ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৭২
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই
পেরিয়েছে আরও বেশ কিছুদিন। সকালের নাস্তা খেতে খেতে খবরের কাগজে চোখ বুলাচ্ছিলেন সাদমান সিকদার। এমন সময় টুং করে হোয়াটসঅ্যাপে একটা নোটিফিকেশন এলো।
তিনি চশমা ঠেলে ফোন হাতে নিয়ে দেখলেন, অচেনা নাম্বার থেকে অনেকগুলো ছবি সেন্ড করা হয়েছে। সাদমান শিকদার শত নাম্বারটায় ক্লিক করলেন।
সাথে সাথেই তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন সাদমান সিকদার।
শিকদার বাড়ির ড্রয়িং রুমে বিরাজমান পিন পতন নীরবতা। প্রত্যক্ষ করলে মনেই হবে না কিছুক্ষণ পূর্বে এই স্থানে টর্নেডো বয়ে গেছে। মাত্রাতিরিক্ত গুমট নীরবতা যেন ঝড়ের পূর্বাভাস।
ড্রয়িং রুমে টু সিটার সোফা গুলোতে পায়ের উপর পা তুলে বসে প্রতীক্ষার প্রহর গুনছেন —
সাদমান শিকদার, খালিদ শিকদার, ফারহান চৌধুরী, মেহজাবিন চৌধুরী, অনন্যা বেগম, শুদ্ধ।
উপস্থিত আছেন বাড়ির মহিলা মহল থেকে শুরু করে চাকরবাকর অনেকেই।
এই বাড়ির কেচ্ছা তাদের কাছে নতুন না। এমনিতে সবসময় লাগে না, কিন্তু যখন লাগে তখন একদম সিনেমার কাহিনীকে হার মানিয়ে যায়।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আর যে বড়সড় কিছু একটা হতে যাচ্ছে, সে বিষয়ে তারা শতভাগ নিশ্চিত।
কল্পনা থেকে উঠে আসা চিন্তাভাবনাগুলো কল্পনা করেই শিউরে উঠছে একেকজন। সকলের মুখেই আতঙ্কের চাপ, শঙ্কায় বুক দুরুদুরু করছে।
অনুশ্রী বেগম ভয়ে ভয়ে বারবার স্বামী আর ননদের দিকে তাকাচ্ছেন। তাদের চোখ-মুখে কী যে পাষবিক নিষ্ঠুরতা!
এরা যখন বেশি রেগে যায়, তখন তাদের আসল রূপগুলো না চাইতেও বেরিয়ে আসে। আর এটাই সবচেয়ে বেশি ভয় করেন অনুশ্রী বেগম।
তিনি তাঁর সব সন্তানদের নীতি-নৈতিকতা, মনুষ্যত্ব শিখাতে পারলেও পারেননি বড় ছেলেকে। সে ঠিক তাঁর বাপ-চাচার ধাঁচে চলে গেছে।
আর তাই এত তাড়াতাড়ি জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে।
খালিদ শিকদার ও ফারহান চৌধুরীরও একই অবস্থা। কেবল শুদ্ধ ব্যতিক্রম— সে কোনো প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন ছাড়াই বসে আছেন।
সবাইকে দেখে মনে হচ্ছে, তারা হয়তো শুদ্ধর উপস্থিতির জন্য নিজেদের ইচ্ছামত বিশেষ কিছু করতে পারছে না; কেবল মনে মনে ফুঁসছে।
সকলের এমন কঠোর মুখাবয়ব দেখে ভয়ে তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ঊষা।
প্রিয়াস্মিতার সাথে চেপে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
“কি সর্বনাশ ঘটতে চলেছে প্রিয়পু, আমার ভীষণ ভয় করছে।”
প্রিয়াস্মিতা ঊষার আতঙ্ক দেখল কিনা বোঝা গেলো না। তার নীলাভ চোখের সুচারু দৃষ্টি এই মানুষগুলোর সাথে নিজের মিল খুঁজতে ব্যস্ত।
পূর্ণতা আজ ধীর কণ্ঠে বলে উঠলো,
“মেজ ভাবি শ্বেতা কে একটা বুদ্ধিমান, ম্যাচিওর মেয়ে ভাবতাম। সে এতটা ম্যাচিওর হয়ে এই কাজটা কীভাবে করতে পারলো? ও কিভাবে অন্য একজনের সংসার ভাঙতে চাইতে পারল? ও তো জানতো আবির্ভাব দা বিবাহিত, তার পরও ওর কাছ থেকে এটা আশা করিনি।”
পূর্ণতার কথায় সহমত পোষণ করলো ইনায়া।
ঊষা ফের চাপা কণ্ঠে বললো,
“সেজো ভাবী, আজকে যে কী হতে চলেছে, সেটা কল্পনা করতেই আমার দম আটকে আসছে।”
পূর্ণতাকে বেশ চিন্তিত দেখালো।
এর মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই বাড়ির কলিং বেল বেজে উঠলো।
কলিং বেলের শব্দ পেতেই লাফিয়ে উঠলো উপস্থিত প্রত্যেকে।
কৌতূহল ভারী উত্তেজিত দৃষ্টিগুলো গিয়ে স্থির হলো দরজার চৌকাঠে।
মেহজাবিন চৌধুরী চোখ-মুখ দপ করে জ্বলে উঠলো প্রচণ্ড নিষ্ঠুরতায়। তিনি চোখ-মুখ শক্ত করে দরজা খুলতে চলে গেলেন।
বাড়ির প্রত্যেকে দুরুদুরু মনে এগিয়ে গেলেন সেদিকে।
দরজার কপাট খুলতেই দৃশ্যমান হলো কতগুলো ক্লান্ত, বিধ্বস্ত মুখ। ক্লান্ত শরীর টেনে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল —
প্রেম, প্রিথম, প্রণয়, আবির্ভাব, শ্বেতা।
প্রণয় আগের থেকে অনেক সুস্থ, কিন্তু শরীর এখনো বেশ দুর্বল। সে বাসায় প্রবেশ করে এদিক-ওদিক কারো দিকে তাকালো না। সকলের কৌতূহলী মুখগুলো দেখেও না দেখার ভান করে চলে গেল নিজ কক্ষে।
প্রিথম, প্রেম আর আবির্ভাব এতো গুলো মানুষকে একসাথে নিজেদের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে খানিকটা ভড়কে গেল।
প্রিথম সবাইকে ঠেলে ঢুকতে ঢুকতে ক্লান্ত কণ্ঠে বললো,
“কি ব্যাপার? এভাবে ঝটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কেন সকলে? ঘরে কী যেতে দেবে না?”
প্রিথম কথা সমাপ্ত করতে পারলো না। তার পূর্বেই বিশাল এক থাবা মেরে শ্বেতার হাতের কব্জি চেপে ধরলো শুদ্ধ। সর্বসম্মুখ থেকে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে যেতে লাগলো বোনকে।
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পরল প্রিথম, প্রেম, আবির্ভাব।
শ্বেতা শুদ্ধর শক্ত হাতের মুঠি ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে মৃদু আর্তনাদ করে বলতে লাগলো,
“আহ দাদা, লাগছে তো! আস্তে ধরো… দাদা আমি ব্যথা পাচ্ছি।”
কিন্তু শ্বেতার সেই অনুনয় শুদ্ধর কান অবধি মোটেও পৌঁছালো না। বরং আরও শক্ত করে চেপে ধরে হিড়হিড় করে টানতে লাগলো।
তার পেছন পেছন মেহজাবিন চৌধুরীও গেলেন। ক্ষোভে, আক্রোশে রঞ্জিতা বর্ণ ধারণ করেছে তাঁর চোখ-মুখ।
প্রিথম সবার চোখে মুখে বিকৃত নিষ্ঠুরতার এক নিকৃষ্ট প্রতিফলন দেখতে পেলো। কিন্তু এর সঠিক কারণ অনুধাবন করতে পারল না।
শুদ্ধ ও মেহজাবিন চৌধুরী শ্বেতাকে টেনে হিঁচড়ে ঘরে নিয়ে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলেন।
ধড়াম করে দরজার পল্লা আটকানোর শব্দে কেঁপে উঠলেন প্রত্যেকে।
আবির্ভাব হাবলার মতো তাকিয়ে রইলো। সে বুঝতে পারলো না এসব হচ্ছে টা কী।
সে বন্ধ দরজার দিকে এগোতেই তার দুই বাহু দুই দিক থেকে চেপে ধরল রাজ ও সমুদ্র।
ভাইদের এমন ব্যবহার দেখে হতবাক হয়ে গেলো প্রিথম।
আশ্চর্যন্বিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“এই বাড়িতে এসব কি মেলোড্রামা শুরু হয়েছে?
আর তোরা এমন বেয়াদবি করছিস কেন? উনি আমাদের বড়ো ভাইয়া! এভাবে চেপে ধরেছিস কেন? ছাড় বলছি!”
আক্রোশে চেঁচিয়ে উঠলো সমুদ্র। চোখ লাল করে বললো,
“মেজদা, উনি আমাদের বড়ো ভাই না। বড় ভাই হলে এই কাজটা সে কোনদিনও করতে পারত না!”
প্রীতম কণ্ঠে বিস্ময়ের রেশ টেনে বলল,
“কী– কী এমন করেছেন ভাইয়া?”
এবার দ্বিগুণ শব্দে গর্জে উঠল রাজ, আবির্ভাবের কলার চেপে ধরে বলল,
“উনি আমাদের কত বড়ো সর্বনাশ করেছেন, তুমি ভাবতেও পারবে না মেজদা!”
“মানে?”
সমুদ্র পুনরায় কিছু বলবে তার পূর্বে বন্ধ দরজার ভেতর থেকে শুদ্ধর উঁচু গলার শব্দ ভেসে এলো, সে চিৎকার দিয়ে বলছে—
“তর ওই মুখে আর একবারও ‘আবির্ভাব’-এর নাম উচ্চারণ করবি না! নাহলে জিব্বা কেটে রাস্তার কুকুরকে খাইয়ে দিতে দ্বিতীয় বার দ্বিধা করব না!”
সাথে মেহজাবিন চৌধুরীর কিছু অশ্রাব্য গালিও ভেসে আসতে শোনা গেল।
“আমাকে মেরো না মম! আমার খুব ব্যাথা লাগছে!” — বলে হুহু করে কেঁদে উঠলো শ্বেতা। করুন কাকুতি মিনতি করতে লাগল তাদের নিকট।
প্রেয়সীর এহেন ব্যাকুল আর্তনাদ শুনে হৃৎপিণ্ড কামড় দিল, আবির্ভাবের গভীর পীড়া অনুভূত হলো অন্তরে। সে ধস্তাধস্তি শুরু করে দিলো, একপ্রকার রাজকে ধাক্কা দিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলো—
“ছাড়ো আমায়! ওরা কী করছে আমার চড়ুই পাখির সাথে! আমায় যেতে দাও আমার বাবুই পাখির কাছে, my love!”
আবির্ভাবের এমন পাগলাটে আচরণে বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেল সকলে। চোখ কপালে তুলে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগলো আবির্ভাবের পাগলামো।
সাদমান শিখদার আর সহ্য করতে পারলেন না, উঠে এসে সজোরে লাথি বসিয়ে দিলেন আবির্ভাবের বুক বরাবর। সাথে সাথেই পুরুষালী আঘাতে কিছুটা দূরে ছিটকে পড়লো আবির্ভাব।
সাদমান শিকদার ছুটে এসে গলায় পাড়া দিয়ে ধরলেন, অশ্রাব্য গালিগালাজ করতে করতে বললেন—
“জানোয়ারের বাচ্চা! তোকে বিশ্বাস করে নিজের বাড়িতে থাকতে দিয়েছিলাম, তুই আমার মান সম্মান নিয়ে চিনি-মিনি খেলবি? আমার ভাগ্নিকে নষ্ট করার চেষ্টা করবি?”
সাথে সাথেই শ্বেতার বিকট শব্দে আর্তচিৎকার ভেসে এলো—
“আমাকে এভাবে মেরো না মম! আমি সত্যি মরে যাবো!”
সাথে সাথেই টেনে ধরে শ্বেতার তুলতুলে গালে ঠাটিয়ে চড় বসিয়ে দিলো শুদ্ধ।
শুদ্ধ ঘৃণিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো—
“তুই আমার বোন হয়ে কিভাবে পারলি আরেকটা মেয়ের সংসার ভাঙতে? তুই আমার বোন হয়ে কিভাবে পারলি জেনে শুনে এক বিবাহিত পুরুষের সাথে সম্পর্কে জড়াতে? কিভাবে পারলি এত নিচে নামতে? তোকে এই শিক্ষা দিয়েছিলাম আমরা? তোর একবারও মনে পড়লো না আমার কথা? আমাদের মান সম্মানের কথা? তোর একবারও মনে পড়লো না ওই লোকটা বিবাহিত? ওর ঘরে বউ আছে?”
“তুই সামনে থেকে সরে দাঁড়া, শুদ্ধ! ওই বান্দির বাচ্চাকে আমার হাতে তুলে দে। আজ ওর শরীরের সকল জ্বালা যদি আমি গুছিয়ে দিতে না পারি, তবে আমি শিকদার বংশের মেয়ে নই।”
শুদ্ধ ও তাই শুনলো। মায়ের হাতে বোনকে তুলে দিয়ে গটগটিয়ে বেরিয়ে গেলো।
শ্বেতা অশ্রু টলমলে চোখে তব্দা খেয়ে বসে রইলো। তার ভাই এগুলো তাকে কী বলে গেল? সত্যি এগুলো ওর নিজের ভাই বলল? নিজের ভাবনার বিরোধিতায় প্রতিবাদের কোন ভাষা খুঁজে পেলো না শ্বেতা। তার ভাই আজকের পূর্বে এমন কঠোর বাক্য দ্বারা কখনো তাকে আঘাত করেনি।
মেহজাবিন চৌধুরী শ্বেতার লম্বা চুলের মুঠি পেচিয়ে ধরে বললেন—
“আজকে দেখবো, তোর শরীরে ঠিক কতটা ঝাল আছে। যার জন্য তোকে ওই বিবাহিত ছেলের কাছে যেতে হলো! আমাদের বলতি, আমরা বিয়ে দিয়ে দিতাম।”
“নষ্টা মেয়ে! ওই ছেলের লাশ তো ফেলবই, সাথে তোকে ও আজ টুকরো টুকরো করে নদীতে ভাসিয়ে দেবো!”
ব্যথার তীব্রতায় ডুকরে কেঁদে উঠলো শ্বেতা। সহ্য করতে না পেরে ঝাঁপটে ধরলো মেহজাবিন চৌধুরীর পা।
শ্বেতা কাঁদতে কাঁদতে বিলাপ করে বললো—
“রহম করো মম! আমি তোমাদের পায়ে পড়ি। তোমরা আমাকে যত খুশি মারো, কাটো, বাটো — যা ইচ্ছা করো, আমি মুখে টু শব্দ করবো না। কিন্তু উনাকে মেরো না মম! উনাকে আঘাত করো না। উনাকে ছেড়ে দাও। সব ভুল তো আমার ছিল, বলো! তাহলে উনাকে শুধু শুধু কেন কষ্ট দেবে?”
শ্বেতার চোখমুখে এমন অপরিসীম ভালোবাসা দেখে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন মেহজাবিন চৌধুরী। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে আরো জোরে জোরে একের পর এক আঘাত করতে লাগলেন।
এতক্ষণ ঘরের ভিতরে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনাই বাইরে থেকে শুনতে পেলো সকলে। শ্বেতার কান্না আর আহাজারি শুনে উন্মাদ হয়ে উঠলো আবির্ভাব।
সে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল সাদমান শিকদারকে। রাজ আর সমুদ্র আবার চেপে ধরলেও এবার তারা কিছুতেই শক্তিতে পেরে উঠছে না।
আবির্ভাব চিৎকার করে বললো—
“দয়া করে, তোমরা আমার পুতুলটাকে আঘাত করোনা! ও অনেক নরম, কোমল, সতেজ একটা ফুল! অল্প আঘাতেই মূর্ছা যায়। তাহলে কিভাবে সইবে তোমাদের এসব পাষবিক নির্যাতন?”
সাথে সাথেই শক্ত হাতে ঘুষি খেয়ে ছিটকে পড়লো আবির্ভাব। তেড়ে গিয়ে ওর শার্টের কলার চেপে ধরল শুদ্ধ। হিংস্র সিংহের ন্যায় থাবা বসিয়ে বললো—
“বিশ্বাসঘাতক! তুই বন্ধুত্বের মুখোশ পরে আমার পিঠে এভাবে ছুরি মারতে পারলি? এমন বীভৎস সুযোগ নিলি আমার বিশ্বাসের? এই প্রতিদান দিলি আমার ভালোবাসার?”
“তুই আমরা চোখের আড়ালে, আমারই বোনের সাথে কেন এই শত্রুতা করলি? আমার সাথে বল, কেন করলি? কেন আমার বোনের জীবনটা এভাবে নষ্ট করে দিলি?”
আবির্ভাব যেন এসকল কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। হৃদয়টা ছিঁড়ে খুড়ে যাচ্ছে শ্বেতার আর্ত চিৎকারে।
সে চিৎকার করে অনুনয় জানায়—
“তোমরা আমার সাথে যা ইচ্ছা করতে পারো। জানে মেরে ফেলবে, মেরে ফেলো — আমি একটু বাধা দেব না। কিন্তু তোমরা ভালোবাসাকে এত নির্দয়ভাবে আঘাত করোনা! আর কষ্ট দিও না! এই আঘাত আমার অন্তরে সহ্য হচ্ছে না।”
“My love…”
সাদমান শিখদারের আর সহ্য হচ্ছে না। মন চাচ্ছে, নিজের হাতে ছেলেটাকে এখানেই কুপিয়ে রেখে দিতে।
শুদ্ধ আবির্ভাবের এমন বাড়ন্ত পাগলামি দেখে রাজ আর সমুদ্রকে চোখের ইশারায় কিছু একটা বুঝাল। সাথে সাথেই আবির্ভাবকে টেনে হিঁচড়ে বাড়ির বাইরে নিয়ে যেতে লাগলো অরণ্য, সমুদ্র ও রাজ।
আবির্ভাব আহত কন্ঠে চিৎকার দিয়ে ডাকলো—
“আমায় কোথায় নিয়ে যাচ্ছো তোমরা? ছাড়ো! প্লিজ, আমাকে শেষ করে দেওয়ার আগে অন্তত একবার দেখতে দাও আমার পাখিটাকে! একটু বুকে নিয়ে আদর করতে দাও!”
“ওই জান… কই তুই? আয় না পাখি! আয় না আমার বুকে… দেখ না, ওরা… ওরা আমাকে তোর কাছে যেতে দিচ্ছে না! আমার থেকে দূরে করে দিচ্ছে তোকে!”
অবির্ভাবকে টানতে টানতে বাড়ির লন এরিয়ে নিয়ে এলো ছেলেরা। এখান থেকে আর অবির্ভাব শুনতে পাচ্ছে না তার পাখির গলার আওয়াজ।
শুদ্ধ তীব্র রাগে ও ক্ষোভে পাগলের মত আচরণ করতে শুরু করল। আচমকা আক্রমণ করে বসলো অবির্ভাবকে, একের পর এক শক্ত বলবান আঘাতে গুঁড়িয়ে দিতে লাগলো অবির্ভাবের বলিষ্ঠ শরীরখানা।
“তুই আমার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আমার বোনের জীবনটা নষ্ট করলি? কিভাবে পারলি? তোর বুক একবারও কাঁপলো না? মনে হলো না আমার বোনটা এর পর বাঁচবে কিভাবে?”
অবির্ভাবকে বেধড়ক মারতে মারতে এক পর্যায়ে রক্তাক্ত করে ফেলেছে শুদ্ধ। সারা শরীর লাল হয়ে গেছে রঞ্জিত তরল পদার্থে। কিন্তু এত আঘাতেও একটু “উফ” করছে না অবির্ভাব। চোখ বুজে সকল যাতনা মেখে নিচ্ছে শরীরে।
বেশিক্ষণ নিজেদের রাগ ধরে রাখতে পারলেন না সাদমান শিকদার আর খালিদ শিকদারও। একত্রে এক নির্মম, পাষবিক নির্যাতনের খেলায় মেতে উঠলেন। একের পর এক বিভৎস আঘাতে জর্জরিত করে দিতে লাগলেন অবির্ভাবের শরীর। নাক-মুখ দিয়ে রক্ত উঠে আসছে। ইতিমধ্যেই অবির্ভাব ভগ্নপ্রায় শরীরে ঠোঁট এলিয়ে হাসলো, ব্যথাতুর কণ্ঠে বিড়বিড় করল—
“তোমাকে কি এর থেকে ও বেশি ব্যথা দিচ্ছে আমার প্রাণ?”
“কি হচ্ছে এখানে?”
দূর থেকে ভেসে আসা হুংকারে থেমে গেলো সকলে।
পিছনে ফিরে দেখলেন প্রণয় ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে।
সাদমান শিকদার ফুঁসে উঠে সজোরে পেটে লাথি মেরে বললেন,
“এই জানোয়ারের বাচ্চা! আরেক জাতের পোলা হয়ে ঘরে বউ রেখে আমার ভাগনিকে ফুসলিয়েছে? ছলে বলে নষ্ট করার চেষ্টা করেছে? ওকে আজ এখানেই জিন্দা দাফন করবো। এরপর ওর লাশের সম্মুখে দাঁড় করিয়ে বিয়ে পড়াবো আমার ভাগ্নির!”
প্রণয় ভ্রু কুঁচকে সামনে তাকিয়ে দেখলো—অবির্ভাবের পুরো শরীর ক্ষত-বিক্ষত। রক্ত চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে আঘাতপ্রাপ্ত স্থান থেকে। যে জায়গায় ফেলে মারছিলো, সেই জায়গার সবুজ ঘাস পর্যন্ত রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে।
দীর্ঘশ্বাস ফেললো প্রণয়। এটা তো হবারই ছিলো। শুদ্ধর মাথায় যেন খুন চেপেছে। সে আবার সর্বশক্তি দিয়ে আঘাত করতে শুরু করলো। কিন্তু পূর্বের ন্যায় এবারও কোনো শব্দ করলো না অবির্ভাব।
সাদমান শিকদার বাড়ি থেকে বড় রামদা নিয়ে আসলেন।
গরু জবাই দেওয়ার দা দেখে ভড়কে গেল প্রেম, প্রীতম, অরণ্য, সমুদ্র, রাজ।
প্রণয় বুকে দুই হাত ভাঁজ করে উত্তেজনাবিহীন শান্ত মুখে দাঁড়িয়ে রইল।
সাদমান শিকদার দা নিয়ে তেড়ে গেলেন অবির্ভাবের গলার কাছে। নিজের পরিণতি আঁচ করতে পেরে চোখ বন্ধ করে নিলো অবির্ভাব। মনে মনে আফসোস করে বললো—
“শেষ ক্ষণে তোকে দেখতে পেলাম না জান…
কিন্তু তোকে কতটা ভালোবাসি বুঝেছিস তো? আমি থাকি বা না থাকি, কখনো আমার ভালোবাসাকে প্রশ্নবিদ্ধ করিস না।
তুই যে আমার বড্ড আদরের বুকপাঁজরে গাঁথা এক অমূল্য সম্পদ।”
সাদমান শিকদার সর্বশক্তি দিয়ে কোপ দিতে নিলেই তার হাত চেপে ধরলো শুদ্ধ। রামদাটা কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলল। অবির্ভাবকে টেনে তুলে বললো,
“আমার বোনকে খুব ভালোবাসিস তাই না? খুব ভালোবাসিস আমার বোনকে?
মৃত্যু মানে মুক্তি, আর মুক্তি তোকে আমি পেতে দেব না! মৃত্যুর মতো এত ক্ষুদ্র শাস্তি দ্বারা তোকে ক্ষমা করবো না!”
অবির্ভাব নিভু নিভু অসহায় চোখে চাইলো শুদ্ধর পানে।
শুদ্ধ চোখ লাল করে ধাক্কা দিয়ে উঠে দাঁড়ালো, বাঁকা হাসি দিয়ে বলল,
“যা, তোকে ছেড়ে দিলাম প্রাণে, মারলাম না। কিন্তু মনে রাখিস, এটা তোর মুক্তি নয়—এটা তোর শাস্তি।
আজকের পর থেকে আমার বোনের ত্রিসীমানায় যেন তোকে না দেখি। তুই আর কোনোদিন ও আসবি না এই বাড়িতে। আমি আমার বোনের বিয়ে দেবো, আর কালকের মধ্যেই দেব।”
এতক্ষণ নীরব থাকলেও শুদ্ধর শেষ বাক্যে আহত বুকটা ছ্যাত করে উঠলো অবির্ভাবের।
শুদ্ধ ফের বললো,
“আমি দুর্বল নই। আমার বোনকে আমি তোর কলঙ্কের বোঝা বয়ে বেড়াতে দেবো না। দুনিয়া জাহান্নামে চলে গেলেও কালই বোনের বিয়ে হবে।”
অবির্ভাব বুক চেপে ধরে ছটফটি উঠলো। দুই হাতে শুদ্ধর পা জড়িয়ে ধরে অসহায় কণ্ঠে বললো,
“তার থেকে তুই আমায় এখুনি শেষ করে দে! তবু আমার ভালোবাসার পাখিটাকে আমার বুক থেকে ছিনিয়ে নিস না!
জীবিত অবস্থায় তুই আমার কলিজাটা বের করে নিলেও আমাকে ততটা যন্ত্রণা দিতে পারবি না, যতটা যন্ত্রণা আমি তখন পাবো।
তুই ও তো বুঝিস ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণা, তাহলে আমার প্রতি এত নিষ্ঠুর আচরণ কীভাবে করিস?”
শুদ্ধ পা ছাড়িয়ে নিলো। কথার জবাব না দিয়ে ভাইদের উদ্দেশ্যে বললো,
“ওকে এক্ষুনি আমার চোখের সামনে থেকে দূর করো, না হলে সত্যি সত্যি একে আমি মেরে ফেলবো।”
অবির্ভাব কাতর হলো ভালোবাসাকে এক নজর দেখার তৃষ্ণায়।
প্রেম আর প্রতীম এগিয়ে আসতেই পুনরায় শুদ্ধর পা আকড়ে ধরলো অবির্ভাব, করুণ গলায় মিনতি করল,
“আমি চলে যাবো। কিন্তু প্লিজ, যাওয়ার আগে একবার—শেষবার—আমার পাখিটাকে দেখতে দে।
একটুখানি বুকে জড়াতে দে, বুকটা পুড়ে যাচ্ছে ভাই, একটুখানি দয়া কর।”
শুদ্ধ রক্তিম চোখে তাকালো ভাইদের পানে। প্রেম আর প্রতীম কিছু বলতে পারলো না। বাধ্য হয়ে অবির্ভাবকে টেনে হিঁচড়ে গেটের বাইরে বের করে দিলো।
সাদমান শিকদার দারোয়ানদের উদ্দেশ্যে হুঙ্কার দিয়ে বললেন,
“এই ছেলেটা যদি এই বাড়ির চৌকাঠ ডিঙোয়, তাহলে সবগুলোর ঘাড় থেকে মাথা আলাদা করে দেবো।”
প্রণয় বুকে হাত গুঁজে শান্ত, নির্লিপ্ত চোখে শুধু অবলোকন করে গেলো দৃশ্যগুলো। আজ তার চোখের সামনে তার প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে এত আঘাত করা হলো, অথচ তার কিছুই বলার নেই।
আসলে এই ব্যাপারটা দেখা ছাড়া কারোর কিছু বলার জায়গাই নেই।
সে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলো—একটা পুরুষ তার ভালোবাসার জন্য ঠিক কতটা অসহায়।
শুদ্ধ মাথার চুল খামচে ধরে ঘাসের উপর বসে পড়লো। চোখের সামনে সব ঝাপসা।
“আমি কী করবো ভাই… কীভাবে আমার বোনকে একটা সুন্দর জীবন দেবো… কিভাবে বের করব তাকে এসব থেকে… ভাই হিসেবে আমি ব্যর্থ হলাম রে…”
প্রণয় শান্ত গলায় বললো,
“তুই ভুল বুঝছিস। ব্যাপারটা… তুই যেমন ভাবছিস, আসল ব্যাপারটা তেমন নয়।”
শুদ্ধ জিজ্ঞেস করলো,
“তাহলে ব্যাপারটা কেমন?”
প্রণয় নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো,
“শ্বেতার সাথে অবির্ভাবের সম্পর্কের বয়স ১ বা ২ বছর নয়—মোটামুটি ৬-৭ বছরের মতো।
অবির্ভাব তোর বোনকে যে পরিমাণ ভালোবাসে, আমার মনে হয় তোরা কেউ তাকে এতটা ভালোবাসিস বা ভালোবাসতে পারবি না।
নসিবের লেখা ছিল আলাদা হয়ে যাওয়া, তাই ওরা আলাদা হয়ে গেছে—তাও অবির্ভাবের বিয়ের আগেই।
শ্বেতার সাথে অবির্ভাবের কোনো এক্সট্রা ম্যারিডাল অ্যাফেয়ার নেই।
তবে বিচ্ছেদ হলেই কি ভালোবাসা ফুরিয়ে যায়? বরং সেই না-পাওয়া ভালোবাসার হাহাকার বুকের প্রতিনিয়ত রক্ত ঝরায়।
ওরা কোনো পাপ করেনি—শুধু শুধু দুটো মানুষকে আঘাত করলি।”
শুদ্ধ বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। বুকটা হুহু করে উঠলো আরও বেশি যন্ত্রণায়।
“তার মানে… আমার ছোট্ট বোনটা এতগুলো দিন ধরে মুখ বুঝে এমন নরক যন্ত্রণা সহ্য করছিলো?
ও… আমার বোনকে ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঠকিয়েছে?
আমার বোনের সাথে সম্পর্ক করে অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করেছে!
এতোটা কাপুরুষ ও! ওকে জীবিত ছাড়াই অন্যায় হয়েছে!”
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো প্রণয়, বললো,
“দেখ, তুই যা ভালো বুঝিস…”
বলে স্থান ত্যাগ করলো সে।
শিকদার বাড়ির বিশাল গেটের বাইরে, রাস্তার এক পাশে রক্তাক্ত শরীরে পড়ে আছে অবির্ভাব।
বুকে তার পাহাড় সম ব্যথা। অনেক চেষ্টার পরও তাকে বাড়ির ভেতর ঢুকতে দেয়নি দারোয়ানগুলো। শরীরে আর জোর নেই।
দিশেহারা হয়ে পড়ছে অবির্ভাব। চোখের সামনে বাঁচার সব রাস্তা বন্ধ হয়ে আসছে ধীরে ধীরে।
জ্বলন্ত বক্ষে হাত চেপে বললো,
“কি আমি টাকে কি বানিয়ে দিলে মাই লাভ? তুমি তোমার পাগলের ডাক্তারকে সত্যি সত্যি পাগল বানিয়ে ছাড়লে।
আমি মরতে চাই না, মাই লাভ… আমি বাঁচতে চাই। কিন্তু সত্যি কি আমি বাঁচতে পারবো? ওরা কি আমাকে সত্যি বাঁচতে দেবে?
আমার গর্ভধারিণী মা আমাকে জীবন্ত লাশ বানিয়ে দিয়েছে, আর তুমি আমাকে চিতায় তুলে দেবে…”
“রাস্তার পাশে বসে কি পাগলের মতো পড়ে বিড়বিড় করছিস? নিজের অবস্থা দেখেছিস? চল, তোকে বাসায় পৌঁছে দেই।”
কথাগুলো বলে মুখের সামনে হাতটা বাড়িয়ে দিলো প্রণয়।
অবির্ভাব দুর্বল চোখে চাইল প্রণয়ের পানে। প্রণয়কে বেশ স্বাভাবিকই দেখাচ্ছে।
প্রণয় ওর হাত টেনে তুলে বসা থেকে দাঁড় করিয়ে বললো,
“সামান্য এতোটুকুতেই মুষড়ে পড়লে হবে বন্ধু? আরো কত কিছু দেখার বাকি!
সবে তো শুরু।”
অবির্ভাবের চোখ-মুখ আতঙ্কে নীল হয়ে গেল।
সকালের মেডিসিনটা মিস হয়ে যাওয়ার দরুন বুকে একটা সূক্ষ্ম চিনচিনে ব্যথা অনেকক্ষণ যাবৎ অনুভব করছে প্রণয়।
সে বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করলো। গাড়ির ফ্রন্ট গেট খুলে দিয়ে বললো,
“উঠে বস।”
অবির্ভাব মুখ ঘুরিয়ে নিলো। স্পষ্ট বাক্যে জানিয়ে দিলো,
“আমার পাখিকে না দেখে এখান থেকে এক পা-ও নড়বো না আমি!”
“এখানে জন্মের পর জন্ম দাঁড়িয়ে থাকলেও তুই কক্ষনো দেখতে পাবি না! এখন চল!”
অবির্ভাব ত্যাড়ামি করতে ধরলেই পেছনে লাথি দিয়ে গাড়ির ভেতর বসিয়ে দিলো প্রণয়।
ডোর লক করে নিজেও এসে বসলো ড্রাইভিং সিটে।
গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে শান্ত গলায় বললো,
“এই বয়সে টিনেজারদের মত পাগলামি করে কোন লাভ আছে, অবির্ভাব?
তুইও খুব ভালো মত জানিস কী হতে যাচ্ছে।
আর যা হতে চলেছে, তা আটকানো তোর সাধ্য নয়।
তোর বুকে এক সমুদ্র ভালোবাসা—পৃথিবীর কাউকে তুই দেখাতে পারবি না।
আর দেখাতে পারলেও হয়তো কিছু করতে পারবি না।
তাহলে শুধু শুধু এখানে পড়ে থেকে লাভ আছে?”
প্রণয় কথা শেষ করতেই চলন্ত গাড়ির কাচে সজোরে ঘুষি পড়লো।
বুলেটপ্রুফ কাচের কিছুই হলো না, কিন্তু অবির্ভাবের চামড়া ছিঁড়ে গিয়ে ভিতরের মাংস থেতলে গেল চোখের নিমিষে।
সেসবের তোয়াক্কা না করে গর্জে উঠলো অবির্ভাব,
“কিছু করার নেই মানে ও আমার, বুঝতে পেরেছিস? ও শুধুই আমার!
ওকে ভালোবাসলে কেবল আমি ভালোবাসবো!
ও সংসার করলে কেবল আমার সাথেই করবে!
বাঁচলে ও আমার সাথে বাঁচবো, আর মরলে ও আমার সাথেই মরবো!
আমি সমাজ, নীতি, সম্পর্ক—এসব কিছুর ধার ধারি না!”
প্রণয় কেবল নিঃশব্দে হাসলো, কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না।
অবির্ভাবের কেমন অনুভব হচ্ছে, তার শতভাগ খুব ভালো মতই অনুভব করতে পারছে প্রণয়।
সে জানে না, এমন চললে অবির্ভাবকে আদৌ বাঁচানো সম্ভব হবে কি না।
কিন্তু এখানে তারও কিছু করার নেই।
শুধু তার কেন—পৃথিবীর কারোরই কিছু করার নেই।
এবার আল্লাহ যা চাইবেন, তাই হবে।
নির্জীব শরীরে মার্বেল বিছানো মেঝেতে লুটিয়ে আছে শ্বেতা। দাগবিহীন মসৃণ শরীরটা বীভৎস মারের কালশিটের দাগের অতলে চেপে পড়েছে।
ফর্সা টুকটুকে গালে জল জল করছে পাঁচ আঙুলের দাগ। ইচ্ছেমতো মেরে বাইরে থেকে দরজা আটকে চলে গেছেন মেহজাবিন চৌধুরী। হালকা ফুপানোর সাথে সাথে শ্বেতার তনু শরীর দুলে উঠছে। গায়ে জোর নেই, কাউকে কিছু বলারও।
তবুও শারীরিক সকল যন্ত্রণাকে পায়ে ঠেলে তীব্র অস্থিরতায় ভরে উঠছে শ্বেতার ছোট্ট মন। বুকে ভেতর ভীষণ জ্বালা করছে ভালোবাসার মানুষটার জন্য। “কতই না মেরেছে হয়তো মানুষটা কে!” এসব ভাবতে ভাবতেই পড়ে পড়ে ঢুকরে কেঁদে উঠল শ্বেতা।
মেঝে আঁকড়ে ধরে ব্যথাতুর কণ্ঠে বলল —
“আপনার অনেক লেগেছে তাই না, আবির্ভাব? ওরা আপনাকে অনেক মেরেছে! সব দোষ তো আপনার! কে বলেছিল আমায় এত ভালবাসতে? কী প্রয়োজন ছিল এত পাগলামি করার? উফ, পাবেন না জেনে ও কেন আমায় এত ভালোবাসেন?” — বলতে বলতে জড়জড়িয়ে কেঁদে দিলো শ্বেতা।
বাইরে থেকে শুনতে পাচ্ছে ফারহান চৌধুরী আর মেহজাবিন চৌধুরীর চেঁচামিচি।
“আমি তোমার ভরসায় আমার ছেলে-মেয়েদেরকে ছেড়ে ছিলাম, মেহু। আর তুমি সামান্য আমার মেয়েটাকে দেখে রাখতে পারলে না? তুমি থাকতে এত বড় ঘটনা ঘটে কিভাবে?”
স্বামীর কর্কশ কণ্ঠে বলা কথাগুলোতে ছ্যাত করে উঠলেন মেহজাবিন চৌধুরী —
“সব আমার দোষ? তোমার মেয়ের যে চরিত্র ভালো না, এটা দেখতে পাও না? আমি কি এত বড় মেয়ের পিছু পিছু ঘুরবো?”
সাদমান সিকদার বিরক্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন —
“আহ, কী হচ্ছেটা কী! তোমরা ওই ছোটোলোকের বাচ্চাকে নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি করো না! আজকেই ওকে বুঝিয়ে দিতাম সিকদার বাড়ির মেয়েদের দিকে হাত বাড়ানোর পরিণাম, কিন্তু তোমাদের ছেলের জন্য পারলাম না!”
খালিদ সিকদার পাশ থেকে ফুঁড়ে কেটে বলে উঠলেন —
“সত্যি, শুদ্ধ না আটকালে আজ ওই ছেলেটাকে জবাই দিয়ে দিতাম, বুঝিয়ে দিতাম আমরা আসলে কোন বংশের!”
“হ্যাঁ, হয়েছে হয়েছে, এসব নিয়ে আর ভাবতে হবে না। যা হবার হয়েছে। এসব লোক জানাজানির আগে যত দ্রুত সম্ভব আমাদের মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। না হলে পরে এই মেয়েকে কেউ বিয়ে করতে চাইবে না।”
“ঠিক বলেছেন ভাইজান। ওই ছেলেটার যা অবস্থা দেখলাম, ওর কোনো গ্যারান্টি নেই, যখন তখন এসে আবার ঝামেলা পাকাতে পারে। ঘরে বউ আছে, তবুও এত…”
শুদ্ধ আর পৃথমকে আসতে দেখে থেমে গেলেন খালিদ সিকদার। শুদ্ধ দ্রুত পদক্ষেপে এগিয়ে এলো ফারহান চৌধুরীর নিকট, চোখে চোখ রেখে কাঠ কাঠ কণ্ঠে বললো —
“আমি চাই কালকেই আমার বোনের বিয়ে হোক। আপনার কি কোনো আপত্তি আছে? যদিও আমি আপনার থেকে এই বিষয়ে মতামত চাইছি না, সিদ্ধান্ত জানাচ্ছি।”
এতে অবশ্য কেউ অবাক হলেন না। ফারহান চৌধুরী শান্ত গলায় বললেন —
“বিয়ে দিয়ে দেবো বললেই তো আর বিয়ে দিয়ে দেওয়া যায় না। আমার একটা মাত্র মেয়ে, তাকে তো আমি আর যার তার ঘরে দিতে পারি না। আমার মেয়ের জন্য উপযুক্ত পাত্র পেয়েছো?”
“না, এখনও জানি না। তবে আমার বোনের বিয়ে কালকেই হবে। আর সব থেকে বেস্ট ছেলেটার সাথেই হবে।”
খালিদ সিকদার একটু ভেবে বললেন —
“এমপি সাহেবের ছেলে চলবে। কয়েকদিন আগেই এমপি সাহেবের সাথে কথা হলো। উনি উনার ছেলের জন্য পাত্রী খুঁজছেন। যেহেতু এমপি’র ছেলে, টাকা পয়সা, শিক্ষা-দীক্ষা, নাম, যশ — সব দিক থেকেই অনেক এগিয়ে।”
কিন্তু উনার কথায় বাগড়া দিয়ে বসলো পৃথম। বিরোধিতা জানিয়ে বললো —
“ওই ছেলেটার চরিত্র ভালো না। মদ আর মেয়ের নেশায় ডুবে থাকে সারাদিন। তবে আমার একজন আছে, যে শ্বেতাকে পছন্দ করে। আর আমাদের ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে ও অনেক শেড উপরে। তোমরা সবাই তাকে চেনো।”
শুদ্ধ ভুরু কুঁচকালো।
পৃথম স্পষ্ট বাক্যে বললো —
“ইরফান।”
চোখ বড় বড় করে ফেললো উপস্থিত জনগণ।
পৃথম সবার এক্সপ্রেশন দেখে হেসে বললো —
“এতো অবাক হওয়ার কী আছে? ইরফান আমাকে বলেছে, সে শ্বেতাকে পছন্দ করে। হয়তো কয়েক দিনের মধ্যেই বিয়ের প্রস্তাব দিত।”
ফারহান চৌধুরী গম্ভীর গলায় বললেন —
“ঠিক আছে, ওই ছেলের আর তার বাবা-মার সাথে কথা বলার ব্যবস্থা করো, দেখি ছেলেটা কেমন।”
সকালের এসব কথাবার্তা শুনে গা কাঁটা দিয়ে উঠলো শ্বেতার। আতঙ্কে নীলাভ বর্ণ ধারণ করলো শুভ্র মুখখানি।
“ন্ন্ন্না, আমি কাউকে বিয়ে করতে পারবো না! আমি কারো হতে পারবো না! আমাকে অন্য কারো হতে দেখলে আমার আবির্ভাব মরে যাবে!” — শ্বেতা চিৎকার দিয়ে বললো — “আমি বিয়ে করবো না, কিছুতেই করবো না! শুনছেন আপনারা? মরে যাবো, তবুও কাউকে কবুল বলবো না!”
মেহজাবিন চৌধুরী রেগে আবার মারার জন্য তেড়ে যেতে নিলে শুদ্ধ আটকে দিল, কঠিন কণ্ঠে শাসিয়ে বলল —
“আর একবারও কেউ আমার বোনের গায়ে হাত তুলবেন না! যদি শুনতে পাই, আপনাদের জন্য মোটেও ভালো হবে না। চল, প্রীতম।”
বলে হন হন করে চলে গেলো শুদ্ধ।
কেউ আর কিছুই বললেন না।
শ্বেতা অসহায়ত্বের জ্বালায় চিৎকার দিয়ে কেঁদে বলছে —
“হে রব, তুমি এত নিষ্ঠুর কেন গো? আমি তো সব মেনে নিয়েছিলাম, তাহলে এমন পরীক্ষা কেন নিচ্ছ? আমরা কি পাপ করেছিলাম? ভালোই তো বেসেছিলাম তোমার নিকট! তোমার সকল বান্দাই তো এক, তাহলে আমরা কেন বিভেদের শিকার হলাম? আমার পাগল মানুষটা কে ধৈর্য্য দিও, আল্লাহ, সহ্য করার তৌফিক দিও, মানুষটা যে বড্ড ছন্নছাড়া।”
ঢাকা পৌঁছতে পৌঁছতে আবার শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এল। আবির্ভাবের প্রণয় ওর অবস্থার বেগতিক দেখে প্রথমেই হাসপাতালে নিয়ে গেলো। সেখান থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ব্যান্ডেজ করিয়ে নিয়ে গেলো আবির্ভাবের নিজস্ব ফ্ল্যাটে।
কলিংবেলের শব্দ শুনে দরজা খুলে দিলেন আবির্ভাবের মা, মিসেস পূজারিণী রায় চৌধুরী। তিনি দিন চারেক হলো এসেছেন।
তিনি দরজা খুলে সামনে অজ্ঞাত পরিচয় যুবককে দেখে অবাক হলেন, কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইলেন —
“কে বাবা তুমি?”
প্রণয় ভদ্রমহিলাকে ২ সেকেন্ড দেখেই চিনে ফেললো, মনে মনে কিছু হিসেব কষে ওষ্ঠে বাঁকা হাসি ফোটালো। পাশ কাটিয়ে ত্রস্ত পায়ে বাসার ভেতর ঢুকতে ঢুকতে বললো —
“আমি শ্বেতার ভাই।”
পূজারিণী ভ্রু কুঁচকে থাকলেন —
“শ্বেতা নামটা ওনার খুব চেনা চেনা লাগছে।”
প্রণয় ওনার ভাবনাচিন্তা পাত্তা না দিয়ে সোফার উপর পা তুলে বসে লাল আপেলে কামড় বসালো। পূজারিণী রায় চৌধুরীর সন্দেহান চোখ মুখ পর্যবেক্ষণ করতে করতে শীতল হেসে ঠান্ডা কণ্ঠে হুমকি ছাড়লো —
“ছেলের প্রাণের মায়া কি একেবারেই ছেড়ে দিয়েছেন?”
এই হাঁটুর বয়সী ছেলের বেয়াদবি দেখে আশ্চর্য না হয়ে পারলেন না পূজারিণী রায় চৌধুরী।
খেঁকিয়ে উঠে বললেন —
“তুমি কে হে ছোকরা? বলা নেই, কওয়া নেই, বাড়ির ভেতর ঢুকে এসেছো?”
“আমি কে — খুব তাড়াতাড়ি আপনাদের ভালো মতো চিনাবো, আন্টিজি। আপনার আদরের ছোট ছেলের শরীরটা এতগুলো টুকরো করবো যে আপনি নিজেই গুনে শেষ করতে পারবেন না। তখন বুঝবেন আমি কে আর কী কী করতে পারি।”
এমন ঠান্ডা গলায় ভয়ংকর হুমকি শুনে জমে গেলেন পূজারিণী রায় চৌধুরী। তবুও তুতলিয়ে বললেন —
“ক্ক্ক্ কে তুমি? আমার ছেলের সাথে তোমার কী শত্রুতা?”
এবার যেন হঠাৎ করেই ক্ষেপে গেলো প্রণয়। শান্ত চোখ-মুখ মুহূর্তেই হিংস্র পশুতে পরিণত হলো। পা দিয়ে সজোরে লাথি দিলো সেন্টার টেবিলে। ঝনঝনিয়ে কাঁচ ভাঙার শব্দ হলো সাথে সাথে। প্রণয় হুঙ্কার ছেড়ে বললো —
“আপনার ছেলের জন্য আমার বোনের জীবনটা জাহান্নাম হয়ে গেছে! আপনার ছেলের জন্য আমার বোনটা তিলে তিলে মরছে! কী ভাবছেন, আবরার শিকদার প্রণয় এত সহজে ছেড়ে দেবে?”
“ছেলেকে বিয়ে করানোর সময় তো ঠিকই অন্য জায়গায় করিয়ে দিয়েছেন, তাহলে এখন আমার বোনের পিছে কেন লেলিয়ে দিচ্ছেন?”
এবার ভয়ে ঘামতে শুরু করলেন পূজারিণী রায় চৌধুরী। তিনি বুঝে গেছেন এই ছেলেটা ওই মেয়ের ভাই, আর ওই সন্ত্রাসী পরিবারের কেউ হয়তো।
এত চিৎকার চেঁচামিচি শুনে ছুটে এলো দেবী।
প্রণয় ভদ্রমহিলার চোখ মুখের ভয়ভীতি অবলোকন করে বললো —
“একদম ভয় পাবেন না আন্টিজি, আপনার ছেলেকে এখনো মারিনি, বাঁচিয়ে রেখেছি। কিন্তু আমার বোনের পিছে যদি আর একবার আসে, খোদার কসম, জ্যান্ত কবর দিয়ে দেবো!” — বলে শাসিয়ে চলে গেলো প্রণয়।
ভয়ে হাড় হিম হয়ে গেলো দেবী ও পূজারিণী রায় চৌধুরীর।
প্রণয় চলে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই বিল্ডিং এর দারোয়ান ধরে ধরে নিয়ে এলো আবির্ভাবকে। রক্তে ভেজা জামাকাপড় আর হাতে মুখে ব্যান্ডেজ দেখে ঘর কাঁপিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলেন পূজারিণী রায় চৌধুরী। দৌড়ে গেলেন ছেলের নিকট ঝাঁপটে ধরতে চাইলেন, কিন্তু ছোঁয়ার পূর্বেই সরে গেলো আবির্ভাব। ঘৃণিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো পূজারিণী রায় চৌধুরীর পানে। আজ কেবল এই ‘মা’ নামক মানুষটার জন্যই তার ফুলের মত সাজানো জীবনটা নরক হয়ে গেছে।
আবির্ভাব নিজেকে সামলে সোফায় শরীর এলিয়ে দিলো। চোখ বন্ধ করতেই মনের ক্যানভাসে ভেসে উঠলো শুভ্র রঙা সেই লাজুক মুখখানি।
পূজারিণী রায় চৌধুরী চিৎকার দিয়ে পুরো ফ্ল্যাট মাথায় তুললেন।
আহাজারি করতে করতে বললেন —
“ওই সন্ত্রাসীগুলো কী অবস্থা করেছে আমার ছেলেটার! এই জন্যই আমি ওদের থেকে দূরে থাকতে বলতাম! ওই ছেলেটা এসে প্রকাশ্যে খুনের হুমকি দিয়ে গেলো!”
মায়ের কান্না দেখে তাচ্ছিল্যময় হাসি আর ধরে রাখতে পারলো না আবির্ভাব। ঘৃণায় দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলো। দুর্বল কণ্ঠে বললো —
“কাল যদি আমার মৃত্যু হয়, তার জন্য একমাত্র দায়ী তুমি থাকবে, মা!”
“আমি ঈশ্বরের কাছে রোজ প্রার্থনা করি — যে পুকুর তুমি আমার বুকে খনন করেছো, তার হাজার গুণ তোমার কাছে ফিরে আসুক। আমি যেমন আমার ভালোবাসা হারিয়ে প্রতিটি সেকেন্ডে ছটফট করতে করতে মরছি, তুমিও যেন তোমার সন্তান হারিয়ে একইভাবে ছটফট করতে করতে মরো!”
আবির্ভাবের এই ক্ষতবিক্ষত অবস্থা দেখে চোখ ফেটে পানি গড়িয়ে পড়লো দেবীর। সে হারে হারে উপলব্ধি করতে পারলো — এই ঘটনা তার কৃত কর্মের ফল।
কিন্তু এরকম কিছু যে হতে পারে তা সে কল্পনায়ও আনতে পারেনি।
আবির্ভাব দেবীর পানে চেয়ে তাচ্ছিল্য করে বললো —
“খুশি হয়েছো, দেবী? তুমি তো এটাই চেয়েছিলে! তাই তো আমার ছবিগুলো চুরি করেছো?”
“ঈশ্বরের করুণায় তোমার জন্য আরও বড় খুশির সংবাদ আসছে, অপেক্ষা করো। সকলকেই তার নিজ নিজ কর্মের ফল ভোগ করতে হয়। আমি করছি, মিসেস রায় চৌধুরী — আপনারাও করবেন!” — বলে দুর্বল পায়ে উঠে নিজের কক্ষে চলে গেলো আবির্ভাব।
দেবীও কাঁদতে কাঁদতে নিজের ঘরে চলে গেলো।
মেঝেতে বসে বিলাপ করতে লাগলেন পূজারিণী রায় চৌধুরী।
রাত গভীর হয়েছে অনেক কিন্তু শিখদার বাড়ির পরিবেশের কোনও উন্নতি হয়নি, বড়োরা এখনো ড্রয়িং রুমে বসে বিয়ের বিষয়ে আলোচনা সমালোচনায় বিভোর।
সকলের মুখ থম থমে, চেহারায় শরতের কালো মেঘ, ঘুম নেই কারো চোখে।
মা না হয়েও অনুস্রী বেগমের কলিজা চিরে যাচ্ছে শ্বেতার আর্তনাদে, মেয়েটার করুণ কণ্ঠস্বর সোজা ওনার কলিজাকে ক্ষতবিক্ষত করছে।
অনুস্রী বেগম ভাত বাড়তে বাড়তে আচলের কোণায় বার বার চোখের পানি মুছছেন আর আল্লাহর নিকট আরজি জানাচ্ছেন।
“হে মাবুদ, ছেলে মেয়ে দুটোকে সস্তি দাও, শান্তি দাও, যা কখনো পাওয়া নয়, তা নিয়ে পাগলামো কমিয়ে দাও, এত হাহাকার আর চোখে দেখা যায় না মাবুদ বারবার কেন এত পরীক্ষা নাও? যে তাকদিরে থাকে না তার জন্য মনে এত মায়া কেন দাও?”
“মাংসটা রেখে এসেছি বড়ো আপা”—বলতে বলতে থেমে গেলেন অনন্যা বেগম।
অনুস্রী বেগম চোখ মুছে বললেন, “এই নে, এই মাছের বাটিগুলো নিয়ে যা।”
অনন্যা বেগম গেলেন না, বরং উনার ও চোখ চলচল করে উঠলো, ভেজা কণ্ঠে বললেন, “আমাদের ছেলে মেয়েগুলো কি কোনদিন ও সস্তি পাবে না আপা? ভালোবাসা না পাওয়ার পাহাড় সম যন্ত্রণা বয়ে কী তাদের বাঁচতে হবে আজীবন?”
“তোমার মনে হচ্ছে না আপা, আমাদের ছেলে মেয়ের জীবন ও আমাদের মতো হয়ে যাচ্ছে?”
“মনে হয় না আমাদের সাথে যা যা হয়েছিল এগুলোর রিভেঞ্জ অফ ন্যচার।”
অনুস্রী বেগম চমকে উঠলেন চট করে চেপে ধরলেন ছোটো বোনের মুখ, ভয়ার্ত চোখে তাকালেন আশেপাশে।
বোনকে চোখ রাঙানি দিয়ে চাপা কণ্ঠে ধমকে বললেন, “তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে, এসব কথা এই বাড়িতে বলছিস কেন?”
অনন্যা বেগম ঝর ঝর করে চোখের পানি ছেড়ে দিলেন, এই অশ্রু রাগের না কি ঘৃণার, সঠিক আন্দাজ করতে পারলেন না অনুস্রী বেগম।
দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন।
বোনের ওই নীলচে চোখের গোপন যন্ত্রণা, ৩৪টা বছরের একটা রাত্রিও তাকে শান্তিতে ঘুমাতে দেয়নি।
তবু ও কণ্ঠে কঠোরতা এটে বললেন, “তোমার জীবনের ৩৪টা বছর পেরিয়ে গেছে অনু, আমার জীবনের ৩৮ বছর পেরিয়ে গেছে, এসব নিয়ে আলোচনা করে নিজের বিপদ ডেকে এনো না, যার ভাগ্যে যা আছে তাই হবে, এই পৃথিবীতে যা কিছু হয় সব আল্লাহো তায়ালার ইচ্ছা।”
তাচ্ছিল্য খেলে গেল অনন্যা বেগমের চোখে মুখে, তিনি বেশ জানেন এগুলো আল্লাহর ইচ্ছা নয়, এগুলো তাঁর নিজের কর্মফল—কারো মনে আঘাত দিয়ে কেউ কোনোদিন সুখী হতে পারে না, তাঁর জলন্ত উদাহরণ তিনি নিজে, কিন্তু তিনি তো ওই মানুষটাকে ঠকাতে চাননি।
অনন্যা বেগম না চাইতে ও অস্পষ্ট ঝাপসা স্মৃতিতে ভেসে উঠলো এলোমেলো চুলের এক যুবকের প্রতিবিম্ব।
“নে ধর, এই খাবারটা নিয়ে শ্বেতাকে দিয়ে আয়, মেয়েটার পেটে সারাদিন কিছু পড়েনি”—বলে খাবারের প্লেটটা তুলে দিলেন অনন্যা বেগমের হাতে।
অনন্যা বেগম প্লেটটা হাতে নিয়ে চলে গেলেন তালাবদ্ধ ঘরের দিকে।
অনুস্রী বেগম টেবিল সাজিয়ে ড্রয়িং রুমে এসে হাঁক ছাড়লেন—
“বড়ো আব্বু, মেঝো আব্বু, সেজো আব্বু, ছোটো আব্বু, তন্ময় বাবা, অরণ্য বাবা, সমুদ্র বাবা—কই তোমরা খাবে, আসো, অনেক রাত হয়েছে।”
“মেঝো বউ, সেজো বউ, ছোটো বউ, প্রিয়—সবাই নিচে আসো।”
অতঃপর স্বামী আর ননদ দেবরদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনারা ও আসুন”—বলে চলে গেলেন অনুস্রী বেগম।
মিনিট ১০ এর মধ্যে টুকটুক করে সকলে ডাইনিং টেবিলে এসে উপস্থিত হলো, এলেন না কেবল শুদ্ধ প্রিথম আর মেহজাবিন চৌধুরী, তারা দরজা বন্ধ করে কিসব আলোচনা করছে।
সকলে নিজ নিজ চেয়ার টেনে বসে পড়লেন, কারোরই মন মেজাজ ভালো নেই, খাওয়ার ইচ্ছা তো আরই নেই, কিন্তু অনুস্রী বেগমের ভাষণ শোনার ভয়ে কেউ কিছু বলতে ও পারছে না, এমনকি সাদমান শিখদারের ও খাওয়ার ইচ্ছা নেই, কিন্তু বাইরে উনি যতো বড়ো শের হোন না কেন, বউয়ের কাছে সব সময় ভেজা বিড়াল।
প্রণয়ের ঠিক মুখোমুখি বসেছে প্রিয়স্মিতা, আশা-ইস্তব ভুরু কুঁচকে এক দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছে প্রণয়কে।
তার ঈগল চোখ প্রণয়ের আকর্ষণীয় কালচে লাল ঠোঁট ঘন কালো ভ্রু ধারালো চোয়াল সবকিছুই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে স্ক্যান করছে।
তবে তার সব ধ্যান জ্ঞান প্রণয়ের দিকে থাকলে ও তার দিকে একটা বারও চোখ তুলে তাকাচ্ছে না প্রণয়, সে যে এখানে বিশেষ কেউ, তার প্রণয় চোখ মুখ দেখে বিন্দু মাত্র ও মনে হচ্ছে না, এতে একটু অবাক হলো প্রিয়স্মিতার ভ্রু বেঁকিয়ে ভাবলো—
“প্রিয় তো বলেছিল, এই মহাশয় নাকি তাকে ভালোবাসে? উঁহু, যে সে ভালুপাসা নয় ভাই, গভীর ভালুপাসা, কিন্তু এই ব্যাটা কে দেখে তোমার কোন দিক থেকেই তা মনে হচ্ছে না।”
“সত্যি যদি ভালোবাসতো তাহলে কি এতো নিলিপ্ত থাকতে পারতো তার ভালোবাসার মানুষটা অন্যের বউ হয়ে তার চোখের সামনেই বসে আছে, অথচ একটা বার চোখ উঠিয়ে দেখছে না পর্যন্ত এরকম তো হবার কথা নয়, এই ব্যাটা সত্যি সত্যি ভালোবাসে তো আমার বোনকে নাকি এখানে ও বোকা মেয়াটা ভুল করেছে?”
প্রিয়স্মিতা কে হা করে প্রণয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবারও ব্যথিত হলেন অনন্যা বেগম, মৃদু ধাক্কা দিয়ে রাগী গলায় বললেন,
“ভাত পাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছিস কেন, তরকারি নিয়ে খা।”
অনন্যা বেগমের ধাক্কায় ভাবনা ছুটে গেল প্রিয়স্মিতার, হকচকিয়ে তাকালো অনন্যা বেগমের পানে, তিনি এখনো রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।
প্রিয়স্মিতা ঢুক গিললো, তাড়াহুড়ো করে কাতলা মাছের বড়ো টুকরোটা পাতে তুলে নিলো, একটু আলু আর ঝোল দিয়ে ভাত মেখে গালে তুলতেই চোখ বড় বড় করে ফেললো প্রিয়স্মিতা।
কেউ কিছু বুঝার আগেই দৌড় দিল বেসিনে, ওয়াক ওয়াক করে মুখের ভাত ফেলে তাড়াহুড়ো করে কুলি করলো।
ঘটনার আকস্মিকতায় হতবম্ব হয়ে গেল সকলে, অনন্যা বেগম ছুটে গেলেন মেয়ের কাছে।
পুনরায় ঝাড়ি দিয়ে বললেন, “কি ব্যাপার? ভাতটা ফেলে দিলি কেন?”
প্রিয়স্মিতার আবার গা গুলিয়ে এলো, ওয়াক তুলে বললো,
“ছিঃ আম্মু, কী দিয়ে মাছ রান্না করো, মাছে এমন বিচ্ছিরি গন্ধ কেনো?”
বলে পুনরায় খাবার টেবিলে বসে পড়লো প্রিয়স্মিতা।
অনন্যা বেগম বিরক্ত হলেন।
অরণ্য মুখ বাঁকিয়ে বললো,
“তোর যত ঢং, আমরা সবাই তো খাচ্ছি—লাভলি, সেজো আম্মু, একদম চুমু হয়েছে মাছ রান্না, আসলে ও তো শেওড়া গাছের বিশেষ প্রাণী কাঁচা মাছ খেয়ে অভ্যস্ত, তাই রান্না মাছের কদর বুঝলো না।”
প্রিয়স্মিতা ভেংচি কাটলো।
অনুস্রী বেগম ছেলে কে ধমকে বললেন,
“হয়ে গেছে, হয়ে গেছে—খালি সুযোগ পেলেই বোনের পেছনে লাগার পাঁয়তারা।”
বড়ো আম্মুর ঝাড়ি খেয়ে চুপসে গেল অরণ্য, অনন্যা বেগম প্রিয়স্মিতার প্লেট বদলে অন্য একটা প্লেটে ভাত দিলেন।
আদুরে কণ্ঠে বললেন,
“ছাড় তো মা, তোকে মাছ খেতে হবে না, তুই মাংস নে”—বলে চিকেনের বাটি এগিয়ে দিলেন অনুস্রী বেগম।
লাল লাল ঝাল ঝাল মুরগির মাংস দেখে প্রিয়স্মিতার জিভে পানি চলে এলো। সে ঝটপট লেগপিসটা প্লেটে তুলে নিলো, মাংসের ঝোল দিয়ে ভাত মাখিয়ে নাকের কাছে নিতেই পুনরায় সেই উৎকট গন্ধে গা গুলিয়ে বমি পেলো মেয়াটার। আবারো খাবার ফেলে ছুটলো বেসিনে। বেসিনের দুই পাশে ভর দিয়ে হর হর করে বমি করে দিলো প্রিয়স্মিতা।
অনুশ্রী বেগম ও অনন্যা বেগম দৌড়ে এলেন, মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“কি হয়েছে মা? শরীর খারাপ?”
প্রিয়স্মিতা কিছু বলতে পারছে না ক্রমাগত বমি করে যাচ্ছে।
অনুশ্রী বেগম ঠান্ডা পানি দিয়ে মুখ ধুইয়ে পুনরায় এনে খাবার টেবিলে বসালেন।
প্রেম চিন্তিত কণ্ঠে বললো,
“তোর কি শরীর খারাপ বোনু? ডাক্তার এর কাছে যাবি?”
প্রিয়স্মিতা কথার জবাব দিলো না আচমকা ঠোঁট উল্টে “ভেঁ” করে কেঁদে উঠলো।
সকলে হতবম্ভ হয়ে গেলেন।
প্রিয়স্মিতা গাল ফুলিয়ে অভিযোগ করে বললো,
“আমার অনেক খিদে লেগেছে কিন্তু আমি কিছু খেতে পারছি না। সব কিছুতেই কেমন পচা গন্ধে লাগে, গা গুলিয়ে বমি আসে।”
ওর কথায় চিন্তিত হয়ে পড়লেন বাড়ির পুরুষরা। সুহেব শিকদার ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বললেন,
“সে কী আম্মা! আপনার এতো শরীর খারাপ? আগে বললেন না কেন? আপনাকে তো এক্ষুণি ডাক্তার এর কাছে নিতে হবে।”
অনুশ্রী বেগম, তনুশ্রী বেগম, অনন্যা বেগম, ঔর্থি বেগম, ইনায়া পূর্ণতা সন্দেহান্বিত চোখে তাকিয়ে আছেন।
অনুশ্রী বেগম একটা প্লেটে করে সাদা ভাতে সঙ্গে খানিকটা তেঁতুলের আচার এনে দিয়ে বললেন,
“দেখ তো, খেতে পারিস কিনা।”
আচার দেখে জিভে জল চলে এলো প্রিয়স্মিতার। খুশিতে বকবাকুম হয়ে বললো,
“আই লাভ ইউ বড় আম্মু! তুমি কিভাবে জানলে আমার আচার খেতে ইচ্ছা করছিল? আরে হ্যাঁ দাও দাও,”
বলে আচার দিয়ে ভাত মেখে ঘপাঘপ মুখে দিতে শুরু করলো প্রিয়স্মিতা।
বাড়ির পুরুষরা আরো চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তবে সে সবের রেশ দেখা গেলো না মহিলাদের চোখে মুখে, তারা মিটমিটিয়ে হাঁসছেন।
এতক্ষণের সকল দৃশ্যই জহুরী চোখে পর্যবেক্ষণ করছিল প্রণয়। তার চোখ মুখে চরম অবিশ্বাস, ঠোঁট দুটো আপনাআপনি ফাক হয়ে আসে বিস্ময়ে।
বুকের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে নীল বিষের যন্ত্রনা বক্ষ পিঞ্জরে বন্দীপাখিটা মরণ যন্ত্রণায় ছটফটিয়ে উঠে–
কাতর কণ্ঠে বলে,
“তুই ভুল ভাবছিস তুই যা ভাবছিস তা কক্ষনো হতে পারে না, কিছুতেই হতে পারে না।”
আমার জান এত তাড়াতাড়ি –আর ভাবতে পারল না প্রণয় এটুকুতেই চোখ পানিতে টইটম্বুর হয়ে গেলো। মাথা নিচু করে নিল প্রণয় সাথে সাথেই ‘টপ’ টপ করে অশ্রু ফোঁটা গড়িয়ে পড়তে লাগলো ভাতের পাতে। সে শতো চেষ্টায় ও আটকে পারলো না।
সাদমান শিকদার চিন্তিত কণ্ঠে বললেন,
“কি হলো মেয়েটার? চল তো মা, এক্ষুনি ডাক্তার এর কাছে যাবি না থাক, আমি ডাক্তার ডেকে আনছি,”
বলে তাড়াহুড়ো করে উঠতে নিলেই ধমকে উঠলেন অনুশ্রী বেগম। তিক্ত কণ্ঠে বললেন,
“একদম ভাত ফেলে উঠবেন না, চুপচাপ বসুন। আপনাদের আলালের ঘরের দুলালির কিছুই হয়নি, বরং ডাক্তার না ডেকে মিষ্টি আনুন।”
উপস্থিত ছেলেরা আশ্চর্য হয়ে গেলেন। অরণ্য চুলে হাত চালিয়ে বললো,
“ইতিহাসে প্রথমবার কোনো শাকচুন্নি অসুস্থ হওয়াতে মিষ্টি খাওয়া হবে?”
পাশ থেকে তন্ময় বলে উঠলো,
“উন্নয়ন উন্নয়ন।”
তনুশ্রী বেগম বিরক্ত, এই ছেলেদের প্রতি। ঔর্থি বেগম ফ্রিজ থেকে মিষ্টি এনে সবার পাতে দিলেন।
প্রেম বিরক্ত গলায় বললো,
“এসব কি হচ্ছে আম্মু? ও অসুস্থ, তোমরা কই ডাক্তার এর কাছে নিয়ে যাবে, তা না করে আমাদের মিষ্টি খাওয়াচ্ছো?”
“হ্যাঁ, খাওয়াচ্ছি। কারণ তোমার বোনের এমন কিছুই হয়নি, বরং খুশি মনে মিষ্টি খাও। মামা হতে চলেছো।”
অনুশ্রী বেগম এর এই এক বাক্যে সকলের খাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো।
পানি দিয়ে ভাত গিলতে গিয়ে বিষম খেয়ে গেলো প্রিয়স্মিতার।
অনুশ্রী বেগম পিঠ চেপে বললেন,
“শাৎ শাৎ, ধীরে খাও।”
প্রিয়স্মিতা চোখ রসগোল্লার মতো বড় করে মা-চাচির দিকে চাইলো।
বসা থেকে লাফিয়ে উঠলো তন্ময়,
“ইয়াহু! আবার মামা হবো!”
সাদমান শিকদার অবাক হয়ে বললো,
“সত্যি বলছো?”
ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৭১ (২)
“হ্যাঁ, ওরকমই মনে হচ্ছে। কাল একবার টেস্ট করে নিলেই হবে। তবে আমি নিশ্চিত, বাড়িতে নতুন অতিথি আসতে চলেছে।”
এবার লজ্জায় নুয়ে পড়লো প্রিয়স্মিতা।
প্রণয় আর সহ্য করতে পারলো না। ভাতের প্লেট ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে হন হনিয়ে চলে গেলো।
সকলের হাসি-হাসি মুখগুলো মলিন হয়ে গেলো মুহূর্তেই।
অনুশ্রী বেগম ছেলের ভাতের পাতের দিকে চেয়ে দেখলেন – যেমনকার ভাত, তেমনই পড়ে আছে, এক দানাও হয়তো মুখে তোলেনি ছেলেটা।

Pls upload next part soon
Don’t be late pls😥
Onk sundr akta golpo taratri next part dio
Pls taratari next part den it’s really nice story