী, তন্ময়, থিরা, থোরি—আরও অনেকে। বিছানাটা প্রায় ছোট খাটো একটা শপিং মলে পরিণত হয়েছে। সবাই মিলে হইহই করে কিনে আনা জামাকাপড় দেখছে, মেহেদি সিলেক্ট করছে। চাঁদ দেখা গেলেই মেহেদি পরার প্রতিযোগিতা শুরু করে দেবে। সারাবাড়িতে উৎসব উৎসব রব, নতুন সাজে সেজে উঠছে শিখদার বাড়ি, যার আনাচে-কানাচে বয়ে যাচ্ছে আনন্দের ফোয়ারা। আত্মীয়-স্বজন, মেয়ে-জামাই, বাচ্চা-কাচ্চাতে পরিপূর্ণ।
পরিণীতা আর পৃথাও এসেছে ঈদ উপলক্ষে। শিখদার বাড়ির হেসেলে চলছে বিশাল রান্নাবান্নার আয়োজন। অনুশ্রী বেগম নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তদারকি করছেন সবকিছু।
রিনা খান ওরফে শাশুড়ির ফরমাইশ শুনতে শুনতে জীবন ভাজা ভাজা হয়ে যাচ্ছে ঊষা আর পূর্ণতার। ইনায়া বেঁচে গেছে প্রেগনেন্সির দোহাই দিয়ে। যদিও ও কাজে হাত লাগিয়েছে পৃথা, পরিণীতা, শ্বেতা, প্রেরণা, তনুশ্রী বেগম, অনন্যা বেগম, অর্থি বেগমসহ আরও অনেক মহিলা। রান্না হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টান্ন ও উপাদেয় সব পদ। ঈদ কাল হলেও, রান্নার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে আজ থেকেই।
তবে সকলে আগের মতো থাকলেও অনুশ্রী বেগম আর আগের মতো নরম-সরম নেই। তিনি আজকাল প্রচণ্ড খিটখিটে হয়ে গেছেন। পান-থেকে-চুন-কষকেই বউদের সাথে খিটমিট করেন। যদিও এতে ছেলেদের বৌরা কিছু মনে করে না, কারণ তারা বোঝে অনুশ্রী বেগমের মনের অবস্থা। এমনকি জানে, তিনি ইচ্ছে করে এসব বলেন না।
শ্বেতা একদিকে ছানা ঢলে ঢলে রসগোল্লা বানাচ্ছে। অন্যদিকে ঊষা বড় একটা কড়াতে দুটো বড় এলাচ আর আধা গামলা পানি দিয়ে চিনির সিরা বানাচ্ছে। পূর্ণতা মাছ ভাজছে আর পরিণীতা সেমাই বানাচ্ছে।
প্রেরণা মিক্সার-গ্রাইন্ডারে চালের গুড়ি বানাচ্ছে।
শ্বেতা একটা বড় স্টিলের থালায় প্রায় ৫০ পিসের মতো মিষ্টি বানিয়ে রাখলো। অনেকক্ষণ ধরে একভাবে ঠায় বসে থাকলে তার ঘাড় ব্যথা করছে।
অনুশ্রী বেগম মিষ্টিগুলো দেখে মুখ কুচকালেন। চাপা বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন—
“আহা! এভাবে একটা গোল, একটা চ্যাপ্টা করছিস কেন?”
বলে একটু ছানা হাতে নিলেন। হাতের তালুর সাহায্যে একটা মিষ্টির পারফেক্ট শেপ বানিয়ে দেখালেন। তারপর ঠিক একই রকম ভাবে আরেকটার নতুন শেপ দিয়ে বললেন—
“এভাবে বানাও।”
শ্বেতা হতাশার নিশ্বাস ছেড়ে বললো—
“আচ্ছা বড়মামী, ঈদ তো কাল। তাহলে আজ এত কিছু রান্না করাচ্ছো কেন? এত এত খাবার কে খাবে?”
শ্বেতার প্রশ্নে অনুশ্রী বেগমের গম্ভীর মুখে হাসি ফুটে উঠলো। তিনি একটু রহস্য করে বললেন—
“আজ আমার বিশেষ দুজন মেহমান আসবে। তা ছাড়াও বাড়িতে মেয়ে-জামাই, নাতি-নাতনি আছে, আরও অনেকে আছে। তাই বেশি কথা না বলে কাজে মন দে।”
শ্বেতা আবারো হতাশ হলো। তবে সত্যি, বেশি কথা বাড়ালো না। অনুশ্রী বেগমের কথামতো কাজে মনোযোগ দিলো।
চার কর্তা সহ রাজ, প্রীতম, প্রেম, অরণ্য, সমুদ্র ড্রইং রুমের সোফায় বসে মসজিদে বিরাট একটা মিলাদ পরানোর ব্যাপারে আলোচনা করছেন। তাদের সাথে আছে বাড়ির মেজ জামাই পৃথার বর সাদিক আর পৃথার ৪ বছর বয়সী সমোজ সন্তান প্রীত আর প্রিতী।
সন্ধ্যা যত ঘনিয়ে আসছে, বাড়ির পরিবেশ তত গমগমে হয়ে উঠছে।
অনুশ্রী বেগম সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ব্যস্ত পায়ে পায়চারি করছেন। যেন কারো আসার অধীর অপেক্ষা।
উনার থেকে কিছু দূরে দাঁড়িয়ে আছে শ্বেতা, পরিণীতা, ঊষা, পূর্ণতা, প্রেরণা। তারা একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে।
পূর্ণতা ঊষার কানে কানে বললো—
“কে এমন আসবে বলতো ছোট, যে আমাদের শাশুড়ি রিনা খান নিজেই তাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য দাঁড়িয়ে আছে?”
ঊষাও না বোঝার ভঙ্গিতে বললো—
“জানি না ভাবি। তবে মনে হচ্ছে ভিআইপি কেউ।”
প্রেরণা পাশে দাঁড়িয়ে সন্দিহান কন্ঠে বললো—
“হু, রহস্যময়!”
এর মাঝেই শিখদার বাড়ির বাইরে থেকে একসাথে অনেক গাড়ির হর্নের শব্দ শোনা গেলো।
প্রিয়তা নিজের ঘরে বসে বাচ্চাদের সাথে কথা বলছিলো। কিন্তু নিচ থেকে অনেকগুলো গাড়ির বিরক্তিকর হর্নের শব্দে প্রিয়তার মাথা ধরে গেলো। কপাল চেপে ধরে ভাবলো—
“এই ভর সন্ধ্যায় আবার কোন আপদ এসে উদয় হলো?”
প্রিয়তা কে আসছে দেখার উদ্দেশ্যে বিছানা থেকে নেমে ধীরপায়ে গিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়ালো।
দৃষ্টি পাত করলো নিচে।
শিখদার বাড়ির রাজকীয় গেট দিয়ে একে একে ঢুকছে অনেক গুলো সাদা-কালো রঙের প্রাইভেট কার। যা সব গুলোই এসে সিরিয়ালে থামলো বাড়ির গার্ডেন এরিয়ায়।
এতোগুলো গাড়ি দেখে ভ্রু কুঁচকালো প্রিয়তা। আগন্তুকদের চেহারা দেখার উদ্দেশ্যে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে রইলো গাড়িগুলোর দিকে।
প্রাইভেট কারগুলোর মধ্যে প্রথম সারির ব্ল্যাক বিএমডব্লিউ থেকে বের হলো ব্ল্যাক শার্টের ওপর ব্ল্যাক ব্লেজার পরিহিত এক অতিমাত্রার সুদর্শন সুপুরুষ। তার হাতের কব্জিতে রোলেক্স ব্র্যান্ডের ঘড়ি, চোখে ব্ল্যাক সানগ্লাস।
পুরুষটার চেহারা চোখে ভাসতেই থমকে গেলো প্রিয়তার পৃথিবী। সে খেই হারিয়ে পাথরের মূর্তি বনে দাঁড়িয়ে রইলো। সুদীর্ঘ ৪ বছর পর সেই মানুষটা আবারো তার চোখের সামনে। যাকে একনজর দেখবে বলে তড়পে মরেছে বিগত ৪টা বছর। যার বিরহে ১ সেকেন্ডও শান্তি পায়নি প্রিয়তা। তবে প্রিয়তার চমক হয়তো এখানেই শেষ নয়। তার জন্য অপেক্ষা করছে আরো বড় সারপ্রাইজ।
প্রণয় গাড়ি থেকে নেমে হাত বাড়িয়ে দিলো গাড়ির ভিতর। যা দেখে কপাল কুঁচকে ফেললো প্রিয়তা। তবে পরমুহূর্তেই যা দেখলো, তাতে প্রিয়তার কলিজায় সেই পুরোনো ছ্যাকা লাগলো।
প্রণয় বাড়িয়ে দেওয়া হাতে হাত রেখে গাড়ি থেকে নেমে এলো এক অতি সুন্দরী নারী। তার পরনে প্রণয়ের সাথে ম্যাচ করা ব্ল্যাক সিল্কের শাড়ি, মুখে সফট মেকআপ, হাতে অ্যাপল ওয়াচ। হালকা কার্ল করা চুলগুলো কোমরের নিচে দোল খাচ্ছে।
মানানসই ফিগারের সাথে ব্ল্যাক গ্যাটাপে পাশাপাশি দুজনকে met for each other লাগছে।
সেই সুন্দরী রমণীর মুখে সুখ আর চোখে আত্মবিশ্বাস। সে গাড়ি থেকে নেমে প্রণয়কে জড়িয়ে ধরলো। যা দেখে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলল প্রিয়তা।
তার পরের বিএমডব্লিউ থেকে বের হলো হোয়াইট ফরমাল শার্টের সাথে ব্লেক ফরমাল প্যান্ট পরিহিত আরেক সুদর্শন সুপুরুষ। তার হাতের কব্জিতেও সেইম রোলেক্স ব্র্যান্ডের ঘড়ি, চোখে ব্ল্যাক সানগ্লাস। সে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ইন্টারন্যাশনাল মানের একজন সেলিব্রেটি ডক্টর মোস্ট হ্যান্ডসাম কার্ডিও সার্জন—ডক্টর আবদ্ধ চৌধুরী শুদ্ধ।
তার পরের গাড়ি থেকে নেমে এলো ব্ল্যাক ফরমাল শার্টের সাথে ব্ল্যাক ফরমাল প্যান্ট পরিহিত আরেক সুদর্শন সুপুরুষ। তার হাতের কব্জিতে ও রোলেক্স ব্র্যান্ডের ঘড়ি, চোখে সানগ্লাস। তবে সে একা নয়। তার পরপর গাড়ি থেকে নেমে এলো লাল জামদানি শাড়ি পরিহিত এক অপরূপ সুন্দরী রমণী। যার দুই হাত ভর্তি মোটা মোটা সোনার কঙ্কন, সাথে মোটা মোটা শাঁখা-পলা। সিঁথি রাঙানো ঝলমলে লাল সিঁদুর, চোখে হাসি আর ঠোঁটে প্রশান্তি।
তার পেছনের গাড়ি থেকে নেমে এলো সাদাফ।
এত মানুষ দেখে মুখ হাঁ হয়ে গেল প্রিয়তার সে আর এক সেকেন্ডও দাঁড়ালো না সেখানে। এক ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
উন্মাদের মতো নামতে লাগলো সিঁড়ি বেয়ে।
সদর দরজায় বাজতে থাকা কলিং বেলের শব্দে অনুস্রী বেগম এর পা স্থির হলো। সুস্রী মুখে আনন্দের ছটা খেলে গেল। তিনি একপ্রকার ছুটে গিয়ে ব্যতিব্যস্ত হাতে খুলে দিলেন সদর দরজা।
ততোক্ষণে প্রিয়তা নেমে এসে দাঁড়িয়েছে শ্বেতা-পরিণীতাদের পাশে।
অনুস্রী বেগম দরজার পাল্লা খুলতেই সকলে চোখের সামনে ভেসে উঠলো চেনা-পরিচিত গুটি কয়েক হাসি মাখা মুখ।
দরজার বাইরে আগত ব্যক্তিদের চেহারা দর্শন করতেই থমকে যায় গোটা শিখদার বাড়ির পরিবেশ। সকলের চোখে ভেসে উঠে ৪ বছর আগের সেই দিন। অতীতের ভয়ংকর সেই দিনটি স্মরণ হতেই ভয়ে সকলে কাঁটা হয়ে যায়।
শ্বেতা আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে দরজার বাহিরে, যেখানে আপাতত প্রণয় আর প্রহেলিকা কে দেখা যাচ্ছে। প্রণয় আর প্রহেলিকা একত্রে অনুশ্রী বেগম এর পা ছুঁয়ে সালাম করলো।
প্রহেলিকা হাসিমুখে বললো —
“ভালো আছো বড় আম্মু?”
অনুশ্রী বেগম ও সাড়া দিলেন, হাসার চেষ্টা করলেন।
এবার শুদ্ধ আর সাদাফও এগিয়ে এসে অনুশ্রীকে সালাম করলো। অনুশ্রী বেগম হাসিমুখে দুজনকে দোয়া করে দিলেন।
কিন্তু উনি যেন কিছুতেই স্থির হয়ে পারছেন না, এখনও বাহিরে উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছেন। উনার অপেক্ষার অবসান ঘটাতে সিকদার বাড়ির চৌকাঠে পা রাখলো এক যুগল।
তবে সেই পুরুষ অবয়ব চোখের পাতায় ভাসতেই শ্বেতার দুনিয়া দুলে উঠলো। অক্ষি কুটর পূর্ণ হয়ে গেলো, ব্যথা মিশ্রিত অশ্রু জলে! দীর্ঘ আড়াই বছরের তৃষ্ণার্থ চোখ সেই কাঙ্খিত ব্যক্তিকে দেখে ব্যাকুল হয়ে উঠলো। কষ্ট-অভিমানগুলো অশ্রু হয়ে ঝড়তে লাগলো গাল বেয়ে। তবে আসল চমক তো এখানো বাকি।
আভির্ভাবকে দরজায় দাঁড়ানো দেখে ছুটে গেলেন অনুশ্রী বেগম। আভির্ভাব কারো দিকে না তাকিয়ে আগে অনুশ্রী বেগমকে ইসলাম ধর্ম মতে সালাম করলো।
অনুশ্রী বেগম ভীষণ খুশি হলেন, প্রশন্ন চোখে তাকিয়ে গালে-মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
তার আশেপাশে দেখতে দেখতে বললেন —
“সে কোথায়?”
অভির্ভাব হাসার চেষ্টা করলো। তার পেছন থেকে বেরিয়ে এলো এক অতি সুন্দরী রমণী যার গায়ে লাল শাড়ি, হাতে শাখা-পলা, সিঁথিতে সিঁদুর। যাকে সিকদার বাড়ির কেউ আগে কখনো দেখেনি, কিন্তু তার পরিচয় আন্দাজ করতে পারছে।
এত মানুষের একত্র দৃষ্টি নিজের উপরে দেখে একটু নার্ভাস হলো দেবী, তবে সেটা মুখে প্রকাশ করলো না। দুই হাত জোড় করে প্রণাম জানালো অনুশ্রী বেগমকে, বিনম্র কণ্ঠে বললো —
“নমস্কার আন্টি, আমি দেবপ্রিয়া রায় চৌধুরী।”
দেবীর উপস্থিতি সবাই স্বাভাবিকভাবে নিলেও শ্বেতার যেন পায়ের নিচের জমিন সরে গেল। মনের শুকনো প্রেমের অরণ্যে যেন দাবানল লেগে গেলো এক মুহূর্তে। তার সকল শারীরিক ও মানসিক শক্তি যেন কেউ চুষে নিলো। ভঙ্গুর হৃদয়ে দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো দেবীর দিকে। শাখা-পলা আর সিঁথি ভর্তি সিঁদুরে সত্যিই দেবী লাগছে।
প্রিয়তা করুণ চোখে চাইল শ্বেতার পানে। কিন্তু এখানে যে দেখা ছাড়া কারো কিছুই করার নেই, কারণ এসব কলঙ্কের ভার একাই বইতে হয়।
এতক্ষণে বাড়ির সকলে সদর দরজার সামনে এসে উপস্থিত হয়েছেন।
অনুশ্রী বেগম আভির্ভাবকে নিজের ছেলের মতো মনে করেন, তাই প্রথম দেখাতেই ছেলের বৌকে নিজের হাতের ভারী সোনার বালা খুলে দেবীর হাতে পরিয়ে দিলেন।
অনুশ্রী বেগম থুতনিতে হাত রেখে বললেন —
“মাশাআল্লাহ, ভীষণ সুন্দর বউ।”
লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলো দেবী।
কিন্তু এসব দৃশ্যে নিঃশ্বাস আটকে আসছে শ্বেতার। অক্ষিকোণে উপচে পড়েছে বেদনাশ্রু।
আভির্ভাব অনুশ্রী বেগমের সাথে কথা বলে হাসিমুখে সামনে থাকতেই সর্বপ্রথম তার চোখ আটকালো মায়াবী এক জোড়া ধূসর বর্ণের চোখের মণিতে।
অপ্রত্যাশিত সেই চির চেনা চোখে চোখ পড়তেই আবির্ভাবের বুকের ভেতরের ছাই চাপা আগুন ধক করে জ্বলে উঠলো। দীর্ঘদিনের চেপে রাখা গোপন যন্ত্রণার ব্যথায় চেয়ে গেলো বুকের বাঁ পাশ।
চোখ এড়ালো না, প্রিয় দুই চোখের সেই অবাধ্য অশ্রুধারা।
যে গোপন ব্যথা সে বুকের খাঁচায় পুষে রেখেছে সযত্নে, তা আবার কেন সামনে এলো? এই অনলের জ্বালা এখন কিভাবে সইবে আবির্ভাব?
প্রহেলিকা প্রণয়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। বলা চলে প্রণয় ওকে নিজের সাথে চেপে রেখেছে। আর কিছুক্ষণ পরপর দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে হেসে হেসে কিছু বলছে।
প্রিয়তা যে এখানে উপস্থিত, তা নিয়ে কোনো হেলদোল দেখা গেল না প্রণয়ের মাঝে। তার ভাবখানা এমন যেন সে দেখতেই পায়নি প্রিয়তাকে, বা প্রিয়তার উপস্থিতি তার কাছে তেমন বড় কোনো ব্যাপার না।
প্রহেলিকার সাথে এত রং-ঢঙ দেখে প্রিয়তার যতটা না মন পুড়েছে, তার থেকে হাজার গুণ বেশি যন্ত্রণায় হৃদয় ভারী হয়েছে প্রণয়ের অবহেলায়।
হয়তো প্রিয়তা আশা করেছিলো, প্রণয় তাকে দেখবে। কিন্তু আফসোস, এমন কিছুই হলো না। আগে প্রহেলিকা থাকলেও প্রণয় তাকে আদর করতো, সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিতো, এক সেকেন্ড চোখের আড়াল হলে পাগল হয়ে যেতো। আর এখন সেই প্রণয় এত বছর পর প্রিয়তাকে দেখে ও গুরুত্ব দিচ্ছে না। এটাতেই হয়তো প্রিয়তার কলিজা জ্বলছে।
শ্বেতার মতো প্রিয়তারও গাল গড়িয়ে টপটপ করে অশ্রু ঝরতে লাগলো। আহত মনে বললো —
“তবে সত্যি আমার থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন প্রণয় ভাই? তাই এখন মুক্তির স্বাদ উপভোগ করছেন? আমি কি সত্যিই আপনার কাছে এতটা গুরুত্বহীন?”
তবে একবারের জন্যও ও প্রিয়তাকে দেখলো না প্রণয়।
অনুশ্রী বেগম সবার উদ্দেশ্যে বললেন —
“যাও, যে যার ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসো। তারপর হালকা নাস্তা খাবে সবাই।”
সবাই তাই শুনলো। প্রণয়, প্রহেলিকা, সাদাফ, শুদ্ধ — সকলেই যে যার জন্য বরাদ্দকৃত রুমে চলে গেলো। শুধু দাঁড়িয়ে রইলো দেবী আর আভির্ভাব।
অনুশ্রী বেগম তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন —
“তোমাদের রুমটা আমি আগেই তৈরি করে রেখেছি। থিরা!”
ছুটে এলো থিরা —
“জি বড় আম্মু?”
“অভির্ভাব দাদাকে প্রেমের পাশের রুমটাতে নিয়ে যাও।”
“জি বড় আম্মু।”
থিরা আভির্ভাবের কাছে গিয়ে নম্র কণ্ঠে বললো —
“চলুন ভাইয়া।”
আভির্ভাব শ্বেতার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো। এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়ানো সেফ নয়, তাই থিরার সাথে চলে গেলো। দেবীও যেতে নিলো।
অনুশ্রী বেগম তাকে আটকে বললেন —
“দাঁড়াও আম্মু, তোমার সাথে তো আলাপই হলো না।”
দাঁড়িয়ে পড়লো দেবী, লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলো। এত মানুষের ভিড়ে তার ভীষণ লজ্জা লাগছে। অনুশ্রী বেগম এসে দেবীর হাত ধরলেন, পুনরায় দেবীকে দেখে বললেন —
“মাশাআল্লাহ, ছেলেটার পছন্দ আছে।”
দেবীর এবার লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে মন চাইল।
তিনি দেবীর হাত ধরে প্রিয়তাদের সামনে এনে দাঁড় করালেন।
মেয়েদের উদ্দেশ্যে বললেন —
“ওকে তোমাদের সঙ্গে রাখো, গল্প করো। ও যেন বোর ফিল না করে।”
দেবী এক ঝলক দৃষ্টি তুলে তাকালো সবার দিকে।
সাথে সাথেই মুগ্ধতা ছেয়ে গেলো দেবীর চোখে-মুখে।
এই বাড়ির নারীদের চেহারা থেকে শুরু করে গায়ের রঙ, সবই যেন রাজকীয় নারীদের মতো। এক একজন চোখ ধাঁধানো সুন্দরী। এমনকি ৫০ ঊর্ধ্ব অনুশ্রী বেগমকে দেখলে মনেই হবে না তিনি এত বড় বড় ছেলে-মেয়েদের মা।
প্রেরণা, পরিণীতা, ঊষা, পূর্ণতা— হেসে হেসে দেবীর সাথে কথা বলতে লাগলো।
তবে দেবীর উপস্থিতি সহ্য করতে পারলো না শ্বেতা। তার মনে হচ্ছিলো কেউ তার কলিজাটা টেনে ছিঁড়ে নিচ্ছে।
শ্বেতা কোনো ফরমালিটি দেখাতে পারলো না। ভরা আসর ছেড়ে চোখ মুছতে মুছতে ছুটে উপরে চলে গেলো।
তার এমন অদ্ভুত আচরণে থতমত খেয়ে গেলেন উপস্থিত সকলে।
এই অদ্ভুত আচরণের হেতু খুঁজে পেলো না দেবী।
সমুদ্র আর অরণ্য নিজেদের মধ্যে হাসি-ঠাট্টা করতে করতে করিডোর দিয়ে হেঁটে আসছিল।
সমুদ্র মুখে মুখে কিছু একটা হিসাব কষে বলল —
“ভাই, আমাদের বাড়ির ইতিহাসের এবার সব থেকে বড় বিয়ে হবে। একেবারে গ্র্যান্ড ওয়েডিং! শুধু পুরো রায়পুর নয়, এবার পুরো পৃথিবী দেখবে।”
অরণ্য হালকা হেসে বলল —
“তা তো অবশ্যই। এবারের বিয়েটা আমাদের মান-সম্মানের ব্যাপার। আর তা ছাড়া পাত্র যেখানে শুদ্ধ ভাইয়া, সেখানে বিশ্বজুড়ে হইচই পড়ে যাবে, স্বাভাবিক।”
সমুদ্র বলল —
“সাদাফ ভাইয়াও কিন্তু একজন নাম করা সাইন্টিস্ট। কয়দিন আগেই তো একটা আর্টিকেল বের হল।”
অরণ্য মাথা নেড়ে বলল —
“হুম। আব্বু-চাচ্চুরা বলেছেন, এই বারের বিয়ের বাজেট হবে এসকে গ্রুপের ২০%।”
অরণ্য একটা চাপা নিশ্বাস ত্যাগ করে আবার বলল —
“শুধু তাই নয় ভাই, প্রেরণা আপুর বিয়ের খরচ দেবে আব্বু-চাচ্চুরা। আর প্রিয়র বিয়ের খরচ দেবে বড়দাদান।”
সমুদ্র মাথা দুলিয়ে বলল —
“সব তো ঠিক আছে, কিন্তু প্রিয়র বিয়ে নিয়ে তো বাড়িতে এখনো কিছু জানানো হয় নাই।”
অরণ্য নিলিপ্ত কণ্ঠে জবাব দিল —
“এখনো জানানো হয় নাই, তবে ঈদ মিটে গেলেই এই বিয়ে নিয়ে কথা উঠবে বাড়িতে।”
সমুদ্র একটু কাচুমাচু করে বলল —
“ভাই, তোর খারাপ লাগছে না? বাড়ির সবাই সবটা জেনেও কিভাবে এমনটা করতে পারে! আমার তো ভাবলেই কান্না পায়।”
অরণ্য ঠোঁটে কৃত্তিম হাসি ফুটিয়ে বলল —
“সবটা জানে বলেই তো তাড়াহুড়ো করে বিয়ে দিতে চাচ্ছে। কারণ, কোন বাবা-মাই তার সন্তানের খারাপ চায় না।”
সমুদ্র চুপ করে গেলেও আবার বলল —
“তবুও একবার ভাব, আমাদের এত খারাপ লাগছে তাহলে…”
কিন্তু কথা সম্পূর্ণ করার আগেই ঝড়ের বেগে ছুটে আসা কিছু সঙ্গে সজোরে ধাক্কা খেল সমুদ্র। অন্যমনস্ক ছিলো বিধায় টাল সামলাতে না পেরে দুই টোক্কর খেয়ে উল্টে পড়ল মেঝেতে।
মুখ দিয়ে ব্যথাতুর শব্দ করে বলল —
“আহ! শ্বেতা, দেখে চলতে পারিস না?”
কিন্তু শ্বেতার কানে বোধহয় সেই শব্দ পৌছালো না। তার নিকট অরণ্য-সমুদ্র যেন অদৃশ্য কেউ। সে চোখ মুছতে মুছতে ছুটে গিয়ে ধারাম করে দরজা লাগিয়ে দিল।
দরজা লাগানোর বিকট শব্দে কেঁপে উঠলো অরণ্য-সমুদ্র। হঠাৎ উড়ে আসা ঝড়ের মতো কোথা থেকে কি হয়ে গেল, কিছুই বুঝতে পারলো না। দুজন আহাম্মকের মতো হাঁ করে তাকিয়ে রইলো বন্ধ দরজার পানে।
অরণ্য হাত বাড়িয়ে টেনে তুলল সমুদ্রকে, ভ্রু বাকিয়ে বলল —
“কি হলো ব্যাপারটা?”
সমুদ্রও একইভাবে বলল —
“বুঝলাম না কিছুই।”
শ্বেতা দরজায় চিটকিনি তুলে হাঁটু মুড়ে মেঝেতে বসে পড়লো। ব্যথাতুর কন্ঠে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো। সেই করুণ যন্ত্রণার মিশ্রিত আর্তনাদ বন্ধ ঘরের চার দেওয়ালে বাড়ি খেয়ে আরো কয়েক গুণ জোরালো শব্দে প্রতিফলিত হতে লাগলো।
কান্নার তুড়ে মাত্র দুই মিনিটে ফর্সা মুখটা লাল টকটকে হয়ে গেল। শ্বেতার দম বন্ধ হয়ে আসা কান্নায় আর বুকফাটা আত্মচিৎকারে শিকদার বাড়ির প্রতিটি দেওয়াল কেঁপে উঠছে নিঃশব্দে—ঠিক সেই ভাবে, যেভাবে চার বছর আগে প্রিয়তার আত্মচিৎকারে কেঁপে উঠতো।
অতিরিক্ত কান্নার ফলে শ্বেতার শ্বাসকষ্ট হতে শুরু হলো। হঠাৎ কিছু মনে হতে চট করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো মেয়েটা। দুই হাতে গাল মুছে ছুটে গিয়ে আলমারি খুললো।
কাঠের আলমারি ভর্তি তাক–তাক শাড়ি, কাপড়ের স্তূপ। শ্বেতা পাগলের মত সেগুলো দুই হাতে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতে লাগলো মেঝেতে। কাপড় সরাতে সরাতে হঠাৎ থেমে গেল। জল–জলে অশ্রুসিক্ত চোখ জোড়া আটকালো একটা সাদা রঙের পুটলির উপর।
শ্বেতা শুষ্ক ঢোক গিলে কাঁপা হাতে সেটাতে স্পর্শ করলো। সাথে সাথেই একটা নিঃশর্ত ঢেউ আছড়ে পড়ল শ্বেতার হৃদয় কিনারে। বুকের যন্ত্রণা এক লাফে হুহু করে বেড়ে গেল কয়েকগুণ। শ্বেতা পুটলিটা নিয়ে মেঝেতে বসে পড়লো।
কাঁপা হাতে সাদা পুটলির গিট্টু খুলতেই তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে এলো খুব নিম্নমানের এক জোড়া শাঁখা–পলা।
লাল–সাদা রঙের চুড়ি চারটে দেখতেই শ্বেতার দম বন্ধ হয়ে এলো। শাঁখা–পলার জোড়া বুকে জড়িয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো মেয়েটা।
চোখের সামনে ভেসে উঠলো অতীতের সেই বিশেষ দিনটি—
অতীত : আড়াই বছর আগে
আবির্ভাব কানাডা থেকে বাংলাদেশে শিফট করেছে প্রায় দুই বছরের বেশি হতে চলল। সে কানাডার একজন নামকরা সাইকিয়াট্রিস্ট হলেও বর্তমানে বাংলাদেশে নিজের ডাক্তারি প্র্যাকটিস করছে। এটা মূলত তার বাবা–মার ইচ্ছা। তাই এখন আর যখন–তখন চাইলেই শ্বেতা আর আবির্ভাব একে অপরকে দেখতে পায় না, ছুঁতে পারে না। ফলে দুজন প্রেমপিপাসু যুগল এক আকাশ সমতৃষ্ণা জমিয়ে বিশ্বের দুই প্রান্তে ছটফট করে আর দিন গুনে কবে তাদের আবার দেখা হবে, কবে তারা আবার একে অপরের চোখে তাকিয়ে মনের অব্যক্ত কথাগুলো পড়ে নেবে, ভালোবাসবে।
সম্পর্কের লং–ডিস্ট্যান্সে তিতা–তিতা হয়ে যায় দুজন! কল–মেসেজে কথা বললেও তাতে তাদের মন ভরে না। তাই শ্বেতা প্রায়শই এই–ওই বাহানা দিয়ে মামার বাড়ি যায়। আর আবির্ভাবও মেডিকেলের এই–ওই ইস্যু দেখিয়ে কানাডা আসে। এভাবেই একটু প্রেম, একটু অভিমান, একটু অপেক্ষা নিয়ে চলতে থাকে তাদের জমজমাট প্রেমকাহিনি।
কথায় বলে না—দূরত্ব বাড়লে মানুষ গুরুত্ব বুঝে উপলব্ধি করতে পারে অপর প্রান্তের মানুষটা তার কত আপন। শ্বেতা–আবির্ভাবের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। দূরত্বের আগুনে জ্বলে পুড়ে অস্থির দুজন প্রিয়জনের অভাব আর সহ্য হয় না তাদের।
এর মধ্যেই শিকদার বাড়িতে রাজের বিয়ের ঠিক হয়। শ্বেতা ও মামাতো ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে মামার বাড়ি আসে। শুরু হয় জোরকদমে বিয়ের তোড়জোড়, কেনাকাটা, আয়োজন।
তার মধ্যেই বিয়ের দুই দিন আগে কোনো এক সন্ধ্যায় শ্বেতার ফোনে কল আসে আবির্ভাবের।
শ্বেতা ফোন রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসে ভারী পুরুষালি কণ্ঠ—
“মাই লাভ।”
শ্বেতা মুখ ঝামটা মেরে জ্বলে উঠে বলল—
“এই এই পাগলের ডাক্তার ঢং করবেন না একদম। আদিখ্যেতা সারাদিন সুন্দরী–সুন্দরী নার্স দেখতে এতই ব্যস্ত থাকেন যে আমার ফোনটা পর্যন্ত ধরেন না। আর এখন আসছেন পীরিত দেখাতে!”
সুমিষ্ট কণ্ঠে ঝাড়ি শুনে আবির্ভাবের বোধহয় কানটা ধন্য হলো। শ্বেতাকে আরেকটু রাগিয়ে দিতে বলল—
“ছ্যাহ! কি সব ছোটলোকি কথাবার্তা! আমায় কি পাগলা কুত্তা কামড় দিছে মাই লাভ?, তোমার রূপের ঝাঁঝেই আমার গলায় দড়ি দেওয়ার উপক্রম—সেখানে ছ্যাহ–ছ্যাহ!”
আবির্ভাবের নাটক দেখে শ্বেতার গা জ্বলে গেল। দ্বিগুণ শব্দে ঝাঁড়ি মেরে বলল—
“সরেন তো মিয়া, ছাড়েন আপনার ঢংয়ের কথা! সারাদিন এদিক ওদিক টাংকি মেরে এখন আসছে আমায় পীরিত দেখাতে? আপনার পীরিতের খ্যাতা পুড়ি আমি!”
আবির্ভাব ঠোঁট কামড়ে ধরে নিঃশব্দে হাসলো, রসিক কণ্ঠে বলল—
“আহা, এখনো আমার ফুলশয্যা হয়নি, পীরিতের খ্যাতা গায়ে জড়িয়ে ঘুমানো হয়নি—এখনই খ্যাতা পুরিয়ে দিলে কিভাবে হবে?”
শ্বেতা ভ্রু কুঁচকে বলল—
“আপনি কি ভাবছেন, আপনার এসব মিষ্টি–মিষ্টি কথা শুনে আমি গলে যাবো? নেভার! এই মৃত্তিকা চৌধুরী শ্বেতা মাটির তৈরি নয় যে আপনি পানি ঢাললেই গলে যাবে।”
আবির্ভাব নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে ফিচেল কন্ঠে বললো—
“জানি তো! মৃত্তিকা চৌধুরী শ্বেতা মাটির তৈরি নয়, সে আইসক্রিমের তৈরি। আমার একটু ঠোঁটের ছোঁয়া পেলেই গলে যাবে।”
এবার চরম লজ্জা পেয়ে গেল শ্বেতা। হুট করে সকল রাগ শিমুল তুলোর মতো উড়ে গেল। এমন নির্লজ্জ মার্কা কথায় কান ঝাঁঝা করে উঠলো শ্বেতার। সে আর রাগ দেখাতে পারলো না, মুচকি হেসে লাজুক কণ্ঠে বললো—
“ছি! নষ্ট পুরুষ।”
আবির্ভাব পুনরায় টোন কেটে বলল—
“দিস ইজ নট ফেয়ার, মাই লাভ! আমার মত একটা পিওর ভার্জিন ছেলেকে তুমি নষ্ট তকমা দিতে পারো না। প্রচণ্ড বুকে লাগে। নষ্ট হওয়ার সুযোগটাই পেলাম না এখনো।”
শ্বেতা এবার আর কিছু বলতে পারলো না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। লজ্জায় তার দুই গাল গরম হয়ে উঠছে।
আবির্ভাব চেয়ার–মাথা এলিয়ে দিল। ভারী দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বলল—
“আর কতদিন বলতে হবে যে একা–একা লজ্জা পাবে না? তোমার লজ্জা–রাঙ্গা মুখটা যদি আমি দেখতেই না পেলাম, তোমার লজ্জার পরিধি যদি বাড়াতেই না পারলাম, তবে এই লাজের কোন মানে আছে?”
শ্বেতা অস্থির হয়ে উঠলো। “এই লোক এত লজ্জা দেয় কিভাবে!”
আবির্ভাব কেমন কণ্ঠে ডেকে উঠলো—
“মাই লাভ?”
“হুম?”
“আমি সকাল থেকে কিছু খাইনি। বাইরের খাবার খেতে ইচ্ছে করে না। একটু রান্না করে দিয়ে যাবে?”
আবির্ভাবের মোহনীয় কণ্ঠের আবদারে ধক করে উঠলো শ্বেতার বুক। সারাদিন ধরে মানুষটা না–খাওয়া—ভাবতেই শ্বেতার ভীষণ মন খারাপ হলো।
নাজুক কণ্ঠে বললো—
“আপনি সত্যি কিছু খাননি?”
“উহু… একটু আসবে?”
শ্বেতা বলল—
“গিয়ে কি করবো? আপনি তো বাসায় নেই!”
আবির্ভাব জবাব দিল—
“তো কি হয়েছে? আমি চলে আসবো ৩–৪ ঘণ্টার ভেতর। এর মধ্যে তুমি রান্না করে রাখবে।”
ভাবনায় পড়ে গেল শ্বেতা। চিন্তিত কণ্ঠে বলল—
“কিন্তু আবির্ভাব, এখন সন্ধ্যা ৭টা। আমি বাড়ি থেকে কি বলে বের হবো? আর বাড়ি ফিরতে ফিরতে না–জানি কত রাত হবে। তখন মামারা, ভাইয়ারা যদি খোঁজ করে…”
আবির্ভাব চোখ বুজে বলল—
“আমি সারাদিন কিছু খাইনি, মাই লাভ। এখন তুমি যা ভালো বোঝো করো। না এলে আর কি… আমি বাসায় এসে যা হোক কিছু একটা বানিয়ে নেবো।”
আবির্ভাবের ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলের চাপে পড়ে ফেঁসে গেল শ্বেতা। হুট করেই আবির্ভাবের জন্য মনটা ভীষণ পুড়ছে। এখন আর সে কিছুতেই ঘরে মন বসাতে পারবে না। তাই আর কিছু না বলে ফোন কেটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
মোবাইলটা কান থেকে নামিয়ে ঠোঁট এলিয়ে হাসলো আবির্ভাব। কারণ সে জানে শ্বেতা আসবেই, আজ বাড়ি গিয়ে গরম গরম খাবার পাবে নিশ্চিত। আজ আর হাত পুরিয়ে রাঁধতে হবে না—ভীষণ ভালোবাসা নিয়ে খাবারের প্লেট মুখের সামনে তুলে ধরবে কেউ।
শ্বেতা কয়েক হাজার মিথ্যে কথা আধা ঘণ্টা যাবত বসে সময় নিয়ে গুছিয়ে খাওয়ালো সবাইকে। সুন্দর মতো ঢপ মেরে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো।
দেড় ঘন্টা জার্নি করে একটা বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে এসে পৌঁছালো শ্বেতা। ঝা চকচকে বিল্ডিং এর টেনথ ফ্লোরে উঠে ২০৩ নাম্বার ফ্ল্যাটের মেন ডোরের সামনে এসে দাঁড়ালো। নিজের পার্স থেকে ফ্ল্যাটের ডুপ্লিকেট চাবি বের করে দরজার লক ঘুরিয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করল।
ফ্ল্যাটের ভেতর প্রবেশ করতেই কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল শ্বেতা। বাড়ির অবস্থা দেখে রাগে দাঁত খিট মিট করে বলল,
“আস্ত বনমানুষ লোক একটা!”
শ্বেতা মোবাইল আর পার্স সেন্টার টেবিল এর উপর রেখে পুরো ফ্ল্যাট ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো।
এদিকেরটা ওদিকে, ওদিকেরটা সেদিকে—পুরো ফ্ল্যাটের অবস্থা নাজেহাল, ছন্নছাড়া। জিনিসপত্র এদিকে ওদিকে ছড়ানো, গাদা গাদা ধুলো জমে আছে আসবাবপত্রের উপর।
সোফার উপর সাদা টাওয়াল ফেলে রাখা দেখে সেটা হাতে নিলো শ্বেতা। সাথে সাথেই ভেজা টাওয়ালের উৎকট গন্ধ এসে নাকে লাগলো।
এসব দেখে বিরাট হতাশ হলো শ্বেতা। মনে মনে কপাল চাপড়ে বললো,
“ব্যাটা প্রেম করার জন্য নয়, বাসা পরিষ্কার করার জন্য ডেকেছে আমায়।”
শ্বেতা পুনরায় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিচেনে গেলো। সেখানকার অবস্থা আরো করুণ। জল ভর্ত্তি সিংকে এটো তালাবাসন ডুবিয়ে রাখা, মসলার কৌটা গুলো ঢাকনা খোলা অবস্থায় এদিক সেদিক পড়ে আছে। হলুদের স্পুন মরিচের গুঁড়ার কৌটায়, আর মরিচের গুঁড়ার স্পুন জিরের গুঁড়ার কৌটায়।
কিচেন ক্যাবিনেটের ওপর প্রায় ৫০ এর বেশি নুডলসের প্যাকেট জমানো।
সব কিছু দেখে শ্বেতার মাথায় হাত।
“একটা মানুষ এতটা অগোছালো কিভাবে হয়!”
কিন্তু এত এত নুডলসের প্যাকেট দেখে মনে মনে ভীষণ দুঃখ পেলো শ্বেতা। ভালোই বুঝলো আবির্ভাব প্রতিদিন বাসায় ফিরে কোনো মতে নুডলস খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
শ্বেতা আর ভাবলো না। থ্রি পিসের কালো ওড়না কোমরে গুঁজে, রিবন্ডিং করা চুলগুলো উঁচুতে তুলে বড় একটা খোঁপা করে নিলো। প্রথমেই ঝাটা খুঁজে বের করে বাড়ির সমস্ত আসবাবপত্রের ধুলোবালি ঝেড়ে বাড়িটা সুন্দর মতো সাজালো। প্রতিটা জিনিসপত্র খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরিষ্কার করে জায়গাটা জায়গায় রাখলো।
কপালে ঘাম মুছে রান্নাঘরের সব এটো তালাবাসন পরিষ্কার করে বাসনের রেকে সুন্দর মত সাজিয়ে রাখলো। সমস্ত মসলার কৌটা গুলোর ঢাকনা লাগিয়ে যথাস্থানে তুলে রাখলো। পুরো রান্নাঘর ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করলো।
ফ্রিজ খুলে দেখলো মাছ মাংস আনাজ সবজি কিছু নেই।
শ্বেতা পুনরায় হতাশ হয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো। অ্যাপার্টমেন্ট থেকে প্রায় ৫ মিনিটের দূরত্বে আসার সময় একটা সবজির বাজার দেখেছে শ্বেতা। তাই সেখান থেকে সবজি তরকারি, মাছ মাংস সহ সব প্রয়োজনে জিনিসপত্র কিনে আনলো।
সেগুলো সুন্দর মতো কেটেকুটে, ধুয়ে বেছে বেশ কয়েক পদের দুসুস্বাদু তরকারি রান্না করলো। ভাত রান্না করলো, এক পদের ডেজার্ট বানিয়ে হাঁফ ছাড়লো শ্বেতা।
ঘড়ির কাটায় তাকিয়ে দেখলো রাত ১১ টা বেজে ৪৫। আবির্ভাব এখনো ফেরেনি।
শ্বেতা রান্না বান্না শেষ করে আবির্ভাবের ঘরে গেলো। সেই ঘরের অবস্থা আরো নাজেহাল। বিছানার উপর, সোফার উপর—শার্ট প্যান্টের পাশাপাশি স্যান্ডো গেঞ্জি সহ আন্ডারওয়ারও পড়ে আছে।
শ্বেতা ঘরের সব কিছু খুব যত্ন নিয়ে গুছিয়ে দিলো। ভালোবাসাময় স্পর্শে ছুঁয়ে দিলো প্রতিটা জিনিস। আবির্ভাব বিছানা থেকে বেডশীট, বালিশ, জামাকাপড়—সব কিছু থেকেই আবির্ভাব, আবির্ভাব গন্ধ আসছে।
শ্বেতা এগিয়ে গেলো আবির্ভাবের ড্রেসিং টেবিলের দিকে। সেখানেই বেশ কয়েক পদের ব্র্যান্ডেড পারফিউম থরে থরে সাজানো। শ্বেতা সবগুলোর ঘ্রাণ নিলো।
অতঃপর আলমারি খুলে আবির্ভাবের একটা শার্ট বের করে তাতে নাক ডুবালো। আহ্! সেই পরিচিত শরীরের গন্ধে শ্বেতার মাথা আউলিয়ে গেলো।
শ্বেতা শার্টটা গায়ে জড়িয়ে আবির্ভাবের বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পড়লো। এবার নাক ডুবালো আবির্ভাবের বালিশে। আবির্ভাব কাছে নেই, তবুও ও মনে হচ্ছে আবির্ভাব জড়িয়ে ধরেছে।
শ্বেতা শুয়ে বিছানার এপাশ থেকে ওপাশে গড়াগড়ি খেতে খেতে লাজুক মুখে বললো,
“লোকটা একটু পাগলাটে, অগোছালো, চঞ্চলচরিত্রের… কিন্তু মানিয়ে নেবো।”
ঘড়ির কাটায় সময় গড়িয়ে রাত ১২ টা ২০
অপেক্ষা করতে করতে শ্বেতা কখন ঘুমিয়ে পড়েছে তার নিজেরই হুশ নেই।
গড়াগড়ি খেয়ে সে নিজেই বিছানার চাদর জমিয়ে দিয়েছে গায়ের ওড়না ও ঠিক নেই, পাজামা উঠে গেছে গোঁড়ালির অনেকটা উপরে ফলে ফর্সা আকর্ষণীয় পা দুটো দৃশ্যমান। সিল্কি চুলগুলোর কয়েকটা মুখের ওপর, আর বাকিগুলো বিছানায় ছড়িয়ে আছে।
আবির্ভাবের পাশ বালিশ বুকে জড়িয়ে জমপেস ঘুম দিচ্ছে শ্বেতা।
তবে গভীর ঘুম ধীরে ধীরে হালকা হয়ে আসছে শ্বেতার। ঘুমের মধ্যেই অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে, মস্তিষ্কের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছে—কেউ হয়তো তার খুব কাছেই আছে, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সেই ব্যক্তির ক্রমাগত নিঃশ্বাসের গরম ভাব এসে আছড়ে পড়ছে শ্বেতার মুখমণ্ডলে।
শ্বেতার অস্থিরতা পর্যায়ক্রমে বাড়তে বাড়তে একসময় ঘুমটাই চটকে গেলো। না চাইলেও চোখ মেলে তাকালো শ্বেতা।
তার মুখের উপর ঝুঁকে পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আবির্ভাব। তার দৃষ্টি স্থির, হয়তো একবারের জন্যও পলক ফেলছে না।
শ্বেতা চোখ মেলতেই চোখাচোখি হয়ে গেলো, সাথে সাথেই লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নিলো শ্বেতা।
তবে কোনো হেলদোল দেখা গেলো না আবির্ভাবের মধ্যে, সে মুচকি হেসে এখনো তাকিয়ে আছে শ্বেতার সুশ্রী মুখে।
শ্বেতা চোখ বন্ধ করে নিয়েছে, তবুও যেন আবির্ভাবের দৃষ্টি তার শরীরে কাটার মতো বিঁধছে।
সেই দৃষ্টির তীব্রতা সইতে না পেরে হাত উঠিয়ে আবির্ভাবের চোখের ওপর রাখলো।
মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে অনুরোধ করে বললো—
“এভাবে দেখবেন না, প্লিজ… আমার লজ্জা লাগে।”
আবির্ভাব ঠোঁট টিপে হাসলো, শ্বেতার হাত ধরে চোখের ওপর থেকে নামিয়ে আনলো।
কোমল হাতের উলটা পৃষ্ঠে ঠোঁট চেপে ধরে মাদকীয় কণ্ঠে বললো—
“তোমাকে লজ্জা দেওয়ার জন্য হলে ও নতুন কিছু করতে হবে মাই লাভ। তুমি হয়তো জানো না, তোমার এই লাজুক হাসিটা কত সুন্দর। তুমি হয়তো জানো না তোমার এই লজ্জা মিশ্রিত রক্তিম মুখটা আমি কত ভালোবাসি। এই লজ্জা দেখার জন্য কতটা ছটফট করি।”
বাই দ্যা ওয়ে আমার শার্টে কিন্তু তোমাকে পাকা স্ট্রবেরি লাগছে।
লজ্জায় এবার দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেললো শ্বেতা।
অতিষ্ঠ কণ্ঠে বললো—
“প্লিজ থামুন আবির্ভাব…”
শ্বেতার লজ্জা দেখে হেসে ফেললো আবির্ভাব।
শ্বেতাকে তুলে বসলালো। দুষ্টু কণ্ঠে বললো—
“তুমি না বলেছিলে আসবে না, তাহলে এলে যে?”
শ্বেতা মাথা নুইয়ে জবাব দিলো—
“আপনি খুব খারাপ জানেন, আপনার জন্য আমাকে কতগুলো মিথ্যে কথা বলতে হলো।”
আবির্ভাব ঠোঁট বাকিয়ে হেসে বললো—
“ও মাই লাভ, তুমি মিথ্যে বলতেও জানো! তোমার এই গুনের ব্যাপারে তো জানা ছিল না। সে যাই হোক, এই অধমকে আবার কখনো মিথ্যে বলবে না যেন। এমনিতেই বুদ্ধি কম।”
শ্বেতা ভ্রু কুঁচকে তাকালো আবির্ভাবের দিকে। মনে মনে ভাবলো—
“একটা মানুষ এতটা মিচকে সয়তান হয় কিভাবে!”
শ্বেতা অযথা কথা বাড়ালো না, নীরব হয়ে আবির্ভাবকে মন ভরে দেখতে লাগলো।
রসিকতা করছে বটে তবে আবির্ভাবকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। কখন ফিরেছে কে জানে, এখনো হাসপাতালের পোশাক পাল্টায়নি। হাতে ঘড়ি, চুলগুলো এখনো সেট করা।
শ্বেতাকে এত মনোযোগ দিয়ে তাকাতে দেখে আবির্ভাব ঠোঁট কামড়ে হেসে বললো—
“কি মাই লাভ, আমাকে কি আজ একটু বেশি সুন্দর লাগছে ? তুমি চাইলে আরো ভালো করে দেখতে পারো, আমি মাইন্ড করবো না।”
আবির্ভাবের কথায় প্রচন্ড লজ্জা পেয়ে দৃষ্টি নত করলো শ্বেতা।
“এই লোকটার মুখে কিছু আটকে না।”
শ্বেতা লজ্জা মিশ্রিত কণ্ঠে বললো—
“যান, গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন। খাবার দিচ্ছি।”
আবির্ভাব তৎক্ষণাৎ বুকে হাত চেপে নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো—
“এভাবে জান ডেকো না মাই লাভ, হার্ট ব্যথা করে। এখন যদি আমার কিছু হয়, এখানে তোমার হিটলার ভাইও নেই, যে আমায় দেখবে?”
আবির্ভাবের কথায় আহাম্মক বনে গেলো শ্বেতা। হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে বললো—
“আপনাকে আবার কখন জান বললাম?”
আবির্ভাব লজ্জা পাওয়ার ভান ধরে বললো—
“এই তো এখনই আবার বললে। বেশি জান জান করো না জান, নাহলে কষে একটা চুমু খেয়ে দৌড় দিব। তখন আবার লজ্জা লুকোনোর জায়গা পাবে না।”
আবির্ভাবের কথায় কাশি উঠে গেলো শ্বেতার।
আবির্ভাব বাঁকা হেসে গুনগুনিয়ে গাইলো—
“বেবি জান বলেছে,
হ্যালো জান বলেছে,
বেবির মিষ্টি হাসির
খুনসুঁটিতে টান বেড়েছে,
বেবি জান জান –
ও বেবি জান জান।
বেবি জান জান বলে আমার জান নিয়েছে,
বেবি জান জান বলে আমার জান নিয়েছে,”
“কাম ডাউন মাই লাভ, জাস্ট একটা চুমু খাবো বলেছি, বলিনি তোমাকে খাবো। So chill.”
শ্বেতা ঢোঁক গিলে তাকালো।
আবির্ভাব ঠোঁট কামড়ে হেসে উঠে দাঁড়ালো। পাশের সোফা থেকে শ্বেতার হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বললো—
“তুমি এখানে রেডি হয়ে নাও, আমি ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
বলে যেতে নিলেই পিছন থেকে শ্বেতা বলে উঠলো—
“এটা তে কি আছে?”
আবির্ভাব দাঁড়িয়ে পড়লো, পুনরায় ঘুরে তাকিয়ে বললো—
“As a small gift for my love.”
শ্বেতা অবাক হলো। প্যাকেটের ভেতর হাত রাখতেই বেরিয়ে এলো একটা খুব সুন্দর সিম্পল সাদা রঙের লাল পাড়ের শাড়ি, সাথে ম্যাচিং লাল ব্লাউজ, পেটিকোট।
শ্বেতা বিস্ময়ে মুখ হাঁ হয়ে গেলো, গোল গোল চোখ জোড়া তুলে তাকালো আবির্ভাবের পানে।
আবির্ভাব মৃদু হেসে পুনরায় এসে শ্বেতার পাশে বসে পড়লো। মধুর কণ্ঠে শুধালো—
“পছন্দ হয়নি, মাই লাভ?”
শ্বেতা মুখে কিছু না বলে আচমকাই আবির্ভাবকে জড়িয়ে ধরলো।
থমকে গেলো আবির্ভাব। হৃদপিণ্ড ধুকধুক করতে লাগলো।
আবির্ভাব শুকনো ঢোঁক গিলে, গলা ভিজালো। কাঁপা হাত দুটো দিয়ে নিজেও জড়িয়ে ধরলো শ্বেতার পিঠ।
এই সামান্য ছোঁয়াটুকু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় আবির্ভাব দিন রাত গলা কাটা মুরগির মতো ছটফট করে। কী দহন যে বুকে পুড়েছে, তা কেবল আবির্ভাবই জানে। অথচ এই বেদনা কাউকে দেখানো যায় না।
মনোবিজ্ঞানের শত শত বই ঘেঁটে ও এই আকর্ষণের কোন কারণ খুঁজে পায়নি আবির্ভাব। আর যে সকল থিওরি পেয়েছে সেগুলো সে মানতে নারাজ।
অতচ ছোট্ট বুকে এই উত্তাল সাগরের পরিধি বাড়ছে দিন দিন। আবির্ভাব অজ্ঞ নয়—সে সব বোঝে, এটাও জানে ভবিষ্যতটা হয়তো তাদের জন্য সুখকর নয়।
তবু সে নিজেকে থামাতে পারে না। ভুল জেনেও ভুলটা করে ফেলে।
প্রথম দেখাতেই এক পঞ্চদশী কন্যাতে সে মন হারিয়েছিলো। সেদিন নিজেকে আটকাতে পারেনি, তাহলে আজ কীভাবে আটকাবে?
শ্বেতা শক্ত হাতে আবির্ভাবের পিঠ খামছে ধরলো। তখন আবেগ সামলাতে না পেরে জড়িয়ে ধরেছিলো। কিন্তু এখন বুকে থেকে মাথা উঠাতে লজ্জা লাগছে।
আর তার উষ্ণ নিঃশ্বাসের বর্ষণে আবির্ভাবের ভেতর অশান্ত হচ্ছে।
আবির্ভাব শ্বেতার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো—
“পছন্দ হয়েছে?”
“হুম…”
বুকে মাথা রেখে লাজুক কণ্ঠে জবাব দিলো শ্বেতা।
“আজকে কেন আসতে বলেছি জানো?”
“উঁহু।”
“আমি কাল ইন্ডিয়া চলে যাবো।”
আবির্ভাবের কথায় চমকে উঠলো শ্বেতা। অভিমানী কণ্ঠে বললো—
“কেন? আমি এখানেই আরো কিছুদিন থাকবো। এর পর যান প্লিজ। না হলে আপনাকে আর দেখতে পাবো না।”
আবির্ভাব মুচকি হেসে শ্বেতার মাথায় চুমু খেলো। আদুরে কণ্ঠে বললো—
“পাগলী মেয়ে, তুমি কি সারাজীবন এভাবেই থাকতে চাও? আমার হতে চাও না চিরতরে?”
আবির্ভাবের কথার মর্মার্থে গায়ের রোম খাড়া হয়ে গেলো শ্বেতার। অজানা অনুভূতির শিহরণ ছড়িয়ে পড়লো অঙ্গে।
“আবির্ভাব কি বলতে চাচ্ছে?”
ওর মনে মনে করা প্রশ্নের জবাবে আবির্ভাব বললো—
“কাল মহালয়া, এর পর দুর্গাপূজা—তুমি তো জানোই। বাবা-মা বাংলাদেশে থাকলেও আমাদের আসল বাড়ি শ্রীরামপুর। ওখানেই আমাদের দাদু-দিদা-কাকারা আছে। সারা বছর যে যেখানেই থাকুক, পূজোর চারটাদিন সবাইকে বাড়িতে থাকতেই হয়।
আর এবার আমার যাওয়ার অন্য একটা উদ্দেশ্য আছে।”
শ্বেতা আবির্ভাবের বুকে হারিয়ে গেলো। আনমনে বললো—
“কি?”
“আমি আমার পরিবারে তোমার কথা জানাতে চাই।”
আবির্ভাবের কথায় গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো শ্বেতার। ভয়ও পেলো খানিকটা।
কাঁপা কণ্ঠে বললো—
“কি বলছেন? উনারা কি মানবেন?”
আবির্ভাব নীরলিপ্ত কণ্ঠে জবাব দিলো—
“জানি না। কিন্তু আমার তোমাকে চাই। তারা আমার অভিভাবক, তাদের জানানো আমার কর্তব্য। ৩০ পেরিয়ে গেছে আমার, এখন তো বিয়ে করতেই হবে।”
শ্বেতার ভয়ে গলা শুকিয়ে গেলো।
আবির্ভাব শ্বেতাকে বুকে থেকে আলাদা করলো। দুই গালে হাত ছুঁইয়ে চোখ চোখ রেখে বললো—
“তুমি কি আমাকে বিয়ে করতে চাও না, মাই লাভ?”
আবির্ভাবের প্রশ্নে শ্বেতার চোখ টলমল করে উঠলো। জবাব দিতে পারলো না।
আবির্ভাব পুনরায় প্রশ্ন করলো—
“তুমি কি চাও না আমার কাছাকাছি আসতে? আমার হতে? আমার সাথে সাথে চিরতরে মিশে যেতে? তুমি কি চাও না আমার সংসার করতে?”
শ্বেতা আবির্ভাবের চোখে আর তাকিয়ে থাকতে পারলো না। দৃষ্টি নামিয়ে উপর-নিচে হ্যাঁ সূচক মাথা দোলালো।
আবির্ভাব খুশি হলো। আবারো শ্বেতাকে বুকে নিয়ে বললো—
“আমি তোমাকে সসম্মানে আমার করতে চাই মাই লাভ, আমি তোমাকে অবৈধ উপায়ে পেতে চাই না। আমি চাই না এই সমাজ তোমার দিকে একটু ও আঙুল তুলুক, একটু ও কুৎসা রটাক। আমি জানি না আমি কীভাবে, কী করবো। শুধু এটুকু জানি আমার তোমাকেই চাই—একেবারে নিজের করে চাই।”
শ্বেতার বুকে ভেতরটা কেমন সুখ সুখ আবহে ভরে উঠলো।
আবির্ভাব এবার একটু শয়তানি করে বললো—
“মাই লাভ, তুমি কি শাড়ি পরতে পারো তো? নাকি আমি হেল্প করবো?”
শ্বেতা লজ্জা পেয়ে আবির্ভাবকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিলো।
লজ্জায় গাল মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে।
আবির্ভাব বুকে হাত চেপে পাশে শুয়ে পড়ে বললো—
“হায়, আমার লজ্জাবতী! এই লজ্জা ভাঙানোর গুরু দায়িত্ব আমি যে, কবে পাবো?”
শ্বেতা এবার সাহস করে আবির্ভাবকে ঠেলে উঠিয়ে দিলো।
লজ্জা লুকিয়ে বললো—
“আরেকটা ও বেফাঁস কথা বলবেন না বদ লোক, ওয়াশরুমে যান। আমি নিজে নিজে শাড়ি পরতে পারি।”
আবির্ভাবও মাথা নুইয়ে বললো—
“জো হুকুম মহারানী!”
বলে উঠে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো।
শ্বেতাও কম কি! আবির্ভাবকে বাইরে থেকে লক করে দিলো, যাতে বেটা কোনো ভাবেই সুযোগ লুটতে না পারে।
শ্বেতা নতুন শাড়িটা হাতে নিয়ে ভাঁজ খুললো।
সত্যি বলতে শাড়িটা সিম্পলের মধ্যে ভীষণ সুন্দর।
এই ধরনের শাড়ি সাধারণত মুসলিম নারীদের পড়তে দেখা যায় না।
লাল পাড়ে সাদা রঙের শাড়ি সাধারণত হিন্দু ধর্মের একটি ঐতিহ্যবাহী পোষাক। হিন্দু নারীরা এটি পুজো-পার্বণের দিনে পরে থাকেন।
শ্বেতা ব্লাউজ, পেটিকোট পরে শাড়িটা গায়ে জড়াতে নিলেই ওয়াশরুমের ভেতর থেকে আবির্ভাবের কণ্ঠ পাওয়া গেলো
“মাই লাভ, দরজা খুলো! বাইরে থেকে লক করেছো কেন?”
কিন্তু আবির্ভাবের কথা শুনেও না শোনার ভান করলো শ্বেতা।
আবির্ভাবকে একটুও পাত্তা না দিয়ে সুন্দর মতো কুঁচি করতে লাগলো।
আর এদিকে আবির্ভাব দরজা ধাক্কিয়েই যাচ্ছে—
“মাই লাভ, দরজা খুলো! I want to see you.”
শ্বেতা বাইরে থেকে মুখ বেঁকিয়ে বললো—
“আপনার মতলব কি আমি জানি না ভেবেছেন, চরিত্রহীন পাগলের ডাক্তার!”
আবির্ভাব ভেতর থেকে বললো—
ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৬২
“এই না কটকটির মা! একদম চরিত্র নিয়ে খোঁটা দেবে না, না হলে সত্যি সত্যি চরিত্রহীন হয়ে যাবে!”
শ্বেতা মুখ বেঁকিয়ে বললো—
“তা আপনি নিজেকে চরিত্রবান মনে করেন বুঝি?”
আবির্ভাব ভেতর থেকে আর জবাব দিলো না।