ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ১১
মিথুবুড়ি
“এই মেয়ে চোখ নামাও। নামাও বলছি।”
‘তবুও চোখ নামায় না ইবরাত,না চোখের পাতা ফেলে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ন্যাসোর দিকে। চার দিনের অনাহারে গালের মাংস চুপসে চামড়ার সাথে মিশে গেলেও চোখেমুখে নেই কোনো ক্লান্তির ছাপ। নিমেষহীন দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকল মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় এক দৃষ্টিতে। ন্যাসো পানির বোতলের মুখ লাগিয়ে উঠতে উদ্যত হলে হতচেতন হয়ে ফিরে ইতরাত। খৈ হারিয়ে তড়িঘড়ি করে ব্যগ্র কণ্ঠে বলল,”আপনি অসম্ভব সুন্দর। আমার দেখা সবথেকে সুন্দর মহাপুরুষ আপনি।”
‘কণ্ঠে ছিল জানপ্রাণ উজার করে দেওয়া মোহ, নিখুঁত আত্মসমর্পণের নীরব ভাষা। ন্যাসো পানির বোতলে কর্ক লাগিয়ে স্যাতস্যাতে মেঝেতে রাখল, তারপর এক হাঁটু গেঁড়ে বসল ইবরাতের মুখোমুখি—হাত-পা বাঁধা, রক্তাক্ত। ওর মুখ একদম স্বচ্ছ, গভীর জলের আয়নার মতো। যা লেখা, তা যে-কেউ পড়তে পারবে। উপর থেকে সাদাসিধে দেখালেও, ভেতরে জটিলতার পাহাড় অসীম, ভয়ংকর। ন্যাসোর অভিব্যক্তিতে রাগ নেই, দুঃখ নেই, হাসিও নেই। সবসময় একটাই রঙ—নিরেট ঠান্ডা। এই দৈত্যাকৃতির মানুষটা একাই দশজনকে মাটিতে মিশিয়ে দিতে পারে। তার শীতল বুদ্ধিমত্তার কাছে পরাজিত হয়েছে অনেক দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। তাই তো রিচার্ড তাকে নিজের ডান হাত বানিয়েছে। এতটা পথ পেরিয়ে এসেছে ন্যাসো, অথচ এই কঠিন খোলসের বাইরে এখন আর বেরোতে পারে না। ওর কণ্ঠে নেই কোনো উত্তাপ, নেই অযাচিত ক্ষুব্ধতা। কেবল বরফশীতল স্বরে বলল, “আমার হাতে কাটা মানুষের মাংসের সাইজগুলোও দারুণ নিখুঁত হয়।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘ঠান্ডা কণ্ঠের বাক্য হলেও তাতে ছিল এক নিজস্ব ওজন। এই গভীর, শ্বাসরুদ্ধকর, শব্দ ছিল ইবরাতের ধারণক্ষমতার অনেক বাইরে। ভিতরে ভিতরে ভয় জমলেও মুহূর্তের উৎকণ্ঠা কাটিয়ে তাকাল ন্যাসোর সুগভীর, নিকষ বাদামি আঁখিতে। ইবরাতের উচ্চতা ন্যাসোর বিশাল কাঠামোর নিচে পড়ে, বাধ্য হয়েই ঘাড় উঁচিয়ে দেখতে হয় ওকে। এতক্ষণ তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘাড়ে ব্যথা ধরে গেল, কিন্তু হৃদস্পন্দন যেখানে থমকে আছে, সেখানে ব্যথার আর কীই-বা মূল্য? বেহায়া মন, নিস্প্রভ দ্বিধাহীন দৃষ্টি সব কিছুই অপরাধীর মতো ন্যাসোর ওপর আটকে রইল।
“তবুও আপনি মহাপুরুষ আমার কাছে।”
‘এতক্ষণে ন্যাসোর অভিব্যক্তিতে সামান্য পরিবর্তন দেখা গেল। একপাশে ঠোঁট বাঁকিয়ে ঠান্ডা হাসল সে। ইবরাতের কান বরাবর শক্ত, পুরুষালি হাত রাখল দেয়ালে, সামান্য ঝুঁকে এলো ওর দিকে। ন্যাসোর গাঢ়, উষ্ণ নিশ্বাস ইবরাতের মুখ ছুঁয়ে যাচ্ছে। শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল একটা স্রোত নেমে গেল। বুকের ভেতর কেমন যেন চাপ ধরে আসছে। হঠাৎ লজ্জায় সংবিৎ ফিরে পেল ইবরাত, বেহায়া দৃষ্টি এবার নত করল। কিন্তু সেই দুর্দমনীয় মন কি এত সহজে হার মানে? এত কাছাকাছি থাকা, এত উত্তপ্ত উপস্থিতি,আলিঙ্গনের সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়? না কখনোই না। শিরশিরে অনুভূতিতে আবারও নিভু চোখে চাইলো ন্যাসোর চওড়া, তামাটে শরীরের দিকে। তবে ন্যাসো সেই দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করল। কাঠকাঠ গলায় শুধোল,
“Wanna die?”
‘ইবরাতের জবাব আসতে দেরি হলো না,”I just wanna be yours.”
‘এইবার ন্যাসোর কপালে একরাশ ভাঁজ পড়ল। ইবরাত থেকে খানিকটা সরে দাঁড়িয়ে শীর্ণ স্বরে বলল,”খুব পাকা পাকা কথা বলছ। চারদিন না খেয়েও একফোঁটা এনার্জি কমেনি দেখি। পানি দেওয়াও বন্ধ করে দিতে হবে এবার।”
‘হঠাৎ বিষণ্নতায় চুপসে গেল ইবরাতের তনুমন। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল পাশের ছোট লোহার খাঁচার দিকে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে, যেন কোনো অন্ধকার ঘরে ইঁদুর ধরার ফাঁদ পাতা হয়েছে,আর ভুলক্রমে সেখানে আটকা পড়েছে এক মধ্যবয়সী নারী। চারদিনের অনাহারে সবিতা বেগমের শরীর নিস্তেজ হয়ে এসেছে। ছোট্ট খাঁচার চারপাশে আবার তারকাঁটার বেড়া, নড়াচড়া তো দূরের কথা, উঠে বসারও উপায় নেই। নিস্তেজ শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে আছেন তিনি, যেন কোনো ক্লান্ত, বিধ্বস্ত পাখি। ইবরাত মায়ের দিকে তাকাতেই বুকের ভেতর মোচড় অনুভব করল। সমস্ত মুগ্ধতা, সমস্ত ভালো লাগা নিমেষে মুছে গিয়ে চোখে শ্রাবণমেঘের ধারা বইতে শুরু করল। কণ্ঠ বুজে এলো কান্নায়, ফ্যাসফ্যাসে স্বরে বলল,
“দয়া করে আমার মা’কে কিছু খেতে দিন। এভাবে শুধু পানি খেয়ে বাঁচা যায় না।”
‘ব্যথাতুর কণ্ঠের গুরুতর অনুরোধও হাসতে হাসতে উড়িয়ে দিল ন্যাসো। ঠোঁট কামড়ে, ভ্রু কুঁচকে বলল,
“তুমি বাঁচবে কী করে?”
‘ইবরাত চোখের জল মুছে দৃঢ় কণ্ঠে জবাব দিল,
“আপনাকে পাওয়ার জন্য হলেও আমাকে বাঁচতে হবে।”
‘ইবরাতের তাৎক্ষণিক, বিলম্বহীন জবাবে এবার সম্পূর্ণ দৃষ্টি ওর ওপর দিল ন্যাসো। এলিজাবেথের মতো অপার সৌন্দর্য না থাকলেও, ইবরাতের মধ্যে একধরনের মায়া আছে অপরিসীম, গভীর, বাঁধনহীন। উজ্জ্বল শ্যামলা চেহারায় চারদিনের অনাহারের ছাপ স্পষ্ট, পুষ্টিহীনতায় ক্লান্ত। হরিণের মতো টানা চোখজোড়ার নিচে অবাধ্য কালো দাগ জায়গা দখল করেছে, অথচ সেই শ্যামলা মুখশ্রীর বিপরীতে গাঢ় গোলাপি ঠোঁটজোড়া যেন ডোবায় ফোটা দুটি পদ্মফুল। স্নিগ্ধ, আর সেই স্নিগ্ধতায় মোড়া গোটা অবয়ব।তবে ন্যাসো সেই স্নিগ্ধতার বিপরীতে চিবুক শক্ত করল। দৃষ্টি কঠোর, গলা ঠান্ডা। চিবিয়ে চিবিয়ে ইটালিয়ান অ্যাকসেন্টে বলল,
“খুব কষ্ট হচ্ছে মায়ের জন্য না? যখন অন্য একটা মায়ের সন্তানকে দিনের পর দিন না খাইয়ে রেখেছিলে তখন কেমন লাগত? খুব ভালো লাগত তাই না? এখন লাগছে না কেন? মেঝে খুব ঠান্ডা, অন্ধকারে থাকতে ভয় লাগছে? তখন সেই এতিম মেয়েটার কেমন লেগেছিল একবারও ভেবেছিলে? তোমার বয়সী একটা মেয়ে যখন ‘ব্যাড টাচ’-এর শিকার হতো নিজের কাছেও কি একটুও ইনসিকিউর ফিল হতো না? সাত হাতের একটা ঘরের মধ্যে দিনের পর দিন যখন ওকে আটকে রেখেছিলে, তখন এত খারাপ লাগা কোথায় ছিল? ডু ইউ থিংকস পিপল আর ফাকিং ফুল?”
‘ন্যাসোর শেষের কথাগুলো ছিল ঝাঁঝালো, কর্কশতায় ভরা। ইবরাতের সমস্ত কায়া কেঁপে উঠল। ন্যাসো আগুন বর্ষণ করল কথায়, আর চোখে জ্বলল ক্রোধের অগ্নি। উপরের ও নিচের মাংসপিণ্ডের ওজনে ওর চোখের গোলমনি ছোট মাছের চোখের মতো দেখাচ্ছে সঙ্কুচিত তবে প্রাণবন্ত। যেন পর্বতমালায় মেঘহীন সাদা আকাশের নিচে কাটা কাটা গাছের ফাঁক গলে বেরিয়ে আসা পাহাড়ের গোল টিলা,বাদামি রঙের ছোট চোখজোড়া। তবে এই বাদামি চোখে এখন দাউ দাউ আগুনের শিখা। ইবরাত হেসে ফেলল চোখে পানি সমেত। ভাঙা কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল,
“তখন আমার জীবনে কেন আসলেন না? আরো কিছু বছর আগে দক্ষিণের দমকা হাওয়ার মতো আপনার আগমন হলো না কেন?”
‘ছোট ছোট চোখ আরো ছোট হলো ইবরাতের কথায়। ন্যাসো তেরছা নজরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“মানে?”
‘একই স্বরে প্রত্যুত্তর করল ইবরাত,”তাহলে হয়তো আমি অনেক আগেই মায়ের শেখানো বুলি থেকে বেরিয়ে নিজের মন দিয়ে কথা বলতে পারতাম। চোখের সামনে থেকে রঙিন পর্দা সরিয়ে দুনিয়ার আসল বাস্তবতা বুঝতে পারতাম। এই যেমন এখন বলছি মন থেকে যা আসছে, তাই বলছি। কানের পাশে কোনো কুপরামর্শদাতা নেই। তাহলে হয়তো আমার পাপের ওজন একটু হলেও হালকা হতো। বিশ্বাস করুন আমি সত্যিই অনুতপ্ত আমার কাজের জন্য। প্রেমে পড়ে আমি বুঝেছি কষ্ট কী জিনিস। খুব সুখে থেকে আমি কখনো এলিজাবেথের কষ্ট অনুধাবন করতে পারিনি।”
‘একটু থেমে ইবরাত চোখ নামাল, কণ্ঠে অভিমান মেশানো স্বীকারোক্তি,”সেদিন আপনাকে প্রথম দেখায় এক বুক ভালোলাগায় ছেয়ে গিয়েছিল মন। বুকের ভেতর দ্রিম দ্রিম শব্দ থামছিল না। সেই কঠিন মুহূর্তেও আমি ছিলাম এক অন্য জগতে, সুখের দোলায় দুলছিল মন। কিন্তু যখন আপনি চলে গেলেন তখন বুঝলাম আমার শূন্য শূন্য লাগছে। সেদিন থেকে আমি প্রথমবারের মতো এলিজাবেথের কষ্ট বুঝতে শুরু করি অনুভব করতে শিখি হারানোর যন্ত্রণা। আমি আম্মুকেও অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছি। বিশ্বাস করুন আমি আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই। আমাকে দয়া করে সাহায্য করুন। আপনাদের বসকে খুঁজতে অনেক চেষ্টা করেছি আমি আর বাবা, কিন্তু কোথাও পাইনি। প্লিজ বলুন না এলিজাবেথ কোথায় আছে? কেমন আছে?”
‘অনুশোচনায় জর্জরিত কথাগুলো উপেক্ষা করে উঠে দাঁড়াল ন্যাসো। চলে যাওয়া জন্য উদ্যত হয়। তখনই পিছন থেকে ইবরাতের অদ্ভুত যত্তসব প্রেমগীতি তেড়ে আসলো। তবুও থামে না ন্যাসো, এগোতে থাকে।
“ভালোবাসি আমি আপনাকে। সারাজীবন এভাবেই বন্দী করে রাখুন আর যেভাবেই রাখুন, আপনার কাছেই রাখুন। আমরা বাঙালি মেয়েরা মরলেও ভালোবাসার মানুষের কোলে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতে চাই।”
‘এতেই থামে না ইবরাত। নিস্তেজ স্বরে অনড়ভাবে বলতে থাকে,”ভালোবাসা পায়ে ঠেলার জিনিস না। বুকে পুঁষে আগলে রাখতে হয়। নয়তো নষ্ট হয়ে যায়।”
“আপত্তি নেই।”
‘পায়ের গতি নিটল রেখেই বলল ন্যাসো গুরুগম্ভীর গলায়। চিলতে হাসল ইবরাত।এবার মৃদু চেঁচাল দূর্বল গলায়,”ধ্বংস হতে চাই আপনার প্রেমে।”
‘ন্যাসো থামল। একপাশে ঘাড় বাঁকাল, তবে পিছন ফিরে তাকাল না। অদৃশ্য দূরত্ব বজায় রেখে রুষ্ট কণ্ঠে বলল,
“এই প্রেমে বিধ্বস্ততা ছাড়া কিছুই নেই। ধ্বংস তো তুমি হবেই, মেয়ে।”
‘ইবরাত কিছু বলার সুযোগ পাওয়ার আগেই লম্বা লম্বা পদক্ষেপে বেজমেন্ট ছাড়ল ন্যাসো। কালো পোশাকধারী দু’জন গার্ডের সামনে এসে শক্ত কণ্ঠে নির্দেশ দিল,
“আজ থেকে পানিও যেন না দেওয়া হয় এদের।”
‘গার্ডদের নিশ্চুপ সম্মতি দেখে তপ্ত শ্বাস ফেলল ন্যাসো। পায়ের গতি ধীর করে বাগানবাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল, যেখানে অপেক্ষা করছে রিচার্ডের হিংস্র আচরণ৷ যার সম্মুখীন হওয়ার জন্য নিজেকে নিটোল করে নিতে হবে।
‘ক্লোরোফর্মের প্রতিক্রিয়া কাটতেই পিটপিট করে চোখ খুলতে চেষ্টা করল এলিজাবেথ। চোখের পাতায় যেন কেউ বিশাল আকৃতির পাথর রেখে দিয়েছে৷ অধিক ওজনে টলমল করছে, খুলতে পারছে না চোখ। তুলার মতো নরম বিছানার সাথে ধনুকের মতো বাঁকানো শরীর লেপ্টে আছে, অনুভব করছে সে। আশপাশের শব্দগুলো বলে দিচ্ছে, এখন সে সুস্থ-সবল, আবাসিক কোনো এলাকায় আছে। গাড়ির হর্ন শোনা যাচ্ছে। খুব সম্ভবত কাছেই ব্যস্ত কোনো রাস্তা, যেখানে বিরতিহীনভাবে ছুটে চলেছে যানবাহন, বিভিন্ন গন্তব্যে।
খোলা জানালা দিয়ে আসছে সতেজ বাতাস প্রশান্তিময়, মুক্ত প্রকৃতির গন্ধমাখা। বহুদিন পর সেই বাতাস ছুঁয়ে দিচ্ছে এলিজাবেথের শুষ্কতায় খরিয়ে যাওয়া শরীর। বহু কসরত করে, অবশেষে চোখ খুলতে পারল এলিজাবেথ।
‘চোখের পাতা খুলতেই ফাঁক গলে উন্মুক্ত হলো এলিজাবেথের নিকষ, সুগভীর কালো আঁখিযুগল। তবে সোডিয়াম লাইটের তির্যক আলোতে তা বেশিক্ষণ টিকতে পারল না। আলো চোখে পড়তেই দ্রুত হাতে চোখ ঢেকে ফেলল! কিছুক্ষণ নিয়ে ধাতস্থ হলো।আবারও চোখ মেলে উঠে বসতেই বিস্ময়ে ছানাবড়া হয়ে গেল ওর চোখ। হতভম্ব দৃষ্টিতে পুরো কক্ষ জুড়ে বুলিয়ে নিল নজর অবিশ্বাসে, অবিশ্বাস্যভাবে।
এটাকে স্রেফ একটা রুম বলা ভুল হবে। কেউ খুব ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে আদরের হাতে সাজিয়েছে এই ডিজনি ল্যান্ড। এলিজাবেথের মনে হলো সে কোনো পিংকিস ওয়ার্ল্ডে অবতরণ করেছে।ক্লোজেট থেকে শুরু করে বিছানার বেডশিট, বালিশ, সোফা, পর্দা সবকিছুই পিংক! যেন কোনো ছোট্ট মেয়ের স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। এমন ব্যক্তিগত কক্ষের জন্য কত মেয়ে না স্বপ্ন দেখে! খুব কম সংখ্যক নারীই আছে যারা পিংক অপছন্দ করে।
‘এলিজাবেথের চোখে এখনো বিস্ময়ের ছায়া। মনে হচ্ছে সে এখনও স্বপ্নের মধ্যে ঘুরছে। স্যাতস্যাতে রান্নাঘরের শক্ত মেঝে আর রিচার্ডের ভয়ংকর ডার্ক থিমের ঘর থেকে এই সাজানো রুমে এসে সে নিজেকে মানতে পারছে না। কখনো বাচ্চাদের একটা কমন ট্রিক কাজ দেয়—এমনই কিছু মনে করেই এলিজাবেথ নিজেকে ঘোর থেকে বের করার চেষ্টা করল। জিভ দিয়ে ওষ্ঠ ভিজিয়ে হাতে চিমটি কাটল একটু জোরে। নখের দাগ বসে লাল হয়ে গেল পাতলা চামড়ায়। ব্যথায় চোখমুখ কুঁচকে ফেলে এলিজাবেথ।ঠোঁট কামড়ে দম আঁটকে কাঁপা কাঁপা চোখের পাতা আবার মেলে। এবার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম মনে হল না, এটা সত্যি, বাস্তব।
‘বেডসাইডের দিকে তাকাতেই চোখ বড় বড় হয়ে যায়। দিন দুনিয়ার কুল-কিনারা হীন হয়ে হাসতে থাকে খিলখিল করে। হাতের বাঁধনের থেকেও বড় সাইজের দুটি ডোরেমন সযত্নে ধরতে গিয়েও ব্যর্থ হয়। এতক্ষণ বিস্ময়ের কারণে ডোরেমন দুটোকে খেয়ালই করেনি এলিজাবেথ। নারীসুলভ আচরণে আত্মসমর্পণ করে আবেগী হয়ে ওঠে এলিজাবেথ ছোটবেলার কথা মনে করে। একসময় তার বাবা নিজ হাতে তার রুমটিও এভাবে সাজিয়েছিল তাদের ছোট কুঠির মধ্যে। ওর জন্য একটি ছোট রাজপ্রাসাদ তৈরি করেছিল। সেখানে ছিল না কোনো কমতি, শুধুই মায়া, ভালোবাসা, এবং যত্ন।
“এলোকেশী৷”
‘অতিপরিচিত মধুমিশ্রিত মাতাল স্বরে স্তম্বিত ফিরে পায় এলিজাবেথ। দরজার সামনে খাবারের ট্রে হাতে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণগহ্বরে তাকাতেই চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল ওর। ঠৌঁটের কোণে প্রশান্তিময় হাসির অস্পষ্ট ঝলকানি। চোখ ভিজে এল। ছুটে গিয়ে হামলে পড়ল পুরুষালি বৃক্ষপটে। অঝোরে কাঁদতে থাকে। পুরুষটা রুক্ষ,শক্তপোক্ত খসখসে হাতটা রাখল এলিজাবেথের মাথায়। কিছুটা সময় দেয় এলিজাবেথ কে নিজেকে সামলে নেওয়ার জন্য।
‘দুর্বোধ্য মেয়েটি, দীর্ঘ সময় পর প্রিয় মানুষের ছায়ায় আশ্রয় পেয়ে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। কান্না থামে না ওর বরং ক্রমশ বাড়তে থাকে প্রতিটি মুহূর্তে। বৃক্ষপটের মালিকও যেন এ দৃশ্য থেকে এক অদ্ভুত তৃপ্তি পাচ্ছে! আটকে রাখতে চায় না নিজেকে। যুগান্তরের পর প্রিয় ছায়াটি কাছে পাওয়া, তা-ও আবার এতো নিভৃতে। এক আশ্চর্য শান্তিতে ভরে তোলে বুক। মরুভূমির খরখর বুকে এক ঝিলিক বৃষ্টি যেন ফোঁটা ফোঁটায় ছড়িয়ে যাচ্ছে। একে অপরকে হারিয়ে ভুলে গেছে নিচে টুকরো কাচের খণ্ডাংশ৷
‘কিন্তু আর পারল কোথায়? এতক্ষণ আড়ালে দাঁড়িয়ে আড়ম্বরে ঘুমিয়ে থাকা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে হৃদয় যতটা প্রশান্তি পেয়েছিল এখন ঠিক তার থেকেও বেশি যন্ত্রণাদায়ক লাগছে সেই কান্না। আড়ষ্ট মেয়েটির কান্নার তীব্রতায় কেঁপে ওঠা প্রতিটি ঝাঁকুনি বুকের পাঁজরে হাতুড়ির আঘাতের চেয়েও গভীর। হৃদয়গহ্বরে যেন এক ঝড় উঠে। লোকটা অস্থির হয়ে ওঠে এলিজাবেথের কান্না থামানোর জন্য।
“এলোকেশী। এই এলোকেশী। এভাবে কাঁদে না, পাখি গলা বসে যাবে তো?”
‘কান্না থামায় না এলিজাবেথ। এই শ্রাবণের বাঁধ আজ এতো সহজে থামবে না। ছটফট করতে থাকা মানবটি উপায়ন্তর না পেয়ে দুহাতের আজলায় চেপে ধরল এলিজাবেথের ভেজা দু’টি গাল। কেঁদে কেঁদে চোখমুখ লাল হয়ে গিয়েছে, কাঁপা কাঁপা চোখের পাতা মিলে তাকাল এলিজাবেথ। দুটো খাদযুক্ত দৃষ্টি একত্রিত হতেই মানবটির বুকে হিম শীতল হাওয়ায় ছেয়ে গেল। ঠোঁট গহ্বরের ফাঁক গলিয়ে বের হলো প্রশান্তিময় নিশ্বাস। কণ্ঠস্বর খাদে নেমে যায় এলিজাবেথের কান্নায়। অস্পষ্ট স্বরে আওড়ায়,
“আমি আবারও হেরে গেলাম ভালো মানুষ। যে সই, তাকেই কেন সারা জীবন সইতে হয়। বেঁচে থাকার শেষ আশাটুকু হারিয়ে ফেললাম আমি।”
“তোমার কিছু হয়নি এলোকেশী এভাবে বলবে না প্লিজ।”
‘মানে না অচেতন মন। পাগলের মতো কাঁদতে থাকে এলিজাবেথ। কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে পড়ল। মানবটিও হাঁটু ভেঙে বসল এলিজাবেথের সামনে। অনুভব করল মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে তার রাজ্যে আগমন করা এই লাস্যময়ী নারীর কান্নাগুলো যেন বিঁধছে তার বৃক্ষপটে, যা মৃত্যু যন্ত্রণা সমতূল্য। জমে থাকা সকল কষ্ট আজ উষ্ণতার চাদরে আবদ্ধ হয়ে মোমের মতো গলে ভিতরে তাণ্ডবীয় ঝড় তুলে দেয়। উন্মাদের মতো নিজের চুল টানতে থাকে এলিজাবেথ। মানবটি ঘাবড়ে গিয়ে আবারও বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে এলিজাবেথকে। ছোটার জন্য মোচড়ামুচড়ি করতে থাকে এলিজাবেথ, বুকের মধ্যে এলোপাতাড়ি কিল-ঘুষি দিয়ে যাচ্ছে। তাও ছাড়ে না মানবটি। অনড়ভাবে বুকের সাথে চেপে রেখে স্বাচ্ছন্দ্যে সব ব্যথায় সহ্য করে নিচ্ছে। কান্নার বেগের সাথে তিরতির করে কাঁপতে থাকে এলিজাবেথের শরীর।
“আপনি আরো আগে কেন আসলেন না ভালো মানুষ? কেন আসলেন না বলুল না।”
“শান্ত হও এলোকেশী। আমাকে ক্ষমা করে দাও আমি সেই সময় দেশে ছিলাম না। থাকলে এমনটা কখনোই হতে দিতাম না বিশ্বাস কর। নিজেকে শক্ত কর। আঘাতপ্রাপ্ত মানুষ একদিন সব ভুলে গেলেও রব ভুলেন না। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির প্রতিটা আর্তনাদ, প্রতিটি শব্দ, অডিও, ভিডিও, রেকর্ডিং সব কিছুই উপরওয়ালার কাছে মওজুদ আছে। প্রতিশোধ যদি বান্দা নিতো,তাহলে অর্ধেক ভালো ছিল। কিন্তু শাস্তি যখন রব নিবেন নিশ্চয়ই তার জগত অতন্ত্য কঠিন হবে। নিশ্চয়ই আমাদের রব সরিষার পরিমাণ জিনিস ভুলে না।”
‘হঠাৎ এলিজাবেথ শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে ধাক্কা মারল মানবটিকে। অতর্কিত ধাক্কায় বেগ পোহাতে না পেরে উল্টে পড়ে যেতে নিলেও সামলিয়ে নিল নিজেকে এক হাতের তালু দিয়ে মেঝেতে ভর দিয়ে। এলিজাবেথের হাত গিয়ে ছিটকে পড়ল ভাঙা কাঁচের টুকরোর উপর। তৎক্ষনাৎ পাতলা চামড়া ভেদ করে একদম ভিতরে ঢুকে যায় কাঁচ, গলগলিয়ে র’ক্ত বের হতে থাকে। এলিজাবেথ হাতের মাংসে বিঁধে থাকা রক্তাক্ত কাঁচের দিকে তাকিয়ে আওড়ায়,”এগুলো আমার স্বপ্ন ভাঙা টুকরো কাঁচ, যা ছিল ভাঙা মনের গভীরে। আজ বদলে গিয়েছে সব। আমার ভিতরে ভেঙেচুরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে।”
“এলোকেশী স্টপ বিং সো চাইল্ডিস। হাত থেকে রক্ত বের হচ্ছে। দেখি, দেখতে দাও।” এগোতে আসলে দূরে সরে যায় এলিজাবেথ। ঠৌঁটের আগায় জড়ো হয়েছে তাচ্ছিল্যের হাসি। অথচ চোখ দিয়ে ঝড়ছে অঝোর শ্রাবণ, না বলতে পারা কষ্টের প্লাবন। যা কাতর চোখে তাকিয়ে থাকা মানবের কাছে তীরের ফলার ন্যায় যন্ত্রনাদায়ক৷ এবার গলায় কাঠিন্যেতা বজায় রেখে বলল, “এলোকেশী প্লিজ। ব্লিডিং বন্ধ করতে হবে।”
‘চোখে পানি সমেত অধর এলিয়ে হাসল এলিজাবেথ। জড় বস্তুর মতো জমে গিয়েছে একদম।
“আর মনে যে রক্তক্ষরণ হচ্ছে তা? রক্তের প্লাবনে ভেসে যাচ্ছি আমি।”
‘অপরপাশ থেকে শোনা যায় বিলম্বহীন জবাব,”দাগ গেঁথে যাওয়া ক্ষত সারানোর ক্ষমতা হয়তো আমার নেই। তবে কথা দিচ্ছি প্রতিটি ক্ষতের দাগ শুভ্র ফুল দিয়ে ঢেকে দিব আমি। কেউ দেখবে না,কোনোদিন না।”
“আর আপনি ?”
“যদি বাক্য দাঁড়ায় আমাকে নিয়ে, আমার দেখা নিয়ে। তবে নিজের চোখ দু’টো নিজ হাতে নষ্ট করে দেব আমি। দেখব না আমি তোমার ক্ষতের দাগগুলো। তবুও সারিয়ে দিতে চাই আমি, মন থেকে চাই।”
“সব মিথ্যে। আপন মানুষগুলোই যখন পারল দূরে ঠেলে দিতে, আর আপনি,,
“এই আপনি তোমার, শুধুই তোমার এই আপনিটা। কিছু কিছু সম্পর্কে রক্তের বন্ধনের প্রয়োজন হয় না, এলোকেশী।”
‘এভাবে কথার প্যাঁচে কথা বলে এলিজাবেথকে ব্যস্ত রেখে এগিয়ে গিয়ে খপ করে ধরে ফেলল এলিজাবেথের রক্তাক্ত হাত মানবটা। স্তম্ভিত ফিরে পায় এলিজাবেথ। এর মধ্যে মানবটি পাঞ্জাবির পকেট থেকে রুমাল বের করে হাতে চেপে ধরে। জোড়াজুড়ি করতে থাকে এলিজাবেথ হাত ছাড়ানোর জন্য। একসময় গলা ছেড়ে চেঁচাল, “আমাকে ছুঁবেন না আমি অপবিত্র।”
‘এলিজাবেথের কথায় থমকে যায় মানবটি। স্তব্ধ হয়ে তাকায় এলিজাবেথের দিকে, তাকাল এলিজাবেথের গলায়। ভালো করে খেয়াল করলে দেখতে পায় এখনো এলিজাবেথের গলায় কালো ছোপ ছোপ দাগ স্পষ্ট। চোখ বুজে তপ্ত শ্বাস ফেলল মানবটি। কয়েক মুহূর্তের জন্য আঁটকে রাখা নিশ্বাস ছেড়ে দিল দীর্ঘশ্বাসে। অভিব্যক্তি অত্যন্ত স্বাভাবিক, বরাবরের মতোই ঠোঁটের কোণায় অমায়িক হাসি। এলিজাবেথের হাতে রুমাল ভালোভাবে পেঁচিয়ে দিতে দিতে স্বাভাবিক গলায় বলল,
“তুমি পবিত্র ফুল। আকাশের সবথেকে উজ্জ্বল নক্ষত্র। যদি কোনো ঝড়ের কারণে নিজের আলো ক্ষইয়ে ফেল তুমি তবে আমি সূর্য হয়ে তোমাকে আলোকিত করে নিজে জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাবো।”
‘এলিজাবেথ তাকিয়ে থাকল কৃষ্ণগহ্বরের দিকে। মানুষটা কতটা সাবলীল গলায় বলে দিত কত জটিল থেকে জটিলতর কথা গুলো। এমনটাও হওয়ার কথা ছিল না। পাপের শহরে রাতের আঁধারে স্বেচ্ছায় শরীর আদানপ্রদান স্বাভাবিক হলেও কেউ অযাচিতভাবে নিজের চরিত্র খোয়ালে কলঙ্কের দাগ বসিয়ে দেয় সমাজ। এলিজাবেথের অভিব্যক্তি শূন্যের কোঠায়। ‘নিস্তেজ স্বরে বলল, “মানে?”
‘মানবটি রুমাল দিয়ে কাটা জায়গা সুন্দর করে পেঁচিয়ে দিল। ওর হাতে লেগে থাকা রক্তগুলো নিজের গায়ে চাপানো পাঞ্জাবিতে রঙের মতো লাগিয়ে দিল। চোখ বড় বড় হয়ে যায় এলিজাবেথের। বুঝতে পারে না এইরকম উদ্ভট কাজের কারণ। সাদা সুভ্র পাঞ্জাবি রক্তজবার অঞ্জলি রঙে রাঙিয়ে যায়। স্নান হাসল লোকটা, হেসে বলল, “লাগিয়ে নিলাম অপবিত্র রক্ত, নিজেও অপবিত্র হয়ে গেলাম। চলো এবার পবিত্র হই একসাথে পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে।”
‘ কথাগুলো বলার সময় লোকটার গলায় ছিল না বিন্দু পরিমাণ জটিলতা, জড়তা। নিরুদ্বেগ ভাব নিয়ে দ্বিধাহীন ভাবে বলে দিল অবান্তর কথাগুলো। যেগুলো লোকটার মুখে একদমই মানায় না। ব্যক্তিত্ব, প্রফেশন কোনো দিক দিয়েই যায় না উদ্ভট কথাগুলো তার সাথে। এলিজাবেথের অবয়ব দেখে ফিচলে হাসল মানবটি। পেলব দু’হাত রাখে এলিজাবেথের গালে। মানবের হাতের স্পর্শ লাগতেই যেন কারেন্টের শর্ট লাগল। ছিটকে দূরে সরে যায় এলিজাবেথ। সে এলিজাবেথের ইনসিকিউরিটি বুঝতে পেরে কিছুটা দূরে সরে বসে। ধাতস্থ গলায় বলে দিল এক অপ্রত্যাশিত কথা,
“বিয়ে করবে আমায় এলোকেশী?”
‘মাথায় যেন বাজ পড়ল এলিজাবেথের। আকাশ থেকে চাঁদ টপকে পড়েছে শোনার মতো চমকালো।
“মানে? এসব আপনি কি বলছেন? সবটা জানার পরেও…”
“সবটা জেনেই বলছি এলোকেশী। আমার হও, সুযোগ দাও তোমাকে সুভ্রতার রঙে রাঙিয়ে দিতে।”
‘গম্ভীর হয় এলিজাবেথের কন্ঠস্বর, “কোথায় আমি আর কোথায়, কি যা-তা বল…”
‘এবারো বাক্য শেষ করার আগেই ছটফট করে উঠল মানবটি। ব্যগ্র গলায় বলল, “এই আপনি তোমার, শুধুই তোমার এই আপনিটা।”
“আমি পারব না আপনাকে ঠঁকাতে। মাফ করবেন আমায়।”
“আমাকে উদ্ধার কর এলোকেশী প্লিজ।”
‘কপালে ভাঁজ ভাসমান হল এলিজাবেথের।
“উদ্ধার! মানে?”
“তোমাকে হারানোর ভয়ে তিলেতিলে শেষ হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা কর আমাকে। হ্যাঁ আমি জানি তুমি হয়তো আমাকে তেমনভাবে ভাবোনি কখনোই। কিন্তু আমি ভাবি, সেই শুরু থেকেই। সঠিক সময়ের অপেক্ষায় ছিলাম আমি। কিন্তু মাঝখান থেকে এক দমকা হাওয়া এসে সব উল্টোপাল্ট করে দিয়েছে। অনেক কষ্ট করে আবারো তোমাকে ফিরে পেয়েছি এলিজাবেথ। আর হারাতে চায় না। প্লিজ আমার হয়ে যাও। তোমার সকল দায়িত্ব নিতে চাই আমি। সারিয়ে তুলতে চাই তোমার মনের ক্ষতগুলো।”
“আপনার সুন্দর জীবনে আমি নোংরা লাগাতে চায় না ভালো মানুষ।”
“এলোকেশী, লুক এট মি পাখি। ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য একটি শক্ত হাতের প্রয়োজন হয়। আমি তোমাকে আমার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছি। দেখো যা হয়েছে তাতে তোমার কোনো হাত নেই, এভাবে নিজেকে গুটিয়ে রেখো না। আমরা চাইলে আবার নতুন করে সব শুরু করতে পারি। সবকিছু আমাদের হাতে নেই। জীবনে এমন অপ্রত্যাশিত অনেক কিছুই হয়। আমরা চাইলে শেষটা সুন্দর করতে পারি এলোকেশী। আমার স্ত্রী হিসেবে সমাজে স্বীকৃতি দিতে চাই তোমাকে, মুছে দিতে চাই তোমার সকল কলঙ্ক। চাঁদেরও কিন্তু কলঙ্ক আছে, তবুও মানুষ সবসময় তার প্রিয় মানুষকে চাঁদের সাথে তুলনা করে। আর তুমি তো আমার বাগানে ফোটা সবচেয়ে রঙিন ফুল। যার স্নিগ্ধতা আর শুভ্রতায় হিংসে করে বাকি ফুল। তুমি হাতটা শুধু ধর, আমি দেখিয়ে দিব সত্যিকারের সম্পর্কের মানে কি।”
‘বিরতিহীন ভাবে কথাগুলো বলে হাত বাড়িয়ে দিল লোকটা। এলিজাবেথ ভেজা চোখে একবার তাকাল সুখের আশায় বাড়িয়ে দেওয়া হাতের দিকে, অতঃপর তাকাল কাতর দু’টি চোখে। সহসাই চোখ বুজে কান্নাচাপা কণ্ঠে বলল,
“আমি পারব না আপনাকে কখনো স্বামীর অধিকার দিতে। নিজের শরীরের উপর ঘৃণা চলে এসেছে আমার।
“ভালোবাসা মানে হলো আলিঙ্গন।
আর আলিঙ্গন মানে প্রচন্ড জোরে শক্ত করে জড়িয়ে ধরা, যেনো পাঁজরের ভিতর পাজর ঢুকে যায়। হোক সেটা শারীরিক বা মানসিক। তোমার শরীর চাই না আমার এলোকেশী। শুধু চাই তুমি আমার পাশে থাকো শেষ সময় অবধি। তোমার অনুমতি ছাড়া তোমার শরীরে স্পর্শও করব না আমি কথা দিলাম। ”
“ভালোবাসার সমস্ত অনুভূতি গুলো হারিয়ে ফেলেছি আমি।”
“আমি অপেক্ষা করব। টেইক ইউর টাইম। যেদিন তুমি আমার ভালোবাসায় আত্মসমর্পণ করবে, সেদিন হবে আমার সবথেকে সুখের দিন। এই পৃথিবীতে সবথেকে খুশি থাকব আমি সেদিন। সেই পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করব, চেষ্টা চালিয়ে যাবো তোমার মনে ভালোবাসার ফুল ফোটানোর জন্য। তবে শোন যেদিনই প্রেমের ফাঁদে পা দাও না কেন, অগ্রিম বার্তা দিয়ে নিও মেয়ে। নাহয় এতো বড় ধাক্কা সহ্য করতে পারব না।
‘বলে ফিক করে হেসে দেয় মানবটি। এলিজাবেথ নিস্প্রভ, দ্বিধাহীন নজরে তাকিয়ে থাকল কৃষ্ণগহ্বরে। অকুতোভয়ী হৃদয় বেগতিক দোটানার স্বাক্ষী। বিষন্ন অনুভূতির মিলনে চুপসে যাওয়া মনে হাজারো দোটানা। অর্হনিশে বার বার কর্ণপাত হতে থাকে সেই ভয়ংকর মুহূর্তের সময়গুলোতে করা আর্তনাদগুলো। মস্তিষ্ক, নিউরন, শ্রবণ ইন্দ্রিয় ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে প্রতিটা আর্তনাদ। অনুভূতির জোয়ারে ভেসে অম্মকঃকরণের রক্তপাত কমাতে হলেও এলিজাবেথকে পারতে হবে। তারা হয়ে আর আকাশের মেঘে ভেসে থাকতে চায় না অধরা দিনের মতো। কাটক দিন তবুও কারোর আশায় চেয়ে না থেকে যন্ত্রণা বুকে বেয়ে। মুছে ফেলতে হবে সেই ব্যথাগুলো, নতুন কারোর মাঝে নিজেকে বিলীন করে।
‘দু’টানা থেকে বেরুতে পারে এলিজাবেথ। কেউ আসুক ভালোবেসে ভরিয়ে দেক মন। আসুক এক নতুন সকাল, ভেঙে দিয়ে কালো অতীত, বর্তমান রুদ্ধ করে, স্তব্ধ আকাশে ঝিলিক দিয়ে উঠুক এক নির্মল বিশুদ্ধ দৃষ্টি। হৃদয় কপাটে আনাচে কানাচে দোল খাক কড়কড়ে, সজীব বসন্তের দোলনা। এলিজাবেথ সব ভুলে চোখ জোরালো আলো নিয়ে মানুষটার কৃষ্ণগহ্বরে তাকাল । যে কাতর চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। চোখে একরায় উদ্বিগ্নতা, উৎকণ্ঠা। বাড়িয়ে রাখা হাত আশাবাদী আশায়। অতীত কে একমুহূর্তের জন্য কালো অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে বর্তমানে ফিরে আসে এলিজাবেথ। শুধু চায় বর্তমান, এমন একটা সময় যেখানে নেই কোনো জোরজবরদস্তির, ধ্বংসযজ্ঞ, পাপাচারে নিবিষ্ট অন্তহীন মরিচীকা। আছে শুধু নমনীয়তা, কোমলতা। ফোঁস নিশ্বাস ছাড়ে এলিজাবেথ। কাঁপতে থাকা হাত রাখলো পুরুষালি খসখসে কুটিল।
‘দৃষ্টি যুগলের আলিঙ্গন দৃঢ় হল। মানবটির ঠৌঁট গহ্বরের ফাঁক গলে ছুঁটে চলল প্রাপ্তির হাসি। যেই হাসি মিশে গেল আকাশে বাতাসে। এলিজাবেথ কে সাবধানে তুলে নিয়ে খাটে বসালো। কান্নার তোড় কমে এল এলিজাবেথের। শান্তির স্রোত বহমান মুখশ্রীতে। মানবটি এলিজাবেথের হাত দু’হাতে আবদ্ধ করে নিল। নিদারুণ কোমল স্বরে বলল,
“এই যে আজ ছুঁলাম। বিয়ের আগে আর ছুঁবো না। আর কোনোদিনই তোমার অনুমতি ছাড়া ছুঁবো না তোমাকে। একটু পর কাজি আসবে। খেয়ে নাও।”
‘এলিজাবেথের হাত ছেড়ে ইন্টারক্রমে কল করে মেড কে নতুন করে খাবার নিয়ে আসতে বলল।সে আবারও গিয়ে বসল এলিজাবেথের পাশে। এলিজাবেথের অভিব্যক্তি মলিন। মানবের চোখের তৃষ্ণা যেন মিটে না। অনড়ভাবে তাকিয়ে থাকল এলিজাবেথের রক্তাভ মুখে।
“আমি কোথায় আছি?”
“দেওয়ান মঞ্জিলে।”
‘চমকে ওঠে এলিজাবেথ। রসগোল্লার মতো গোল গোল চোখ কোটর থেকে পারলে বেরিয়ে আসে। বিস্মিত স্বরে বলল “কতক্ষণ যাবত এখানে আছি?”
”কাল রাত থেকে।”
“এখন ক’টা বাজে?”
“এখন সন্ধা। সাতটা বাজে।”
‘চমকে উঠল এলিজাবেথ দ্বিতীয় বারের মতো। শুকনো ঢোক গিলে বলল, “এতোক্ষণ ঘুমিয়েছি আমি?”
‘মানবটি অপরাধীর ন্যায় মাথা নত করে ফেলে। ঠৌঁট কামড়ে স্মিত হেসে বলে, “আসলে ক্লোরোফর্ম একটু বেশি পড়ে গিয়েছিল। ”
‘এবার চোখ ছোট ছোট করে চাইল এলিজাবেথ। সরাসরি দৃষ্টিতে নিক্ষেপ করে নিকটে চুরের মতো চুপসানো মুখে বসে থাকা মানবে, “ওটা আপনি ছিলেন?”
“না তোমাদের পাড়ার দশু পাগলা।”
‘ফিক করে হেসে দেয় এলিজাবেথ। বহুদিন পর ঠৌঁটে ফুটে সেই চঞ্চল হাসি। তা মনোমুগ্ধকর ভাবে তাকিয়ে দেখল মানবটা। হঠাৎই হাসি থেমে গেল এলিজাবেথের। চেহারায় চিরায়ত গম্ভীর ভাব ফিরে আসে,
“আমাকে ডাক দিলেন না কেন? আর সত্যিটা আপনি জানলেন কি করে? আর ঐ গোপন জায়গায় ই বা পৌঁছালেন কীভাবে? আমার চাচা, চাঁচি কেমন আছে? ঐ পশুটা ওদের কোনো ক্ষতি করেনি তো। ইবরাত ঠিক আছে তো?”
“আরে আরে শ্বাস তো ফেলো । ধীরে ধীরে প্রশ্ন কর আমি উত্তর দিচ্ছি।”
‘অস্থিরতা কমে না এলিজাবেথের। ছটফটিয়ে উঠে বলল,”বলুন না।”
“আচ্ছা আচ্ছা দিচ্ছি। প্রথম প্রশ্নের উত্তর হলো, এতোটা আড়ম্বরে ঘুমাচ্ছিলে যে ডাকতে ইচ্ছে হলো না। আর সত্যিটা জেনেছি শিহাবের কাছ থেকে। দুইদিন আগে দেশে ফিরেই শিহাবের সাথে দেখা করি, আমি তখনই সব জানতে পারি। তারপর অনেক খুঁজে, অনেক লোক লাগিয়ে, সবশেষে বহু কসরতে পেয়েছি তোমাকে। তাইতো এতো দেরি হয়ে গেল। আর তোমার চাচা চাঁচির খোঁজ নেওয়া হয়নি৷ আমি শুধু পাগলের মতো খুঁজছিলাম তোমাকে। আমাকে ক্ষমা করে দাও এলোকেশী, তোমার এতো খারাপ সময়ে আমি তোমার পাশে থাকতে পারিনি। দেশে এসে আমরা ওদের সাথে দেখা করতে যাব কেমন?”
‘কথার পারদে এলিজাবেথ দ্রুত সবেগে আওড়াল,
“ফিরে এসে মানে? কোথায় যাচ্ছি আমরা?”
“আমরা ভোরের ফ্লাইটে আমেরিকা যাচ্ছি।”
“কেন?”
“আপাতত ওটায় আমাদের জন্য সেভ হবে। ঐ গ্যাংস্টার এখন দেশে আছে। নিশ্চয়ই পাগলের মতো খুঁজছে আমাদের।”
‘রিচার্ডের কথা মনে পড়তেই বিষাদে ছেদে গেল এলিজাবেথের মন। আবারো চোখ ভিজে আসে। ভাঙা গলায় শুধায়, “কেন আমার এই নোংরা জীবনের সাথে জড়াতে চাচ্ছেন? কতদিন পালাতে পারবেন এভাবে?”
‘অপরপাশ থেকে শোনা গেল রাশভারি আওয়াজ, বলল, “গোপনীয়তা হল শক্তি। মানুষ যা জানে না তা ধ্বংস করতে পারে না। আর তুমি তো আমার কাছে সবথেকে মূল্যবান জিনিস, যা সযত্নে আগলিয়ে রাখব আমি সারাজীবন। শুধু একবার লিখিত দলিলখীতভাবে আমার হয়ে যাও, কারোর শ্রাদ্ধ নেই তোমাকে আমার থেকে আলাদা করার।”
‘বিষন্ন মন তবুও মানে না। চোখের সামনে ঝলক দিতে থাকে রিচার্ডের নৃশংসতা। হঠাৎ মৃত্যু পথযাত্রী রোগীর মতো ছটফট করতে থাকে এলিজাবেথ। ছটফটে গলায় বলতে থাকে, “রেশমা মা, রেশমা মা, নিশি ওরা কোথায়? আমাকে না পেয়ে নিশ্চয়ই ঐ জানোয়ারটা ওদের মেরে ফেলবে। যে করেই হোক ওদের বাঁচান প্লিজ। এই মাতৃ ছায়া আমি হারাতে চাই না। হারাতে হারাতে সর্বশান্ত আমি।”
‘মানবের মুখে আঁধার নেমে আসে। এলিজাবেথের কাছে চেপে গেল পুরো বিষয়টি। এই সুন্দর মুহূর্ত নষ্ট করতে চাই কোনোভাবেই। জলদগম্ভীর গলায় বলে,
“তুমি চিন্তা কর না এলোকেশী। আমি ওনাকে তোমার কাছে নিয়ে আসব খুব শীঘ্রই।”
‘এরিমধ্যে মেড খাবার নিয়ে আসে। এলিজাবেথ আর কোনো কথা বলে না চুপ হয়ে যায় একদম। ডুবে গেল ভাবনার জগতে। পুরুষালি হাতটি যখন মুখের সামনে খাবারের লোকমা তুলল, তখন ধ্যান ভাঙলো ওর। বিনাবাক্যে মুখে তুলে নিল এলিজাবেথ। এই ছোট ছোট যত্নের কাঙ্গালই তো সে ছিল এতো কাল যাবত। এলিজাবেথকে খাবার খাইয়ে দিয়ে ওঠে দাঁড়ায় মানব। বেডসাইড থেকে একটা খাম নিয়ে বাড়িয়ে দেয় এলিজাবেথের দিকে। প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায় এলিজাবেথ।
“তোমার পাসপোর্ট। ওদিকে ক্লোজেট প্রয়োজনীয় সকল কিছু আছে। ফ্রেশ হয়ে নাও। একটু পর কাজী আসবে।”
‘বলে চলে গেল সে। এলিজাবেথ তাকিয়ে থাকে খামের দিকে। তবে দৃষ্টি সেখানে নেই। কানে বার বার বাজতে থাকে ‘কাজী আসবে ‘। একটু পর শুরু হবে নতুন জীবনের সূচনা। আচ্ছা অভাগীর কপালে কি সুখ আসে?কেমন হবে তার নতুন জীবন?কে বের হয়ে সিঁড়িতে পা রাখতেই দেখা হল রেয়ানের সাথে। রেয়ান এই ভদ্রলোকের বা হাত। গত রাতে যার হাত দিয়েই ঝড়েছিল রেশমার রক্ত।
“রেয়ান।”
“স্যার আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম।”
“কেন?”
“মন্ত্রী সভায় মিটিং ছিল আটটায়।”
“আজকের সকল কিছু ক্যান্সেল করে দাও। কাজী আনতে পাঠাও কাউকে এক্ষুনি?”
‘রেয়ান ভ্রু কুঁচকে ফেলে, “কাজী?”
“হ্যাঁ কাজী। আমার বিয়ের কাজী।”
‘রেয়ান আর কোনো প্রশ্ন করেনি। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সুঠাম দেহের অধিকারী মানবের ঠোঁটের কোণে চিলতে হাসি দেখে সম্মতি জানিয়ে কাজের জন্য বেরিয়ে পড়ল। ফুরফুরে মেজাজে নিচে নামতে থাকা মানবটি ঠোঁটের কোণ থেকে হাসির ঝলকানি সরানোর চেষ্টা করল না। নিচে এসে বসার ঘরে মুখোমুখি হয় পিতা ‘তাজুয়ার দেওয়ান’-এর সাথে। বয়স্ক লোকের চেহারায় বয়সের ছাপ দেখা গেলেও শরীর এখনো বেশ ভালো অবস্থায়। তাজুয়ার দেওয়ান তার চোখের সামনে থেকে নিউজপেপার সরিয়ে তেরছা নজরে ছেলের দিকে তাকাল। পরপর রুষ্ট গলায় বলল,
“শেষমেশ নিচু জাতের মেয়েকে বিয়ে করতে চাচ্ছো? আমার রেপুটেশনের কথা একবারও ভাবলে না?”
‘প্রথমবারের মতো এলিজাবেথের ভালো মানুষের গলার স্বর শক্ত হল। চোখেমুখে কাঠিন্য এনে বজ্রপাতের মতো গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“আমার ব্যাপারে কারোর একচুল মতামত পোষণেও আগ্রহী নই আমি।”
‘বলেই গমগম পায়ে চলে গেল সে। তাজুয়ার শক্ত চোখে তাকিয়ে রইল ছেলের যাওয়ার পানে।
“আমার মা-বোন কোথায় জানো’য়ারের বাচ্চা?”
‘কর্কশ গলায় হুংকার দিতে দিতে ভিতরে আসে শিহাব এক ক্ষুদার্ত হিংস্র প্রাণী হয়ে। রাগে ফনা তুলছে। ভিতরে পা রাখতেই ন্যাসো ঝড়ের বেগে গিয়ে শিহাবের হাঁটুর কাছে লাথি মারলে হাঁটু ভেঙে শরীর নিচে বসে যায়, উঠতে চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয়। হাড়ের ভেতর মটমট শব্দ হতে থাকে৷ শ্বাসরুদ্ধকর ব্যথা সহ্য করে সহসা চেঁচিয়ে বলল
“আমার মা-বোনদের সাথে কী করেছিস?”
‘রিচার্ড কাউচে পায়ের উপর পা তুলে একদৃষ্টিতে শিহাবের দিকে তাকিয়ে আছে। অভিব্যক্তি পানির মতো স্বচ্ছ অথচ শূন্য দৃষ্টিতে জমে থাকা ক্রোধের পাহাড়। ঠোঁটের আগায় জড়ো হওয়া রহস্যের ঘনঘটা। ধারালো চোয়ালে রহস্যময় হাসি। ন্যাসো আবারও উদ্যত হয়ে শিহাবের ঘাড়ে আঘাত করতে যায়, কিন্তু রিচার্ড বাঁধা দেয়।
“ওহ ন্যাসো নো। আমার শালা, তাকে নিজ হাতে আপ্যায়ন করতে দাও আমাকে।”
‘শিহাব আজ দমে না। আহত অবস্থায় ও চেঁচাল,
“শালা মানে? মশকরা হচ্ছে, কি করেছিস আমার বোন কে?”
‘উঠে দাঁড়ায় রিচার্ড। দু-হাত পকেটে ঢুকিয়ে ড্যাসিং ভাব নিয়ে এগোতে থাকে শিহাবের দিকে, কালচে ঠৌঁট গোল করে শিষ বাজাতে বাজাতে। দুপাশে ঘাড় ঘুরিয়ে টানটান হয়ে দাঁড়াল শিহাবের সামনে। অতঃপর হঠাৎ শক্তপোক্ত লম্বা হাতে শিহাবের চুল টেনে ধরে মুখ উপরে তুলল। ব্যাথায় কুকড়িয়ে ওঠে শিহাব। শক্ত করে টেনে ধরার কারণে মস্তক থেকে চামড়া কিছুটা উপরে ওঠে আসে। ব্যাথায় টনটন করতে থাকে মাথা। মুহূর্তের মধ্যে রিচার্ডের মুখভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে যায়। নীলাদ্রি চোখে আগুনের লেলিহান দাবালনের মতো দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে। রুষ্ট গলায় চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“তোর সাথে তো আমার পুরোনো হিসেবে এখনো বাকি রয়ে গেছে। তুই কি ভেবেছিস, তুই নিজে থেকে এখানে এসেছিস?”
‘থেমে গিয়ে, শিহাবের চুলের মুঠি ছিঁড়ে এক অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল রিচার্ড। ন্যাসো বুঝতে পারে না, রিচার্ডের মনের গভীরে কী চলছে। শুধু চোখে জমে থাকা উন্মাদ কৌতূহলে তাকিয়ে থাকে। হাসি থামায় রিচার্ড। মুখে আগুনের মতো তীক্ষ্ণ শব্দের বাণী উঠে আসে, সেই সাথে চোখে জ্বলছে ক্রোধের সুনামি।
“আমি তোকে এখানে আনতে চেয়েছি, তাই তুই এখানে।”
‘ন্যাসো বিস্মিত ভাবে পিছিয়ে যায়। সত্যিই তো শিহাবের মতো এক নিম্নমানের প্রাণীর পক্ষে এমন গাঢ় জঙ্গলের ভেতর এতো সুরক্ষিত বাগান বাড়ি খুঁজে আসা এক অসম্ভব ব্যাপার। ভিতরে প্রবেশ তো একেবারেই অসম্ভব। নতুন গার্ড রাখা হয়েছে। যারা চূড়ান্ত সতর্ক, এক চুল হেরফেরেও প্রাণ নিয়ে নিবে।
‘সেদিন সিসিটিভির লাইভ ফুটেজে রিচার্ড এলিজাবেথ আর রেশমার মধ্যে কথোপকথন শুনেছিল। আর সে থেকেই অজানা ক্ষোভ জমেছিল এলিজাবেথের ভাই-বোনদের উপর। পরদিন দেশের বাইরে যাত্রার আগে রিচার্ড ন্যাসোকে সেই কাজের জন্য পাঠিয়েছিল।ওদের তুলে নিয়ে বেজমেন্টে বন্দী করে রেখে যেন এলিজাবেথের মতো করেই তাদের টর্চার করা হয়। সেদিন ন্যাসো ওদের তুলে আনলেও শিহাবকে খুঁজে পায়নি, কারণ সে আগে থেকেই গায়েব হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীতে ন্যাসো রিচার্ডকে এই ব্যাপারে জানালে রিচার্ড বলেছিল দেশে ফিরে সে নিজে শিহাবকে খুঁজে এনে, নিজের হাতে তার নৃশংস মৃত্যু দিবে। তবে এতো জলদি রিচার্ড, শিহাবকে কোথা থেকে পেয়েছে সেটা ঠাওর করতে পারল ন্যাসো। চিন্তা থেকে বের হয়ে আসে ন্যাসো রিচার্ডের হুংকারে। রিচার্ড শিহাবের মাথায় বন্দুকের নল ঠেকালে শিহাবের সমস্ত সাহস এক মুহূর্তে গগনে চলে যায়। থরথর করে কাঁপতে থাকে শিহাব। রিচার্ডের চোয়াল মটমট করছে, গর্জন করছে স্ফুলিঙ্গের মতো। কাঠকাঠ গলায় বলে,
ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ১০
“সত্যি করে বল কে ছিল?”
‘শিহাব জানে সে আজ নিঃশেষ হয়ে গেছে। রিচার্ডের মতো এক ভয়ংকর গ্যাংস্টারের সামনে মিথ্যা বলা এক অমৃত মৃত্যুর অপেক্ষা। গলা কাঁপছে, শরীর অস্থির।
“তা… তাকবীর দেওয়ান।”
‘ঠিক সেই মুহূর্তে, ঠাসসস! বন্দুকের সবগুলো গুলি শিহাবের মগজে ঢুকে গেল। ট্রিগার থেকে হাত সরিয়ে নেয় রিচার্ড, মুখে রক্তে ভেজা এক ভয়ংকর হাসি। শিহাবের রক্তে সিক্ত হয় ওর পুরো মুখমন্ডল। বিড়বিড়িয়ে ওঠে পৈশাচিক সাইকো মস্তিষ্কের গর্জন,
“You won’t be able to escape me, Red.”