ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৪৭
মিথুবুড়ি
‘সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে বিলাসবহুল হোটেল—কাপিলা। দাম, প্রতিপত্তি, নিরাপত্তার শীর্ষে থাকা এই স্থানে ঢোকার অনুমতি পাওয়া মানে এক বিশেষ পরিচয়ের স্বাক্ষর। কিন্তু আজ এক অচেনা আগন্তুক তার নিজস্ব নিয়মেই প্রবেশ করছে। সুঠাম দেহ, দৃষ্টিতে তীব্রতা, চলনে এক ধরনের গর্জনময় আত্মবিশ্বাস। আপাদমস্তক তার কালোতে আবৃত। সুঠাম গড়নে কালো চামড়ার জ্যাকেট, পেশিবহুল হাতে গ্লাভস, চওড়া তামুক মাস্কে আর চোখে কালো সানগ্লাস,সেই সাথে মাথায় ক্যাপ। কালো মুখোশের অন্তরালে চাপা পড়ে আছে রক্তখেকো উন্মাদনা, অধর কোণে লেগে হিংস্রতার তীব্র দাহ।
‘প্রবেশদ্বারে নিরাপত্তা কড়াকড়ি। মেটাল ডিটেক্টর গেটের সামনে দাঁড়াতেই গার্ড এগিয়ে আসে। উগ্র বিক্রম একটুও দ্বিধা না করে দু’হাত ছড়িয়ে দিল নিজেই নিজেকে উন্মোচন করে। সেই সঙ্গে তার চোখের কোণে এক চাতুর্যের ঝলক। ধূর্ততা দৃষ্টিতে দ্রুত এক নজরে চারপাশ পরখ করে নেয়। সময়ের কাটার প্রতিটি সেকেন্ড তার হাতে বন্দি হল। ভিড়ের মাঝে চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অদৃশ্য গোয়েন্দা নজরদারি। সেই ধ্বংসযজ্ঞ ধীর পায়ে প্রবেশ করে ভেতরে। ক্ষণিকের মধ্যেই সে নিঃশব্দে ছায়ায় বিলীন হয়ে যায় সকলের মাঝে অশুভ ছায়ার মতো। ঠিক সেই মুহূর্তেই হোটেল প্রাঙ্গণ কেঁপে উঠল হেলিকপ্টারের গম্ভীর গর্জনে। বিরতিহীন ভাবে হেলিকপ্টারটা উড়ে গেল আকাশপথে। রুফটপে আছড়ে পড়ে এক কালো একটা ব্যাগ। চারপাশে আঁচড়ে পড়ল রক্তহিম আতঙ্কের দাবানল, অতল অন্ধকার। বাতাসেও শ শ শ করতে থাকে শ্বাসরুদ্ধকর হিংস্রতা।
‘খেলা শুরু হয়ে গেছে। শুরু হল রক্তাক্ত সংগ্রাম। মৃত্যুঞ্জয়ী সংকল্প।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
_Lets begin_
_Now, the killing machine is on the Ground_
‘স্বতঃস্ফূর্ত অথচ সুসংযত, রক্তপিপাসু ক্রোধের দাবানলে দগ্ধ হয়ে সে এগিয়ে চলছে। প্রতিটি পদক্ষেপ মাটির বুকে ছাপ ফেলে। তবুও ন’রখা’দকের মাঝে নেই তাড়াহুড়া, নেই অপারস্থিরতা। পায়ের গতিতে স্বয়ংক্রিয়তা বজায় রেখে অবিচল, নির্মম গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে সে স্বয়ংক্রিয়ভাবে দেহ থেকে প্রাণ কেড়ে নেওয়ার ব’র্বর উল্লাসে মাতোয়ারা হতে। চারপাশের প্রতিটি ছায়া, প্রতিটি চলমান প্রতিচ্ছবি তার শীতল, শ্বাপদদৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারছে না। পথ চলতে চলতে সূক্ষ্মভাবে সে মেপে নেয় সিসিটিভির নজর, পথচারীদের অসচেতন দৃষ্টি, এবং সুযোগের ক্ষণ।
‘নিপুণ দক্ষতায় সে গলে যায় ব্যস্ততার ছদ্মবেশে, ঢুকে পড়ে স্টাফ ওয়াশরুমে। সেখানটা একদমই নির্জন, নীরব, নিরাপত্তাহীন। দেয়ালে ঝোলানো সাদা কাঁচের সামনে দাঁড়ায় সে! অতঃপর এক অপ্রতিরোধ্য শ্বাসে খুলে ফেলে মুখোশ। ঝলসে ওঠে উজ্জ্বল আলোর নিচে তার মুখশ্রী—প্রজ্জ্বলিত, প্রতিহিংসার লেলিহান শিখায় দগ্ধ। সেই নীলাভ গভীর চোখজোড়ায় সাগরের অতল গভীর থেকে উঠে আসা দানবীয় প্রবলতা আবিষ্ট, ধ্বংসপ্রবণ। সময় নষ্ট করে না সে। সুচারু দক্ষতায় হাত থেকে খুলে নেয় ঘড়ি, ফের ঠান্ডা নির্লিপ্ততায় সেটার কাঁচের অংশ খুলে আনে। অতঃপর অপার পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্দয় নিপুণতায় সিঙ্কের ধাতব প্রান্তে ঘষতে ঘষতে কাঁচটাকে তীক্ষ্ণ ত্রিভুজে রূপ দেয়। কুয়াশাচ্ছন্ন চোখে নয়, বরং অবিচল সিদ্ধান্তে সৃষ্ট হয় সেই অস্ত্র, ক্ষুদ্র, কিন্তু মরণধারী। সোজা হয়ে দাঁড়ায় সে। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের চোখে চোখ রাখে। সেখানে দোল খাচ্ছে এক দুর্দমনীয় ঘূর্ণিঝড়, প্রতিশোধ, তাণ্ডব, এবং এক ভয়াল অবিনাশী শপথ!
‘এলিভেটরের পয়তাল্লিশ বোতামে চাপতেই যন্ত্রণা শুরুর সিগন্যাল বাজল। নিস্তব্ধ যান্ত্রিক গতিতে এলিভেটর উঠে গেল শূন্যে!পলকের ভেতর থেমে গেল গন্তব্যে। দরজা খোলার শব্দে কালো পোশাকধারী গার্ডরা কাঁধে অস্ত্র তুলে নিল! চোখে স্নায়ু টানটান সতর্কতা। এই ফ্লোর সংরক্ষিত। সুরক্ষিত। নিষিদ্ধ। এখানে অন্যদের প্রবেশ নিষেধ, অনুমতির তোয়াক্কা না করাই মৃত্যুর নিমন্ত্রণ। দরজা খুলতেই ধাতব শব্দ প্রতিধ্বনিত হল! সামনে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক দানবীয় উপস্থিতি। রক্তের মতো গভীর দৃষ্টি, নিঃসঙ্গ পাথরের মতো শীতল অভিব্যক্তি। এক মুহূর্তও লাগল না চেনায়—এ প্রেতত্মা কে? সে রিচার্ড কায়নাত। নিখুঁত নৈরাজ্যের স্থপতি। অস্ত্রধারীদের জন্য এক দুঃস্বপ্ন। তার এই দুঃসাধ্য অস্তিত্বই ঘোষণা করছে এখানে শাসকের শাসন টিকে থাকবে না। আগুনের পথে শুধুই ছাই লেখা থাকবে।
‘এলিভেটরের মুখোপ্রান্তে উপস্থিতি গার্ডদের রক্তে কাঁপন ধরালো রিচার্ডের করাল দৃষ্টি। কালো পোশাকধারী ছায়াগুলো মুহূর্তেই সতর্ক হয়ে আঙুল ট্রিগারে চেপে বসলো। দেহে তীক্ষ্ণ প্রস্তুতি নিয়ে সবাই বিদুৎবেগে আক্রমণ করতে আসে। তবে যে দাঁড়িয়ে আছে দরজার ওপারে, সে মৃত্যুকেও ভয় পায় না। রক্ত-ধূসর চোখ, সুনির্মম অভিব্যক্তি বুলেটের চেয়েও ঠাণ্ডা মন—সে রিচার্ড কায়নাত। গ্যাংস্টার বস। নৃশংসতার সম্রাট। সন্তান হারা নির্বিক পিতা।
‘গার্ডদের নিকটবর্তী হতেও সময় নিল না রিচার্ড। নিঃশব্দ এক শিকারির ক্ষিপ্রতায় ঝাঁপিয়ে পড়ল! প্রথম গার্ড বুঝতে পারার আগেই তার অস্ত্র ছিনিয়ে গলায় ছু’রি বসিয়ে দিল কলার বর্নে। স্টি’লের ঠান্ডা ধারাল ফলা মাং’স ছিঁ’ড়ে প্রবেশ করল হা’ড় পর্যন্ত। গার্ডের চোখ বিস্ফারিত হলো, মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল উষ্ণ তরল। গলা থেকে বুদবুদ উঠতে উঠতে র’ক্ত উগরে দিল সে। দ্বিতীয়জনের হাতে বন্দুক উঠতে না উঠতেই রিচার্ডের আঙুল তার কবজিতে গ্রিপ করল! একটানে মটকে দিল হাড়। বিকট ক্রাঞ্চিং শব্দে কাচের দেয়াল কেঁপে উঠল সঙ্গে ভেসে এল মর্মান্তিক চিৎকার!
‘তৃতীয়জন—ট্রিগার চেপে ধরতে গিয়েও পারেনি। তার রিব কেজে বজ্রাঘাতের মতো আছড়ে পড়ল রিচার্ডের হাঁটু। বুকের হাড় ধসে গেল ভেতরে! বাতাসের জন্য হাঁসফাঁস করতে করতে সে পেছনে গড়িয়ে পড়ল। দ্বিতীয়বার নিশানা লাগানোর সুযোগ দিল না রিচার্ড পিঠে ছু’রি ছুঁড়ে দিল! স্টিলের ফলা ঘাড় ভেদ করে গলা দিয়ে বেরিয়ে এল! গলিত র’ক্তের উষ্ণ প্রবাহে করিডোর রঞ্জিত হলো। মুহুর্তের মধ্যে চারপাশ লাশের স্তূপে রূপ নিল। নিখুঁত দক্ষতায়, একের পর এক ঝরে পড়ল দেহগুলো! প্রতিটিই নিঃশব্দ মৃত্যুর কবলে। অস্ত্র বিহীন লড়ে গেল সে এক ঝাঁক শত্রুর সাথে। রিচার্ড ধীর পায়ে এগিয়ে গেল। তার হাতে এখনও র’ক্তমাখা ছু’রি! মুখে অচেনা প্রশান্তি, চোখে অবিশ্বাস্য শীতলতা। ছু’রি থেকে পড়তে থাকা র’ক্তের টপটপ শব্দের সাথে নরকের ক’সাই হেঁটে যাচ্ছে। পঁইতাল্লিশ তলা আজ দোজখের দরজা খুলে দিয়েছে।
‘রিচার্ড ধীর পায়ে এগোতেই সামনে থেকে নতুন শকুনের পাল অস্ত্র তুলে ঝাঁপিয়ে এল। মুখে তাদের নির্মম উদাসীনতা, চোখে শীতল হত্যার খিদে। অর্ধশতাধিক বন্দুক তার দিকে তাক করা, ট্রিগার চাপতে বাকি মাত্র একটুখানি। কাদেরের লোক এরা। কাদের জানে তার সময় ফুরিয়েছে। সে যা করছে এতে আর তার আশ্রয় হবে না ধরণীতে। একবার যদি রিচার্ড পৌঁছে যায় এখানে সব শেষ। তাই তো এত সুরক্ষা, এত পাহারা! পুরো পঁইতাল্লিশ তলা আজ তার ব্যক্তিগত দুর্গ। তবু বুকের গভীরে একটাই আতঙ্ক চেপে বসেছে—যদি……রাবণের পালের মাঝ থেকে এক উগ্র মেজাজি চেঁচিয়ে উঠল,
“রাজার রাজত্ব শুধুমাত্র তার রাজ্যেই। আজ সাথেও নেই কেউ, এবার তোর লাশ ফিরবে ইতালি।”
‘অকস্মাৎ রিচার্ড পিছু হটল,ছুটে পালাতে শুরু করল!
গার্ডদের ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠল। এই লোকের জন্য কাদের এত টাকা ঢেলেছে? একটা কাপুরুষ, যে ভয় পেয়ে পালাচ্ছে? তারা ধাওয়া দিল পিশাচের ক্ষুধায়। তাদের বুটের ভারি আঘাতে করিডোর কেঁপে উঠল। চারদিকে শুধু একটাই শব্দ-ধ্বংসের পূর্বাভাস! রিচার্ড ছুটছে। তবে তার দৌড়ে অস্থিরতা নেই, আতঙ্ক নেই। বরং নিখুঁত হিসাবে এক কৌশলী স্থিরতায় ছুটছে আঁকাবাঁকা ভাবে, যাতে করে বন্দুকের ঝাঁঝ এসে তার গায়ে না লাগে।
‘রিচার্ড এক দৌড়ে ছুটে গেল রুফটপে, দরজার অন্তরালে লুকিয়ে পড়ল। পায়ের শব্দে ভারী বাতাসে তীব্র উত্তেজনা। মুহূর্তের মধ্যে ঘাতক প্রহরীরা তার পিছু পিছু ছুটে এল রুফটপে বন্দুকের লক খুলে একদম তৈরি হয়ে। সবাই রুফটপে পৌঁছানো মাত্রই রিচার্ড আড়াল থেকে বেরিয়ে নিঃশব্দে দরজা বন্ধ করে দিল। মুখে তার অদ্ভুত এক নিঃসঙ্গ হাসি। ছাদের বাতাসে নিকোটিনের ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ল তার হাতে ধরা সিগারেট থেকে। বিপদের সম্মুখেও সে নিরেট ঠান্ডা। হাতে শক্ত কাঠের ডাণ্ডা দুলিয়ে একপাশে দাঁড়াল দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে। রিচার্ড জানত, নিচে সংঘর্ষে জড়ানো মানেই পুরো ঘটনা প্রকাশ্যে চলে আসা আর এতে তার আততায়ী পরিকল্পনা ধুলোয় মিশবে। আজ সে ক্ষমতার প্রদর্শনী করতে আসেনি। এসেছে নিখাদ নৃশংসতার বিভীষিকা ছড়াতে। এসেছে সন্তানের হত্যার প্রতিশোধে রক্তরঞ্জিত অধ্যায় লিখতে।
“Everyone is a gangster, until the real gangster arrives.”
‘শব্দটা বাতাসে কাঁপন তুলল। মুহূর্তেই শিকারের মতো পিছিয়ে এল ঘাতকেরা। তাদের প্রশিক্ষিত মস্তিষ্ক প্রথমবারের মতো আতঙ্কের স্বাদ পেল। রিচার্ড ধীরে ধীরে ধোঁয়া ছেড়ে দিল সুদূরে, চোখে জ্বলে উঠল দানবীয় আলো। স্থবির মস্তিষ্ক হঠাৎই প্রতিশোধ-জর্জরিত পৈশাচিক সত্তায় বিদীর্ণ হলো। স্বকীয়তার শৃঙ্খল চূর্ণ করে আদিম হিংস্রতায় অগ্নিশ্বাস ছড়িয়ে গর্জে উঠল সে বিভীষিকাময় দানবের মতো!
“হিংস্র শিকারি কখনো ঝাঁক বেঁধে চলে না। সে যে জঙ্গলে পা রাখে, সেইখানেই সে রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে নিঃসঙ্গ কিন্তু অজেয়।”
‘আর কোনো অপেক্ষা নয়। এক ঝড়ের বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ল রিচার্ড। প্রথমজনের কণ্ঠ’না’লী লক্ষ্য করে ডাণ্ডার তীব্র আঘাত করতেই গলা ভেঙে চিৎকারটা থেমে গেল মাঝপথে! ঝাঁঝরা হয়ে গেলো তার শ্বাসনালী। অন্যজন বন্দুক তুলতে গেলে রিচার্ড দড়ির মতো পাক খেয়ে তার কব্জি মুচড়ে দিল। হাড় ভাঙার শব্দ বাতাসে প্রতিধ্বনি তুলল! দেহের ভাঙ্গনে ধাতব মেঝেতে লুটিয়ে পড়তেই রিচার্ড তার মাথা দু’হাত দিয়ে চেপে ধরে এমন জোরে শক্ত টায়েলে ঠুকলো যে খুলিটা চিড় ধরে ছত্রখান হয়ে গেল।
‘ক্রোধে মটমট করছে রিচার্ডের তীক্ষ্ণঘাত চোয়াল। শরীরে ভর করছে পশুরী শক্তি। আরেকজন পিছন থেকে ছু’রি চালাতে চাই, তবে তা রিচার্ডের তীক্ষ্ণতা আগেই সংকেত পাঠিয়ে দেয় তার মস্তিষ্কে। ঘূর্ণির বেগে ঘুরে কোমরে মোচড় দিয়ে পেছনে গিয়ে ছুরির হাত ধরে বাঁকিয়ে দিলো অতঃপর রোবোটিক ভঙ্গিতে সেই ছুরিটাই তার গলার গভীরে ঠুকিয়ে দিল। র’ক্তের উষ্ণ স্রোত ওর হাতে গড়িয়ে পড়ল গলগল করে। লোকটা গলা চেপে ধরার চেষ্টা করলেও শরীরটা ধপ করে পড়ে গেলো। অপর একজন বন্দুক উঁচিয়ে গুলি চালাতে গেলে রিচার্ডের ডাণ্ডা বিদ্যুতের গতিতে উঠে এসে তার কনুই চূর্ণ করে দিলো। বন্দুক হাত থেকে ছিটকে পড়তেই রিচার্ড তার মুখে এমনভাবে ডাণ্ডার আঘাত হানে যে দাঁতগুলো ঝরে পড়ে ছড়িয়ে গেলো রক্তের স্রোতের মাঝে। হালকা একটা থড শব্দের পর সব শান্ত। ধ্বংসের উন্মত্ত লীলায় কেঁপে উঠছিল রুফটপ প্রাঙ্গণ। ধাতব মেঝে র’ক্তে স্নাত! ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে বিকৃত, নিথর দেহগুলো। স্তরে স্তরে জমে থাকা লা’শের ভিড়ে কিছু এখনও টানটান, কিছু চূড়ান্ত যন্ত্রণায় কাতর। কারো চোখে ছু’রি গভীরভাবে গেঁথে আছে, কারো বাহু চ্যুত, কারো ছি’ন্নব’ক্ষ থেকে গলগলিয়ে গড়িয়ে পড়ছে উষ্ণ র’ক্ত। গো’ঙানি আর মৃ’ত্যুয’ন্ত্রণার রু’দ্ধশ্বাস শব্দে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। মুহূর্তের ঝড়ে রিচার্ড একাই রূপান্তরিত করেছে এই স্থানকে এক বিভীষিকাময় শবস্তূপে!
‘একজন এখনও বেঁচে আছে! গুরুতর আ’হত, আতঙ্কিত। পেছাতে গিয়েও গায়ের চামড়ায় লেগে থাকা র’ক্তের আঠালো আস্তরণে পা পিছলে পড়ে গেলো সে।রক্তমাখা ধাতব ডাণ্ডাটা মাটিতে টেনে আনতে আনতে রিচার্ড ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো। ছিটকে আসা র’ক্ত তার গা থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে নিচে টপটপ শব্দ তুলে। ওর নিঃশ্বাস স্থির, চোখ শূন্য! অথচ শরীর থেকেও যেন মৃত্যুর ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ছে।
“প্লিজ… প্লিজ আমাকে মেরো না…”
‘কাঁপা গলায় মিনতি করল সে! রিচার্ডের পদক্ষেপ থামল না। এক পা… দুই পা… তারপর নিঃশব্দে ঝাঁপিয়ে পড়ে ডাণ্ডাটা এমনভাবে নামিয়ে আনল যে খুলির হাড় মুহূর্তেই চূর্ণ হয়ে ছিটকে পড়ল চারদিকে। মগজের উ’ষ্ণ লা’লস্রো’ত ছাদজুড়ে ছড়িয়ে গেল! বেয়ারা পাথরে চটচট শব্দ তুলে গড়িয়ে পড়ল র’ক্তের গাঢ় ফোঁটা।
“মাদা**! এভাবে কে মারে রে? তুই মানুষ না, নরখাদক তুই!”
‘রিচার্ড থামল। পিছন ফিরল। একজন এখনো বেঁচে আছে! মেঝেতে পড়ে কাতরাচ্ছে। তার হাঁটুতে ছু’রি বিঁধেছে। র’ক্ত ধীর কিন্তু অবিরাম প্রবাহিত হচ্ছে পায়ের নিচে। কথায় তেজ থাকলেও দেহ ক্ষতবিক্ষত, চোখে মৃত্যুভয়। রিচার্ড বাঁকা হাসল। কপাল ফেটে বেরিয়ে আসা গলিত র’ক্ত হাতের পিঠ দিয়ে মুছে ধীর, স্থির পদক্ষেপে এগিয়ে গেল। গার্ডটা পিছাতে লাগল। র’ক্তমাখা মেঝে তার পথ রুদ্ধ করল। রিচার্ড নিচু হয়ে ছোট একটা ধারালো ছু’রি তুলে নিল। ছুরির ধার চাঁদের আলোয় যেন আরো নিষ্ঠুরভাবে ঝলসে উঠল। গার্ডের বুকের ভেতর থেকে আতঙ্কের ঝড় বয়ে গেল। কাঁপতে কাঁপতে সে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।
“আমরা তোর এক সন্তানকে মেরেছি, আর আজ তুই শত শত বাচ্চাকে এতিম করলি!”
‘রিচার্ড থামল। ঠোঁটে ফুটল এক চমৎকার হাসি। এমন হাসি তার অধরে সচরাচর দেখা যায় না। এ হাসি ঠান্ডা, নির্মম, বিকৃত! গার্ডটা হামাগুড়ি দিয়ে পালাতে চাইলে রিচার্ড ক্ষিপ্র গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার চুলের মুঠি চেপে ধরল। ঝাঁকুনি দিয়ে তাকে সোজা করে মাথা নিজের কাঁধের সাথে চেপে ধরল। গার্ডের কানের কাছে মুখ এনে হিসহিসিয়ে ফিসফিস করল,
“আমি আমার সন্তান নিয়ে সুন্দর একটা পরিবার চেয়েছিলাম।”
‘তারপর, এক শ্বাসের ব্যবধানে…
ছু’রিটা বজ্রের গতিতে গার্ডের গলায় চালিয়ে দিল! পাতলা চামড়ার বাঁধা চূর্ণ হয়ে ছু’রির ফলাটা একটানে ছিঁ’ড়ে দিল কণ্ঠ’নালি। গার্ডের মুখ থেকে শব্দ বেরোল না। শুধু উগরে উঠল র’ক্তের মোটা ফোয়ারা। চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল। রিচার্ড ঠাণ্ডা চোখে দেখল ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে শরীরটা! ধপ করে মাটিতে লুটিয়ে যাচ্ছে। তারপর সম্পূর্ণ নীরবতা। র’ক্তের স্রোত থামল না কেবল প্রবাহের মালিকটাই নিঃশেষ হয়ে গেল।
‘রিচার্ড ধীর পায়ে এগিয়ে গেল রুফটপের ধারে। কালো ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে সে হাঁটছিল লা’শের উপর দিয়ে। র’ক্তের গাঢ় আস্তরণে তার ভারী বুট চাপ ফেলছিল এক এক করে। প্রত্যেক পায়ের নিচে মাং’স চটকে যাওয়ার ভিজে শব্দ! র’ক্তের শিরাগুলো ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার মৃদু প্রতিধ্বনি। সবকিছু যেন এক অভিশপ্ত সঙ্গীত হয়ে বাজছিল এই র’ক্তমাখা মঞ্চে। দরজার কাছে এসে থমকালো সে। বাইরে থেকে আটকানো। মনে পড়ল,সেই সময় একজন প্রাণপণে পালিয়ে দরজা আটকে দিয়েছিল ভেতর থেকে। কিন্তু তার কি সত্যিই বাঁচার সুযোগ আছে? রিচার্ডের ঠোঁটের কোণে এক বিন্দু উপহাস ফুটে উঠল। তার মারের হিসাব সে ভালোই জানে, একবার ছুঁলে কেউ আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। নিশ্চয়ই সে নিচে নামার আগেই সিঁড়িতে পড়ে নিথর হয়ে গেছে।
‘রুফটপের কিনারায় এসে কাঁধ থেকে ব্যাগ নামাল রিচার্ড। এক নিখুঁত শিকারির মতো নিস্তরঙ্গ হাতে খুলল চেইন। অন্ধকার অস্ত্রভাণ্ডারের ভেতর হাত চালিয়ে বের করল কারেন্টের তার। রাত্রির বাতাসে ধাতব তারগুলো শীতলভাবে ঝলসে উঠল। এবার শুধু অপেক্ষায় আছে আরও কিছু মাংস পোড়ানোর জন্য, আরও কিছু আর্তনাদকে আগুনে ঢেকে ফেলার জন্য। রাত্রির কালো শূন্যতা চিরে বাজপাখির মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। তার শরীরের ওজন আর গতির সংঘাতে পঁয়তাল্লিশ তলার কাঁচের দেয়াল কাঁপল কিন্তু ভাঙল না। উপর থেকে দুলতে থাকা শরীরটা মুহূর্তে স্থির হয়ে গেল। শিকারির চোখে এক তীব্র দৃষ্টি ফুটে উঠল ভিতরের দৃশ্য দেখে। কাদের—তার সবচেয়ে বড় শত্রু—দু’জন মেয়ের মাঝে ডুবে আছে। জগতের সব ভয় ভুলে সে আত্মসুখে নিমজ্জিত।
‘রিচার্ডের রাগ জ্বলে উঠল নরকের আগুনের মতো। ঠান্ডা কাচের উপর মৃদু একটা ধাক্কা দিয়ে দুলে পিছনে ছিটকে গেল সে,পূনরায় ফিরে এসে পায়ের আঘাত বসাল কাঁচেই। এভাবে কয়েকবার এমন করতে থাকে। প্রতিবারই দোলনাটা আরও দ্রুত, আরও শক্তিশালী হতে থাকল। এক সময় প্রচণ্ড গতিতে ছুটে এসে সে কাচে ভয়ংকর এক ধাক্কা দিল। মুহূর্তেই শিরশিরে শব্দ তুলে কাচ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে চারদিকে ছিটকে পড়ল। রিচার্ড বিদ্যুৎগতিতে সেই ভাঙা অংশের ভেতর দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ল। নরকের দুয়ার ভেঙে এক নৃশংস শিকারি প্রবেশ করল তার শিকারের রাজ্যে। বাতাসে ছড়িয়ে থাকা কাচের টুকরোগুলো ঠিকরে পড়ল চারপাশে! কাদেরের শিথিল সুখের আস্তানায় এক নিমেষেই নেমে এল ভয়ংকর ত্রাস।
‘রিচার্ডকে দেখামাত্র কাদেরের ভেতরটা শীতল বরফে জমে গেল। বুকের হাড় গুঁড়িয়ে আসছে, পাঁজরের নিচে কুঁকড়ে উঠছে এক ভয়ংকর সন্ত্রাস। সে জানত, এটাই একদিন ঘটবে। সে জানত, তার মৃত্যু একদিন তার সামনে এসে দাঁড়াবে।কিন্তু সে কল্পনাও করতে পারেনি সেটা এতো দ্রুত হবে। একটা অর্ধনগ্ন মেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে রিচার্ডের দিকে তেড়ে গেলে রিচার্ডের হাত এক ঝটকায় তার শরীর ছিটকে ফেলল। শূন্যে ভেসে গিয়ে ঠাস্! টেবিলের কোণে মাথা লাগল, খু’লির ভেতর চিঁড়িক করে একটা আওয়াজ হল। মুহূর্তের মধ্যেই গাঢ় র’ক্ত গড়িয়ে পড়ল মেয়েটার ঘাড় বেয়ে, ধপাস করে লুটিয়ে পড়ল সে।
‘আরেকটা মেয়ে নরপশুর মতো দেখতে র’ক্তে ভেজা রিচার্ডকে দেখে আতঙ্কে দরজার দিকে দৌড় দিল।রিচার্ড ঠফলের ঝুড়ি থেকে একটা না’ইফ তুলে নিখুঁত অংকের মতো হিসাব কষে ছুঁড়ে মারল তার দিকে। না’ইফটা ঘূর্ণি তুলতে তুলতে ছুটে গিয়ে মেয়েটার ঘাড়ে বিঁধল। মাংস কেটে ছুরি এত গভীরে ঢুকল যে এক মুহূর্ত সে বোঝার আগেই তার পা দুটো ভেঙে পড়ল, শরীর ধপ করে মাটিতে আছড়ে পড়ল। মুখ থেকে কোনো শব্দ বেরোল না, শুধু একজোড়া বিস্ফারিত চোখে সে তাকিয়ে থাকল শূন্যে, যেন নিজেই বিশ্বাস করতে পারছে না যে সে মারা গেছে। কাদের আতঙ্কে দেয়ালের দিকে সরে গেল। বুকের ভেতর কাঁপতে থাকা প্রাণটা যেন দেহ ফুঁড়ে বেড়িয়ে আসতে চাইছে। হাত-পা অবশ হয়ে গেছে, হাঁটু থরথর করছে। সে চাইছে চিৎকার করতে কিন্তু গলার স্বর কোথাও হারিয়ে গেছে।
‘রিচার্ড নির্বিকার। টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে তার ব্যাগ খুলল। একে একে বের করতে থাকল অস্ত্র—ধারালো চা’পা’টি, ন’র’কীয় ছু’রি, সি’রি’ঞ্জ, ছোট ছোট শিশি, অ্যা’সিড… আরো অনেক কিছু। নিস্তব্ধ কক্ষ, অথচ নিস্তব্ধতার ভেতর একটা পৈশাচিক শীতলতা ছড়িয়ে পড়ছে। প্রতিশোধের সুনসান আগুন ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে। কাদেরের হাঁটু এত জোরে কাঁপছে যে দাঁত কটকট শব্দ তুলছে। সেই শব্দে রিচার্ড একবার মুখ তুলে তাকাল। ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ হাসি। রিচার্ড এগিয়ে গেল, কাদেরের কাঁপতে থাকা মুখের সামনে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল,
“আমার সন্তানের শোক পালন করার জন্য তো আমি আছি। কিন্তু তোর মৃত্যুর শোক পালন করবে কে?”
‘কাচের জারের ভেতর ঘন, অস্বাভাবিক গাঢ় খয়েরি তরল নড়েচড়ে উঠছে। জারটা সম্পূর্ণ হয়ে টপটপ শব্দে রক্তের শেষ ফোঁটাগুলো ঝরে পড়ছে নিচে! প্রতিটি ফোঁটার সাথে কাদেরের নিঃশেষিত জীবন গলে পড়ছে ধাতব ট্রেতে। কাদেরের দেহ উল্টো ঝুলছে একটা মাংসের থলের মতো। পুরো শরীর ফ্যাকাসে রূপ ধারণ করেছে রক্তশূন্যতায়। নাকের সরু ছিদ্র দিয়ে গাঢ় লাল দাগ শুকিয়ে জমে আছে।ঠোঁটের কোণ বেয়ে একটা জমাট বাঁধা রেখা নেমে গেছে থুতনিতে। সারা শরীরটা যেন ফুটোফুটো করা হয়েছে।সিরিঞ্জের সূক্ষ্ম ছিদ্র থেকে এখনও রক্তের ছোট ছোট বিন্দু বেরিয়ে আসছে নিস্তব্ধ যন্ত্রণায়। চামড়া ছিঁড়ে যাওয়া জায়গাগুলো ফুলে উঠেছে, কিছু জায়গায় ক্ষতের ভেতর জমাট রক্ত জমে কালচে হয়ে গেছে।
‘রিচার্ড কাঁপতে কাঁপতে শেষ সিরিঞ্জটা ছুঁড়ে ফেলল মেঝেতে। ঘামের ধারা তার ঘাড় বেয়ে বুকে নেমেছে। ধমনীতে রক্তের চেয়ে বেশি পাম্প করছে ক্লান্তি আর উত্তেজনা। এতক্ষণে তার কাজ শেষ। ধীরে ধীরে, নিস্তব্ধতায়, সে একে একে নিজের পোশাক খুলতে লাগল। শার্ট, প্যান্ট, মোজা সব খুলে ফেলে দিল একপাশে। তার ত্বক এই রক্ত মাখতে চায় না, এই নরখাদকের ছোঁয়া বহন করতে চায় না। তাছাড়া বাংলাদেশ থেকে সে এক কাপড়ে এসেছে। শরীরে আন্ডার গার্মেন্টস ছাড়া কিছুই রাখল।
‘রিচার্ড ধীরে ধীরে কাদেরের ঝুলন্ত দেহের দিকে তাকাল। কাদের দূর্বলতায় ঝিমাচ্ছে। রিচার্ড রক্তে পরিপূর্ণ জারটা হাতে তুলে নিল। এক শ্বাসে অর্ধেক জার খালি করে দিল সে। জারটা টেবিলে রেখে হাতের পিঠ দিয়ে ঠৌঁটের পাশে লেগে থাকা রক্ত মুছে নিল।
“জানিস, আমি এতোদিন মুখে কিছু দিইনি, শুধুমাত্র তোর রক্ত খাবো বলে।”
‘রিচার্ড হাতে তুলল রিভলভার। নিশানা স্থির করে ট্রিগারে চাপ দিতেই দঁড়ির শেষপ্রান্ত ছিঁড়ে গেল। কাদেরের মৃতপ্রায় শরীর আছড়ে পড়ল নিচে। দীর্ঘক্ষণ উল্টো ঝুলে থাকার যন্ত্রণা তার রক্তে ছাপ রেখে গেছে। নাকমুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসছে। চোখের সামনে সবকিছু ধোঁয়াটে।
“পানি… পানি… আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে…”
‘শব্দগুলো অসহায় ভাবে বেরিয়ে এলো যেন মরুভূমির পিপাসার্ত কোনো পথিকের করুণ আর্তি। হঠাৎই শরীরের ওপর ছিটকে এলো উষ্ণ, সোনালি তরল। কাদের কিছু না দেখে, না বুঝেই মুখ নামিয়ে দিল, কাঠফাটা তৃষ্ণায় উন্মত্ত হয়ে গেল। তবে প্রথম চুমুকেই জিভের স্বাদ বদলে গেল, ঘৃণা আর অবিশ্বাসের ঢেউ বয়ে গেল মেরুদণ্ড বেয়ে। মাথা তুলে তাকাতেই ধাক্কা খেলো। নরকের শাস্তিও বোধহয় একটা নগন্য হয় না। রিচার্ড দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে, মুখে অশ্লীল তৃপ্তির ছায়া। কাদেরের পাকস্থলীতে একটা প্রচণ্ড মোচড় উঠল। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে সে বমি করতে লাগল, থামার আগেই আবার উগরে দিল পাকস্থলীর অবশিষ্ট কণা।
‘ঘরের বাতাসে এখন রক্ত, ঘাম, মূত্র আর বমির বন্যা। কাদেরের চোখ দুটো ঝাপসা, পেটের ভেতরটা খালি হয়ে গেলেও মাথার মধ্যে ঢেউ তুলছে চরম অবমাননার যন্ত্রণা। সে শুয়ে পড়ল মেঝেতে। রিচার্ড নিচু হয়ে তার মুখের কাছে ফিসফিস করে বলল,
“স্বাগতম, নরকে। এটা তো কেবল শুরু…”
‘কাদের কিছু বলতে যাবে তার আগেই রিচার্ড তার মাথা পা দিয়ে টায়েলের সাথে এমন শক্ত করে চেপে ধরল যে, অকস্মাৎ এমনটা হওয়ায় কাদের দাঁতের মাঝে পড়ে জিহ্বার আগা কেটে পড়ে যায়৷ পাহাড়ের চুড়ো থেকে প্রবাহিত ঝরনার মতো রক্ত প্রবাহ হতে থাকে কাদেরের মুখগহ্বর থেকে। কাদেরের গলা দিয়ে বেপরোয়া গর্জন বের হতে থাকে। নিষ্ঠুর তান্ডবে মত্ত হয়েছে রিচার্ড। কাদের চুল টেনে ধরে তুলল। কাদের গলা হতে নির্গত কর্কশ গোঙানির শব্দে দূর্বল গলায় উচ্চারণ করল,
“মেরে ফেল আমাকে, মেরে ফেল।”
‘অবিশ্রান্ত প্রতিশোধস্পৃহায় দগ্ধ সে। রক্তঝরা ক্রোধ গ্রাস করে নিয়েছে পৈশাচিক আত্মা। হিংস্র কামড়ে টেনে ছিঁড়ে ফেলল কাদেরের কান। মাংস ছিঁড়ে যাওয়ার করুণ শব্দ ধ্বনিত হল শীতল বাতাসে। রিচার্ডের দাঁতের ফাঁক ফোঁকরে ঝুলে রয়েছে মাংসের পিন্ড। মাটিতে রক্তে গড়াগড়ি খেতে থাকে কানটা। অসহায়ের মতো গোঙাচ্ছে কাদের। বার বার মেরে ফেলার আর্তি করছে। শক্ত ঢোক গিলে পিপাসা মেটালো রিচার্ড। ঢোকের সাথে মুখে লেগে থাকা তাজা রক্ত আবারও গেল গহ্বরে।
“তোকে এক কোপে শেষ করব না। ধীরে ধীরে ছিঁড়ে খাব, কুত্তার মতো ছিঁড়ে ছিঁড়ে—রক্তের শেষ ফোঁটাটুকু পর্যন্ত তোকে কষ্ট দিয়ে মারব!”
“আমার ভুল হয়ে গেছে। সন্তান হারানোর শোকে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলাম আমি। আমাকে মেরে ফেল।” কাদের মৃগী রুগীর মতো কাঁপতে কাঁপতে বলল। শ্বাসকষ্টে খেঁকিয়ে উঠছে একটু পরপর। রিচার্ড পৈশাচিক উন্মাদনার হাসি দিল। অতঃপর নির্মম থাবা দিয়ে অপর কান টেনে ছিঁড়ে ফেলল মেঝেতে। সাউন্ডপ্রুফ রুমের বাইরে যায় না কাদেরের গনবেদনী চিৎকার। অসহনীয় নির্যাতন থেকে আর শরীর মুক্তি চাচ্ছে, তবে এই শানিত বিদ্বেষ তাকে মুক্ত দিতে নারাজ।
‘রক্তের তপ্ত তরঙ্গ বইছে ফ্লোর জুড়ে। কাদেরেদ ভগ্ন দেহখান শক্তপোক্ত ভাবে চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। ছুরির নির্মম খচখচ শব্দ আর কণ্ঠচাপার গভীর ঘড়ঘড়ানি ছাড়া আর কিছুই কর্নপাত হচ্ছে না এই মুহুর্তে। কাদের শরীর ছেড়ে দিয়েছে চেয়ারে। মাথা চেয়ারের প্রান্তভাগে ঝুলে আছে। রক্তাক্ত হাত থেকে বার বার ছু’রিটা পিছলে যাচ্ছে। রিচার্ড উঠল, ওর গা থেকে ঝড়ঝড় করে র’ক্ত ঝড়ছে। সে গিয়ে টিস্যুর বক্স নিয়ে আবারও কাদেরের পায়ের কাছে বসল। ডান পায়ের হাড় ইতিমধ্যে ভেসে উঠেছে। সে এবার বাম পায়ে হস্তান্তরিত হল। পা থেকে খাবলা খাবলা মাংস কেটে বক্সে রাখতে থাকে। চোখে অদ্ভূত উৎফুল্লতা, হাতে বর্বরতা। সে আজ হুটহাট কোনো জল্লাদীয় আক্রমণ করছে না, বরংচ যা-ই করছে খুবই ধৈর্যের প্রমাণ সহকারে করছে।
“তুই কখনোই মানুষ হতে পারিস না।”
‘কাদেরের গাল থেকে ভেসে আসা অস্পষ্ট শব্দে উঠে দাঁড়াল রিচার্ড। পায়ের নিচে আপাতত ধ্বংস করার মতো কিছুই নেই। রিচার্ড নখের নিচে লেগে থাকা মাংসের টুকরো বের করতে করতে ধ্বংসের হিমশীতল ছোঁয়া মিশ্রিত কণ্ঠে শুধালো,
“হতে তো চেয়েছিলাম, তুই তো হতে দিলি না।”
‘রিচার্ড হেঁটে গেল টেবিলের কাছে, যেখানে সে তার সকল হাতিয়ার রেখেছিল। সেখান থেকে একটা ছোট শিশি হাত তুলে নিল, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল বিধ্বস্ত কাদেরের দিকে। তুষ্ট হেসে কাদেরের সামনে গিয়ে দাড়িয়ে শিশির মুখ খুলতে খুলতে রাশভারি আওয়াজে বলল,
“তোর পাপ ছিল আমার বাপকে মারতে চাওয়া, তোর পাপ বেড়েছে, আমার সন্তানকে মেরে।”
‘শিশির উপর থেকে কর্ক খুলতেই ভিতর থেকে উপ্তত্ত ধোঁয়া বের হতে থাকে। হাঁটু গেঁড়ে বসল রিচার্ড, শিশির ভিতরের ভয়ংকর রাসায়নিক ক্যামিকেল কাদেরের পায়ের অবশিষ্ট হাড্ডিতে ঢালতেই শক্ত হাড় গলে গলে পড়তে থাকেন। নরকযন্ত্রণা দায়ক আর্তনাদের হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে কাদের। বেদনার কন্টময়ক প্রতিটি আর্তনাদে অন্তরের পৈশাচিক সুখ বয়ে যায় রিচার্ডের। কাদের বিরতিহীন চেঁচাতে থাকে,
“আমাকে মেরে ফেল, মেরে ফেল আমাকে। মুক্তি দে এই নরকযন্ত্রণা থেকে।”
‘রিচার্ডের ঠোঁটের কোণে একচিলতে বিকৃত হাসি খেলল। নিচে পড়ে থাকা কাদেরের শরীরটা রক্তশূন্য, নিঃস্তব্ধ।কেবল কোমরে ঝুলছে একটা পাতলা আন্ডারওয়্যার, যা অস্তিত্বের শেষ চিহ্ন হয়ে টিকে আছে। রিচার্ড খুঁজে একটা ম্যাচ বের করল। উদ্দেশ্যেকৃত জিনিসটা খুঁজে পেতেই শিকারের মতো হিংস্র উল্লাসে তার মুখে বিকারগ্রস্ত হাসি ফুটে উঠল।
সুখটান দিয়ে আগুন ধরালো অতঃপর ঠাণ্ডা নিষ্ঠুরতায় ম্যাচটা ছুড়ে দিল ঠিক কাদেরের গোপাঙ্গের ওপর। এক নিমেষে কর্টনের আন্ডারওয়্যার দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। তীব্র শিখা আঁকড়ে ধরল তাকে। কাদেরের শরীর ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে উঠল যন্ত্রণায়! তার চিৎকার কক্ষের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। রিচার্ড নির্বিকার দাঁড়িয়ে রইল। কাদেরের চোখগুলো তৃষ্ণায় ফেটে যাচ্ছে, শ্বাস আটকে আসছে, অথচ মৃত্যুর করুণ দয়া পাচ্ছে না সে।
‘আগুন ছড়িয়ে পড়ার আগেই নিভিয়ে দিল রিচার্ড। খেলা তখনো শেষ হয়নি। সে একগ্লাস এসিড নিয়ে এগিয়ে গেল, থমকে দাঁড়িয়ে এক মুহূর্ত কাদেরের ফুঁপিয়ে ওঠা যন্ত্রণা উপভোগ করল পরপরই ঠান্ডা ঢেলে দিল জ্বলন্ত তরল কাদেরের গোপাঙ্গে। তীক্ষ্ণ শোঁ শোঁ শব্দে চামড়া গলে গেল, মাংস দগদগে হয়ে খুলে পড়তে থাকল। কাদেরের কণ্ঠনালী ফেটে চৌচির। অথচ শব্দ বেরোচ্ছে না—শুধু হাহাকারের মতো কিছু গুঞ্জন, যেটা হয়তো শয়তানও সহ্য করতে পারত না! তার পুরুষতন্ত্র ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, তার ক্ষমতার মূল অস্ত্র গলে গলে নিচের শুকনো রক্তের সাথে মিশে যাচ্ছে। এই অস্ত্র দিয়েই কত মেয়ে কেঁদেছে, কেঁপেছে আতঙ্কে। কত নিরাপদ মেয়ের ইজ্জত কেড়ে নিয়েছে সে, অথচ প্রকৃতির নির্মম পরিহাসে আজ সে নিজেই ছটফটাচ্ছে। রিচার্ড শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কাজ শেষ। পশুর বিচার হয়েছে পশুর মতোই! ওয়েট, ওয়েট, রিচার্ড কায়নাতের নৃশংসতা কি এতো সহজে শেষ হয়?
‘হঠাৎ করুণ এক মেয়েলি চিৎকার ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে। কলগার্ল মেয়েটা সদ্যই চেতনা ফিরে পেয়েছে। চোখের সামনে চাক্ষস এমন অপ্রীতিকর নৃশংস অবলোকন হওয়ায় ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। দৌড়ে ওয়াশরুমে গিয়ে গলা চেপে ধরে গরগর করে বমি করতে লাগল সে। রিচার্ড বিরক্ত চোখে মেয়েটার দিকে তাকাল। তার কাজে ব্যাঘাত ঘটানো সে সহ্য করতে পারে না! ক্ষুব্ধতায় মেয়েটার চুলের মুঠি ধরে এক ঝটকায় টেনে নিয়ে এল কাদেরের সামনে। এক মুহূর্ত দেরি না করে শুরু হলো নৃশংস খেলা। ছুরি চালাল সে বারবার, বারবার! প্রতিটি কোপে মাংস ছিন্নভিন্ন হয়ে মেঝেতে পড়তে থাকল, চামড়া খুলে গেল, হাড় বেরিয়ে এল। শরীরটা একানব্বই টুকরোয় বিভক্ত হলো। মাংসের এক করুণ স্তুপ পড়ে রইল কাদেরের সামনে। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। মেয়েটার কাটা পায়ের একটা আঙুল তুলে নিল রিচার্ড। ধীরস্থির হাতে সেটার উপর এসিড ঢেলে দিল। মুহূর্তেই গলে গেল মাংস! এক জ্বলন্ত পিণ্ডে পরিণত হলো সেটা। ঠান্ডা দৃষ্টিতে কাদেরের মুখের দিকে তাকাল অতঃপর সেই জঘন্য পিণ্ডটা ঠেসে ঢুকিয়ে দিল কাদেরের মুখে!
“তোর পায়ে ধরি আমাকে মেরে ফেল। আমি মরতে চাই। এই যন্ত্রণা আমি আর সহ্য করতে পারছি না।”
‘রিচার্ড টেবিল থেকে ভারী চা’পা’তি’টা তুলে নিল। তার চোখে এক ধরনের অশুভ দীপ্তি, ঠোঁটের কোণে বিকৃত এক হাসি খেলা করছে। একপ্রকার লাফিয়ে গেল কাদেরের সামনে। মাথা নিচু করে ফিসফিস করল,
“কষ্ট হচ্ছে? আমার সন্তানেরও হয়েছিল… যখন লাথির আঘাতে ওর ছোট্ট শরীরটা ছটফট করেছিল। ঠিক এখানটায়, আর ওখানটায়…”কথা শেষ করার আগেই প্রথম কো’পটা বসাল রিচার্ড এক লহমায় কাদেরের চামড়া ফেটে র’ক্তে’র ফোয়ারা ছুটল। দ্বিতীয় কোপ, তৃতীয়—গণহারে কো’পাতে থাকল সে! চা’পা’তির ধা’রাল ধাতব ঠোঁট কাদেরের মাং’স ছি’ন্নভিন্ন করে দিচ্ছে, র’ক্ত ঝরঝর করে গড়িয়ে পড়ছে মেঝেতে, ঘরজুড়ে কেবল র’ক্ত আর মাং’সে’র পিণ্ড। নাক, চোখ, ঠোঁট শরীরের প্রতিটা অংশ ক্ষতবিক্ষত হতে লাগল। মাং’সের টুকরো ছিটকে ছিটকে পড়ছে চারপাশে। বুক থেকে চা’পা’তির ঠৌঁটের সাথে বেজে বেরিয়ে আসে নিকোটিনের ধোঁয়ায় পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া কলিজা।
‘কাদেরের পতন হলো এভাবেই। যন্ত্রণার কালো গভীরে ডুবে গেল তার অস্তিত্ব। তবুও রিচার্ড এত সহজে থামার পাত্র নয়। সে কাদেরের বু’ক চিরে একে একে হৃ’দপিণ্ড, কলিজা, লিভার,ফুসফুস বের করল। তারপর সেগুলো নিখুঁত দক্ষতায় ছোট বাক্সে ভরে নিল । কাদেরের দ্বি’খণ্ডিত মা’থা’টা তুলে ব্যাগে পুরে ফেলল বাক্সগুলোর সঙ্গে।শরীরে এখনো রক্তের ভার, ক্লান্তি জমেছে গাঁয়ে। টলতে টলতে ওয়াশরুমে ঢুকল রিচার্ড। ঝরনার নিচে দাঁড়িয়ে ধুয়ে ফেলল নৃশংসতার সব চিহ্ন। কাঁধ থেকে রক্ত মুছে যেতেই আবারও ঝলমলে হয়ে উঠল তার বলিষ্ঠ কায়া। আয়নার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। চোখেমুখে বিধ্বস্ততার ছাপ, অনুভূতিহীন শূন্যতা জমে আছে তার দৃষ্টিতে। হঠাৎই এক থাবায় আয়নাটা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলল সে!
‘শাওয়ার শেষ করে রেডি হয়ে দরজা খুলল রিচার্ড।দেখতে পেল কাদেরের গার্ডগুলো দাঁড়িয়ে আছে। ওরা রিচার্ডকে দেখে যেন ভূত দেখেছেকিন্তু যখনই ভেতরের রক্তের সমুদ্র, ছিন্নভিন্ন দেহের স্তূপ দেখতে পেল তখন ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পেছন ফিরে দৌড় দিল সকলে। রিচার্ড চাইলেই ওদের পিছু নিতে পারত কিন্তু ক্লান্ত শরীর বিদ্রোহ করল। সে আর এগোল না ধীরপায়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে এল। হোটেল থেকে বেরিয়ে যেতেই এক বিকট বিস্ফোরণ কাঁপিয়ে দিল চারপাশ! মুহূর্তের মধ্যে হোটেল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলো। আগুনের ভয়াবহ লেলিহান শিখায় পুড়ে ছাই হয়ে গেল কাদেরের অস্তিত্ব। তার দল, দলের লোক। রিচার্ড দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ! নিষ্পলক চেয়ে দেখল ধ্বংসস্তূপের দিকে। তারপর নিঃশব্দে পা বাড়াল, তার কাজ শেষ।
ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৪৬
‘হোটেলে রাতে ঢুকেছিল রিচার্ড, এখন সন্ধ্যা। রিচার্ড বসে আছে একটা ছাউনির নিচে! চোখের সামনে ঝরছে টিপটিপ বৃষ্টি। চারপাশ স্যাঁতসেঁতে, ঠান্ডা অথচ তার শরীরে এখনো আগুন জ্বলছে। পাশেই কুকুরের দল মত্ত হয়ে মাংস খাচ্ছে। ক্ষুধার্ত পশুর মতো চেটেপুটে শেষ করছে তাদের বরাদ্দ। রিচার্ড ব্যাগ খুলে আরেকটা ছোট বক্স বের করে চুপচাপ ছুঁড়ে দিল তাদের দিকে। কুকুরগুলো গর্জে উঠে সেটাও লুফে নিল। রিচার্ড নিষ্প্রাণ চোখে তাকাল বৃষ্টিমুখর আকাশের দিকে। চাঁদ ঢাকা পড়ে গেছে ঘন মেঘের আড়ালে, যেভাবে তার সন্তান হারিয়ে গেছে পাপের অন্ধকারে অস্তিত্বহীন, নিঃশব্দে। শুধু এক অনন্ত শূন্যতা রেখে গেছে তার ভেতরে।