ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৩৪ (২)
মিথুবুড়ি
‘সিলেট গ্র্যান্ড সুলতানের বিশাল প্রাঙ্গণে আজ রাজকীয়তার ছোঁয়া। সুইমিং পুলের নীলাভ জলরাশি তার চারপাশের রঙিন আলোর ঝলকানিতে প্রতিফলিত হয়ে এক মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। পুলের পাশের খোলা জায়গায় ঝুলন্ত লাল-নীল আলো, স্নিগ্ধ মোমবাতির আলো আর সিল্কের ঝুলের টেবিল কভার পার্টির অভিজাততাকে দ্বিগুণ করে তুলেছে।
বড় বড় রাজনীতিবিদ, নামকরা বিজনেস টাইকুন আর বহিরাগত উচ্চশ্রেণির অতিথিরা একের পর এক আসছেন। কাঁচের গ্লাসে চকচকে ওয়াইন, মৃদু স্যাক্সোফোনের সুর আর মৃদু হেসে চলা কথোপকথন মিলিয়ে পরিবেশ আরো সুরম্য। পার্টি শুরু হয়ে গিয়েছে আরো বেশখানিক আগে। স্ট্রিফেন ডার্ক ব্লেজার আর প্রিমিয়াম টাই পরে ব্যক্তিগতভাবে সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছে। নিজের থ্রো করা পার্টি নিজেই মাতিয়ে রেখেছে। স্ট্রিফেন বহিরাগত হলেও বাংলাদেশের প্রতি তার নিগূঢ় এক টান আছে।
‘তাকবীর আর এলিজাবেথ কিছুক্ষণ আগে এসে পৌঁছেছে। একজন সফল বিজনেস ম্যান হওয়ার পাশাপাশি একজন মিনিস্টার হওয়ার সুবাদে তাকে পাঞ্জাবিই পরতে হলো। শুভ্র রঙা পাঞ্জাবির ওপর কালো রঙের কটি, সাথে মিলিয়ে হাতে কালো ঘড়ি। কুঁকড়ো চুলগুলো আজ সম্ভবত জেল দিয়ে সেট করে রাখা। আজ না চাইতেও মিলে গিয়েছে তাকবীর আর এলিজাবেথের পোশাক। এলিজাবেথ সেই সাদা কালো সংমিশ্রণের গাউনটায় পরেছে। সাথে লাইট মেক-আপ। শ্রবণদ্বায় এবং গলায় ছোট চকচকে ডায়মন্ডের ছোঁয়া।
ওর ঘন লাল রেশমি চুল মাঝ সিঁথি করে ছেড়ে রাখা হলেও সামনের অংশের কিছু চুল পিছনে নিয়ে সাদা ক্লো ক্লিপারে নরম ভঙ্গিতে বাঁধা। পায়ে ঝলমলে সিন্ডেলা হিল। সব মিলিয়ে, এলিজাবেথ কেবল এলিজাবেথ নয়, যেন স্বয়ং প্রিন্সেস এলিজাবেথ।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘এলিজাবেথের চোখেমুখে পার্টির উচ্ছ্বাস। বহু বছর পর এমন পার্টিতে জয়েন হয়ে ও খুবই আপ্লূত। মুক্ত পরিবেশে নিজেকে অনুভব করছে মুক্তমনা হিসেবে। ওষ্ঠপুটে দুরন্ত হাসি। যদিও ভিতরে কিছু শঙ্কা ছিল তবে তা এখন আর নেই। পার্টিতে আসার পরপরই রিচার্ড আর এলিজাবেথ সম্মুখীন হয়েছিল। আকষ্মিক রিচার্ডকে দেখে এলিজাবেথ কিছুটা হচকিয়ে গেলেও রিচার্ড ওকে দেখেও না দেখার ভান ধরে চলে গিয়েছিল। তারপর থেকেই এলিজাবেথের ভিতর এক ধরনের শান্তি অনুভূত হচ্ছে। রিচার্ড যদি সত্যিই ওকে ধরে ফেলত তবে একটু হলেও তার প্রতিক্রিয়া দেখাতো। তবে তেমন কিছুই হয়নি। হয়েছে উল্টো।
‘রিচার্ড কায়নাতের স্বভাব বরাবরের মতো স্থির। আজও পরেছে কালো পোশাক, তবে সবার থেকে একদম আলাদা। ভরা মজলিসের পার্টিতে যেখানে সবাই কোট স্যুট পরেছে, সেখানে রিচার্ড পরেছে কালো ফরমাল প্যান্টের সঙ্গে কালো শার্ট। আজ দু’টোর জায়গায় শার্টের তিনটি বোতাম খোলা। যার ফলে ঢেউ খেলানো বৃক্ষপটটা ফুটে উঠেছে। সেই সাথে কোমরে চকচকে হরমসের বেল্ট। গেটআপের সাথে ফিট করে মাথার ব্রাউনি চুলগুলো পরিপাটি করে সেট করা। গোটা খানিক চুল কার্নিশ কোণে আঁচড়ে পড়ে আছে। চিবুকে সামাজিকতার কিছু ছোঁয়া থাকলেও, গাম্ভীর্য ওর উপস্থিতিকে আরো গভীর করেছে। তবুও পুরো পার্টির সেন্টার অফ অ্যাটেনশন আজ রিচার্ডই। চেয়ে আছে তার দিকে অনেকগুলো চোখ অবাক চোখে।
‘রিচার্ডের সাথে মিলিয়ে লুকাস কালো স্যুট পরলেও ন্যাসো ব্যতিক্রম। তিনি বৌয়ের গাউনের সাথে মিলিয়ে গ্রে কালারের স্যুট পরেছে। তবে ভরা পার্টির মাঝে এক অদ্ভুত দৃশ্য বিরাজ করছিল। অন্যান্যদের কোট-স্যুটে সাজানো পোশাকের ভিড়ে এক অবাক করা চিত্র ছিল লাড়া। বিজনেস রিলেটেড পার্টিতে লাড়া পরেছে সিল্কের হোয়াইট ব্রাইডাল গাউন। মাথায় ব্রাইড ক্রাউন। বরাবরের মতো পায়ে ছিল মস্ত বড় স্টিলেটো হিল। ওর দুধে-আলতা গড়ন এবং সাদা গাউনের সাথে ঠোঁটে কড়া লাল লিপস্টিক ছিল এক জটিল চমক।
পার্টির আলোয় ঝলমলে হয়ে উঠছিল লাড়া, আর তার কয়েক মুহূর্তের উপস্থিতি পুরো পার্টির সমস্ত পুরুষের দৃষ্টি চুরি করে নিয়েছে।
‘মিউজিক বক্সে গান বাজছে। সকলে একে অপরের সাথে আলাপআলোচনায় ব্যস্ত। কারোর দিকে কারোর হুঁশ নেই। ইতিমধ্যে সকলে ফোকাল পয়েন্টে এসে উপস্থিত হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই এনাউন্সমেন্ট শুরু হবে, যেখানে তাকবীর আর লাড়ার হাতে ডিল ইস্যু তুলে দেওয়া হবে। ঠিক তখনই রিচার্ডকে দেখে একটু ভরকে গেল স্ট্রিফেন। রিচার্ডের অপ্রত্যাশিত উপস্থিতি তাকে সামান্য হতবাক করল। তবে মুহূর্তের মধ্যেই তার পি.এ জানান দেয়, রিচার্ড ইতোমধ্যেই এই রিসোর্টটি কিনে নিয়েছে। আর সেই কারণেই পার্টির আয়োজন ঠিকঠাক চলছে কিনা তা দেখতেই নিজে এসেছে রিচার্ড। স্ট্রিফেন এ কথা শুনে কিছুটা বিস্মিত হলেও ব্যাপারটা আমলে নিল না। তার দৃষ্টি আবার ফিরে গেল অনুষ্ঠানের প্রস্তুতিতে।
‘এলিজাবেথ স্টেজে ওঠেনি, পুলের ধারে নির্জন দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ শক্ত করে টেনে ধরল তার হাত। অপ্রত্যাশিত স্পর্শে সারা দেহে শীতল শিহরণ বয়ে গেল। ভয়মিশ্রিত চোখে দ্রুত পিছন ফিরতেই ভয়কাতুরে চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে উঠল। ইবরাত ফিক করে হেসে দিয়ে এলিজাবেথকে জড়িয়ে ধরল। এলিজাবেথও এক গাল হেসে ইবরাতকে সযত্নে আগলে নিল। দূর থেকে তাকবীর গভীর স্বস্তিতে নিঃশ্বাস ফেলল। এলিজাবেথকে একা রেখে যেতে ওর মন খচখচ করছিল।
“এলিজাবেথ তোকে তো আজ একদম পরীর মতো লাগছে।”~’ইবরাত কিছুটা জোড়েই বলল। এলিজাবেথ লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গিতে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে ইবরাতের মুখ চেপে ধরল।
‘ন্যাসো আর লুকাস, রিচার্ডের অবিচ্ছেদ্য ছায়া। তার শক্ত দু-হাতের মতোই সর্বদা তাকে ঘিরে রাখে তারা। রিচার্ড ফোকাল পয়েন্টের এক কোণে টানটান দাঁড়িয়ে। চোয়ালে কোনো আবেগের ছাপ নেই। শুধু মূর্তিমান শীতলতা। ওর দু’পাশে সবসময়ের মতো সটায় হয়ে উপস্থিত লুকাস,ন্যাসো। রিচার্ডের চোখে কালো সানগ্লাস থাকলেও কালো কাচের ফাঁক গলিয়ে দৃষ্টি স্থির এক মেঘ ময়ূরীর উপর। রিচার্ড যেন জমে থাকা কালো মেঘ, অথচ সেই কালো মেঘের দৃষ্টি এক স্নিগ্ধতায় ঘেরা মানবীর ওপর। মেঘের গম্ভীরতার মাঝে ময়ূরীর কোমলতা তাকে গভীরভাবে টেনে ধরেছে যেমন করে রাতের অন্ধকার আঁকড়ে থাকে নক্ষত্র। মুখে না বলা প্রশংসা মিশে রয়েছে চোখের মুগ্ধতায়। যেখানে অনুভূতি একেবারে নিরবভাবে ফুটে ওঠে।
‘মঞ্চের স্পটলাইটে দাঁড়িয়ে স্ট্রিফেন মাইক হাতে গম্ভীর ভঙ্গিতে এনাউন্সমেন্ট শুরু করল। কর্কশ শব্দের ভেতরেই প্রথমে পরিচিত স্বরে প্রসঙ্গ তুলল লাড়াকে নিয়ে।
“হেই গর্জিয়াস লেডি। এত বড় ডিলটা জিতে কেমন লাগছে তোমার?”
‘লাড়া ওর কাঁধ সমান চুলগুলো ঠেলে পিছনে দিয়ে নিঃসংশয়ে বলল,”নতুনত্বের অনুভূতি সবসময়ই থাকে। তবে এই মুহূর্তে আমার কোনো অনুভূতিই কাজ করছে না।”
‘লাড়ার স্বভাবসিদ্ধ সোজাসাপ্টা জবাব শুনে স্ট্রিফেনের মুখ খানিকটা থমথমে হয়ে গেল। তবে নিজেকে সামলে নিয়ে দ্রুত অন্য প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,”তাহলে আজ হঠাৎ ব্রাইডাল সাজে আসার পেছনে রহস্যটা কি? সবাই জানতে চাইছে!”
‘তাকিয়ে থাকা চোখগুলোর ভিড়ে লাড়ার ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ এক রহস্যময় হাসি খেলে গেল। যেন উত্তর তার চোখে, কিন্তু শব্দে ধরা দেয় না। লাড়া মাইক হাতে নিয়ে দূর থেকে রিচার্ডের দিকে চেয়ে ঠৌঁট কামড়ে হেসে বলল,
“আই’ম গেটিং ম্যারিড ভেরি সুন, সো টুডে’স লুক ইজ পার্ট অব মাই আরলি প্রিপারেশন্স।”
‘লাড়ার দৃষ্টি অনুসরণ করে এলিজাবেথের চোখ আটকালো রিচার্ডের ওপর। মুহূর্তে বুকের ভেতর অদ্ভুত এক মোচড় উঠল। অন্যদিকে লাড়ার মুখে এমন ঘোষণা শুনে পার্টির ভিড়ে কানাঘুষা শুরু হলো। মুগ্ধ চোখগুলোতে ধীরে ধীরে বিভ্রান্তির ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠল৷ মনে ভাঙন ধরল সেইসব মানুষের, যারা এতক্ষণ লাড়ার কথায় মুগ্ধ ছিল।
‘হঠাৎ বিকট এক গুলির শব্দে পার্টি কেঁপে উঠল। চারদিকে নেমে এলো নিস্তব্ধ আতঙ্ক। এলিজাবেথ ভয়ে ইবরাতকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। ভিড় সরিয়ে চোখ গেল এক প্রান্তে রক্তে ভেসে নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে একজন। আতঙ্কের ঢেউ আরো ঘনীভূত হলো। রিচার্ড ধীর পায়ে এগিয়ে এলো। হাতে ধরা বন্দুকের নল থেকে ধোঁয়া উঠছে। রিচার্ডের নিশানা বরাবরই নিখুঁত—প্রাণপাখি নিয়ে গুলির লক্ষ্যভেদে সে কখনো ভুল করে না। ঠোঁটের কোণে এক ঠান্ডা হাসি ঝুলিয়ে বন্দুকের নলে হালকা ফুঁ দিয়ে রিচার্ড নির্ভয়ে স্টেজের মাঝে এসে দাঁড়াল। সকলের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুঁড়ে রিচার্ড গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,
“To all the gentlemen who have eyes on my girl, আপনাদের রুচির তারিফ না করে পারা যায় না। তবে সতর্কবাণী হিসেবে বলব নিজেদের চোখকে ভালোবাসুন। দুনিয়া অনেক সুন্দর, দেখার মতো এখনো অনেক কিছু বাকি। সবাই নিশ্চয়ই আমার আরেকটা পরিচয় জানেন।”
‘রিচার্ডের কণ্ঠ গভীর, শীতল অথচ তীক্ষ্ণ। কথার ভেতর লুকিয়ে থাকা হুমকি কণ্ঠস্বরকেও ধারালো করে তুলেছে। উপস্থিত জনতার মধ্যে চাপা এক শিহরণ বয়ে গেল। রিচার্ডের গার্ডরা এসে লাশটাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায়। কেউ এর বিরুদ্ধে টু শব্দ অব্ধি করার সাহস পেল না। এলিজাবেথ রিচার্ডের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য আরেকটু পিছিয়ে গেল। থরথর করে কাঁপছে ওর শরীর। তাকবীর দাঁতে দাঁত পিষে দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে। তবে লাড়ার চোখে ছিল ঘোর। মনোমুগ্ধকর ভাবে চেয়ে ছিল রিচার্ডের দিকে।
‘স্ট্রিফেনের মুখেও ভয় স্পষ্ট। তবু সকলের আতঙ্ক কমাতে উনি জোর করে হাসল। পরিস্থিতি হালকা করার জন্য অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে রিচার্ডের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিল,
“তো মি. কায়নাত, আমরা তো জানি আপনি একজন একাকী মানুষ। এটাও শুনেছি আপনি নাকি নারীদের সঙ্গ ঘৃণা করেন? তাহলে এই মাত্র যা বললেন_? এই বিষয়ে কিছু বলবেন?”
‘সবাই রিচার্ডের উত্তর শোনার অপেক্ষায়। রিচার্ড এলিজাবেথের উপর দৃষ্টি স্থির রেখেই গমগমে আওয়াজে তুলে বলল,
“ইয়েস আই অ্যাম সিঙ্গেল… বাট মাই সিক্রেট ওয়াইফ নো হাউ ডার্টি মাইন্ডেড আই অ্যাম।”
‘রিচার্ডের এহেন অদ্ভুত ও রহস্যময় উত্তরে পুরো ভিড়ে বিস্ময়ের ঢেউ বয়ে গেল। এতোক্ষণ ধরে নীরব থাকা লাড়া হঠাৎ ঘোর থেকে বেরিয়ে এল। চোখে জ্বলে উঠল ক্রোধের ঝলক। তাকবীর যদিও ভেতরে তীব্র অস্বস্তি আর রাগ অনুভব করছে,তবু যথাসম্ভব নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করল। রিচার্ড আবারও বলল,
“To my lady, get ready—we will marry again on 21st December”
‘বিস্ময়ের আরেকটি ঢেউ খেলে গেল জনতার মাঝে। স্ট্রিফেন কৌতূহলী হয়ে রিচার্ডের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিল,
“Why twenty-first December?”
‘রিচার্ড চোখ থেকে সানগ্লাস খুলল। আশপাশের দৃষ্টি উপেক্ষা করে তার গভীর, সমুদ্রের মতো দৃষ্টি গিয়ে স্থির হলো এলিজাবেথের ওপর। ঠোঁটের কোণে এক রহস্যময় হাসি খেলে গেল। ঠোঁট কামড়ে গম্ভীর গলায় বলল,
“Because it has the longest night.”
‘রিচার্ডের কথা শোনামাত্র এলিজাবেথের তলপেটে নাড়া দিয়ে উঠল। আর এক মুহুর্তও এখানে দাঁড়ায় না,ছুটে অন্যদিকে চলে যায়। রিচার্ডের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ওর ভেতরটাকে আরও এলোমেলো করে দিচ্ছে। অন্যদিকে তাকবীর আর লাড়ার অভিব্যক্তি একই রকম—চাপা রাগ আর বিস্ফোরণের অপেক্ষা। উপস্থিত সবাই প্রাপ্তবয়স্ক হলেও রিচার্ডের লাগামহীন মন্তব্যে লজ্জায় মিইয়ে গেল সকলে। স্ট্রিফেন যদিও একজন বিদেশি, তবুও রিচার্ডের এমন কথা শুনে কিছুটা ভড়কে গেল। পরিস্থিতি সামলাতে সে কথার মোড় ঘুরিয়ে তাকবীরের দিকে প্রশ্ন করল,
“মি. বীর, সকলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তো জানা হলো। আপনার কী প্ল্যান? ক’দিন পরেই তো নতুন বছর।”
‘তাকবীর ভেতরের অস্থিরতা চাপা দিয়ে আন্তরিকভাবে হেসে উঠল। কথার জবাবে প্রথমে একবার এলিজাবেথ যেখানে ছিল সেই শূন্য স্থানে চেয়ে থেকে মৃদু হেসে বলল,
“নতুন বছরে আর কী হবে। আমি তো এখনো সেই ২০২০ সালে আটকে আছি, সেই এক দর্শনার্থে।”
‘এনাউন্সমেন্ট শেষ হওয়ার পর ডান্স ফ্লোরের আবহ ছিল উদ্দাম আলো-আঁধারিতে ভেসে যাওয়া আনন্দমুখর মানুষদের নাচে। খানিক বাদে ডিনারের ঘোষণা হবে, তারপর পার্টির সমাপ্তি। রিচার্ড সেই সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে উঠল এক অন্য রোমাঞ্চের পথে। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গেল রুম নম্বর ২০৪। রিচার্ড রুমে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে পেছনে চাপা শব্দে দরজাটা লক হয়ে গেল। রিচার্ডের তীক্ষ্ণ মস্তিষ্ক মুহূর্তেই বুঝে নিল এটা লাড়ার চাল। টাকা খাইয়ে কোনো ওয়েটারকে দিয়ে ন্যাসোর কথা বলে এই ফাঁদে ফেলতে চেয়েছে রিচার্ডকে।
‘তবে এটা রিচার্ড কায়নাত, বারো শয়তানের পাচায় মারা রিচার্ড কায়নাত। সবটা বোঝার পরও রিচার্ড একটুও বিচলিত হলো না,আর না ক্রোধ প্রকাশ করল। তার মুখে এক অদ্ভুত প্রশান্তির ছাপ, যেনো সে এই নাটকের চিত্রনাট্য আগেই পড়ে রেখেছে। ধীরপায়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে রিচার্ড ঢুকল অন্ধকারে ডুবে থাকা রুমে। প্রতিটি কদমে পায়ের নিচে অনুভূত হলো নরম ফুলের পাপড়ির কোমলতা।
‘রিচার্ড বেডের কাছে যেতেই পুরো ঘর হঠাৎ ঝলমলিয়ে উঠল মৃদু আলোয়। টেবিলের উপর ছোট ছোট মোমবাতি জ্বলছে। সফেদ সাদা চাদরের উপর ছড়িয়ে আছে লাল গোলাপের পাপড়ি। ঘরের প্রতিটি কোণ লালের আবেশে ডুবে গেছে। বেডের শেষ প্রান্তে ব্রাইডের সাজে বসে আছে লাড়া। এক হাঁটু ভাঙে রাখা, অপর পা সোজা রাখা। দেহভঙ্গি ইঙ্গিতপূর্ণ, যেনো প্রতীক্ষায় অনন্ত কিছু। রিচার্ডের জিভ গালের ভিতরে নাচিয়ে বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে কপালে অযথা ঘষে চোরা দৃষ্টিতে ধীর গাম্ভীর্যে পুরো রুমটি পরখ করল। ঠিক তখনই লাড়া সুর তুলল তার কণ্ঠে, শব্দের গাঁথুনিতে এক অদ্ভুত মোহ সৃষ্টি করে।
“কালো সানগ্লাসটাই কেনো এতো সুখ?
হেই যুবক, রং চটা জিন্সের প্যান্ট পরা!
জ্বলন্ত সিগারেট ঠোঁটে ধরা,
কালো শার্ট গায়ে তার, বুক খোলা।”
‘রিচার্ড চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে ফেলল। ঠোঁটে জমে থাকা সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে দিল। ঘরের বাতাসে মিশে গেল বিষাক্ত ধোঁয়া এক নিঃশব্দ ঘোষণার মতো। ভাঙা হাঁটু আরেকটু ভাঁজে নিল লাড়া। ঠোঁটে রহস্যময় ভারি হাসি। ঠৌঁট কামড়ে হাস্কি স্বরে হিসহিসিয়ে বলল,
“রিদ, বেবি। আই নো তোমার লাল রং খুব পছন্দ। এই দেখো, একদম তোমার মনের মতো করে সাজিয়েছি আমি। শুধুমাত্র আমাদের জন্য। আজ তোমার মন পুরোপুরি ভরিয়ে দেব। আর কোনো অভিযোগ থাকবে না, বেবি।”
‘রিচার্ডের ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটে উঠল। চোখেমুখে চাপা তাচ্ছিল্যের আভাস। দ্বিধাহীন ভাবে বলল, “তাই?”
‘লাড়া ছটফটিয়ে উঠল,”ইয়েস বেবি। আজ তোমার সব কষ্ট ভুলিয়ে দেব আমি। ভুলে যাও ওই মেয়েটাকে। চলো আমরা বিয়ে করে নিই।”
”শুরু করা যাক?”
‘রিচার্ডের কথার সুর সেই অদ্ভুত স্থিরতা এক মুহূর্তের জন্য ভরকে গেল লাড়া। তবে ভাবতেই তলপেটে অসংখ্য প্রজাপতি খেলা করে গেল। এই “শুরু”র অর্থ তার কল্পনার চেয়েও গভীর আর বিপজ্জনক কিছু হতে চলেছে। যা ছিল নেহাৎই তার স্বপ্ন। লাড়াকে আরো অবাক করে দিয়ে রিচার্ড আগ বাড়িয়ে শার্টের বোতাম খুলতে থাকে। আশ্চর্য, আশ্চর্য, খুবই অবাক হচ্ছে লাড়া আজ রিচার্ডের কান্ডে। তবে যা ছিল নিতান্তই ক্ষণস্থায়ী।
‘শার্টের চতুর্থ বোতাম খুলতেই উন্মোচিত হলো রিচার্ডের ঢেউ খেলানো বুকের মাঝখানে ইটালিয়ান ভাষায় লেখা সেই পেঁচানো শব্দগুলো। লাড়ার চোখ স্থির হয়ে গেল সেখানে। একজন ইটালিয়ান হয়ে সেই শব্দের গভীর অর্থ বুঝতে তার বেশি সময় লাগল না। মুহুর্তেই লাড়ার মুখের রং বদলে গেল। সব আশা মুহূর্তেই জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে যায়। রিচার্ড যে তার ছলনার খেলকে শুরুতেই ধরে ফেলেছিল, তা স্পষ্ট হয়। ঠোঁট কাঁপল, চোখ ভিজে উঠল। কিন্তু কোনো কান্নার শব্দ বের হলো না। শক্ত করে নিজেকে ধরে রাখল লাড়া।
‘গাউনের বুকের অংশের ফিতা, যা পিঠ থেকে ঘুরে নাভির উপরে বাঁধা ছিল, এক টানে খুলে দিল লাড়া। সঙ্গে সঙ্গে উন্মোচিত হলো শরীরের সামনের অংশ উন্মুক্তভাবে। রিচার্ড তৎক্ষণাৎ শক্ত করে চোখ বন্ধ করে ফেলল। তার মুখে তীব্র ঘৃণা আর ক্রোধের ছাপ। চোখ বন্ধ রেখে অবস্থায় ই ঠাসিয়ে এক চড় বসাল লাড়ার গালে। লাড়া ভারসাম্য হারিয়ে উল্টে ছিটকে গিয়ে বিছানায় পড়ল। রিচার্ড ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে ব্ল্যাঙ্কেট ছুঁড়ে মারল লাড়ার উন্মুক্ত পিঠে। পরপরই হিংস্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ল লাড়ার উপর। এক হাঁটু বিছানায় গেড়ে ঝুকে লাড়ার চুল মুঠোয় নিয়ে টেনে ধরল। চোখে আগুন,গলায় তীব্র ঘৃণার ঝড়। কক্ষ কাঁপিয়ে চিৎকার করল রিচার্ড, “শালি সস্তা! তোদের মতো নষ্টদের জন্যই নারী সমাজ কুলশিত হয়। সম্মান হারায়! শুধুমাত্র তোদের মতো মাগীদের কারণেই, রাস্তা দিয়ে পর্দা করে হেঁটে যাওয়া মেয়েরাও ইভটিজিংয়ের শিকার হয়!”
‘লাড়ার চোখে ভয় আর অপমানের ছায়া নাচল। তবুও ঠোঁট থেকে কোনো শব্দ বের হলো না। রিচার্ডের এই তীব্র আক্রোশ তাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। ঘর জুড়ে জমাট বাঁধল নীরবতা। আর সেই নীরবতার মাঝেই রিচার্ডের শ্বাসের শব্দ বজ্রধ্বনির মতো প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। রিচার্ড শুধু এতেই থেমে থাকল না, ওর হাতের জ্বলন্ত সিগারেট চেপে ধরল লাড়ার কাঁধে। লাড়া চিৎকার করতে চাইলে, রিচার্ড ওর মুখ বিছানার সাথে চেপে ধরল। লাড়া হাত-পা ছুঁড়ে গোঙানির শব্দ তুলতে থাকল। এ ছাড়া কিছুই করার নেই। রিচার্ডের হাতের শক্ত বাঁধন থেকে ছাড়া পাওয়ার সাধ্য তার নেই।
“শালি, করলি টা কি? আমার চোখ নাপাক করে দিলি! তোকে তো এখন কেটে লবণ, মরিচ লাগিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।”
‘আশ্চর্যজনকভাবে রিচার্ডের শরীর কাঁপছে। ছটফট করতে থাকে, যেন মস্ত বড় পাপ করে ফেলেছে। লাড়াকে ছেড়ে দিয়ে রুমের ভেতর অস্থির ভাবে পায়চারি করতে থাকে রিচার্ড। অন্যদিকে, শক্ত মনের লাড়াও আজ ঠুকরে কেঁদে উঠল। চোখের জল আর চেপে রাখতে পারল না। রিচার্ড আচমকা থামল, পায়চারি বন্ধ করে লাড়ার দিকে চাইল। তার দৃষ্টি শূন্যতার গভীরে প্রবেশ করল। কর্কশ কণ্ঠে, দাঁতে দাঁত চেপে চিবিয়ে বলল,
“কুত্তার বাচ্চা, আর একবার আমার কাছে আসার চেষ্টা করলেই একদম এসিড ঢেলে দেব! সব কারেন্ট চলে যাবে, বুঝলি?”
‘লাড়ার হৃদয় কাঁপিয়ে দিল সেই ভারি স্বর। বার বার প্রতিধ্বনিত হতে লাগল সেই কথার হিংস্র প্রতিশব্দ। আর থাকল না রিচার্ড। হনহনিয়ে দরজা কাছে গেল। বন্ধ দরজাও ওর শক্তির কাছে টিকল না। রিচার্ডের পায়ের তিনটে ধাক্কায় যথেষ্ট ছিল ভাঙার জন্য।
‘এলিজাবেথ একটা চেয়ারে বিষন্ন মনে বসে আছে। পা ফুলে গিয়েছে। তাই হিল খুলে রেখেছে আপাতত। তবে পা ব্যাথার থেকেও বেশি যন্ত্রণা হচ্ছে ওর মনে এক অজানা কারণে। বার বার চোখের সামনে ঝলক দিয়ে উঠছে সেই বিরক্তিকর মূহুর্তটা। লাড়া যখন বিয়ে কথা বলল রিচার্ডের দিকে তাকিয়ে। তাহলে কি লাড়া রিচার্ডকে বিয়ে করার কথায় বলেছে?
‘ভাবনার মাঝেই হঠাৎ পায়ে ঠান্ডা স্পর্শ অনুভব করল এলিজাবেথ। সামনে তাকাতেই অপ্রস্তুত হয়ে গেল। পা টেনে সরিয়ে আনতে চাইলেও পারে না। তাকবীর ওর পা কুটিল হাতে তুলে নিয়ে পাশের আরেকটা চেয়ারে বসল। এলিজাবেথ তুলতুলে পা রাখল নিজের হাঁটুর ওপর। তাকবীর আলতো করে ফোলা অংশে টিপে দিতে থাকে, একগুঁয়ে যত্নে।
“একি! কি করছেন?”
‘এলিজাবেথ চমকে উঠে বলে। তাকবীর নিদারুণ কোমল স্বরে জবাব দেয়, পা হাতের মুঠোয় রেখে,”ভয় পেয়ো না। বন্ধুত্বের মাঝে বন্ধুর সেবা করা জায়েজ।”
‘এলিজাবেথ অস্বস্তিতে ছটফট করতে করতে বলল,
“প্লিজ ছাড়ুন! আমার অস্বস্তি লাগছে।”
‘তাকবীর থামে না। “কেন? আমি পর বলে?”
“ছিঃ! কী বলছেন! আপনি তো আমার দূরে থাকা সবচেয়ে আপন একজন।”
‘তাকবীর মলিন হেসে মাথা নত করে।বলল,
“চেয়েছিলাম তো আপন হতে। হতে আর পারলাম কই।”
‘এলিজাবেথের কণ্ঠ নরম হয়ে আসে। ক্ষীণ স্বরে বলল,”পিছনে ফিরে না তাকানোই উত্তম।”
‘তাকবীর থেমে যায়। সময়ের ভার দু’জনের মাঝের বাতাসে থমকে থাকে। হঠাৎ করেই তাকবীরের ফোন ভেজে উঠল। তাকবীরের ইশারায় এলিজাবেথকে বলে একটু সাইডে চলে গেল। দীর্ঘশ্বাস ফেলতে থাকল এলিজাবেথ। ঠিক তখনই উদ্ভট ঝামেলা হিসেবে হাজির হয় লুকাস। কালা চাঁন পরনের কালো কোট টেনেটুনে সোজা করতে করতে এলিজাবেথের পাশে এসে বসল। এলিজাবেথের বিরক্তিকর চেহারার বিপরীতে মুক্তার দানার মতো ঝিকঝিকে দাঁত কেলিয়ে বলল,”ডাস্টবিন কুমারী।”
‘এলিজাবেথ তিরিক্ষি মেজাজ দেখিয়ে কিছু বলতে যাবে তখনই ঝড়ের বেগে কোথা থেকে চলে আসলো রিচার্ড। একটানে এলিজাবেথকে তুলে নিল কাঁধে। আবার যেই বেগে এসেছিল সেই বেগেই ছুটল। তাজ্জব বুনে গেল লুকাস।
“ছাড়ুন বলছি। ছাড়ুন আমাকে। কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?”
‘রিচার্ড একেবারে এলিজাবেথকে ওয়াশরুমে নিয়ে গিয়েই ছাড়ল। দপ করে বসিয়ে দিল সিঙ্কের উপর। কোমরে খুব লাগল এলিজাবেথের, তবে তা প্রকাশ করার আর সুযোগ পেল না। হঠাৎ কোনো পূর্ব ইঙ্গিত ছাড়াই রিচার্ড এলিজাবেথকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। এমন দৃঢ় আলিঙ্গন যেন কোনো অদৃশ্য শত্রুর হাত থেকে ওকে সুরক্ষিত রাখতে চাইছে। এলিজাবেথ নড়ার চেষ্টা করতেই রিচার্ড শান্ত কিন্তু কঠোর গলায় বলে উঠল, “একটুও নড়বে না।”
‘এলিজাবেথ হতবাক। রিচার্ডের এই আচরণ তার কাছে একেবারেই অপ্রত্যাশিত। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল ও। রিচার্ডের দুই হাত এক কঠিন দেয়াল হয়ে ওকে ঘিরে রেখেছে। এলিজাবেথের পিঠে রিচার্ডের শক্ত মুঠো, আর রুক্ষ থুতনিটা ঠেসে আছে কাঁধে। অবাক করে দিয়ে শোনা গেল গ্যাংস্টার বসের শান্ত গলা।
“আমার কেমন কেমন লাগছে রেড। এমন তো আগে কখনো হয়নি।”
‘এলিজাবেথ স্তব্ধ হয়ে থেকে মৃদু স্বরে প্রশ্ন করল,”কেমন লাগছে?”
‘রিচার্ড গভীর শ্বাস নিল, বলল,”তোর জন্য আমার ক্রোধ আকাশ ছুঁয়েও থামে না। অথচ তোর উষ্ণ আলিঙ্গনেই সেই ক্রোধ জল হয়ে গলে যায়।”
‘রিচার্ডের কণ্ঠে ছিল এক অদ্ভুত মিশ্রণ। অভিযোগ, আবেগ আর অস্বস্তির। এলিজাবেথ বুঝতেও পারল না রিচার্ডের ভেতরের যুদ্ধে সে অপরিহার্য এক অংশ হয়ে উঠেছে। এলিজাবেথ রিচার্ডের কথার গভীরতা বুঝে উঠতে না পেরেই মোচড়ামুচড়ি করতে থাকে ছাড়া পাওয়ার জন্য। রিচার্ড আরো শক্ত ভাবে চেপে ধরল এলিজাবেথকে। সেই গভীর, মায়াময় স্বরে ডাকল,
“এলি জান।”
‘এলিজাবেথের বুক কেঁপে উঠল। কেন জানি সে এই ডাকে কখনোই অবজ্ঞা করতে পারে না। মৃদু স্বরে সাড়া দিল,”হুম।”
‘রিচার্ডের কণ্ঠে এক অদ্ভুত কোমলতা,”আমার হুরপরী, ভুবনমোহিনী এসব কিছুই লাগবে না। শুধু তোকে লাগবে এলি। তুই-ই আমার সব।”
“আপনি কি কিছু খেয়েছেন?”
‘দিল, দিল, দিল মুডের একদম বারোটা বাজিয়ে। ছেড়ে দিল রিচার্ড এলিজাবেথকে। ওর দিকে রক্ত গরম চোখে তাকিয়ে বলে,”নাহ!তবে তোকে এখন খাবো।”
‘সঙ্গে সঙ্গে কামড়ে ধরল এলিজাবেথের ওষ্ঠদ্বর। হচকিয়ে যায় এলিজাবেথ। এই হঠাৎ আক্রমণে ওর মাথা গিয়ে ঠেকল পিছনের বিশাল মিররের সাথে। মাথায় সযত্নে লাগিয়ে রাখা ক্লো ক্লিপার টা ভেঙে পড়ল নিচে। রিচার্ডের মুখ থেকে নির্গত সিগারেটের গন্ধে পাকস্থলী উগরে বেরিয়ে আসতে চাইছে সবকিছু। তবে সেই সুযোগটাও দিচ্ছে না রিচার্ড। এলিজাবেথ বাধ্য হয়ে কামড় বসাল রিচার্ডের জিভে। রিচার্ড সঙ্গে সঙ্গে সরে ছেড়ে দিল ওর ঠৌঁট। চোখে মিশে রয়েছে চমক আর একধরনের অদ্ভুত আনন্দ। হাতের পিঠ দিয়ে ঠৌঁট মুছে হাসল। এলিজাবেথ পিছনে পিঠ এলিয়ে শরীর ছেড়ে দিল। ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলতে লাগল। রিচার্ড আবারো এগিয়ে এসে দু’আঙ্গুল রাখল এলিজাবেথের কণ্ঠনালীর খানিকটা উপরে। চাপ প্রয়োগে উপরে তুলল এলিজাবেথের দূর্বোধ্য অবয়ব। হিসহিসিয়ে বলল,
“এটুকুতেই? আই’ম নট ডান ইয়েট।”
‘অপর হাত দিয়ে এলিজাবেথের কোমর পেচিয়ে নিজের খুব কাছে নিয়ে আসল। যতোটা কাছে আসলে আর দূরত্ব থাকে না। উরুর উপর হাত রাখতেই নাজুক এলিজাবেথ খামচে ধরল রিচার্ডের হাত। ভীতসন্ত্রস্ত স্বরে বলল,
“এই হাতগুলো আমি খুব ভয় পাই। এদের স্পর্শ,বিচরণ আমাকে এলোমেলো করে দেয়।”
‘এলিজাবেথের কণ্ঠ কাঁপল। রিচার্ডের ঠৌঁটে হাসি ফুটে উঠল এলিজাবেথের সহজসরল স্বীকারোক্তিতে। ঠোঁটের কোণে এক রহস্যময় হাসি টেনে বলল,
“এই হাতের প্রতিটি ছোঁয়া তোমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে গিয়ে জানান দেয়, তুমি শুধু আমার।”
‘তবে বোকা এলিজাবেথ জানত না এই হাত শুধু ওকে এলোমেলো করার জন্যই নয়, ওকে গড়ে তোলার জন্যও।
“কিন্তু প্রতিবার তো শুধু রক্ত ঝরিয়ে যান। আপনার মতোই আপনার হাতও সত্যকে ভয় পায়। তাই শক্তি দেখায়, শুধু শক্তি।”
“তুই ভুল না, রেড। কিন্তু তুই জানিস না, এই শক্তির পেছনে কতটা অসহায়ত্ব লুকিয়ে আছে।” মনে মনে আওড়ালেও মুখে বলতে পারল না রিচার্ড। কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। চোখে আগুনের মতো কিছু জ্বলছিল। আবার সেই আগুনেই একটা দুর্বলতার ছায়া ছিল। যেটা তার সামনে জলে টইটম্বুর আঁখিদ্বয় নিয়ে তার দিকে উত্তরের আশায় চেয়ে আছে।
“আমি মানেই রক্তপাত, রেড। আমার ছায়া মানেই ক্ষত। আজ পর্যন্ত যতবার তোর কাছে এসেছি, কোনোবার কি রক্ত না ঝড়িয়ে গিয়েছি?”
‘এলিজাবেথের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল। সে জানত রিচার্ডের কথা সত্যি। তার উপস্থিতি মানেই যুদ্ধ, ক্ষত, আর অশান্তি।
“এই কান্না করছ কেন? দাগের জন্য? আচ্ছা আচ্ছা এখুনি দূর করে দিচ্ছি।”
‘বলেই রিচার্ড এলোপাতাড়ি ছোট ছোট চুমুতে ভরিয়ে দিতে থাকে এলিজাবেথের গাল, ঠৌঁট, গলা,কানের লতি। এলিজাবেথের কান্নার তোড় আরো বাড়তে থাকে। দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল রিচার্ডের হাতে। সঙ্গে সঙ্গে রিচার্ড অস্থির ভাবে ওর ঠৌঁট চেপে ধরল এলিজাবেথের চোখে। বাচ্চাদের ভুলানোর মতে করে বলতে থাকল,
“সব দাগ দূর করে দিলাম। দেখো, এখন দাগ নেই, শুধু সুবাস আছে। দাগ দূর, সুভাসে ভরপুর।”
‘এলিজাবেথ স্তব্ধ হয়ে রইল। তার কান্নার মধ্যেই অজানা এক অদ্ভুত উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ল। বাচ্চাদের মধ্যে ঠৌঁট উলটিয়ে বলল,”কিসের সুভাস।”
“আমার শরীরের সুভাস। যখনই আমাকে মনে পড়বে। তখনই পাবে।”
‘এলিজাবেথ ধাক্কা দিয়ে রিচার্ডকে সরিয়ে দিল। নাকমুখ কুঁচকে বলল,”ফালতু কথা।”
‘রিচার্ড তেড়ে আসল না। ক্ষুব্ধতা প্রকাশ করে এই মুহুর্ত নষ্ট করতে চাইল না। তাকে শান্ত হওয়ার জন্য এই মেয়ের সঙ্গের প্রয়োজন। হঠাৎ রিচার্ড গম্ভীর গলায় আজব গান ধরল।
“না এই চোখে আর কিছু ভাসে না। তোকে ছাড়া একা রাতে চাঁদ হাসে না। এলিজাবেথ তুই, জান আমার তুই। তোর জন্যই হয়েছি আমি কলঙ্কিত।”
‘এলিজাবেথের চোখ দুটো ক্রোধ আর অপমানের অগ্নিতে দপদপ করে উঠল। গলা ছেড়ে চিৎকার করে উঠল, “আমি কলঙ্কিত করেছি মানে?”
‘রিচার্ড ঠোঁট কামড়ে এক অদ্ভুত ভঙ্গিতে ভ্রু নাচিয়ে বলল,
“আমার ভার্জিনি কেড়ে নিয়েছ।”
‘এলিজাবেথের বুকের ভেতর ছ্যাৎ করে উঠল। পুরোনো দিনের সেই ভয়াবহ স্মৃতিগুলো মুহূর্তেই ভেসে উঠল চোখে। ঘৃণা আর কষ্টে মন বিষিয়ে উঠল। চোখের কোণে জল জমে উঠে আবারো, গড়িয়ে পড়ার অপেক্ষা শুধু। কিন্তু।রিচার্ড তার আগেই কাছে এগিয়ে এল এলিজাবেথের দিকে।
“হুয়াই ইউ আর সো ফাইন, বেবি? লেট মি হার্ট ইউ মোর।”
‘এগিয়ে এলিজাবেথের চিবুক আঁকড়ে ধরার আগেই পেছন থেকে কারোর উপস্থিতি টের পাওয়া গেল। দু’জনেই দ্রুত পিছনে ফিরল।একটা লোক মেল ওয়াশরুম থেকে বেরুলো সবেমাত্র। তাদের এই অবস্থায় দেখে থমকে গেল। এলিজাবেথের নগ্ন পা ঝুলে ছিল, চুলগুলো এলোমেলো, রিচার্ড ছিল তার একদম কাছে। রিচার্ড লোকটাকে গমগমে গলায় চেঁচিয়ে বলল,
“শালা, যা করতে এসেছিস তা করে যা। দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কোষ্ঠকাঠিন্য হয়েছে? ফায়ার সার্ভিস ডাকতে হবে?”
‘লোকটা ভয়ে, লজ্জায় আর বিভ্রান্তিতে দ্রুত পালিয়ে গেল। লোকটা চলে যেতেই রিচার্ড আবার এলিজাবেথের ঠোঁটের দিকে ঝুঁকল। তবে আচমকা এক বিকট শব্দে থমকে গেল। গালে হাত চলে গালে। এলিজাবেথের ঠোঁট তিরতির করে কাঁপছে। মুহুর্তেই রিচার্ডের চোখ আগুনে পরিণত হলো। যেন এক জংলি জন্তু ফুঁসে উঠল। পকেট থেকে রিভলবার বের করে সোজা চেপে ধরল এলিজাবেথের কপালে।
“আল্লার বান্দির দেখছি সাহস বেড়ে গেছে। দিব নাকি টিকিট কেটে ওপরে পাঠিয়ে?”
‘এলিজাবেথ একটুও ভড়কে গেল না। কোনো কথা না বলে শুধু শক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রিচার্ডের চোখে। প্রকম্পিত ঠৌঁট জোড়া দাঁতে আঘাত হানছে। রিচার্ড কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে রইল৷ মিলে ছিল দু’টো অগ্নি দৃষ্টি। রিচার্ড সরে আসে। ঘন ঘন শ্বাস ফেলতে লাগল। পায়চারি করতে করতে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল। নিজের সাথেই বিড়বিড় করে বলল, “কন্ট্রোল… কন্ট্রোল।” তবুও ব্যর্থ হচ্ছে গ্যাংস্টার বস। বাধ্য হয়ে কয়েকটা শক্ত ঘুষি বসালো দেয়ালে। রক্তপাতের সাথে যেন ঝড়ে গেল সকল ক্রোধ,ক্ষোভ। কিছুক্ষণ পর রাগ নিয়ন্ত্রণ করে আবার এলিজাবেথের দিকে এগিয়ে গেল। একদম কাছে গিয়ে নিজে হাতে এলিজাবেথের পা তুলে নিজের কোমরে পেঁচিয়ে দিল। রিভলবারটা এলিজাবেথের কোমরে গুঁজে দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“এখন আমি কথা বলব। তুই শুধু হুম, হা করবি। বাড়তি কোনো প্রশ্ন করবি না। আমার ফিলিংস আসছে এখন।”
‘শব্দ করল না এলিজাবেথ। একই ভাবে নিটল থাকল। রিচার্ডের হাতে অঝোর ধারার রক্তপাতও ওকে একটুও টলাতে পারল না। এলিজাবেথের মধ্যে বাধ্যকতা দেখে খুশি হলো রিচার্ড। খুশি হয়ে নরম করে অধর ছোঁয়ালো নাকের ডগায়।
“আমি রং দেখানো শুরু করলে নিতে পারবেন তো?”
‘এলিজাবেথের হঠাৎ এমন কথায় মুহূর্তের জন্য থমকে গেল রিচার্ড। তবে বিস্ময়ের আবরণ খুব দ্রুত ছিন্ন হলো। ভিতরের দুষ্টু সত্ত্বা তখনই রঙিন জবাবের জন্য মুখিয়ে উঠল।
“হ্যাঁ, এলি জান হ্যাঁ। সেই দিনের অপেক্ষায় ই তো শুকিয়ে যাচ্ছি। এই-যে,তাকিয়ে দেখো, শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। একটু দেখাও না প্লিজ! জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দাও আমাকে, তোমার মনের রঙে ভাসিয়ে দাও!”
‘বলেই রিচার্ড এলিজাবেথের ঘাড়ে চেপে নিচের দিকে ইঙ্গিত করল! চোখে তার রসিকতার স্পষ্ট দৃষ্টি। সঙ্গে সঙ্গে এলিজাবেথ মনে মনে তওবা কাটল। এত বড় ভুল! এতটা রঙিন কথা নিয়ে এই নির্লজ্জের সামনে বলার সাহস করল কীভাবে সে! এটা তো গম্ভীর স্বভাবের নাক কাটা, ঠৌঁট কাটা।এলিজাবেথ রাগে ধাক্কা দিল রিচার্ডের কাঁধে। যদিও তাকে এক চুলও সরাতে পারল না, তবু তিরিক্ষি মেজাজে বলে উঠল,
“এসব বারো আনার কথা আমার কাছে বলবেন না। গিয়ে আপনার ওই লাড়া বেবিকে বলুন।”
‘লাড়ার নাম শুনেই রিচার্ডের চোখে আগুনের লেলিহান জ্বলে উঠল। রিচার্ড চায় না সেই অপ্রীতিকর অসহনীয় মুহুর্তের কথা এলিজাবেথ জানুক। তাই নিজের রাগ আড়াল করে ঠোঁটে হালকা হাসি টেনে বলল,
“ওটা বেবি? ধ্যাত! কোন দিক দিয়ে বেবির কাতারে পড়ে। শালির মধ্যে একটুও মায়া নেই। শুধু সুন্দর আর হট হলেই মায়াবতী হওয়া যায় না।”
‘এলিজাবেথ ভ্রু কুঁচকে সরু গলায় জিজ্ঞেস করল,
“তাহলে মায়াবী কাকে বলে?”
‘রিচার্ড আর একটু নিকটস্থ হলো। এলিজাবেথের কানের লতিতে ঠৌঁট ছুঁইয়ে দিয়ে হাস্কি স্বরে ফিসফিস করল,”শুধুই তোকে বলে! এই যেমন আমি ছুঁতেই শরীরটা কেমন থরথর করে কেঁপে ওঠে। লজ্জাবতীর মতো মাথা নুইয়ে ফেলিস, যেন মাটির সঙ্গে মিশে যেতে চাইছিস। ঠিক এটাই তো মায়াবীদের আসল বৈশিষ্ট্য। অভিমান আর মাধুর্যে ভরা এক অদ্ভুত সম্মোহন।”
‘রিচার্ড একটু থামল। কোমল স্বর মুহূর্তেই বদলে গেল তার চিরচেনা ভারিক্কি স্বরে।
“এসব স্টাইলিশ মেয়েদের পেছনে ঘুরলে শুধু দামি দামি লিপস্টিকের ক্যামিকেল খাওয়া যাবে, কিন্তু ভালো রান্না আর খাওয়া হবে না। আর খাওয়া-দাওয়ার বেপারে আমি কিন্তু খুবই নাক তোলা।”
‘অদ্ভুতভাবে এবার এলিজাবেথ নিজের রং বদলাল। হেসে দু’হাতে রিচার্ডের গলা পেঁচিয়ে ধরল। মুখটা ওর একদম কাছে এনে ঠোঁট গোল করে মিষ্টি গলায় বলল,
“তাহলে আসেন একদিন হাবিলীতে। একটু বসলাম, কিছু খেলাম। তারপর নাহয় মুড আসলে একটু কিছু করলাম। বুঝলেন তো, সবই মুডের উপর।”
‘রিচার্ড ঠোঁট কামড়ে ভ্রু গুছিয়ে এলিজাবেথকে গভীরভাবে দেখে নিল। খুব শীঘ্রই যে,সে ছলনার শিকার হতে চলেছে, এটা বুঝেও নিজেকে নিবৃত্ত করল না। ধনুকের মতো বাঁকানো কোমরটা ধরে এলিজাবেথকে আরেকটু কাছে টেনে আনল। চোখে চোখ রেখে বলল,”তাই বুঝি?”
“হুম,” ঠোঁট চেপে হাসল এলিজাবেথ।
‘রিচার্ড একটু হেসে প্রশ্ন করল, “তো এখন মুড কী চাচ্ছে?”
“মুড চাচ্ছে আপনার লাউ বাগানে লাথি মেরে পালাই!”
‘যেমন বলা, তেমনই কাজ। রাগ আর সাহসের মিশেলে এলিজাবেথ জোরসে এক লাথি বসালো রিচার্ডের টিউব লাইটে। হঠাৎ আঘাতে রিচার্ড ব্যথায় দু’কদম পিছিয়ে গেল। সেই সুযোগে এলিজাবেথ লাফ দিয়ে নেমে ছুটল।প্রিন্সেস এলিজাবেথ খালি পায়ে ছুটে চলল, রাজকীয় আভিজাত্য পেছনে ফেলে তার প্রিন্স থেকে মুক্তির খোঁজে।রিচার্ড ব্যথায় কুঁকড়ে পড়েও গলা ছেড়ে ডাক দিল। কণ্ঠে ব্যথার সঙ্গেও মিশে ছিল বিটলামি,
“ও মেয়ে, চুমু না দিয়ে তুমি যাইও না!
ও মেয়ে, মন না দিয়ে তুমি যাইও না!”
‘রিচার্ডের ঠোঁটের কোণে ফিকে হাসি ফুটে উঠল। কিন্তু সেই মুহূর্তেই চোখ পড়ল দরজার অপর প্রান্তে। সেখানে তাকবীর দাঁড়িয়ে। পাথরের মতো শক্ত আর নড়বড়ে। রিচার্ডের হাসি মিলিয়ে গেল। গাম্ভীর্যের ভারে মুখ আঁধার হলো। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল তাকবীরের সামনে। চোখে চোখ রাখল।
“জানিস কেন তুই হিরো আর আমি ভিলেন? কারণ তোর মধ্যে ছাড় দেওয়ার মনোভাব আছে, তাই তুই হিরো। এ-যে দেখ এখন যেমন, নিজের পছন্দের মানুষকে অন্যের সাথে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখেও দুঃখের সাগরে ভেসে যাচ্ছিস, কিন্তু কিছু বলতে পারছিস না। কিন্তু তোর জায়গায় আমি হলে শা*লির ঘাড় থেকে গলা আলাদা করে ফেলতাম। কারণ আমি ভিলেন, আর আমাদের মধ্যে এটাই পার্থক্য।”
‘তাচ্ছিল্যের স্বরে হেসে বলল রিচার্ড। এক হাত পকেটে ঢোকানো। কণ্ঠে গম্ভীরতা৷ তাকবীরের অভিব্যক্তি তখনও শক্ত, তবে ভিতরে ভিতরে খুবই নড়বড়ে।
“এ জেন্টলম্যান নেভার ইনসাল্ট হিজ লেডি, নট ইভেন অ্যাজ এ জোক।”
‘তাকবীরের কথায় রিচার্ড কাঁধ উঁচিয়ে নিরুদ্বেগহীন ভাবে নিয়ে বলল,”কে জেন্টলম্যান? যেটা আমি না সেটার তকমা আমার উপর দিতে যাচ্ছিস কেন?”
‘তাকবীর নিঃশব্দ। নিরবতার মাধ্যমে দমানোর চেষ্টা করছে ভিতরের তীব্র ক্রোধ। রিচার্ড পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরালো। মুখ ভর্তি ছাই রঙা ধোঁয়া গুলো তাকবীরের মুখের উপর ছেড়ে দিয়ে গান ধরে সামনে হাঁটা দিল।
“আগে তো বুঝি নাই আমি
পিরিতের কি জ্বালা।
হাউজ কইরা কেন খাইলাম
পিরিতেরই ঘোলা!
দুধ, বাত আর কলা
গিলতে পারলাম না আমি।
ঠেকিলো গলায় রে ইতালির পোলা,
আমায় ছক্কা মাইরা দিলো রে
ইতালির ওই পোলা।”
‘রিচার্ড কাটা ঘায়ে লবণ ছিটিয়ে চলে গেল। তাকবীর পিছন ঘুরে দাঁড়াল।চেহারায় বিধ্বস্ততার ছাপ। গভীর এক যন্ত্রণার ঝড় বয়ে যাচ্ছে তার ভেতরে। অনুভূতির ভারে নুয়ে পড়ে ঠোঁট দিয়ে বেরিয়ে এলো চাপা অভিমানী স্বীকারোক্তি।
“বাস্তবতা দিয়ে কি এসে যায়?
তুমি আমারই থাকবে, আমৃত্যু।
দেহটা যদি না-ও হয় অন্য কারোর হোক,
তোমার হৃদয়টা চিরকাল আমারই।”
‘ধীর পায়ে এগিয়ে গেল তাকবীর মিররের সামনে। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল নিজের প্রতিবিম্বের দিকে। চোখে অদ্ভুত শূন্যতা। যেন সে নিজেকে দেখতে পাচ্ছে না, বরং অন্য কোনো অচেনা রূপ দেখছে। হঠাৎ এক প্রচণ্ড ধাক্কায় মিররটা ভেঙে ফেলল। ভাঙা কাচের ধারালো টুকরো হাতের পিঠে ফলা ফলা হয়ে কাটল। রক্ত ঝরছে ফোঁটা ফোঁটা।কিন্তু তাকবীরের চোখে করুণার ছিটেফোঁটাও নেই। তার কৃষ্ণগহ্বরে ফুটে উঠল পৈশাচিক হিংস্রতা। হাতের রক্ত মুঠো করে ধরে মাথা নিচু করে বিরবির করতে থাকল, “কি ভেবেছিস, আমি এমনটা বলব? নাহ… নাহ… নাহ! রক্তের বন্যা বইয়ে দিব আমি। সব শেষ করে দিব।”
‘তখনই দৌড়ে আসে রেয়ান। তাকবীরের বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে এক মুহূর্তের জন্যও বিচলিত হলো না। এমন দৃশ্য তার জন্য নতুন কিছু নয়। ঠাণ্ডা গলায় বলল,
“বস, ম্যাম ড্রিংকস করছে।”
‘তাকবীর মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। ভাঙা মিররের কাচ আর রক্তমাখা হাত ভুলে, বদ্ধ উন্মাদের মতো ছুটে গেল পার্টির দিকে। তাকবীর পার্টিতে গিয়ে দেখতে পেল এলিজাবেথ ইতিমধ্যে প্রচণ্ড বেশি খেয়ে ফেলেছে। টলমল হাতে আরেক বোতল খুলতে গেলে তাকবীর গিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে বোতলটা আটকাল। রেয়ানের দিকে তাকিয়ে কঠিন স্বরে বলল,”গাড়ি বের কর।”
‘রেয়ান কোনো প্রশ্ন না করে ছুটে গেল তৎক্ষণাৎ। এদিকে এলিজাবেথ বোতলটা ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য জোরাজুরি করতে থাকল। তাকবীর ওর হাত চেপে ধরে রাখল শক্ত করে। চারপাশের মানুষজন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, কিছুটা বিরক্তও। এলিজাবেথ মাতাল কণ্ঠে শুরু করল আবোলতাবোল বকবক। প্রতিটি কথা তীর হয়ে গিয়ে বিঁধতে লাগল তাকবীরের হৃদয়ে।
“প্রথমে মনে হয়ছিল, গোলামের পুতের জন্মই হয়ছে আমার জন্য। পরে দেখি আস্তো শয়তান।”
“সে কতোটা খারাপ, এখনও পর্যন্ত সত্যিটা স্বীকার যাইতেছে না ভালো মানুষ।”
“ঐ নীল চোখে অন্য কেউ কেন তাকাবে?”
‘শেষের এই সাতটা শব্দ ছুরির মতো চিরে দিল তাকবীরের ভগ্ন হৃদয়। কৃষ্ণগহ্বরে ফুটে উঠল শূন্যতা। বুকের গভীর থেকে এক আক্ষেপ নিয়ে বলল,
“এগুলো না বলে মেরে ফেলতে চাও,
সেটা বললেই তো পারো, প্রিয়া আমার।”
‘গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন ছিল এলিজাবেথ। মাতাল অবস্থায় তাকবীরের কোলে ঢলে পড়ার পর আর কিছুই মনে নেই ওর।ফোনের ক্রমাগত নোটিফিকেশন ঘুমের স্বপ্নময় পর্দা ভেদ করে ঢুকে পড়ল। বিরক্ত ভঙ্গিতে হাতরে ফোনটা হাতে তুলে নাম্বার না দেখেই একটি ভয়েস মেসেজ প্লে করল। ভেসে এলো ইবরাতের কান্না। ইবরাতের আতঙ্কিত কণ্ঠস্বর এলিজাবেথের মস্তিষ্কে বজ্রপাত ঘটাল।
“এলিজাবেথ বোন আমাকে বাঁচাও। ওরা মেরে ফেলবে আমাকে।”
‘মুহূর্তেই ছুটে গেল এলিজাবেথের ঘুম। বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল ভীষণ শঙ্কা। নাইট স্যুট পরা অবস্থাতেই তড়িঘড়ি করে রুম থেকে বেরিয়ে ছুটল। কাল পার্টিতে ইবরাতের সঙ্গে কথা বলার সময় ওদের রুম নম্বর জেনেছিল। পাশের বিল্ডিংয়ে তাদের রুম। আর কিছু ভাবার সময় নেই। এলিজাবেথ দৌড়ে বেরিয়ে গেল তাদের বিল্ডিং থেকে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য অবস্থায়। কিন্তু কিছু দূর যেতেই হঠাৎ পাশের একটি গাড়ির দরজা খুলে গেল। সেখান থেকে দুটি শক্ত হাত বেরিয়ে এসে ওর মুখ চেপে ধরল। কোনো শব্দ করার আগেই ওকে গাড়ির ভেতর টেনে নিয়ে গেল। চারপাশ যেন বোবা হয়ে গেল, কেউ কিছু টেরও পেল না। রাতের অন্ধকারে নিঃশব্দে হারিয়ে গেল এলিজাবেথ।
‘বেলা তখন বারোটা। কাল তাকবীর নিজেও অধিক পরিমাণের নেশা করেছিল। রাতের অতিরিক্ত মদের প্রভাব এখনও কাটেনি। চোখের পাতায় ভর করে আছে পাহাড়সম ঘুম। হঠাৎ ফোনটা বিকট শব্দে ভেঁজে উঠল। ঘুমজড়ানো হাতে ফোন কানে নিতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো এলিজাবেথের কান্না আর অস্পষ্ট আহাজারি। বুকের ভিতর ঢেউ খেলে গেল তাকবীরের। মুহূর্তে সমস্ত ঘুম উবে গেল। এরিমধ্য অপর প্রান্ত থেকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। তাকবীর পাগলের মতো দৌড়ে ছুটল এলিজাবেথের রুমে। কিন্তু এলিজাবেথের রুম একেবারে ফাঁকা।
‘তাকবীরের খেলোড়ী মস্তিষ্কের আর কিছু বুঝতে বাকি রইল না। চোখে হিংস্রতার আগুন জ্বলে উঠল। দম নিয়ে সোজা নিজের রুমে গেল। ড্রয়ার খুলে বের করল নিজের লাইসেন্সকৃত গ্লক পিস্তল। দ্রুত পকেটে সেট করে ফোন বের করে রেয়ানকে কল দিল। কথা শেষ হতেই ফোন কেটে দিয়ে, পিস্তল কোমরে গুঁজে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। পায়ের প্রতিটি পদক্ষেপ প্রতিশোধের ঘোষণা দিচ্ছিল।
‘একটা ধুলোমাখা গুদাম ঘরের মেঝেতে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে এলিজাবেথ। কপালের পাশ থেকে গড়িয়ে আসছে রক্তের সরু ধারা। চুল এলোমেলো, শরীর ক্লান্ত, এবং চোখে ভয়ের ছায়া। দস্তাদস্তির চিহ্ন ওর অবস্থা আরও করুণ করে তুলেছে। সেই কখন থেকে গুনগুন করে কাঁদছে এলিজাবেথ। মনের ভেতর একটাই ভাবনা—ইবরাত কি ঠিক আছে? অথচ ওর অচেতন মনের এখনও অজানা ইবরাত তার স্বামীর বক্ষপিঞ্জরের গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
‘হঠাৎ দরজার পাশ থেকে ভেসে এলো পায়ের শব্দ আর ফিসফিসে কথা। গলার স্বরগুলো আরও কাছে আসতেই এলিজাবেথ ভয়ে আরও গুটিয়ে গেল। থরথর করে কাঁপতে থাকে শরীর। অতীতের ভয়ে সংকীর্ণ এলিজাবেথ নিজের প্রাণ আর ইজ্জতের জন্য প্রার্থনা করতে লাগল। বাইরে থেকে ভেসে আসা হাসি আর ফিসফিস শব্দ সেই ভয়ঙ্কর রাতগুলোর ইঙ্গিত দিচ্ছিল।
“বস এটা ঠিক হচ্ছে না।”
‘লোকটা দরজার লকে হাত রেখেও থমকে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনের দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বলল, “কি ঠিক হচ্ছে না?”
‘পেছনের লোকটা একটু দ্বিধা নিয়ে বলল, “আমাদের কাজ তো শুধু কিডন্যাপ করা পর্যন্তই ছিল। স্পষ্ট কথা ছিল মেয়েটার গায়ে যেন ফুলের টুকরোও না লাগে।”
‘অপর লোকটা অদ্ভুত একটা বিকৃত হাসি দিয়ে উত্তর দিল,”হ্যাঁ, সেটা শেষ। কিন্তু এখন আমাদের নতুন কাজ এসেছে। ডাবল টাকা!”
“মানে?”
‘লোকটা কিছু না বলে পকেট থেকে একটা ফোন বের করল। স্ক্রিনে একটা ছবি দেখাল। ছবি দেখেই প্রথম লোকটার মুখে বাঁকা হাসি ফুটে উঠল। বলল, “ওকে বস। দেশ তো ছাড়তেই হবে, তার আগে একটু মজা করাই যায়। আপনার পরে কিন্তু আমি! মাইয়াডা হেব্বি কড়া মাল।”
‘খপ শব্দে খুলে গেল দরজাটা। শরীরের ভয়ের স্রোত বয়ে গেল এলিজাবেথের। অকুতোভয়ী হৃদিন্ড হৃদয়ে ঝড় উঠে। একটা কালো মোটাসোটা লোক ঠৌঁটের কোণে কুৎসিত হাসি ঝুলিয়ে এক পা,এক পা করে এলিজাবেথের দিকে এগিয়ে আসছে। লোকটার প্রতিটা কদমে কদমে পিছাতে থাকে এলিজাবেথ। ঠেলে ঠেলে পিছনের যাওয়ার কারণে পায়ের অংশের কাপড় কিছুটা উপরে উঠে যায়। ফলে, ফুটে উঠল ওর ধকধকানো সাদা পা। লোকটার চোখে ঘোর লেগে গেল। এগিয়ে দিয়ে হাত রাখল এলিজাবেথের পায়ে। শরীরের মধ্যে কোনো অদৃশ্য কারেন্ট ছোঁ মেরে যায় এলিজাবেথকে। কাঁদতে থাকে, কিন্তু কান্নার শব্দ আটকে থাকে। কোনোভাবে মুখের বাইরে বের হতে পারে না মুখ বাঁধার কারণে।
‘লোকটা এলিজাবেথের হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিল। সঙ্গে সঙ্গেই এলিজাবেথ এক বুক সাহস সঞ্চয় করে লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে দৌড়ে গেল দরজার দিকে। কিন্তু তার ভাগ্য প্রতিকূল ছিল—দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ। এলিজাবেথের ভিতর সব শুকিয়ে আসে। কাঁপা কাঁপা হাতে পাজামার পকেট থেকে ফোনটা বের করে পিঠের পিছনে লুকিয়ে কাকে যেন কল দিতে চাইছিল। কিন্তু তার আগেই লোকটা ছুটে এসে এলিজাবেথের চুলের মুঠি টেনে ধরল। তাকবীরের নাম্বার ছিল প্রথমে কন্টাক্টে। এক লহমায় কল চলে যায় তাকবীরের নাম্বারে। এলিজাবেথের গোঙানি শুনে ওপাশ থেকে তাকবীর পাগলের মতো চিৎকার করতে থাকে। তাকবীরের কণ্ঠ পেয়ে লোকটা ঘাবড়ে যায়, এলিজাবেথের ফোনটা হাত থেকে টেনে নিয়ে পা দিয়ে পিষে দেয়।
‘শুরু হয় তাদের মধ্যে তীব্র দস্তাদস্তি। লোকটা এলিজাবেথকে আক্রোশ মেটাতে একের পর এক চড় মেরে রক্তে ভরিয়ে দেয় ওর অবয়ব। তবুও এলিজাবেথ হাল ছাড়ে না, প্রতিরোধ করতে থাকে নিজেকে সপে দেয় না। শেষ পর্যন্ত না পেরে লোকটা আবারও জোর করে তার হাত-পা বেঁধে ফেলল। এলিজাবেথের চোখের সামনে অন্ধকার নেমে আসে। শরীর অসাড় হয়ে যায় রক্তে ভিজে। লোকটা এলিজাবেথকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় খড়ের উপর ফেলে লালসার দৃষ্টিতে চেয়ে শার্টের বোতাম খুলতে শুরু করে। মৃত্যুর পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল এলিজাবেথ। ঠিক তখনই
হঠাৎ বিকট শব্দে ভেঙে গেল দরজাটা। তেড়ে এলো বজ্রকণ্ঠ।
“তুই শুধু ওর গায়ে হাত দে, বাই°°°দ। ঈদ ছাড়াই আজ কুরবানি হবে, আর বলি হবি তুই।”
‘লোকটা চকিতে পিছন ফিরল। চোখে পড়ল হিংস্র রূপে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তাকবীরকে। চোখের বুজে যাওয়ার আগেই তাকবীবের প্রতিচ্ছবি এলিজাবেথের চোখের সামনে ভেসে উঠল। সহসা এক উজ্জ্বল শিখা প্রজ্জ্বলিত হলো ভিতরে, যেন সৃষ্টির পাখি উড়ছে অন্ধকারের মধ্যে। শরীর আর সাই দিল না। সহসাই শিখা নিভে গেল চোখ বন্ধ হওয়ার আগেই। হঠাৎ করে লোকটাও এলিজাবেথের পাশে লুটিয়ে পড়ল। একটা গুলি তার মস্তক ভেদ করে গিয়ে দেওয়ালে বিঁধল।
‘এলিজাবেথ আর কোনো অসহনীয় ব্যথা অনুভব করল না। ওর শরীরটা শূন্যে ভাসছে, সবকিছু ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। তাকবীর ওকে কাঁধে তুলে বেরিয়ে সময় শুধু ঝাপসা চোখে অবলোকন হয় দরজার বাইরে মন্ডু-ছাড়া কয়েকটা লাশ, মেঝেতে র’ক্তের বন্যা। দরজার এক কোণে পড়ে ছিল একটা ধারালো ছু’রি, র’ক্তে ভেজা। গুদাম ঘরটা রিসোর্টের খুব কাছেই ছিল। তাই ফোন ট্রেস করে তাকবীরের এখানে পৌঁছাতে বেশি সময় লাগেনি। এই দ্রুততার জন্যই আজ বেঁচে গেল এলিজাবেথ-এই ভয়াবহ, মরণছায়া থেকে।
‘তবে কথায় আছে, শেষ ভালো যার সব ভালো তার। আজ যেন ভাগ্যও তাদের প্রতিকূলে। এলিজাবেথ একেবারে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। কপাল আর নাক থেকে অনবরত রক্ত ঝরছে। তাকবীর তড়িঘড়ি নিজের শার্টের অংশ ছিঁড়ে এলিজাবেথের মাথা বেঁধে দিয়েছে, কিন্তু তাও র’ক্তপাত থামছে না। তবে এই রক্তপাতের চেয়েও ভয়াবহ রক্তক্ষরণ হচ্ছে তাকবীরের হৃদয়ে। ঝড়ের বেগে গাড়ি চালাচ্ছে তাকবীর! ভিতরে ভিতরে ভেঙে পড়ছে, দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে। এরই মাঝে তারা তুমুল জ্যামের মধ্যে পড়ে। তাকবীর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। ক্রমাগত হর্ন বাজাতে থাকে। কিন্তু একটাও গাড়ি সরছে না সামনে থেকে। ক্রোধে স্টিয়ারিংয়ে ঘুষি মারতে থাকে এলোপাতাড়ি। বারবার এলিজাবেথের রক্তাক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে, ওর অবশ দেহ দেখে তাকবীরের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠছে।
‘একজন মন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও আজ তাকবীর নিয়ম ভেঙে ফেলল। ট্রাফিক জ্যামের বাধা পেরোতে বাধ্য হয়ে রং সাইড দিয়ে গাড়ি চালাতে শুরু করল। আর কোনো উপায় ছিল না তার। তীব্র আতঙ্ক আর অসহায়তায় মুখে কোনো ভাবনাই স্থির হচ্ছিল না। ট্রাফিক পুলিশ তাকবীরের রাস্তা ব্লক করে দিতে চাইলে তাকবীর এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে অর্ধেক শরীর গাড়ির জানালা দিয়ে বের করে । বাংলাদেশের একজন সংসদ সদস্যকে কে না চিনবে! পুলিশরা এক মুহূর্ত দেরি না করে পথ ছেড়ে দিল, উল্টো তাকবীরকে স্যালুট জানাল। আজ সেই সম্মান গ্রহণ করার মতো অবস্থায় ছিল না তাকবীর। আবারও সিটে ফিরে ফুল স্পিডে গাড়ি চালাতে থাকল। হাত-কাঁপা স্টিয়ারিং আর ফেটে যাওয়া হৃদয়ের মাঝে একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে তার এলোকেশীকে হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে।
‘এলিজাবেথের মাথা থেকে ঝরতে থাকা রক্তের ধারার মতোই তাকবীরের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তায় শরীর ঘামে ভিজে যাচ্ছে। মাথার ভেতর এলিজাবেথের প্রতিটি মুহূর্তের অবস্থা তাকে আরও বিপর্যস্ত করে তুলছে। এবার সমস্যার সমাধান তো দূর, নতুন বিপদ এসে সামনে দাঁড়াল। স্ট্রেইট কাটে যাওয়ার জন্য তাকবীর পাহাড়ি ঢালু রাস্তা ধরে এগোচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই সামনের পুরো রাস্তা কয়েকটি গাড়ি দিয়ে ব্লক করা। কয়েকজন কালো পোশাকধারী লোক গাড়ির সামনে আরামসে বসে আছে, যেন তারা অধীর অপেক্ষায় ছিল। তাকবীরের ওদের চিনতে দেরি হলো না। ভয় আর হতাশায় তার গলা শুকিয়ে গেল।
‘তাকবীর একবার এলিজাবেথের ফ্যাকাসে মুখের দিকে তাকিয়ে ফোঁস করে দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে গাড়ি থেকে নেমে এল। রাস্তার মাঝখানে কালো পোশাকধারীদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। হঠাৎ একজন ঠোঁট কামড়ে ঠাণ্ডা হাসি দিয়ে লাফিয়ে গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে এসে তাকবীরের সামনে দাঁড়াল। এটাই ভিডিও ফ্রুটেজের সেই লোক, যাকে তাকবীর গান পয়েন্টে নিয়েছিল।
“আমরা বিজনেস রিলেটেড ঝামেলা পার্সোনাল ইস্যুতে না নিই ওকে? রাস্তা ছেড়ে দাও। শি নিডস ট্রিটমেন্ট।”
‘তাকবীর শান্ত চাপা কণ্ঠে বলল। লোকটা হঠাৎ উচ্চস্বরে হাসল। তার পেছনে থাকা সঙ্গীরাও সেই হাসিতে যোগ দিল। তাদের অট্টহাসি এতটাই তীব্র যে গুমোট পাহাড়ি পরিবেশ আরও ভারি হয়ে উঠে। হঠাৎ লোকটা তাকবীরের কানের মুখে মুখ নিয়ে হিসহিসিয়ে বলল,
“দিলাম ছেড়ে।”
‘তৎক্ষণাৎ, একটা মালবাহী লড়ি এসে তাকবীরের গাড়িটাকে এক ধাক্কায় নিচে ফেলে দিল। চকিতে পিছন ফিরে তাকাল তাকবীর। এক মুহূর্তেই থমকে গেল ওর দুনিয়া। নিঃশ্বাস হিম হয়ে গেল। নিচে গভীর জঙ্গল। অন্ধকারে ঢাকা এক বিপন্ন প্রকৃতি। এলোকেশী? মনে ছায়া ফেলল এক পুরনো প্রতিচ্ছবি। ছুটে যেতে পারল না তাকবীর। পিছন থেকে এক শক্ত আঘাতে নিচে লুটিয়ে পড়ল। চোখের সামনে ভাসছে এলিজাবেথের রিনঝিনে হাসি। ধীরে ধীরে নিভে গেল সন্ধ্যার প্রদীপ, আর তার সঙ্গেই হারিয়ে গেল তাকবীরের চেতনা। ঘন জঙ্গলের গহীনে হারিয়ে গেল এলিজাবেথ।
“বল কাদের কোথায়?”
‘নিশ্চুপ সামসুল। মুখ পুরো রক্তে মোড়ানো, এমনকি একটা জায়গাও রক্তমুক্ত নয়। তবুও অবিশ্বাস্যভাবে দৃঢ় সে। চার ঘণ্টার অমানবিক টর্চারেও মুখ দিয়ে একটাও শব্দ বের করেনি। রিচার্ড বিরক্তিতে হাত থেকে কাটারিটা ফেলে দিল। সামসুলের আঙুলের ফাঁকে ঠেসে দেওয়া লোহার টুকরোগুলো বের করে আনল একটা একটা করে। লুকাস ততক্ষণে এক কোটা ব্লিচিং পাউডার এগিয়ে দিল রিচার্ডের দিকে। বাঁকা হাসি ফুটল রিচার্ডের ঠোঁটে। ধীরে ধীরে কর্ক খুলে পাউডারটা ছিটাতে শুরু করল সামসুলের কাটা আঙুলের ফাঁকে,যেভাবে সালাদের উপর লবণ ছেটানো হয়।
ব্লিচের জ্বালায় সামসুলের গলা ফেটে যাচ্ছে, তবুও সে কিছু বলতে নারাজ। চিৎকার করতে করতে যখন কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল তখনও সামসুল হাল ছাড়ল না।
‘রিচার্ড এবার একটা ইলেকট্রনিক প্লাজমা কাটার হাতে তুলে নিল। কাটারের তীক্ষ্ণ ধাতব শব্দে কেঁপে উঠল ঘর। রিচার্ড স্বাভাবিক অভিব্যক্তিতে সামসুলের মধ্যমা আঙুলে সেট করে ধীরে ধীরে উপরের দিকে চালাতে লাগল প্লাজমা কাটার। ফুটো হতে থাকা মাংসপেশি আর রক্তের স্রোতে ভিজে গেল রিচার্ডের মুখ। সামসুলের শরীর ধীরে ধীরে নিস্তেজ হতে হয়ে আসে মনের শক্তিটুকু শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আর অক্ষুণ্ণ রইল না।
“বলছি! আমি বলছি!”
‘তখনই রিচার্ডের ফোন বেজে উঠল। লুকাস ফোন কানে ধরতেই চোখেমুখের রং মুহূর্তেই বদলে গেল রিচার্ডের। প্রথমবারের মতো দুশ্চিন্তার ছাপ ফুটে উঠল গ্যাংস্টার বসের অবয়বে। সমুদ্র-নীল চোখে এবার এক অগ্নুৎপাতের ছায়া। সামসুলের আর কোনো কথা শোনার অপেক্ষা করল না। সহসা রিচার্ড এক ঝটকায় প্লাজমা কাটার চালিয়ে দিল সামসুলের কণ্ঠনালিতে। চুপ হয়ে গেল সব। কিন্তু রক্তের গন্ধ তখনও বাতাসে ভাসছে।
‘আয়না সবচেয়ে সৎ। যা আমরা, ঠিক তাই দেখায় নির্মল, নিখুঁত। কোনো ভেজাল নেই। সারাজীবন শক্ত পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকা গ্যাংস্টার বসের মনেও আজ কেমন এক শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে তা বাইকের ফ্রন্ট মিররে স্পষ্ট হয়ে ধরা দিচ্ছে। কপালের গভীর ভাঁজগুলো যেন চিৎকার করে জানাচ্ছে ভিতরের অস্থিরতার গল্প। বাইরের পৃথিবী আজ তার গতিহীন নিয়ম মানছে না। বাতাসের স্রোতও পিছু হটেছে রিচার্ডের বাইকের গতির সামনে। মৌলভীবাজারের দিকে ছুটে চলেছে রিচার্ডের ব্ল্যাক মনস্টার ভার্সন থ্রী। স্পিডোমিটারের কাঁটা তখন শেষ সীমায় ঠেকেছে।
‘রিচার্ডের প্রিয় যন্ত্র দুটি—তার কালো মার্সিডিস আর ভার্সন থ্রি মনস্টার এডিসন। তবে বাইকের প্রতি ওর নির্ভরশীলতা আলাদা। ব্যক্তিগত প্রতিটি কাজে বাইকই তার একমাত্র সঙ্গী। সেই সম্পর্ক থেকে জন্ম নিয়েছে এক অনন্য দক্ষতা। তাই তো গতিহীন ভাবে প্রতিটি টার্নেল পেরিয়ে যেতে পারছে নিস্পৃহ দ্বিধাহীন, নির্ভুল শুধু নিখুঁত নিয়ন্ত্রণের এক শক্তিশালী উদাহরণ দিয়ে। ভিতরে সকল আক্রোশ ঢালছে গিয়ারের উপর। প্রশস্ত বুকে বাতাস আছড়ে পড়ছে নির্ভীক স্রোতের মতো। রাস্তার পাশের প্রতিটি মুখ অবাক হয়ে চেয়ে আছে রিচার্ডের গতির দিকে। চোখের পলকে সবাইকে পেছনে ফেলে অপ্রতিরোধ্য এক শক্তির মতো রিচার্ড
ছুটে চলেছে সেই গন্তব্যে। যেখানেই রয়েছে তার সবকিছু। তবে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব।
‘রিচার্ডের বাইক অবশেষে গিয়ে থামল সেই কাঙ্ক্ষিত স্থানে। তীব্র গতির বাইক আচমকা ব্রেক কষতেই পিছনের চাকা পাঁচ ইঞ্চি শূন্যে উঠে গেল তবে রিচার্ডের নিখুঁত নিয়ন্ত্রণে মুহূর্তেই স্থির হলো। চাকার কর্কশ শব্দে আধো আলোর চারপাশ ভারি হয়ে উঠে। ইতিমধ্যে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। এম্বুলেন্স, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস সব উপস্থিত থাকলেও জঙ্গলের ভিতর এখনও কেউ ঢুকেনি। রিচার্ডের কঠোর নিষেধাজ্ঞা। এত বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে তবু কোনো সাংবাদিকের আনাগোনা নেই এখানে। রিচার্ড পুরো পরিস্থিতি নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিয়েছে ওর কাছে খবর যাওয়া মাত্রই। বাইক থেকে নেমেই রিচার্ড সামনে দাঁড়ানো এক ব্যক্তির কলার চেপে ধরল। চোখে আগুন, মুখে উগ্রতার তীব্র ছাপ। হিংস্র পশুর মতো গর্জে উঠল রিচার্ড,
“আজ সকল বন্য প্রাণীদের জন্য ভোজের আয়োজন করব। আর তাদের প্রধান আহার হবি তুই!”
‘রিচার্ডের শশব্যস্ত বিদুৎ বেগী চাহনি দেখে কেঁপে উঠল লোকটা। এই লোক এলিজাবেথকে দেখে রাখার দায়িত্বে ছিল। রিচার্ড লোকটাকে ছেড়ে অস্থির ভাবে পায়চারি করতে থাকে। হাত নিশপিশ করছে। সহ্যশক্তির শেষ সীমানায় দাঁড়িয়ে। একবার ঘন জঙ্গলের দিকে তাকাল রিচার্ড। মৃদু শব্দ করে উঠে বুকের ভিতর। অস্থিরতা আরো বেড়ে গেল রিচার্ডের। ভেতরের চাপা উত্তেজনা আরও তীব্র হল। হঠাৎ লোকটার দিকে ফের তেড়ে গেল রিচার্ড। গলার স্বরে হুকুম,
“ব্লাস্ট হয়েছে কোনো?”
‘লোকটা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে মাথা নেড়ে জানাল না। গভীর স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলল রিচার্ড। বড় শ্বাস টেনে আবার প্রশ্ন করল,”যা যা বলেছিলাম, সব রেডি তো?”
“জি, বস।”
“গিভ মি ওয়ান।”
‘লোকটা দ্রুত একটা ওয়াকিটকি এগিয়ে দিল। রিচার্ড সেটি কোটের পকেটে ঢুকিয়ে নিল। পরপর ওয়েস্ট কোটের পকেট থেকে একটা বিশেষ ঘড়ি বের করল। ঘড়িটার ডিসপ্লেতে মাঝ জঙ্গলের লোকেশন আর শরীরে রক্ত সঞ্চালনের হার দেখাচ্ছে।
“ওকে, যেভাবে বলেছি ঠিক সেভাবে কর। ফাস্ট।”
‘এই বলে রিচার্ড দ্রুত জঙ্গলের ভিতর ছুটল। পিছন থেকে এক পুলিশ অফিসার সতর্ক করল,”স্যার এটা জঙ্গল ভয়ানক। একা যাওয়া রিস্ক।”
‘রিচার্ড না থেমে পেছন ফিরে চিৎকার করে,”শি ইজ অলসো অ্যালোন ইন দেয়ার ড্যামেট। তাপমাত্রা দ্রুত কমে আসছে। আমার রেড…” কথা শেষ হওয়ার আগেই রিচার্ডের শব্দ জঙ্গলের গাঢ় অন্ধকারে মিশে গেল। পাহাড়ি অঞ্চলে সাধারণত খুব দ্রুত শীত নেমে আসে এবং শীতের প্রকোপও বেশি থাকে। ইতিমধ্যে চারপাশে গা কাঁপানো ঠান্ডা বাতাস বইছে। রিচার্ড জঙ্গলের ভিতর ছুটে যেতেই লোকটা দ্রুত কারও সঙ্গে যোগাযোগ করল। মুহূর্তের মধ্যে একটানা কয়েকটা হেলিকপ্টার উড়ে গেল জঙ্গলের উপর দিয়ে। আকাশ থেকে মেঘের মতো নেমে আসতে লাগল অসংখ্য ওয়াকিটকি আর ফ্লেয়ার লাইট। পুরো জঙ্গল জুড়ে আলো আর যোগাযোগের জাল বিছিয়ে দেওয়া হয়।
‘বিধ্বস্ত, ক্ষতবিক্ষত শরীরে এলিজাবেথ একটা গাছের ডালে ঝুলে ছিল। দেহের বিভিন্ন জায়গা থেকে এখনও রক্ত চুইয়ে পড়ছে। ভিজে যাচ্ছে মাটি। এলিজাবেথের জ্ঞান ফিরতেই সামান্য নড়াচড়া করার চেষ্টা করলে নড়বড়ে ডালটা সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে নিচে আছড়ে পড়ল।এলিজাবেথের হৃদয়বিদারক চিৎকারে প্রাঙ্গণ কেঁপে উঠল। সেই চিৎকারের মধ্যে ভেসে এলো হাড় ভাঙার ভয়ংকর মটমট শব্দ। শরীরজুড়ে তীব্র ব্যথা, শীতের কামড় আর রক্তক্ষরণে শরীর ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। কান্নার শক্তিটুকুও আর নেই। কেবল একটা শীতল নিস্তব্ধতা ওকে ঘিরে ধরেছে। ঠৌঁট কামড়ে কাঁদতে থাকে এলিজাবেথ। সে তো সব কিছু থেকে দূরে চলেই যাচ্ছিল। তবুও এই দুর্দশার জীবন তাকে ছাড়ছে না। ধ্বংসযজ্ঞ আর পাপাচারে নিমজ্জিত এক অন্তহীন মরীচিকার জীবন থেকে মুক্তির আশায়ই তো সে এতদূর পালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
‘হঠাৎ উপর থেকে ধাতব প্রকৃতির কিছু একটা পড়ল এলিজাবেথের পায়ের উপর। তীব্র ব্যথায় দ্বিতীয় দফায় চিৎকার করে উঠল এলিজাবেথ। যন্ত্রণা সামলে পায়ের উপর পড়া জিনিসটা হাতড়ে ধরল। অন্ধকারে অনেক চেষ্টার পর বুঝল এটি একটা ওয়াকিটকি। এলিজাবেথ চিনতে পারল এই যন্ত্রটি। এক মুহূর্তের জন্য ভেতরে আশার আলো জ্বলে উঠে। কিন্তু সে ওয়াকিটকি ব্যবহার করার পদ্ধতি জানে না। তবু অস্থির হাতে বোতামগুলো টিপে দেখতে থাকে। হঠাৎ যন্ত্রটি থেকে ঝিরিঝিরি শব্দ বের হতে লাগল। অপ্রত্যাশিত শব্দে ভয়ে কুঁকড়ে গেল এলিজাবেথ। ঠিক তখনই ওয়াকিটকি থেকে ভেসে এলো রিচার্ডের কণ্ঠস্বর। গভীর, তীক্ষ্ণ, এবং চেনা সেই সাথে অস্থির। শব্দটা শুনে মুহূর্তেই শিউরে উঠল এলিজাবেথ। অভ্যন্তরে ঝড় শুরু হলো—আশা আর শঙ্কার এক অদ্ভুত মিশ্রণ।
“এলি জান।”
‘রিচার্ড উন্মাদের মতো ছুটছিল এবড়োখেবড়ো জঙ্গলপথে। ওয়াকিটকিতে সংকেত আসা মাত্র থেমে গেল পা। বুক ধুকপুক করছে। ছটফট করতে লাগল এলিজাবেথের কণ্ঠস্বর শোনার জন্য। ওপাশ থেকে শোনা গেল মৃদু গুনগুন কান্নার শব্দ। কর্কশ গোঙানির মাঝে এলিজাবেথ দূর্বল চিত্তে উচ্চারণ।
“হুম।”
‘প্রশান্তির এক প্রবল ঢেউ বয়ে গেল রিচার্ডের ভেতর। হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ল কাদামাখা মাটিতে। নিজের ‘পোস’ স্বভাবের ধার ধারল না। দু’হাতে মুখ চেপে ধরে ঘন ঘন শ্বাস ফেলতে লাগল। হঠাৎই এক অদম্য যন্ত্রণা থেকে চিৎকার করে উঠল,
“আল্লাহর এক বান্দি এসেছিল পৃথিবীতে! আমার জীবনটাকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছিস শালি।”
‘ওপাশ থেকে ভাঙা, তীব্র শীতের জড়ানো কণ্ঠে এলিজাবেথ বলল,”আমার শরীর জমে যাচ্ছে।”
‘রিচার্ড দ্রুত উঠে দাঁড়াল। আবারও দৌড়াতে শুরু করল। ছুটতে ছুটতেই চিৎকার করে বলল,”আমি আসছি, রেড! আমি আসছি! তুই জোরে শ্বাস ফেল,জোড়ে।”
‘এলিজাবেথ কাঁদতে কাঁদতে কাঁপা গলায় বলল,”আমার খুব ভয় করছে।”
“শোন, জান আমার। আমি আছি। তোর রিচার্ড আছে। একটুও ভয় পাবি না। আমি আসছি। আমি তোর খুব কাছেই আছি।”
‘ওপাশ থেকে আর কোনো শব্দ শোনা গেল না। রিচার্ডের বুক চেপে ধরল উদ্বেগ। দৌড়াতে দৌড়াতে আরো জোড়ে চেঁচিয়ে উঠল,”রেড, তোমার যদি কিছু হয়… আমার ভীষণ আঘাত লাগবে। প্লিজ! আমি আসার আগ পর্যন্ত নিজেকে বাঁচিয়ে রাখো!”
‘কণ্ঠ তেজ হারিয়ে গভীর খাদে নেমে গেল, প্রতিধ্বনি হয়ে জঙ্গলে মিশে গেল। ওপাশ থেকে এবারও কোনো শব্দ এলো না। রিচার্ডের নিশ্বাস ভারি হয়ে উঠে। প্রতিটি শ্বাস তার বুক ছিঁড়ে বেরোচ্ছে। চিৎকার করতে থাকল,
“কুত্তার বাচ্চা, শব্দ কর! শ্বাস ফেল, তুই! তোর নিশ্বাসের শব্দ শুনতে চাই আমি। তুই নিঃশ্বাস নে,,,
_থেমে, আরও অনুনয় করে বলল,
“এলি জান, কথা বল। প্লিজ, কিছু বল। গালি দে আমাকে! তোর মুখের গালি শুনতেও ভাল্লাগে আমার। তবুও কিছু বল প্লিজ৷”
‘মুহূর্তের নীরবতা কাটিয়ে ওপাশ থেকে ধীরে ধীরে এলিজাবেথের দুর্বল কণ্ঠ ভেসে এল,”আপনার কণ্ঠ এমন শুনাচ্ছে কেন?”
‘রিচার্ডের গলা ভারী। নিজেকে সামলাতে পারছে না। বিলম্বহীন জবাবে বলল,”কারণ আমি ভয় পাচ্ছি।”
“কিসের ভয়?”
“মৃত্যুর ভয়।”
“আপনি না বলেছিলেন, আপনি মৃত্যুকে ভয় পান না? সেদিনই তো বললেন…”
‘রিচার্ড এক দমে গর্জে উঠল,”কুত্তার বাচ্চা, অমানুষের বাচ্চা! শালি জানোয়ার। আমি তোর মৃত্যুকে ভয় পাচ্ছি! তোর মৃত্যু! বুঝলি?”
‘রিচার্ডের কণ্ঠ সমস্ত জঙ্গল কাঁপিয়ে দিল। একদিকে তীব্র আবেগ, অন্যদিকে অসহায়তার এক অন্তহীন গভীরতা।
“আমার কোমরের নিচ থেকে কিছু অনুভব করতে পারছি না আমি। তাড়াতাড়ি আসুন না। আমি আপনাকে দেখে যেতে চাই।”
‘রিচার্ডের বুক ছিঁড়ে যাচ্ছিল কথাগুলো শুনে। ছটফটিয়ে উঠল,”আমি আসছি! আমি আসছি, এলিজাবেথ! তোর কিচ্ছু হবে না!”
“তাড়াতাড়ি…” এলিজাবেথের কণ্ঠ ফিসফিস করে এলো। সময় আর শরীর যে তাকে ছিনিয়ে নিতে চাইছে। রিচার্ড মনের ক্ষোভে শুধু চেঁচাচ্ছ,”আমাকে ছেড়ে যাওয়ার অধিকার তোর নেই এলিজাবেথ! শুনে রাখ। আমি আসছি। তুই শুধু শক্ত হয়ে থাক।”
‘অবশেষে, রিচার্ড গিয়ে পৌঁছাল এলিজাবেথের কাছে। এলিজাবেথের নিস্তেজ, রক্তাক্ত দেহের সামনে দাঁড়াতেই রিচার্ডের পা থমকে গেল। দৃশ্যটা তার কল্পনার চেয়েও ভয়াবহ। যেমনটা আন্দাজ করেছিল এলিজাবেথের শরীরের পোশাক কেটে ছিঁড়ে গেছে। অনেকটুকু অংশই দেখা যাচ্ছে। শরীরের অধিকাংশ অংশে কাটা-ছেঁড়া আর রক্তের চিহ্ন। নিজের কোট খুলতে খুলতে এগিয়ে গেল এলিজাবেথের দিকে। মুহূর্তে বুকের সাথে মিশিয়ে নিল। তার উষ্ণতা দিয়ে রক্তহীন, জমে যাওয়া সেই শরীরে আবার প্রাণ ফিরিয়ে দিতে চাইল। এলিজাবেথ তখনও কিছুটা জ্ঞান ধরে রেখেছে। ঝাপসা চোখে রিচার্ডের চেহারা অবলোকন করল। ঠোঁট কেঁপে উঠল কিছু বলার চেষ্টা করতে গিয়ে।
“টাকায় কিনা রক্ষিতা কে বাঁচানোর জন্য এভাবে ছুটে এলেন।”
‘এলিজাবেথ নিভু স্বরে আওড়াচ্ছে। রিচার্ড ওর ঢেউ খেলানো বুকের আরো শক্ত করে চেপে ধরল এলিজাবেথের মাথা। ফোসফাস নিশ্বাস ফেলে কঠিন এক স্বীকারোক্তি দিল আজ।
“তোকেও টাকা দিয়ে কিনে আনিনি আমি। সইয়ের মাধ্যমে হালাল রূপে আমার প্রাসাদে তুলে ছিলাম। হ্যাঁ আমার ধরন হয়তো একটু ভিন্ন ছিল, তবে এমনই আমি। এরথেকে বেশি কিছু আশা করা যায় না আমার কাছ থেকে। যা দিয়েছি তা আমার সীমা ছিল, আর এই সীমায়ই আমি স্বাভাবিক।”
‘শরীরের সীমাহীন ব্যথায় এলিজাবেথ রিচার্ডের কথা শুনতেই পেল না। নিজের অবচেতন মনের সমস্ত জমানো ক্ষোভ আর ব্যথা কথার স্রোতে বেরিয়ে আসতে লাগল।
“আমি আপনাকে সব সময় অভিশাপ দিয়ে যাবো। আপনার জন্য যতটুকু ক্ষতি আমার হয়েছে, আল্লাহ তার থেকে অনেক বেশি ক্ষতি যেন আপনাকে করে।”
“ক্ষতি করিনি আমি, করিনি ক্ষতি। সেদিন তোমাকে আমি আমার মনের সবথেকে বড় জায়গায় স্থান দিয়েছিলাম। যেখানে আজ পর্যন্ত কেউ পৌঁছাতে পারেনি, যেখানে শুধু তুমি ছিলে, আর কিছুই না। সেই জায়গাটাতে তোমার উপস্থিতি ছিল অমূল্য, আর এখন সেই স্থান শূন্য, অথচ পূর্ণতায়।”
‘এলিজাবেথের কোনো সাড়া না পেয়ে রিচার্ড ঘাড় নামিয়ে তাকাল। বুঝতে পারল এলিজাবেথ সম্পূর্ণ চেতনা হারিয়ে ফেলেছে। রিচার্ড তপ্ত শ্বাস ফেল৷ এলিজাবেথকে ভালোভাবে ঢেকে সতর্কতার সাথে তুলে দাঁড়াল।
‘হাসপাতালের সাদা বেডে এলিজাবেথের শরীর নিস্তেজভাবে শুয়ে আছে। স্যালাইন চলছে। ওকে এখানে আনা হয়েছে অনেকক্ষণ আগে। পাশের কেবিনে তাকবীরও চিকিৎসাধীন, রেয়ান তাকে রেসকিউ করে নিয়ে এসেছিল।
‘বিগত এক ঘণ্টা ধরে ধৈর্যহীন গ্যাংস্টার বস, এলিজাবেথের বেডের পাশে বসে আছে খুবই ধৈর্যের সহিত। তার চোখে এক গুঁয়ে দৃষ্টি। পুরো পৃথিবী একমাত্র এলিজাবেথকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। দৃষ্টির মাধ্যমে মিটিয়ে নিচ্ছে ভিতরের সকল অস্থিরতা। গ্যাংস্টার বস রিচার্ড সাহসী, সবসময় দৃঢ়। তবুও এলিজাবেথের নিস্তেজ, অচেতন অবস্থার সুযোগ নিয়ে এক অজানা সত্য স্বীকার করল। ধীরে ধীরে এক হাত রাখল এলিজাবেথের ঠোঁটের লাল রেশে। কণ্ঠ নেমে গেল গভীর খাদে। নিজের অজান্তেই মনের সত্যি কথাটা বেরিয়ে এলো,
“আমার পাপের রাজ্যে তুমি ছিলে পবিত্রতার শেষ কণা নিষিদ্ধ এক ফুল। আমি এ রাজ্যের দুষ্টু রাজা, তোমার আগমন ঘটালাম—মাত্র পঁচিশ মিনিটের এক সিদ্ধান্তে। তুমি এলে আমার রাণী হিসেবে।
কিন্তু সেই রাণী ? রাণীর অতীত ছিল দগদগে এক ক্ষত। যা রাণী কখনো মানতে পারতো না। রাণীর সেই গোপন রহস্য রাণীকে ভেঙেচুরে দিত, যা আমাকে বাধ্য করল কঠিন হতে।
রাণী হতে হলে শক্তি লাগে। লড়াই লাগে। তোমার জন্য রাজা যা ত্যাগ করেছে, সেই ত্যাগের ওজনের কাছে আজও তোমার চোখের জল হেরে যায়। দূরত্ব রাখি কারণ জানি—যে আগুনে আমি জ্বলেছি, সেখানে তোমাকেও একদিন জ্বলতে হবে।”
ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৩৪
‘বেশিক্ষণ এই কঠিন স্বীকারোক্তির মাঝে থাকতে চাইল না রিচার্ড। ভেতরের সমস্ত শক্তি এক মুহূর্তে অবসন্ন হয়ে গেল। উঠে দাঁড়িয়ে এলিজাবেথের ফ্যাকাসে ঠোঁটে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে এক পলক তাকিয়ে রইল। তারপর নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল।