ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৪২
মিথুবুড়ি
‘হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন,
“প্রত্যেক ভালবাসায় দুইজন সুখী হলেও
তৃতীয় একজন অবশ্যই কষ্ট পাবেই
এটাই হয়তো প্রকৃতির নিয়ম…!
‘আকাশে নরম রোদ ছিল আজ, ক্ষীণ আশ্বাসের মতো। তবে তার আয়ু ছিল ক্ষণিকের; সন্ধ্যার অমোঘ গ্রাসে তা বিলীন হয়ে গেছে কিছু পল আগে। এখন আকাশজুড়ে নিস্তব্ধ এক রাজত্ব নির্ভার। নীলের গভীরে জ্বলে ওঠেছে অসংখ্য নিঃসঙ্গ তারা।
‘আবহাওয়ার অপ্রত্যাশিত বৈরিতায় তাকবীরকে গাড়ি নিয়েই বান্দরবান ছাড়তে হয়েছে। রাতের আঁধারে ডুবে থাকা পথ পেরিয়ে আসার পুরোটা সময় এলিজাবেথ একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি। দিনভর কোনো অনুভূতির রেখা খেলে যায়নি ওর ক্ষতবিক্ষত অবয়বে। মুখেও তোলেনি কিছু সারাদিনে। তাকবীরও কোনো জিজ্ঞাসার ভার চাপায়নি ওর ওপর। কাল সচক্ষে এলিজাবেথের মাঝে দেখা রিচার্ডের জন্য উৎকণ্ঠা ওকে ভঙ্গুর করে দিয়েছে। তাই তো চুপচাপ
নিস্তব্ধতার ভার ভাগ করে নিয়েছে এলিজাবেথের মতোই। একটি নীরব বোঝাপড়া, শব্দের অতীতে ক্লান্তি ভরা।
‘তবে যখন গাড়ি ঢোকে দেওয়ান মঞ্জিলের পথ ধরে তখনই হঠাৎ করে এলিজাবেথ জড়সড় কণ্ঠে গাড়ি থামাতে বলে। তিনদিন পর ওর রাশিয়ার ফ্লাইট! এই স্বল্প সময়টা চাচার সাথে কাটাতে চায়। এলিজাবেথ ছিল অনড়! তাকবীরের অনুরোধের সামনে একটুও নতি স্বীকার করে না। ওর নির্লিপ্ত চোখের পেছনে লুকানো থাকে এক সমুদ্র তিক্ততা। নিজেকে যেন আড়াল করতে চাইছিল সবকিছু থেকে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘তবু তাকবীরের একান্ত অনুরোধে,অবিন্যস্ত কণ্ঠে একটুখানি কোমলতার ঝলক পেয়ে শেষবারের মতো একটি রাত দেওয়ান মঞ্জিলে থাকার জন্য রাজি হয় এলিজাবেথ। তাছাড়া পর জিনিসপত্রও তো সেখানেই আছে। সেগুলোও নিতে হবে। জীবনে যত টানাপোড়েন আসুক না কেন এই মানুষটাকে এলিজাবেথ কখনো তুচ্ছ করতে পারবে না। এই নিঃস্বার্থ, শক্তিমান মানুষটা ছিল আলোর দিশারি,শান্তির পূজারী। ওর ভেজা চোখ উজ্জ্বল আলো দিয়ে ম্রান করিয়েছে এই মানুষ।
‘গাড়ি থামল দেওয়ান মঞ্জিলের নির্জন প্রাঙ্গণে। অন্দরমহলে পা রাখতেই তাকবীরের বুকের ভেতর শূন্যতার হাহাকার উঠল। চারপাশের নিস্তব্ধতায় আরও ভারী হয়ে করে দিল ওর ভিতর খা খা শূণ্যতায়। এই বিশাল,নীরব মহলটি আজ আরও শূন্য, আরও ফাঁকা। মানুষটা যতই নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন হোক না কেন সে ছিল তার বাবা। তাজুয়ার দেওয়ানের প্রতি ছিল তাকবীরের এক অমোঘ ঘৃণা। গাঢ়, জমাট, বছরের পর বছর ধরে জমে থাকা কালো কুয়াশার মতো। তবুও এই শূন্যতার মুখোমুখি হয়ে বুকের ভেতর অদ্ভুত এক জ্বালা জেগে উঠেছে। ঘৃণা আর শূন্যতার জটিল সমীকরণে পুড়তে পুড়তে পুড়তে তাকবীর অনুধাবন করতে পারে মানুষটা যত খারাপই হোক, তবুও সে ছিল তার বাবা। আর সেই শূন্যস্থান কোনো ঘৃণায়ও ভরানো যায় না। আজ থেকে সে একদম এতিম, বটবৃক্ষ শূন্য।
‘এলিজাবেথ নৈঃশব্দ্যের ভার বয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছিল। পেছন থেকে নিচু, ভাঙা গলায় ডাকল তাকবীর,
“এলোকেশী?”
‘পায়ের থামা শব্দে ঘুরে দাঁড়াল এলিজাবেথ। চোখে কোনো অভিব্যক্তি নেই! শুধুই শীতল শূন্যতা। তাকবীরের গলা শুকিয়ে এল; শক্ত করে ঢোক গিলল। সে জানে বলা উচিত নয়। এই দুর্বল স্বীকারোক্তি তার অহংবোধে ফাটল ধরাবে। তবু মন, সেই অবাধ্য মন, কোনো নিয়ম মানল না।
“আর ইউ ফলিং ইন লাভ?”
‘এলিজাবেথের শরীর টানটান হয়ে উঠে। কথাটা যেন গিয়ে শিরদাঁড়ায় ঠেকেছে। চোখে জ্বলে উঠেছে এক ঝলক অস্বীকারের আগুন। কাঠকঠ কণ্ঠে বলল,
“না, ঘৃণা করি আমি তাকে। সেই মানুষটা মরে গেলেও যেন তার মৃত্যুসংবাদ আমার কান পর্যন্ত না আসে।”
‘কথাটা ছুড়ে দিয়ে মুহূর্তেই সিঁড়ি বেয়ে উপরে দৌড়ে চলে গেল এলিজাবেথ। পেছনে রয়ে গেল তাকবীর—একটি নীরব প্রশ্নচিহ্ন হয়ে। কিছুক্ষণই পর খট করে দরজা বন্ধ হওয়ার তীব্র এক শব্দ শূন্যতায় প্রতিধ্বনিত হলো। তাকবীর ধীর পায়ে উপরে গেল। ওর পায়ের গতিতে যেন আজ ঝং ধরেছে। নিঃশব্দে গিয়ে দাঁড়ালো দরজার সামনে। বেদনার নীরবতায় চারিপাশ। শুধু ভিতর থেকে ভেসে আসছে করুণ দীর্ঘশ্বাস আর বুকভাঙা হাহাকার। নাক টানা আর ঘন নিশ্বাসের মাঝে হঠাৎ ছিটকে আসে কিছু ভারি শব্দ ভিতর থেকে।
“তাকে ভালোবেসে আমি ছটফট করতে করতে মরে যাই, তবুও আমার মুখ থেকে “ভালোবাসা” শব্দটি বের হোক না।”
‘একটু বেশিই ভারি ছিল বোধহয় তাকবীরের জন্য। হাতটা আপনাআপনি গিয়ে ঠাঁই নিল বুকে। এখানে এখন চেপে না ধরলে যেকোনো সময় বিপদ হয়ে যেতে পারে। বক্ষপিঞ্জরে বন্দি দুর্দমনীয় হৃদযন্ত্র অদৃশ্য অগ্নিঘোটকের সাথে তীব্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে । সমগ্র দেহে প্রচণ্ড কম্পন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, যেন শিরায় শিরায় প্রলয়ের শিখর। হঠাৎ করেই হেসে ফেলল তাকবীর দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে। তবে শরীর দাঁড়িয়ে থাকতে সায় দিল না বেশিক্ষণ। দরজার সাথে পিঠ ঘেঁষে শরীরটা পড়ল মেঝেতে।
“তোমার অন্যপথে পতিত প্রতিটি পদচিহ্নে প্রতিধ্বনিত হয় আমার স্বপ্নভাঙার করুণ কঙ্কালস্বর এলোকেশী।”
‘দারুণ হাসল তাকবীর। ওর কৃষ্ণগহ্বরে আঁধার থাকলেও কথা বলার সময় চোখ দু’টো জ্বলজ্বল করছিল। কান্নায় ভেসে যাওয়া পুরুষের বৈশিষ্ট্যের সাথে সাদৃশ্যপূণ নয়। কাঁদল না তাকবীর। বুকে হাত চেপে ওভাবেই বসে রইল কিছুক্ষণ। ধস্তাধস্তিতে জিনিস পড়ে যাওয়ার মতো শব্দ ভেসে আসছে হৃদয়ের গহ্বর থেকে। এলিজাবেথ বোধহয় কান্না করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। ভেতর থেকে আর কোনো শব্দ আসছে না। তাকবীর আবারো চাপা হাসল। এই দুর্বিষহ ক্ষণেও তাকবীরের অন্তঃস্থলে জেগে উঠল অগ্নিগর্ভ কবিতার শিরা-উত্তাপ। শৈশব থেকেই সুরের ধারাবাহিকতায় গলিত স্বরযন্ত্রের সাথে সাথে কঠিন শব্দের নির্মাণশিল্পেও ছিল তার দুর্দান্ত দক্ষতা। হৃদয়ের গভীরতম গহ্বরে সঞ্চিত ব্যথা রূপ নিল অমোঘ ছন্দে। একটি কবিতা, যা রচিত হলো রক্তাক্ত নীরবতার অভ্যন্তরে৷ যেখানে প্রতিটি শব্দ শিলালিপির মতো স্থির ও শীতল।
আমি তোমাকে ভালোবাসতাম,
তুমি আমাকে ভালোবাসতে,
কতই না সুন্দর হতো আমাদের গল্পটা।
তবে কেন এতো টানাপোড়েন,
কেন এই দূরত্বের বেড়াজাল?
কেন তুমি এলোমেলো পথের যাত্রী হলে,
কেন এলোকেশী মত্ত হলো অন্যতে।
আমার পৃথিবীটা সাজাতে চেয়েছিলাম তোমায় ঘিরে,
কিন্তু তুমি তো হারিয়ে গেলে অন্য কোথাও।
এ গল্প হয়তো অসম্পূর্ণই থেকে যাবে,
তবু হৃদয়ে থেকে যাবে তোমার স্মৃতি।
কখনো যদি ফিরে আসো,
আমার ভালোবাসা তখনো
তোমার অপেক্ষায় থাকবে প্রিয়।
‘উঠে দাঁড়াল তাকবীর। পায়ে ক্লান্তি ভর করেছে। খুব সময় লাগলো গোটা কয়েক সিঁড়ি পেরিয়ে নামতে। দেওয়ান মঞ্জিলে আজ সেই মিষ্টি শ্বাস-প্রশ্বাসের আনাগোনা নেই। চারিদিকে শুধু শূন্যতার ভার। উপরের কোণার ঘর থেকে ভেসে আসছে না ‘বীর, বীর,বীর ঔষধ খেয়েছ তুমি, বীর খেতে আসো’ বলে ডাকা সেই গম্ভীর স্বরটা। এলোমেলো পা ফেলে দেওয়ান মঞ্জিলের প্রাঙ্গণ ছেড়ে বের হল। একটু খোলা জায়গার প্রয়োজন ভিতরের বারি নিশ্বাস গুলোকে মুক্ত করতে। কিছু দূর যেতেই অপ্রত্যাশিত ভাবে দেখা হয় তাকওয়ার সাথে। জিপ থেকে নেমে তাকবীরের সামনে এসে দাঁড়াল তাকওয়া।
“বাহ আমার জিপের তেল খরচা হল না। পথেই দেখা হয়ে গেল।”
‘ক্লান্তির ভার তাকবীরের কণ্ঠেও,”আপনি?”
“হেরে গেলেন নাকি হার মেনে নিলেন?”
‘তাকবীর কিঞ্চিৎ অবাক হল তাকওয়ার কথা। পরক্ষণেই গভীরতা বুঝতে পেরে গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করল,”আপনি কি মিন করছেন?”
‘আলতো হেসে সোনালী চুলগুলো তালুতে চুঁড়ো করে বাঁধল তাকওয়া। হাতের চাবি ঘুরাতে ঘুরাতে একদম তাকবীরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গাঢ় স্বরে বলে,
“আপনি নিজেও জানেন না আপনার সমস্ত নাড়িভুড়ি বের করার জন্য আমার ঠিক কত রাত তন্দ্রাহীন থাকতে হয়েছে।”
“তো উপসংহারে কি উঠে এল ?”
“আপনার মৃত্যু।”
‘তাকওয়ার কড়া গলার কথা একটুও বিচলিত করল না তাকবীর কে। উল্টো ঘাবড়ানোর পরিবর্তে ফিক করে হেসে দিল। শক্ত হল তাকওয়ার গলার স্বর,
“আপনার মৃত্যু অনিবার্য মিনিস্টার সাহেব।”
‘তাকবীর ফাঁপা দৃষ্টিতে শূন্যে তাকাল। গোল ঠৌঁটের ফা’ক গিয়ে বেরুলো বুক চিঁড়ে আসা অন্তর্হিত কান্না। এক চিলতে হাসল তবে চোখে তার কোনো ঝলক নেই।
“মানুষের মন মরে গেলে শরীরের কথা আর ভাবে না।”
‘তাকবীরের শূন্য দৃষ্টির ফ্যাঁকাশে উচ্চারণে ধ্বনিত শব্দ গুলো যেন মুচড়ে যাওয়া এক অনুভূতির মতো বুকের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেল তাকওয়ার। আপন মনে কণ্ঠের কাঠিন্যত্ব গলে মোম হয়ে গেল।
“অন্যের আকাশে স্বৈরাচারী রাজত্ব বেশি স্থায়ী হয় না মিনিস্টার সাহেব।”
“আমি তো বোকা মানুষ। পরের চাঁদ, পরের আকাশ, আমি পাহাড়া দিই, কারণ আমি তো সেই চাঁদের মালিক নই।”
‘হাসতে হাসতেই বলে দিল তাকবীর। ওদিকে চোখের তারা ফ্যাঁকাশে যেন আলো নিভে গেছে ভেতরে। মুখটাও পাথরের মতো কোনো অনুভূতির ছায়া নেই। হঠাৎ করে ঠৌঁট শক্ত করে চেপে ধরে তাকবীর। মুহুর্তের মধ্যেই রক্তিম বর্ণ ধারণ করে ওর কৃষ্ণগহ্বর। গর্জনমিশ্রিত রুক্ষ কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল,
“সূর্যের আলোই পারে চাঁদের প্রতিটি রশ্মি মুছে দিতে। আমি সূর্য, আলোর মহাশক্তি। ওকে অন্ধকার থেকে তুলে এনে আমি আলোকিত করেছি। আমার আলোয় যে জীবনে আমি প্রবাহিত, সেখানে অন্য কারোর ছায়া ঢুকতে দেব না। আমি যদি শাসন করি, তা হলে তাতে অন্য কোন হস্তক্ষেপ সহ্য করা হবে না।”
‘হচকিয়ে যায় তাকওয়া তাকবীরের গর্জনমুখর চিৎকারে। অবাক করে দিয়ে নিমিষেই তাকবীরের কণ্ঠ খাদে নেমে এল। কান্না চাপা ভাঙা গলায় আওড়ালো,
“জানেন ও না ব্যাকরণের কঠিন বাগধারা বুঝে ফেলে, কিন্তু আমার সহজলভ্য, তৃষ্ণার্ত চোখের ভাষা কেন যেন ওর হৃদয়ে পৌঁছায় না।”
‘কথাগুলো বুকের ভিতর কাঁটার মতো বিঁধে রইল তাকওয়ার। অদেখা কষ্ট অনুভব করতে পেরে ওর বুকটাও হঠাৎই ভারী হয়ে উঠে। সে তো নিজেও অনুভব করছে এই তিক্ত অনুভূতি গুচ্ছ গুলো। অন্য দিকে ঘুরে ঘনঘন ফোঁস নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে দৃঢ় করল তাকওয়া। নিজেকে স্বাভাবিক করে ঘুরে তাকবীরের নির্ভার মুখ, প্রাণহীন অভিব্যক্তিতে তাকাতেই চমকে উঠল।
“এই কান্না করছেন আপনি? অদ্ভুত ছেলেরা কান্না করে? স্টপ ক্রায়িং।”
‘তাকবীর ছটফটে অন্য দিকে ঘুরে গেল যাতে করে আলগোছে লোকাতে পারে কষ্টের পাহাড়। অজান্তেই চোখ থেকে গড়িয়ে পড়েছিল নিরবে বহন করা ভার। ভারি শ্বাসের ফাঁকের টুকরো টুকরো কথার মাঝেই লুকিয়ে ছিল অব্যক্ত সব যন্ত্রণা।
‘চাঁদনী রাতের নিস্তব্ধতায় বিশাল এক গাছের ছায়াতলের নিচে দাঁড়িয়ে দুটি ভগ্নহৃদয়। পৃথক গল্প, তবুও সংলাপের সুর একই,বিরহ। তারা আপ্রাণ চেষ্টা করছে ভেতরের আকাশভর্তি যন্ত্রণা লুকোতে৷ কিন্তু হৃদয়ের ক্ষত কি সহজে আড়াল করা যায়? তাকওয়া এমনই ভালোবাসা চেয়েছিল, কিন্তু চায়নি ভালোবাসতে সেই মানুষটিকে, যে অন্য কারও হৃদয়ে বন্দি। তবুও তাকওয়া পারেনি নিজেকে আটকাতে কারণ ভালোবাসা তো আর কোনো যুক্তির ধার ধারে না।
“ছোট একটা জীবন। আপনি কিন্তু আমার হলেও পারতেন মিনিস্টার সাহেব।”
‘ভ্রু কুঁচকে তাকওয়ার দিকে তাকাল তাকবীর। ললাটে ভাঁজ, চোখে অনুচ্চারিত হিসাব-নিকাশের ছায়া। গলায় গম্ভীরতা ঝরে পড়ল,
“মিস তাকওয়া, আমি আপনার চোখের ভাষা বুঝি। উপদেশ হিসেবে বলল সময় নষ্ট করবেন না। কারণ আমি তার নেশা নামক বিষাক্ত এক মহামারিতে আক্রান্ত।”
‘তাকওয়া কঠিন এক ঢোক গিলল। চাঁদনি রাতের নিস্তব্ধতায়, প্রিয় মুখের উপস্থিতিতে তাকওয়া ভেঙে চুরমার। হৃদয়ের গভীরে দাউ দাউ করে জ্বলছে অনুভূতির দাবানল, বিস্ফোরিত হতে উন্মুখ। বুকের গহীন থেকে উঠে আসছে অব্যক্ত কথাদের নিঃশ্বাস। জীবন-মৃত্যুর মাঝের এক চিৎকার, যা আর চাপা রাখা যায় না।
“আমি যে আপনি নামক বিষাক্তে রোগে আক্রান্ত হয়েছি সেটা?”
‘তাকবীরের নাকের পাটা টানটান, বিরক্তি স্পষ্ট। ওর সুগভীর, নিকষ কালো চোখ হতে অগ্নিশিখা বিচ্ছুরিত হচ্ছে। তিক্ত কণ্ঠে প্রশ্ন ছুড়ল,
“এই পর্যন্ত আপনার সাথে আমার কতোবার দেখা হয়েছে?”
‘তাকওয়া নির্বিঘ্নে জবাব দেয়,”অফিসিয়ালি একবার।”
“আনঅফিসিয়ালি?”
“আজই প্রথম।”
“হ্যাঁ, আর এটাই শেষ।”
‘কথার খোঁচা হাওয়ার ধারালো ছুরির মতো গিয়ে বিঁধল ভেতরটায়। জড়িয়ে যাওয়া স্বরে তাকওয়া বলে,”কেন?”
“এই আনহেলদি অবসেশন থেকে বের হন, প্লিজ।”
“আপনি কি সময়ের পাল্লা মেপে এতো জলদি মুভ অন করতে বলছেন?”
“হ্যাঁ। ক্ষণিকের মোহ ভুলতে ক্ষণিক ক্ষণই যথেষ্ট।”
‘তাকওয়ার চোখে ক্ষীণ হাসি। তবে গলার স্বরে কাঁপন লুকোতে পারল না,
“আপনার সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়তো দু’টি নির্দিষ্ট সময়ের বাঁধনে বেঁধে রাখা। কিন্তু আপনার শ্যামবর্ণ কৃষ্ণগহ্বর আমার চোখে প্রতিফলিত হয়েছে অজস্রবার। আপনার নাম আমার মস্তিষ্কে তোলপাড় তুলেছে বারবার। মোহ বলেই কি এতোকিছু?”
‘তাকবীরের ঠোঁট শক্ত হয়ে ওঠে,”আইনের লোকদের মস্তিষ্কে পাপীদের চিন্তা শোভা পায় না মিস তাকওয়া।”
“হ্যাঁ, তাইতো প্রকাশ্যে আনিনি সেই আনহেলদি অবসেশন। আমার কাছে সবার আগে আমার সততা। সেটা আমি খোয়াতে পারি না, দম বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু ঐযে—ওস্তাদের মার শেষ রাতে। সারাজীবন চোর ধরতে ধরতে আজ নিজেই ধরা পড়ে গেলাম।”
‘এক মুহূর্তের নীরবতা। তারপর তাকওয়া ফিসফিস করে বলল,
“অনুভূতি চেপে রাখা যায়, কিন্তু চোখ থেকে আড়াল করা যায় না। ঠিক প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসে তাই না?”
‘তাকবীর কাঠকাঠ কণ্ঠে প্রত্যুত্তর করল,”ভুল জায়গায় অনুভূতি সঞ্চারণ মানে অনুভূতিকে তুচ্ছ করা।”
“তাহলে আপনি যা করছেন সেটা কী?”
‘থমকে যায় তাকবীর। কোনো উত্তর নেই। তাকওয়া হেসে ফেলল। একটা ক্লান্ত, তিক্ত হাসি।
“একটা উপদেশ দিই? আজই ছিঁড়ে ফেলুন সেই সব বইয়ের পাতা যেখানে লেখা আছে—ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়। আপনি তো আপনার সবটা দিয়ে চেষ্টা করেছিলেন।”
‘আবারও থমকে যায় তাকবীর। আসলেই তো,সে তো তার সমস্তটা উজাড় করে দিয়েছে! আত্মার শেষ বিন্দু দিয়ে চেষ্টা করেছে। তবুও কেন এই শূন্যতা? কেন এলোকেশীর চোখে জ্বলজ্বল করে অন্য কারোর জন্য কাতরতা? প্রশ্নের বিষাক্ত ছায়ায় ডুবে যায় তাকবীর। মস্তিষ্ক অস্থির, হৃদয় উন্মাদ। সবকিছু তোলপাড়! ভেতরে এক নিঃশব্দ ঝড় বয়ে যাচ্ছে, ধ্বংসের জন্য উন্মুখ। মাথার চুল টেনে ধরে নিচে বসে পড়ল তাকবীর। অস্থির গোঙানির শব্দ বের হচ্ছে মুখ থেকে। তাকওয়া ছুটে আসে।
“আমি তো আগেই জানতাম তুমি আর হবে না। তবুও কেন ভালোবেসে ফেললাম? কী এমন ছিল তোমার মধ্যে যা উপেক্ষা করতে পারিনি? জেনে-বুঝেই কি মানুষ নিজের সর্বনাশ বেছে নেয়? নাকি ভালোবাসা আসলেই বুদ্ধির বাইরে কোনো অভিশাপ?”
‘হ্যালুসিনেশনে ভেসে যেতে থাকে তাকবীর। চোখের সামনে স্পষ্ট দাঁড়িয়ে এলিজাবেথ—সেদিনের সেই মেয়েটা। এক লাফে গাছ থেকে পড়ল! পাপড়ি জোড়া তিরতির করে কাঁপছে। আবার ক্ষণিকের মধ্যেই প্রকম্পিত চোখ ডুবে গেল হাসির ঝরনায়। ওষ্ঠপুটে ঝলমল করছে সরল, চঞ্চল হাসি। সেই দূরন্ত মেয়েটাকে এখন আর দেখা যায় না। গম্ভীর হয়ে গেছে, সারাক্ষণই অন্ধকার রাজ্যে ডুবে থাকে। তবে তাকবীরের কল্পনায় সে প্রায়শই ফিরে আসে। আর তখন তাকবীর প্রতিবারই ছুটে যায়! ছুটে গিয়ে জাপটে ধরে তাকে! এমনভাবে মিশিয়ে নেয় বুকের গভীরে যেন আর কোথাও পালানোর সুযোগ না থাকে। আর তারপর?এইভাবেই বুকের ভেতর নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। রাত পেরোয় নিঃশ্চিন্তে। সেসব রাতগুলোতে তাকবীরের আর এলিজাবেথের রুমের দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে ভয়ে থাকতে হয় না! কারণ তার এলোকেশী তখন তার বুকের সাথে লেপ্টে থাকে,একটু মমতা খুঁজে নেওয়া মা-হারা বেড়ালছানার মতো।
‘এলিজাবেথ হাসছে, খিলখিলিয়ে হাসছে। দু’হাত মেলে তাকবীরকে ডাকছে। বুকের ভেতর উথলে ওঠে আনন্দের ঢেউ। সেই উচ্ছ্বাসে তাকবীর সুর তোলে! গান গাইতে গাইতে এগিয়ে যায় এলিজাবেথের দিকে।
“কখনো যদি জড়িয়ে ধরে
বলো ভালোবাসো,
আমি তখনই, হ্যাঁ তখনই
তোমার নামে লেখা চিঠিটা
পড়ে তোমাকে শোনাবো,,, ”
‘একদম শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শূন্য বুকটা ভরিয়ে নেয় তাকবীর। অতঃপর চুপচাপ শুয়ে পড়ল রাস্তায়। এক হাত রাস্তায় বিছানো, যেখানে কল্পনায় এলিজাবেথ মাথা রেখে শুয়ে আছে। আরেক হাতে শক্ত করে ধরে রাখল এলিজাবেথের তুলতুলে শরীর, যেন হারিয়ে না যায়। কিছু মুহূর্তের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে তাকবীর। তাকওয়ার চোখ থেকে বেগোড়ে অশ্রু ঝড়ছে। উঠে গিয়ে বসল তাকবীরের পাশে। বুক ভারী হয়ে গেছে নিজের চোখের সামনে সবটা দেখে। আলতো করে হাত ছোঁয়ায় কুঁকড়ে থাকা চুলগুলোতে। কাঁপছে তাকওয়ার শক্ত কণ্ঠস্বর,
“মানুষ হিসেবে আপনি পাপী হলেও এই ভুবনের খাঁটি প্রেমিক পুরুষ আপনি। যদি ভালোবাসা নামক কোনো আদালত থাকত তাহলে আমি সেই আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতাম, গা থেকে আইনের পোশাক খুলে। হতাম আপনার ভালোবাসার ক্ষতবিক্ষত রাজসাক্ষী।”
‘আগুনের লেলিহান শিখা চারদিক জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। এ-যেন ধ্বংসের নরকদ্বার খুলে গেছে। বিষাক্ত ধোঁয়ার গন্ধে ভারী হয়ে উঠেছে আকাশ-বাতাস, র’ক্তে’র তীব্র লৌহঘ্রাণে দম বন্ধ হয়ে আসছে। বাতাস কাঁপছে মৃত্যুর ক্রন্দনে। মাটি জুড়ে ছড়িয়ে আছে ছিন্নভিন্ন দে’হে’র নৃ’শং’স অবশিষ্টাংশ। দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা ফার্মহাউজের ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো এক মানবাকৃতির ন’রখা’দক। চোখজোড়া জ্বলে উঠেছে পিশাচের তীব্র পিপাসায়। মুখমণ্ডল র’ক্তে’র স্রোতে লেপ্টে আছে। তাজা প্রাণের উষ্ণতা এখনো মেখে আছে তার চামড়ায়। পৈশাচিক উল্লাসে ভারী পায়ের ছাপ ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে সে, প্রতিটি পদক্ষেপের সাথে শরীর থেকে টপটপ করে চুইয়ে পড়ছে ঘন লাল র’ক্ত-নি’র্মম’তার অবশিষ্ট সাক্ষী হয়ে।
‘রিচার্ডের শক্ত মুঠিতে দুলছে এক বিকৃত, বিক’লা’ঙ্গ মাথার খু’লি। যেখান থেকে এখনো ফোঁটা ফোঁটা র’ক্ত চুঁইয়ে পড়ছে, মাটিতে আঁকছে বিকৃত লা’ল দাগ। মৃ’ত্যু’র পরেও শান্তি মেলেনি মার্কোর; তার মুখ যেন নরকের নকশা। নেই না’ক, চোখের খোঁ’ড়ল দুটি শূন্য, ঠোঁ’ট ছিঁ’ড়ে ফেলা, দাঁ’তের অস্তিত্ব মুছে গেছে নির্মমতার ধারালো আঘাতে। এমনকি পুড়ে যাওয়া চোখের পাপড়ির ছাইও পড়ে আছে গলে যাওয়া চামড়ার ভেতর। রিচার্ডের নিষ্ঠুর হাতেও শেষ হয়নি সেই য’ন্ত্রণা। খ’ণ্ডবি’খ’ণ্ড সেই খুলিটাকে বয়ে নিয়ে চলেছে। মৃত্যুও মুক্তি নয়-কেবল অমর লাঞ্ছনার এক অবিনাশী চিহ্ন তৈরি করে।
‘চারপাশে বিধ্বস্ত নিস্তব্ধতায় ভাঙন ঘটায় একের পর এক আগুনে দগ্ধ কাঠের ভেঙে পড়ার গর্জন-শুনা যাচ্ছে বজ্রপাতের মতো। গাড়ির কাছে পৌঁছাতেই ফার্মহাউজটি গুমরে ধসে পড়ল। আগুনের লেলিহান শিখা গিলে নিল সবকিছু। রিচার্ড শেষবারের মতো তাকাল মার্কোর বিকৃত খুলির দিকে তারপর ঠাণ্ডা উদাসীনতায় ছুঁড়ে ফেলে দিল জঙ্গলের গভীরেবন্য প্রাণীদের জন্য রাতের রক্তমাখা আহার হিসেবে দান করে।
‘তখন রিচার্ডের ইঙ্গিত অনুযায়ী লাড়া নিঃশব্দে ঢুকেছিল মার্কোর ঘরে। ঠাণ্ডা কৌশলে ছলনা আর প্রলোভনের জালে জড়িয়ে ফেলেছিল মার্কো কে। যেমন শি’কারের আগে হিং’স্র’তার নেশায় তীক্ষ্ণ করে রাখা হয় ছু’রি। প্রতিরোধের সামান্য সুযোগও দেয়নি-বাঁধা পড়ে গিয়েছিল মার্কো অসহায়ভাবে। এরপর শুরু হয় নৃশংসতার উল্লাস। সতেরো ঘণ্টা ধরে রিচার্ড কোনো বিরতি নেয়নি। প্রতিটি আঘাত, প্রতিটি যন্ত্রণার রেখা ছিল একেকটা সই! যা লেখা হচ্ছিল মার্কোর শরীরে। অ’ঙ্গ’প্রত্য’ঙ্গের ওপর চলেছিল অবিরাম নির্যাতন। মাং’সে’র প্রতিটি টুকরোতেই রিচার্ডের হিংস্র উল্লাসের ছাপ গেঁথে গিয়েছে। শেষ পর্যন্ত মৃত্যু ছিল না কোনো মুক্তি-শুধু অবসান
‘গাড়ির ভেতর থেকে লুকাস এগিয়ে দিল পানির বোতল। রিচার্ড মুখ ধুয়ে নিল। রক্তের লাল ধারা মুছে যেতেই উন্মুক্ত হলো গালের সেই কালো দাগ। জীবিত বেঁচে থাকার আরেকটা দগদগে চিহ্ন। জঙ্গলের মাইনটা সৌভাগ্যক্রমে নিষ্ক্রিয় ছিল। তাই মৃত্যুর ছোঁয়া গায়ে লাগলেও এই যাত্রায় রিচার্ড বেঁচে যায়। গাড়িতে উঠে বসতেই ন্যাসো ইগনিশন ঘোরাল। ইঞ্জিনের গর্জন মিলিয়ে গেল জঙ্গলের নিস্তব্ধতায়। ওদের মুখে আজ এক অদ্ভুত ফুরফুরে প্রশান্তি।
‘গাড়ির ভেতর জটিল নীরবতা ভেঙে দেয় ন্যাসো। ফ্রন্ট মিররে রিচার্ডের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হেসে বলল,
“ইউ আর সো স্ট্রং বস। এক চান্সেই একদম বাবা হয়ে যাচ্ছেন!”
‘রিচার্ড টিস্যু দিয়ে রক্তের শেষ চিহ্নগুলো মুছতে মুছতে ঠান্ডা, দায়সারা গলায় জবাব দেয়,
“আমাকে দুর্বল ভেবে থাকলে তোমার ভুল ধারণা ন্যাসো।”
‘ন্যাসো ঠোঁট কামড়ে হাসে। পাশ থেকে লুকাস ফুরফুরে গলায় যোগ দেয়,
“বস এবার চলুন। বনভোজন শেষ—এবার পার্টি করা যাক! আফটার অল বাবা হতে যাচ্ছেন বলে কথা!”
‘রিচার্ড কোনো সাড়া না দিয়ে ট্যাব তুলে নেয়। ঠান্ডা চোখে স্ক্রিনে চোখ রাখে। দেওয়ান মঞ্জিলের সিসিটিভি ফুটেজে এলিজাবেথ নিস্তব্ধতায় ঘুমিয়ে। এলিজাবেথের ঘুমন্ত মুখের প্রশান্তি যেন রিচার্ডের বুকে ছুরি চালায়। তপ্ত শ্বাস ফেলে সিটে গা এলিয়ে দিল রিচার্ড। কণ্ঠে বিষন্নতা,
“একটা হাসির কথা শুনবে?”
“কি?”
‘রিচার্ডের ঠোঁটে বিদ্রূপ মাখা হাসি,
“আজই পূর্ণতা, আজই অপূর্ণতা।”
‘ন্যাসো কপাল কুঁচকায়, “মানে?”
“প্রকাশিত ভালোবাসা আবারও লুকিয়ে গেল ঘৃণায়। ওর চোখে আবারও ঘৃণা দেখব আমার জন্য।”
‘লুকাস ফিসফিস করে ওঠে, “কিন্তু বস সবই তো আপনি ম্যামকে বাঁচানোর জন্য করেছেন!”
‘রিচার্ড হঠাৎ উচ্চহাসিতে ফেটে পড়ে। একটা খাঁকির মতো হাসি যেটা মৃত্যুর আগে শেষ শ্বাসের মতো বেজে ওঠে।
“সে তো শুধু কঠোরতাই দেখে গেল। ”
‘মলিন হয়ে যায় ন্যাসো আর লুকাসের মুখ। নীরবতার ফাঁকে লুকাস নিচু স্বরে জিজ্ঞাসা করে,
“এভাবে কতদিন বস?”
“কি জানি! এই গল্পটা কেন যে এক পাক্ষিক প্রেমকেই খুব বেশি টানে!”
“ম্যামকে নতুন ম্যানশনে কবে তুলছেন?”
“ফিরেই।”
“যদি আসতে না চায়?”
“তুলে নিয়ে আসব।”
“আবারও?”
“যতবার আসতে চাইবে না ততবারই তুলে নিয়ে আসব।”
‘আড়াআড়িভাবে একে অপরের দিকে তাকাল দু’জন। অতঃপর একসাথে পিছন ঘুরল। পিছন ফিরতেই চোখাচোখি হয়ে গেল রিচার্ডের সাথে। একসাথে হেসে দিল তিনজন।
‘”লাড়া বেগম মোবারক হো। কাজ হয়েছে? সম্পূর্ণ হয়েছে নিজেকে ভাঙা?”
“হুম”
“জানতাম হবেই। লাড়া বলে কথা৷”
“কি করে জানলে?”
“ওটা তো টপ সিক্রেট। ওটা কিভাবে বলি? পুলিশ মানুষ চোরের পিছন লেগে থাকাই কাজ। তবে তুমি ঠিক আছো তো? সবাই কিন্তু জানে লাড়া খুব শক্ত।”
“অফিসার কোথায় তুই?”
“বন্দর থেকে ফিরছি।”
“খালি হাতে?”
“বন শূন্য থাকলে তো শিকারীকে তো খালি হাতেই ফিরতে হবে।”
“লেটস ক্যাচ আপ।”
“তুমি ঢাকা ব্যাক করোনি?”
“না।”
“ওকে লোকেশন সেন্ড কর। আমি আসছি।”
‘কল কাট হয়ে গেল। নীরবতা আরও ঘনিয়ে এলো চারপাশে। রিচার্ডের ফার্মহাউজে ফিরতে ফিরতে ভোরের মলিন আলো ফুটে উঠেছিল। ফিরে এসেই দেরি না করে লাড়াকে জঙ্গল থেকে শহরে নিরাপদে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। কিন্তু লাড়া যায়নি। শহরের দিকে পা না বাড়িয়ে সে একা গিয়ে বসেছে একটা পাহাড়ের চূড়োয়। চারপাশের বিশাল শূন্যতার ভেতর নিজের ভারী হয়ে আসা শরীর আর জীর্ণ মন নিয়ে থেমে আছে। পাহাড়ের নিরবতাই এখন ওর একমাত্র সঙ্গী।
‘অন্যদিকে, প্রেম—যে আজও রিচার্ডের পেছনে লাগতে গিয়েছিল অদম্য এক অভিপ্রায়ে। কিন্তু প্রতিবারের মতো এবারও বন্দর থেকে খালি হাতে ফিরল। বন্দরে কোনো শীপ পায়নি। লাড়ার পাঠানো লোকেশন অনুযায়ী প্রেম ওর খুব কাছেই ছিল। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে পৌঁছাতে বেশি সময় লাগল না। পাহাড়ি ঠান্ডা বাতাসে ওর নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠছিল তবুও পা থামেনি।
‘প্রেমের উৎফুল্লতায় দূর থেকেই চিৎকার করে উঠল,”হেই লাড়া জান্স! আই লাভ ইউ!”
‘বলে হুড়মুড় করে গিয়ে দাপাস করে বসে পড়ল লাড়ার পাশে। লাড়া ফিরেও তাকাল না। নিঃস্পৃহ দৃষ্টিতে সামনের শূন্যতায় চোখ রাখা। ঝাঁঝের বিপরীতে ঠান্ডা কণ্ঠে বলল,
“ফ্রেন্ডশিপের প্রথম শর্ত ছিল—কখনও ভালোবাসার কথা বলা যাবে না। আই’ম ব্রেকিং আপ উইথ ইউ।”
‘প্রেম তড়িঘড়ি করে দুই আঙুল জোড়া গালে লাগিয়ে তওবা করার ভঙ্গিতে বলল,”হেই, হেই, কুল! আই’ম সরি। প্লিজ পার্ডন মি। এই যে প্রমিস করছি৷ আর কখনও ভালোবাসার কথা বলব না প্রমিস! কখনোই না!”
‘লাড়া কিছু বলল না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে প্রেমের কণ্ঠস্বর হঠাৎই নিচু হয়ে গেল। গভীর দৃষ্টিতে তাকাল লাড়ার দিকে। ধীরে ধীরে বলল,
“আবার আরেক দিন বলব৷ মৃত্যুর আগের দিন বলে যাবো শেষ বারের মতো ‘লাড়া আমার হৃদয়হরণী, প্রণয়নী ভালোবাসি তোমায়।’”
‘লাড়া ফিরল প্রেমের দিকে। চোখদুটো অসম্ভব ফুলে রয়েছে, বেদনায় ভারী। গলাটা কেঁপে উঠল,”আর ততোদিন?”
‘প্রেম হাঁটুতে মাথা রেখে লাড়ার দিকে তাকাল। ঠোঁটে এক ফালি হাসি খেলে গেল,”অপেক্ষা করব।”
“পুরোটা জীবন অপেক্ষায় পার করে দিবে?”
“অপেক্ষা করতে ভয় লাগে না, কারণ এটা একাই করা যায়। ভয় তো এক হওয়ায়—হারানোর ভয়।”
‘লাড়ার ভেজা গলায় বিরক্তির সুর,”কাম অন প্রেম! তুমি কেন বুঝতে চাইছো না…”
“এতো কথা পেঁচিয়ে লাভ আছে? তুমি যে আমাকে ভালোবাসো না সেটা আমিও জানি। স্পষ্টতই জানি।”
“তবুও কেন আমার পিছে পড়ে আছো? এই কষ্ট এখন আমিও বুঝি। প্রেম প,,,,,,
‘কথা শেষ করতে দেয় না প্রেম। হঠাৎই এগিয়ে যায়, বুড়ো আঙুলে তুলে নেয় লাড়ার গাল বেয়ে পড়া অব্যক্ত বেদনার অশ্রু। ঠোঁটে সেই অমায়িক, কোমল হাসি।
“ডোন্ট ওয়ারি লাড়া। আমি জানি। তোমার চোখে আমি অন্যের জন্য ভালোবাসা দেখতে পাই—স্পষ্টতই।”
‘লাড়া কিছু বলে না, শুধু তাকিয়ে থাকে। শূন্য চোখে। কথাগুলো হৃদয়ের কোথাও গুঁড়ো হয়ে যায়। তারপর ধুলো হয়ে উড়ে যায় পাহাড়ের হাওয়ায়। ঠোঁট ভেঙে আসছে লাড়ার। দুঃখের ভার চেপে ধরেছে কণ্ঠ। চোখের পানি গড়িয়ে পড়ার আগেই সোজা হয়ে বসল। বুকের ভিতরে দ্রিম দ্রিম শব্দ যেন যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে চলেছে। থামার কোনো নাম নেই। শ্বাসগুলো ভারী, জড়ানো।
‘প্রেমও সোজা হয়ে বসল! অদ্ভুত এক নীরবতায় ঘেরা চারিপাশ। চোখের দৃষ্টি দূরে অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া পাহাড়ের টিলায়। যেন অদেখা কোনো উত্তর খুঁজছে শূন্যতার গভীরে। কোনো কথা নেই, শুধু নিঃশ্বাসের ভার আর বুকের তীব্র হাহাকার। একটু দূরে বসেও যেন হাজার মাইল দূরে দুইটা মন। পাহাড়ের বাতাস হালকা ঠান্ডা হয়ে গেছে। সেই সত্বেও দু’জনের বুকের ভেতর জ্বলছে না বলা কথার আগুন।
“আমি যদি আজ একটু কাঁদি তাহলে কি আমাকে অন্য মেয়েদের মতো দুর্বল লাগবে?”
‘প্রেম মৃদু হাসল। সেই হাসিতে কোনো উপহাস নেই,ছিল শুধু একরাশ কোমলতা। ওর কাঁধটা বাড়িয়ে দিল চুপচাপ। লাড়া নিঃশব্দে, নিস্তব্ধে মাথা রাখল প্রেমের কাঁধে। প্রেম নিজের জ্যাকেটটা খুলে লাড়ার মুখটা ঢেকে দিল।
“নাও, আমিও দেখব না। ইউ ক্যান ক্রাই নাও।”
‘লাড়ার ঠোঁট কেঁপে উঠল। গলার ভেতর দলা পাকানো কষ্টের ঢেউ তা ভাঙতে সময় নিল। নিভু স্বরে আওড়ালো,
“এক পাক্ষিক প্রেমে কেন এতো বিরহ অফিসার?”
‘প্রেমের দৃষ্টি স্থির! আকাশের শূন্যতার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল,”কারণ ওটা এক পাক্ষিক। ধাক্কা খেলে আগলে ধরার কেউ থাকে না।”
“এই ধাক্কার শেষ কোথায়?”
“যেদিন ভালোবাসা শেষ হবে।”
‘লাড়ার গলা হঠাৎই ভেঙে গেল। এক গলিতে আটকে থাকা কান্না বেরিয়ে এলো, “কিন্তু এই ভালোবাসা যে আমৃত্যু থাকবে!”
“তবে এই কষ্ট ও আমৃত্যু সঙ্গী হয়ে থাকবে।”
‘আচমকা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল লাড়া। প্রেমের বুকে আঁচড়ে পড়ল কষ্টে। দুই হাত দিয়ে প্রেমের শার্ট শক্ত করে খামচে ধরল৷ সেই জায়গাটায়, যেখানে সুইট কর্টন ফেব্রিকসের নিচে লুকিয়ে আছে প্রেমের আহত হৃদয়। ঠিক সেই জায়গাটা, যা অন্য কারো ছোঁয়ায় নয়, শুধু ভালোবাসাহীনতার যন্ত্রণায় পুড়ে যায়।
“প্রেম, ইউ কুডন্ট ফিল মাই পেইন। আই অ্যাম ব্রেকিং আপ।আমি দেখেছি,নিজের ভালোবাসার চোখে অন্য কারও জন্য আতঙ্কের ছায়া। সেই চোখে যে একদিন কেবল আমার জন্য জ্বলতো আগুন, সেখানে এখন ভয়ের আঁচড়। আমি দেখেছি কীভাবে সেই ভয় ওকে গিলে খাচ্ছে, কীভাবে ও কাঁপছে অন্য কাউকে হারানোর আতঙ্কে। ওর হাত কাঁপছিল প্রেম, গলা কাঁপছিল।”
‘প্রেমের চোখে জল জমল। যথাসম্ভব নিজেকে শক্ত রাখল। আলগোছে হাত রাখল লাড়ার মাথায়। হুট করেই সংযম হারিয়ে বুকে আরও শক্ত করে চেপে ধরল লাড়া কে। কোনো শব্দ নেই, কোনো সান্ত্বনা নেই। শুধু নিঃশব্দে ভাগাভাগি করা কষ্টের ভার। লাড়া অঝোরে কাঁদছে। বুকের সবটুকু ভার জল হয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে। প্রেমের বুকটাও ভিজে গেল সেই কান্নায়। কোনো শব্দ নেই, শুধু দুটো হৃদয়ের বেদনার কম্পন। প্রেমের চোখ থেকে এক বিন্দু অশ্রু গড়িয়ে পড়ল লাড়ার মাথায়। নিশ্বাসে মিশ্রিত এক ফিসফিসে শব্দে প্রেম আপন মনে শুধালো,
“নিজের কষ্টের সাগরের বাঁধ ভাঙতে গিয়ে এভাবে আমাকে ভাসিয়ে দিও না লাড়া। প্লিজ…”
‘কথার কোনো জবাব নেই। শুধু কাঁদা, বেদনা, আর দুটো হৃদয়ের নিঃশব্দ বোঝাপড়া। রাতের নিস্তব্ধতা বাড়তে থাকে, বাড়তে থাকে লাড়ার আহাজারি। মা মারা যাওয়ার আজ এই প্রথম কাঁদল লাড়া। তারপরেও সে পাবে না তার ভালোবাসা। আরেকটি অপূর্ণ প্রেম কাহিনী হিসেবে রয়ে যাবে ওর কাহিনী।
ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৪১ (২)
“এই অফিসার তুই চুপ করে আছিস কেন? কিছু বল না। তোর আইনে কি অনুভূতি দমানোর কোনো আইন নেই? অন্য নারী ওকে ভালোবাসবে, ওকে ছুঁবে, ওর উপ্তত্ত নিশ্বাস পড়বে অন্য কারোর খোলা বুকে। এই যন্ত্রণা গুলো আমি কিভাবে সহ্য করব, বল না অফিসার!”
‘প্রেম কোনো জবাব দিতে পারে না। শুধু বুকের মাঝে শক্ত করে চেপে ধরে রাখে লাড়াকে। সত্যি বলতে এক পাক্ষিক প্রেমের কোনো শব্দ হয় না, কোনো বর্ণনা হয় না, কোনো সান্ত্বনা হয় না। শুধু সয়ে যেতে হয়, সহ্য করতে হয়।