ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৭
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই
প্রিয়তা কে নিয়ে বেরিয়ে গেল প্রণয়। প্রনয় যেতেই সেখানে শুদ্ধ এসে উপস্থিত হলো। শুদ্ধ ও প্রণয়ের মতোই সেই একই রকম দৃষ্টিতে তাকালো লোকগুলোর দিকে। ভয় কাঁপছে তারা, শুদ্ধর ভয়াবহ হিংস্র দৃষ্টি দেখে।
ওই দৃষ্টির পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে হিংস্রতা।
সে গিয়ে তাদের সামনের চেয়ারে পায়ে পা তুলে বসে অকথ্য কয়েকটা গালি দিয়ে বলল, “তোদের কে পাঠিয়েছে?”
ছেলেগুলো চুপ করে আছে দেখে, শুদ্ধ একটার মুখ বরাবর লাথি দিল। সে ভালোই বুঝতে পেরেছে, এদের কে পাঠিয়েছে। তাদের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল—
এটাই তদের শেষ রাত”শেষবারের মতো আল্লাহকে ডেকে নে, কারণ তোরা নিজেও জানিস না, কার কলিজায় হাত দিয়েফেলেছিস!”
বলে সে চলে গেল।
এতক্ষণ শিকদার বাড়ির পরিবেশ জমজমাট ছিল । সবাই হৈ-হুল্লোড় করছে। সাদিকের শালা-শালিরা মিলে তাকে ফতুর করে দিয়েছে । বিয়ের মিটে যাওয়া অনেকেই নিজের বাড়িতে চলে গেছেন, তাই অন্যান্য দিনের তুলনায় আজকে লোক সমাগম কিছুটা কম। রাত তখন ১টা, পরিনীতার চিন্তায় গলা বেয়ে দরদর করে ঘাম ছুটছে , কারণ সে সারাবাড়ি খুঁজে ও প্রিয়তাকে কোথাও পায়নি। গত ৫ ঘন্টা হলো , প্রিয়তাকে সে সারাবাড়ির কোথাও দেখতে পায়নি। বিয়ে বাড়ির হৈহুল্লোড়ময় পরিবেশ অনেকটাই শান্ত। সবাই গভীর তন্দ্রাচ্ছন্ন, শুধু ঘুম নেই তার চোখে।
সে কাকে বলবে এই কথা? এই সব ভেবে সে অস্থির হয়ে গেল কিছু একটা ভেবে বড় দাদানকে ফোন করবে ভাবলো , কারণ আগে এই বাড়িতে প্রিয়তাকে সব থেকে বেশি ভালোবাসতো বড় দাদান। কিন্তু এত রাতে বড় ভাইকে ফোন করতে ও সংকোচ বোধ হচ্ছে। প্রণয় ওর নিজের মায়ের পেটের ভাই সে ভাইয়ের মনের ভাব বোঝে না এমনটা নয় সে সবই বোঝে, কিন্তু কিছু করার নেই যে! প্রিয়তার বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে মাঝে মাঝে খুব রাগ হতো ভাইয়ের ওপর, কিন্তু তার এত সাহস কোথায় ভাইকে প্রশ্ন করার?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সে ভাবলো, একবার দাদানকে গিয়ে ডাকবে, কিন্তু প্রহেলিকা কি মনে করবে ভেবে আর গেল না। এতো কিছু না ভেবে সে প্রণয়ের নম্বরে ফোন করলো। ফোনটা রিং হতে হতে কেটে গেল।
সে এখন কী করবে?
সে আবারও প্রণয়ের নম্বরে ফোন করলো। প্রণয় এক হাতে প্রিয়তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ড্রাইভ করছিল। বাবার বোনের ফোন আসতে দেখে বিরক্ত হলো। এক হাতে ফোনটা ধরলো। সে কিছু বলার আগেই পরিণীতা উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললো,
— দাদান!
প্রণয় বুঝলো বোনের কণ্ঠ কাঁপছে। প্রণয় বললো,
— কিছু বলবি?
পরিণীতা বললো,
— দাদান, আমি প্রিয়োকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না!
প্রণয় দীর্ঘশ্বাস ফেললো,
— খুঁজিস না, ও আমার সঙ্গেই আছে।
পরিণীতাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফোন কেটে দিয়ে মোবাইল সুইচ অফ করে দিল। নিজের বুকে অপার্থিব শান্তি আর উষ্ণতা অনুভব করছিল সে, যার জন্য গত ২২ মাস তার হৃদয় ভীষণ পুড়েছে। এখন এই হৃদয় হরনী কে বুকে দেখে ভিতরটা প্রশান্তিতে ভরে গেল।
এই ২২ মাস সময় টাকে তার ২২ বছর দীর্ঘ মনে হয়েছে। প্রণয়ের কাছে মনে হলো কত বছর পর যেন মরুর বুকে এক ফোঁটা শীতল জলের বৃষ্টিধারা নেমেছে। কত শতবার যে ইচ্ছে হতো , এই তুলোর মতো দেহটাকে নিজের বুকে চেপে ধরে রাখতে… কিন্তু!
দীর্ঘনিশ্বাসে বেরিয়ে এলো চপা কিছু অব্যক্ত আর্তনাদ। প্রিয়তার এখনো জ্ঞান ফেরেনি, তাই সে এত নিশ্চিন্তে তাকে বুকে চেপে রেখেছে। মন বলছে, “সময়টা এখানেই থেমে যাক!”
কিন্তু তা তো আর হওয়ার নয়।
প্রিয়তার চুলের খোঁপা খুলে দীঘল কালকেশ রাশি গাড়ির সিটের নিচ পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছে । প্রণয় গাড়ি ব্রেক করলো। চুলগুলো নিজের হাতে পেঁচিয়ে নিয়ে নাকের কাছে ধরলো। চুল থেকে ছুটে আসা সেই অতি চেনা সুমিষ্ট গন্ধটা ভেসে আসছে—যা প্রণয়ের কাছে মাদক দ্রব্যের চেয়ে কোনো অংশে কম নয় বরং বেশি বলা যেতে পারে।
প্রিয়তার নিস্তেজ মুখটা দেখে ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে। সে আর দেরি করলো না। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ১৫ মিনিটের মধ্যেই তাদের বাগবাড়িতে পৌঁছে গেল।
একজন দারোয়ান ছুটে এসে গেট খুলে দিলেন।
দুই তলা বিশিষ্ট বিশাল বাগানবাড়ি, চারপাশে জঙ্গল আর সবুজে ঘেরা। কিন্তু এই মধ্যরাতে সবকিছুই ভূতুড়ে লাগছে। আশেপাশে থাকলে পিলে চমকে যাবে !
প্রণয় প্রিয়তাকে কোলে তুলে নিয়ে বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেল। কেয়ারটেকার আর তার স্ত্রী অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন তাদের দিকে।
অন্যদিকে, তাদের গোপন আস্থানায় কয়েকজন মিলে তুমুল ঝগড়া করছিল। শুদ্ধর মাথার শিরাগুলো ফুলে দপ দপ করছে, চোখ-মুখ অস্বাভাবিক লাল। সে আর কোনোভাবেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না । কথায় আছে না দুর্বল জায়গায় আঘাত পেলে মানুষ হিংস্র হয়ে ওঠে শুদ্ধর ও একি অবস্থা হল –
সে মেয়েটির চুলের মুঠি ধরে বলে উঠলো—
— “তোর সাহস হয় কী করে?!”
আমার ভালোবাসায় হাত দেওয়ার বলেই গলা টিপে ধরলো। সাথের দু’জন ছুটে এসে তাকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো। তারাও ভীষণ খেপে আছে, শুদ্ধ অশ্রাব্য ভাষায় গালি-গালাজ করছে।
সামনের মেয়েটা ফুঁসে উঠে বললো, “ওর জন্য আমি সব কিছু পেয়েও পাচ্ছি না! ও যদি না থাকে, তাহলে সব কিছুই আমার হবে!”সর্বোপরি প্রণয় আমার হবে।
আমি সব সময় প্রনয়ের চোখে শুধু ওর জন্য ভালোবাসা দেখতে পাই এই সব সহ্য হচ্ছে না আমার।
শুদ্ধ একটা বিশ্রী গালি দিয়ে বললো, “এইজন্যই প্রণয় তোকে কোনোদিনও ভালোবাসেনি!”
এই কথা শুনে মেয়েটার চোখ লাল হয়ে গেল। শুদ্ধ বললো, “সালী, তোকে আমি সবকিছু পাইয়ে দিয়েছি, আর তুই আমার জানটা ধরে টানাটানি করছিস! আজকে তোকে আমি খুন করে ফেলবো!” বলে আবার তেড়ে গেল।
সবাই আবার আটকালো। শুদ্ধ রাগে ঠোঁট কাঁপছে, সে বললো, “সে বলল তোর চোদ্দো গুষ্টির কপাল ভালো যে এখানে আমার জায়গায় প্রণয় নেই। না হলে তোর এমন হাল করে দিতো তুই নিজেই নিজের চেহারাটা আনে দেখতে চাইতি না !”
মেয়েটা রেগে বলে উঠলো, “ওই মেয়ের মাঝে কী এমন আছে, যার জন্য সব পুরুষদের মাথা নষ্ট ? কি এমন দেখায় সবাইকে? আমি কি কম সুন্দরী?”
শুদ্ধ তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, “কাক আজীবন কাকই থাকে। কাক ময়ূরের পালক গায়ে দিলেই তো আর ময়ূর হয়ে যায় না। তুই তো আমার থেকেও বেশি নিকৃষ্ট!”
“আজকে যে ভুলটা করেছিস, সেটা দ্বিতীয়বার করতে আসলে, I promise, আমি তোকে মারবো না! প্রণয়কে শুধু সব সত্যিটা বলে দেবো!”
এই কথা শুনে মেয়েটার সর্বাঙ্গে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়ে গেল। প্রণয় যদি কোনোদিন এতটুকুও কিছু জেনে যায়! সেটা ভেবে সে আবার ভীতিগ্রস্ত হলো। ওর মুখের এক্সপ্রেশন দেখে শুদ্ধ বাঁকা হেসে বেরিয়ে গেল।
তার বুকে ভিশন যন্ত্রণা হচ্ছে। হতে পারে সে আস্ত শয়তান, কিন্তু সে ও তো মানুষ! তার মনও তো আছে! আর সে তো আগে এমন ছিল না নিজের ভালোবাসাকে নিজের করে পাওয়ার জন্য তাকে শুধু এতটা খারাপ কেনো পৃথিবীর সব থেকে নিকৃষ্ট কিট হতে হলেও সে রাজি আছে। প্রণয় তো একা ভালোবাসেনি, সেও তো ভেসেছে, পাগলের মতো ভালোবেসেছে!
তাহলে ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার তার কেনো থাকবে না। অতচ প্রণয় তাকে কোনোদিনও তার প্রিয়তার আশেপাশে ঘেঁষতে দিতো না, সবার থেকে আলাদা করে লুকিয়ে রাখতো ! ভালোবাসার যন্ত্রণায় সে যে কত বছর তড়পেছে, নির্ঘুম রাত পার করেছে! সেটা শুধু সে আর তার আল্লাই ভালো জানেন।
এত কষ্ট সহ্য করার পর ফাইনালি সে একটা সুযোগ পেয়েছে, সবসব কিছুর প্রতিশোধ নেওয়ার! ভালোবাসাকে প্রণয়ের বুক থেকে কেড়ে নিয়ে নিজের বুকে স্থাপন করার! আর সে তার প্রথম চালটা চেলে দিয়েছে,, প্রণয়ের প্রতি তার এক আকাশ পরিমাণ বিতৃষ্ণা!
প্রণয়ের জন্য সে যত কষ্ট পেয়েছে, প্রণয়কে তার হাজার গুণ করে ফিরিয়ে দেবে। এমন অবস্থা করবে যে প্রণয় না পারবে গিলতে আর না পারবে উগরাতে!
সর্বশেষে, ওই নারীটি প্রণয়ের রক্ত জবা থাকবে না—তার সুইটহার্ট হবেই থসবে! বলে বাঁকা হাসলো।
আজকে সে প্রণয়কে ওভাবে ছুটে যেতে দেখে, সে কিছু একটা আন্দাজ করেছিল — তই সে প্রনয়ের পিছু নিয়েছিল সবটাই দেখেছে প্রণয়ের এক-একটা আর্তনাদ তার বুকে সুখের বৃষ্টি নামিয়েছিল। শত্রুকে ভালোবাসার জন্য ছটফট করতে দেখে সে যে সুখটা অনুভব করেছে সেটা সে কোনদিন ও অনুভব করেনি !
কিন্তু সে এখন কিছু একটা ভেবে চিন্তায় পড়ে গেল।
প্রণয় প্রিয়তাকে একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে বেডের উপর শুইয়ে দিল। কেয়ারটেকারের স্ত্রীকে ডেকে ওয়ার্ডরোব থেকে একটা ওভারসাইজ টি-শার্ট আর একটা শর্টস হাতে দিয়ে বললো, “ওকে চেঞ্জ করিয়ে দিন, আমি বাইরে আছি।”
বলে সে বাইরে চলে গেল।
তিনি প্রিয়তার কাছে গেলেন। তিনি প্রিয়তাকে চেনেন। সেজো কর্তার মেয়ে! ভীষণ মায়াবী দেখতে মেয়েটাকে। কিন্তু এই সুন্দর মেয়েটার কী হয়েছে? জানতে ইচ্ছে হলো।
কিন্তু প্রণয় শিকদারকে কিছু জিজ্ঞেস করার দুঃসাহস তো তার নেই! তাই তিনি চুপচাপ মেয়েটার কাপড় পরিবর্তন করিয়ে দিলেন।
তিনি কিছু একটা লক্ষ্য করে অবাক হলেন।
কিন্তু কাজের লোকদের মালিকের ব্যাপারে নাক গলানোর অধিকার শিকদাররা দেন না। তাই তিনি আর এই নিয়ে কিছু ভাবলেন না।
ঘর থেকে বেরিয়ে এসে প্রণয়কে বললেন, “বড় ভাইজান, আপামনির কাপড় পরিবর্তন করে দিয়েছি।”
প্রণয় ঘরে…ঢুকতেই থমকে গেল প্রণয়।
তার কালো রঙের টি-শার্টটা প্রিয়তার হাঁটুর নিচে নেমে গেছে, আর শর্টসটা পায়ের গোঁড়ালির অনেকটাই নিচে! কোথায় ৬ ফুট ১ আর কোথায় ৫ ফুট ২—এমনটা তো হওয়ারি কথা !
যাই হোক, মেয়েটাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে।
প্রণয় এক পা, দুই পা করে এগিয়ে গেল। প্রতিটি ধাপে তার হৃদপিণ্ড লাফাচ্ছে।
সে প্রিয়তার মুখের সামনে বসলো। কে জানে কতক্ষণ অপলক তাকিয়ে ছিল সেই মায়াবী মুখের দিকে!
জানা নেই, প্রণয় ভাবলোত তার মনে এত কেন তৃষ্ণা! যতই দেখে, এই তৃষ্ণা যেন মিটতেই চায় না।
সে হাত বাড়িয়ে দিল, প্রিয়তার গালে।
নরম তুলতুলে গালটায় স্পর্শ করলো।
কেউ এতটা নরম হতে পারে?
হ্যাঁ, হতে পারে!
প্রণয়ীর গাল!
সে মুখ এগিয়ে নিল, ধীরে… সময় নিয়ে, ভালোবাসার স্পর্শ এঁকে দিল প্রিয়তার কপালে।
আগেও যেমন নির্দ্বিধায় প্রিয়তাকে স্পর্শ করতো, এখনও করে। কারণ তার বিশ্বাস মতে, সবকিছু পাপ হলেও ভালোবাসা পাপ নয়!
তার হৃদয়ে এই নারীর জন্য যে ভালোবাসা জমে আছে, তাতে এই নারীকে পানিতে গুলে খেলেও মন ভরবে না!
পরপর সে বন্ধ চোখের পাতায়ও চুমু খেলে।
তাদের সম্পর্কের সামাজিক দূরত্ব বেড়েছে হাজার আলোকবর্ষ!
কিন্তু মনের দূরত্ব?
সেটা কখনোই ছিল না, আর না তো কোনোদিন হবে!
ভালোবাসা এমন এক জিনিস, যা পাওয়ার চেয়ে হারালে বেশি বাড়ে!
তাই প্রণয় আর প্রিয়তা, দুজনেই অনুভব করছে তাদের ভালোবাসার গভীরতা।
প্রণয় আজ সারাদিন অনেক ক্লান্ত ছিল। রাতের ঘটনার সময় মনে হচ্ছিল, সে এখনই মরে যাবে।
কিন্তু এত কিছুর পর মেয়েটাকে এত কাছে দেখে তার ক্লান্তি, বিষণ্নতা—কিছুই আর নেই!
প্রণয়ের এইসব ভাবনার মাঝেই প্রিয়তা পিটপিট করে তাকালো।
একটা দৃষ্টি…
প্রণয় এক ঝটকায় দূরে সরে গেল।
আগের ফর্মে ফিরে এলো।
চোখ-মুখ অনুভূতিশূন্য!
প্রিয়তা চোখ খুলে সামনে থাকা মানুষটাকে দেখে ছটফট করে উঠলো!
তার কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে আসছে!
সে তখন কাঁদতে পারেনি, কিন্তু এখন…
এখন এই মানুষটাকে একটু ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। নীলাভ চোখদুটো ছলছল করতে দেখে প্রণয় ভিতর ভিতর অস্থির হয়ে উঠলো, কিন্তু মুখে তা প্রকাশ না করে অত্যন্ত সাবলীল ভঙ্গিতে বললো,
“রক্তজবা…”
প্রিয়তা প্রণয়ের চোখের দিকে তাকালো। প্রণয়কে কিছু বুঝে ওঠার সুযোগ না দিয়েই নিজেই ঝাপিয়ে পড়লো তার বলিষ্ঠ বুকে।
প্রণয় একটু থমকালো।
প্রিয়তা সেই ছোট বেলার মতো প্রণয়ের শার্ট খামচে ধরে জড়িয়ে জড়িয়ে কাঁদছে। প্রণয়ের শার্টেই নাকের পানি, চোখের পানি সব মুছে নিচ্ছে।
প্রিয়তার কান্না দেখে প্রণয়ের কলিজাটা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে। বলতে ইচ্ছে করছে, “এই মেয়ে, শুনো! তুমি কেঁদো না… তুমি কাঁদলে আমার অনেক কষ্ট হয়।”
প্রিয়তা শার্ট ছেড়ে পিঠ জড়িয়ে ধরলো। কিন্তু ভালোভাবে ধরতে হলে তাকে একটু বেগ পেতে হচ্ছে।
এই কান্নায় শুধু আজকের ভয়ের ছাপ নেই। গত ২২ মাসের জমে থাকা সমস্ত কান্নাই যেন নোনা পানির স্রোত হয়ে নেমে আসছে।
এই প্রায় দুই বছরে কত শতবার ইচ্ছে হয়েছে এই মানুষটার বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে! কিন্তু সে পারেনি। কী ভীষণ যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে!
কিন্তু আজ আর সে নিজেকে সামলাতে পারলো না।
বাহুবন্ধনে আবদ্ধ ছোট্ট দেহটা তিরতির করে কাঁপছে। কান্নার তীব্রতায় হেঁচকি উঠে গেছে।
প্রণয় যতটা সম্ভব নিজেকে সামলে নিয়ে প্রিয়তার মাথায় হাত রাখলো। ধীরে ধীরে তাকে নিজের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিলো।
প্রিয়তা এতে অনেক কষ্ট পেলো। মনে মনে বললো,
“আমি তো তোমার কাছে কিছু চাইনি, প্রণয় ভাই।
শুধু একটু কেঁদে নিজেকে হালকা করতে চেয়েছিলাম।
কিন্তু তুমি প্রমাণ করে দিলে, আমার জন্য তোমার মনে সামান্য মায়াটুকুও নেই।”
তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে মনে মনে বললো,
“থাকার কথাও তো নয়!
ভালোবাসা তো শুধুই আমার একার।
তুমি তো অন্য নারীর স্বামী…”
“আমাকে কেন কাঁদতে দেবে তোমার বুকে?”
প্রণয় সরিয়ে দিয়ে আলতো হাতে চোখ মুছে দিলো, তারপর বললো,
“কিছু হয়নি তোর, আমি আছি। তুই রেস্ট নে, আমি আসছি।”
বলে বাইরে চলে গেল।
প্রিয়তা বালিশে মুখ গুঁজে দিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো। সে বারবার ভুলে যায় যে এই মানুষটা তার নয়।
রাত ৪টা ২০ মিনিট
প্রণয় বাইরে এসে পাশের দেয়ালে জোরে জোরে কয়েকটা ঘুষি মারলো। মনে মনে বললো,
“যদি পারতাম,
তোর হাতে আমার কলিজাটা তুলে দিয়ে বলতাম—
দেখ!
সেখানে ছাই ছাড়া আর কিছু নেই!”
প্রণয় নিজেকে সামলালো। পাশের ঘর থেকে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে আবার রুমে ফিরলো।
প্রিয়তা উপুড় হয়ে শুয়ে আছে।
প্রণয় পাশে বসলো। ধীরে ধীরে টি-শার্টটা পিঠের দিকে একটু তুললো।
ক্ষতগুলো চোখে পড়তে মস্তিষ্কে হিংস্রতা জেগে উঠলো।
কে যেন জামাটা তুলে দিয়েছে, বুঝতে পেরে প্রিয়তা লাফিয়ে উঠে পিছনে ফিরে চাইলো।
প্রণয় শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
প্রিয়তা চোখ নামিয়ে নিয়ে বললো,
“আমি পারবো…”
প্রণয় কপালে ভাঁজ ফেলে তুলোয় স্যাভলন লাগিয়ে প্রিয়তার হাতে দিলো।
প্রিয়তা হতভম্ব হয়ে গেল। সত্যিই তো, সে তো নিজের পিঠ দেখবে কি করে!
অথচ, পিঠটা ব্যথায় চেয়ে যাচ্ছে!
প্রণয় বললো, “কি হলো? লাগা!”
প্রিয়তা মাথা নিচু করে নিলো। ওর থেকে তুলো নিতে নিতে প্রণয় বলে উঠলো,
“তুই এতটাও বড় হয়ে যাসনি!”
প্রণয়ের কথার অর্থ বুঝতে পেরে প্রিয়তার মনে হলো ভিতরটা কেউ খামচে ধরেছে।
সে মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো,
সবকিছু কেন এভাবে বদলে গেল প্রণয় ভাই !
যদি সেই ছোটবেলাটা না যেত…
বা সেই মধুর দিনগুলো আবার ফিরে পেতাম…
আপনি শুধু আমারই থাকতেন!”
এইসব ভাবতে ভাবতেই চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো প্রণয়ের হাতে।
প্রণয় দেখলো কয়েক পলক প্রিয়তার চোখের দিকে।
সে বুঝতে পারলো, তার প্রিয়তোমা কী ভাবছে।
প্রণয়ও মনে মনে সম্মতি জানিয়ে বললো,
“ঠিকই বলেছিস…
সেই দিনগুলো যদি আবার ফিরে পেতাম…
আগের চেয়েও অনেক বেশি তোকে আগলে রাখতাম…
না না, তোকে নিয়ে দূরে চলে যেতাম…
আর এইসব বিষাক্ত দিন আসতোই না!”
প্রণয় প্রিয়তার টি-শার্টটা তুললো।
পিঠে পুরুষালি স্পর্শ পেতেই প্রিয়তার সারা শরীর শিরশির করে উঠলো।
অত্যন্ত ফর্সা পিঠে আঘাতের দাগগুলো কালচে-নীল হয়ে আছে।
কয়েক জায়গায় ছিঁড়ে গেছে।
ভিতরটা জ্বলে উঠলো প্রনয়ের।
তুলোটা একটু চেপে ধরতেই প্রিয়তা চিৎকার করে আবার কেঁদে দিলো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল প্রণয়ের গলা।
এবার আর প্রণয় সরিয়ে দিলো না, বরং আরও কাছে টেনে নিলো।
ধীরে ধীরে ক্ষতগুলোর ওপর স্যাভলন লাগিয়ে টি-শার্টটা নামিয়ে দিলো।
তারপর বললো, “ঘুমিয়ে পড়ো, রক্তজবা…”
প্রিয়তা নীলাভ চোখে তাকালো।
কিন্তু হায়!
কোনো অনুভূতি দেখতে পেলো না।
প্রিয়তা মাঝে মাঝে নিজের কাছেই খারাপ মেয়ে মনে হয়।
সে একটা বিবাহিত পুরুষের মাঝে ভালোবাসা খুঁজেছে!
এইসব ভাবতে ভাবতেই তার চোখ বন্ধ হয়ে এলো।
অন্যদিকে…
ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৬
প্রণয় বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে আছে।
ধীরে ধীরে সূর্যের আলো ফুটছে।
পৃথিবীতে আরেকটি নতুন দিনের সূচনা হলো…