ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ১০
মিথুবুড়ি
‘ঈশান কোণে মেঘ জমেছে। ধূসর মেঘের ছায়ায় বিষণ্ণ হয়ে আছে গোধুলি। দিনের আলো ফুরিয়ে সন্ধ্যা রাত্রির পর্দা টেনেছে ধরিত্রী। রূপালী থালার মতো গোল চাঁদ আড়াল হয়ে গিয়েছে কালো মেঘের আঁড়ালে। অমাবস্যার কালো রঙে তলিয়ে যাচ্ছে ভুবন। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঘন জঙ্গলের লম্বা লম্বা দানবীয় গাছপালা অভিশপ্ত মূর্তির মতো লাগছে। ঘন কালো জঙ্গলে বাগানবাড়িটি কোনো পরিত্যক্ত রাজপ্রাসাদের চেয়েও কম মনে হচ্ছে না। অকস্মাৎ শরীর শিউরে উঠার মতো দমকা শীতল হাওয়া বয়ে গেল বাগানবাড়ির প্রাঙ্গণে। হঠাৎ করে বাগানবাড়ির সমস্ত ইলেকট্রিসি লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অজ্ঞাত গুপ্তচর এক এক করে প্রতিটি কোণার সিসিটিভি ক্যামেরার লাইন কেটে দিল। থমথমে আবহাওয়ায় গুমোট পরিবেশে শোকে গেয়ে উঠল। মুহুর্তেই স্মশান ঘাটের মতো গাঁ ছমছম ভাবে সঙ্গোপন আতঙ্কে রুপান্তরিত হলো পুরো বাগানবাড়ি।
‘রাত তখন এগারোটা। নীরবতা ভেদ করে কেবলই ভেসে আসছে সশস্ত্র গার্ডদের ভারী বুটের চাপা শব্দ। তারা পায়চারি করছে নির্লিপ্তে সতর্ক ভঙ্গিতে। হঠাৎ তাদের দৃষ্টি আঁটকে আকাশের দিকে—একটি হেলিকপ্টার বাগানবাড়ির আকাশে বারবার চক্কর দিচ্ছে, অস্বাভাবিকভাবে দীর্ঘ সময় ধরে। কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে গার্ডদের। মুহূর্তেই এলার্ট হয়ে ওঠে সবাই। কানে থাকা ব্লুটুথ ডিভাইসের মাধ্যমে দ্রুত বার্তা বিনিময় হয়। বাগানবাড়ির আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা গার্ডরা দ্রুত অবস্থান নেয় আরও সতর্কভাবে। এদিক-ওদিক নজর বোলায়, সন্দেহের ছায়া খুঁজে বেড়াল অন্ধকারে।
‘গার্ডদের একজন ন্যাসোর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে। তবে ন্যাসোর কোনো সাড়া না পেয়ে অবিলম্বে বিপদ সংকেত পাঠিয়ে রাখে। সবাই নিজ উদ্যোগে পাখি শিকারীর মতো নিখুঁত নিশানায় বন্দুকের সরু নল তাক কর ধরল হেলিকপ্টারের দিকে। সেফটি লক খুলে ফেলে আঙুল রাখল ট্রিগারের ওপর। চাপা উত্তেজনা আর ক্ষীণ এক ধৈর্য্য নিয়ে অপেক্ষা করছিল তারা। সামান্যতম ঝুঁকির ইঙ্গিত পেলেই গর্জে উঠবে আগুনের ঝলক! ভেদ করবে নীরব রাতের বুক।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘আচমকা হেলিকপ্টারটি নিচের দিকে নামতে শুরু করে। গার্ডরা একে-অপরের দিকে দ্রুত দৃষ্টিবিনিময় করে। পরবর্তীতে তাদের সন্দেহের রেখা ক্ষণিকের জন্য ঝাপসা হয়ে যায়। ধীরে ধীরে তারা বন্দুকের নল নামিয়ে ফেলল,সতর্কতা বজায় রেখেই একত্রিত হয় একজোট হয়ে। সবার ভেবেছে রিচার্ড এসেছে। রিচার্ড দেশের বাইরে গিয়েছে তিন দিন আজ। এমন হঠাৎ আগমন তার জন্য নতুন কিছুই নয়। প্রায়শই রিচার্ড হেলিকপ্টারে করে আসা-যাওয়া করে৷ আর মাঝে মধ্যেই এই রকম অদ্ভুত কাণ্ড ঘটিয়ে গার্ডদের সতর্কতার পরীক্ষা নেয়। এই পরীক্ষাই ঠিক করে দেয় কারা যোগ্য, কারা অযোগ্য।
‘ যারা উত্তীর্ণ হতে পারে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় ইতালিতে। সেখানে তারা সরাসরি ড্রাগন গ্রুপের হয়ে কাজ করার সুযোগ পায়। কিন্তু যারা ব্যর্থ হয় তাদের জন্য অপেক্ষা করে এক ভয়াবহ উপহার—নিঃশ্বাসরুদ্ধ মৃত্যু। রিচার্ড কায়নাত—এক হৃদয়হীন, নৃশংস, হিংস্র শিকারি। তার হৃদয় পাথরের মতো কঠিন, মস্তিষ্ক পৈশাচিক আর সাইকোটিক। দুর্বলতা তার ধৃষ্টতার চোখে ঘৃণার প্রতীক। সে কেবল শক্তি, দৃঢ়তা আর নির্মমতার ভাষা বোঝে। তার দুনিয়ায় জায়গা আছে কেবল শক্তদের, আর বাকিদের জন্য শুধুই শেষের প্রহর।
‘সকল গার্ড নত দৃষ্টি নিবিষ্ট করে দাঁড়িয়ে থাকল। অনিশ্চিত উত্তেজনায় বুক ধড়ফড় করতে থাকে কারও অজান্তেই। হেলিকপ্টারটি আরও নিচে নেমে আসতে থাকে! তার দৈত্যাকার ব্লেডগুলো ঘূর্ণায়মান ঝড়ের মতো বাতাসকে ছিঁড়ে ফেলছে তীব্র শব্দে। সেই ঘূর্ণি বাতাসে সোজা পায়ে দাঁড়িয়ে থাকাই মুশকিল হয়ে পড়ল গার্ডদের জন্য। হঠাৎই অপ্রত্যাশিতভাবে হেলিকপ্টার থেকে একধরনের তরল পদার্থ বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ে তাদের উপর। মুহূর্তের মধ্যে তা বাষ্পে পরিণত হয়ে চারপাশে মিশে যায়! স্নায়ুর মতো অদৃশ্য কিন্তু প্রাণঘাতী। গার্ডরা চেষ্টা করে সজাগ থাকতে, কিন্তু বাষ্প নাকে পৌঁছাতেই শরীরের নিয়ন্ত্রণ হারালো তারা। একের পর এক টলতে টলতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে নিস্তেজ হয়ে।
‘হেলিকপ্টারের ককপিটের পাশে বসে থাকা এক সাদা শুভ্র পাঞ্জাবি পরিহিত ব্যক্তি এই দৃশ্য উপভোগ করল খুব। তার ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে এক নিঃশব্দ, ঠাণ্ডা, বাঁকা হাসি। চোখের কোণে কোনো করুণা নেই, কেবল নির্দয় তৃপ্তি। ককপিটের দিকে এক নিঃশব্দ ইশারা করল পাঞ্জাবি পরিহিত লোকটি। হেলিকপ্টার এবার ধীরে ধীরে নেমে আসে সুইমিং পুলের পাশের বিস্তৃত ফাঁকা জায়গাটাই। বিশাল ব্লেডের বাতাসে সদ্য গজানো কোমল গাছগুলো দুলতে থাকে। হেলিকপ্টারের দরজা খুলে বেরিয়ে আসলো সেই সাদা পাঞ্জাবি গায়ে চাপানো লোকটি। বাতাসের তোড়ে তার কুঁকড়া চুলগুলো এলোমেলো হয়ে উড়ছে অবাধ্যতার ঘোষণা দিয়ে। তার পেছন পেছন নেমে আসে আরও দু’জন—পরনে সেফটি জ্যাকেট, মুখ ঢাকা night owl মুখোশে। মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা তাদের চেহারা অস্পষ্ট!কিন্তু চলার ভঙ্গিতেই ফুঠেছে অদ্ভুত এক কঠোরতা।
‘পাঞ্জাবি পরিহিত সেই অমানবিক হাসির মানুষটি দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় সদর দরজার দিকে! ঠোঁটের কোণে লেপ্টে আছে এক রহস্যময় বিজয়ের হাসি। পেছনে ছদ্মবেশী প্রহরী দু’জন ছায়ার মতো সঙ্গ দিচ্ছে। তাদের পেটানো শরীরের গঠন শক্তিশালী। তবে চমকপ্রদ নয়! তাদের আসল ভয়াবহতা লুকিয়ে আছে বাহুর পেশীতে নয় বরং অন্তরের অন্ধকারে। সদর দরজাটি ভিতর থেকে শক্ত করে লক করা ছিল। লোকটি সামান্য ঘাড় ঘুরিয়ে তার প্রহরীদের দিকে তাকাল শুধু। মুখে কোনো উত্তেজনা বা তাড়া নেই। ইঙ্গিত পেয়ে প্রহরী দু’জন সামনে এগিয়ে যায়, আর তাদের ‘রাজা’ একপা পিছিয়ে দাঁড়াল।
‘দু’জন প্রহরী বলিষ্ঠ কাঁধ দিয়ে পরপর কয়েকবার দরজায় আঘাত হানে। ধাতবের গর্জন ভেসে আসে নির্জনতার বুক চিরে। অবশেষে ভেতর থেকে দরজার ছিটকিনি টেনে খুলে গেল।ছিমছাম গড়নের হলেও তাদের শারীরিক শক্তি প্রমাণিত হয় এই এক মুহূর্তেই।
পাঞ্জাবি পরিহিত সেই রহস্যময় মানুষটি ঠোঁটের কোণে আরও একবার ঠান্ডা, তীক্ষ্ণ হাসি টেনে নেয়। এক অদ্ভুত তৃপ্তি আর অমানবিক আনন্দের ছোঁয়া নিয়ে হেঁটে গেল ভিতরে। বিকট শব্দে ঘুম থেকে লাফিয়ে ওঠে রেশমা। স্নায়ুর মধ্যে তীক্ষ্ণ কাঁপনে বুক শুকিয়ে আসে। বাগান বাড়ির ভিতরে এখন শুধু সে, নিশি আর এলিজাবেথ এই তিনজনেই আছে। ন্যাসো তো ইতিমধ্যেই রিচার্ডের দেওয়া কাজে নিযুক্ত। তাহলে এতো রাতে কে আসলো? রিচার্ড?
‘নাহ, রিচার্ড আসলে কখনো এমনভাবে আসবে না। তিন দিন ধরে রিচার্ড কোনো যোগাযোগ করেনি। ওটা কী ধরনের শব্দ ছিল? দরজা ভাঙার শব্দ। নিজের স্বর্গরাজ্যে তো কেউ চোরের মতো ঢুকবে। ঘুমন্ত নিশির দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে দেখে সে শান্ত, অশ্রুপ্লাবিত শীতল নিঃশ্বাসে ডুবে আছে। তারা দু’জনে কিচেনের মেঝেতে মেট্রেস বিছিয়ে একসাথে ঘুমায়। কিছুক্ষণ আগেই রেশমা এলিজাবেথকে রাতের খাবার ও ওষুধ খাইয়ে শুইয়ে দিয়েছিল। এলিজাবেথ যাকে দেখে এখন যেন জীবন্ত মৃত এক মূর্তি মনে হয়। কিছুদিন আগে রিচার্ডের করা অমানবিক ট্রর্চারের পর থেকে একেবারে চুপ হয়ে গেছে। যতটা সম্ভব সুস্থ হতে হয়েছিল কিন্তু সেদিনের পর থেকে এলিজাবেথের মুখে কোনো কথা নেই। রেশমা বুঝতে পারে না কেন এলিজাবেথ হঠাৎ এমন চুপ হয়ে গেছে। কিন্তু অন্তরের গভীর থেকে অনুভব করতে পারে—এলিজাবেথের ভিতরে কোনো এক সত্তার মৃত্যু ঘটেছে। হয়তো আর কোনো শক্তি নেই তার শরীরে, জীবনে বা মননে, যা তাকে পুনরায় জাগিয়ে তুলবে।
‘নিশির ঘুম খুবই গভীর তাই এতো শব্দেও ঘুম ভাঙেনি। বুকে সাহস সঞ্চয় করে উঠল রেশমা। নিঃশব্দে নগ্ন পা ফেলে ডাইনিং এরিয়া থেকে উঁকি দিল রেশমা। সামনে তাকাতেই ভয়ে শিউরে উঠল সর্বাঙ্গ। তিনজন লোক এদিকেই আসছে। অন্ধকারের জন্য অবয়ব অস্পষ্ট হলেও রেশমা বুঝতে পারে এরা রিচার্ডের দলবল নয়। উচ্চতা এবং স্বাস্থ্য কোনোদিন দিয়েই এরা রিচার্ডের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। শুধুমাত্র সামনের জন দেখতে একটু সুস্বাস্থ্যের অধিকারী সেই সাথে পেটানো শরীর। রেশমা শুকনো ঢোক গিলে কিচেনে গেল আবারও। কিচেন কেবিনেটের উপর দাঁড়িয়ে সরু ফাঁকা জায়গা দিয়ে বাইরে তাকাল। সোডিয়াম আলোতে দেখা যাচ্ছে গার্ডরা মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ে আছে নিস্তেজ। এবার ভয়ে শরীর কাঁপতে থাকে রেশমার। কাঁপছে চোখের পাতা! তাকাল ঘুমন্ত নিশির দিকে। যে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে, দিনদুনিয়ার কোনো খবর নেই।
‘রেশমা ঠোঁট গোল করে পরপর তিনবার নিশ্বাস ছাড়ে। গুটি গুটি পায়ে নিশির কাছে গিয়ে কম্বল দিয়ে আপাদমস্তক ঢেকে দেয়। নিজের মাথার বালিশটাও নিশির কানের উপর রাখে যেন শব্দ কর্ণপাত না হয়। রেশমা আবার ছুটে যায় ডাইনিং এরিয়ায়। ওরা ইতিমধ্যে লিভিং এরিয়ায় চলে এসেছে। ভয়ে, সংকীর্ণে শরীর থেকে নির্গত শীতল ঘামে জামা শরীরের সাথে অষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যায়। রেশমা শব্দ ছাড়া কয়েকটি চেয়ার বহু কষ্টে টেনে নিয়ে ঘুমন্ত নিশির সামনে সাজায়, যাতে বোঝা না যায় এখানে কেউ শুয়ে আছে।
‘এবার এলিজাবেথ! এলিজাবেথের কথা ভাবতেই বুকে মোচড় দিয়ে ওঠে রেশমার। যে করেই হোক এলিজাবেথকে বাঁচাতে হবে। যারা এসেছে তারা নিশ্চয়ই ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে আসেনি। শত শত মানুষের রক্ত ঝড়ছে রিচার্ডের হাতে, শত্রুর অভাব নেই তার। তাদেরই কেউ হয়তো রিচার্ডের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে আক্রমণ করতে এসেছে। তিন ছায়ামূর্তি মানব যতই এগিয়ে আসছে, ততই রেশমার কপালের মধ্যভাগে ভাঁজ আরও গভীর হয়ে সংকুচিত হচ্ছে।
‘নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে বোঝার চেষ্টা করল রেশমা। আর একটু কাছে আসতেই বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে যায়, দু’হাতে মুখ চেপে ধরল। সামনের লোকটির কৃষ্ণগহ্বরের মতো গভীর চোখে তাকাতেই চিনে ফেলল। বহুবার টিভিতে দেখেছে তাকে। কিন্তু এতো মহৎ একজন মানুষের রাতের আঁধারে গ্যাংস্টারের বাসভবনে আসার কারণ কিছুতেই বুঝতে পারে না রেশমা। যখন দেখে তিনজন কোনো দিকে না তাকিয়ে সরাসরি সিঁড়ির দিকে পা বাড়ায় তখন রেশমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তীব্র সংকেত দেয়—ওরা এলিজাবেথের জন্যই এসেছে। ওরা নিশ্চয়ই আগে থেকেই জানে আজ রিচার্ড বা তার কোনো বডিগার্ড বাড়িতে নেই।
আর চুপ থাকতে পারল না রেশমা। নিজের জীবনের কথা একবারও না ভেবে, কিচেন থেকে সবজি কাটার ছু’রি নিয়ে দৌঁড়ে ছুটে যায় ওদের পেছন পেছন।
“দাঁড়ান। ”
‘রেশমার বজ্রকণ্ঠে বলা কথায় কারও মধ্যে তেমন কোনো ভ্রুক্ষেপের ছাপ দেখা গেল না। মানবটি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে সবিনয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। তার পিছু পিছু বাকি দু’জনও থেমে যাওয়া পায়ের গতি বাড়িয়ে এগিয়ে যায়। রেশমার গলা কাঁপছিল ভেতর থেকে, তবুও পরোয়া করে না। বুক ঠুকে চেঁচিয়ে ওঠে,
“আপনাদের উদ্দেশ্য কী? কেন এসেছেন এখানে?”
‘থামে না কেউ। রেশমা ছুটে পিছু পিছু উঠতে থাকে তাদের। আগুন বর্জন করল কথায়, চোখে জ্বলছে ক্রোধের অগ্নি,
“আপনাকে তো আমরা ভালো মানুষ জানতাম। রাতের আঁধারে এটাই বুঝি আপনার আসল রূপ?”
‘অতর্কিত আক্রমণে হতচকিয়ে যায় রেশমা। দু’জনের একজন ঝাঁপিয়ে পড়ে তার কণ্ঠনালি শক্ত হাতে চেপে ধরে। রেশমার হাত থেকে ছু’রিটা ঝনঝন শব্দে সিঁড়িতে পড়ে যায়। রেশমার দুই চোখ উত্তল হয়ে উঠল। শ্রাবণের বৃষ্টিধারার মতো অশ্রু গড়িয়ে পড়ে কার্নিশ বেয়ে। দম বন্ধ হয়ে আসে! বুকের ভেতর হাহাকার জমে ওঠে। তবুও ভাঙা গলায়, ফুসফুসের শেষ শক্তি দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে। এলিজাবেথের রুমের দিকে এগিয়ে যাওয়া লোকটাকে ডাকতে থাকে।
“আ আল্লাহর দোহাই লাগে এমন নিষ্ঠুর হবেন না।”
‘গলায় চেপে রাখা হাতের দৃঢ়তা আরও বাড়তে থাকে। রেশমার বুকের ভিতর সব কিছু শুকিয়ে যায়। সামনে থাকা মানুষটি যেন এক ক্ষুধার্ত হিংস্র দানব। বজ্রপাতের মতো গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “মরার খুব শখ হয়েছে নাহ?”
‘রেশমা অস্পষ্ট স্বরে বিলম্বহীন জবাব দেয়, “আমার মেয়ের কাছে যেতে হলে আমাকে মেরে যেতে হবে।”
‘বাঁকা হাসি দিয়ে লোকটা তার চিবুকে রহস্যময় হাসি ছড়িয়ে দিল। জ্যাকেটের ভিতর থেকে ছোট সাইজের স্টিলের কারামভিটের ছু’রি বের করে সোজা ঢুকিয়ে দিল রেশমার পেটে! একদম যেন পাকস্থলীকে খুবলে নিয়ে বেরুলো ছু’রি’টা। রেশমার মুখ দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে। ফিন্টি দিয়ে ছিটকে আসা তাজা উষ্ণ রক্তগুলো গিয়ে পড়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটির মুখে। লোকটি চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলল। নৃশংস দৃশ্য দেখে ভিতরে ভিতরে কেঁপে উঠলেও নিজেকে যতটা সম্ভব শক্ত রাখল। বোঝাই যাচ্ছে এ-সব কাজের জন্য সে মোটেও দৃঢ় নয়। শরীরের স্নায়ুকোষগুলো অকেজো হতে থাকে ধীরে ধীরে, রক্তচলাচলের গতি কমে আসে। রেশমার চোখের সামনে সব ঘোলাটে হয়ে উঠতে থাকে। তবে শরীরের ব্যথা থেকে বেশি ছটফট করছে এলিজাবেথের কথা ভেবে। রহস্যময় মানুষটার মুখ থেকে দ্বিতীয়বারের মতো শব্দ বের হয়। নিরুদ্বেগভাবে বলল,
“তো মর।”
‘তৎক্ষণাৎ গলায় চেপে রাখা হাত আলগা করে দিলে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে নিচে পড়তে থাকে রেশমা। নিশি দু’হাতে মুখ চেপে ধরল। কিছুক্ষণ আগেই তার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। আড়াল থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে সেই লোমহর্ষক দৃশ্যও সে দেখেছিল। ডুকরে কেঁদে উঠল, তবুও আগানোর সাহস পেল না। অসহায়, কাতর চোখে তাকিয়ে থাকল রেশমার নিথর দেহে। কপাল ফেটে রক্ত মেঝেতে আল্পনার মতো বিছিয়ে যাচ্ছে। অকুতোভয়ী হৃদয় তখনও মৃত্যুর ব্যথা ভুলে উপরে তাকিয়ে ছিল। প্রতিটি মায়ের কাছে তার সন্তানই সবকিছু, হোক না তা অন্যের। মাতৃ মন গেয়ে উঠে সন্তানের সমবয়সী কাউকে দেখলেই। নিজের জীবনের কথা না ভেবে শেষ পর্যন্ত লড়েও রেশমা পারল না এলিজাবেথের জীবন বাঁচাতে। চোখে ব্যর্থতার নিশানার ছাপ। সহসাই চোখ বুজে এলো রেশমার।
‘কিছু পরার শব্দে ঘুম থেকে দরফরিয়ে উঠে এলিজাবেথ। দুদিন ধরে স্লিপিং পিলস নিচ্ছে এলিজাবেথ । পরাজিত জীবনে আবারো হেরে গেল সে চরমভাবে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে অনুভব হচ্ছিল ঘুমের মধ্যে কেউ তার উপর ঝুঁকে আছে, একগুঁয়ে দৃষ্টিতে তাকিয়ে। কারোর গরম নিশ্বাস আঁচড়ে পড়ছিল মুখের উপর। গলা শুকিয়ে আসে এলিজাবেথের। ঢোক গিলে বেডসাইড ঝুঁকে পানির গ্লাসটা নিতে গেলে আকস্মিকভাবে ঘাড়ের পিছন থেকে একটি শক্ত হাত এসে রুমাল দিয়ে মুখ চেপে ধরল। আবারো ঘুমের জগতে তলিয়ে গেল এলিজাবেথ কিছু বুঝে ওঠার আগেই। বুঝতেও পারল না সব হারিয়ে পাওয়া নতুন কোলও হারিয়ে ফেলল চিরকাল জন্য। মম, ড্যাডের মতো রেশমা মা-ও তাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গিয়েছে।
সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত সেই মানবটি এলিজাবেথের ধনুকের মতো বাঁকানো শরীর কোলে তুলে নিল। ঠোঁটের কোণে বিজয়ের হাসি। এগোতে থাকল দরজার দিকে।
‘সাজানো পরিবেশ বিধ্বস্ত হয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। লিভিং এরিয়ার কোন কিছুই আর আস্ত নেই। ভাঙা কাঁচের গ্লাসের টুকরো গুলো গড়াগড়ি খাচ্ছে লাল রক্তে। ন্যাসো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে! মুখ চুপসে রয়েছে। সেও যথেষ্ট পরিমাণ তটস্থ। মেঝেতে সারি সারি গার্ডের লাশ পড়ে রয়েছে শীতের প্রথম প্রবাতে কুয়াশায় ভেজা মৃত্তিকায় যেমন শিউলি ফুল বিছিয়ে থাকে ঠিক তেমনি। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে রক্তের বন্যা বয়ে গেছে রিচার্ডের লাক্কুরিয়াস ডার্ক থ্রিমের লিভিং এরিয়ায়। রেশমার লাশের উপর সফেদ সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। নিশি রেশমার
‘রিচার্ডের সমুদ্র নীল চোখ দুটি আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের মতো প্রকম্পিত হচ্ছে। ক্ষুধিত হিংস্রতার মতো গর্জন শোনা যাচ্ছে শুধু। শূন্য দৃষ্টিতে জমে থাকা ক্রোধের পাহাড় যেন এক দানবীয় শক্তি হয়ে ফুঁসে উঠছে। অতি ফর্সা শরীরের মধ্যে আগ্নেয়গিরির লাল লাবার মতো এক বিভৎসতা। রিচার্ডের মস্তিষ্ক, একেবারে থমকে গিয়ে, তার চিরাচরিত পৈশাচিক আত্মার কাছে নত হয়ে গিয়েছে। ক্রোধে মটমট করছে! ধারালো চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে! ধুরা সাপের মতো চোখের আগুন ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। উত্তেজিত ভাবে ছটফট করছে শুধু। পায়চারি করছে রক্তের উপর দিয়ে অনবরত।
‘আবারও হিংস্র হয়ে উঠল। অবশিষ্ট দু’জন গার্ডের মস্তক বরাবর গুলি করে খুলি উড়িয়ে দিল। ওদের হাত পা বেঁধে, হাঁটু ভেঙে বসিয়ে রাখা হয়েছিল। মুখগুলো উদ্বিগ্নতায় পূর্ণ ছিল। অতঃপর রক্তশূণ্য হয়ে ধ্বংসের মাঝে হারিয়ে ঢলে পড়ল রক্তের স্রোতে। পাপাচারে নিবিষ্ট এক অন্তহীন মরিচীকা থেকে মুক্তি নিয়ে তারা চিরতরে বিদায় নিল। শুকনো ঢোক গিলতে গিলতে ন্যাসো এগিয়ে আসে। নতজানু হয়ে বলল
“বস হেলিকপ্টার থেকে ক্লোরোফর্ম ছাড়া হয়েছিল তাই গার্ড’রা কিছু বুঝে উঠার আগেই,,,
‘রিচার্ডের আগুনের মতো জ্বলন্ত চোখ দুটি দেখে ন্যাসো বুকের মধ্যে এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করল। পিছিয়ে আসলো সে। রিচার্ডের চোখের গহ্বরের চারপাশে থাকা নীল রগগুলো হঠাৎ উত্তেজনায় টান টান হয়ে উঠেছে। যেন কোনো আগ্নেয়গিরির লাভার মতো, এক ভয়ংকর শক্তির প্রতীক। রিচার্ডের মধ্যে উগ্রতা গড়ে ওঠে! তার হিংস্রতা যেন এক ক্ষুধার্ত পশুর মতো প্রবল হয়ে ওঠে। দাঁতগুলো একে অপরকে শক্তভাবে চেপে ধরে গর্জন করতে করতে বলল,
“আই ওয়ান্ট দ্যাট মা’দার’ফা’কার ইন মাই বেজমেন্ট।”
‘ন্যাসো রিচার্ডের চোখের আগুনে পুড়ে গিয়ে, সস্ত্রীক দুই পাশে মাথা নাড়িয়ে যায় চুপচাপ। কিছু বলতে সাহস পেল না। রিচার্ডের ক্রোধ বাড়তেই থাকে। পায়ের রক্ত তিরতির করে মাথায় উঠে যেতে থাকল। হিংস্র, পৈশাচিক মস্তিষ্কের সঙ্গে রেলগাড়ির মতো চেইন টেনে, একের পর এক ক্রোধ চিৎকার করতে করতে ছুটে চলছে। রিচার্ড আবারও পায়ের নিচে পিষে রাখা সাদা কাগজের উপর পা সরিয়ে পূনরায় তাকাল লেখাটার দিকে,
“If you’re a gangster,
then I’m the predator,
taking my prey.”
ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৯
“এলোকেশী !”
‘অতিপরিচিত মধুমিশ্রিত মাতাল স্বরে স্তম্ভিত ফিরে পায় এলিজাবেথ। দরজার সামনে খাবারের ট্রে হাতে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণগহ্বরের ন্যায় অবয়বে তাকাতেই চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল এলিজাবেথের। খেলে গেল ঠৌঁটের কোণে প্রশান্তিময় হাসির অস্পষ্ট ঝলকানি। চোখ ভিজে এলো, কেঁপে উঠল ওষ্ঠদ্বয়। ছুটে গিয়ে হামলে পড়ল পুরুষালি বৃক্ষপটে। অঝোরে কাঁদতে থাকে।