ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৭০
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই
বিয়ে পড়ানো শেষে দুই বউকে আপাতত তাদের নিজের নিজের কক্ষে ফ্রেশ হতে পাঠিয়ে দিয়েছেন বড়োরা। মেহমান, আত্মীয়-স্বজন সহ সকলে রাতের খাবার খেতে ব্যস্ত।
অরণ্য, সমুদ্র, রাদিফ, সাদিফ, অভ্র, শুভ্র, তন্ময়, থিরা, থোরি, দীপ্তি, মেহেক, শুভ্রতা, তৃধা, লাবিবা সহ সকল শালা-শালীরা দুই তরফা বাসর ঘর সাজাতে ব্যস্ত।
প্রিয়তা নিজের ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে দিল। সতর্ক দৃষ্টি মেলে আশেপাশে দেখে, ব্যালকনি, জানালা সহ অন্যান্য জায়গায় পর্দা টেনে দিল।
অতঃপর বালিশের নিচ থেকে নিজের ফোন বের করে কল দিল।
ফোন রিসিভ হতেই কাঁপা কণ্ঠে ধীরে ধীরে বললো,
“মাত্র ১০ মিনিট আছে, ঝটপট চলে এসো।”
অপর প্রান্ত হইতে কি বললো শোনা গেলো না। প্রিয়তা ফোন রেখে বিছানায় বসে পড়লো। ভারী ভারী শাড়ি, গয়না পরে তার শরীর কেমন কুট কুট করছে, বিরাট আনকমফর্টেবল ফিল হচ্ছে। পা নাড়তে নাড়তেই হঠাৎ দরজায় কড়াঘাত পড়লো।
ঝট করে বসা থেকে উঠে পড়লো প্রিয়তা। দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল। দুয়ারে দাঁড়ানো ব্যক্তির চেহারা অবলোকন করে বাঁকা হাসলো।
মানুষটা ঝট করে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়লো। আশেপাশে দেখে দরজা লাগিয়ে দিল প্রিয়তা।
লোকটার সামনে দাঁড়িয়ে চিন্তিত কণ্ঠে সূধালো,
“সব ঠিকঠাক হয়েছে?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ওর ভয়ার্ত এক্সপ্রেশনে বাঁকা হাসলো ইরফান। ওর পানে একটা কোর্ট পেপার এগিয়ে দিয়ে বললো,
“নিজেই দেখ।”
ইরফান হাত থেকে ঝট করে কাবিননামা কেড়ে নিলো প্রিয়তা। কাগজটা চোখের সামনে মেলে ধরতেই খুশিতে তার দৃষ্টি উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
ইরফান হেসে সূধালো,
“খুশি তো?”
প্রিয়তা লাফিয়ে উঠে ইরফানকে জড়িয়ে ধরলো। আনন্দে আত্মহারা হয়ে বললো,
“থ্যাংক ইউ! থ্যাংক ইউ! থ্যাংক ইউ ভাইয়া! তুমি ওয়ার্ল্ডের বেস্ট ভাইয়া!”
ইরফান তৃপ্ত হেসে বোনের মাথায় হাত রাখলো। আদুরে কণ্ঠে বললো,
“আমার বোন আমার কাছে কিছু চেয়েছে আর আমি দেবো না — এটা কখনো হয়? এখন অন্যের খুলোশ ছেড়ে বেরিয়ে আমার বোন হ।”
প্রিয়স্মিতা বাঁকা হাসলো। বেনারসির আঁচল কোমরে গুঁজে ভাব নিয়ে বললো,
“তোমার বোন আগে ও আগুন ছিলো, এখনো তাই আছে, ভবিষ্যতে ও তাই থাকবে।”
ইরফান প্রিয়স্মিতার দুই হাত টেনে দিয়ে বললো,
“সাবাস বাঘের বাচ্চা! এটাই তো চাই!”
প্রিয়স্মিতা হঠাৎ থেমে গেলো। একটু ভেবে বললো,
“পর্দার আড়ালের কাজিকে টাকা বুঝিয়ে দিয়েছো?”
“হুম, দিয়েছি।”
“কিন্তু মনে রাখিস, এটা একটা প্রতারণামূলক বিবাহ।”
প্রিয়স্মিতা মুখ বাঁকিয়ে বললো,
“প্রতারণা করতে চাইছিলো কে? আমি তো বলেই ছিলাম — চল, তুলে নিয়ে যাই, গান পয়েন্টে রেখে বিয়ে করে ফেলি।”
ইরফান অস্থির হলো। বোনের মাথায় গাঁট্টা মেরে বললো,
“ডার্ক থ্রিলার স্টোরি পড়া বন্ধ কর। এটা রিয়েল লাইফ উপন্যাস নয়। এখানে এত বড় বড় পাবলিক ফিগারদের কিডন্যাপ করা যায় না। আর আমরা যদি টপ ৫ কার্ডিও সার্জন ডঃ অবদ্ধ চৌধুরী শুদ্ধ কে কিডন্যাপ করার চেষ্টা ও করতাম, তাহলে পুরো দুনিয়া আমাদের শত্রু ভাবতো।”
“তারপর ভাই-বোন মিলে গারোদের পেছনে বসে মশা মারতাম।”
প্রিয়স্মিতা মুখ কালো করে ফেললো।
ইরফান কঠোর কণ্ঠে বললো,
“ডঃ চৌধুরী সব দিক থেকে ভালো, তাই তোর সাথে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছি। কিন্তু মনে রাখিস — বিয়ে হয়ে গেছে বলে কিন্ত তুই সাপের পাঁচ পা দেখিস না। তোকে ভালো মতো পড়তে হবে, ইঞ্জিনিয়ার হতেই হবে। মনে থাকবে?”
প্রিয়স্মিতা এবার মুখ দ্বিগুণ কালো করে ফেললো। মনে মনে ভেংচি কেটে ভাবলো,
“এত কাটখড় পুড়িয়ে বিয়ে করেছি, কি পড়াশোনা করবো বলে! ইম্পসিবল। এখন শুধু রোমান্স করবো!”
ভাবতে ভাবতে লজ্জায় লাল-নীল-বেগুনি হয়ে গেলো।
ওর অবস্থা দেখে ইরফান ধমকে উঠলো,
“এই! কী ভাবছিস?”
ধমক খেয়ে ভাবনার জগৎ থেকে চিটকে পড়লো প্রিয়স্মিতা।
ইরফান শুধালো,
“তুই যে এই বাড়িতে এসেছিস, তুই এই বাড়ির সবাইকে ঠিকঠাক চিনেছিস তো? কে তোর সম্পর্কে কি লাগে, সব বুঝতে পেরেছিস তো?”
ইরফানের প্রশ্নে প্রিয়স্মিতার চেহারায় অমাবস্যার ঘন আঁধার নেমে এলো। সে মুখ কালো করে গিয়ে বিছানায় বসে পড়লো। গালে হাত দিয়ে নিরুত্তাপ কণ্ঠে বললো,
“ধুর! এতো এতো ক্যারেক্টার মনে রাখা যায় নাকি? বাপরে বাপ! এটা পরিবার নাকি জাতীয় সংসদ!”
ইরফান হতাশাপূর্ণ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। বোনের পাশে বসে বললো,
“ওরা ক্যারেক্টার নয়, তোর পরিবার। তোকে প্রত্যেককে ভালো মতো চিনতে হবে। উল্টাপাল্টা করলে যখন তখন ধরা পড়ে যাবি।”
প্রিয়স্মিতা মুখ কালো করলো।
ইরফান নিজের ফোন গ্যালারি থেকে শিকদারদের ফ্যামিলি ফটো বের করলো। এক এক করে ধরে দেখাতে লাগলো — সম্পর্কে ওরা ওর কে কী হয়।
প্রিয়স্মিতা চোখ বড়ো করে বেশ কয়েকবার দেখলেও সব গুলিয়ে ফেললো। বোনের অবস্থা দেখে ইরফান হতাশ কণ্ঠে বললো,
“এই ব্রেইন নিয়ে তুই ইঞ্জিনিয়ার হবি? গাধা!”
প্রিয়স্মিতা মুখ কাঁদো কাঁদো করে ফেললো। ইরফান আরো কিছু বলতো, কিন্তু তার পূর্বেই প্রিয়স্মিতা তাকে থামিয়ে দিলো।
এক লাফে গিয়ে দরজা খুলে ইরফানকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলো ঘর থেকে। আবার তাড়াহুড়ো করে লম্বা ঘুমটা টেনে বসে পড়লো খাটের মাঝখানে। প্রিয়স্মিতা সস্থিতে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারলো না — তার পূর্বেই দরজায় এসে হাজির হলেন অনন্যা বেগম। হাতে খাবারের প্লেট।
অনন্যা বেগম দরজায় দাঁড়িয়ে অশ্রুশিক্ত নয়নে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
আজকাল মেয়ের সামনে পড়তেও ওনার সংকোচ বোধ হয়। নিজেকে বড়ো নিঃকৃষ্ট লাগে নিজের কাছে। কিন্তু উনি নিজেও যে নিরুপায়। পেটে ধরেছেন একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে — তো আর ঠেলে দিতে পারেন না।
অনন্যা বেগম দীর্ঘ শ্বাস টানলেন। শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে এগিয়ে গেলেন মেয়ের পানে। গলা অব্দি ঘুমটা দেখে বললেন,
“কি রে মা, এখনো এসব ছেড়ে ফ্রেশ হোসনি? কখন না তোকে পাঠানো হলো!”
প্রিয়স্মিতা ঘুমটার আড়াল হইতে অনন্যা বেগমকে দেখতে পেলো না।
অনন্যা বেগম স্নেহের সহিত বললেন,
“আয়, তোকে এসব খুলে দেই।”
আরও গুটিয়ে গেলো প্রিয়স্মিতা। কণ্ঠ শুনে বুঝতে পারছে না কে।
অনন্যা বেগম খাবারের প্লেটটা বিছানার এক পাশে রেখে প্রিয়স্মিতার সামনে বসে পড়লেন। মাথার ক্লিপ খুলে মুখের উপর থেকে ভারী ওড়নাটা সরিয়ে নিলেন।
অনন্যা বেগম এর মমতাময়ী মুখখানা ভেসে উঠলো প্রিয়স্মিতার দৃশ্যপটে। সে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো অনন্যা বেগম এর মুখের দিকে। অনন্যা বেগম আলতো হাতে প্রিয়স্মিতার কানের দুল, হাতের বালা, গলার হার সব খুলে নিলেন।
মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে কন্ঠে বললেন,
“এখন ভালো লাগছে মা?”
প্রিয়স্মিতার ডাগর অক্ষিতে নোনা পানির আভাস পাওয়া গেলো।
অনন্যা বেগম খাবারের প্লেট হাতে তুলে নিলেন। ভাতের লুকমা মেখে প্রিয়স্মিতার সম্মুখে ধরে বললেন,
“ঝটপট হা করতো, আমার অনেক কাজ পড়ে আছে বাবা।”
প্রিয়স্মিতা অশ্রু চোখে তাকিয়ে নিজের অজান্তেই হা করলো। অনন্যা বেগম তাকে খাইয়ে দিতে লাগলেন।
প্রিয়স্মিতার বুকটা কেমন ভারী ভারী অনুভব হচ্ছে। গলা দিয়ে খাবার নামছে না, মনে হচ্ছে বুকে উপর কেউ কয়েকশো টনের ওজন রেখে দিয়েছে। না চাইতেই অশ্রু রেখা নেমে আসছে গাল বেয়ে।
অনন্যা বেগম ব্যথিত হলেন। প্লেট রেখে বা হাতে মেয়ের গাল মুছে দিলেন, স্নেহের সহিত বুঝালেন,
“কাদিস না মা, ভাতের পাতে চোখের পানি ফেলতে হয় না। দেখিস তুই একদিন খুব সুখী হবি, খুব ভালো থাকবি। পুরনো কথা তোর মনেই পড়বে না।”
“মা!” বলে আচমকা অনন্যা বেগম কে ঝাঁপটে ধরলো প্রিয়স্মিতা। দুই হাতে কোমর জড়িয়ে ধরে শব্দহীন কান্নায় ভেঙে পড়ল।
হঠাৎ এমন ব্যবহারে হতবাক হয়ে গেলেন অনন্যা বেগম। ভেবে নিলেন হয়তো প্রণয় জন্য কষ্ট পাচ্ছে—খুব ভালোবাসতো কিনা। মেয়ের কান্নাতে অনন্যা বেগম এর চোখে ও পানি চলে এলো। এমন না যে তিনি বুঝেন না মেয়ের কষ্ট। তিনি সবই বুঝেন। ভালোবাসা না পাওয়ার যে কি জ্বালা তা উনার থেকে ভালো আর কে জানে! প্রণয়ের জীবনের যদি ১০% ও গ্যারান্টি থাকতো তাহলে উনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিতেন। কিন্তু যে ছেলে এখন মরবে না একটু পরে মরবে তার কোনো ঠিকানা নাই। এমন একটা ছেলের হাতে মা হয়ে নিজের মেয়েকে কিভাবে তুলে দিতেন? চোখের সামনে মেয়ের গায়ে সাদা শাড়ি জড়াতে কিভাবে দেখতেন! উনার তো দুটো বাচ্চা ছাড়া এই দুনিয়াতে আর কিছুই নেই।
দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলেন অনন্যা বেগম। মেয়ের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“কাদিস না মা, নিজেকে শক্ত কর।”
কিন্তু প্রিয়স্মিতার এসব কিছুই কানে লাগলো না। অনন্যা বেগম এর গা থেকে কেমন তীব্র মা-মা গন্ধটা ছুটে আসছে। এত শান্তি লাগছে যা বলে বোঝানোর মতো না। সে কিছু বললো না, শুধু চুপচাপ অনন্যা বেগম কে জড়িয়ে ধরে বসে রইলো।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে প্রিয়র কক্ষে প্রবেশ করলো শ্বেতা, পরিনীতা, ইনায়া, ঊষা, ত্রিধা।
মা-মেয়ের এমন মধুর মুহূর্ত দেখে ওরা স্থির হলো। ইনায়া পেছন থেকে অনন্যা বেগম কে জড়িয়ে ধরে অভিমানী কন্ঠে বললো,
“হুঁ হুঁ ঠিকই আছে, শাশুড়িরা কোনোদিন মা হতে পারে না। এটা আবারো প্রমাণিত। সব আদর মেয়ের জন্য, আর আমি ছেলের বউ। আমায় একটু ও আদর করা যায় না!”
ঊষা আর শ্বেতা ও তাল মিলালো,
“ঠিক ঠিক! আমরা কি বানের জলে ভেসে এসেছি?”
অনন্যা বেগম হেসে সবাইকে জড়িয়ে ধরলেন। সকলকে আদর করে বললেন,
“তোরা তাহলে তোদের বোন কে সাজা। আমি যাই, আমার অনেক কাজ আছে বাবা।”
শ্বেতা মাথা নাড়িয়ে বললো,
“ঠিক আছে সেজো মামি।”
অনন্যা বেগম যেতে নিলে তাকে ঝাঁপটে ধরলো প্রিয়স্মিতা। অনন্যা বেগম আবার আদর করে বললেন,
“ছাড় মা, বাসা ভর্তি মেহমান, তাদের ভালো মন্দ দেখতে হবে।”
প্রিয়স্মিতা ও বাধ্য হলো ছাড়তে।
গুলবাহার বানু কুঁজো হয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করলেন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“কি রে অনু, তুই এই ছুড়িগুলার মাঝে দাঁড়াই দাঁড়াই কি করোস? তোর বড় বোন যে তোকে খুঁজে দেখস না?”
মায়ের কথায় বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লেন অনন্যা বেগম। তাড়াহুড়ো করে বললেন,
“একক্ষুনি যাচ্ছি আম্মা!”
বলে কক্ষ ত্যাগ করলেন অনন্যা বেগম। গুলবাহার বানু ফুগলা দাঁতে হেসে এসে প্রিয়স্মিতার পাশে বসলেন।
পান খাওয়া দাঁতে হেসে বললেন,
“দেখ লো দেখ, সবাই বিয়ে হতে না হতেই নাতনির যৌবনের ফুল ফুঁটে উঠেছে!”
“বিয়ে হলে বুঝি, হলে বুঝি যৌবনের ফুল ফুটে, নানি?”
“হ্যা রে নাতিন, সব কিছুর একটা সময় আছে। ওরে ছুঁয়া তো ছাড়, একটু ফুঁ দিয়ে দেখ, লাফিয়ে উঠবে!”
প্রিয়স্মিতা বরাবরই লজ্জা শরম কম, কিন্তু গুলবাহার বানুর ঠোঁটকাটা কথাগুলো কেমন হজম হয় না। লজ্জা লাগে ভীষণ। এবারও তাই হলো।
লজ্জায় রাঙা হয়ে গেল তার মুখখানি। গুলবাহার বানু ফের বললেন,
“দেখে এলুম তোর জামাই কে। বিশ্বাস কর বোইন, তোর নানা ও এত সুপুরুষ ছিল না!”
দীপ্তি চোখ বড় বড় করে বললো,
“হায় হায় দাদি! তুমি দুলাভাই কে নজর দিয়ে এসেছো?”
“ধুর নডি, নজর দিতে যাব কেন! দেখলাম খালি গায়ে বসে আছে, আমার আবার এত লোভ নাই!”
উনার নাতনিরা চোখ ছোট ছোট করে তাকালো উনার দিকে। প্রিয়স্মিতার ভীষণ হিংসে হলো।
সে মনে মনে ফুঁসে উঠে বললো,
“লুচ্চা বুড়ি! নিজের জামাই শেষ, আমার জামাই এর দিকে নজর!”
“না বোন, তোর জামাইয়ের দিকে নজর দেইনি, তবে সুপুরুষ অনেক। তুই সুখ পাবি ভালো!”
প্রিয়স্মিতা ঢুক গিললো। এই বুড়ি মনের কথা কেমন বুঝলো!
গুলবাহার বানু প্রিয়স্মিতার দিকে তাকিয়ে টোন কেটে বললেন,
“চুল তো আমার এমনি এমনি পাকেনি নাতনি, অভিজ্ঞতায় পেকেছে! এই তোরা কি করিস, সাজা এ!”
শ্বেতা মাথা নাড়িয়ে শপিং ব্যাগ খুলে একটা লাল রঙের পাতলা শাড়ি বের করলো।
পরিনীতা শাড়িটা দেখে ভুরু কুঁচকালো,
“এটা দিয়ে কী করবি? বেনারসী কই?”
শ্বেতা ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বললো,
“বেনারসী নয় ভাবী, আজ এটাই পরবে।”
সকলে চোখ গুল গুল করে তাকালো শাড়িটার দিকে। পরিনীতা শাড়িটা হাতে নিয়ে দেখলো, এপার থেকে ওপার দেখা যাচ্ছে—কিন্তু অনেক সুন্দর।
পরিনীতার কেন জানি চোখে পানি চলে এলো। “তার ভাইটা কোথায় পড়ে আছে, কে জানে… আর এরা কিনা!”
গুলবাহার বানু বললেন,
“তুই ঠিক বলেছিস নাতনি। আজকের রাতে ওইসব ভ্যুজং ভ্যুজং পরে কোনো লাভ নেই। শুধু শুধু খুলতে সময় নষ্ট হবে। তোরা বরং এটাই পরিয়ে দে।”
ইনায়া ও ঊষা প্রিয়স্মিতাকে শাড়ি পরাতে লাগলো। এত লোকের সামনে শাড়ি পরতে প্রিয়স্মিতার লজ্জা লাগছে। ইনায়া বুঝলো তাই ঊষার উদ্দেশ্যে বললো,
“ছোটো ভাবী, ওকে ওয়াশরুম থেকে শাড়িটা পরিয়ে নিয়ে আসো।”
ঊষা ও তাই করলো।
মিনিট পাঁচেক পর ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ হলো। সকলে সেদিকে তাকালেন। কিন্তু সামনের দৃশ্য দেখে অটোমেটিকালি তাদের চোখ মুখ হা হয়ে গেলো।
প্রিয়স্মিতার এবার চরম লজ্জা লাগছে। সে শাড়ির আঁচল এদিক ওদিক টেনে টুনে শরীর ঢাকার চেষ্টা করছে কিন্তু ব্যর্থ, কারণ শাড়ির মধ্য থেকে তার শরীরের প্রত্যেকটা ভাঁজ স্পষ্ট দৃশ্যমান।
হাত কাটা স্লিভলেস ব্লাউজের সাথে উন্মুক্ত হয়ে আছে ফরসা পেট-পিঠ।
দীপ্তি মুখে হাত দিয়ে বললো,
“ওয়াও প্রিয়পু! কি সেক্সি ফিগার, মাইরি!”
“কিভাবে মেইন্টেইন করো একটু বলো না? আমার জন্মের স্বপ্ন এমন ফিগার পাওয়া!”
গুলবাহার বানু রষিয়ে রষিয়ে বললেন,
“এসব ফিগার-টিগার কিছু না। এগুলো হচ্ছে যৌবনের মধু। সময় হলে তোরও হবে।”
দীপ্তি মুখ কালো করে বললো,
“ধুর দাদি, কি যে বলো! এমন আইকনিক ফিগার এমনি এমনি হয় না! জিম করতে হয়, ডায়েট করতে হয়, মেইন্টেইন করতে হয়!”
ঊষা প্রিয়স্মিতাকে এনে খাটের উপর বসালো। ইনায়া ওর কানে কানে বললো,
“আজ হার্টের ডাক্তার হার্ট অ্যাটাক করবে কনফার্ম!”
ইনায়ার কথায় প্রিয়স্মিতার শরীরের পশম দাঁড়িয়ে গেলো। ভেতরের বাঘিনী কেমন নুইয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে।
স্বেতা স্ট্রেইটনার এনে হাঁটু ছাড়ানো চুলগুলো পুনরায় স্ট্রেইট করে পিঠের উপর ছেড়ে রাখলো। গলায় ও কানে ছোট্ট একটা পার্ল সেট পরিয়ে দিলো।
ইনায়া পুনরায় কানে কানে বললো,
“আজ রাতে কি কি হলো, কাল কিন্তু সব শুনবো আমি!”
প্রিয়স্মিতা ঢোঁক গিললো।
পরিনীতার নিকট এই সব কিছু বিষাক্ত লাগছে। সবাইকে শত্রু মনে হচ্ছে। সে আর এসব সহ্য করতে পারলো না, ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। প্রিয়তার লজ্জা মাখা এক্সপ্রেশন দেখে শরীর ঝলসে উঠছে তার—
“কাল অব্দি আমার ভাইয়ের জন্য মরছিলো, আর আজ কবুল পড়তে না পড়তেই!”
পরিনীতা গজগজ করে বললো,
“অথচ আমার ভাই নিজের গোটা জীবন উজার করে দিয়েছে শুধু এই মেয়েটার জন্য!”
পরিনীতা পায়চারি করতে করতে মাথা ভর্তি দুশ্চিন্তা নিয়ে ডায়াল করলো প্রণয়ের নম্বরে। একবার, দুবার… কয়েকবার রিং হতে হতে কেটে গেলো।
এতে পরিনীতার দুশ্চিন্তা বাড়লো। ভয় কমলো না। সে ক্রমাগত ফোন করতেই থাকলো। অবশেষে এক সময় ফোন রিসিভ হলো। ওপার প্রান্তের কথা না শুনেই পরিনীতা বললো,
“দাদান, তুমি কোথায়? ফোন তুলছিলে না কেন?”
কিছুক্ষণের নীরবতার পর ওপার থেকে একটি কণ্ঠ ভেসে এলো—প্রেম, শান্ত কণ্ঠে বললো,
“দাদানের সেন্স নেই, পরি…”
একটি মাত্র বাক্যে স্থির হয়ে গেলো পরি।
প্রেম পুনরায় বললো,
“দাদান হার্ট অ্যাটাক করেছে। ডাক্তার বলেছে অবস্থা নাকি ভালো নয়। ইউএসএ নিয়ে যেতে আমরা তার প্রিপারেশন নিচ্ছি, পরি… কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা রওনা দেবো।”
পরিনীতা নীরবে চোখের কান্না ছেড়ে দিলো।
প্রেম বললো,
“এসব কথা বাড়ির কাউকে বলিস না। বিশেষ করে শুদ্ধ ভাইয়া আর প্রিয়তাকে তো কোনো অবস্থাতেই বলিস না। রাখলাম আমি। বাড়ির সবাইকে দেখে রাখিস।”
ফোন কেটে দিলো প্রেম।
পরিনীতা তব্দা লেগে কিছুক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার মস্তিষ্ক বুঝতে পারছে না চূড়ান্ত কথাটা প্রেম কী বললো।
কয়েক মুহূর্ত পর ভাইয়ের মায়ায় চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো পরিনীতা। ভাঙ্গা কণ্ঠে বললো,
“পর কখনো আপন হয় না দাদান… তুমি কেন বুঝলে না? কেন ওকে নিজের থেকেও অধিক ভালোবাসলে দাদান? কেন আমাদের বাসলে না? আমরা তোমার জন্য প্রাণ দিয়ে দিতাম, তবু ও তোমায় কষ্ট পেতে দিতো না! তুমি আমাদের মাথার উপর বিশাল বটবৃক্ষ… দাদান, তোমায় হারালে আমরা ফতুর হয়ে যাবো… কিন্তু ওর কিছুই যাবে আসবে না। ফিরে আসো দাদান!”
রাতের মধ্যপ্রহর চলমান। চার তলার বিশাল বারান্দা লাগোয়া ঘরটা সাজানো হয়েছে লাল-সাদা থিমে।
ঘরের সব লাইট নিভিয়ে জ্বালানো হয়েছে বড় বড় ক্যান্ডেল, ক্রিস্টাল জারের টলটলে পানিতে ভেসে বেড়াচ্ছে লাল-সাদা পদ্ম, মাঝে মাঝে ছোট ছোট ক্যান্ডেল।
বিছানা সহ মেঝের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে টকটকে লাল গোলাপের পাপড়ি। ঘর লাগোয়া বারান্দাও সাজানো হয়েছে মনের মতো, মরিচ বাতির আলোয় ঝলমল করছে বারান্দা।
শুদ্ধ দোলনায় বসে অধৈর্য চিত্তে হাত কচলাচ্ছে আর হাত ঘড়িতে সময় পর্যবেক্ষণ করছে।
হাতের ঘড়িটা জানান দিচ্ছে রাত প্রায় ১২টা ছুঁই ছুঁই। কিন্তু তার বহু প্রতীক্ষিত সেই নারীর দেখা নেই। এক পর্যায়ে অধৈর্য হয়ে পড়লো শুদ্ধ। আর অপেক্ষা করতে পারলো না। ঘটাঘট পা ফেলে স্থান ত্যাগ করলো।
রাত অনেক হয়েছে। প্রিয়স্মিতাকে চেপে ধরে আড্ডা দিচ্ছে মেয়েরা, যেন তাকে বাসরঘরে দেওয়ার তাদের কোনো ইচ্ছাই নেই। অথচ প্রেরণাকে সাদাফের ঘরে বসিয়ে এসেছে অনেকক্ষণ।
গুলবাহার বানু বৃদ্ধ মানুষ, তাই তিনি চলে গেছেন। ইনায়া আর ঊষা ও তাদের কক্ষে চলে গেছে, কারণ তাদের স্বামী তাদের ছাড়া ঘুমাতে পারে না। তাই বর্তমানে প্রিয়স্মিতাকে ঘিরে বসে আছে ত্রিধা, লাবিবা, স্বেতা, শুভ্রতা, দীপ্তি, থিরা, আরো অনেকেই।
অনামিকা দৌড়ে ঘরে প্রবেশ করলো। মেয়েদের উদ্দেশ্যে ত্রস্ত কণ্ঠে বললো,
“শুদ্ধ ভাইয়া…”
“কি শুদ্ধ ভাইয়া?” গম্ভীর স্বরে বললো দীপ্তি।
অনামিকা তাড়াহুড়ো করে বললো,
“শুদ্ধ ভাইয়া হন্তদন্ত হয়ে এদিকেই আসছেন! তোমরা তৈরি হও!”
ওর কথায় নড়ে চড়ে বসলো মেয়েরা। শুদ্ধ কক্ষে প্রবেশ করতে নিলেই তার পথ আগলে দাঁড়ালো।
শুদ্ধ ভ্রু কুচকে তাকালো ওদের দিকে।
লাবিবা শয়তানি হেসে বললো,
“উহু হু হু! এত তাড়া কিসের, দুলাভাই? রয়ে সয়ে! দম নিন!”
“ডান হাত, বাঁ হাত… আগে আমাদের দাবি পূরণ করুন, তারপর আপনার দাবি, ও আমরা পূরণ করে দেবো!”
“বেশি না, মাত্র ৮০,০০০।”
শুদ্ধ মোটেও তর্কে জড়ালো না, সাদা পাঞ্জাবির পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে পুরোটা ওদের হাতে দিলো।
চোখ বড় বড় করে ফেললো মেয়েরা। শুদ্ধ ওদের বিস্ময় পাত্তা না দিয়ে সবার পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো। ঘুমটার আড়ালে গুটিয়ে গেলো প্রিয়স্মিতার, অজানা আতঙ্কে তার বুক কেমন ধুকধুক করে উঠলো।
শুদ্ধ কোনো কথা বার্তা ছাড়াই প্রিয়স্মিতাকে কোলে তুলে ঘর থেকে চলে গেলো।
মেয়েরা মুখ হাঁ করে ফেললো। এতে লাবিবা ত্রিধাকে খামচে ধরে বললো, “হাউ রোম্যান্টিক, হায় হায়!”
সময় অনুমানিক ভোর পাঁচটা। দূরের কোনো গৃহস্থ বাড়ি হইতে কর্কশ কণ্ঠে মোরগ ডেকে উঠছে।
দক্ষিণের খোলা জানালা ভেদ করে প্রভাতের প্রথম কিরণ এসে লুটোপুটি খাচ্ছে শুভ্র রঙা বিছানায়, মৃদু বাতাসে তালে উড়ছে ঘরের মোটা মোটা লাল-সাদা পর্দাগুলো।
মেঝেতে গলানো মোমের অবশিষ্টাংশ পড়ে আছে অবহেলায়, দেহতলে পৃষ্ঠ হয়ে লাল গোলাপের পাপড়িগুলো, ওহ, মলিন কালচে বর্ণ ধারণ করেছে!
উদোম শরীরে কম্ফর্টার জড়িয়ে গভীর তন্দ্রায় তলিয়ে আছে শুদ্ধ, উপুর হয়ে শোয়ার দরুন এক গুচ্ছ এলোমেলো অনাদরে পড়ে আছে ললাটের উপর।
পিঠের দিকের কম্ফর্টার সরে যাওয়ার ফলস্বরূপ সুঘটিত ফর্সা পুরুষালি পৃষ্ঠ দেশের পুরোটাই দৃশ্যমান, তবে তাতে লেগে আছে হাজারো যখমের লাল নীল চিহ্ন।
নিস্তব্ধ কক্ষে দরজা লাগানোর বিকট শব্দে ঘুমের মধ্যেই মুখ বিকৃত করে ফেলল শুদ্ধ।
ওয়াশরুমের দরজা ঠেলে নগ্ন পায়ে বেরিয়ে এলো এক অতি সুন্দরী রমণী, যার সদ্যস্নাত নারীদেহের প্রতিটি ভাজে ভাজে লেপ্টে আছে স্বামী সোহাগের গভীর চিহ্ন।
সুন্দরীর ফর্সা কোমল ত্বক বেয়ে গড়িয়ে নামছে বিন্দু বিন্দু চিকন পানির ধারা।
হাতের মোটা মোটা কঙ্কনের রুমঝুম শব্দে মৃদু আলোড়ন তুলছে চারপাশে।
ভেজা শরীরে পানিতে সিঁদুর রঙা জামদানিটা ও প্রায় অনেকটা ভেজা।
প্রিয়স্মিতা অতিষ্ঠ হল ভেজা চুল নিয়ে। আশেপাশের কোথাও সে হেয়ার ড্রায়ার খুঁজে পেল না। অগত্যা দুই হাতে চুলের পানি ঝাড়তে ঝাড়তে ধীর স্থির কদমে এগিয়ে চললো শুদ্ধর নিকট।
শুদ্ধ গভীর তন্দ্রায় আচ্ছন্ন।
প্রিয়স্মিতা তার পানে চেয়ে ঠোঁট টিপে হাসলো, কাছে এসে আলগোছে বসে পড়লো শুদ্ধর শিয়রে।
গালে হাত দিয়ে এক ধ্যানে চেয়ে থাকতে থাকতে আনমনে বলল,
“ঘুমের মধ্যেও কোন পুরুষকে এত সুন্দর লাগে?”
সকাল সকাল নিজ বিবাহিত স্বামীর উপর বেশ কয়েকটা ক্রাশ নামক বাঁশ খেয়ে বসলো প্রিয়স্মিতা।
হাত নিসফিস করে উঠলো একটুখানি ছুঁয়ে দেয়ার জন্য। নিজের ইচ্ছা শক্তিকে দমাতে পারল না প্রিয়স্মিতা।
প্রচণ্ড আসক্তিতে হাত চলে গেলো শুদ্ধর গালে।
আলতো স্পর্শে খোঁচখোঁচে দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে মায়াময় কণ্ঠে বললো,
“নুনা সমুদ্রের অপরিসীম লবণাক্ত পানি হইতে তার লবণ আলাদা করতে পারবেন ডাক্তার সাহেব? পারবেন না।
লবণাক্ত সাগরের লবণ যেমন আলাদা করা দূরসাধ্য অসম্ভব, ঠিক তেমনি এই মেহেরিমা সিকদার প্রিয়স্মিতার থেকে আপনাকে আলাদা করা অসম্ভব।
যে চেষ্টা করবে, এই মেহেরিমা শিকদার প্রিয়স্মিতা তার জান নিয়ে নেবে।”
কথাগুলো বলা কালীন প্রিয়স্মিতার চোখ মুখ কেমন অজানা হিংস্রতায় ছেয়ে গিয়েছিল।
ঠিক অজানা নয় — এই হিংস্রতার সাথে আমার পাঠকরা বেশ ভালো মতন পরিচিত।
প্রিয়স্মিতার ফিসফিসানো বলা কথাগুলো শুদ্ধ শুনলো কিনা বোঝা গেল না।
হালকা নড়ে চড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লো, যেন এমন শান্তির ঘুম সে পূর্বে কখনো ঘুমায়নি।
শুদ্ধকে বারবার ঘুমিয়ে পড়তে দেখে প্রিয়স্মিতা বাঁকা চোখে তাকালো।
প্রিয়স্মিতার সারা শরীরে ব্যথা বানিয়ে দিয়ে এই লোকের এত সুখ আসে কোথা থেকে!
প্রিয়স্মিতা ঈর্ষান্বিত হল।
২ মিনিট চিন্তাভাবনা করতেই ফট করে মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি উঁকি দিলো।
শয়তানি হেসে কম্ফর্টারের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিলো প্রিয়স্মিতা।
আস্তে আস্তে পেট শুরু করে বুক পর্যন্ত সুরসুরি দিতে লাগলো আলতো হাতে।
ঘুমের মধ্যেই বিরক্তিতে নাকের পাটা ফুলে উঠলো শুদ্ধর।
প্রিয়স্মিতা বেশ মজা পেয়ে গেলো।
সে ঠোঁট চেপে হাসে, শুদ্ধর কানে সুড়সুড়ি দিলো, চিকন কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বললো,
“আই লাভ ইউ ডাক্তার সাহেব।”
চোখ বন্ধ রেখেই ঠোঁট কামড়ে হাসলো শুদ্ধ।
আচমকা হাতের কবজিতে প্রচণ্ড হেঁচকা টান অনুভব করলো প্রিয়স্মিতা।
অন্যমনস্কতায় তাল সামলাতে পারল না, মুখ থুবড়ে পড়লো উদোম পুরুষালি বুকে।
আতকে উঠলো প্রিয়স্মিতা।
ব্যাপারটা বোধগম্য হওয়ার পূর্বেই তার তুলতুলে শরীরটা চাপা পড়লো পুরুষালি নগ্ন দেহের তলে।
লজ্জায় শিটিয়ে গেলো প্রিয়স্মিতা।
শুদ্ধ মেট কম্ফর্টার টেনে দিলো দুজনের গায়।
প্রিয়স্মিতা ভেজা শরীরের গন্ধে শুদ্ধর আবারো মাথা আউলিয়ে যাচ্ছে।
সে তীব্র কামনায় মুখ ডুবিয়ে দিলো প্রিয়স্মিতার ভেজা শরীরে।
চমকে চেঁচিয়ে উঠলো প্রিয়স্মিতা,
শুদ্ধর এলোমেলো চুলের মুঠি খামচে ধরে অনুরোধ করলো,
“সকাল হয়ে গেছে ডাক্তার সাহেব, ছেড়ুন আমায়।”
শুদ্ধ নিজের কর্মে ব্যস্ত থেকে প্রিয়স্মিতার ওষ্ঠে তর্জনী চেপে ধরলো।
স্পর্শকাতর অঙ্গে দীর্ঘ চুম্বনে একে বললো,
“শশশ, সুইটহার্ট, ওয়ান্স মোর প্লিজ।”
প্রিয়স্মিতার বুকের ভেতর অনুভূতির তুফান পুনরায় লন্ডভন্ড করতে চলে আসছে।
সে চুল ছেড়ে শুদ্ধর আহত পিঠ খামচে ধরলো, পুনরায় অসহায় কণ্ঠে বললো,
“না প্লিজ, আমি মাত্রই গোসল করে এসেছি।”
শুদ্ধ অসব আলাপন পাত্তাই দিলো না।
এক টানে বুকের উপর থেকে আঁচল সরিয়ে দিলো, কানের লতিতে আলতো চুম্বন একে নেশালো কণ্ঠে বললো,
“আমাকে ব্যাড টাচ করার আগে এটা তোমার ভাবা উচিত ছিলো সুইটহার্ট। এখন কর্মফল ভোগ কর।”
“ডাক্তার সাহেব প্লিজ…”
“শশশ, জাস্ট ফিল মাই লাভ।”
অজানা কারণে মাথা প্রচন্ড ভার হয়ে আছে। প্রিয়তার সে চোখ মেলে তাকাতে চাচ্ছে, কিন্তু অসহনীয় বিষাক্ত যন্ত্রণায় নিপীড়িত হয়ে বারবার চোখ-মুখ কুঁচকে বন্ধ করে ফেলছে। এমন বেশ কয়েকবার হওয়ার পর অবশেষে চোখ মেলতে সক্ষম হলো প্রিয়তা। তবে তাতেও বিশেষ লাভ হলো না। নিজের অবস্থান সম্পর্কে ধারণা করতে পারল না, কারণ চোখ খোলা অবস্থাতেও সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। সামনে দৃশ্যের সম্পূর্ণটাই তার নিকট ধোঁয়াটে, অস্পষ্ট।
সে হাত দিয়ে চোখ ঢলতে নিলে অনুভব করলো, তার দুই হাত শক্ত মোটা কিছুর সাথে চেপে বাঁধা হয়েছে। এমতো পরিস্থিতিতে ঘাবড়ে গেল প্রিয়তা। অসস্তিতে দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হলো। হাত-পা ঘষে নড়াচড়া করার চেষ্টা করল, কিন্তু এবার অনুভব হলো—সে পা-ও নাড়াতে পারছে না। যার অর্থ তার হাত-পা দুটোই বাঁধা।
ভয়ে আতঙ্কে চিৎকার দিয়ে উঠলো প্রিয়তা,
“কে আছো! কে আমাকে বেঁধে রেখেছো! ছাড়ো বলছি! আমার ভীষণ ব্যাথা লাগছে! হাত পা ঝিনঝিন করছে! প্লিজ ছাড়ো আমায়!”
বলতে বলতে কেঁদে দিলো প্রিয়তা।
শুনতে পেলো, বেশ কয়েক জোড়া জুতার শব্দ এদিকেই এগিয়ে আসছে।
“রুহি, মেয়েটা তো জ্ঞান ফিরেছে! কী করবো এখন?” অস্থিরতায় প্রশ্ন ছুঁড়লো নুহা।
রুহি ভ্রু কুঁচকে প্রিয়তার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে কর্কশ আওয়াজে বলল,
“এই মেয়ে, তোমার কি মাথা ব্যাথা করছে? শরীর খারাপ লাগছে? কোথাও সমস্যা হচ্ছে?”
প্রিয়তা ঝাপসা চোখে সবকিছু দেখলো, কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলো না। টনটনে মাথার যন্ত্রণায় ফুঁপিয়ে উঠলো।
এত বড় মেয়েকে আচমকা কাঁদতে দেখে হকচকিয়ে গেলো—দৃষ্টি, সৃষ্টি, জারা, রুহি, নুহা, স্নেহা।
স্নেহা গোল গোল চোখে প্রিয়তাকে কাঁদতে দেখে ঢোক গিলে রুহির বাহু জড়িয়ে ধরে হতবাক কণ্ঠে বললো,
“এই ভাই, আমাকে একটা চিমটি কাটতো! না হলে কষে একটা থাপ্পর মার! এ আমি কি দেখছি! জীবন দশায় এমন দৃশ্য কখনো দেখতে হবে, এটা আমি বাপের জন্মেও ভাবিনি! ওই দেখ প্রিয়শ্মিতা কাঁদছে!”
ওকে কথা সম্পন্ন করতে না দিয়ে ওর কান গরম করে দিলো রুহি। চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
“আহাম্মক! ওহ, প্রিয়শ্মিতা নয়!”
স্নেহার মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। সে চোখ বড় বড় করে দেখতে লাগলো প্রিয়তাকে। বোকার মতো বলল,
“আসলেই!”
প্রিয়তা ক্রন্দনরত কণ্ঠে চিৎকার দিয়ে উঠলো ভাঙ্গা গলায়,
“প্রণয় ভাই, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে! আপনি কোথায়? আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলুন! আমার ভীষণ হাত পা ঝলছে!”
দৃষ্টি গালে হাতে দিয়ে বললো,
“এই প্রণয় ভাই আবার কোন ভাই?”
নুহার ভীষণ মায়া হলো। সে মায়াভরা চোখে প্রিয়তাকে দেখলো। মেয়েটার চোখ-মুখের অবস্থা ভালো নয়। সে জারাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“ওর হাত-পা গুলো খুলে দেওয়া যায় না? আমার মনে হয় ও অনেক ব্যথা পাচ্ছে।”
জারারও তাই মনে হলো। সে সৃষ্টিকে বললো,
“যা, এক বোতল পানি নিয়ে আয়।”
“দাঁড়া, আনছি!” বলে চলে গেলো সৃষ্টি।
রুহি গিয়ে প্রিয়তার হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিলো। দীর্ঘক্ষণ বাঁধা থাকার দরুণ ফর্সা চামড়ায় কালচে দাগ হয়ে গেছে।
“এই যে পানি,” বলে বোতলটা জারার হাতে দিল সৃষ্টি।
জারা হাতের আঞ্জলে পানি ভরে প্রিয়তার চোখে-মুখে ছুঁয়ে মারলো। হালকা কেঁপে উঠলো প্রিয়তা। মুখের ওপর পড়া দীঘল চুলগুলো একত্রে সরিয়ে মুঠো করে ধরলো স্নেহা।
এভাবে কয়েকবার পানির ঝাপটা দেয়ার পর কিছুটা শান্ত হলো প্রিয়তা। এখন সে সবকিছু পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু মুখের উপর ঝুঁকে থাকা এতো গুলো অচেনা মেয়ে দেখে মনে মনে ঘাবড়ে গেল।
রুহি বুঝতে পারলো প্রিয়তা হয়তো তাদের ভয় পাচ্ছে। তাই অভয় দিতে বললো,
“তুমি আমাদের বিশ্বাস করতে পারো। আমরা তোমার শত্রু নই।”
প্রিয়তা তবু ভয় পেল। চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করলো—সে এখানে কিভাবে এসেছে। হালকা হালকা কিছু কথা মনে পড়লো প্রিয়তার।
গত রাতে প্রণয় ভাইয়ের উপর জেদ করে ছাদ থেকে নেমে আসার সময় হঠাৎ কিছুতে সজোরে উষ্টা খেয়ে যায় প্রিয়তা। মুখ থুবড়ে পড়ে মেঝেতে। তখন কিছু একটা হয়। অন্ধকারে কেউ তার মুখ চেপে ধরে। কাউকেই দেখতে পায় না। কিছু বোঝার আগেই কি হয়—আর কিছু মনে নেই।
প্রিয়তা নিজের দিকেই তাকিয়ে দেখলো, গায়ে এখনো সেই হলুদ শাড়িটা। জায়গায় জায়গায় কুচকে, এলোমেলো হয়ে আছে।
“আচ্ছা, তোমার নামটা যেন কি?” হঠাৎ প্রশ্নে চমকে উঠলো প্রিয়তা। ভয়ার্থ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।
ওকে হঠাৎ হঠাৎ ঘাবড়ে যেতে দেখে ভীষণ হাসি পেলো স্নেহার।
“প্রিয়শ্মিতা কে এভাবে কথায় কথায় কাঁদতে, ভয় পেতে দেখার বিরাট স্বপ্ন ছিল আমার! যাই হোক, কেউ তো পূরণ করলো!”
কণ্ঠস্বর যথেষ্ট নমনীয় রেখে পুনরায় প্রশ্ন ছুড়লো রুহি।
“তোমার নাম কী?”
প্রিয়তা চোখ নামিয়ে নিলো। নিচু গলায় জবাব দিলো,
“তনয়া শিকদার প্রিয়তা।”
নুহা জারার কানে কানে বললো,
“প্রিয়তা আর প্রিয়শ্মিতা নাম দুটো কাছাকাছি না?”
জারা উপরে নিচে মাথা ঝাঁকালো।
রুহি পুনরায় শুধালো,
“সাজিদ আঙ্কেল তোমার কে হয়?”
হঠাৎ এমন প্রশ্নে কপালে চিকন কয়েকটা ভাজ পড়তে দেখা গেলো প্রিয়তার। সে বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কে হয় মানে?”
“মানে আমি জানতে চাইছি, সাজিদ সিকদার তোমার কে হয়?”
এমন আজাইরা প্রশ্নে বিরক্ত হলো প্রিয়তা। তবু বললো,
“উনি আমার আব্বু। কিন্তু হঠাৎ আমার আব্বুর কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন আপনারা?”
প্রিয়তার উত্তরেই চমকে উঠলো ওরা পাঁচজন। নিঃশব্দে মাথায় বজ্র পড়ার মতো অনুভূতি হলো তাদের।
বিস্ময়ে স্নেহার চোখ দুটো ডিম্বাকৃতি ধারণ করলো। সে নিজের মাথায় হাত দিয়ে অবাক কণ্ঠে বললো,
“সত্যি?”
প্রিয়তা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো।
জারার বেশ কৌতূহল হলো। সে আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“আচ্ছা, তোমার বয়স কতো? পুরোটা বলো।”
প্রিয়তার তর্ক করার সাহস হলো না। তাই স্পষ্ট জবাব দিলো,
“২০ বছর ২ মাস।”
এবার চুয়াল ঝুলিয়ে মাটিতে বসে পড়লো ওরা পাঁচজন। চোখ বড় বড় করে একে অপরের দিকে তাকালো।
নুহা রুহিকে খোঁচা দিয়ে বললো,
“মইরি, বুঝতে পারছিস কত বড় ঘাপলা! দুধে জল নয়, জলে দুধ!”
রুহি ভ্রু কুঁচকে বললো,
“এর মানে তারা আইডেন্টিক্যাল টুইন্স?”
“হুম। কিন্তু আঙ্কেল কত বড় স্ক্যাম করলো দেখেছিস? আমরা সব সময় জেনে আসলাম, উনার একটা মাত্র মেয়ে আছে। আর সে হলো প্রিয়শ্মিতা।”
“কিন্তু আজ জানতে পারছি আঙ্কেলের আরো একটা মেয়ে আছে, তাও একদম হুবহু জেরক্স কপি।”
দৃষ্টি গভীর চিন্তা করে বলল,
“অসব ছাড় আর এটা ভাব। এই মেয়েটা নিশ্চিত প্রিয়শ্মিতার জমজ বোন আর থাকে সিকদার পরিবারের সাথে। মানে নিজের পরিবারের সাথে, যেখানে বাবা, চাচা, ভাই-বোন, পরিবার সবাই আছে। তার মানে দাঁড়ালো ওইটা প্রিয়শ্মিতা আসল পরিবার।”
সৃষ্টির সব গুলিয়ে গেলো।
“তাহলে সিলেটে যে তৃপ্তি অ্যান্টি থাকেন, ওটা কি প্রিয়শ্মিতা? তাহলে কি উনার সন্তান না অন্য কারো সন্তান?”
সাথে সাথেই চমকে উঠলো ওরা ৫ জন। একে অপরের দিকে তাকিয়ে লাফিয়ে বসা থেকে উঠে পড়লো। কৌতূহলে তাদের মাথা ফেটে যাচ্ছে।
রুহি অধৈর্য কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“তোমার মায়ের নাম কী?”
প্রিয়তা লিটারালি এদের প্রতি তিক্ত বিরক্ত, কিন্তু সে এদের হাতেই কিডনাপ হয়ে আছে। তাই জলে থেকে কুমিরের সাথে বিবাদ করার ভুল করল না। শান্ত কণ্ঠে জবাব দিল,
“অনন্যা বেগম।”
“এহ্! সত্যি?”
“হুম।”
স্নেহা রুহির কানে কানে বললো,
“তার মানে এটা পরিষ্কার সাজিদ আঙ্কেলের দুটো বউ।”
পাশ থেকে নুহা ও তাল মিলিয়ে বললো,
“হুম, গভীর জলের ফিশ।”
ওদের কথা কানে নিলো না রুহি। ফের জিজ্ঞেস করলো,
“আচ্ছা, তোমার আর কোনো ভাই-বোন আছে?”
“জি আছে।”
“ভাই না বোন?”
“বড় এক ভাই।”
“নাম কী?”
“প্রতীক সিকদার প্রিথম।”
“তোমার আপন ভাই?”
“জি।”
“তোমার বড় না ছোট?”
“বড়।”
“উনার বয়স কত?”
“৩১ বছর।”
বিস্ফোরক সকল তথ্য শুনে চক্ষু চড়ক গাছ! ওদের ভিমরি খাওয়ার উপক্রম হলো।
জারার মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো।
“এর মানে ওর আম্মু প্রথম পক্ষ?”
“ওটা বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে ওরা দুজন আসলে কার মেয়ে — তৃপ্তি অ্যান্টি নাকি অনন্যা বেগম?”
রুহি একটু ভেবে বললো,
“মেইবি অনন্যা বেগম। কস তৃপ্তি আন্টি হলে ওরা দুজন তৃপ্তি আন্টির কাছেই থাকতো। এখন ও সিকদার বাড়িতে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।”
“এটা ভাবছিস কত বড়ো বলদ আমরা। আমরা এতো বছর ভাবতাম সাজিদ আঙ্কেল সাধারণ একজন গভার্নমেন্ট এমপ্লয়ী। কিন্তু এখন জানতে পারছি উনি বাংলাদেশের টপ ফাইভ ইন্ডাস্ট্রিজের একটা SK group এর অনার!”
“মানে ভাব, কি পরিমাণ প্যাচ লাগানো চারদিকে! কিন্তু আমি এটা বুঝতে পারছি না — এতো মিথ্যে, এতো ছলনা, এতো প্রতারণার কি প্রয়োজন?”
জারা ও সায় জানিয়ে বললো,
“একদম ঠিক বলেছিস। প্রিয়শ্মিতা যদি সিকদার বংশের মেয়ে হয়ে থাকে, তাহলে সে আমাদের সাথে এতো সাধারণ মধ্যবিত্ত জীবনযাপন কেন করতো? আর ওকে সবকিছু থেকে বঞ্চিত করার মানেটাইবা কি?”
“বুঝতে পারছি না। কিন্তু এতটুকু বুঝতে পারছি সাজিদ আঙ্কেল দ্যা গ্রেট বিজনেসম্যান সাদমান সিকদারের ভাই। আর প্রিয়শ্মিতা ওই বাড়ির মেয়ে। কিন্তু ছোট থেকে বড় হয়েছে খুবই সাধারণ আর মধ্যবিত্ত ভাবে, যেখানে ওর বংশের সবাই বিলিয়নিয়ার!”
“এই মেয়েটাকে দেখ, বন্দী হয়ে পড়ে আছেন ২৪ ঘন্টার বেশি। চেহারা ও মলিন হয়ে গেছে। কিন্তু তাও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সে কোনো অভিজাত পরিবারের মেয়ে। আর তার থেকেও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে সে কারো অতি আদরের।”
“হুম।”
“দারা দারা, এক সেকেন্ড! মেয়েটা একটু আগেই কার নাম নিয়েছিলো?”
“মেইবি প্রণয় ভাই।”
“রাইট! প্রণয় ভাই — তুমি বুঝতে পারছিস তো ও কোন প্রণয়ের কথা বলছে?”
স্নেহার ইঙ্গিতে চোখ বড় বড় করে ফেললো ওরা ৪ জন।
নুহা মুখে লাজুক হাসি ফুটিয়ে বললো,
“আমার ক্রাশ — বাংলাদেশের টপ বিজনেসম্যান আবরার শিকদার প্রণয়!”
“হ্যাঁ, আবরার শিকদার প্রণয়! সাদমান সিকদারের বড় ছেলে আর বাংলাদেশের টপ ফাইভ কোম্পানির আরেকটা পি.এস কোর্প এর ওনার! আরে, দুই দিন পরপরই তো পেপার, ম্যাগাজিন, আর্টিকেল — আরো কত কিছু বের হয় ওদের উপর! কাদা কাদা ছবি ছাপে দৈনিক সংবাদ এর শিরোনাম থাকে প্রায়শই!”
“এবার ভয় লাগতে শুরু করেছে। ওদের বান্ধবীর পাল্লায় পড়ে মেয়েটাকে আটকে রেখেছে ঠিকই কিন্তু ওই পরিবারের কেউ জানতে পারলে ১৪ পুরুষের নাম মিটিয়ে দেবে।”
হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠার সাথে সাথে ওদের আলোচনায় ছেদ পড়লো।
রুহি বললো,
“যা, দরজা খুলে দে। হয়তো প্রিয়শ্মিতা এসেছে।”
নুহা মাথা নুয়ে চলে গেলো।
প্রিয়তা চোখ ছোটো ছোটো করে ওদের ফিসফাস শুনছে।
“আসলেই এরা কি বলছে আর বলতে চাচ্ছে কিছুই আমার মাথায় ঢুকছে না। আমাকে কিডনাপ করে ওদের কি লাভ? মুক্তিপণের জন্য কিডনাপ করেছে বলে তো মনে হচ্ছে না!”
নুহা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একটু ইতস্তত করে বললো,
“প্রিয়শ্মিতা বলেছে আমাদের বাইরে আসতে। ঐ মেয়েটার সাথে নাকি তার পার্সোনাল ডিসকাশন আছে।”
ওরা কেউ কিছু না বলে চুপ চাপ চার জন কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।
প্রিয়তা খানিক অবাক হয়ে ভাবলো,
“এই প্রিয়শ্মিতা আবার কে? ওদের লিডার নাকি?”
প্রিয়তা ভাবনা শেষ করার পূর্বেই একটা সুপরিচিত কিন্তু অদ্ভুত কণ্ঠ এসে কানে লাগলো,
“বোন…”
তৎক্ষণাৎ দরজার পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো প্রিয়তা। সাথে সাথেই ৪৪০ ভোল্টেজের বৈদ্যুতিক ঝটকা খেললো। ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। জ্বীন-ভুত ভেবে ভয়ে হাত-পা কাঁপতে লাগলো, থর থর করে।
মুখ থেকে আপনাআপনি বেরিয়ে এলো,
“এটা কীভাবে সম্ভব!”
প্রিয়স্মিতার দৃষ্টি নরম, সে ধীর কদমে এগিয়ে এলো প্রিয়তার নিকট।
প্রিয়তা বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লো এক ঝটকায়। বিস্ফোরিত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইলো প্রিয়স্মিতার পানে।
তার নিজের চোখকেই বিশ্বাস হচ্ছে না — অবিকল তার মতো দেখতে কেউ একজন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এক নাক, এক কান, এক চোখ, এক ঠোঁট, এক চুল, এক উচ্চতা — নখ পরিমাণ পার্থক্য নেই!
প্রিয়স্মিতা এগিয়ে এসে ঝাঁপটে জড়িয়ে ধরলো প্রিয়তাকে।
আচমকা কেঁপে উঠলো প্রিয়তা, স্নায়ুতে তরঙ্গ খেলে যাওয়ার মতো অনুভূতি হলো।
প্রিয়স্মিতা কাঁদছে না, তবে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে প্রিয়তাকে। হয়তো বোনকে একটু অনুভব করার প্রয়াস চালাচ্ছে।
প্রিয়তার কণ্ঠনালীতে এসে সকল শব্দ দলা পাকিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। সে আওয়াজ বের করতে পারছে না।
তবু কাঁপা কাঁপা সরে শুধালো,
“কে আপনি?”
প্রিয়স্মিতা ছাড়লো প্রিয়তাকে, চোখে চোখ রেখে এক বাক্যে বললো,
“আমি তোর বোন।”
প্রিয়তা ডাগর অক্ষি কোঠর ছাড়ানোর উপক্রম হলো, অবিশ্বাসের কণ্ঠে বললো,
“আমার বোন?”
প্রিয়স্মিতা উপরে নিচে মাথা ঝাঁকালো।
প্রিয়তার বিশ্বাস হলো না।
প্রিয়স্মিতা ওর চোখে অবিশ্বাস দেখে হাসলো, পুনরায় বসিয়ে দিলো প্রিয়তাকে চেয়ারে। নিজে ও এসে বসলো প্রিয়তার সম্মুখে। আচানক নিজের হাত প্রিয়তার পানে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
“স্পর্শ কর।”
প্রিয়তা হতবাক।
প্রিয়স্মিতা পুনরায় বললো,
“স্পর্শ কর।”
প্রিয়তা ঢোঁক গিললো, কাঁপা কাঁপা হাতটা বাড়িয়ে রাখলো প্রিয়স্মিতার হাতের উপর। আবারও সেই একই তরঙ্গ অনুভব হলো। প্রিয়তার অবচেতন মন তার আপন জনকে স্বীকার করে নিল।
প্রিয়স্মিতা ভ্রু কুঁচকে বললো,
“কী ফীল করলি?”
প্রিয়তা জবাব দিতে পারলো না।
প্রিয়স্মিতা হাত সরিয়ে নিতে চাইলে তার আরো হাত শক্ত মুঠোয় চেপে ধরলো প্রিয়তা।
প্রিয়স্মিতা বাঁকা হাসলো।
প্রিয়তা অবিশ্বাসের কণ্ঠে বললো,
“তুমি আমার বোন হও?”
“কোনও সন্দেহ আছে?”
প্রিয়তা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো।
প্রিয়স্মিতা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“তোর সাথে আজকের পূর্বে আমার কক্ষনো দেখা হয়নি। তবু ও তুই আমার আপন, পৃথিবীতে সবার থেকে সব থেকে বেশি আপন। প্রথম স্পর্শে তোর প্রতি যে টান অনুভব করেছি, তা আমার ২০ বছরের জীবনে ওই নারী-পুরুষের প্রতি কক্ষনো করিনি। যারা নিজ স্বার্থসিদ্ধি উদ্ধারে মিথ্যে বলে, ছলনা করে, আমাদের আলাদা করে দিয়েছিল।”
অজানা কারণে চোখ টল টল করে উঠলো প্রিয়তার। সে ও নিজের অজান্তেই প্রিয়স্মিতার তালে সম্মতি জানালো।
“আমার ও তোকে খুব আপন লাগছে।”
প্রিয়স্মিতার অক্ষি কোণে সূক্ষ্ম পানির দেখা মিললো। তবু ও নিজেকে সামলে কঠিন কণ্ঠে বললো,
“তুই জানতে চাস না আমরা বোন হলে আলাদা ছিলাম কেন? তুই কেন আমার কথা জানতিস না? আমি কেন তোর কথা জানতাম না? কেন আমরা এতগুলো বছর এত দূরে ছিলাম?”
প্রিয়তার দুই চোখে কৌতূহল।
প্রিয়স্মিতা গর্জে উঠে বললো, কন্ঠে একদলা ঘৃণা মিশিয়ে বলল,
“ঘৃণা করি ওদের! খুব খুব ঘৃণা করি ওদের ওই প্রতারকদের! ঘৃণা করি ওই স্বার্থপরদের! ঘৃণা করি ওই বেঈমানদের! ঘৃণা করি, যারা নিজের স্বার্থে আমাকে আমার বোনের থেকে আলাদা করেছে! তাদের প্রত্যেককের থেকে গুনে গুনে হিসাব নেবো! এই মেহরিমা সিকদার প্রিয়স্মিতা কাউকে ছাড়বে না! ওদের পাপের সাম্রাজ্যের পতন হবে আমার হাতেই!”
প্রিয়স্মিতার তেজ ও ক্রোধ দেখে ভয়ে থর থর করে কেঁপে উঠলো প্রিয়তা। ওই সমুদ্রনীল চোখ দুটো যেন জ্বলন্ত আগুনের দুই কুণ্ডু।
কই, এতো সাহস তো নেই প্রিয়তার। সে কেবল উপর উপর শক্ত হওয়ার অভিনয় করে। কিন্তু ভেতরে তার এমন সাহসের এক কণাও নেই।
প্রিয়তা ভয়ভয় বললো,
“তুমি কী বলছো? কারা আমাদের আলাদা করেছে? আমাদের বাড়ির কেউ কেন তোমার কথা জানে না?”
ক্রোধে প্রিয়স্মিতার ঘাড়ের রগ ফুলে উঠছে। সে দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
“সাজিদ সিকদার আর তৃপ্তি বেগম!”
চমকে উঠলো প্রিয়তা। ঝট করে ছেড়ে দিলো প্রিয়স্মিতার হাত।
প্রিয়স্মিতা তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তাই না? আমারও হয়েছিল। কিন্তু এটাই সত্যি। ভালো মানুষের মুখোশধারি এই সাজিদ সিকদারই সব কিছুর মূলে ছিল। জন্মের পর সবার অগোচরে সে আলাদা করেছে আমাদের। আমাদের জীবনে যত দুঃখ কষ্ট, যন্ত্রণা, বেদনা, না পাওয়া, হাহাকার সব কিছুর সূচনা করেছে ওই সাজিদ সিকদার, যাকে আমি এত বছর আমার আদর্শ মনে করতাম।”
প্রিয়তা কৌতূহলী কণ্ঠে জানতে চাইলো,
“কীভাবে?”
“তুই প্রচণ্ড বোকা জানিস? তোর মতো গবেট আর মাথামোটা মেয়ে আমি দুটো দেখিনি। না হলে তোর চোখের সামনে এত কিছু ঘটলো, আর তুই চোখ বন্ধ করে থাকলি?”
প্রিয়তা কিছু না বুঝে বোকার মতো তাকিয়ে রইলো। মেয়েটার বোকা বোকা চাহনি দেখে প্রিয়স্মিতার মন চাইলো ঠাটিয়ে একটা কানের গোড়ায় লাগিয়ে দিতে।
তবুও নিজের বাড়ন্ত রাগ গিলে নিলো প্রিয়স্মিতা। হতাশ হয়ে বললো,
“তুই আমার বোন! আহারে কী কপাল আমার! ভাবতেই লজ্জা লাগে যে তুই আমার বোন! এই মেহরিমা সিকদার প্রিয়স্মিতার বোন! আমার বোন এত মাথামোটা! তোর চোখের সামনে দিনের পর দিন কত কিছু ঘটে গেল, আর তুই দেখতেই পেলি না? যাজ্ঞে ছাড়! এতদিন যখন বুঝিসনি আর তোকে কিছু বুঝতে হবে না। এবার যা বুঝার আমি বুঝবো! তবে I’m sure, এখানে কিছু একটা হচ্ছে। কিছুতো এমন আছেই, যেটা আমি জানি না বা বুঝতে পারছি না। কিন্তু তোর এত দিনে জানা উচিত ছিল।”
প্রিয়তা ও ভাবনায় পড়ে গেলো।
“সত্যি কি আমি এত বোকা?”
তৎক্ষণাৎ প্রিয়স্মিতা ডাকলো,
“প্রিয়!”
কেঁপে উঠে তাকালো প্রিয়তা।
প্রিয়স্মিতা ওর হাতের উপর হাত রাখলো।
কেন যেন এই ছোঁয়ায় ভীষণ ভরসা আর বিশ্বাস পেলো প্রিয়তা। প্রথমবারের মতো অনুভব হলো সত্যি তাকেও কেউ বুঝবে, ভালো চাওয়ার অজুহাতে দূরে সরিয়ে দেবে না।
প্রিয়স্মিতা কোমল কণ্ঠে বললো,
“থাক, তোকে বেশি ভাবতে হবে না। আমি এসে গেছি না। আমি সব ভাববো। তবে তোকে কিছু সত্যি জানাতে চাই।”
প্রিয়তা প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।
প্রিয়স্মিতা কোনো অস্বস্তি ছাড়াই বললো,
“তুই আজকের পর আর কোনোদিন সাজিদ সিকদারের সাথে কোনো কথা বলবি না।”
প্রিয়তা কেন জিজ্ঞেস করতে নিলেই প্রিয়স্মিতা বললো,
“কেননা সাজিদ সিকদার একজন অনেক বড় ক্রিমিনাল। সমাজে অপরাধ করেছে কিনা জানি না, তবে আমাদের সাথে যে অপরাধ করেছে তার কোনো ক্ষমা হয় না।”
“আমাকে পরিষ্কার করে বলো।”
প্রিয়স্মিতা লম্বা শ্বাস টেনে বলতে শুরু করলো,
“আমি সবটা জেনেছি, মাত্র দুই দিন হলো। এখন তোকে বলছি — তুই কী ভাবিস সাজিদ সিকদার তোকে খুব ভালোবাসে? হুহ মূর্খ তুই এতদিন ঠিক এটা আমিও ভাবতাম। তাই মূর্খ আমি! আসল সত্যি হলো সাজিদ সিকদার তোকে, আমাকে, ভাইয়াকে — কাউকেই ভালোবাসে না। আমরা কেউ তার আপন নই। তার ভালোবাসার মানুষ যদি কেউ হয়ে থাকে সে কেবল তৃপ্তি বেগমকে। তৃপ্তি বেগমের স্বার্থে সে তোকে আমাকে খুন করতে দুবারও ভাবেনি। এমনকি এটাও মনে রাখবে না যে সেই আমাদের জন্ম দিয়েছে।”
প্রিয়তা হতভম্ব কণ্ঠে শুধালো,
“কী, কে এই তৃপ্তি বেগম?”
প্রিয়স্মিতা চোখ বন্ধ করলো, তবু নিজেকে কঠোর রেখে বললো,
“তৃপ্তি বেগম, সাজিদ সিকদারের প্রথম পক্ষ।”
এহেন কথায় প্রিয়তা যেনো তাজ্জব বনে গেলো।
প্রিয়স্মিতা পুনরায় বললো,
“হ্যাঁ, তৃপ্তি বেগম সাজিদ শিখদারের প্রথম পক্ষ এবং একমাত্র ভালোবাসার মানুষ। উনার প্রথম পক্ষ সন্তান ধারণে অক্ষম। তাই আমাদের জন্মের পর খুব সন্তর্পণে আমাদের একজনকে চুরি করেছেন। উনি পৃথিবীর সবাইকে জানিয়েছেন, উনার যমজ সন্তানের একটি মৃত। কিন্তু আসল সত্য তো অন্য কিছু ছিল।”
প্রিয়তা যেন ঘোরের মাঝে আছে। বাবার দু’টা বউ—এই কথাটা শোনা কোনো সন্তানের জন্য খুব একটা কাম্য নয়।
হঠাৎ করেই প্রিয়তার ভীষণ কান্না পেলো। সে নিজেকে আটকাতে পারলো না, হুহু করে কেঁদে উঠলো। প্রিয়স্মিতা তাকে পরম মমতায় জড়িয়ে নিলো বুকে। সে ভেবে নিয়েছে, এই মেয়েটা ব্যতীত এই পৃথিবীতে তার আর কোনো আপন নেই।
ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৬৯
সব সম্পর্কই তার খাদের ধারে পা দুলাচ্ছে—যখন তখন ভেঙে পড়বে। কিন্তু আজীবন আঁকড়ে ধরার মতো থেকে যাবে এই এক আপনজন।
প্রিয়তা হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“আব্বু এত খারাপ! আমি কখনো ভাবতে পারিনি। আই হেট হার।”
“আই অলসো হেট হার সিস্টার।”