ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৩০
মিথুবুড়ি
‘নয়টার পর এলিজাবেথের চেতনা ফিরেছে। তবে এখনও পর্যন্ত মুখ দিয়ে একটি শব্দও বের হয়নি। এলিজাবেথের ভেতরে এক ধরনের চাপা অস্থিরতা। হাঁটুতে মুখ গুঁজে নিঃশব্দে বসে রয়েছে অনেকক্ষণ ধরে। তাকবীরও ওকে কোনো প্রশ্ন করেনি কিংবা বাঁধা দেয়নি। শুধু পাশে চুপচাপ বসে রয়েছে, হয়তো অপেক্ষায়, কখন এলিজাবেথ তার এই নীরবতার জাল ছিঁড়ে কথা বলবে।
‘কিছু মুহুর্ত পর, এলিজাবেথের নিরবতা ভাঙল। ওর নিস্তেজ স্বর একটি দীর্ঘশ্বাসের মতো ঘরের নিস্তব্ধতাকে ছুঁয়ে গেল।
“আমি আসলেই অলক্ষী।”
“তুমি সৃষ্টির সেরা।”
‘তাকবীরের কণ্ঠে ভরসার দৃঢ়তা। তবুও এলিজাবেথ তাকাল না তাকবীরের দিকে। অন্তরের গভীরে ঝড় উঠেছে। ক্ষণে ক্ষণে আঘাত হানছে, বুকের ভেতর গুমরে ওঠা কষ্ট তাজা উষ্ণ অশ্রুর মতো ঝরে পড়ছে।
“বারবার আমার সাথেই কেন?”
‘তাকবীর ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। টুল থেকে উঠে বিছানায় গিয়ে বসল, দূরত্ব রেখে। এলিজাবেথের জমে থাকা কষ্টময় উপস্থিতির দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলল,
“উপরওয়ালা তাঁর প্রিয় মানুষদেরই সবচেয়ে বেশি পরীক্ষা নেন। কারণ তিনি তাঁদের অনেক বেশি ভালোবাসেন।”
‘কার্নিশ কোণ থেকে আঁটকে রাখা বাঁধ এবার ভেঙে পড়ল। ভেজা চোখে এলিজাবেথ তাকাল তাকবীরের দিকে। কণ্ঠ বুজে এলো কান্নার ভারে। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল,
“ওরা কারা ছিল? আমি কি এমন ক্ষতি করেছি মানুষের? কেন বারবার আমাকে মারতে চায়?”
‘এলিজাবেথের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া প্রতিটি অশ্রুকণা যেন তীরের ফলার মতো। তা শুধু মাটিতে পড়ে না, সোজা গিয়ে বিঁধে তাকবীরের হৃদয়ে। তাকবীর গভীরভাবে তাকাল এলিজাবেথের ভেজা চোখের দিকে। চোয়াল শক্ত করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“যার হাতই থাকুক এই ঘটনার পিছনে… কেউ ছাড় পাবে না। ওদের শাস্তি হবেই। দেখে নিব আমি।”
‘এলিজাবেথের ভেতরটা কেঁপে উঠল। ভয় মাখা চোখে তাকিয়ে তড়িগড়ি করে বলল,
“দয়া করে আপনি কোনো রক্তের খেলায় মেতে উঠবেন না। আমি আর কাউকে হারাতে চাই না। আমার জন্য আর কোনো প্রিয়জনকে হারানো সহ্য হবে না। কথা দিন, আপনি প্রতিশোধের খেলায় নামবেন না।”
‘তাকবীর এক মুহূর্তের জন্য চুপ করে রইল। চোখে কঠিন সংকল্পের ছায়া, কিন্তু এলিজাবেথের কণ্ঠে আকুলতা ওকে থমকে দিল। গভীরভাবে শ্বাস নিয়ে নিচু স্বরে বলল,
“আমি যা-ই করি, তোমার জন্য করব। তবে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, তোমার শান্তি নষ্ট হওয়ার মতো কিছু করব না।”
‘তাকবীরের মুখে শান্ত কথা থাকলেও ভেতরে প্রতিশোধের আগুন জ্বলছিল। এই চাপা উত্তাপ এলিজাবেথও অনুভব করল। ওর অস্বস্তি বেড়ে উঠতে লাগল। তাকবীর বুঝতে পারে। নিজেকে সংযত করে এলিজাবেথকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল। ফিচলে এক হাসি ফুটিয়ে বলল,
“আরে ভয় পাচ্ছো কেন! কথা দিয়েছি তো আমি, কিছু করব না। তুমি স্বাভাবিক হও, সব ঠিক হয়ে যাবে।”
‘তাকবীরের হাসি কৃত্রিম হলেও এলিজাবেথের ভেতরের শঙ্কা এক মুহূর্তের জন্য হলেও কমল। কিন্তু এই প্রশান্তি কতটা সত্যিকারের, তা কারও জানা নেই। হঠাৎ এলিজাবেথের কণ্ঠে আতঙ্ক আর যন্ত্রণা একসঙ্গে ফুটে উঠল,
“ঐ নিকৃষ্ট লোকটা… মনে হয় রেশমা মা আর শিহাব ভাইকে কিছু করে ফেলেছে।”
‘তাকবীর চুপ রইল। সত্যিটা প্রকাশ করার সাহস পেল না। তাকবীরের নীরবতা আরও ভারি করে তুলল পরিস্থিতি। এলিজাবেথের গলা আবার ধরে এলো। কাঁপা কণ্ঠে বলল,
“শয়তানটা আমার সবকিছু ধ্বংস করেও, বারবার কেন আমাকে বাঁচাতে আসে?”
‘তাকবীরের ভিতর ক্ষুব্ধতা থাকলেও শান্ত স্বরে উত্তর দিল,
“এলোকেশী, নিজের উপর এত প্রেসার দিও না। তোমার শরীর খুব উইক। কাল ডক্টরের কাছে নিয়ে যাবো তোমাকে।”
‘কিন্তু এলিজাবেথ মানতে চাইল না। ভেতরের অস্থিরতা থামছিল না। বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল চেতনা হারানোর আগের সেই মুহূর্ত। রিচার্ডের সমুদ্র নীল চোখজোড়া, যেগুলোতে একটুও ভয় বা অস্থিরতা ছিল না। বুকের ভেতর এক অদৃশ্য আগুন জ্বলছিল অস্ফুট, অথচ প্রচণ্ড। রিচার্ডের সেই চোখ এলিজাবেথকে নীরবে তাড়া করে ফিরছিল। তাকবীর ধৈর্য ধরে কিছুক্ষণ সময় নিল। ধীরে ধীরে এলিজাবেথকে শান্ত করল। কথা ঘুরিয়ে স্বাভাবিক আলোচনায় নিয়ে এলো।
‘দু’জনেই চেষ্টা করল চাপা অস্থিরতা সরিয়ে ফেলে স্বাভাবিক হওয়ার। আর এই অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যেও একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠল, তাদের বন্ধুত্ব। এটি এমন এক বন্ধুত্ব, যেখানে এলিজাবেথ সম্পূর্ণ মুক্তমনা। ওর প্রতিটি চিন্তা, প্রতিটি অনুভূতি তাকবীরের সামনে খোলা বইয়ের মতো। আর তাকবীর, তার নিজের মতো করে সবকিছু সামলে এই বন্ধুত্বের ভারসাম্য ধরে রাখার চেষ্টা করছে। কঠিন সময়েও তাদের এই বোঝাপড়া এক ধরনের শান্তির ছোঁয়া এনে দেয়।
“আচ্ছা ভালো মানুষ আপনি তখন ভিতরে গেলেন কিভাবে?”
‘তাকবীরের হাসি ধীরে ধীরে মিলিয়ে গিয়ে গম্ভীর স্বর ধারন করল। বলল,
“তখন বাইরে অপেক্ষা করছিলাম সময় লক্ষ্য করলাম, কতগুলো গাড়ি ভিতরে ঢুকছে। প্রথমে আমলে না নিলেও, পরে গুলির শব্দে ছুটে গেলাম। ভাগ্য ভালো, ঠিক সময়েই পৌঁছেছিলাম।”
“ওহ্হহহহহ!” ঢং করে দীর্ঘ টান দিয়ে বলল এলিজাবেথ, যেন তাকবীরের কথায় অতিরঞ্জনের ইঙ্গিত করছে। মুহূর্তেই দুজনেই হেসে উঠল। হঠাৎ তাকবীর উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটু গেঁড়ে মেঝেতে বসে পড়ল। এলিজাবেথ ভ্রু কুঁচকে তাকাল তাকবীরের এই অদ্ভুত আচরণের দিকে। হঠাৎ তাকবীর কোনো কথা না বলে খাটের নিচ থেকে একটা বাস্কেট বের করল। দেখামাত্রই এলিজাবেথ চিৎকার করে উঠল। খপ করে বাস্কেটটা ছিনিয়ে নিয়ে ভিতর থেকে বিড়ালটিকে বের করে এনে বুকের সাথে মিশিয়ে আদর করতে লাগল। চোখে-মুখে আনন্দে ঝলমল করছিল। তাকবীর মনোমুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইল তার এলোকেশীর দিকে। এলিজাবেথের উচ্ছ্বল হাসি আর উজ্জ্বল মুখ ওকে টেনে ধরছিল। হাসিমাখা মুখে এলিজাবেথ তাকাল তাকবীরের গভীর চোখে। বলল,
“জুলিয়েট এখানে আসল কীভাবে?”
‘তাকবীর মিষ্টি হেসে এলিজাবেথের পাশে বসে বলল,
“আসার সময় সাথে করে নিয়ে এসেছি।”
‘তাকবীর বিড়ালটির দিকে চেয়ে হেসে বলল,”কিউটি, তোমার নাম বুঝি জুলিয়েট?”
“না ওর নাম মায়া।”
‘এলিজাবেথ বিড়ালটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে খোশমেজাজে বলে দিল অবলীলায়। তাকবীর গদগদকণ্ঠে বলল,
“তাই। আপনার নাম বুঝি মায়া। মায়ার নাম মায়ার মতো মায়াবী। সম্ভবত আমার এলোকেশীর কপি ক্যাট এটা৷”
‘এলিজাবেথ হাসতে গিয়েও থেমে যায়। এতোক্ষণে খেয়ালে আসে, বলতে বলতে কি বলে ফেলেছে। এলিজাবেথ বের হতে চাই দ্রুত এমন অস্বস্তিকর মুহুর্ত থেকে। তারাতাড়ি করে কথা পাল্টে ফেলল।
“আচ্ছা কিছু খেললে কেমন হয়?”
‘তাকবীর ভ্রু গুছিয়ে ভাবুক ভঙ্গিতে বলল,”আচ্ছা, কি খেলা যায়?”
‘এলিজাবেথ এক মুহূর্তও না ভেবে বলে উঠল, “হাউ অ্যাবাউট ট্রুথ অ্যান্ড ডেয়ার?”
“ওকে কি নিবে বল।”
“আমি ভাই মেয়ে মানুষ এতো সাহস নেই ডেয়ার নেওয়ার৷”
‘ঠোঁট কামড়ে ভ্রু গুছিয়ে দেখল তাকবীর এলিজাবেথকে। পরপর কিছুক্ষণ ভেবে সবেগে অবিলম্বে আওড়াল,
“চাইল্ডহুড ক্রাশ কে ছিল?”
‘এলিজাবেথ হেসে সঙ্গে সঙ্গে গদগদ করে উত্তর দিল,”সালমান খান।”
‘চোখ বড় বড় হয়ে গেল তাকবীরের,বলল” আরে, আমারো তো।”
‘তাদের হাসির রিনঝিনে শব্দে নিস্তব্ধ ঘরের পরিবেশ গরম হয়ে উঠল। এবার খেলার পালা তাকবীরের। এলিজাবেথ ভ্রু নাচিয়ে বলল, “বলুন, ট্রুথ না ডেয়ার?”
‘তাকবীর কোনো সময় নষ্ট না করে তড়িঘড়ি করে বলল,
“ট্রুথ।”
‘এলিজাবেথ চোখ ছোট করে তাকাল। ভেংচি কেটে সরু গলায় বলল, “পুরুষ মানুষ! তাও ডেয়ার নেওয়ার সাহস নেই?”
‘তাকবীর হেসে আঙুলের অর্ধেক ভেঙে দেখাল, “আমি মানুষটা বড়সড় হলেও, আমার কলিজাটা এতোটুকু।”
‘এলিজাবেথ ঠোঁট বাঁকাল। অতঃপর চিন্তাভাবনার ভান করে বলল, “জীবনের একটা লজ্জাজনক সত্যি বলুন। যেটা আজও পর্যন্ত কেউ জানে না।”
‘তাকবীর এক মুহূর্ত থেমে হেসে বলল, “বলব?”
‘এলিজাবেথ আগ্রহে উপরে-নিচে মাথা ঝাঁকাল, “হুম!”
‘তাকবীরের কৃষ্ণগহ্বরের শ্যামলা গড়নে লাল আভা ফুটে উঠল। যেন চেহারায় খানিকটা লজ্জার ছাপ পড়ল। একগুঁয়ে দৃষ্টিতে তাকাল এলিজাবেথের দিকে।একটু থেমে নরম গলায় বলল, “একটা সত্যি বলছি… যেদিন প্রথম তোমার হাত ধরেছিলাম, সেদিন আমার এই শক্ত হাত কেঁপে উঠেছিল।”
‘এলিজাবেথের চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল। এক মুহূর্তের জন্য কথা হারিয়ে ফেলল। তাকবীরের সরল স্বীকারোক্তি ঘরের নিস্তব্ধতাকে আরও গভীর করে তুলল। তাকবীর মিটিমিটি হাসছে। হেসে কাব্যিক ভঙ্গিতে বলল ,
“তোমার চাহনি যদি আমার দেহ পুড়াতে পারে,
তাহলে তোমার মিলনে আমার আত্মা কোথায় পৌঁছাবে, তা কল্পনাতেও ভীত এলোকেশী।”
‘এলিজাবেথের বুকের ভেতর চাপ দিয়ে ধরে রাখল, তাকবীরের গভীর অর্থের কথাগুলো ওর হৃদয় কাঁপিয়ে দিচ্ছে। চেহারায় রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়ল। তাকবীরের চোখে এক অদ্ভুত উজ্জ্বলতা জ্বলে উঠল। কণ্ঠস্বরও গভীর আর আবেগপ্রবণ হয়ে খাদে নেমে গেল।
“যেভাবে আত্মা আর দেহ একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, সেভাবে তুমিও আমাকে তোমার আত্মার মতো সঙ্গে নিয়ে যেও। মিশে যাওয়া আত্মায়, আমাদের আত্মাও যেন বিলীন হয়ে যায়।”
‘তাকবীরের কথাগুলো বাতাসের প্রতিটি কণায় প্রতিধ্বনি তুলল। এলিজাবেথ স্থবির হয়ে তাকিয়ে থাকল তাকবীরের দিকে। দুটো খাদযুক্ত দৃষ্টি মিলে গেল৷ তাকবীর হঠাৎ আবেগপ্রবণ হয়ে এলিজাবেথের হাত আঁকড়ে ধরতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই দরজার পাশ থেকে হস্তদন্ত হয়ে প্রবেশ করল সেই বয়স্ক মহিলা। তার উপস্থিতি এতটাই আকস্মিক আর দ্রুত ছিল যেন তিনি আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন বাইরে।
‘তাকবীর মুহূর্তেই সরে এলো এলিজাবেথের থেকে। এলিজাবেথও মায়াকে বুকে চেপে ধরে খানিকটা পিছিয়ে গেল। তাকবীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মহিলার দিকে তাকাল। স্বর ছিল চাপা কিন্তু স্পষ্ট, “খালা, এভাবে কেউ কারোর ঘরে ঢোকে? এত বছর এই বাড়িতে থেকেও নিয়মকানুন শেখা হলো না?”
‘মহিলার মুখে বিব্রত ভাব ফুটে উঠল। আমতাআমতা করতে থাকল,”না মানে বীর বাবু, মেডাম তো রাতের খাবার খায়নি। সে-জন্যে ডাকতে এসেছিলাম।”
“যান আপনি। টেবিল রেডি করুন৷”
‘মাথা নাড়িয়ে চলে গেল মহিলা। তাকবীর আবারও ফিরে তাকায় এলিজাবেথের দিকে। স্মিত হাসল, পরিস্থিতি নরমাল করার জন্য।
“চল বাকিটুকু শেষ করি। এবার কিন্তু তোমার পালা।”
‘হালকা হাসল এলিজাবেথ৷ “ঠিক আছে। কি নেওয়া যায়?”
“এইবার কিন্তু ডেয়ারই নিতে হবে।”
‘ঠোঁট ফোলাল এলিজাবেথ। তাও মানল না তাকবীর। বাধ্য হয়ে এলিজাবেথকে ডেয়ারই নিতে হলো। প্রশ্ন ছুড়লো তাকবীর।
“জীবনের অবিচ্ছেদ্য একটা সত্যের কথা বলে সাহসের প্রমাণ দাও।”
‘হাসি থেমে গেল এলিজাবেথের। গম্ভীর হলো মুখভঙ্গি। নিচু স্বরে বলল,”আমার জীবনের সবকিছুই চরম সত্য। আর সকলই কিছুই জানেন আপনি, ভালো মানুষ।”
‘তাকবীর অতি সাবলীল গলায় বলল,”আমি যেটা জানি না সেটা জানতে চাই এলোকেশী।”
‘এলিজাবেথ মনমরা এক হাসি দিয়ে আনমনে বলে উঠল,
“কিছু একটার শূন্যতা ছিল, যা পূর্ণতার সীমা ছুঁতে পারেনি। কেউ একজন ছিল, যে আমার ছায়া, তবু আলোর মতো অধরা।”
‘তাকবীরের বুকের ভেতর এক অদ্ভুত চাপ অনুভূত হলো। কিছু প্রশ্ন থাকে, যেগুলো হৃদয় না চাইলেও কৌতূহল বাধ্য করে জিজ্ঞেস করতে। গলার ভরাট কণ্ঠে তাকবীর অবশেষে জানতে চাইলো,
“প্রেমে পড়েছিলে তুমি… কারো?”
‘এলিজাবেথ চোখ বন্ধ করল। সেই মুহূর্তে ওর মুখে ফুটে উঠল এক গভীর, কল্পনায় মিশে যাওয়া হাসি। এলিজাবেথের গলায় একধরনের স্বপ্নের ছোঁয়া, তবু এক সীমাহীন বেদনার মায়া।
“পড়েছি তো প্রেমে আমিও পড়েছিলাম সেই কবেই, এক কল্পপুরুষের প্রেমে। তাকে প্রথমবার দূর থেকে দেখেছিলাম, একটুখানি। সেটুকুতেই ছিল আমার সর্বনাশ। সে ছিল এক মুহূর্তের ঝলক, যা আমাকে তলিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। মরতে গিয়েছিলাম, তাকে দেখে বেঁচে থাকার নতুন আশা নিয়ে ফিরে এসেছিলাম। সে না চাইতেও আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল সেদিন। আর সেদিন থেকেই শুরু হলো আমাদের পথচলা। আমি তাকে মনের কোণে সাজিয়ে নিয়েছিলাম নিজের মতো করে_নিখুঁত, নিঃশব্দ, নিগূঢ়। এমন গভীর ভালোবাসায় জড়িয়ে ফেলেছিলাম তাকে, যেন আমার জীবন দিয়ে তার জন্য লড়তে পারি। অথচ, বাস্তবের কোনো সীমানায় তাকে পাইনি। সে রয়ে গেছে আমার কল্পনার রাজ্যে, এক দূর আকাশের তারা হয়ে।”
‘তাকবীর নির্বাক হয়ে বসে রইল। এলিজাবেথের প্রতিটি কথা বাতাসে ঘুরপাক খেয়ে তাকবীরের হৃদয়ে এসে লাগল।
“মানুষ ভালোবাসে পাওয়ার আশায়, আর হারালে নিজেরই ভাঙা হৃদয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে আফসোস করেকেন এত আশা করেছিল? তাই না এলোকেশী।”
‘এলিজাবেথ ভিতরের চাপা কষ্ট চেপে রেখে চোখ খুলল। দৃষ্টি জড়িয়ে গেল তাকবীরের শ্যাম বর্ণে। কুঁকড়ানো চুলগুলো আজ খুব একটা পরিপাটি মনে হচ্ছে না, কিন্তু পাঞ্জাবির সঙ্গে এমনভাবে মানিয়ে গেছে যেন সেটাই ছিল তার জন্য উপযুক্ত। এলিজাবেথের চোখে ভাসছিল তাকবীরের চোখের গভীরে সাঁজানো কষ্টের প্রতিটি রেখা। কখনো কখনো, এলিজাবেথের নিজেকে খুব স্বার্থপর মনে হয় অথচ নিজের কষ্টের গভীরতা সে নিজেই খুঁজে পায় না। ঠোঁট কামড়ে কান্না চেপে এলিজাবেথ বলল, “আমাকে একটু একা থাকতে দিবেন, ভালোমানুষ?”
‘তাকবীর চাপা হাসল, এক মুহূর্তও না দেরি করে উঠে বেরিয়ে গেল। তাকবীরও আর এই মুহূর্তে থাকতে চাইছে না। তাকবীর দরজার বাইরে যেতেই এলিজাবেথ ছুটে এসে দরজা আঁটকে দিল ভিতর থেকে। আবারো ছুটে গিয়ে উপুড় হয়ে পড়ল বিছানায়। বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকে। তাকবীর গেল না, দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে এলিজাবেথের কান্না শুনছিল। জানে না কেন এলিজাবেথ কাঁদছে, কিন্তু আজ তাকবীর এলিজাবেথের কান্না আটকাতে পারল না। আজ, এলিজাবেথ ঠোঁট চেপে কান্না চেপে রাখেনি, নিজের কষ্টের কাছে সারেন্ডার করেছে। কান্নায় ভিজে মনের অভ্যন্তরের ক্ষতগুলো বেরিয়ে আসছে। হঠাৎ, তাকবীরের ঠোঁটে ফিকে এক হাসি ফোটে। হৃদয় থেকে এক অজানা অশ্রু গড়িয়ে যায়। ঠোঁট কোণে হাসি ঝুলিয়ে, বলল,
“নারী জাত সত্যিই বিস্ময়কর সৃষ্টি। যারা হৃদয় উজাড় করে ভালোবাসে, তাদের অনায়াসে ত্যাগ করে ছুটে চলে মরীচিকার মোহে। কিন্তু নিশীথ রাতে, নিঃসঙ্গতার বুকে আফসোসের সুর শুধুই নিজের জন্য বাজে।”
‘ফোঁস নিশ্বাস ছেড়ে চলে গেল তাকবীর। সঙ্গে সঙ্গে এলিজাবেথের কক্ষের ডান পাশের জানালার পাশ থেকেও একটা লম্বা আকৃতির ছায়া সরে গেল।
“খালা।”
‘মহিলা চমকে উঠে, বুকে ফু দিয়ে পিছনে ফিরল। তাকবীর বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে , টানটান হয়ে। মহিলার গলা কাঁপছিল অকারণে।
“জি… জি ছোট সাহেব, আ-আপনি? খা-খাবেন তো? আমি খাবার সাজিয়ে দিয়েছি।”
‘তাকবীর এক পা এক পা করে এগিয়ে এলো কাঁপতে থাকা মহিলার দিকে। চোখে ছিল তীক্ষ্ণ এক দৃষ্টি, গলায় গভীর গম্ভীরতা। নিরেট ঠান্ডা স্বরে বলল,
“চাঁচির মনে হচ্ছে, প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন, তাই না ?”
‘মহিলা ভরকে গেল, আমতাআমতা করে বলল,”মা-মানে?”
‘তাকবীরের কণ্ঠ আরো গম্ভীর হয়ে উঠল, “মানে, যখনই আমি আমার স্ত্রীর আশেপাশে যাই, তাকে ছুঁতে যাই, তখনই আপনি চলে আসেন। সারাক্ষণ আমি স্ত্রীর সঙ্গে আঠার মতো জড়িয়ে থাকছেন, কাজ ছাড়া। আমি আমার অচেতন স্ত্রীর দিকে সাহায্যের হাত বাড়াই, গাড়ি থেকে কোলে তুলে তাকে ভিতরে নিয়ে আসতে গেলাম, তার আগেই আপনি আগ বাড়িয়ে অন্য মেডদের নিয়ে এগিয়ে আসেন তাকে নিতে। জিনিসগুলো খুবই অদ্ভুত, না?”
‘মহিলা তাকবীরের কথায় কোনো উত্তর দিতে পারে না। থরথর করে কাঁপছে তার হাত। তাকবীরের কণ্ঠস্বর এবার উঁচু হলো। রুষ্ট গলায় বলল,
“এতোদিনে নিশ্চয়ই আমার, আমার জাত সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা হয়ে গিয়েছে চাঁচি। কাল থেকে আপনার ছায়াও যেন না দেখি এই বাড়িতে।”
‘হনহনিয়ে চলে গেল তাকবীর। মহিলার শরীরের কাঁপন তবুও কমে না। কাঁপতে কাঁপতে শাড়ির কচির কাছে গুঁজে রাখা ফোন বের করে, কল করল কারোর নাম্বারে।
‘ন্যাসো সম্পূর্ণ বাগানবাড়িতে একঝলক চোখ বুলিয়ে রুমে প্রবেশ করল। হাতে দুধের গ্লাস। কিছুক্ষণ আগেই ইবরাতকে রাতের খাবার আর ঔষধ খাইয়ে বাইরে গিয়েছিল। তবে সেই আঘাতের পর গুরুতর কিছু না হলেও ইবরাতের মাথায় দুটো সেলাই পড়ে। ইবরাত খাটের মাঝখানে চুপটি মেরে শুয়ে আছে। প্রতিদিনের মতো আজ কোনো চঞ্চলতা নেই, একদম নীরব। ন্যাসো রুমে ঢোকা মাত্রই ছুটে এসে কোলে না উঠে চুপ করে শুয়ে থাকার দৃশ্য দেখে ন্যাসোর বুকটা চেপে ধরল। তপ্ত শ্বাস ফেলল এগিয়ে গিয়ে ন্যাসো ইবরাতের পাশে বসে, টানলেও আজ একদমই উঠে না ইবরাত। সাধারণত ন্যাসো জোর করে তুলে দুধ খাওয়ালেও আজ কোনো বাধ্যতা সৃষ্টি করেনি। ইবরাতের মনের অবস্থা বুঝে ন্যাসো ধীরে ধীরে ওর পাশে শুয়ে পড়ল চুপচাপ। অন্যদিনের মতো ইবরাত আজ ন্যাসোর বুকে এসে জাপ্টে পড়ল না। ন্যাসো কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকল, অতঃপর অগত্যা নিজেই ইবরাতকে একটানে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিল। ন্যাসোর বুকের মাঝে ইবরাত এক মুহূর্তে হারিয়ে গেল, কারণ তাদের দৈহিক গঠনের মধ্যে এতই বৈসাদৃশ্য। পাশাপাশি, তাদের গায়ের রঙের মধ্যে আকাশ সমান ভিন্নতা ছিল। তবুও, সে মুহূর্তে কিছুই মেটার না। দুটো হৃদয় একে অপরকে অনুভব করছিল, সব পার্থক্য ভুলে, একে অপরের পাশে।
‘আজ যখন হামলা হয়, তখন সবিতা বেগম কিচেনেই ছিল। সন্ত্রাসীরা যখন উপরে অস্ত্র হাতে যাচ্ছিল, সবিতা বেগম দেখেও এগিয়ে যায়নি, মেয়েকে বাঁচাতে, আর সকল মায়েদের মতো। তিনি নিজেকে বাঁচানোর জন্য স্টোর রুমে গিয়ে লুকিয়ে ছিল। তবে সরল ইবরাত তা জানত না। ন্যাসো গিয়ে যখন রুমের লক খুলে ইবরাতকে বের করে, ইবরাত ছুটে গিয়েছিল মায়ের জন্য। কিন্তু পরবর্তীতে যা দেখতে পায়, তা ওর ছোট কোমল মন একদম ভেঙে দেয়। এক মুহূর্তে ওর পৃথিবী চুরমার হয়ে যায়। সেই থেকে ইবরাতের বিষন্নতা শুরু হয়। এরপর আর রুম থেকেও বের হয়নি,এমনকি সবিতা বেগমের হাতের রান্না খায়নি। বাধ্য হয়ে ন্যাসো নিজেই বৌকে সুপ রেঁধে খাইয়েছিল।
“আমি কি আম্মুর পেটের মেয়ে না?”
“তোমার জন্মের সময় আমি ছিলাম না তো জান।”
‘চিমটি কাটলো ইবরাত ন্যাসোর বুকে। ফিক করে হেসে দিল ন্যাসো। ইবরাতের মাথাটা ওর শক্ত বুকে, শক্ত করে চেপে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। ইবরাতের চোখের কোণা বেয়ে এক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে ন্যাসো উঠে বসে। আলো জ্বালায়। ইবরাতকে টেনে তুলে দু’হাতের আজলায় চেপে ধরল ওর অবয়ব। কিছুটা শক্ত গলায় বলল,
“শেষ ভালোবাসা দুইদিনেই?”
‘ইবরাত ভয় পেয়ে গেল। শুষ্ক ঢোক গিলে বলল,”মানে?”
“তখন তো বিয়ের আগে বলতে আমাকে পেলেই হবে, আর কিছু লাগবে না। তাহলে এখন কষ্ট পাচ্ছো কেন অন্যদের কারণে? আমি থাকাটা কি তোমাকে একটু আনন্দ দিচ্ছে না?”
‘সঙ্গে সঙ্গে ইবরাত হামলে পড়ল ন্যাসোর বুকে। ছোট্ট শরীরটা কাঁপছিল কান্নার চাপে। ন্যাসো কিছু বলল না, বাঁধাও দিল না। ওকে নিজের কোলের ওপর বসিয়ে দু’হাতে কোমর পেঁচিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। এই জড়িয়ে ধরা ওদের সব ভাঙা অংশকে জোড়া লাগিয়ে দিল। রুমে শুধু নাক টানার শব্দ শোনা যাচ্ছে। ন্যাসো ইবরাতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নির্ভয় দিচ্ছে। ছোট্ট ইবরাতের কান্নার ভার ন্যাসোর বুকে জমছিল, কিন্তু ন্যাসো কিছু বলল না শুধু শক্ত করে ধরে রাখল।
“জান অনেকক্ষণ হয়েছে আর না, থামো।”
‘ইবরাত থামতে চাইছিল না, শেষমেশ থামল ন্যাসোর কঠিন ধমকে। ন্যাসো ইবরাতের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে শান্ত গলায় বলল,
“আমার এই শক্ত মনেও কষ্ট হয় তোমার কান্নায়। আর কেঁদো না, রাত।”
‘ন্যাসোর কথায় প্রশান্তির একটা ঝলক এসে পড়ল ইবরাতের মুখে। কান্না থেমে গেল, ঠোঁটে ফিকে হাসি ফুটল। ন্যাসো আবারও ইবরাতকে বুকের সাথে মিশিয়ে শুইয়ে পড়ল। হঠাৎ বাইরে থেকে গাড়ির শব্দ ভেসে এলো। ইবরাত, ন্যাসোর লোমহীন বুকে মুখ গুঁজে রেখে মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“কে আসল এখন?”
‘ন্যাসো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখল। সাড়ে এগারোটা বাজে। এক মুহূর্ত থেমে বলল, “বস।”
‘ইবরাত কৌতূহল নিয়ে বলল, “কোথায় গিয়েছিল ভাইয়া? আপনারা না একসাথেই ছিলেন?”
‘ন্যাসো চোখের পাতা সামান্য নামিয়ে ক্লান্ত গলায় বলল,
“সন্ধ্যায় একসাথেই বেজমেন্ট থেকে বেরিয়েছিলাম। তবে পরে বস কোথায় যেন গেল।”
“কোথায় গিয়েছিল?”
‘ন্যাসো ঠোঁটে হালকা বিদ্রুপের হাসি টেনে বলল, “কোথায় আর যাবে? দেশে আসার পর নিজের বাড়িতে থেকেছে কয়দিন? এত বড় রাজপ্রাসাদ রেখে রাস্তায় থাকে, গাড়িতে।”
_থেমে,
“আচ্ছা, ঘুমিয়ে পড় রাত। তোমার শরীর খুব উইক।”
‘ইবরাত সাথে সাথে ন্যাসোর বুক থেকে মুখ তুলে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। চোখে প্রশ্নের ঝলক। ন্যাসোও কপাল কুঁচকালো ইবরাতের এমন চাহনিতে। তবে মুহূর্তেই কারণটা বুঝতে পেরে মুচকি হাসল। ওর মাথা আবারও বুকের সাথে চেপে ধরে, স্নেহের ছায়ায় ঢেকে কম্ফোর্টার জড়িয়ে দিল ন্যাসো।
“এতো অবাক হওয়ার কিছু নেই। ছাড় দিচ্ছি অসুস্থ বলে, ছেড়ে দিচ্ছি না। সুস্থ হলে সব পাওয়া সুধে আসলে মিটিয়ে নিব।”
“আব্বা, ওদিকে কোথায় যাচ্ছেন?”
‘তাজুয়ার থমকে দাঁড়াল, কেঁপে উঠল ভেতরটা। চমকে পিছন ফিরে তাকাল। তাকবীর ভ্রু কুঁচকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তাজুয়ারের চোখে এক মুহূর্তে ভয়ের ছায়া ফুটে উঠল। ঘাবড়ে গিয়ে এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল,
“আমি তো চিলেকোঠার ঘরে যাচ্ছিলাম।”
‘তাকবীরের চিবুক মুহূর্তেই শক্ত হয়ে উঠল। ভেতরের ক্রোধ চেপে রাখতে পারছিল না। এক ধাপ এগিয়ে এসে রুষ্ট গলায় দাঁত পিষে বলল,
“চিলেকোঠা ছাদে, আর ছাদের সিঁড়ি ঐদিকে।”
‘তাজুয়ার শুষ্ক ঢোক গিলতে লাগল। কণ্ঠ শুকিয়ে এল। কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছিল না। তাকবীরের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার উপর ঠিকরে পড়ছিল, এবং সেখান থেকে পালানোর কোনো পথ তাজুয়ার দেখছিল না। তাকবীর আরেকটুখানি এগিয়ে দিয়ে দাপুটে গলায় চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“খবরদার আব্বা আপনার কুদৃষ্টি যদি আমার এলোকেশীর উপর পড়েছে। ভুলে যাবেন না, আমার রক্ত কিন্তু ভালো না। নিজেকে বদলাতে চাচ্ছি, তবে বদলে যায়নি।”
“বীর।”
‘চোখ গলায় চোখ রাঙালো তাজুয়ার। তাকবীরের স্বর আরো গাঢ় হলো।
“আস্তে আব্বা। আমার স্ত্রী ঘুমাচ্ছে।”
‘তাজুয়ারের কথার আগুন নিভে গেছে, কিন্তু চোখে জ্বলে উঠে দহনশীল ক্রোধ।”মস্ত বড় ভুল করছ তুমি বীর, এই মেয়ের জন্য সব ছেড়ে দিয়ে। একদিন এই মেয়েই তোমাকে ছেড়ে চলে যাবে।”
“আমার জীবনে যেন কেউ থাকতে না পারে, সেই ভাবেই আমাকে তৈরি করেছেন আপনি। এখন আর আপনার মুখে এসব কথা মানায় না আব্বা।”
‘তাজুয়ার কর্কশ গলায় বলল,”অকৃতজ্ঞের মতো কথা বলবে না বীর। তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছুই হয়নি। পস্তাবে একদিন তুমি। এই মেয়ে তোমাকে ধ্বংস করে দিয়ে যাবে।”
‘ব্যগ্র পায়ে চলে গেল তাজুয়ার। তাকবীর রেলিঙে কোমর লাগিয়ে সিগারেট ধরালো। দৃষ্টি বন্ধ দরজাতে। ভিতরে ঘুমাচ্ছে এলিজাবেথ, তার এলোমেলো, শখের নারী। তাকবীর মাথা উপর তুলে গালের ভিতরে জমানো সব বিষাক্ত ধোঁয়া উড়িয়ে দিয়ে আনমনে বিরবির করল,
“না তোমার আগমন আমার পাপের রাজ্যে হতো, আর না নিজের লক্ষ্যের পথ থেকে বিচ্যুত হতাম আমি। তাহলে নিজের চোখে নিজের ধ্বংসের মর্মান্তিক প্রতিচ্ছবি এঁকে দেখার অভিশাপ থেকে হয়তো মুক্ত থাকতাম।”
‘পাঞ্জাবির পকেটের ভেতর থেকে হঠাৎ গিজগিজে বিরক্তিকর শব্দে বেজে উঠল ফোনটি। তাকবীর ধীর ভঙ্গিতে আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে ফোন রিসিভ করে কানে তুলল। ওপাশ থেকে ভেসে এল রায়ানের ঘুমজড়ানো স্বর,
“বস, আপনার কথা মতো কাদেরের বাড়ি পুড়ে ছাই না হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে ছিলাম। পা ফুলে গিয়েছে। এখন রাত চারটে বাজে। আমি কি এবার বাড়ি যেতে পারি?”
‘তাকবীর ঠান্ডা স্বরে বলল, “ওকে। আর শোনো, কাদের ওদের হাতে পড়ার আগেই ওকে আমি চাই।”
‘রায়ান হাই তুলতে তুলতে বলল, “বিয়ান কাদেরের পরিবারের সবার কল ট্র্যাক করছে। খুব শিগগিরই ওকে ধরে ফেলব আমরা।”
‘তাকবীরের ঠোঁটে বিদঘুটে এক হাসি ফুটে উঠল। “বিয়ান পারবে, আমি জানি।”
‘রায়ান সম্মতি জানিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থাকল। হঠাৎ স্বর কিছুটা নিচু হয়ে এলো।
“বস, ডক্টরের সাথে কথা হয়েছে?”
‘তাকবীর ধোঁয়ার মেঘ ছেড়ে ঠোঁট গোল করে বলল, “হুমম।”
‘রেয়ান জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে সংকোচের সুরে বলল,
“বস, সব কিছু আবার এরেঞ্জ করতে সময় লাগবে।”
‘তাকবীর ধীর স্বরে জবাব দিল, “হুম, অপেক্ষা করলাম আরও কয়েকটা মাস।”
‘রেয়ানের কণ্ঠে উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট, “কিন্তু বস, এতদিন…? এটা তো আপনার জন্য রিস্ক হয়ে যাবে।”
‘তাকবীর সিগারেটের শেষ টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল, “আমি সব সামলে নেব। কাল থেকে কোম্পানিতে বসব।”
‘রেয়ান হতাশ স্বরে বলল, “এটাই তো রিস্ক, বস। আরেকটু ভেবে দেখলেই হয় না? এতদিনে…”
‘তাকবীরের কণ্ঠে দৃঢ়তা ফুটে উঠল, “আমার ভাবা হয়ে গিয়েছে, রেয়ান।”
‘এক মুহূর্ত নীরবতার পর রেয়ান চাপা গলায় বলল, “উপর থেকে একের পর এক হুমকি আসছে, বস। এভাবে হঠাৎ করে সবকিছু থেকে বেরিয়ে আসা যায় না।”
“রেয়ান আমার মাইন্ড সেটআপ অলরেডি ডান। রাখলাম।”
‘তাকবীর কল কেটে দিল। চোখে-মুখে গভীর ছাপ, ললাটে ভাঁজ আর চোখে অন্ধকার। কিছু সময় পেরিয়ে, হঠাৎ খট করে খুলে গেল এলিজাবেথের রুমের দরজা। এলিজাবেথ ঘুমকাতুরে চোখে বেরিয়ে এলো। তাকবীরকে দেখামাত্র কুঁচকানো চোখ আরও কুঁচকে গেল।
“ভালো মানুষ, আপনি?”
‘তাকবীর তড়িঘড়ি সিগারেট ফেলে পা দিয়ে পিষে দিল, হাতে ধোঁয়া উড়িয়ে হাসল।
“কিহ, ঘুম ভেঙে গেছে?” বলেই চোখ গেল এলিজাবেথের হাতে রাখা পানির জগে। “ও আচ্ছা, পানি খাবে? আমি নিয়ে আসছি।”
“না, না, আপনি যাবেন না। আমি যাচ্ছি। আপনি এতো রাতে এখানে কেন? ঘুমাননি?”
“আমি একটু… “ঠিকানায়” যাচ্ছিলাম। আচ্ছা, সিঁড়ি দিয়ে দেখে নেমো। এদিকটায় একটু অন্ধকার।”
‘তাকবীর কথাগুলো এড়িয়ে গেল, একবারও পিছন ফিরল না। সোজা গিয়ে ঠিকানা নামক রুমের দরজা আটকালো। এই রুমটা এলিজাবেথের রুমের দু’টি রুম পরে। সবসময়ই বাইরে থেকে তালা দেওয়া থাকে। বড় বড় দু’টি তালা। এখানে তাকবীর আর তাজুয়ার ছাড়া কেউ ঢুকতে পারে না। এলিজাবেথ একদিন ঐ রুমের সামনে গেলে, মেড এসে ওকে সরিয়ে দেয়। জিনিসটা সন্দেহজনক হলেও, এলিজাবেথ তেমন কিছু মনে করেনি।
‘এলিজাবেথ অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে তাকবীরের দাঁড়িয়ে থাকা জায়গাটার দিকে। মেঝেতে সিগারেটের জ্বলেপোড়া টুকরো ছড়িয়ে আছে। ধোঁয়ার হালকা গন্ধ এখনো বাতাসে ভাসছে। তাহলে কি সারারাত এখানেই ছিল তাকবীর? একা, নীরব, আর সিগারেটের পর সিগারেট ফুঁকছিল? এলিজাবেথের মনে এক অজানা শঙ্কা খেলে গেল। এই অস্থিরতা, এই গভীর চিন্তা—সবকিছুর মানে কী?
‘ধরিত্রী সোনালি শুভ্র আভায় ঝলমল করছে। সোনালি আলো চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। নতুন দিনের শুরুতে প্রকৃতিও সাজছে। এলিজাবেথ ধীরে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল। চোখে ঘুমের রেশ, কিন্তু তাকবীরের কঠিন গলার নির্দেশ মনে পড়ে গেল,প্রতিদিন সকালে টেবিলে বসে ব্রেকফাস্ট করতে হবে তার সাথে। তাকবীর চায় একটি হ্যাপি, স্বাস্থ্যকর ফ্যামিলি। নিজের চাওয়ার সাথে এলিজাবেথের জীবনেও স্থিরতা আর স্বস্তিতে নিয়ে আসতে চায়। কিন্তু এলিজাবেথের তাজুয়ার দেওয়ানের জন্য নিচে নামাটা সবসময়ই একটা চ্যালেঞ্জ। যদিও তাজুয়ারের সঙ্গে খুব কমই দেখা হয়েছে, কারণ তাজুয়ার বেশিরভাগ সময়ই বাড়ির বাইরে থাকে।
‘এলিজাবেথ ধীরে ধীরে গুটি গুটি পায়ে নিচে নামল। এক অদ্ভুত অনুভূতি ওকে ঘিরে ধরল। যেন কিছু একটা অপেক্ষা করছে ওর জন্য,এলিজাবেথ জানে না ভালো, না খারাপ।যেমন ভয় পাওয়া, তেমনই কাজ। আজ টেবিলে তাজুয়ার বসে আছে। তার পাশেই বসে আছে তাকবীর। পাশে খালি রাখা চেয়ারটা এলিজাবেথের জন্য। তাকবীর এখনো খায়নি, কিন্তু তাজুয়ার নিজের মতো খেতে ব্যস্ত। এলিজাবেথকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাকবীর চোখে এক টুকরো আশ্বাস নিয়ে ওকে ডাকল। ধীর পায়ে এগিয়ে এলো এলিজাবেথ। কিন্তু ঠিক যখন চেয়ারটা টেনে বসতে যাবে, তখনই তাজুয়ারের কঠিন কণ্ঠস্বর ঘরের ভারী নীরবতা ভেঙে দিল।
“এই মেয়ে, তুমি এখানে বসবে না।”
‘এলিজাবেথ থমকে গেল। মাটির দিকে চোখ নামিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ভেতরে ভেতরে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। তাকবীরের মুখে চাপা অস্বস্তি ফুটে উঠল, কিন্তু তাকবীর তার স্বভাবসিদ্ধ শান্ত ভঙ্গিতে তাজুয়ারের দিকে তাকিয়ে ধীর কণ্ঠে বলল,
“আব্বা, আপনার তো খাওয়া শেষ। আপনি উপরে চলে যান।”
‘তাজুয়ার তাকবীরের দিকে কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করে চুপচাপ চেয়ার সরিয়ে উঠে দাঁড়াল। যাওয়ার আগে এলিজাবেথের দিকে এক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুঁড়ে দিল, যেন এলিজাবেথের অবস্থান স্মরণ করিয়ে দিতে চাইল। তাজুয়ার চলে যেতেই ঘরে এক ধরনের নীরব আরাম নেমে এলো। তাকবীর এবার শান্ত গলায় বলল,
“বসো, এলিজাবেথ। এটা তোমার জায়গা।”
‘এলিজাবেথ ধীরে ধীরে চেয়ারে বসে পড়ল। মনের শঙ্কা এখনো কাটেনি, কিন্তু তাকবীরের কথায় এক অদ্ভুত নিরাপত্তাবোধ কাজ করল। পাশে বসে থাকা মানুষটার উপস্থিতি ওকে একটু একটু করে সাহস জোগাচ্ছিল।
‘তাজুয়ার বসার ঘরে গিয়ে টিভি চালু করল। স্ক্রিনে তখনই ভেসে উঠল একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ। বারিধারায় অবস্থিত জে.কে এম্পায়ারের প্রধান কার্যালয়ের সামনে ভিড় করেছে অসংখ্য সাংবাদিক। কালো পোশাকধারী সশস্ত্র গার্ডে গিজগিজ করছে বারো তলা বিশাল বিল্ডিংয়ের চারপাশ।
(নিউজের হেডলাইন স্পষ্ট—“জে.কে এম্পায়ারের আসল মালিকের চাঞ্চল্যকর উদ্ভাবন!”)
‘তাজুয়ার গভীর মনোযোগে খবর দেখতে থাকল। মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। কোনো এক অজানা টান তাকে স্ক্রিনের প্রতিটি দৃশ্য গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে বাধ্য করছিল। লাইভ নিউজে উত্তেজনা তুঙ্গে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর, জে.কে এম্পায়ারের সামনে এসে থামল একটি কালো মার্সিডিস। মুহূর্তের মধ্যে সবার দৃষ্টি গাড়ির দিকে নিবদ্ধ হলো। দরজা খুলতেই বেরিয়ে এলো রিচার্ড। পা থেকে মাথা পর্যন্ত কালো পোশাকে মোড়ানো, চোখে কালো সানগ্লাস। রিচার্ডের উপস্থিতি চারপাশের পরিবেশকে আরও গুরুগম্ভীর করে তুলল।
‘এটাই প্রথমবার, রিচার্ড গণমাধ্যমের সামনে এলো। রিচার্ডের ধারালো চিবুক, শক্তিশালী চেহারা, আর আত্মবিশ্বাসী হাঁটা দেখে উপস্থিত ফিমেল রিপোর্টারদের চোয়াল ফাঁক হয়ে যায়। রিচার্ডের অভিজাত অ্যাটিটিউড মুহূর্তেই সবাইকে স্তব্ধ করে দিল। ক্যামেরা, মাইক, আর চিৎকারে ভরে উঠল প্রাঙ্গণ। সাংবাদিকেরা দৌড়ে রিচার্ডের দিকে এগিয়ে গেল, প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে। কিন্তু ন্যাসো ও লুকাস তা সম্ভব হতে দিল না। তাদের কড়া তদারকিতে, তারা যথাসম্ভব রিচার্ডকে ভিড়ের হাত থেকে রক্ষা করল। রিচার্ড এগুলো মোটেও পছন্দ করে না। চোখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট হলেও রিচার্ডের উপস্থিতি ছিল অটল। এলোমেলো প্রশ্নের ঝড় তুলেছে রিপোর্টাররা। বাতাসে ভাসছে তাদের হাজারো কৌতূহল। গার্ডরা যতই তাদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করুক,জবানের অনড় জেদ থামছে না। হঠাৎ এক সাহসী সাংবাদিক গলা উঁচিয়ে প্রশ্ন করল,
“স্যার, আপনার এই সাফল্যের পেছনে প্রধান কারণ কী?”
‘রিচার্ড থমকে দাঁড়াল। সাধারণত, এমন প্রশ্ন ওকে বিরক্ত করে, তবে এটি রিচার্ডের কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো। রিচার্ড প্রশ্নকর্তার দিকে তাকিয়ে দৃঢ় গলায় বলল,
“আমার মনোবল।”
‘রিচার্ডের গম্ভীর কণ্ঠ আর সংক্ষিপ্ত জবাবে উপস্থিত সবাই মুগ্ধ হয়ে গেল। এটাই তো রিচার্ড স্পষ্টবাদী ও আত্মবিশ্বাসী। প্রশ্নকারীদের আগ্রহ আরও বেড়ে গেল।একজন এগিয়ে এসে আরেকটি প্রশ্ন করল,
“নিশ্চয়ই আপনার প্রথম অগ্রাধিকার আপনার কাজ। তাই এই অল্প দিনেই এত সফলতা ?”
‘রিচার্ড একটু বাঁকা হাসল। চোখে এক অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস খেলা করল। গম্ভীর কিন্তু সাবলীল ভঙ্গিতে বলল,
“নো! মাই ফাস্ট প্রায়োরিটি ইজ মাই ওয়াইফ।”
‘রিচার্ডের কথায় উপস্থিত জনতার মধ্যে শোরগোল বয়ে গেল। এমন উত্তর কেউই আশা করেনি। ফিমেল রিপোর্টারদের প্রশ্নের ঝড় কিছুটা স্তিমিত হতে না হতেই, এবার মেল রিপোর্টারদের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। একজন এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল,
“স্যার, আপনার পরবর্তী টার্গেট কী?”
‘রিচার্ড এক মুহূর্ত থামল। চোখে শীতল আগুনের ঝলক দেখা গেল। রুষ্ট কণ্ঠে বলল,
“বীর টেক্সট স্টাইলের পতন।”
‘ভণিতা না করে দ্রুত ভিড় পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল রিচার্ড। ওর গম্ভীর ঘোষণা শুনে উপস্থিত সবার মধ্যে বিস্ময় আর শিহরণ ছড়িয়ে পড়ল। টিভি থেকে এই ঘোষণা শুনে আগুনে ঘি পড়ল তাজুয়ারের। হিংস্র জন্তুর মতো আচমকা চিৎকার করে উঠল এবং তেড়ে গেল ডাইনিং টেবিলের দিকে। তাকবীর ও এলিজাবেথ এতক্ষণ খবরটি মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। তাকবীরের অভিব্যক্তি দেখলে বোঝা যায়, সে ভেতরে গভীর চিন্তায় নিমগ্ন। তবে বাইরের তেজ ভাতের উপর ঢালছে। আঙুলের মাঝে ভাত পিষে যাচ্ছে। যেন নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। রিচার্ডের ঘোষণা, তাজুয়ারের প্রতিক্রিয়া সবকিছু যেন আরও বড় কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে এলিজাবেথ যেন কোথায় হারিয়ে গিয়েছে। মনের মধ্যে বাজতে থাকে রিচার্ডের বলা, সেই কথাটা “মাই ওয়াইফ ইজ মাই ফাস্ট প্রায়োরিটি”।
“আমি আগেই বলেছিলাম, বীর, এই মেয়ে একটা অলক্ষী।যেখানে যায়, সেখানেই সব ধ্বংস করে দেয়। এই অপয়ার জন্যই শয়তানটা এখন আমাদের কোম্পানির পিছনে লেগেছে। এই মেয়ে আর কত জ্বালাবে আমার ছেলেকে? বেরিয়ে যা, এখনই!”
ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ২৯
“এলোকেশী, তুমি উপরে যাও। আমি তোমার খাবার নিয়ে আসছি।”
‘এলিজাবেথ আর এক মুহূর্তও দাঁড়াতে পারল না। চোখের কোণে জমে থাকা কান্না বাঁধ মানল না। কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে বেরিয়ে গেল ডাইনিং থেকে।
‘তাকবীরও থামানোর চেষ্টা করল না। জানে এখানে থাকলে তাজুয়ারের কথায় আরো বেশি কষ্ট পাবে এলিজাবেথ। এলিজাবেথ রুমে যায়নি। ওর পায়ের চাপে সিঁড়ির প্রতিটি ধাপ কাঁপছিল। দৌড়ে সোজা ছাদে উঠে গেল। ছাদে পা দিয়েই এলিজাবেথ থমকে গেল। চোখ ছাদের ধাতব মেঝেতে স্থির। এলিজাবেথের নিঃশ্বাস দ্রুত হতে লাগল। সামনে পড়ে থাকা দৃশ্য ওর সমস্ত শরীরকে জমে যেতে বাধ্য করল। মেঝেতে রক্ত দিয়ে তৈরি করা এক অদ্ভুত আলপনা। রক্তের লালচে দাগগুলো ধাতব মেঝেতে কেমন ভয়ানকভাবে গেঁথে আছে খুবই নৃশংসকর ভাবে। আর সেই আলপনার শীর্ষে রাখা একটি বিধ্বস্ত মাথার খুলি। খুলি থেকে গড়িয়ে পড়া শুকিয়ে যাওয়া রক্তের চিহ্ন।