ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৭৩
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই
বিদ্ধস্ত মুখে আবির্ভাবকে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে এলো দেবী। তার চোখ-মুখে তীব্র হতাশা আর অপরাধবোধের চাপ।
সে আবির্ভাবের পাশে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় ডাকলো —
“আবির্ভাব…”
শুনেও যেন শুনলো না আবির্ভাব, সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে গেলো।
এতে চোখ টলমল করে উঠলো দেবীর। নিজের অন্যায়ের ভয়াবহতা সে উপলব্ধি করতে পারলো। সে জানে, আজকের এত শত ঝড়ঝাপটা—সবকিছুর মূল কারণ সে-ই। আজ তার জন্যই আবির্ভাবকে এতটা আঘাত সহ্য করতে হলো।
বেলা শেষে আজ সে-ও উপলব্ধি করতে পারলো—শুধু ভালোবাসলেই হয় না, ভালোবাসাকে আপন করে পাওয়ার ভাগ্য নিয়ে জন্মাতে হয়। ভালোবাসার পাখিকে আপনি যতই নিয়ম-শৃঙ্খলার বেড়াজালে বাঁধুন, তাকে ফাঁসাতে পারবেন না; সে শত বাধা-বিপত্তি ডিঙিয়েও উড়ে যাবে নিজ গন্তব্যে।
কিন্তু সে তো এসব চায়নি। সে তো আবির্ভাবকে চায়নি। তাহলে কেন তাকে জুড়ে দেওয়া হলো এই মানুষটার সঙ্গে? সে তো কারও মাঝে তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে ঢুকতে চায়নি। তাহলে তাকে কেন বলির পাঁঠা বানানো হলো? কেন তার জীবনের সঙ্গে এমন ভয়াবহ এক্সপেরিমেন্ট করা হলো?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সে তো একটা অতিসাধারণ মেয়ে, একটা অতিসাধারণ জীবন চেয়েছিল। আর পাঁচটা মেয়ের মতো স্বামীর আদর, যত্ন, ভালোবাসা চেয়েছিল। কিন্তু দিন শেষে কী পেলো?
দুই হাতের তালুতে নিজের চোখের পানি মুছে, হাতে থাকা কাগজটা বাড়িয়ে দিলো আবির্ভাবের সম্মুখে।
আবির্ভাব ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
চোখের পানিতে দেবীর বুক ভেসে যায়, কিন্তু যেখানে ভালোবাসা নেই সেখানে আবেগ দেখানো নিরর্থক। কিন্তু মন যে মানে না!
দেবী কাগজের সঙ্গে একটা কলমও এগিয়ে দিলো, উগ্রে আশা ও কান্না চেপে রেখে বললো —
“আমি সাইন করে দিয়েছি, তুমি-ও সাইন করে দিও।”
আবির্ভাব ভ্রু কুঁচকে কাগজটা হাতে নিয়ে দেখলো — কোর্ট পেপার। কপালের ভাঁজ দৃঢ় হলো তার। খামের ভিতর থেকে কাগজ বের করে দেখলো —
প্রথম পৃষ্ঠায় বড় বড় করে লেখা ‘Divorce’।
বিস্ময়ে বিষম লেগে গেলো আবির্ভাবের। সে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো দেবীর পানে।
দেবী চোখের পানি ধরে রাখতে পারলো না। ডুকরে কেঁদে উঠে বললো —
“আজ থেকে তুমি মুক্ত, আবির্ভাব… আর আটকাবো না তোমায়, আর কাঁটা হবো না তোমার পথে। আমি বুঝে গেছি—জোর করে সব আদায় করা গেলেও ভালোবাসা আদায় করা যায় না। আমি হয়তো জোর করে তোমার ঘরে জায়গা পাবো, কিন্তু তোমার মনে?…
আমি ঘরের রানী হতে চাইনি, মনের রানী হতে চেয়েছিলাম, আবির্ভাব।
আমি খারাপ নই, আবির্ভাব। নিজের সংসার বাঁচাতে বাধ্য হয়েছিলাম। আচ্ছা, আমার অপরাধটা তুমি দেখাতে পারো?”
নীরব হয়ে গেলো আবির্ভাব।
দেবী দুই হাতে চোখ মুছে বললো —
“তুমি ওই মেয়েটাকে ভালোবাসো, ওই মেয়েটাকে ছাড়া মরবে। কিন্তু এটা একবারও ভাবলে না—আমি কীভাবে বাঁচবো তোমায় ছাড়া? আমার জীবনের সঙ্গে এমন খেলা কেন খেলা হলো? কেন আমাকে ব্যবহার করে এমন ছুঁড়ে ফেলা হলো?”
আবির্ভাবের মনের কোথাও একটা খারাপ লাগা কাজ করলো। সত্যিই তো—এসবের মধ্যে দেবীর তো কোনো দোষ ছিল না। মাঝখান থেকে নিরপরাধ মেয়েটা ফেঁসে গেলো।
আবির্ভাব নতমস্তকে বললো —
“আমার তোমাকে কিছু বলার বা সান্ত্বনা দেওয়ার কোনো ভাষা জানা নেই, দেবী। তুমি যথেষ্ট ভালো একটা মেয়ে। আমার জীবনে তোমার পূর্বে ভালোবাসা না আসলে আমি হয়তো তোমাকেই ভালোবাসতাম। কিন্তু তা হয়নি। তুমি আসার বহু বছর আগেই আমার জীবনে ভালোবাসা এসে গেছে, যাকে আমি নিজের সর্বস্বটা দিয়ে ফেলেছি। আমার মধ্যে আর অবশিষ্ট কিচ্ছু বাকি নেই অন্য কাউকে দেওয়ার মতো।”
দেবী ম্লান হেসে বললো —
“জানি। থাক, এই জনমে নাই বা হলো তোমার সাথে আমার। কিন্তু তোমাকে এটাও মনে রাখতে হবে—আমাদের বন্ধন সাত জন্মের, জন্মজন্মান্তরের। তুমি আমাকে অগ্নিসাক্ষী করে বিয়ে করেছ। সর্বপ্রথম এই জন্মটা তোমাকে ছেড়ে দিলেও বাকি ছয় জন্মে তুমি আমার। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো।”
আবির্ভাব কিছু বলল না।
দেবী মুখ চেপে কান্না দমিয়ে রেখে বললো —
“আমি চলেই যাবো… কিন্তু যাওয়ার আগে আমার শেষ একটা কথা রাখবে, আবির্ভাব?”
আবির্ভাব প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালো।
দেবী ফুঁপিয়ে উঠে বললো —
“তোমার ওই প্রশস্ত বুকে একটু মাথা রাখতে দেবে? বেশি না, একটুখানি…”
আবির্ভাবের মন আরও বেশি খারাপ হলো। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে হাত বাড়িয়ে দিলো।
সাথে সাথেই ঝড়ের গতিতে বুকের উপর হামলে পড়লো দেবী, পিঠ আঁকড়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে উঠলো। বিরামহীন চোখের পানিতে ভিজিয়ে দিতে লাগলো আবির্ভাবের বুক…
অলো আধারি রুমের ঠান্ডা বাতাসে একটা হালকা মিষ্টি ঘ্রান ভেসে বেড়াচ্ছে, যা নাসারন্ধ্রে মিষ্টি মনে হলেও তা গ্রহণ করা মাত্রই মস্তিষ্ককে নেশার জগতে ডুবিয়ে দেবে।
ঠান্ডা ঘরের পরিবেশকে আরো শীতল করতে তুলতে প্রবল বাতাসের দোলুনিতে উড়ে যাচ্ছে জানালার ভারী মোটা পর্দাগুলো, উন্মুক্ত ব্যালকনি দিয়ে চাঁদের স্নিগ্ধ শীতল আলো এসে আঁচড়ে পড়ছে ঘরের মেঝেতে।
পরিবেশটা একদম নিরিবিলি, শান্ত, ভৌতিক — এই অন্ধকার নিমজ্জিত ঘরের মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসে আছে প্রণয়, দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে, একটু পর পর আঙ্গুলের ফাঁকের জ্বলন্ত সিগারেটটা ঠোঁটের কালচে লাল অংশে চেপে ধরছে।
তার চোখ দুটি অসম্ভব লাল। সামনের মেঝেতে পড়ে আছে খালি কয়েকটা ইনজেকশন সিরিঞ্জ — দেখে মনে হচ্ছে গলা অবধি নেশায় ডুবানো। নড়াচড়া করার বা কথা বলার সামর্থ্য নেই, রক্তের ফোঁটা ফোঁটায় নেশার রাজত্ব কিন্তু মস্তিষ্কে।
প্রণয়ের বুকটা অবশ হয়ে আসছে অসহনীয় এক ব্যথায়, কিন্তু কেন এর সঠিক উত্তর জানা নেই প্রণয়ের। তার মন তার কাছে বারবার প্রশ্ন করে জানতে চায় —
“শান্তির বদলে কেন আমাকে এত নিকৃষ্ট পীড়া দিচ্ছিস তুই? নিজেই তো আমার থেকে আমার প্রাণকে অনেক দূরে সরিয়ে দিয়েছিস।
কেড়ে নিয়েছিস আমার অস্তিত্বের সকল সুখ নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিস বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বন।
তাহলে এখন কিসের এত যন্ত্রণা তোর?”
“কেন নিজে জ্বলছিস আর কেনই বা আমাকে জ্বালাচ্ছিস?
এখন কেমন লাগে তোর? তোর ভালোবাসার গায়ে প্রতিনিয়ত অন্য কেউ তার ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়,
অন্য কারো স্পর্শে তোর পাখি কাঁপে কাঁদে চিৎকার করে — কেমন লাগে?
তুই শুধুই দর্শক।
জানি তুই মরবি — কিন্তু এতটা যন্ত্রণা বুকে নিয়ে মরবি যে তুই মরলেও শান্তি পাবে না, কবরে পচবে না তোর লাশ।”
প্রণয় হাঁসফাঁস করে ওঠে, তার সর্বশক্তি দিয়ে হাতে থাকা কাছের বোতলটা ছুড়ে মারল সামনের দেওয়ালে। বিকট শব্দ করে কয়েক হাজার টুকরোতে বিভক্ত হয়ে গেল কাঁচের বোতলটা।
অস্থিরতায় নিষিদ্ধ টানে বুকটা খা খা করে উঠে, মন চায় ছুটে গিয়ে নিজের প্রাণপাখিকে ঝাঁপটে জড়িয়ে ধরতে, নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিতে চিরতরে — কিন্তু চাইলেই কি আর তা কখনো সম্ভব?
অপরাগতার অগ্নিশৃঙ্খলে আটকা পড়ে উন্মাদ প্রেমিকের পাগলাটে ভালোবাসা।
প্রণয় শব্দ করে না, কেবল বন্ধ চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে অনর্গল তপ্ত অশ্রু।
ছোট্ট প্রাণের অস্তিত্ব বক্ষে অনুভব করার জন্য সর্বাঙ্গ কাঁপে, দিশেহারা হয় প্রণয়। অনেকক্ষণ চেষ্টা করে — ও নিজেকে দমন করার আর কোনো উপায় খুঁজে পায় না।
শেষে একপ্রকার বাধ্য হয় অনিচ্ছার কাজটা করতে। সে কাঁপা হাতে মেডিসিন বক্স ঘেঁটে একটা সবুজ ওষুধের পাতা বের করে চোখের সামনে ধরে। এটা সেই ওষুধ, যেটা দিয়ে একসময় প্রহেলিকার উগ্রতা থেকে নিজেকে রক্ষা করত প্রণয় — প্রহেলিকাকে ঘুমন্ত অবস্থায় কল্পনিক সুখ দিতো। কিন্তু সে কখনও দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেনি — বেঁচে থাকার জন্য কোন একদিন এটা-ই হবে তার শেষ অবলম্বন।
প্রণয়ের বুক পুড়ে যাচ্ছে ভালোবাসার তৃষ্ণায়। প্রণয় আর দেরি করলো না — সবুজ রঙের ওষুধের পাতা থেকে দুটো ট্যাবলেট বের করে খেয়ে নিলো।
এটা মূলত আপনাকে ঘুমন্ত অবস্থায় আপনার অবাস্তব চাহিদাকে কল্পনা করতে সাহায্য করে — আর জাগ্রত অবস্থায় আপনার চাহিদাকে হ্যালুসিনেট করতে সাহায্য করে। এটা মূলত খাস বাংলায় পাগলের ওষুধ — যেসব ডিপ অবসেসট মেন্টাল পেশেন্টদের একদমই কন্ট্রোল করা যায় না তাদেরকেই দেওয়া হয় শান্ত রাখতে।
প্রণয় বক্স উলটো-পালটো করে, কোথাও ঘুমের ওষুধ খুঁজে পেল না, হাল ছেড়ে দিলো সে। তার শরীরে এখন এতোটাও জোর নেই যে উঠে গিয়ে খুঁজে আনবে।
বুকের অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে ওভাবেই পড়ে রইলো প্রণয় — চোখ বন্ধ করে কল্পনায় অনুভব করার চেষ্টা করলো প্রিয় সেই অস্তিত্বকে।
সঙ্গে সঙ্গে নাসারন্ধ্রে এসে হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করলো — পুরোনো সেই মাদকীয় ঘ্রান।
ঝট করে চোখ খুলে ফেললো প্রণয়। উত্তেজনায় শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো, তার পিপাসা বাড়তে বাড়তে আকাশ ছোঁল।
সামনে তাকিয়ে অস্থির চোখে খুঁজলো সেই রমণীকে, নরম কণ্ঠে ডাক ছাড়লো —
“জান…”
মাদকীয় সেই বহু পরিচিত গন্ধটা এবার আরো কাছে থেকে পাচ্ছে প্রণয়।
সে পিপাসা জড়ানো কাতর কণ্ঠে বললো —
“তোর তৃষ্ণায় আমি মরে যাচ্ছি জান, একবার কাছে আয়, আর একবার আমার প্রচণ্ড খরায় পুড়ে যাওয়া বুকটা ভিজিয়ে দে তোর ভালোবাসায়।
আর একবার ছুঁয়ে দে আমায়, আর একবার তোকে আদর করতে দে, না হলে ছটফট করতে করতে এখানেই মরন হবে আমার…”
প্রণয়ের বাক্য সমাপ্ত হওয়ার আগেই দূরের অন্ধকার ভেদ করে দৃশ্যমান হলো এক নারী অবয়ব।
রূপোলি চাঁদের আলোয় তার হাঁটু ছড়ানো খোলা চুলের মাধুর্যে যেন থাকে রূপকথার পরীদের থেকেও বেশি রূপবতী লাগছে।
প্রণয় তৃষ্ণার্ত চোখে শত জনমে তৃষ্ণা জমিয়ে কাতর চোখে চেয়ে রইলো সেই স্নিগ্ধ মুখশ্রীতে। তবে কয়েক মুহূর্ত যেতেই দৃষ্টি নামিয়ে অন্যত্র মুখ ঘুরিয়ে নিলো। আহত গলায় বললো —
“এতো পাষাণ তুই কিভাবে হতে পারিস জান? বাস্তবে আমার না হলি, কল্পনাতে তো আমার হয়ে আসতে পারতি — এত নির্মম আচরণ আমার প্রতি কেন?”
“কেন আমার কল্পনায়ও তুই অন্যের বউ সেজে এলি?”
সামনের রমণী বোধহয় হাসলো, উক্ত প্রশ্নের জবাব না দিয়ে প্রণয়ের শরীর ঘেঁষে বসে পড়লো।
অতি আকাঙ্ক্ষিত সেই নরম শরীরের ছোঁয়ায় কেঁপে উঠলো প্রণয়ের দৃঢ় সত্তা, চোখ ভরে এলো অশ্রুতে।
প্রিয়তা হাতে হাত রেখে কোমল কণ্ঠে প্রশ্ন করলো —
“কেমন আছেন মিস্টার আবরার শিখদার প্রণয়? নিশ্চয়ই অনেক ভালো আছেন।
অবশ্য ভালো থাকারই তো কথা — ভালো থাকবেন বলেই তো আমায় অন্যের ঘরে পাঠালেন।
তাহলে এখন আমার সখের প্রণয় ভাইকে এভাবে ভাঙছেন কেন?”
প্রণয়ের কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে।
প্রিয়তা ফের তাচ্ছিল্য হেসে বলে —
“এখন বুঝি আমায় আর অন্যের সঙ্গে দেখতে ভালো লাগে না? বুকে কি খুব বেশি ব্যথা হয়?”
প্রণয় এবারও জবাব দিলো না।
“আমার মন ও শরীরের মালিক অন্য কেউ — এটা বুঝি মানতে পারেন না?”
উক্ত কথাটুকু সম্পূর্ণ করতে পারলো না প্রিয়তা —
তার পূর্বেই কোমল ওষ্ঠ দুটি নিরব হয়ে যায়।
প্রিয় পুরুষের শরীরের ঘ্রানে অস্তিত্বের পরতে পরতে প্রশান্তির জোয়ার বয়ে গেলো।
প্রণয় তপ্ত বুকে ছোট্ট শরীরটা চেপে ধরে শব্দ করে কেঁদে উঠলো, তুলতুলে শরীরটা আরো গভীরে মিশিয়ে নিয়ে বললো —
“আর বলিস না জান, বিশ্বাস কর, তোর প্রণয় ভাই আর সহ্য করতে পারবে না।
তোকে অনেক ভালোবাসে তোর প্রণয় ভাই, খুব ভালোবাসে জান…”
প্রিয়তার অক্ষি কোনে জল টলমল করে উঠলো।
সে প্রণয়কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বললো —
“আমাকে একদম ছুবেন না মিস্টার আবরার শিকদার প্রণয়। ভালোবাসলে ধরে রাখতে হয়, যেটা আপনি করেননি।
বিলিয়ে দিয়েছেন আমায় অন্যের বিছানায় — তাই আপনি এসবের উপযুক্ত।”
“আমি আপনাকে বলেছিলাম না, একদিন এমন আসবে যেদিন আমার অভাবে মৃত্যু হবে আপনার —
তবুও আপনি আমায় পাবেন না। মিলেছে আমার কথা।”
প্রণয় নীরব থেকে আবারও প্রিয়তাকে টেনে নিয়ে বুকে জড়ালো, নিঃশ্বাস আটকে অস্তিত্বে অনুভব করলো নিজের জানকে।
অতঃপর দুর্বল গলায় বললো —
“হ্যা, মিলেছে… প্রতিটা মুহূর্তে আমি নতুন করে মৃত্যু সুখ অনুভব করছি।
তোকে চোখের সামনে রেখে মন ভরে দেখতে না পেরে মরছি, ছুতে না পেরে মরছি…
তৃষ্ণায় মরছি, পিপাসায় মরছি…”
“তোকেই জান বলে ডাকতাম — তোর কি মনে হয় এটা শুধু মুখের কথা? উহু… এখান থেকে বলতাম।”
বলে প্রিয়তার মাথা চেপে ধরলো বুকের বা পাশে, কণ্ঠ খাঁদে নামিয়ে বললো —
“নিজের জানটা অন্যকে দিয়ে দিলে কেউ বাঁচতে পারে ময়না পাখি?
আমি ও বেঁচে নেই — মরে গেছি অনেক আগেই।”
অনর্গল ধারায় চোখের অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে প্রিয়তার।
প্রণয় দীঘল চুলে হাত বুলাতে বুলাতে কণ্ঠে আসক্তি মিশিয়ে বললো —
“তুই আমার জন্য কী জানিস?”
“কি?”
প্রণয় থামলো, মসৃণ ললাটে ভেজা স্পর্শ এঁকে বললো —
“নেশা।”
“হ্যাঁ…”
“হ্যাঁ, তুই এই আবরার শিকদার প্রণয়ের নেশা।
পৃথিবীর যত প্রকার নেশা আছে, সব থেকে উৎকৃষ্ট মানের নেশা।
যা এই আবরার শিখদার প্রণয়ের অস্তিত্বকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে নিয়েছে।”
তুই আমার এমন এক নেশা, যা মৃত্যু আমায় ছাড়াতে পারবে কি না সন্দেহ। তোর ওই কোমল অঙ্গের পরতে পরতে নেশা, নীলাভ চোখ দুটো যেন প্রাণনাশী কোন নেশার সাগর। তোর উপস্থিতি আমার শরীরে শিহরণ জাগায়, তোর স্পর্শ আমায় নেশার অন্য দুনিয়ায় নিয়ে যায়।
এই নেশাই আমার জীবনের চরম সুখ। এই নেশার সাগরে ডুব দিতে না পারলে আমার শরীর-মন দুটোই যন্ত্রণায় মৃত্যুকামনা করে।
“এতো ভালোবেসে ছেড়ে দিলেন কেন?”
মলিন হাসলো প্রণয়। প্রিয়তার উন্মুক্ত চুলে নাক ডুবিয়ে দিল, মোলায়েম গলায় বলল —
“ছাড়লাম আর কোথায়? তোকে তো অস্তিত্বে মিশিয়ে রেখেছি। এই দুনিয়ার মায়া ছেড়ে দেওয়া কোনো বড় ব্যাপার নয়, কিন্তু তোর মায়া…! হয়তো তুই আমার জন্য দূর আকাশের চাঁদ। তাতে কি মানুষ চাঁদকে দূর থেকে ভালোবাসে? আমি ও হয়তো আমার চাঁদকে দূর থেকেই ভালবাসলাম।”
“আমি তো কাছেই থকতে চেয়ে ছিলাম।”
প্রণয় ক্লান্ত কণ্ঠে বলল —
“জীবনে কিছু অপূর্ণতা থাকতে হয়, নাহলে মানুষ পূর্ণতার মূল্য বুঝে না।
এই যে আমাকে দেখ, আমি মানুষটা মাথা থেকে পা পর্যন্ত পুরোটা ব্যর্থতা আর শূন্যতার চাদরে মুড়ানো। আমাকে জিজ্ঞেস কর, আমার না-পাওয়ার তালিকা কত বিশাল। আমাকে জিজ্ঞেস কর, আমি যদি তোকে না হারাতাম, তাহলে হয়তো আমার হার্টটা পাল্টাতে হতো না।
কেবল তোকে চাইতে চাইতে একটা গোটা হৃদয় আমি নষ্ট করে ফেললাম, তবুও তোকে পেলাম না।”
প্রণয়ের শেষ বাক্যে চমকে উঠল প্রিয়তা। বুক থেকে মাথা তুলে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে নিক্ষেপ করল প্রণয়ের পানে।
এতে বোধহয় কিছুটা অসন্তুষ্ট হল প্রণয়। দুর্বল হাতে পুনরায় টেনে নিল প্রিয়তাকে বুকের মাঝে।
ধমকে উঠে বলল —
“এতো ছটফট করছিস কেন? একটু বুকে নিয়ে বসে আছি, সহ্য হচ্ছে না?”
প্রিয়তা আবার প্রণয়ের বুক থেকে সরে গেল। আতঙ্কিত দৃষ্টি মেলে কয়েক সেকেন্ড প্রণয়কে দেখে দ্রুত হাসতে হাসতে শার্টের বোতাম খুলতে উদ্যত হল।
সাথে সাথেই তুল তুলে হাতটা টেনে নিয়ে বুকে চেপে ধরল প্রণয়। চোখ বন্ধ করে তৃপ্ত কণ্ঠে বলল —
“আহ্… এবার আরাম লাগছে জান!”
প্রিয়তার নীলাভ চোখ পানিতে ভর্তি হয়ে গেল। সে আবার হাত টেনে সরিয়ে নিল। দ্রুত বোতাম খুলে শার্ট সরাতেই স্তব্ধ হয়ে গেল প্রিয়তা।
চোখের পলক ফেলার আগেই গড়িয়ে পড়ল তপ্ত অশ্রু। নিখুঁত ফর্সা বুকে এক পাশে সেলাই করা অপারেশনের দাগ ঝলমল করছে।
প্রিয়তার দুঃখে কষ্টে গলায় ধরে এলো। ভীষণ রাগ জমল এই মানুষটার প্রতি।
সে কিছু না বলে উঠে চলে যেতে নিলে তার নরম হাতটা টেনে ধরল প্রণয়। অবুঝ গলায় বলল —
“আমাকে একা ফেলে চলে যাচ্ছো, রক্তজবা?”
শ্বাস রুদ্ধ হলো প্রিয়তার। অভিমানে নাকের পাল্লা ফুলে উঠছে। সে কঠিন গলায় বলল —
“ছাড়ুন! আমার আপনার সাথে কোনো কথা নেই।”
প্রণয় পুনরায় হেঁচকা টানে বুকে নিয়ে এলো। কণ্ঠে আকুলতা মিশিয়ে বলল —
“ছেড়ে যাস না জান… খুব কষ্ট হয় তোকে ছাড়া থাকতে। আমি খেতে পারি না, ঘুমাতে পারি না, নিশ্বাস নিতেও পারি না। আমার সব সময় তোকে চাই, জান।”
প্রণয়ের বলিষ্ঠ পিঠ আঁকড়ে ধরে এবার ডুকরে কেঁদে উঠল প্রিয়তা।
কান্নার ধ্বনি শুনে অস্থির হয়ে উঠল প্রণয়। প্রিয়তার নরম দুই গালে হাত রেখে বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল —
“কি হয়েছে জান পাখি? কাঁদছিস কেন? আমি কি মরে গেছি?”
প্রিয়তা বুকের শার্ট খামচে ধরে ভেজা কণ্ঠে বলল —
“আপনার মতো এমন জঘন্য খারাপ মানুষ আর দু’টো দেখিনি। কি অবস্থা করেছেন আমার প্রণয় ভাইয়ের!”
প্রেয়সীর এমন মধুর অভিমান শুনে কলিজা ঠান্ডা হয়ে গেল প্রণয়ের। তৃপ্তি নিয়ে বলল —
“একটু ভালোবাসা দে দেখবি, আগের থেকেও বেশি ভালো হয়ে যাব।”
প্রিয়তার কান্নার বেগ বাড়ল। কাঁপা কাঁপা হাতে স্পর্শ করল প্রণয়ের চোখ-মুখে, তারপর বিশাল শরীরটা টেনে নিজের ছোট্ট বুকে মিশিয়ে নিল। আবিষ্ট গলায় বলল —
“ভালোবাসব, খুব খুব ভালোবাসব আপনাকে। তবু ও এভাবে নিজেকে ভাঙবেন না, আমি তো আপনারই।”
প্রণয় দুই হাতে প্রিয়তার কোমর জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ গুঁজল। প্রিয়তমার শরীরের মাতাল করা সুবাসে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে বলল —
“সান্ত্বনা দেওয়ার নাম করে ক্ষুধার্তকে খাবারের লোভ দেখাস না, জান।”
প্রিয়তা আর জবাব দিল না। এক হাত পিঠে রেখে অন্য হাতে প্রণয়ের চুলে হাত বুলাতে লাগল।
প্রণয়ের ঘুর লাগছে চোখে। সে প্রিয়তার গলায় নাক ঘষে দিয়ে নেশাগ্রস্ত কণ্ঠে বলল —
“এখন আদর দিচ্ছিস, কিন্তু একটু পর তো ঠিকই নরকে ছুঁড়ে ফেলে অন্যের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়বি।”
প্রিয়তা হাত বুলানো থামিয়ে দিল। চোখ ছোট ছোট করে বলল —
“আপনার তাই মনে হয়?”
তাচ্ছিল্য মাখা হাসি দিল প্রণয়। প্রিয়তার অস্তিত্বের সাথে আরও নিবিষ্টভাবে মিশে গিয়ে বলল —
“আবরার শিকদার প্রণয়ের জীবনে তোর অবস্থাটা একটা বিরাট খড়ের স্তূপের মতো, যার প্রধান কাজই হলো আবরার শিকদার প্রণয়ের বুকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বালানো।”
প্রিয়তা ওর কথায় পাত্তা দিল না। সে ভালোই বুঝছে এই লোক মাতলামি করছে।
“আমার এত আদর, তুই এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলি জান? কিভাবে পারলি এত তাড়াতাড়ি অন্যের সন্তানকে নিজের মধ্যে ধারণ করতে?”
প্রিয়তা হাই তুলে বলল —
“কি অদ্ভুত প্রশ্ন! রোজ রাতে বাসর করতে দোষ নাই, পেটে বাচ্চা এলেই দোষ! ব্যাপারটা এমন হয়ে গেল না ধরা না পড়া পর্যন্ত চুরি করা পূণ্যের কাজ? আচ্ছা, তবু ও যখন বলছেন, তখন এর পরের বার থেকে প্রোটেক…”
প্রিয়তা কথা সম্পূর্ণ করতে পারল না, তার আগেই তীব্র কাঁচ ভাঙার শব্দে ভয়ে চমকে উঠল।
প্রণয় নিজের থেকে সরিয়ে দিল তাকে। ভাঙা কাচের বোতলটা প্রিয়তার গলায় চেপে ধরে হিংস্র কণ্ঠে বলল
“একদম জানে মেরে ফেলব তোকে একদিন, বলেছি না, আমার সামনে এসো না বলতে! যন্ত্রণা দেওয়ার ইচ্ছে থাকলে অন্যভাবে দিবি, কিন্তু এসব বলবি না। আমি চাইনা তুই আমার হাতে খুন হয়ে যা।”
প্রিয়তা মোঠেও ভয় পেল না। বরং চোখে চোখ রেখে বলল —
“অন্যের সাথে এক ঘরে দরজা বন্ধ করে থাকলে অসুবিধা হয় না, কেবল মুখে বললেই দোষ! একশোবার বলব, হাজারবার বলব — পেটের বাচ্চাটা তো আর উড়ে উড়ে আসে নাই।”
প্রণয়ের রক্তিম চোখ-মুখ বলছে সে কতটা রেগে আছে। কিন্তু যতই সে হুঁশ হারাক, প্রিয়তাকে আঘাত দেওয়ার সামর্থ্য কি তার আছে?
প্রিয়তা তার রাগকে পাত্তা দিল না। আবার প্রণয়ের মাথা বুকে চেপে ধরে বলল —
“আমি আপনার ছিলাম, আছি, থাকব। এখন আর এত রাগ করতে হবে না, শান্ত হন।”
প্রণয়ও শান্ত হয়ে গেল। তার আর বুক জ্বালা করছে না, অস্থির অস্থির লাগছে না। চোখের পাতা ভারী হয়ে এসেছে, মন আর মস্তিষ্ক দুটোই শিথিল লাগছে।
প্রিয়তা মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে এক সময় অনুভব করল, তার বুকে ঘন ঘন নিশ্বাস এসে আছড়ে পড়ছে।
নিশ্চিন্ত হল প্রিয়তা। এই লোকটিকে বিছানায় তোলার শক্তি তার নেই, তাই নিজের থেকে সরিয়ে মেঝেতে শুইয়ে দিল। বিছানা থেকে বালিশ আর চাদর এনে শরীরে ঢেলে দিল। কপালে চুমু খেয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
দরজা ভেজিয়ে তিন তলার ছাদে পা রাখতেই চোখ চকচক করে উঠলো প্রিয়তার।
দৌড়ে গিয়ে এক প্রকার লাফিয়ে পড়লো প্রিয়স্মিতার বুকে।
বোনকে জড়িয়ে ধরে হেসে ফেললো প্রিয়স্মিতা। সতর্ক নজরে আশেপাশে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বললো, “কেউ দেখে নি তোকে?”
প্রিয়তা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললো, “একদম না।”
বোনের মলিন ফ্যাকাশে মুখে হাসি ফুটতে দেখে মনে শান্তি পেলো প্রিয়স্মিতা। বোনকে লজ্জা দিতে দুষ্টু হেসে বললো, “হুম হুম ব্যাপারটা তো খুব একটা সুবিধার নয়, মুখটা এমন লাল লাল লাগছে কেন?”
প্রিয়স্মিতার বলার ধরনে লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠলো প্রিয়তা, লাজুক মুখটা নিচু করে বললো, “যাহ্ আপু! তুমি যে কি বলো না!”
হুহ নাটক দেখো, উনি করলে দোষ নাই, আমি বললেই দোষ! আচ্ছা বাদ দে, ভালোবেসেছে।
মুখের লজ্জা মিলিয়ে গেলো প্রিয়তার, ফিক করে হেসে দিলো।
“এই পাগলের মতো হাসছিস কেন?”
প্রিয়তা হাসতে হাসতে বাঁধানো বেঞ্চে বসে পড়লো। ঢোঁক গিলে বললো, “What a expectation! আফা, উনি আদর করবেন! তাও আমাকে! ওই আল্লাহর বান্দা এমন না!”
প্রিয়স্মিতারও উৎসাহ মিলিয়ে গেলো, বসে পড়লো বোনের পাশে। গালে হাত দিয়ে বললো, “একদম রোমান্টিক না, তাই না?”
“হুঁ, রোমান্টিক! আচ্ছা, তুমি এসব ছাড়ো, তোমার সাথে কথা নেই।”
প্রিয়স্মিতার কপাল কুঁচকালো, “কেন?”
প্রিয়তা মুখ ঘুরিয়ে বললো, “তুমি আবার প্রমাণ করে দিলে, তুমি আমার নিজের বোন না, সৎবোন!”
আশ্চর্য হয়ে গেলো প্রিয়স্মিতা, চোখ বড় বড় করে ফেলল,
“আমি তোমার নিজের বোন হলে আমার থেকে এত বড় একটা কথাটা চেপে যেতে পারতে?”
প্রিয়স্মিতা আহাম্মক বনে গেলো, অবাক কণ্ঠে বললো, “কি চেপে গেলাম?”
প্রিয়তা গাল ফুলালো, অভিমানি গলায় বললো, “আবার মিথ্যে বলছো! আমি যে খালামণি প্লাস ফুপি হতে যাচ্ছি, এটা কি আমায় বলেছো?”
এতক্ষণে বুঝতে পারলো প্রিয়স্মিতা, নিজেও হালকা লজ্জা পেয়ে গেলো। মাথা নিচু করে বললো, “বাড়িতে এত সমস্যা হচ্ছে, এত কিছুর চাপে তোকে জানাতে ভুলে গেছি।”
ঝামেলার কথা শুনে চিন্তার ভাঁজ পড়লো প্রিয়তার কপালে, আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলো, “কিসের ঝামেলা?”
প্রিয়স্মিতা কথা কাটিয়ে বললো, “ওসব কিছু না, এসব তোর জানার দরকার নেই, তুই পড়াশোনায় কনসেনট্রেট কর।”
“ওহ, আর ভাববো না।” দুষ্টু হেসে বললো, “এই সুখবর শুদ্ধ ভাই—থুক্কু—দুলাভাইকে জানিয়েছো?”
প্রিয়স্মিতা লাজুক হেসে দুই পাশে মাথা নাড়ালো।
প্রিয়তা অবাক হয়ে বললো, “এখনও জানাওনি?”
“উঁহু।”
“কেন?”
“এখন না, ফ্যামিলি প্রোবলেমগুলো মিটুক, তারপর।”
“আহা, কি রিঅ্যাকশন দেবে ভাবতেই উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছি!” বলে মনে মনে নেচে উঠলো প্রিয়তা।
প্রিয়স্মিতা ওকে বসা থেকে উঠিয়ে বললো, “অনেক হয়েছে, এখন কেটে পড়, কে কখন কোন দিক দিয়ে দেখে নেবে এই বাড়ির মানুষ গুলো আস্ত এলিয়েন, দুই গুণ শোনে, চার গুণ দেখে!”
প্রিয়তা আরো কিছু বলতে চাইলো, কিন্তু ওর কথা শুনলো না প্রিয়স্মিতা। আশপাশ দেখতে দেখতে ওকে নিয়ে চলে গেল।
পুবের বারান্দায় ঠাস করে কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দে চমকে উঠলো শ্বেতা।
মারের ব্যথায় শরীর নড়তে পারছিল না বলে উপুড় হয়ে শুয়ে নিঃশ্বাস ফেলেছিল। কোনমতে বাইরে শুঁ শুঁ শব্দে বাতাস বইছে শুনে বিশেষ গুরুত্ব দিলো না শ্বেতা। ভাবলো, হয়তো বা বাতাসের ধাক্কায় ফুলদানি টুলদানী কিছু একটা পড়ে ভেঙে গেছে। ওইভাবেই কিছুক্ষণ পড়ে রইলো শ্বেতা।
ছোট্টো একটা নিঃশ্বাস ফেলার সাথে সাথেই আবারও বাইরে থেকে বিকট শব্দ ভেসে এলো। একের পর এক ঠাস ঠাস শব্দে কাঁচের বস্তু মেজেতে পড়ে ভাঙার শব্দে কেঁপে উঠলো শ্বেতা।
ভয়ার্থ চোখে তাকালো বারান্দার দিকে, তবে চারদিকের ঘুটঘুটে ঘন অন্ধকার ব্যতীত অন্য কিছুই নজরে এলো না।
এতক্ষণ অন্ধকার নিমজ্জিত ঘরে পড়ে থাকলেও এবার ভয় লাগতে শুরু হলো শ্বেতার। চোখ মেলে আশেপাশে তাকানোর চেষ্টা করতেও ভয়ে গা শিউরে উঠছিল। অবচেতন মন নিজের কঠোর বিরোধিতা সত্ত্বেও কল্পনায় ভয়ানক সব চিত্র অঙ্কন করতে মরিয়া।
জিনিসপত্র ভাঙচুরের শব্দ বাড়ছে ক্রমেই। শ্বেতা মনের অবশিষ্ট সাহস জুটিয়ে ভয়ে ভয়ে তাকালো গহীন অন্ধকারে। সাথে সাথে গা কাঁটা দিয়ে উঠলো। শ্বেতার চোখে খিচে বন্ধ হয়ে গেল। মনে হলো ওই ঘন কালো অন্ধকারের মধ্য থেকে দুটো ভয়াবহ লাল লাল চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে — বা হয়তো এখনই ছুটে এসে গলা টিপে ধরবে!
নিজের মনের এসব উদ্ভট ভাবনায় নিজেই ঘাবড়ে গেল শ্বেতা। বিষ ব্যথায় জর্জরিত শরীরটা টেনে তুলে শোয়া থেকে উঠে বসল।
অন্ধকার হাতড়ে দ্রুত জ্বালিয়ে দিল পাশের টেবিল ল্যাম্পটা।
সাথে সাথেই ল্যাম্পের মৃদু হলুদ আভায় ঝলমল করে উঠল চারপাশ। দূর হয়ে গেল সকল ভয় ভীতি। চারপাশে তাকিয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল শ্বেতা।
বারান্দার বন্ধ দরজার দিকে চেয়ে দেখলো এখনো বাইরে থেকে টুক টাক এটা-সেটা পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। হয়তো বিড়াল টিড়াল আটকে গেছে। এসব ভেবে নিজের ব্যথাতুর শরীরটা টেনে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো শ্বেতা।
বারান্দার সব লাইট জ্বালিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল সে।
কাচ বসানো কাঠের কারুকার্যময় দরজাটা খুলে সামনে দেখতেই এক পশলা দমকা বাতাস এসে লুটিয়ে পড়লো শ্বেতার।
চোখ কুঁচকে বন্ধ করে ফেললো শ্বেতা। বাইরের প্রবাহমান ঠান্ডা হিমেল বাতাসটা বড়োই গায়ে লাগছে। হয়তোবা ধরণীতে শীতের আগমন ঘটতে চলেছে।
শ্বেতা নিজেকে সামলে আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে তাকালো। কিন্তু কোথাও কিছুই নেই। কেবল পায়ের কাছে কয়েকটা ফুলদানির ভাঙা টুকরো পড়ে আছে যেন কেউ ইচ্ছে করেই ফেলেছে।
আপনা আপনি ভ্রু কুঁচকে এলো শ্বেতা। কাচের টুকরোগুলোর পাশ কাটিয়ে ধীরে এগিয়ে গেল।
দমকা বাতাসে ঢেউ খেলে যাচ্ছে কোমর ছাড়ানো চুলগুলো। শ্বেতা আনমনে সামনে পড়া কয়েক গাছা কানের পিঠে গুঁজে দিল। দুই হাত রেলিংয়ের ওপর রেখে ঘন অন্ধকারে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। পরিবেশ গুমোট ভাব বলছে— ঝড় আসছে, যেমন ঝড় আসছে শ্বেতার জীবনে।
নিষিদ্ধ আবেগে বুকটা হুহু করে উঠলো শ্বেতার। অন্তর পুড়ে গেল সেই নিষিদ্ধ পুরুষটাকে একনজর দেখার আকাঙ্ক্ষায় কল। অবুঝ মনটা খুব করে চাইলো একটিবার সেই মানুষটার দর্শন পেতে — কিন্তু তা কি আর কখনো সম্ভব?
“মাই লাভ…”
আকস্মিক ভেসে আসা ভারী পুরুষালী কণ্ঠে কল্পনায় বাধা প্রাপ্ত হলো শ্বেতা। বুকের ভেতর কেমন অস্বাভাবিক কম্পন অনুভব করল।
কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? হিজিবিজি ভাবনায় মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো শ্বেতার। সে নিজেই নিজের মাথায় বাড়ি মেরে বললো, “এটা কিভাবে সম্ভব? আমি কি পাগল হয়ে গেলাম? আমি এটা কার গলা শুনছি?”
শ্বেতা ভাবনার মধ্যেই আবারও গমগমে সেই কণ্ঠ ভেসে এলো—
“আমার দিকে কী ফিরে চাইবে না, মাই লাভ… আমি যে এক আকাশ পরিমাণ তৃষ্ণা জমিয়ে এসেছি তোমার দ্বারে। আমাকে কি একটু ও দেখবে না? এই তৃষ্ণার্তকে কি একটু ভিক্ষা দেবে না?”
বাক্যগুলো কর্ণে পৌঁছাতেই স্তব্ধ হয়ে গেল শ্বেতা। বিস্ময়ে পেছন ঘুরে তাকাতেই তব্দা খেয়ে গেল। মনে হলো সে হয়তো জেগে দিবাস্বপ্ন দেখছে!
এতো কাঠ খড় পড়ানোর পর অবশেষে মায়াবিনীর মায়াভরা মুখটা দেখতে পেয়ে আরো প্রচন্ড তৃষ্ণায় কলিজাটা খা খা করে উঠলো। আবির্ভাবের কণ্ঠে কাতরতা মিশিয়ে বুকে ডাকলো—
“এখানে একটু আসবে, মাই লাভ? চেয়ে দেখো, তোমার অভাবে চৈত্রের খরা লেগেছে।”
অশ্রুতে চোখ ভর্তি হয়ে উঠলো শ্বেতার।
আবির্ভাবের হাতে ব্যান্ডেজ, মাথায় ব্যান্ডেজ, আর বাকিটা পোষাকের অন্তরালে ঢাকা।
“এই মেয়ে আসবি না দেখ, তোর জন্য চার তলার পাইপ বেয়ে উঠে এলাম। আয়না, বুকের জ্বালা টা একটু জুড়িয়ে দে, তোর দহনে পুড়ে যাচ্ছে তো …”
আবির্ভাব মুখের কথা সম্পন্ন করতে পারল না; তার পূর্বেই তীব্র এক ঝাঁকুনিতে তাল সামলাতে না পেরে পিছিয়ে গেল কয়েক পা।
প্রচন্ড ব্যথায় সারা শরীর ভেঙে চুরে গেলেও চোখের পাতায় নেমে এলো সুখের জোয়ার। শ্বাসে শ্বাসে জড়িয়ে গেল প্রশান্তি।
শ্বেতা প্রশস্ত বুকে মুখ লুকিয়ে ছোটো বাচ্চাদের মতো কেঁদে উঠলো।
জড়ানো গলায় এলোমেলো কিছু বাক্য ছুড়ে দিল আবির্ভাবের দিকে—
“আপনি এখানে কেন এলেন, আবির্ভাব? কিভাবে এলেন? আপনি-আপনি জানেন, এই নরপিশাচগুলো কত খারাপ! একবার আপনাকে দেখে ফেললে ছিঁড়ে খাবে!”
শ্বেতার অস্থিরতা দেখে বুকের ভেতর সুখের অনুভূতিগুলো দোলা দিয়ে গেল। আবির্ভাবের দুর্বল হাতে শ্বেতার তুলতুলে শরীর খানিক মিশিয়ে নিল। এলো চুলে চুমু এঁকে বলল—
“ওরা আমায় মেরে ফেলুক, মাই লাভ। আমার কোনো আপত্তি নেই। তবুও তো জানবো, আমার ভালোবাসা সত্যতা প্রমাণিত করতে পেরেছি। তোমার আর কখনোই সন্দেহ হবে না আমার ভালোবাসার উপর।”
আবির্ভাবের কণ্ঠে বিষ ঢেলে দেওয়ার মতো অনুভূতি হল শ্বেতার। সে অশ্রু টলটলে চোখে প্রচন্ড অভিমান নিয়ে তাকালো সামনের মানুষটার দিকে।
“কেন আসে বারবার এই মানুষটা? কেন মরণের মুখে ঠেলে দিতে চায় নিজেকে— কেবল তার জন্য?”
ঠোঁট কাঁপল, শব্দ গলায় এসে আটকে গেল শ্বেতা।
এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল আবির্ভাবের সুগভীর কৃষ্ণকায় নেত্রের দিকে, তারপর ধীরে—
খুব ধীরে—
দুই হাত তুলে ঠেলে সরিয়ে দিল তাকে নিজের থেকে।
বুকের ভিতর ফাঁকা হয়ে গেল।
চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল একফোঁটা ফোটা নুনা অশ্রু।
“এ কি আমার তোতা পাখিটা কাঁদে কেন?” — বলে এগোতে নিলে ঝট করে দু’কদম পিছিয়ে যায় শ্বেতা।
মৃদু ধাক্কায় দূরে সরিয়ে দেয় নিজের থেকে।
রক্তিম চোখে তাকিয়ে খপ করে চেপে ধরে আবির্ভাবের শার্টের কলার। দাঁতে দাঁত পিষে বলে—
“ওই ব্যাটা বেয়াদব! আমাকে একা ফেলে মরে যাওয়ার খুব শখ, তাই না? আয়, আয়, তোর সাধ পূরণ করে দেই, এই সোয়াবের কাজটা আমি নিজের হাতেই করি!” — বলে সত্যি সত্যি কলার ছেড়ে গলা টিপতে চলে এলো শ্বেতা।
চোখ বড় বড় করে দুই পা পিছিয়ে গেল আবির্ভাব।
শ্বেতা রাগে ফসফস করতে করতে পুনরায় তেড়ে এলে কৌশলে দুই হাত একত্র পেছনে চেপে ধরল আবির্ভাব, অন্য হাতে কোমর জড়িয়ে ধরে হেঁচকা টানে, মিশিয়ে নিল নিজের সঙ্গে।
হুড়মুড়িয়ে বুকের উপর আছড়ে পড়লো শ্বেতা। মুখ ঢেকে গেল দীঘল চুলে। আদুরে মেয়েটাকে আরো কাছে টেনে নিল আবির্ভাব, মুখের উপর ঝুলে থাকা এলোমেলো চুলগুলো সযত্নে কানের পিঠে গুঁজে দিল, মসৃণ গালে নাক ঘষে দিয়ে বলল—
“আমার রাক্ষুসী!”
শ্বেতা রাগে ফুঁসে উঠল, বুকে কিল ঘুষি মারতে মারতে তুই তোকারি করতে শুরু করল—
“এই এই, ছাড়! ব্যাটা ছাড়, ছাড় বলছি! তুই মরতে চাস? আজ তোকে সত্যি সত্যি মেরে ফেলব!” — বলে আর দ্বিগুণ গতিতে মারতে লাগলো।
আহত শরীরে পুনরায় মার পরতেই ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠল আবির্ভাব।
কঠিন সংযম ছাড়িয়ে আহ বলে ব্যথাতুর শব্দ করে উঠলো।
আপনা আপনি হাত থেমে গেল শ্বেতার। চোখ ভরে উঠল নতুন উদ্যোমে।
খোঁচা খোঁচা দুই গালে হাত ছুঁইয়ে অস্থির গলায় শুধালো—
“কি হয়েছে জান? কোথায় ব্যথা লেগেছে?”
সম্মোধন শুনে হৃদযন্ত্র থমকে গেল আবির্ভাবের। ভালোবাসা জড়ানো ডাগর ডাগর দুই চোখে চেয়ে রইল নিরনিমেষ।
স্বচ্ছ পানি ভর্তি ওই দুই চোখের সৌন্দর্যে পদ্য রচনা করতে ইচ্ছা হল আবির্ভাবের, কিন্তু সে তো ডাক্তার কবি নয়।
“বলো না, জান…”
আবির্ভাব মলিন হাসলো, চকচকে কপালে ওষ্ঠ চেপে দুর্বল গলায় বলল, “কিচ্ছু হয়নি জান।”
চোখ বুজে ফেলল শ্বেতা। কয়েক ফটো উষ্ণ তরল নেমে এলো গাল বেয়ে।
থুতনি গড়িয়ে পড়ার আগেই তা সযত্নে শুষে নিল আবির্ভাব। ভেজা চোখের পাপড়িতে চুমু দিয়ে বলল, “শরীরের আঘাত ক্ষণিকের, কিন্তু তোমার কান্না আমার কোথায় লাগে তা যদি একবার বুঝতে পারতে তাহলে আমার মৃত্যুতে ও হয়তো তোমার কান্না আসতো না।”
বলে চোখ মুছে দিতেই আবারও উপচে পড়া নোনতা জলের ধারা নেমে এলো।
আবির্ভাবের বিবর্ণ ফ্যাকাশে মুখে চোখ বুলিয়ে সফেদ ব্যান্ডেজে হাত ছুয়াল। শ্বেতা কান্না মিশ্রিত কাতর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “ওরা আমার জানকে অনেক মেরেছে, তাই?”
আবির্ভাব মুচকি হাসল, তুলতুলে হাতের উল্টো পিঠে চুমু দিয়ে নরম গলায় বলল, “ওরা মেরে কষ্ট দিয়েছে, তুমি আদর দিয়ে পুষিয়ে দাও, হিসাব বরাবর।”
“উফ, আবার কাঁদে। তুমি টাইট করে জড়িয়ে ধরে কষে একটা চুমু খাও, শত্রুপক্ষের আঘাতের চেয়ে দশ গুণ ভারী পড়বে।”
“তাই।”
“হুম।”
একটা প্রশ্ন করব, আবির্ভাব।
“হুম।”
“আমি কি খুব বেশি সুন্দর? তাই কি এতো ভালোবাসেন?”
আবির্ভাব প্রাণ জুড়িয়ে দেখল প্রিয়সির মায়াভরা মুখখানি, বোঝার চেষ্টা করল এই মেয়েকে সুন্দরী লাগে কোন দিক থেকে।
কই তার কাছে তো বাচ্চা বাচ্চাই লাগে আদর আদর পায়, তবে সাধারণ মানুষের বাহ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাকে কেবল সুন্দরী নয়, আগুন সুন্দরীদের তালিকায় নিঃসন্দেহে অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
আবির্ভাব আর এত কঠিন কঠিন ভাবনায় গেল না। মায়াবিনীর মায়া জড়ানো ছোট্ট মুখখানা আদরে আদরে ভরিয়ে দিয়ে বলল —
“তুমি একটা ছোট্ট বাচ্চা, ওসব সুন্দরী টুন্দরী কিছু না, ওসব আউল ফাউল চিন্তা-ভাবনা মাথায় কে ঢুকায়।”
শ্বেতা চোখ ছোট ছোট করে বললো, “আমি ২১। সঠিক সময় বিয়ে হলে এতদিনে ডিভোর্স হয়ে যেত। আমার বয়সী মেয়েদের দুটো তিনটে করে বাচ্চা আছে।”
আবির্ভাবের মুখ হা হয়ে গেলো।
শ্বেতা ফের বলল, “সত্যি বলো।”
আবির্ভাব মুখ গোল করে নিঃশ্বাস ছাড়লো, থুতনিতে হাত রেখে, নিরেট পর্যবেক্ষণী চোখে শ্বেতা শরীরের ভাজে ভাজে দৃষ্টি বিচরণ করতে লাগলো।
উপর থেকে নিচ পর্যন্ত দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসলো আবির্ভাব, গলার কাছে মুখ নামিয়ে গভীর হাস্কি টেনে বলল,
“মধু লোভী মৌমাছিকে মৌচাকের লোভ দেখিয়ে অভুক্ত ছেড়ে দেওয়ার নামই হলো মেয়ে মানুষ।”
আকস্মিক লজ্জায় লজ্জাবতী গাছের ন্যায় নুইয়ে পড়ল শ্বেতা।
আবির্ভাবের ইঙ্গিতপূর্ণ কথাগুলো কাটা হয়ে বিধলো শরীরে।
তবে কিছু একটা ভেবে লজ্জা মিলিয়ে গেল শ্বেতার।
আবির্ভাব তার শান্ত চোখে তাকালো শ্বেতার দিকে। মস্তিষ্কের ডাক্তার তার সাথে মস্তিষ্কের খেলা খেলছে কথার ছলে শ্বেতাকে ভুলিয়ে দিচ্ছে।
বেশরমের মতো কথা বলছি ঠিক ওই, কিন্তু মানুষটার চোখ, মুখ, অঙ্গভঙ্গি ঠিক লাগছে না। শ্বেতার নিকট ভীষণ আহত লাগছে।
কোনো কথা ছাড়াই শার্টের বোতাম খুলতে শুরু করল শ্বেতা।
আকস্মিক আক্রমণে ভড়কে গেল আবির্ভাব।
শ্বেতার ব্যস্ত হাত বুকে চেপে ধরে বলল,
“এভাবে না বলে কয়ে একটা অবলা ছেলের ইজ্জত হরণ করছ কেন, মাই লাভ?”
শ্বেতা ওর কথায় পাত্তা দিল না। ঝাড়া মেরে হাত সরিয়ে দিয়ে শার্টটা টেনে খুলে ফেলল।
সাথে সাথেই বাকরুদ্ধ হয়ে গেল শ্বেতা।
ক্ষতবিক্ষত শরীরটা দেখে নরম মনটা আর্তনাদ গড়ে উঠলো।
পলক ঝাঁপটানোর পূর্বেই নিজের অজান্তে গড়িয়ে পড়লো তরল।
চোখ বন্ধ করে ফেলল আবির্ভাব।
ক্ষতস্থানগুলো ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেতেই শিরশিরিয়ে উঠলো শরীর।
শ্বেতা অশ্রু ফেলতে ফেলতে পাগলের মতো ছুঁয়ে দিতে লাগল ক্ষতস্থানগুলো।
আবির্ভাব ছটফট করে উঠলো, নিশ্বাস দমিয়ে রেখে, ব্যাকুল গলায় বলল,
“একটু আদর করে দাও ময়না পাখিটা। তোমার সঞ্জীবনী ভালোবাসায় আমার দেহের সকল জ্বালা জুড়িয়ে দাও। তোমার তপ্ত কোমল ঠোঁটের স্পর্শে আমার আঘাতগুলো নিশ্চিহ্ন করে দাও।”
শ্বেতা ও তাই করল। বাধ্য মেয়ের মতো, আবির্ভাবের প্রতিটা দৃশ্যমান ক্ষতস্থানে গভীর ভালোবাসায় নরম ঠোঁট ছুঁইয়ে দিতে লাগল।
আবেশে চোখ বুজে মাথা এলিয়ে দিল আবির্ভাব।
কোমর আঁকড়ে ধরে দ্রুত নিঃশ্বাস ফেলতে লাগল। পুরুষালী শরীরের রগে রগে ছুটে চলা নিষিদ্ধ অনুভূতি জন্মানো হরমোনেরা মাথা ছাড়া দিয়ে উঠছে।
ফের কাতর কণ্ঠের নিষিদ্ধ আবদার শুনতে পেল শ্বেতা —
“আমাকে ভালোবাসো মাই লাভ, অনেক অনেক ভালোবাসো। তোমার ভালোবাসাই পারে পৃথিবীর সকল দুঃখ ভুলিয়ে দিতে।”
তাদের দৈহিক ঘনিষ্ঠতা আরেকটু বাড়তেই ব্যালকনির নিচ থেকে ভরাট কন্ঠের খড়খড়ে আওয়াজ ভেসে এলো
“এই রাত দুপুরে কে রে, ওখানে নষ্টামী করে?”
এই অবেলায় চমকে উঠল দু’জন।
শ্বেতা ভয়ার্থ চোখে নিচে তাকিয়ে চোখ বড় বড় করে ফেলল, “মেজো মামা।”
অজানা আশঙ্কায় হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এল শ্বেতার।
ঢোক গিলে চাইল আবির্ভাবের পানে।
আবির্ভাবের দৃষ্টিতে ভয় নেই, আছে কেবল নির্ভীক পুরুষত্ব।
খালিদ সিকদার ফের চেঁচিয়ে উঠলেন, হাক ছেড়ে ডাকলেন,
“সবাইকে আয়! শুদ্ধ! প্রণয়! রাজ! প্রীতম প্রেম বাপ! তোরা কোথায়, তাড়াতাড়ি এদিকে আয়, দেখতে যা রাতের অন্ধকারে কী নষ্টামী চলছে এই বাড়িতে!”
ভড়কে গেল শ্বেতা। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আবির্ভাবকে টেনে নিজের ঘরে নিয়ে এলো।
উত্তেজনায় সর্বাঙ্গ ঘেমে নেয়ে ভিজে উঠেছে মেয়েটার। সে আবির্ভাবের বলিষ্ঠ হাতে চেপে ধরে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে শুধালো,
“এবার কি করবো? আমি কোথায় লুকাবো আপনাকে? মেজ মামা আমাদের একসাথে দেখে ফেলেছে। আজ ধরা পড়লে নিশ্চিত মৃত্যু!”
আবির্ভাব চুপচাপ শুনলো, কোনো প্রকার বাড়তি উত্তেজনা দেখালো না।
শ্বেতার দুই গাল হাত চেপে, দৃষ্টি মিলানো উদ্ভ্রান্ত সে ভীত, সন্ত্রস্ত চোখে নয়নে নয়ন ঠেকিয়ে বলল,
“কিচ্ছু হয়নি। এই দিকে তাকাও, আমার চোখের দিকে তাকাও।”
আবির্ভাবের গভীর চোখে চোখ পড়তেই হাত-পা কাঁপাকাঁপি শান্ত হয়ে গেল শ্বেতার।
আবির্ভাব চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল,
“আমার সাথে বেশিদিন বাঁচতে পারবে না জানি, কিন্তু আমার সাথে মরার সাহস রাখো মাই লাভ?”
শ্বেতা এক্ষেত্রে কালবিলম্ব করল না। মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় ওপর নিচে মাথা ঝাঁকাল।
প্রাণোচ্ছল হেসে শ্বেতাকে বুকে চেপে ধরল আবির্ভাব।
আঙুলের ফাঁকে আঙুল গুঁজে দিয়ে বলল,
“চলো, তাহলে।”
“কোথায়?”
“নিরুদ্দেশে।”
খালিদ সিকদারের চেঁচামিচিতে ধড়ফড়িয়ে জেগে উঠল সিকদার বাড়ির সকলে।
প্রেম চশমার ভিতর দিয়ে চোখ ডলতে ডলতে হাই তুলে এসে দাঁড়ালো খালিদ শিকদারের সম্মুখে। বিরক্ত গলায় বলল,
“কি হয়েছে মেজো চাচ্চু, এই মাঝরাতে চেঁচাচ্ছেন কেন? বাড়িতে কি ডাকাত পড়েছে?”
খালিদ সিকদার আগ্রাসী কণ্ঠে বললেন,
“এর থেকে অনেক বেশি কিছু হয়েছে বাপ, কথা কম বলে ওপরে দেখ।”
প্রেম, উনার কথামতো ভুরু কুঁচকে চার তলার ব্যালকনির দিকে তাকালো, কিন্তু কোথায়? কি?
মেজাজ খারাপ হলো প্রেমের। মুখ তেতো করে বলল,
“আপনার চশমা কোথায় মেজো আব্বু? কি দেখতে কি দেখেছেন? ধুর! মাঝরাতে চেঁচামিচি করে মাথা ধরিয়ে দিলেন।”
ততক্ষণে পুরো সিকদার বাড়ি এসে হাজির হলো গার্ডেন এরিয়ায়।
শুদ্ধ ভুরু কুঁচকে বলল,
“কি সমস্যা এত, হৈচৈ কিসের?”
খালিদ সিকদার পুনরায় জোর দিয়ে বললেন,
“বিশ্বাস কর বাপ, আমি দেখেছি ওখানে…”
প্রণয় অবাক হওয়ার ভান ধরে জিজ্ঞাসা করল,
“কি দেখেছেন?”
খালিদ বললেন,
“আমি দেখেছি ওখানে দু’জন…”
প্রণয় আরও আগ্রহী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“দু’জন? কি?”
খালিদ ধীরস্থির কণ্ঠে বললেন,
“দেখ বাপ, এত বিস্তারিতভাবে বলতে পারব না আমার লাজ শরম আছে — ওই পূর্ব পাশের ঘরটা কার?”
“শ্বেতার।”
চোখ বড় বড় করে ফেলল বাড়ির সকলে।
মেহজাবিন চৌধুরী ছুটলেন মেয়ের ঘরের দিকে। কিন্তু সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও শ্বেতার আর দেখা পেলেন না।
আবারও জরুরি বৈঠক বসলো সিকদার বাড়ির ড্রইংরুমে।
প্রণয় হাই তুলে নিরুৎসুক কন্ঠ বললো,
“এই কাক ডাকা ভোরে না ঘুমিয়ে গোল মিটিং করলেই ওদের পেয়ে যাবে না। তার জন্য শান্ত মস্তিষ্কে চিন্তা ভাবনার প্রয়োজন আছে। তাই আমি তো গেলাম ঘুমাতে, বাকিটা আপনাদের ব্যাপার।”
সাদমান সিকদার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বসে রইলেন জ্বলন্ত কন্ঠে হুংকার ছেড়ে বললেন,
“পৃথিবীর যে গর্তেই পালিয়ে যাও, আমার হাত থেকে তোদের নিস্তার নেই। পাতাল খুঁড়ে হলেও তোদের খুঁজে বের করব। আগেরবার প্রাণের ভিক্ষা দিয়েছিলাম, কিন্তু এবার আল্লাহর নামে শপথ নিয়ে বলছি, এবার তোর মাথাটা নিজের হাতে আলাদা করবো। আমি আবার ওই রায়পুরের দৃষ্টান্ত স্থাপন করব—”
সকাল গড়িয়ে দুপুর প্রায় দু’টা, মাথার উপর খাঁ খাঁ করছে চড়া রোদ। যানবাহনের শব্দে মুখরিত ব্যস্ত সড়ক।
ব্যস্ত যাত্রীরা উৎসুক নজরে চেয়ে আছে রেল লাইনের দিকে। তার ঠিক দুই মিনিটের মাথায় চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন জংশনের ৫ নম্বর প্ল্যাটফর্মে এসে থামলো সুরমা এক্সপ্রেস।
যাত্রীবাহী ট্রেনের কামরাগুলো থেকে গাদাগাদি করে নামছে কর্মজীবী মানুষরা।
এতো ভিড়ভাট্টা লোকসমাগম এড়িয়ে ট্রেনের বাইরে পা রাখলো এক যুগল। মেয়েটি ভীত সন্ত্রস্ত, সে অত্যন্ত বিশ্বাসের সঙ্গে ধরে আছে ছেলেটির পেশীবহুল হাত। ছেলেটি নিজ উদ্যোগে মেয়েটির চিকন কোমল আঙুলের ফাঁকে নিজের আঙুল গলিয়ে দিলো।
মেয়েটি শুকনো মুখের পানে চেয়ে বললো—
“চলো।”
মেয়েটি পুনরায় শংকিত হলো, ডাগর ডাগর চোখ দুটো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চোরের মতো আশেপাশ দেখে জিজ্ঞেস করলো—
“কো-কোথায়?”
ছেলেটি মুচকি হেসে তার হাত ধরে নিয়ে গেল স্টেশন লাগোয়া ছোট্টো একটা টঙ দোকানে।
সেখানে থেকে ২০ টাকা দামের একটা পানির বোতল মেয়েটার হাতে দিয়ে কোমল গলায় বললো—
“চোখ মুখে পানি ছিটিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করো মাই লাভ, আমরা চুরি করছি না।”
অথচ তোমার চোখ মুখ দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে আমরা হয়তো ডাকাতি করতে নেমেছি।
শ্বেতা শুকনো ঢোক গিললো, অসহায় চোখে তাকালো আবির্ভাবের পানে। সে এই মাথামোটা লোকটাকে কিভাবে বোঝাবে— এই লোকটা যতটা স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছে ব্যাপারটা, আদৌতে ও তা নয়।
শ্বেতা পানির বোতল নিয়ে চোখ মুখে ছিটিয়ে দিলো, ওড়নার কোনায় মুখ মুছতে মুছতে বললো—
“এবার কোথায় যাবো আমরা?”
আবির্ভাব এক কাপ চা আর দুটো বন রুটির প্যাকেট শ্বেতার হাতে দিয়ে সরল গলায় বললো—
“আমরা এখন দেশে যেতে পারবো না মাই লাভ, এতক্ষণে এয়ারপোর্টে জাল বিছানো হয়ে গেছে।”
উৎকণ্ঠায় গলা শুকিয়ে কাঠ হলো শ্বেতার, কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো—
“তা-তাহলে কোথায় যাবো আমরা?”
“অপাতত রাঙামাটি।”
“কিন্তু ট্রেন তো রাঙামাটি অবধি যাবে না।”
“জানি, এখান থেকে আমাদের বাসে করে যেতে হবে। তার আগে কিছু জরুরি কাজ আছে, সেগুলো করতে হবে।”
“কি কাজ?”
আবির্ভাব ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললো—
“সবার আগে খেতে হবে, এত বড় মানুষ আমি— কতক্ষণ না খেয়ে থাকতে পারি?”
আবির্ভাবের কথা শুনে শ্বেতার মনে ভয় জানালা দিয়ে পালালো। সে পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বললো—
“খান।”
মুচকি হাসলো আবির্ভাব।
শ্বেতা হাতের বনরুটি দুটোও এগিয়ে দিয়ে বললো—
“এগুলোও খান।”
আবির্ভাব বিনা বাক্যে নিলো, প্লাস্টিকের প্যাকেট ছাড়িয়ে রুটিতে কামড় বসালো।
শ্বেতার যেন দেখেই, ক্ষুধা মিটে গেলো, সে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল ৩০ ঊর্ধ্ব সেই যুবকের পানে।
প্রেয়সীকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বাঁকা হাসলো আবির্ভাব, পিঞ্চ মেরে বললো—
“খাবারে নজর দিচ্ছ মাই লাভ? থাক, নজর দিতে হবে না হা করো।”
বলেই রুটির টুকরো মুখের সামনে তুলে ধরল আবির্ভাব।
শ্বেতাও বিনা বাক্যে খেয়ে নিলো। খাওয়া-দাওয়া শেষে দোকানের বিল মিটিয়ে হাতে হাত ধরে হাটা দিলো বাসস্ট্যান্ডের দিকে।
ফুটপাতের রাস্তায় পা মিলিয়ে হাঁটছে দুজন। যেতে যেতে আবির্ভাব বললো—
“এভাবে ঘোরা কি সেফ হচ্ছে মাই লাভ? আমাদের যেকোনো সময় যে কেউ চিনে ফেলতে পারে। তোমার বাবা ভাইয়ের থেকে পালিয়ে বাঁচা এতটা সহজ হবে না।”
আবির্ভাবের কথায় শ্বেতাও দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলো। কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করে বললো—
“ঠিক বলেছেন, আমরা ওদের থেকে পালিয়ে বেশিদিন বাঁচতে পারবো না। কিন্তু…”
‘কিন্তু কী…”
“কিন্তু আমার মাথায় একটা চকাচক আইডিয়া আসছে, যেটা অনুসরণ করলে ওরা আর আমাদের সাত জন্মেও খুঁজে পাবে না।”
হাঁটা থামিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালো আবির্ভাব, সন্দিহান কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো—
“কি?”
শ্বেতা বাঁকা হেসে বললো—
“চলুন কাপড়ের দোকানে।”
“কি? কেন?”
“আরেহ, চলুন না!”
অতঃপর ১০ মিনিট পর দুজন একটা কাপড়ের দোকান থেকে বের হলো।
আবির্ভাব বুকে হাত চেপে বললো—
“Is Nazar se Nazar milane ke baad jeena mushkil ho gaya tha mera, tab bhi to socha, kya hai is najar mein, Aankher jawab milhi gaya.”
শ্বেতা আবির্ভাবের বুকে ধাক্কা দিয়ে বললো—
“পাগলের ডাক্তার!”
“আর তাকে নিজের প্রেমে চুবিয়ে পাগল বানিয়েছ তুমি।”
শ্বেতা লজ্জায় নুয়ে পড়লো।
আবির্ভাবের হৃদপিণ্ড কেমন বেয়াদবের মত লাফালাফি শুরু করেছে, চোখ ফেরানোই দায়— সে বুক চেপে ধরে মুখ হাঁ করে তাকিয়ে রইল।
কালো বোরখা আর কালো নিকাবে নারী অঙ্গের প্রতিটি ভাঁজ ঢাকা পড়েছে, কেবল দৃশ্যমান হয়ে আছে ভারী পল্লব বিশিষ্ট ডাগর ডাগর একজোড়া ধূসর বর্ণ চোখ— যা সেই চোখের সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দিয়েছে হাজারগুণ।
শ্বেতা আবির্ভাবের বাহু জড়িয়ে ধরে লাজুক কণ্ঠে বললো—
“ইস চোখ সরান, এভাবে কেবলার মত তাকিয়ে থাকলে মানুষ কি বলবে।”
“মানুষকে নিয়ে এত সেক্রিফাইস করতে পারবো না আমি।”
“হুহ, বছর তিনেক জ্বালিয়ে পুড়িয়ে এখন আসছে প্রেম দেখাতে ব্যাটা মানুষ।”
” আমি তো সুখের ঠেলায় তিন বছরে তিনটা সন্তানের বাপ হয়ে গেছি।”
শ্বেতার লজ্জা উবে গেলো। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল,
“বাচ্চা হয়নি তো তারমানে তো আর এটা প্রমাণ হয়ে যায় না, আপনি বিশুদ্ধ পুরুষ।”
আবির্ভাবের কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়লো।
“কি বলতে চাও?”
শ্বেতার কন্ঠ কাপলো। সে প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে চলে যেতে নিলেই তার হাত টেনে ধরলো। আবির্ভাব হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“তুমি আমায় বিশ্বাস করো না, মাই লাভ?”
শ্বেতা কান্না আটকানোর চেষ্টা করে বলল,
“বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন কোথা থেকে আসে? আবির্ভাব, আপনি বিবাহিত ছিলেন কিছু করলেও সেটা বৈধ উপায়ে করেছেন। অন্যায়ের কি আছে?”
আবির্ভাব আশ্চর্য হয়ে গেল এসব কথা শুনে, সঙ্গে প্রচন্ড রাগ হলো নিজের প্রতি।
“তুমি মনে করো আমি তুমি ব্যতীত অন্য কোন নারী শরীরে স্পর্শ করেছি?”
শ্বেতা মুখ ঘুরিয়ে বললো,
“মনে করাটা কি অস্বাভাবিক কিছু? আড়াই বছর সংসার করে ও আপনি নিজেকে ভার্জিন দাবি করেন।”
“তোমাকে ভার্জিনিটির প্রমাণ কিভাবে দিতে হবে বলো? পৃথিবীর কোন মেডিকেল সাইন্সে আজ পর্যন্ত পুরুষের ভার্জিনিটি প্রমাণ করার কোন ফর্মুলা লেখা আছে বলে আমার জানা নেই।”
আবির্ভাবের সিরিয়াস চোখ মুখ দেখে ফিক করে হেসে দিলো শ্বেতা। হাসতে হাসতে আবির্ভাবের বাহু জড়িয়ে ধরে বলল,
“এতো সিরিয়াস হচ্ছেন কেন? আমি তো মজা করছি। আপনি ভার্জিন কি ভার্জিন না এসব দিয়ে আমি কি করবো? আমি শুধু জানি আপনি সেই মানুষটা যে আমাকে আমার থেকেও বেশি ভালবাসে আর আমার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট।”
“কিন্তু…”
“কোন কিন্তু নয়, এসব ছেড়ে কাজের কথা শুনুন।”
“না, আগে তোমাকে আমার কথা শুনতে হবে।”
শ্বেতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চাইলো,
“তুমি সত্যি আমাকে বিশ্বাস করো না?”
“প্রথমত, পুরুষের ভার্জিনিটি নামক কিছু আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না। দ্বিতীয়ত, আমাকে অন্তরে রেখে আমার পুরুষ অন্য কাউকে স্পর্শ করবে এটা হতেই পারে না। এবার হ্যাপি।”
রাস্তার মধ্যেই শ্বেতা কে জড়িয়ে ধরল আবির্ভাব। ব্যথিত কন্ঠে বলল,
“পৃথিবীর সবাই আমাকে অবিশ্বাস করুক, আমার কিছু যায় আসে না, কিন্তু তোমার অবিশ্বাস আমি সহ্য করতে পারবো না, মাই লাভ।”
“এবার আমার কথাটা শুনবেন।”
“হুম, বলো।”
“শুনুন, আমাদেরকে পরিচয় গোপন করে ফেলতে হবে পুরোপুরি। কেউ আমাদের খুঁজ করলে সবার আগে এটা বলে খোঁজ করবে – আপনি একজন হিন্দু।”
“ওদের এই ধারণার সুযোগ নিতে হবে।”
“মানে?”
“মানে, এভাবে আমাদের কেউ থাকতে দেবে না। এটা কানাডা নয়, এটা বাংলাদেশ। এখানে এভাবে ঘরভাড়া পাওয়া যায় না।”
“তাহলে কি করতে হবে, ম্যাডাম?”
“আমরা বিবাহিত— এটা বললেই ঘরভাড়া নিতে হবে।”
আবির্ভাব ঠোঁট কামড়ে হাসলো, কানের লতিতে ঠোঁট ছুঁইয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
“তো এতে মিথ্যের কি আছে? আমরা তো সত্যিই বিবাহিত।”
লজ্জায় আরও একটু কুঁকড়ে গেলো শ্বেতা।
আবির্ভাব ফের বললো,
“বিয়ে তো অনেক আগেই করেছি, এখন শুধু সংসার করা বাকি।”
শ্বেতা লজ্জায় অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো,
“একদম লজ্জা দেবেন না, আমি সিরিয়াস।”
আবির্ভাব ওর ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলে গভীর হস্কি কন্ঠে বললো,
“আমিও সিরিয়াস।”
পেটের ভেতর মুচড় দিয়ে উঠলো শ্বেতার, কথা কাঁটাতে বললো,
“দে… দেখুন, ওই বিয়ের কথা বলিনি, বলেছি আমাদের দুজনকেই মুসলিম দম্পতি সেজে থাকতে হবে।”
“হুঁ, সাজবো।”
“উহু, ব্যাপারটা অতটা সহজ না, আপনাকে আমাদের মতো থাকতে হবে, কথা বলতে হবে, আমল করতে হবে।”
“এ্যাঁ, সেটা আবার কি? আমরা সবাই তো একইভাবে কথা বলে চলাফেরা করি।”
শ্বেতা মাথা নাড়িয়ে বুঝানোর ভঙ্গিতে বললো,
“না, আপনি বুঝতে পারছেন না। ধর্মীয় অভ্যন্তরীণ কিছু জিনিস আছে যেটা আমাদের মধ্যে কখনোই মিলে না, আর এটা অন্যদের নজরে পড়লে আপনি ধরা পড়বেন।”
আবির্ভাব কপাল কুঁচকালো।
শ্বেতা দম নিয়ে বললো,
“আপনি আমার দাদাকে তো দেখেছেন, উনি যেভাবে চলেন, তার থেকেও ফরহেজগার ভাবে চলতে হবে, যাতে আমাদের কেউ না সন্দেহ করে।”
“কীভাবে?”
শ্বেতা হতাশ হলো, অভির্বাবের মাথা থেকে পা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে বললো,
“প্রথমেই এসব শার্ট, প্যান্ট ছাইপাস পড়া ছাড়তে হবে, এসব চলবে না।”
“তাহলে কি পরবো?”
“পাঞ্জাবি। আপনি আজ থেকে সবসময় সাদা পাঞ্জাবি পরবেন, পাঁচ ওয়াক্ত মসজিদে গিয়ে সালাত আদায় করবেন, কোন পরিচিত বা অপরিচিত কারো সাথে দেখা হলে কথা বলার পূর্বে সালাম দিয়ে আলাপ শুরু করবেন, ভালো কোনো সংবাদ শুনলে আলহামদুলিল্লাহ বলতে ভুলবেন না, সুন্দর কিছু দেখলে প্রশংসার্থে ‘বিউটিফুল নয়, মাশাআল্লাহ’ বলবেন। আপনার চলাফেরায় যেন কখনোই প্রকাশ না পায় যে আপনি অন্নধর্মী, আর আমি সবসময় বোরখা, নিকাব পরে চলবো, কেউ চিনতে পারবে না।”
“সব ঠিক আছে, কিন্তু মসজিদে যাওয়ার ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে না। যতই হোক, আমি তো মুসলিম নই, তাহলে আমার উপস্থিতিতে পবিত্র স্থানের অপমান হবে না, আর সর্বোপরি, আমি তো নামাজ পারি না।”
শ্বেতা বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
“অপমান কেন হবে? আপনি কি অপবিত্র নাকি? এই জগত মহান রবের সৃষ্টি, মানবকুলও মহান রবের সৃষ্টি। জাতপাত, ধর্ম, বর্ণের ভেদাভেদ মানুষ করে, সৃষ্টিকর্তা নয়। আল্লাহর নিকটে তাঁর সকল বান্দাই সমান। উনি তাঁর দরবারে হাত উঠানো কোনো বান্দাকেই নিরাশ করেন না। আপনি শুদ্ধ মনে যখনই আল্লাহর স্মরণ করবেন, উনি নিশ্চয়ই আপনার ডাক শুনবেন।”
“আর আপনি নামাজ জানেন না? আমি তো আছি, আমি শিখিয়ে দেবো।”
আবির্ভাব মুগ্ধ হয়ে বললো,
“যথা আজ্ঞা, বিবিজান।”
শ্বেতা হেসে ফেললো।
আবির্ভাবের কিছু একটা স্মরণ হতেই সে ঝটপট বললো,
“তোমার ফোনটা দাও তো, মাই।”
শ্বেতা বিনা বাক্যে দিলো।
আবির্ভাব ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো ব্যাটারি ডেথ, স্বস্তি পেল। মনে মনে নিজের ও শ্বেতার ফোন থেকে সিম দুটো খুলে ছুঁড়ে মারলো। ব্যস্ত সড়কে, অতপর শ্বেতার চোখের পানে তাকিয়ে বললো,
“সব ঠিক আছে, কিন্তু সবার আগে আমার খুনিকে ঢাকতে হবে।”
শ্বেতা মুখ হাঁ করে বললো,
“এ্যাঁ।”
“এ্যঁ নয়, হ্যাঁ। আমার খুনিকে লুকাতে হবে। সে যে বড় সুন্দর, যে একবার দেখলেই সে আর কখনো ভুলতেই পারে না।”
“আপনি তো বেঁচে আছেন।”
“হ্যাঁ, তো মনটা তো খুন করেছে।”
“কি বুঝাতে চাচ্ছেন, বলুন তো?”
“বুঝাতে চাচ্ছি তোমার এই ইউনিক চোখের কালার ঢাকতে হবে, নাহলে তোমার এই রেয়ার চোখের কালার আমাদের কট খাওয়ানোর জন্য যথেষ্ট।”
শ্বেতা রেগে দাঁত খিচিয়ে বললো,
“বোয়াদপ লোক, এই কথা এইভাবে পেঁচিয়ে বলতে হয়।”
“যাহ বাবা, মিথ্যে কি বললাম? আমার খুনিকে খুনি বলবো না।”
“সরুন তো।”
দুপুর গড়িয়ে, গোধূলি বিকেল, পাহাড়ি সুন্দর্যে ভরপুর রাঙা মাটি শহরের উত্তর ভাগে একটি ছোট টিন শেড বাড়ির এক চালায় দাঁড়িয়ে আছে আবির্ভাব ও শ্বেতা।
আবির্ভাব স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
“ঘর ভাড়াটা আমাদের খুব দরকার চাচা, আপনি চাইলে আমরা অ্যাডভান্স দিয়ে দিতে পারি।”
ভদ্রলোক ভ্রু কুঁচকালেন।
“টাকা পাবো বলেই তো আমার বাড়িতে যাকে তাকে থাকতে দিতে পারি না। তো নাম কি তোমাদের? এই মেয়ে কে হয় তোমার?”
আবির্ভাব এক পলক শ্বেতার পানে তাকিয়ে মুচকি হেসে জবাব দিলো,
“জি, আমার নাম তাশদীদ মাহবুব, আর আমার বিবি মল্লিকা সুলতানা।”
“হুম, বিয়ের কাগজ আছে?”
আবির্ভাব হেসে বললো,
“জি না চাচা, আমাদের বিয়ের রেজিস্ট্রি হয়নি। আমরা শরিয়া মতাবেক বিয়ে করেছি কেবল কাল পরশু নাগাদ রেজিস্ট্রি করে ফেলবো।”
ভদ্রলোক আর কথা না বাড়িয়ে গম্ভীর হয়ে বললেন,
“ঠিক আছে, ওই পূর্ব দিকের ঘরটা তোমাদের প্রতি মাসের এক তারিখের মধ্যে ভাড়া ক্লিয়ার করে দেবে। বারবার তাগাদা দিতে যেন না হয়। আর অ্যাডভান্স তিন মাসের ভাড়া পরিশোধ করো।”
“জি চাচা,” ওরা দুজনই বললো।
ওয়ালেট বের করে তিন মাসের ভাড়া বাবদ ৩০,০০০ টাকা পরিশোধ করে দিলো আবির্ভাব।
ভদ্রলোক বললেন,
“ঠিক আছে, তোমরা যেতে পারো। তবে আমার বাড়িতে নেশা, পানি বা কোনো অনৈতিক কাজ-কারবার করবে না, ইমান সহিত থাকতে হবে পাঁচ ওয়াক্ত আমল করতে হবে।”
ওরা দুজনেই সম্মতি জানিয়ে নিজেদের জন্য বরাদ্দকৃত নির্দিষ্ট কক্ষে চলে গেলো।
ঘরটা খুব একটা বড় না, মোটামুটি মাঝারি আকারের, শুধু একটা রান্নাঘর আর একটা ছোট বেডরুম।
শ্বেতা ঘরটা দেখে খিলখিল করে হেসে বললো,
ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৭২
“এটা আমাদের সংসার।”
“হুম, পছন্দ হয়েছে?”
“খুউউব।”

Onk sundr lagse onk asay thaki kokn porbo asbe …… Taratri next porbo chai
Apu kindly taratari den onek shundor golpo ta pls pls taratari next part den Apu,🤍