ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ১৬
মিথুবুড়ি
‘ক্যালিফোর্নিয়ার একটি বৃহত্তম শহর হলো সান ফান্সিসকো। আমেরিকার পঞ্চমতম বৃহত্তম ঘনবসতির শহর হলো সান ফান্সিসকো। সান ফান্সিসকো মূলত পাহাড়ের উপর গড়ে উঠেছে। এখানে প্রায় পঞ্চাশটি পাহাড় রয়েছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো টুইন-পিক। টুইন- পিক থেকে গোটা সান ফান্সিসকোর অসাধারণ ভিউ পাওয়া যায়। এই শহরে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আকর্ষণ হচ্ছে খাড়া পাহাড় ও ক্যাবল কার। এখানকার ক্যাবল কার আমেরিকা একমাত্র ম্যানুয়ালি পরিচালিত কেবল কার। এই ক্যাবল কার কে আমেরিকার ওই জাতীয় ঐতিহাসিক মনুমেন্ট হিসেবে ধরা হয়। যা পৃথিবীর একমাত্র চলমান মনুমেন্ট।
‘ক্যাবল কারের ভেতর একটি কাচের জানালা যা দিয়ে বাইরে তাকালে পাহাড়ের উপরে নীলচে সবুজ মেঘের চাদর, নিচে ছোট্ট গ্রামগুলো, আর কিছু দূরেই ঘন সবুজ বনাঞ্চল দেখা যাচ্ছে। ক্যাবল কারটি আস্তে আস্তে উপরের দিকে উঠছে। এই ভ্রমণের মুহূর্তগুলো শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে এলিজাবেথ। শূন্য দৃষ্টিতে ও রয়েছে এক ধরণের মুগ্ধতা, যেনো তার চারপাশের প্রকৃতির সৌন্দর্য মনের গভীরে গেঁথে যাচ্ছে। দীর্ঘ আট বছরের বন্দী জীবন পেরিয়ে এসে এখনও নিজেকে এতো মুক্তমনা হিসেবে ধাতস্থ করতে পারছে না এলিজাবেথ। এখনো মনে হচ্ছে এগুলো ভোর রাতের সেই স্বপ্ন গুলো। যা ফজরের আযানে ঘুম ভাঙার সাথে সাথে লাপাত্তা হয়ে যেত।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘এলিজাবেথের পরণে লম্বা, হালকা ফ্লোরাল প্রিন্টের স্কার্ট যা হাওয়ায় হালকা দুলছে। তার সাথে রয়েছে উষ্ণতাজনক একটি সোয়েটার। বাউন কালারের সোয়েটার এলিজাবেথের তুলতুলে নরম তনুতে একদম মিশে রয়েছে। গাঁয়ের কালারের সাথেও যেন স্বকীয়তা খুইয়েছে। স্নিগ্ধ, স্বাচ্ছন্দ্যময় লুকে দেখা যাচ্ছে এলিজাবেথকে, সেই সাথে ঠৌঁটের আগায় জড়ো হয়েছে মিষ্টি হাসি। এগুলো বাস্তব, কোনো অবাস্তব স্বপ্ন নয়। সেও উড়তে পারছে মুক্তমনা পাখির মতো। প্রশান্তিময় হাসির স্পষ্ট ঝলকানি ওষ্ঠপুটে। ওষ্ঠপুটের গহ্বরের ফাঁক গলে ছুঁটে চলল প্রাপ্তির হাসি। যেই হাসি মিশে গেল আকাশে বাতাসে। মুহুর্তগুলো থেমে থাকুৃক, মিশে থাকুক এভাবেই স্নিগ্ধ বাতাসের মাঝে । আর এলিজাবেথ ডুবে থাকুক প্রকৃতির মাঝে। সেখানে ঠাঁই না হোক কোনো বিশ্বাসঘাতকতার, কোনো বিষাদের রাজার।
‘এলিজাবেথের লাল চুল গুলো পতাকার মতো বাতাসে ঝাপটা খেয়ে খেয়ে উড়ছে । বার বার গিয়ে আঁচড়ে পড়ছে পাশে একগুঁয়ে দৃষ্টিতে হরনকারী তৃষ্ণার মানবের কৃষ্ণগহ্বরে। এই একদৃষ্টিতেই যেন শুষে নিবে এলিজাবেথের সকল সৌন্দর্য। বন্দী করে ফেলবে আর হৃদয়হরণীকে অন্দরমহলের রাজপ্রাসাদে। মাথায় মুকুট পরিয়ে স্থান দিবে রাণীর সিংহাসনে। রাণীর সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবে প্রজা হিসেবে। চোখের পকল যেন আজ পড়বে না তাকবীরের। থেমে গিয়েছে, থাকুক না থেমে। এভাবেই, এতো মনোরম ভাবেই।
এলিজাবেথকে জানালার পাশে সিট দিয়েছে তাকবীর, নিজে বসেছে এলিজাবেথের পাশে। পর্যাপ্ত দূরত্ব বজায় রেখে। সকালের ঐ কান্ড অবলোকন হওয়ার পর এলিজাবেথের প্যানিক অ্যাটাক ওঠে। ভয়, ভীতি, সংকীর্ণতা ভিতরে অষ্টেপৃষ্ঠে জরিয়ে আসে। তাকবীর আর এক মুহূর্তও এলিজাবেথকে ঐ জায়গায় রাখেনি। সাথে সাথে শহর পরিবর্তন করে। এবার আর কোনো বড়, ওয়েস্টার্ন হোটেলে উঠে না। বরংচ গ্রাম সাইডের খুব ছোট একটু হোটেল দুটি রুম নেয়। সান ফান্সিসকোর একেবারে কেন্দ্রের কাছাকাছি ছোট একটি শহর ” ব্রিসবেন “। চিন্তা ভাবনা বাকি কয়দিন এখানেই থাকা।
‘ তাকবীর আগে থেকেই এলিজাবেথের প্রয়োজনীয় সকল জিনিস নিজের হাতে বেছে বেছে কিনে সংগ্রহ করে রেখেছিল। তবে আজ এখানে এসে তারা সর্ব প্রথমবারের মতো একসাথে শপিং করেছে। এতো কিছুই মাঝেও এলিজাবেথের মনের কোণে বিষন্নতার রেশ থেকেই যায়। তা এলিজাবেথ শত জোরপূর্বক হেসে আড়াল করতে চাইলেও বুঝে যায় তাকবীর। দরুন তাকবীর কর্নসান হয় আরো এলিজাবেথের প্রতি। এলিজাবেথকে খুশি করার জন্য আজ তাকবীর ও এলিজাবেথের সোয়েটারের সাথে ম্যাচ করে সোয়েটশার্ট পরেছে। এই সকল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচেষ্টার পিছনে অভিপ্রায় একটাই প্রতি ক্ষেত্রে এলিজাবেথকে স্পেশাল ফিল করানো।
‘তাকবীরের মর্ডান স্টাইলের সোয়েটশার্টের সাথে ট্রাউজার এবং আরামদায়ক হাইকিং বুট। খোঁচা খোঁচা কোঁকড়া চুল গুলো কপালে বিছিয়ে আছে বাতাসে বেগ হারিয়ে। তাকবীরের ত্বক হালকা, যাকে সোনালী বা উষ্ণ শ্যামলা বলে, যা ওর সমগ্র উপস্থিতিকে এক অদ্ভুত মোহনীয় আভা দেয়। এই কৃষ্ণগহ্বরের চোখজোড়া অসম্ভব মায়ায় মোড়ানো। দু’জনকে একসাথে খুবই মানিয়েছে আজ।
‘তাকবীর আজ এলিজাবেথকে ওর জামা পছন্দ করতে সাহায্য করেছে। এখনও পর্যন্ত কোনোকিছুতেই এলিজাবেথের তরফ থেকে কোনো প্রকার নিষ্পৃহ পায়নি তাকবীর। তাই সম্পূর্ণটায় নিজের মতো করে গুছিয়ে নিচ্ছে নিজ দায়িত্বে। যথাসম্ভব চেষ্টা করছে এলিজাবেথকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে এনে অন্ধকারের মোড়ানো কিছু নিন্দনীয় অতীর মুছে দিতে। তাকবীর আজ তাদের পোশাক এমনভাবে বাছাই করেছে যা পাহাড়ি ভ্রমণের সাথে মানানসই কিন্তু আধুনিক এবং ফ্যাশনেবল। এবং সে তার কাজে যথেষ্ট সফলও হয়। এলিজাবেথকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে, পাশাপাশি খুশিও করতে পেরেছে। এতেই তার প্রাপ্তি।
‘হঠাৎ পিছন ঘুরে তাকায় এলিজাবেথ। চোখাচোখি হল দুজনের। তাকবীরের দৃঢ় দৃষ্টিতে চোখ রাখতে পারে না এলিজাবেথ। দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। এই চোখে গভীরতা অনেক, তাকালেই মনে হয় সেখানো লুকানো হাজারো গল্প। কথা না বলা কথা জমে আছে চোখজোড়ায়, যা খুব করে প্রকাশ হতে চাচ্ছে। ফিচলে হাসে তাকবীর, হাসল এলিজাবেথও। আবারো মাথা তুলে এলিজাবেথ, মিলে গেল দৃষ্টি এবারো। একে অপরেরকে উষ্ণ হাসি উপহার দিল।
” আপনার ঠোঁট দুটি সরু, কিন্তু এমনভাবে বাঁকা যে মনে হয় শুধু মৃদু হাসতে পারেন, আর সেই হাসিতে লুকিয়ে থাকে অপার কোমলতা। ”
‘ তখনও মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে ছিল তাকবীর। এলিজাবেথের কথায় চোখের পলক ফেলে। ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ কুঁচকিয়ে বলল, ” তাই? ”
‘ উৎসুকভাবে উপরনিচ মাথা নাড়াল এলিজাবেথ। এই ছোট একটুখানিক কনর্সাননেস তাকবীরের তৃষ্ণার্ত হৃদয়ে একটুকরো আহারের যোগান দিল। হালকা দাঁড়ি যুক্ত গাল প্রসারিত করে হাসল তাকবীর একদম চব্বিশ কপাটি বের করে, হেসে বলল, ” আমি এভাবেও হাসতে পারি। তবে এভাবে শুধু তোমার জন্যই হাসি। ”
‘ ছোট ছোট চোখ করে তাকায় এলিজাবেথ, বলে”
“কেন, কেন?”
‘তাকবীরের বিলম্বহীন জবাব, “এর উৎস যে তুমি।”
‘গাম্ভীর্যহীন, কোমল এবং আন্তরিকতা মেশানো কন্ঠে আর সুগভীর, নিকোষ কালো মায়াবী চোখজোড়ার গভীর চাহনিতে এবার কিছুটা লজ্জা পেল বটে এলিজাবেথ। তাকবীরের এহেন কণ্ঠে মনে এক কোমল আবেশ ছুঁয়ে দেয়। এলিজাবেথ কে বেশিক্ষণ লজ্জায় থাকতে দিল না তাকবীর।
“বন্ধু হবে?”
‘ এলিজাবেথ এবার পূর্ণ দৃষ্টি দিল তাকবীরের কৃষ্ণগহ্বরে। নেত্রদ্বয়ে চকচকে কৌতুহল লেপ্টে আছে। হাসল তাকবীর, অমায়িক হাসি। জড়তা বিহীন গলায় সবিনয়ে আওড়াল, ”
“চলো, আমরা আগে বন্ধু হই। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের চেয়ে বন্ধুত্বের সম্পর্কই আরও বেশি মূল্যবান, কারণ ভালো বন্ধুই একজন আরেকজনকে গভীরভাবে বুঝতে শেখায়। তাই আমাদের আগে বন্ধুর মতো করে একে অপরকে জানার, বোঝার সুযোগ নিতে হবে। বন্ধুত্বের মধ্য দিয়ে সম্পর্কের মধ্যে এমন এক দৃঢ়তা আসবে, যা পরস্পরকে আরও কাছাকাছি নিয়ে আসবে এবং একে অপরকে আরও গভীরভাবে বুঝতে সহায়ক হবে। আমাদের এই বন্ধুত্বই হবে আমাদের সম্পর্কের ভিত্তি, যা সময়ের সঙ্গে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। হবে আমার বন্ধু এলোকেশী ?
‘ চেয়ে থাকল এলিজাবেথ। গাঢ় দৃষ্টিতে। ভিজে আসছে চোখ। দু’পাশে মাথা নাড়িয়ে অগ্রাম সংকেত দিল তাকবীর। ঠৌঁট কামড়ে কান্না আটকানো চেষ্টা করল এলিজাবেথ। চোখে মুখের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে শোকে মুর্ছা যাচ্ছে। চোখে পানি সমেত হাসল এলিজাবেথ। ফ্যাসফ্যাসে আওয়াজে বলল, ” আপনি আমায় এতো কেন বুঝেন?
‘ জবাব দেয় না তাকবীর। নিমেষহীন তাকিয়ে থাকে তার বোকা রাণীর দিকে। যে একটু কিছু হলেই ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না শুরু করে দেয়। নিজেকে ধাতস্থ করে এলিজাবেথ। অতঃপর বললো, ” ধন্যবাদ আমাকে সহজ হবার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।
‘ পরপর থেমে, নিজের পেলব হাত বাড়িয়ে দিল তাকবীরের অভিমুখে, দিয়ে বললো, ” বেস্ট ফ্রেন্ড হবেন আমার ? যেখানে সম্পর্কের ভিত্তি হবে নিঃশর্ত বিশ্বাস, আর সন্দেহ থাকবে দূরতম। ক্লান্ত পথিকের মতো যখন পথের মাঝে বসে পড়ব, তখন কি আপনি নির্ভরতার সেই শক্ত হাত বাড়িয়ে দিবেন ? বিপদে বিশ্বাসী হাত হিসেবে সবার আগে আপনার হাত এগিয়ে আসে, যেখানে অনুমতির প্রয়োজন হবে না স্পর্শ করার জন্য। ভালো মানুষটা কি হবে আমার বেস্টফেন্ড। যেই বন্ধুত্ব প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দিবে হ্যাঁ, এটাই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। যে আমার পাশে আছে নিঃশর্তে, নিঃস্বার্থে, অনন্ত ভরসায়?
‘ তাকবীর আবেশিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল দীর্ঘক্ষণ এলিজাবেথের পানে। এমন কথা এলিজাবেথের কাছ থেকে সে মোটেও আশা করেনি এতো দ্রুত। সন্ধি ফিরতে একমুহূর্ত ও আর ব্যয় করল না তাকবীব। মিলিয়ে দিল দু’হাতের বাঁধন। ঠৌঁট প্রসার করে হাসল দুজনেই। হঠাৎ তাকবীর পিছন থেকে একটা বক্স বের করে সামনে ছোট টেবিলের উপর রাখল। এলিজাবেথ একবার বক্সটার দিকে তাকাচ্ছে, আবার তাকাচ্ছে তাকবীরের দিকে। তাকবীর এলিজাবেথের কুঁচকানো ভ্রুদ্বয় দেখে ঠৌঁট কামড়ে হাসল।
” বন্ধুত্বের সূচনা হিসেবে আমার তরফ থেকে ছোটখাটো একটা তোফা। ”
” কিন্ত,,
” কোনো কিন্তু না জাস্ট ওপেন ইট। ”
‘ মৃদু ধমক মিশ্রিত কণ্ঠে উপায়ন্তর না পেয়ে বক্সটির উপরের অংশ সরাল। লাল গোলাপের অজস্র পাপড়ি দেখে অতর্কিত আঁধার নামল অবয়ে। নিচু স্বরে প্রত্যুত্তর করল, ” লাল গোলাপ আমার পছন্দ নয়। ”
‘ খানিকটা অবাক হল তাকবীর। তার জানা মতে এলিজাবেথের ফুল খুবই পছন্দ। বিশেষ করে লাল গোলাপ।
” কিন্তু তোমার তো আ,,,
” ওটা আগে ছিল। সবসময় যে মানুষের পছন্দ এক থাকে তেমনটা কোথাও লেখা নেই। ”
‘ তাকবীর বুঝল না হঠাৎ এলিজাবেথের অযাচিত রাগের কারণ। তবে ঘাঁটল না আর। প্রসঙ্গ পাল্টে বললো, ” আচ্ছা সরি নেক্সট টাইম আর এমন হবে না। এবার এটার ভিতরে দেখ কি আছে। ”
‘ এলিজাবেথ কোনো বাক্য ছাড়া পাপড়ির ভিতর হাত রাখল। হাতে আরেকটা বক্সের মতো কিছু অনুভূত হল। বস্তু টা পাপড়ির ভিতর থেকে বাইরে বের করে আনতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় এলিজাবেথের। তাকবীর চোখে ইশারায় বলল বক্সটিকে আনবক্সিং করতে। এলিজাবেথ বোকার মতো তাই করল। চোখজুড়ানো বিষ্ময়তা। বক্সের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো একটা আইফোনের লেটেস্ট ভার্সন। আইফোন সিক্সটিন পো ম্যাক্স । এলিজাবেথের কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ।
” এটা কার?
” কার হাতে এটা?”
” আমার। ”
” তাহলে তোমারই। ”
” এটা তো মনে হচ্ছে খুব দামি। ”
” তবুও তোমার কাছে নস্যি। ”
” এভাবে মাথায় তুলবেন না আমায় । ”
” তুলিনি তো। মাঝেমাঝে খুব খুসকি হয় । তাই বুকের মধ্যে নেওয়ার চেষ্টা করছি। ওখানে রক্তক্ষরণ ছাড়া আর তেমন কোনো প্রতিকূলতা নেই। ” বলে ঠৌঁটে ঠৌঁট চেপে হাসল তাকবীর। এলিজাবেথ স্তব্ধ। তা দেখে তাকবীর আবারো বলতে শুরু করল, ”
” তুমি আমার পোষা পাখি, তবে সম্পূর্ণ মুক্ত। আকাশজুড়ে ইচ্ছে মতো ডানা মেলে উড়ে বেড়াবে অতিথি পাখির মতো। তবু দিনের শেষে ফিরে আসবে আমারই নীড়ে, ভালোবাসার আঙিনায়। ”
‘ এলিজাবেথের ভেজা দৃষ্টি, ভেজা গলা, ” এই আমি অভাগীর কপালেও এসব ছিল? এ ভালোবাসা গুলো আমি কখনো পায়নি। ”
” এভাবে আর কখনো বলবে না এলোকেশী, যে তোমাকে কেউ ভালোবাসে না, কারণ এই দেখো, তোমার নাম আমার হাতে ট্যাটু করা আছে। আমি এই পৃথিবীর সবচেয়ে নিবেদিতপ্রাণ মানুষ তোমার জন্য, আমার ভালোবাসায় পূর্ণ হবে তুমি । তোমার কোনো ক্ষতি আমি কখনোই হতে দেবো না। আমি শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তোমার পাশে থাকব, তোমার হাত ধরে রাখব। আর মৃত্যুর পরেও আমি তোমার সঙ্গ ত্যাগ করব না, আত্মার মতো তোমার কাছেই থাকব। তুমি আমার কাছে শুধু কিছু নও, তুমি আমার কাছে সবকিছু।”
‘ এলিজাবেথ তাকায় তাকবীরের বা হাতের কব্জিতে । অতঃপর শিরশিরে অনুভূতিতে নিভু চোখে চাইলো তাকবীরের দিকে। তাকবীরের হাতের কব্জিতে থেকে কনিষ্ঠ আঙুলের বরাবর এলিজাবেথের নাম ইংলিশে লেখা। এলিজাবেথের চোখেমুখে এখনো বিষ্ময়তা। কেঁদে দিবে মেয়েটা এখনই।
” এতোসব কখন করেন? এভাবে সর্বক্ষণ পাশে থেকেই কখন কীভাবে করছেন এতোকিছু? সবকিছুই মনে হচ্ছে পূর্ব থেকে কত শখ করে আয়োজন করা। ”
‘ এই প্রসঙ্গ পুরোপুরি এড়িয়ে গেল তাকবীর। ক্যাবল কার দাঁড়াল একটি স্পোপে। তাকবীর ওঠে দাঁড়ায়। কণ্ঠস্বর গভীর, বললো ” একটা দামি এডভাইজ দেই? ”
‘ এলিজাবেথের কণ্ঠস্বরের আশা করল না তাকবীর। নিজে থেকেই সবেগে আওড়াল, ”
” Moving on Isn’t about
forgetting them.
it’s means what you are
without them,,,!
‘ বলে সামনে এগোতে থাকল তাকবীর। এলিজাবেথের মনে ভিতর এক অদ্ভুত আর সুন্দর অনুভূতি তৈরি হয়। শুরু হয় বন্ধুত্বের সূচনা। থাকবে না আর কোনোপ্রকার জড়তা। শুধু চোখের চাহনি কিংবা অজানা কোন অভ্যন্তরীণ অনুভূতির মাধ্যমে একে অপরের মনের কথা বুঝে ফেলা হবে । এই ধরনের সম্পর্ক গভীরতা, সমঝদারী এবং অগোচরে একে অপরকে বোঝার এক নিখুঁত নিদর্শন হয়ে উঠবে। শোনা গেল তাকবীরের উচ্চ স্বর ।
” এলোকেশী জলদি নামো। গাড়ি ছেড়ে দিবে। আমরা আবার টুইন পিক যাব। ”
‘ এলিজাবেথের চেহারায় স্বচ্ছ এক অনাবিল প্রশান্তি ও উচ্ছ্বাস ফুটে ওঠে। অনেকদিনের আটকে থাকা অনুভূতিগুলো ধীরে ধীরে মুক্তি পেয়ে ছুটে আসছে। বৃক্ষপটে হালকা অনুভূত হয় আর আনন্দে ভরে উঠে । চারপাশের সবকিছু সুন্দর ও উজ্জ্বল লাগতে শুরু হয়। উৎফুল্ল গলায় চেঁচিয়ে বলল, ” আসছি ভালো মানুষ। ”
” আই থিংক ইট’স টাইম ফর ইউ টু রিটায়ার ন্যাসো। ”
‘ঠৌঁট কামড়ে নিশ্বাস আঁটকে চোখ বন্ধ করে রাখে ন্যাসো। নত দৃষ্টি নিবিষ্ট। পাশেই চুপসানো মুখে দাঁড়িয়ে আছে লুকাস। আপাতত আলাদিন বা তার দলবল কেউই এখানে নেই। গাঁ ছমছমে পরিবেশ। নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে সম্পূর্ণ কক্ষ জুড়ে।
” সরি বস। ”
‘ হাতে থাকা ওয়াইনের গ্লাস ছুড়ে মারে রিচার্ড। ঝনঝন শব্দে ভেঙে চুরমার হলো, ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরল মেঝেতে। রিচার্ডের কপালের পাশের রগগুলো ফুলে ফেপে উঠেছে। তিরতির করে বাড়তে থাকে ক্রোধ। ঝাঁঝাল কন্ঠে চেঁচাল, ”
” ধ্যাঁন কোথায় থাকে তোমার? বাংলাদেশ থেকে আসার পর থেকেই দেখছি সবকিছুতে অমনোযোগী তুমি। ট্রেনিং কি সব ভুলে গিয়েছ? কাল আর কয়েক সেকেন্ড দেরি হলে কি হতো হ্যাভ ইউ এ্যনি আইডিয়া ইউ ফা*কিং ইডিয়েট।
‘ থেমে, বজ্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করল লুকাসের উপর। রিচার্ডের রক্ত লাল চোখ দেখে বুক শুকিয়ে এলো লুকাসের। উগ্রতা ভেঙে হিংস্র প্রাণীর মতো গর্জে উঠল রিচার্ড আবারো, ” তোমার কাছে তো হ্যান্ডহেল্ড মেটাল ডিটেক্টর ছিল। ছিল না? আর ইউ গাইজ ফা*কিং কিডিং উইথ মি? ”
‘ মিইয়ে যায় দুজনেই। আবারো শুনা গেল রিচার্ড হুংকার। ন্যাসোর দিকে তাকিয়ে কর্কশ গলায় চেঁচিয়ে বলল, ” গো ব্যাক টু বাংলাদেশ। ”
‘ ন্যাসোর অভিব্যক্তি নিটল। দু’ কদম এগিয়ে আসল। কণ্ঠে অনুতপ্ততার রেশ। নিচু স্বরে বলল, ” সরি বস। গিভ মি অন মর চান্স। ”
” রিচার্ড কায়নাতের কাছে সুযোগ বলে কিছু হয় না। প্রবাবলি ইউ ফরগট দ্যাট। ”
‘ শক্ত গোছের ন্যাসোর চেহারায় এবার ফুটে উঠল ভীতি। পরপর তিনবার ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে আবারও বলতে চাইল, ” লাস,,,
‘ থামিয়ে দিল রিচার্ড। কাউচে বসা অবস্থায় ন্যাসোর দিকে না তাকিয়ে একটা ফাইল এগিয়ে দিল । ন্যাসো রিচার্ডের পিছন দাঁড়িয়ে থেকে ফাইলটি হাতে নিল। রিচার্ডের ঠৌঁটের কোণায় জড় হয় শয়তানি বিদঘুটে হাসি।
” সন্ধ্যায় ফ্লাইট। ”
” কাজ হয়ে যাবে বস। ”
” গো। ”
‘ তাৎক্ষণিক বেরিয়ে যায় ন্যাসো। লুকাস ন্যাসোর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে কাজের জন্য বেস্ট অফ লাক জানালো। বিশাল আকৃতির পেন্ট হাউজে এখন শুধু তারা দুজন। লুকাসের ফোন ক্রমাগত রিং হচ্ছে। তপ্ত শ্বাস ফেলে ফোন নিয়ে রিচার্ডের নিকট এগিয়ে আসল লুকাস। মলিন স্বরে আওড়ায়, ” বস ফাদার। ”
‘ সহজ ভঙ্গিতেই ফোন হাতে নিল রিচার্ড। লুকাস অবাক হল কিছুটা। ভেবেছিল বারংবারের মতো এবারও কল তুলবে না। স্পিকারে দিল রিচার্ড। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। ওপাশ থেকে শোনা যায় একজন মধ্যে বয়স্ক লোকের ভারিক্কি কর্কশ কণ্ঠস্বর। যা রিচার্ডের গুরুগম্ভীর ভারি স্বর কেও ছাড়িয়ে।
” রিদ মাই সান। ”
” ইয়েস ফাদার। ”
” এস সোন এস কাম ব্যাক টু ইতালি। তুমি ছাড়া এদিকে সবকিছু এলোমেলো হয়ে আছে। তোমার সই ছাড়া পরবর্তী প্রোজেক্ট এগোতে পাচ্ছে না । মিলিয়ন, মিলিয়ন টাকা লস হচ্ছে। ”
‘ ঠোঁট গোল করে সিগারেটের বিষাক্ত ধোঁয়ার সাথে গরম নিশ্বাস ছাড়ে রিচার্ড। অতঃপর সহজ সাবলীল গলায় উত্তর দিল, ” আমি এসে সব সামলে নিব ফাদার ডোন্ট ওয়ারি। ”
‘ কিছুটা ক্ষিপ্ত হল ওপাশের জন। তিরিক্ষি মেজাজ দেখিয়ে বলল, ” সব খবর আমারে কানে আসছে রিদ। ফালতু ঝামেলায় ঝাড়াচ্ছো কেন? মেয়ে লাগবে তোমার ! ইতালি আসো মেলা বসিয়ে দিব আমি তোমার জন্য। ”
‘ কাউচে গাঁ এলিয়ে আয়েশ করে শুলো রিচার্ড। এক দলা সাদা বাষ্পের মতো ধোঁয়া শূন্যে উড়িয়ে দিয়ে বলল, ” অনেকদিন পর অনেক ইন্টারেস্টিং একটা গেইম পেয়েছি ফাদার। শেষটা একটু দেখায় যাক।” বলে অপর পাশ থেকে কিছু শোনার অপেক্ষা না করে কল কেটে দেয়। পরপর হাতে অদ্ভুত রকমের দেখতে একটা ঘড়ির দিকে এক পলক তাকিয়ে ওঠে দাঁড়ায়। কালচেরে ঠৌঁট জুড়ে বিরাজ করছে রহস্যময় বক্র হাসি। ঘড়িটা রিচার্ড সবসময়ই সঙ্গে রাখে, তবে হাতে খুব কমই। রিচার্ডের হাঁটা দেখে পিছন নিল লুকাস। কদমে কদম মেলাতে মেলাতে বলল, ” বস আমি আসব?
‘ পায়ের তালের মতোই রিচার্ডের গমগমে গলা,বলল,
” নোপ। ”
” কোথায় যাচ্ছেন বস? ”
“মধু খেতে। ”
‘ লুকাসের কাছে লাগল সে দুনিয়ার সবথেকে আশ্চর্যজনক কথা শুনলো। তাও রিচার্ডের মতো তেতো মানুষের কাছ থেকে। তবে তা বেশিক্ষণ আমলে রাখল না। খাবারের কথা শুনে থেমে যাওয়া গতি আবার বাড়ায়। এক প্রকার দৌঁড়ে দিল। রিচার্ডের লম্ব কদম এতোক্ষণে গাড়ি পযন্ত পৌঁছে গিয়েছে। লুকাসের ব্যগ্র কন্ঠস্বর, ” বস আমিও যাব। শুনেছি এখানো কোন রেস্টুরেন্টে ভালো মধু পাওয়া যায়। ”
ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ১৫
‘ ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসল রিচার্ড। বজ্রপাতের মতো গম্ভীর কণ্ঠে শুধায়, “এই চাকে শুধু রিচার্ডের জন্যই মধু জমে। ”
‘ লুকাসের মুখ মলিন হয়। গাড়ির উইন্ডোর কাছটায় খানিকটা ঝুঁকে মলিন স্বরে বলে, ” বস আমি আসি? ”
” নো আই নিড প্রাইভেসি।
‘ বাতাসের সাথে ধুলো উড়িয়ে চলে গেল রিচার্ডের ব্ল্যাক সার্ক। এবার লুকাসের মাথায় সাত আসমান ভেঙে পড়ল। প্রাইভেসি? কেন? তাও রিচার্ডের মতো অবাঁধের? আশ্চর্য! আশ্চর্য!
