ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৬৬ (২)

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৬৬ (২)
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই

ড্রেস, কসমেটিক্স, জুয়েলারিস সহ যাবতীয় সবকিছু কেনা প্রায় শেষের দিকে। দিনের শেষ ভাগ চলমান, বাহিরের নীলচে আকাশ ছেয়ে গেছে নরম কমলা রঙা আভায়। বেলা দেখে বোঝা যায় কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো সূর্য অস্ত যাবে। সারাদিন কেনাকাটার ধান্ধায় সেই যে সকাল বেলা নাশতা করে সকলে এক সাথে বাসা থেকে বেরিয়েছিল, ব্যাস এর পর আর কারো কিচ্ছু খাওয়া হয়নি; বাচ্চাগুলো খিদেতে মুশরে পড়েছে প্রায়। সকলের মুখের এমন বেহাল দশা দেখে অনুস্রী বেগমের বেশ মায়া হলো। তিনি অরণ্যর উদ্দেশ্যে বললেন,
“যা তো বাবা, ভাই-বোনদের কিছু খাইয়ে আন। ওদের সকলেরই খিদে পেয়েছে। বাসায় ফিরতে অনেক রাত হবে।”
অনুশ্রী বেগমের মুখের কথা খষতে দেরি, কিন্তু তন্ময়ের বিকট লাফ দিয়ে বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেরি হল না। সে পেট চেপে ধরে বললো,

“হ্যাঁ হ্যাঁ পার্টনার, তাড়াতাড়ি চলো খেয়ে আসি। নাহলে আমার পেটের হাতিগুলো এবার মারামারি শুরু করে দেবে।”
অরণ্য সম্মতি জানিয়ে বললো ,
“ওকে, কোন রেস্টুরেন্টে যাবি?”
তন্ময় ২ সেকেন্ড ভেবে বলল,
“আসার সময় বাইরে একটা জোস চাইনিজ রেস্টুরেন্ট দেখে আসছি, চলো, ওখানেই যাওয়া যাক।”
অরণ্য কিছু বলার আগেই রাজ নাক শিটকালো, ওয়াক তুলে বললো,
“ছি ইউ, তুই চাইনিজ খাবি?”
রাজের রিঅ্যাকশন দেখে তন্ময় ভ্রু কোঁচকালো, সিরিয়াস মুখে বলল,
“হ্যাঁ খাব, তো কি হয়েছে?”
রাজ এবার চোখের ইশারায় থিরা কে কিছু একটা বোঝালো সবার মাঝে দাঁড়িয়ে চিৎকার দিয়ে বলল,
“অ্যাটেনশন গাইজ, তোমরাও কি চাইনিজ খেতে চাও?”
অন্যরা বলার আগেই থিরা বলে উঠলো,
“চাইনিজে কি কি আইটেম থাকে সেজদা?”
রাজ এবার শয়তানি হাসলো,
“অনেক অনেক লোভনীয় আইটেম থাকে।।
“যেমন”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“যেমন – সান্ডা বিরিয়ানি, সাপের কালো ভুনা, তেলাপোকার চচ্চড়ি, টিকটিকির ডিমের সরবত, বিছে ফ্রাই, পিঁপড়ের পাকোড়া, কুত্তার মাংসের ভুনা খিচুড়ি ইত্যাদি।”
খাবারের নাম শুনে সকলের পেটের ভিতর পাক দিয়ে উঠলো। তন্ময় কটমট চোখে তাকালো রাজের দিকে।
অনুস্রী বেগম ছেলেকে ধমকে বললেন,
“এতো বড় হয়েছো, এখনো বদমাইশি কমলো না! যাও, ভাই-বোনদের কিছু খাইয়ে নিয়ে আসো।”
মেহজাবিন চৌধুরীও বললেন,
“হ্যাঁ হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি যাও। এ ছাড়া ছোট ছোট বাচ্চাগুলো আছে, ওদেরও তো কিছু খাওয়া হয়নি।”
শুদ্ধ সকলকে নিয়ে যাও শুদ্ধ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।
অনুস্রী বেগম বললেন,

“দেখিস বাবা, এই বাঁদরগুলোকে আমার কোন বিশ্বাস নেই। এগুলো যেন কোনো বদমাইশ করার সুযোগ না পায়।”
শুদ্ধ পুনরায় মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। রাজ ও থিরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে বিশ্বজয়ের হাসি দিল, কারণ তাদের চাইনিজ পছন্দ নয়। অনেক কথাবার্তার পর বড়দের ফেলে ছোটরা সকলে চলে গেল পেট পুজো সারতে, সকলেরই পেটের ভেতর হাতি দৌড়াদৌড়ি করছে।
“আহা, না না বাবা, কাঁদে না, এইতো আছি, এই তো। দেখো, আল্লাহ আল্লাহ, সোনা ছেলে, কাঁদে না বাচ্চা।”—বলে অভিরাজকে কোলে নিয়ে রেস্টুরেন্টের বাইরের মেন এন্ট্রান্সে পায়চারি করতে লাগলো প্রিয়তা। কিন্তু বাচ্চাটা কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না। প্রিয়তার কাঁধে মাথায় হেলিয়ে এক নাগারে কেঁদেই চলেছে।
যমুনা ফিউচার পার্কের অপজিটে একটা মেক্সিকান রেস্টুরেন্টে খাবার খাওয়ার উদ্দেশ্যে ঢুকেছে সকলে। কিন্তু খাওয়ার মাঝেই হঠাৎ কান্নাকাটি শুরু করে দেয় অভিরাজ। তাকে উপস্থিত সকলেই শান্ত করার চেষ্টা করেন কিন্তু সে কারো কোলেই বসতে রাজি হয় না। অতঃপর বাধ্য হয়ে প্রিয়তা তাকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছে।
প্রিয়তা অভিরাজকে নিয়ে পায়চারি করছে আর পিঠে মৃদু চাপড় মারতে মারতে আদুরে কণ্ঠে বলছে,
“লক্ষী ছেলে কাঁদে না। এইতো আমরা একটু পরই মাম্মার কাছে চলে যাবো। আমার বাবাটা লক্ষী না, কাঁদে না সোনা।”

কিন্তু অভিরাজের থামার কোনো লক্ষণ নেই; অতিরিক্ত কান্নার তোড়ে বাচ্চাটার ফর্সা মুখখানি লাল টুকটুকে হয়ে গেছে।
“এই যে মাইয়া, শোনো—তোমাকে না খুব চেনা চেনা লাগছে।”
আচমকা কারো কণ্ঠে থেমে গেলো প্রিয়তার পা। অভিরাজের পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে অন্যমনস্ক ভাবে পেছন ফিরে তাকালো সে। তার থেকে কয় হাত দূরে চশমা পরিহিত একজন ৬০ ঊর্ধ্ব মহিলা দাঁড়িয়ে কেমন চোখে যেন থাকিয়ে আছেন ওর দিকেই। ভদ্রমহিলাকে চিনে ফেলতেই গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেলো প্রিয়তার, ভয়ে হৃৎপিণ্ড ধুকপুক করতে লাগলো। ভদ্র মহিলা চোখের হাই পাওয়ারের চশমা ঠেলে এগিয়ে এলেন প্রিয়তার নিকট। প্রিয়তা তটস্থ চোখে আশেপাশে দেখলো কেউ আছে কিনা।
ভদ্রমহিলা কাছে এসে কয়েক পল নিশ্চুপ থাকলেন। প্রিয়তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত গভীর চোখে নিরীক্ষণ করে হঠাৎ বলে উঠলেন,

“হ্যাঁ, মনে পড়ছে! তুমি ওই মাইয়াটা না, যে ৩–৪ বছর আগে আমাদের বাড়িতে এসেছিলে?”
প্রিয়তা আতঙ্কিত নয়নে আশেপাশে দৃষ্টিবুলিয়ে ছোট্ট করে জবাব দিল,
“জ্বী।”
ভদ্র মহিলা প্রিয়তাকে আরো অভিজ্ঞ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে বললেন,
“হ্যাঁ, তুমি তো সেই ঝড়বৃষ্টির রাতে আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলে তোমার স্বামীর সাথে। তুমি তো ছিলে, তাই না?”
সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে ইঙ্গিত করে “স্বামী” সম্মোধন শুনে প্রিয়তার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো। কি বলবে সে?
প্রিয়তা নম্র কণ্ঠে জবাব দিলো,
“জ্বী, আমি ছিলাম।”

নিশ্চিত হতে পেরে যেন প্রসন্ন হলেন ভদ্র মহিলা। ধীর কন্ঠে বললেন,
“আসলে তোমাকে অনেকক্ষণ থেকে দেখছিলাম। খুব চেনা চেনা লাগছিলো, কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না কোথায় দেখেছি। আসলে বয়স হয়েছে তো।”
প্রিয়তা সৌজন্যমূলক হাসলো। ভদ্র মহিলার এবার নজর পড়লো প্রিয়তার কোলে। তিনি অভিরাজকে দেখে বললেন,
“এটা তোমার বাচ্চা? মাশাল্লাহ মাশাল্লাহ।”
ওনার কথায় প্রিয়তার মুখ হাঁ হয়ে গেলো। উনার এই আন্দাজের কারণ হিসেবে মনে পড়ে গেলো চার বছর আগের সেই রাতে বলা একটা কথা—
“তা বাচা, তুমি কয় মাসের পোয়াতি?”
—”জি, এক মাস।”
সেই দিনের কথা মনে করে প্রিয়তা পুনরায় ঢুক গিয়ে থাকলো উনার দিকে। অভিরাজ এখনো ঠোঁট উল্টে নিরন্তন ভাবে কাঁদছে।
ভদ্র মহিলা অভিরাজের গাল টেনে আদর করে বললেন,

“মাশাল্লাহ, মাশাল্লাহ, একদম রাজ পুত্তুরের মতো মুখ খানা। আমি বলে ছিলাম না মেয়ে তোমার পুলা হবে, দেখেছো? এই জয়তুন খাতুনের কথা কখনো ভুল হয় না।”
প্রিয়তা বোকার মতো দাঁড়িয়ে শুনলো উনার কথা। উনি পুনরায় প্রসন্ন চিত্তে বললেন,
“এমনি পুলা তো দেখি বাপের মতো হয়নি।”
“জি।”
“হ্যাঁ, পুলা তো দেখতে একদম হুবহু তোমার মতো হয়েছে, একদম মায়ের মতো। এক নাক, এক চোখ, এক মুখ সবই তো তুমার মতো, বাপের দেখি কোন ছাপই নাই।”

উনার কথার ধরনে প্রিয়তা নিজের অজান্তেই লজ্জা পেল, হয়তো খুশি হলো।
“তা মেয়ে, তুমি এতটুকু বাচ্চা কোলে নিয়ে একা একা দাঁড়িয়ে আছো কেনো? তোমার বর কোথায়?”
বর নামটা শুনতেই প্রিয়তার লাজুক হাসি মিলিয়ে গেল।
ভদ্র মহিলা আশেপাশে খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ উনার দৃষ্টি আটকালো বেশ কিছুটা দূরে। সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে। মলের বাইরে গাড়ির দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রণয়, পায়ে পা জড়িয়ে মোবাইলে কিছু একটা করছে হয়তো।
“ওই যে, ওটা তোমার স্বামী না? চলো, ওর সাথে কথা বলে আসি।”
ভদ্র মহিলার হাতের ইশার অনুসরণ করে প্রিয়তা পাশে থাকলো। কালো ফরমাল শার্ট আর কালো প্যান্ট পরিহিত যুবককে দেখে প্রিয়তার বুকটা মুচড় দিয়ে উঠলো।

“কী হলো মেয়ে, চলো।”
প্রিয়তা বাধা দিয়ে বলল,
“চাচী, বাবু কাঁদছে। আপনি গিয়ে কথা বলে আসুন, আমি এখানেই থাকি।”
“চলো তো মেয়ে, তোমরা আজ কালকের মেয়েরা বেশি বোঝো। বাচ্চাকে বাপের কোলে দিলে আর কাঁদবে না।”
প্রিয়তা অপ্রস্তুত বোধ করলো।
“চলো, চলো।”
বাধ্য হয়ে প্রিয়তা ওই ভদ্র মহিলার পিছু নিলো। কারণ এখানে দাঁড়িয়ে উনার সাথে কথা বলা মানেই হাই রিস্ক, কে কখন কোন দিক থেকে উনার কথা শুনে ফেলবে। এসব ভেবে আর দ্বিমত করলো না প্রিয়তা।
“বউ বাচ্চাকে ওখানে একা ফেলে ফোন টিপছো? তোমার ছেলেটা যে কেঁদে কেটে অস্থির হয়ে যাচ্ছে, তা কি দেখেছো?”

অপরিচিত নারী কণ্ঠে ফোন থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকালো প্রণয়। তার থেকে এক হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছেন একজন ৬০ ঊর্ধ্ব বৃদ্ধা, আর পাশে সেই নারী। প্রণয় চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো ভদ্র মহিলার পানে।
“তোমার বাচ্চা কাঁদছে, কোলে নাও।”
উনার কথায় প্রণয় অবাক হলো। নিজের দিকে দেখিয়ে বললো,
“আমার বাচ্চা?”
“হ্যাঁ, তোমার বাচ্চাই তো। ওই যে দেখো।”
প্রণয় এবার সরাসরি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো প্রিয়তার মুখের পানে। প্রিয়তা টলমল চোখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে, কোলে অভিরাজ। প্রিয়তা দুই পাশে মাথা নাড়িয়ে ইসারায় বারণ করলো, যার অর্থ উনাকে সত্যিটা বলবেন না।
“তোমার বউ আর বাচ্চাকে দেখে তো প্রথমে চিনতেই পারছিলাম না, তার পর মনে পড়ল।”
ভদ্র মহিলার কথায় প্রণয়ের বুকের ভেতর ধাক্কা লাগলো। সে কেমন করে তাকিয়ে রইলো প্রিয়তার দিকে, মনে মনে আওড়ালো— আমার বউ বাচ্চা…

“এই মেয়ে, পিছনে লুকাচ্ছো কেনো? সামনে আসো, স্বামীর পাশে এসে দাঁড়াও।”
প্রিয়তা ও তাই করলো। ধীর পায়ে হেঁটে এসে প্রণয়ের পাশে দাঁড়ালো। ভদ্র মহিলা তৃপ্তি নিয়ে দেখলেন ওদের তিনজনকে। উনার মুখ থেকে আপনা আপনি বেরিয়ে গেল,
“মাশাল্লাহ, এমন সুন্দর পরিবার! আমি শেষ করবে দেখছি, মনে পড়ে না। তা বাবা, ভালো আছো তো?”
প্রণয় যেন সেই কথা শুনতেই পেল না। সে থমকে আছে উনার বলা একটা বাক্যে— হয়তো মিথ্যা, কিন্তু এমন সুখের শব্দ সে জীবনে খুব কম শুনেছে।
প্রণয় কিছু বলছে না দেখে প্রিয়তা প্রণয়ের বাহুতে আস্তে করে চিমটি কাটলো।
সাথে সাথেই প্রণয় এর জবাব এলো,
“জি, ভাল আছি।”
ভদ্রমহিলা হেসে বললেন,

“তোমাদের দেখে অনেক ভালো লাগলো। তোমাদের পুচকুরে নিয়া একদিন আমাদের বাড়িতে আইসো।”
প্রিয়তা হাসার চেষ্টা করে বললো,
“জি, অবশ্যই।”
রাত হয়ে যাচ্ছে দেখে ভদ্র মহিলা বললেন,
“আচ্ছা তাহলে আজ আসি, তোমাদের চাচা বাড়িতে একা।”
“জি চাচী, আপানি ও চাচাকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসবেন।”
“নিশ্চয়ই। ভালো থেকো তোমরা, অনেক অনেক দোয়া রইল তোমাদের জন্য।”— বলে মৃদু হেসে চলে গেলেন ভদ্র মহিলা।
উনি যেতেই বড়ো করে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো প্রিয়তা। বাড়ির কেউ যদি এসব কথা শুনতো তাহলে নিশ্চিত কেলেঙ্কারি হয়ে যেত…

অভিরাজের কাঁদতে কাঁদতে কাশি উঠে গেছে।
“বাচ্চা সামলাতে পারিস না তাহলে নিয়ে আসিস কেনো?”
ভারী পুরুষালী আওয়াজে কেঁপে উঠলো প্রিয়তা।
প্রণয়ের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার পূর্বেই নাক কুঁচকে আরো জোরে কেঁদে উঠলো অভিরাজ।
“মাম্মা পাপা, আমি পাপার কাছে যাবো, আমি মাম্মার কাছে যাবো, ফুপ্পি মনি।”
প্রিয়তা আর প্রণয়ের কথায় ধ্যান দিলো না, অভিরাজকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
“এই তো, শহহহ… কাঁদে না বাবা আমার, এখনই তোমার মাম্মার কাছে যাবো। কিন্তু তার আগে আমরা চকলেট খাবো। তুমি চকলেট খাবে বাবা?”
“না, আমি মাম্মার কাছে যাবো।”
“আচ্ছা বাবা, চলো আমরা এখনই বাড়ি ফিরে যাবো।” বলে অভিরাজের পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে যেতে ধরলো প্রিয়তা।

“দাঁড়া।”
থমকে দাঁড়ালো প্রিয়তা।
“এদিকে দে।” বলে অভিরাজের দিকে হাত বাড়ালো প্রণয়। সরে গেল প্রিয়তা। অভিরাজকে আরো শক্ত করে বুকে আগলে ধরে বললো,
“আপনি নিতে পারবেন না, কোল থেকে ফেলে দেবেন।”
“আচ্ছা আমি যদি কোল থেকে বাচ্চা ফেলতাম,তাহলে আজ তোর হাড়গোরে একটাও আস্তো থাকতো না! ”
“খোটা দিচ্ছেন?”
প্রণয় ওর কথায় কানে নিলো না, ছুোঁ মেরে অভিরাজকে নিজের কোলে নিয়ে গেলো।
এতে বেশ চটে গেল প্রিয়তা। নাক ফুলিয়ে বললো,
“ওকে ফিরিয়ে দেন বলছি।”
প্রণয় ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে প্রীতমকে ভিডিও কল দিলো। ফোন দু’বার রিং হতেই ধরে ফেললো প্রীতম। ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল,
“বলো দাদান।”
“তোর ছেলে তোর সাথে কথা বলতে চায়, নে কথা বল।” বলে অভিরাজকে পুনরায় প্রিয়তার কোলে দিলো প্রণয়, ফোনটা তুলে ধরলো অভিরাজের সামনে।
প্রিয়তা মুগ্ধ হলো প্রণয়ের বুদ্ধিমত্তায়।

প্রীতম ছেলের বিধ্বস্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আদুরে চুমু ছুড়ে দিয়ে বলল,
“কী হয়েছে পাপা, তুমি কাঁদছো কেন?”
অভিরাজ ঠোঁট উল্টে কান্না করে বলল,
“পাপা, আমি তুমলার কাছে যাবো।”
“নিশ্চয়ই আসবে পাপা, কিন্তু এখন তুমি বড় চাচ্চুর কাছে থাকো। আমার বাবা না গুড বয়?”
অভিরাজ ড্যাবড্যাব চোখে তাকালো বাবার মুখের দিকে।
“ওকে পাপা, রাখি। বাড়ি আসার পর তোমাকে অনেক আদর করবো ঠিক আছে। তুমি কিন্তু এখন একদম দুষ্টুমি করবে না, গুড বয় হয়ে থাকবে কেমন?”
অভিরাজের কান্না অফ হয়ে গেল। সে উপর-নিচ মাথা দুলিয়ে বললো,

“অকে পাপা।”
“এই তো আমার বাচ্চা, লাভ ইউ মাই সান।”
“লাভ ইউ টু পাপা।”
প্রীতম কল কেটে দিলো। প্রণয় মোবাইল পকেটে ঢুকিয়ে দুই হাত বুকে গুঁজে তাকালো প্রিয়তার মুখের দিকে। চোখ ছোট ছোট করে বললো,
“তুই নিজে একটা বাচ্চা হয়ে অন্য বাচ্চা কোলে নেস কোন সাহসে?”
“আমি বাচ্চা?”
“তাহলে তুই কি বড়ো?”
“অবশ্যই বড়ো, আমি ২০ ইয়ারস অল্ড।”
“তাহলে তো বুড়ি হয়ে গেছিস।”
“কী?”
“হ্যাঁ, শুনিসনি? ২০-তে বুড়ি।”
প্রিয়তা এবার আরো রেগে গেল। প্রণয়ের দিকে আঙুল তুলে বললো,
“আমি বুড়ি হলে আপনি কী? কচি খুকা? আপনি তো—”
“তুমলা ঝগড়া কলছো কেনু, ঝগড়া তো পচা মানুষলা কলে।”
প্রণয় ঠোঁট ছেপে হেসে বললো,
“দেখ, এতটুকু বাচ্চা ও বুঝে গেছে তুই ঝগড়াটে।”
মৃদু রাগে প্রিয়তার নাকের ডগা লাল হল হয়ে যাচ্ছে।
“আমি ঝগড়াটে?”

“বিশ্বাস না হয় জিজ্ঞেস কর।”
প্রিয়তা ও তাই করলো। অভিরাজের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“বাবা, আমি ঝগড়াটে?”
অভিরাজ ছোট মানুষ, সে আর ঝগড়ার কী বোঝে? তবে সে যা দেখেছে, তার ভিত্তিতে উপর-নিচ হ্যাঁ-সূচক মাথা ঝাঁকালো।
প্রিয়তা চোখ বড়ো বড়ো করে ফেললো। প্রণয় প্রিয়তার কোল থেকে অভিরাজকে নিয়ে বললো,
“চলো চাচ্চু, এসব ঝগড়াটে মহিলার সাথে মুখ না লাগানোই ভালো।”
অভিরাজ ও মাথা দুলিয়ে বললো,
“আচ্ছা চাচ্চু।”
অভিরাজকে প্রণয়ের সাপোর্ট নিতে দেখে প্রিয়তা মুখ বাঁকিয়ে বললো,
“তোমার লক্ষণ ভালো নয় বাবা। তুমি এই বয়সে এতো পাল্টিবাজ, বড়ো হলে নিশ্চিত চাচার এক কাটি উপর দিয়ে যাবে।”
“ইসস, মুখের কী ভাষা! বাচ্চাদের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে? তুই আর কবে বড়ো হবি?”
“আমি যথেষ্ট বড়।”
“তা তো দেখতে পাচ্ছি।”
“কী বললেন?”

“হ্যাঁ, ঠিকই তো বললাম যে সামান্য কথায় নাক গাল ফুলায় থাকে আর কি বলবো?”
প্রিয়তা ও হয়তো আরো কিছু জবাব দিলো। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সকল দৃশ্য দেখলো পরিনিতা ও প্রেরণা।
“দেখছো আপু, ওদের একসাথে কতো সুন্দর লাগছে। ঐ ভদ্র মহিলা ঠিকই বলেছেন, এতো সুন্দর পরিবার আমি ও আগে কখনো দেখিনি।”
“সত্যি, অভিরাজকে দেখে মনেই হচ্ছে না ও মেজদার সন্তান। মনে হচ্ছে যেন এরাই ওর আসল বাবা-মা। কী সুন্দর হাসছে ওদের সাথে।”
“এই মিথ্যেটা কী কোনভাবে সত্যি হতে পারতো না আপু? এই মিথ্যেটা যদি সত্যি হতো তাহলে বেশি তো ক্ষতি হতো না বলো। আমাদের ভাইটা ও জীবনে সুখ পেত।”
দীর্ঘশ্বাস ফেললো প্রেরণা। মলিন হেসে বললো,
“তুই সার্থপর হচ্ছিস বোন।”

“মাঝে মাঝে সত্যি নিজেকে খুব সার্থপর মনে হয় আপু। খালি মনে হয়, সব কিছুর উর্ধ্বে গিয়ে ও যদি ওদের এক করে দিতে পারতাম।”
“তা আর সম্ভব নয় বোন। আমরা নিজেদের স্বার্থে প্রিয়তার জীবনটা নষ্ট করতে পারি না। আমাদের বাড়ির কেউ ওদের খারাপ চায় না, কিন্তু সকলেরই হাত-পা বাঁধা।”
“তবু ও আপু, যদি কোনো ভাবে—”

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৬৬

“তবু ও হয় না পরি। প্রিয়তা আমাদের চাচাতো বোন, একই রক্তের আপন। আমরা আমাদের ভাইকে কিছুদিন সুখে রাখার জন্য ওর সারাজীবন নষ্ট করে দিতে পারি না।”
“দাদান আসলে কে আর কী, সেটা তুই ও জানিস, আমি ও জানি, বাড়ির সবাই জানে। এরপরও কিভাবে আশা করিস সেজো চাচ্চু আর মেজদা ওদের বিয়ে দিতে রাজি হবে? আর তা ছাড়া, এসব বড়ো দাদান শুনলে খুব রেগে যাবে। আমাদের এগুলোতে না ঢোকাই ভালো। ওদের সাথে সেটাই হবে যেটা ওদের ভাগ্যে আছে।”

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৬৭