ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৩৪
মিথুবুড়ি
“বস খুব জ্বালাচ্ছে ইদানীং। দিব নাকি একদম ঘাড়ে বসিয়ে?”
‘রেয়ানের কথায় তাকবীর হাত থেকে ফাইলগুলো রেখে গম্ভীর ভাবে তাকাল ওর দিকে। পরপর আবারো ফাইলগুলো চেক করতে করতে ভারি গলায় বলল,”উমহু রেয়ান, রেসপেক্ট। সম্পর্ক বদলেছে এখন।”
“আপনি আমার কাছ থেকে কি লোকাচ্ছেন ভালো মানুষ?”
‘হচকিয়ে গেল দুজনেই। দরজায় এলিজাবেথকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাকবীরের মুখ রক্তশূণ্য হয়ে গেল। অদ্ভুত ভাবে কেঁপে উঠল হাত। রেয়ার ভয়কাতুরে চোখে তাকবীরের দিকে তাকাল। তাকবীর পরপর কয়েকবার শুষ্ক ঢোক গিলে এলিজাবেথের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। চোখেমুখে অপ্রত্যাশিত ভাব। জোরপূর্বক হেসে বলল,”এলোকেশী, এসব কি বলছ তুমি?”
” ঐগুলো কি?”
‘এলিজাবেথ দৃঢ় কণ্ঠে বলে, শক্ত হাতে আঙুল তুলে দেখাল সেই রহস্যময় ঘরের দিকে। তাকবীরের দৃষ্টি সেদিকে যেতেই চোখ ঝলসে উঠল উত্তেজনায়। দরজার তালা খোলা! তাহলে কি অবশেষে ভেদ হতে চলেছে সেই ভয়ংকর ঘরের রহস্য? তাকবীরের মস্তিষ্ক কোনো অতল গহ্বরের কর্কশ শব্দ বাজতে শুরু হয়, কিছু ভয়ংকর আর্তনাদ ভেসে আসছে স্মৃতির গহীন থেকে। ধীরে ধীরে শরীরের প্রতিটি কোষ ফেটে পড়তে শুরু করল অদ্ভুত এক আতঙ্কে। ঠিক তখনই এলিজাবেথ ওর হাত শক্ত করে ধরে টেনে নিতে লাগল সেই রহস্যে মোড়া ঘরের দিকে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘ঘরে পা দিতেই তাকবীরের শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। এই ঘর যেনো মৃত্যুর চেয়েও বেশি ভয়ানক কিছু। কোনো সাইকোপ্যাথের নিজের হাতে গড়া জাহান্নাম। অন্ধকারে ঢেকে থাকা চার দেয়াল। আলো বলতে শুধু এক ড্রিম লাইটের বিষাক্ত নিয়ন আভা, যা ঘরের বিভৎসতাকে আরও তীক্ষ্ণ করে তুলেছে। দেয়ালজুড়ে শুকনো রক্তের লম্বা লম্বা ছোপ, যেনো এখানে কেউ নিজেকে আঘাত করে তিলে তিলে শেষ হয়েছে। রক্তাক্ত দেয়ালে ঝুলানো মস্ত বড় একটা পেন্টিং, ছোট ছোট আরো রয়েছে। পেন্টিংগুলোও সাধারণ নয়; একেকটা মানসিক বিকৃতির বাস্তব রূপ। সবচেয়ে ভয়ংকর সেই বিশাল চিত্রকর্ম—এক মায়ের বিবর্ণ মৃতদেহ, তার দু’পায়ের মাঝে সদ্যোজাত শিশুর রক্তাক্ত শরীর। এটা সেই ছবির পেন্টিং, যেই ছবি এলিজাবেথ তাকবীরের বালিশের নিচে পেয়েছিল। ছবিটা এতটাই জীবন্ত যে মনে হয়, একটু আগেও তাদের আর্তচিৎকার এখান থেকেই ভেসে এসেছিল। সেদিকে তাকালেই এলিজাবেথের বুক ফেটে কান্না আসছে।
‘মেঝেতে ছড়ানো শত শত ঘুমের ওষুধের খালি পাতা আর ইনজেকশনের সিরিঞ্জ। চারপাশের পঁচা গন্ধ আর বাতাসে ভাসমান স্যাঁতসেঁতে ভাব এই ঘরের গুপ্ত কোনো জঘন্য অপরাধের সাক্ষী হয়ে আছে। ঘরের প্রতিটা কোণ, প্রতিটা দাগ, প্রতিটা ছায়া যেনো একটাই কথা বলছে—এখানে কিছু একসময় এত ভয়াবহ ঘটেছে, যা মনে রাখারও সাহস হয় না। মাঝখানে রাখা ছোট্ট একটা টেবিল, তার ওপর ধুলোমাখা, মাকড়সার জালে ঢেকে থাকা এক পুরোনো টেপরেকর্ডার। ময়লার স্তুপ জমেছে টেপরেকর্ডারের উপর। আসবাবপত্র বলতে শুধু একটা ছোট টেবিল ই রয়েছে এই কক্ষে। টেবিলের পাশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিছু ছেঁড়া কাগজ, তাতে অসম্পূর্ণ বাক্য৷
‘অকস্মাৎ তাকবীর শক্ত করে চেপে ধরে এলিজাবেথের হাত। টেনে ধরে হিরহির করে বেরিয়ে আসে সেই অভিশপ্ত কক্ষ থেকে। এলিজাবেথ অপ্রস্তুত হয়ে গেল তাকবীরের এমন উগ্র আচরণে। তাকবীর এলিজাবেথকে টেনে ওর রুমের কাছে নিয়ে গেল। এলিজাবেথ ঝাড়া মেরে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল। বিস্মিত কণ্ঠে আওয়াজ তুলল,
“এসবের মানে কি ভালো মানুষ? আপনি কি লোকাচ্ছেন ঐ ঘরটায়?”
‘তাকবীরের চোখের মনি রক্তিম বর্ণ ধারণ করছে। ঘূর্ণির পাকে পড়েছে মস্তিষ্ক। বেড়ে গিয়েছে শরীরের রক্ত সঞ্চালন। কণ্ঠে দন্ডায়মান হয় মস্ত বড় প্রাচীর। কথা আসছে না কণ্ঠগহ্বর থেকে। তাকবীরের নিরবতা এলিজাবেথের ভিতর সন্দেহের সঞ্চালন আরো বাড়ায়।
“আপনি চুপ করে থাকবেন না।”
“এলোকেশী প্লিজ রুমে যাও! এই বিষয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাচ্ছি না।”
‘এলিজাবেথের কথার পারদে তাকবীর এ ক’টা বাক্য আওড়ালো বহু করসতে। এলিজাবেথের কণ্ঠ আরো গম্ভীর হলো। “আপনি আমাকে সত্যিটা খুলে বলুন! এই ঘরের রহস্য কী? আর সেই ভয়ংকর ছবিটা ওখানে সাজিয়ে রাখার মানেই বা কী? কে ঐ মহিলা, আর কে ঐ বাচ্চা? তাদের এভাবে মেরে ফেলা হলো কেন?”
‘তাকবীরের কণ্ঠ যেন কোনো অন্তহীন গহ্বরে হারিয়ে গিয়েছে। খাদ মেশানো বিষণ্ন স্বরে শুধু বলল, “এলোকেশী… প্লিজ।”
‘এলিজাবেথের জিদ্দি গলা সমস্ত ঘরের ভারী নীরবতা ভেঙে দিল, “আপনাকে সত্যিটা বলতেই হবে আজ। আর লুকাবেন না।”
‘তাকবীরের চোখে অদ্ভুত এক শূন্যতা। দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল, “সব সত্য শুনতে নেই। কিছু সত্য অতীতেই চেপে রেখে আসতে হয়। না হলে সেই অতীতের করুণ বর্ণনায় ভবিষ্যৎ তলিয়ে যায়।”
“মানে?”
“সবার জীবনেই কিছু দুঃখ থাকে, এমন কিছু যা কখনো কাউকে বলা যায় না। আমারও আছে। প্লিজ, আমায় আমার মতো করে ছেড়ে দাও। এটা আমার এমন এক দুনিয়া, যেখানে কেউ নেই, কারো জায়গা নেই। তুমিও এখানে নেই, ছিলেও না। আর এই দুঃখের ভারে কারো ক্ষতি হবে না,এখানে কেবল আমি আছি, একা। তাই বলছি, দয়া করে আমার সেই দুনিয়ায় পা রেখো না। ওই দরজা বন্ধ। যদি জোর করে ঢুকতে চাও, আমি ভেঙে পড়ব। আমি আর সহ্য করতে পারব না। প্লিজ, আমাকে একা থাকতে দাও।”
‘থেমে, পরপর কয়েকবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আবারো বলছি, আমার সেই দুনিয়ার সাথে কারোর সম্পর্ক নেই।”
‘দীর্ঘশ্বাসে মোড়ানো কথাগুলো শেষ করে তাকবীর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। এলোমেলো পা ফেলে চলে গেল। এলিজাবেথ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার হাতে ছিল সেই চাবি, যেটি রিচার্ড কাল তাকে দিয়েছিল। এলিজাবেথ জানত না, এই চাবি ঐ দরজার চাবি—যদি আজ কৌতূহলবশত চাবিটা তালায় না লাগিয়ে দেখতো। তবুও এলিজাবেথের মনের ভেতর কৌতূহলের অজস্র প্রশ্ন রয়ে গেল।
‘তাকবীর এক প্রকাশ এলিজাবেথের থেকে পালিয়ে নিচে চলে আসে। এসেই সোফায় গা ছেড়ে দিল। ঠৌঁট গোল করে ছাড়তে থাকে বড় বড় নিশ্বাস। এগুলো ভিতরে আঁটকে রাখা নিশ্বাস। যা এতোক্ষণ সে ভিতরে আঁটকে রেখেছিল। আচানক দীর্ঘশ্বাসের সাথে চোখ দিয়ে বেরিয়ে আসে দু’ফোঁটা জল। তাকবীর বা হাতে বুকে শক্ত করে চেপে ধরে সেই জায়গাটায়, সেখানে ঝড় উঠেছে। জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। পরক্ষণেই তাকবীরের মনে পড়ে গেল সে পুরুষ মানুষ। তাকে সবসময় শক্ত আবরণের পর্দা গায়ে চাপিয়ে রাখতে হবে। আলগোছে কষ্টের পাহাড় লুকাতে মুছে দিল অশ্রুসিক্ত আঁখিদ্বয়।
‘হঠাৎ ভেসে এলো গাড়ির হর্নের শব্দ। খুব কাছে থেকে আসছে। তাকবীর উঠে দাঁড়াল। এগিয়ে গেল সদর দরজার দিকে। রেয়ানও বাইরে থেকে আসছিল। মুখোমুখি হলো দু’জন। তাকবীর বাইরে তাকাল, দেখতে পেল একটা মাঝারি সাইজের পিকআপ ভ্যান। রেয়ানের দিকে তাকালে রেয়ান আগ বাড়িয়ে বলল,”বস! একটা ড্রেস এসেছে। আপনি নাকি ম্যামের জন্য অডার করেছিলেন, পার্টিতে পরার জন্য।”
‘তাকবীরের অভিব্যক্তি সেই আতঙ্ক থেকে বেরিয়ে এলেও ললাটে ভাঁজ সংকুচিত হলো। ভ্যানের দিকে চেয়ে সরু গলায় বলল,”আমি অডার দিয়েছি?”
“স্লিপে তো আপনার ই নাম দেওয়া।”
‘তাকবীর রেয়ানের হাত থেকে স্লিপটা নিল। এড্রেসে দেওয়ান মঞ্জিল আর নামের জায়গায় তাকবীরের নাম-ই দেওয়া। তাকবীরের ভ্রুদ্বয়ের ভাঁজ আরো গভীর হতে থাকল। পরক্ষণেই মনে হলো, এলিজাবেথের জন্য তো সে প্রায়ই বিভিন্ন ধরনের ড্রেস অর্ডার দিত– এগুলোই হবে হয়তো কোন একটা। হয়তো আসতে কিছুটা দেরি হয়ে গেছে, তাই এতদিন মনে নেই।
‘ডেলিভারি ম্যান, ভ্যান থেকে গাউন যার্ক নামাল। সাদা কালো সংমিশ্রণের ভেলভেট গাউনের দিকে তাকাতেই তাকবীর সকল জড়তা দূর হয়ে গেল নিমিষেই। চোখের সামনে ভেসে উঠলো এক স্বপ্নময় পরি। যার তুলোর মতো নরম আর তুলতুলে শরীরে সাদা-কালো ভেলভেট গাউন। যেন মেঘের মধ্যে আছড়ে পড়া আলো। পরিটার মাথার চুলগুলো রক্তিম লাল, সূর্যাস্তের শেষ আলোর মতো। তার উপস্থিতি ছিল অসম্ভব মায়াবি। স্বপ্নের মত এক অপার্থিব রূপ, যা বাস্তবতার সীমানা ছুঁতে চায় না। তাকবীর আর কথা বাড়ালো না। ড্রেসটা রিসিভ করে নিল।
‘সিলেটের সবথেকে বড় বিলাসবহুল রিসোর্ট হলো গ্র্যান্ড সুলতান। তাকবীর এলিজাবেথকে নিয়ে এই রিসোর্টে ই উঠেছে। রাতে পুল সাইডে পার্টি হবে। তাকবীর এলিজাবেথকে রুমে দিয়ে একটু বাইরে বের হয়েছে। প্রকৃতির সতেজ বাতাস আহরোণের জন্য। ওরা প্লেনে করে এসেছে, তাই সময় লাগেনি। সকালের সেই ঘটনার পর অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে গোটা কয়েক ঘন্টা। এর পর এলিজাবেথ তাকবীরকে ঐ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করেনি।
‘তাকবীরের ভিতরের অস্বস্তি এক অব্যক্ত কষ্ট। যা অতীতের ভয়ংকর স্মৃতির ভারে চাপা পড়ে থাকে। সেই ভয়াল মুহূর্তগুলো যেগুলো কখনো ভোলার নয়, আবার কখনো তাদের মুখোমুখি হওয়াও অসম্ভব। সেই অসহ্য বেদনা, অতীতের সেই লোমহর্ষক মুহূর্তগুলো আবারও নতুন করে তাকবীরের মনকে ছিঁড়ে ফেলছে। একটু শান্তির জন্য তাকবীর নিজের সঙ্গে এক মুহূর্তের সঙ্গম, যেখানে শুধু নিজেকে জানার, বোঝার, আর একান্তে শান্তির সন্ধানে হাঁটতে বের হয়েছে। এলিজাবেথকে না নিয়ে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল এক দৃষ্টির সন্ন্যাস, যেখানে বাইরের দুনিয়া থেকে পালিয়ে শুধুই নিজস্বতার মধ্যে ডুব দেওয়ার তীব্র ইচ্ছা। তবে নিস্তব্ধতায় ডুব দেওয়ার কথা থাকলেও আদৌতে ডুব দেওয়া হয়নি। এখনও মস্তিষ্কের গহীনে পাক খাচ্ছে প্লেনের মধ্যে সেই কথোপকথনগুলো। প্রতিটি শব্দ এখনও মনের মধ্যে জমাট বেঁধে আছে।
“আমার উপর ঘৃণা টেনে আনুন। আমায় নিয়ে শত ভানবার মৃত্যু ঘটান। আমি ভুল মানুষ আমাকে ভুলে গিয়ে অন্য কারও হয়ে জীবন উপভোগ করুন। এ চাওয়ায় নেই প্রাপ্তি।”
‘এলিজাবেথের মুখে এমন কথা শুনে তাকবীরের স্পন্দন এক মুহূর্তের জন্য থমকে যায়। খৈ হারিয়ে রক্তশূণ্য মুখে এলিজাবেথের দিকে তাকাল। এলিজাবেথ তার দিকে স্তব্ধ চোখে চেয়েছিল। তাকবীরের গলা কাঁপছে, ভারি হয়ে উঠছে কথাগুলো।
“এসব কি বলছ, এলোকেশী?”
‘এলিজাবেথ এক টুকরো শূন্যতা নিয়ে বলল, “বাস্তবতা মেনে নিন, ভালো মানুষ। এতে জীবন অনেক সহজ হবে। আমাদের কাছে এখন সবকিছু স্পষ্ট। আমরা দু’জন দুই প্রান্তে আছি। আমাদের ভাগ্যে এক হওয়া নেই।”
‘তাকবীর মুচকি হাসতে চেষ্টা করল, কিন্তু তার হাসি ক্ষীণ হয়ে আসে। ফিচলে হেসে, প্রকম্পিত স্বরে বলল,
“যেখানে তুমি আমাকে ভালোবাসনি, সেখানে তোমাকে পাওয়ার স্বপ্ন দেখা তো শুধু বিলাসিতা।”
‘এলিজাবেথের চোখ থেকে দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। হঠাৎ করেই হুরহুর করে কেঁদে উঠল। চোখের অশ্রু না থামিয়ে বলল,”আমাকে ক্ষমা করবেন, ভালো মানুষ। সব কিছুর পরও আমি চেষ্টা করেছিলাম। তবে আমাদের ডেসটিনি ছিল আলাদা।”
‘তাকবীরের হৃদয়ে এক অদ্ভুত ব্যথা ঢুকে গেল, যে ব্যাথা ওর মন গহীনে ফাটল ধরাতে থাকে। তবে তাকবীর নিজেকে সামলে নিয়ে জোরপূর্বক হাসি দিল। পকেট থেকে রুমাল বের করে স্নেহপূর্ণ দৃষ্টি নিয়ে এগিয়ে দিল এলিজাবেথের দিকে। স্মিত হেসে, আন্তরিক গলায় বলল,
“এই যে তোমার চোখে আমার দুঃখে পানি, এটাই আমার প্রাপ্তি।”
‘এলিজাবেথের চোখে আরও এক সাগর গড়িয়ে পড়ল।
“ভালোবাসলেই কি এতো মহৎ হতে হয়?”
‘এক গভীর শ্বাস নিল তাকবীর,সাবলীল ভাবেই বলল,
“জানি না তবে ভালোবাসলে মানুষ সংযম হারায়৷
যার প্রতি একবার মনে বাসা বাঁধে, ভাগ্যের ফেরে যদি সে অন্য কারোর হয়ে যায়, তবুও মন শুধু তাকেই চায়। হোক না অন্যের স্ত্রী, কারোর পুত্রবধু, কারোর মা।”
‘এলিজাবেথ বুকে হাত চেপে ফ্যাসফ্যাসে আওয়াজে বলল,
“জীবন সত্যিই কখনো কখনো বিশ্রীভাবে ভুল জায়গায়, ভুল মানুষের পিছনে চলে যায়। ভালোবাসার অপচয় হয়, কিন্তু হয়তো সেই ভুলগুলোই আমাদের শেখায়, আমাদের সত্যিকারের পথে নিয়ে যায়।”
‘তাকবীর নত দৃষ্টি নিবিষ্ট করে রেখেই মাথা ঝাকিয়ে এলিজাবেথের কথায় এক ধরনের নিরসতা অনুভব করল। এলিজাবেথ চোখের পানি মুখে সযত্নে মুছতে মুছতে বলল,
“আমার পাসপোর্ট ঠিক হতে আর কেমন সময় লাগবে?”
“আরো কিছুদিন সময় লাগবে।” এতটুকু বলে মাথা তুলে তাকবীর এলিজাবেথের চোখে চোখ রেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। এলিজাবেথের শ্রাবণের ধারায় চেয়ে, হতাশ স্বরে বলল,”সত্যিই চলে যাবে?”
‘এলিজাবেথ ঠোঁট চেপে সমস্ত আবেগ ভিতরে আটকে রেখে কান্না আটকাল। তারপর এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে, অসম্ভব অস্থিরতায় বলল, “হুম।”
“বস।”
‘তাকবীর পিছন ফিরে তাকাল। রেয়ান ছুটে তার কাছেই আসছে। তাকবীর পা থামিয়ে দাঁড়াল। স্বাভাবিক করল নিজেকে, শক্ত পরতে এঁটে নিল। রেয়ান তাকবীরের সামনে এসে থামল। হাড়কাঁপানো ঠান্ডা হাওয়ায়ও শরীর থেকে ঘাম ছুটে গিয়েছে বেচারার।
“একি তুমি এখানে?তোমাকে না বলেছি,তোমার ম্যামের কাছে থাকার জন্য।”
‘রেয়ান তাকবীরের সরু স্বরে মিয়িয়ে গেল খানিকটা। মাথা নিচু করে বলল,”ম্যাম পাঠাল আমাকে।”
‘নিমিষের মধ্যে উধাও হয়ে গেল সকল গম্ভীরতা। দূরন্ত বয়সের চঞ্চল বালকের মতো ঝলঝল করে উঠল তাকবীরের কৃষ্ণগহ্বর। ছটফটিয়ে উঠল,”কেন? কি বলেছে?”
‘রেয়ান মাথা নিচু করে ঠৌঁট কামড়ে হাসল, তার বসের এহেন আচরণে।
“ম্যামের সম্ভবত আপনার জন্য চিন্তা হচ্ছিল। তাই আমাকে পাঠিয়েছে আপনার সাথে থাকার জন্য।”
‘রেয়ানের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকবীর উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,”ও কি আমাকে মিস করছে?”
“জানি না বস। আমাকে শুধু বলল সকালের পর থেকে আপনাকে ঠিক লাগছে না।”
‘জবাবটা আশাজনক না হলেও এতটুকুতেই প্রশান্তি পেল তাকবীর। আবারো হাঁটতে শুরু করল। তাকবীরের সাথে সাথে হাঁটতে থাকল রেয়ানও।
“কি সৌভাগ্য আমার আমার এলোকেশীর চোখে আমার বিধ্বস্ততা ধরা দিয়েছে এতোদিনে।”
‘রেয়ান সামান্য হাসল তাকবীরের কষ্ট লুকানো অভিমানে ভরা কথায়। হাঁটতে হাঁটতে বলল,
“প্রথম প্রেম, সেটা সবসময় ভুল সময়, ভূল মানুষের সাথে হয় তাই না বস?”
‘তাকবীর দ্বিধাহীন ভাবে জবাব দিল,”প্রথম আর শেষ বলতে কিছু নেই। সত্যিকারের ভালোবাসা একবারই হয়।”
“এটা কি আপনার প্রথম প্রেম না শেষ প্রেম?”
‘তাকবীর মলিন হেসে বিলম্বহীন জবাবে বলল,”আমার সত্যিকারের ভালোবাসা।”
‘থেমে, তাকবীর পা থামিয়ে দাঁড়াল। ফিরে তাকাল রেয়ানের দিকে। খাদযুক্ত নরম স্বরে বলল,
“জানো রেয়ান, মাঝে মাঝে মনে হয় ভালোবাসাও পাপ। পাপ জানার পরেও আমি পূর্ণের দিকে ফিরতে পারছি না। কষ্টটা বড্ড বেশি রেয়ান, অনেক বেশি। এখন আমার দুই চোখের পাতা এক করতেও ভয় হয়, যদি সেই সুযোগে আমার এলোকেশী, আমার কাছ থেকে চলে যায়। এই অনিশ্চয়তা, এই ভয়ের মাঝে আমি শ্বাস নিতে পারি না।”
“আপনি নিজেই তো ম্যাম কে চলে দিতে যাচ্ছেন। ম্যামের পাসপোর্টের ঠিক হয়ে গেলেই তো ম্যাম রাশিয়া চলে যাবে সারাজীবনের জন্য।”
‘তাকবীর লম্বা করে শ্বাস টানল। “সত্যি বলতে কি, ঐ মেয়েটাকে হয়তো তোমরা সবাই স্বার্থপর ভাবতে পারো। কিন্তু ওর চলে যাওয়ার একমাত্র কারণ আমি নিজেই। ও জানে, আমার সাথে থাকলে আমি ওর মায়ায় আরও গভীরভাবে পড়ে যাবো। তাই, সব কিছু ছেড়ে, নিজের পথে চলে যেতে চাচ্ছে— আমাকে রক্ষা করার জন্য।”
‘রেয়ান চোখ ছোট ছোট করে তাকবীরের দিকে চেয়ে বলল,”আপনি যে এতো সহজে ম্যামকে দূরে যেতে দিবেন, সেটা কেন জানি আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।”
‘হাসল তাকবীর। বলল,”নামে হোক বেনামে হোক, ওর সারা জীবনের দায়িত্ব আমি নিয়েছিলাম। আর আমি আমার দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করে যাবো। ও চলে যাক রাশিয়া, সমস্যা নেই। এদিকের ঝামেলা শেষ করে আমিও ছুটবো ঐ হৃদয় হরিণীর পিছে। কাছে টেনে না নেক,আমি দূরে থেকে দেখে যাবো।”
‘রেয়ান ফোঁস নিশ্বাস ছেড়ে বলে,”দু’টো জিনিস না হলে খুব ভালো হতো বস।”
“কি কি?”
“এক, ঐদিন যদি হসপিটালে আগুন না লাগত, তবে এতোদিনে আপনি আর ম্যাম কাতার থাকতেন হাসিখুশি। দুই, না ম্যাম আপনার জীবনে না আসতো, না আপনি এতো বড় সিদ্ধান্ত নিতেন আর না আপনার জীবন এতো রিস্কে পড়ত।”
‘তাকবীর ভেজা গলায় অর্নথক হাসি হেসে চাপা স্বরে বলল,
“এতো খারাপ ভাগ্য নিয়ে আর কেউ না জন্মাক।”
‘আজ পুরুষ মানুষের গলাও কাঁপছে । তাকবীর জলে ডুবানো চোখে রেয়ানের দিকে চেয়ে বলল,”এই দুনিয়ায় আমাদের মিলনে এতো বাঁধা কেন রেয়ান?”
‘রেয়ান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “নসিব বলেও একটা জিনিস আছে, বস। সেখানে থাকতে হয়।”
‘তাকবীর একটুও শান্তি পাচ্ছিল না। সে মাথা ঝাঁকাল, একটু গম্ভীর হয়ে বলে উঠল,”শুনেছি দোয়া নাকি ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে। রেয়ান, আমি তো আমার প্রতিটা মোনাজাতে ওকেই চেয়ে আসছি। তবুও আমার সবকিছু কেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে?”
‘রেয়ান খোলা আকাশের পানে চেয়ে বলল,”আরশের মালিক তো আপনারও, চেষ্টা চালিয়ে যান। আজ না কাল, পেয়ে যাবেন।”~সঙ্গে সঙ্গে তাকবীর একবুক আশা নিয়ে তাকাল নীল আকাশে।’
‘ভুবন তখন অন্ধকারে আচ্ছন্ন। সন্ধ্যার আলো গাঢ় হতে না হতেই তাকবীর ফিরে আসে। কিছু ক্ষণের মধ্যেই পার্টি শুরু হবে। তাকবীর একটু আগে এলিজাবেথকে তাড়া দিয়ে গেল রেডি হবার জন্য এবং সাথে করে তখনের সেই গাউনটা দিয়ে গেল এলিজাবেথকে পার্টিতে পরার জন্য। এলিজাবেথ বিনা বাক্যে নিয়েছিল। সত্যি বলতে, ওর নিজেরও পছন্দ হয়েছে গাউনটা। তবে যত সহজে নিয়েছে, তত সহজে পরেনি এলিজাবেথ। ওর চোখে-মুখে একধরনের রহস্যময় হাসি খেলা করে গেল। মাথায় শয়তানি বুদ্ধির ছায়া।
‘ব্যাগ থেকে খুঁজে একটা নিকলেস ড্রেস বের করে বিছানার উপর রাখল। জামাটা অতি নগন্য, কাঁধের দিক দিয়ে তো নেই-ই, সেই সাথে নিচ দিয়ে উরু পর্যন্ত। এলিজাবেথ ড্রেসটা আরো ইচ্ছাকৃত ভাবে ছোট করে বিছালো বিছানায়। পরপর ছুটে গিয়ে টেবিল থেকে ফোনটা নিয়ে এসে গোটা কয়েক ছবি তুলে নিল। অতঃপর বেছে বেছে সবথেকে ক্রিঞ্জস ছবিটা সিলেক্ট করে সেন্ড করে দিল “মায়া ফাঁদ ” নামে সেভ করা হোয়াটসঅ্যাপ একাউন্টে। সাথে লিখে দিল,”টুকি বেস্টু, আজ একটা পার্টি আছে। আমি এই ড্রেসটা পরি। সুন্দর না?”
‘অপরদিকে রিচার্ড’রা রিসোর্টে উঠেছে সবেমাত্র। এসে কেউ আর রেস্ট নেওয়ার সময় পেল না। রিচার্ড তাড়া লাগিয়ে দেয় রেডি হওয়ার জন্য। প্রত্যেকে প্রত্যেকের রুমে রেডি হচ্ছে।
‘শাওয়ার শেষে দরজা ঠেলে বাইরে আসে রিচার্ড। কোমরে সাদা তোয়ালে পেঁচানো। সুবিস্তৃত, শক্তপোক্ত সুঠোম বুক থেকে পানি গড়িয়ে গড়িয়ে নিচে পড়ছে। চুলগুলো এখনো ভেজা, এলোমেলো। ভেজা চুলের ফাঁক দিয়ে পানির কণা গড়িয়ে কপালের পাশ বেয়ে নেমে আসছে। রিচার্ড ওর শক্ত পেশিবহুল হাতে তোয়ালের এক কোণা ধরে নিজের গা মুছতে শুরু করল। শরীরের প্রতিটি ভাঁজ, প্রতিটি গঠন যেনো জীবন্ত হয়ে উঠেছে এই মুহুর্তে। উন্মুক্ত ঢেউ খেলানো বুকের মাঝখানে দেখা যায় নতুন আরেকটি ট্যাটু যুক্ত হয়েছে। তবে তা অতি ক্ষুদ্র। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কি যেনো লেখা।
‘বিছানায় অবহেলায় ফেলে রাখা ফোনটাই হঠাৎ টিং শব্দ হলো। রিচার্ড গম্ভীর ভঙ্গিতে ফোনটা হাতে নিল। নোটিফিকেশনে চাপ বসাতেই নিয়ে গেল “বোকা হরিণী” নামক একাউন্টায়। আগত ছবি দেখে তুষ্ট হাসল রিচার্ড। তাকাল বেডের দিকে। পার্টিতে পরার সকল জিনিস বেডে গুছিয়ে রাখা ছিল। রিচার্ড সেখান থেকে হরমসের বেল্টটি হাতে নিয়ে ক্লোজ এঙ্গেল থেকে ছবি তুলে পাঠিয়ে দিল রিপ্লাই হিসেবে।
‘এদিকে মেসেজের ফিডব্যাক দেখে এলিজাবেথের গলায় কাশি উঠে গেল। গাল দিয়ে উষ্ণ ধোঁয়া বের হতে থাকে। এলিজাবেথ পরপর কয়েকবার ছবিটা দেখল, দেখে নিল নিজের নতুন নাম্বারটা। সব কিছু তো ঠিকঠাক, তবে এমন রিপ্লাই কেন? এমনটা তো এলিজাবেথ মোটেও আশা করেনি।
ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৩৩
‘এলিজাবেথ ফোনে চোখ রেখে কয়েকবার মেসেজটা পড়ল। না এটা রিচার্ড কায়নাত’ই। যে একটা অচেনা নারীর প্রতি এতোটা ডোমিনেটিং মনোভাব দেখিয়েছে। কিন্তু এটা কি আদৌতেও যায় গ্যাংস্টার বসের চরিত্রের সাথে? তবে… কি সত্যিই রিচার্ড এলিজাবেথকে চিনে ফেলেছে? কিন্তু সেটা তো অসম্ভব! এলিজাবেথ তো সিম চেঞ্জ করে নিয়েছিল, এমনকি ভয়েসটা পর্যন্ত। তাহলে, কি কিছুই বদলানো সম্ভব হয়নি? এলিজাবেথ গভীর চিন্তায় ডুবে ছিল, এমন সময় রিচার্ডের একাউন্ট থেকে আরেকটা মেসেজ আসলো।
“ডোয়ান্ট ওয়ারি বেবি। আমি সাথে থাকলে এটাও পরতে হবে না।”~’মেসেজটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে এলিজাবেথের হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেল।