ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৫৬
মিথুবুড়ি
‘ঘড়ির কাঁটা এগারোটার ঘরে থেমে থেমে টিকটিক করছে। রান্নাঘর জুড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে মাখনের গন্ধ, টমেটো সস আর ভেজা পাস্তার ঘ্রাণ। এলিজাবেথের কাজে আজ কোনো বিরক্তি নেই, ক্লান্তিও যেন ছুটে পালিয়েছে। সে দৌড়ে বেড়িয়েছে একপাশ থেকে আরেকপাশ। ইউটিউব ভিডিও দেখে দেখে লুকাসের সাহায্যে বানিয়েছে রিচার্ডের পছন্দের ইটালিয়ান খাবার। লুকাস জানিয়েছে তাকবীরের অবস্থা স্থিতিশীল। গুলিটা পিঠ ভেদ করে বেরিয়ে গেছে তাই বেঁচে গিয়েছে তাকবীর। রিচার্ডও ভালো আছে, আপাতত গোডাউনে।
‘খবরগুলো পেয়ে এলিজাবেথের ভেতর খানিকটা স্বস্তি এসেছে কিন্তু অস্থিরতা এখনও কমেনি। যতক্ষণ না নিজ চোখে রিচার্ডকে দেখবে ততক্ষণ শান্তি নেই তার। দরজার সামনে বারবার পায়চারি করছে এলিজাবেথ। ম্যানশনের ভিতর নির্জনতা। অতিরিক্ত কোনো মেড নেই সবিতা বেগম ছাড়া। সব কাজ এখনও তাকেই করতে হয়। রিচার্ড এখনও বদলাননি সে নিয়ম। ম্যানশনের অভ্যন্তর জুড়ে এক অদ্ভুত অপেক্ষা, অশান্তি, আর চুপচাপ ভালোবাসা ঘোরাফেরা করছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘কারোর পায়ের শব্দে এলিজাবেথ ছুটে গেল মেইন গেটের কাছে। রিচার্ড, ন্যাসো আর লুকাস একসাথে ভিতরে প্রবেশ করছে লম্বা, লম্বা পা ফেলে। ক্ষুব্ধ হয়ে আছে রিচার্ড। এলিজাবেথ দৌড়ে দিয়ে পথ আটকে দাঁড়াল। আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কাঁধে ব্যান্ডেজ ছাড়া আর কোথাও ক্ষতের চিহ্ন নেই রিচার্ডের শরীরে। এলিজাবেথ কিছু বলতে যাচ্ছিল তখনই উপর থেকে হুড়মুড়িয়ে নেমে আসে ইবরাত। কোনোকিছু তোয়াক্কা না করে ঝড়ের বেগে ছুটে গিয়ে জাপ্টে ধরল ন্যাসো। ন্যাসো তাল রাখতে না পেরে একটু এলিয়ে গেলেও সামলে নিল নিজেকে। দু’হাতে শক্ত করে আগলে ধরল ইবরাত’কে৷ ফোঁপাচ্ছে ইবরাত,
“আ- আ আপনি ঠিক আছেন তো?”
“আমি একদম সুস্থ আছি, রাত।”
“আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
‘ন্যাসো একহাতে ইবরাতের মাথায় পরম আহ্লাদে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,”আমি এসে গেছি তো, আর কোনো ভয় নেই।” কথার ফাঁকে ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকাতেই দেখতে পেল লুকাস নাক কুঁচকে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। পরপরই ন্যাসে ঘাড় ঘুরিয়ে বা দিকে তাকাল। দেখতে পেল রিচার্ড সে নিজেও ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। চোখেমুখে বিরক্তের ছায়া আবছা। ভরকে গেল ন্যাসো, খানিকটা লজ্জাও পেল। শত হোক বস বলে কথা। আর এক মূহুর্তও সেখানে রইল না। ইবরাত কে কোলে তুলে এক প্রকার দৌড়ে চলে গেল উপরে। লুকাস নিজেও প্রস্থান করল ভেংচি কেটে। উপস্থিত রইল শুধু রিচার্ড আর এলিজাবেথ। কয়েক কদম এগিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল এলিজাবেথ।
“আমি জানতাম আপনি আসবেন।” বলে রিচার্ডের কাছে যেতে চাইলে হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দিল রিচার্ড। অন্য দিকে মুখে ঘুরিয়ে গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“আসার কথা ছিল, তাই এসেছি।”
‘থমকে দাঁড়িয়ে রইল এলিজাবেথ। রিচার্ডের কথা যেন শরীরের ভেতর দিয়ে শিরশিরে একটা আগুন ছড়িয়ে দিল। তবুও মুখে এক চিলতে হাসি রেখে ডাইনিংয়ের দিকে পা বাড়াল। গলা নিচু করে বলল,
“আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন, আমি খাবার সার্ভ করছি।”
“আমি খেয়ে এসেছি।”
‘রিচার্ডের কাঠের মতো কঠিন কণ্ঠে এলিজাবেথ থমকে দাঁড়িয়ে গেল। আহত চোখে তাকিয়ে বলল,
“কিন্তু…”
“কিন্তু কী?”
“আমাদের তো একসাথে ডিনার করার কথা ছিল।”
“হ্যাঁ, ছিল। কিন্তু সবকিছু বদলে গেছে এখন। অনেক কিছুই তো বদলে যায়!”
‘রিচার্ড নিরুত্তাপভাবে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। এলিজাবেথ দাঁড়িয়ে রইল, নিঃসঙ্গ। চোখের কোণে জল জমে উঠল। কণ্ঠ কেঁপে উঠল। ধীর গলায় বলল,
“আমি খাইনি… আপনার জন্য।”
‘কিন্তু সেই শব্দ রিচার্ডের কানে পৌঁছানোর আগেই সে দৃষ্টিসীমা ছাড়িয়ে গেল। অশ্রুগুলো আর বাঁধ মানল না, গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। দূর থেকে সেই ভাঙা দৃশ্য দেখে ঠোঁটের কোণে বিষমিষ্টি তৃপ্তির হাসি ফুটল সবিতা বেগমের। এলিজাবেথ আর খেলো না। খাবারগুলো নিঃশব্দে ফ্রিজে রেখে এলিজাবেথ ধীর পায়ে উপরে উঠে গেল। মাস্টার বেডরুম অর্থাৎ তাদের ব্যক্তিগত কামরায় ঢুকতেই চোখে পড়ল রিচার্ড ফ্রেশ হয়ে বেরিয়েছে। নিচে কালো ট্রাউজার, কাঁধে সাদা তোয়ালে। বুক বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানির ফোঁটা। এলিজাবেথকে এক পলক দেখেও না দেখার ভান করে ভেনিটির সামনে গিয়ে দাঁড়াল রিচার্ড। তোয়ালেটা গা থেকে ছুঁড়ে ফেলল কাউচে তারপর চুলে চিরুনি চালাতে লাগল।
‘এলিজাবেথের ঠোঁট থরথর করে কাঁপতে লাগল। কান্না আর চাপা থাকল না।সে জানে এই উপেক্ষার কারণ সকালের সেই কটু কথা। এগিয়ে গেল রিচার্ডে দিকে। রিচার্ডের হাতটা একটু কাঁপছে। ঠিকভাবে চুল আঁচড়াতে পারছে না, কাঁধের ক্ষতে টান পড়ছে।
“আমি হেল্প করব?”
‘ওর দিকে এক পলক তাকিয়ে রিচার্ড চুপচাপ চিরুনি নামিয়ে রাখল। বিছানা থেকে একটা বালিশ তুলে নিয়ে কাউচের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল,”নো থ্যাংকস।”
‘জীবন সংগ্রামে এলিজাবেথ অনেক অবহেলা সয়ে এসেছে। কিন্তু আজ রিচার্ডের এই ক্ষুদ্র অবজ্ঞা তার সহ্যের সীমা পেরিয়ে গেল। ছুটে গিয়ে পিছন থেকে তার হাত টেনে ধরল। রিচার্ড ঘুরে তাকাল। জলে টলমল করছে এলিজাবেথের চোখ।
“স্যরি,”
“হোয়াই?”
“সকালের ব্যবহারের জন্য। আমি আসলে…”
‘রিচার্ড কঠিন স্বরে কেটে দিল কথা,”রিচার্ড কায়নাত নেভার একসেপ্টস এপোলজি।”
‘এবার এলিজাবেথ দু’হাতে চেপে ধরল রিচার্ডের হাত। কাঁপছে ঠোঁট। শব্দগুলো কাঁপা কাঁপা গলায় বেরোল,
“আজ এখানে শুতে হবে না… আপনার কাঁধে ক্ষত…”
‘রিচার্ড একটানে হাত ছাড়িয়ে নিল। হঠাৎ টান সামলাতে না পেরে এলিজাবেথ ছিটকে গিয়ে পড়ল বিছানায়। গর্জে উঠল রিচার্ড,”রিচার্ড কায়নাত কারোর দয়ার পাত্র না, ওকে?”
“আপনি এমন কেন করছেন? বললাম তো—স্যর…”
‘কথা শেষ হবার আগেই ফের গর্জে উঠল রিচার্ড,”কেমন করছি?মেরেছি? তুইতোকারি করেছি? গালিগালাজ করেছি?জোর করে ছুঁয়েছি? টেনেহিঁচড়ে বেডে নিয়েছি?”
‘প্রতিটি শব্দ যেন বিষবাণ হয়ে বিঁধে গেল এলিজাবেথের হৃদয়ে। চোখের জল এবার থামানো গেল না। রিচার্ড আবারও বলতে থাকে,
“ফিরব বলেছিলাম, ফিরেছি। হসপিটালের বেডে নয়, নিজের ঘরে, নিজের জন্য বরাদ্দকৃত জায়গায় শুচ্ছি।
আর এখন আমাকে বিরক্ত কোরো না। ঘুমাবো আমি। আই’ম টায়ার্ড। ঘুমের সময় বিরক্ত আমি একদম সহ্য করব না। স্টে অ্যাওয়ে ফ্রম মি। আন্ডারস্ট্যান্ড? ”
“বলেই উল্টে শুয়ে পড়ল কাউচে। পিছনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল এলিজাবেথ অভিমান, যন্ত্রণা আর ভালোবাসার এক বিষণ্ণ মিশেলে। নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিল কতক্ষণ। রিচার্ড ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতে পেরে নিঃশব্দে এগিয়ে গেল এলিজাবেথ। সাহস আর কান্নার মাঝামাঝি কোথাও এলিয়ে পড়ল তার পাশে। চোখের পাতায় এখনও কাঁপছে আবেগের কম্পন। শরীর একটু পরপর কেঁপে উঠছে -ভয়, ভালোবাসা আর অভিমান একসাথে। এলিজাবেথ ধীরে হাত রাখল রিচার্ডের কপালে। নরম গলায়, নিজের ভিতরের শব্দগুলো ছাড়তে ছাড়তে বলল,
“জানেন, জীবনে আসা সহজ…কিন্তু থেকে যাওয়া তা বড়ো কঠিন। আমি আপনাকে চাই দুই দিনের সঙ্গী হিসেবে নয়।শেষ নিঃশ্বাসের আগেও আমি চাই, এই নীল চোখ দুটো থাকুক আমার সামনে। তাই আমাকে হতে হবে শক্ত, কঠিন…ফিরিয়ে আনতে হবে আপনাকে সেই আঁধারের পথ থেকে। পাথরের বুকেও ফুল ফুটাতে হবে,পরিশুদ্ধ করতে হবে আপনাকে আমাদের জন্য। কারণ আপনি শুধুই আমার। আমি কীভাবে আপনাকে সেই অন্ধকারের যাত্রী হতে দিই?”
‘চোখের কোনা বেয়ে একফোঁটা জল পড়ল রিচার্ডের কপালের কাছে। নিশ্বাসের শব্দে জবাব দিল রিচার্ড! নাকি ও নিঃশব্দেই শুনে গেল সব? এলিজাবেথ শুধু জানে এ লড়াই ভালোবাসার। আর সে হার মানবে না। সবাই ভুল বুঝলে বুঝুক।
‘আলতো করে ঝুঁকে এল এলিজাবেথ। নরম ঠোঁট ছুঁয়ে দিল রিচার্ডের কপালে এক নিঃশব্দ চুম্বন।কণ্ঠে চাপা কৃতজ্ঞতার কান্না মিশিয়ে বলল,
“ধন্যবাদ প্রিয় স্বামী…
আপন সেজে আঘাত করা মানুষগুলোকে চিনিয়ে দেওয়ার জন্য।”
‘ঘরের বাতাস নিঃশব্দে সেই শব্দগুলো বয়ে নিল। আর রিচার্ড, সে হয়তো ঘুমের গভীরে বা হয়তো চুপচাপ শুনেই গেল সব। রিচার্ডের কানের কাছে গিয়ে নিঃশব্দে ফিসফিস করল এলিজাবেথ,
“ভালোবাসি স্বামী, খুব ভালোবাসি আপনাকে।
ভালোবাসি আমার ইহকালের সঙ্গীকে,
ভালোবাসি আমার ভালোবাসাকে,
ভালোবাসি আমার একমাত্র অভিভাবককে,
ভালোবাসি আমার দুনিয়ার সঙ্গীকে,
ভালোবাসি আমার হারানো সন্তানের বাবাকে,
ভালোবাসি আমার ভবিষ্যৎ সন্তানের বাবাকে,
ভালোবাসি আপনার স্পর্শকে।
সবমিলিয়ে ভালোবাসি আপনাকে,খুব করে ভালোবাসি। ভালোবাসার থেকেও ভালোবাসি।
ভালোবাসা যতটা, তার থেকেও বেশি ভালোবাসি।
বিশ্বাস করুন, আপনার স্পর্শে বিষ খুঁজে পায় না আমি,
পায় শুধুই ভালোবাসা। আমি ভালোবাসি… আপনার ছোঁয়াকেও ভালোবাসি।
‘কথাগুলো বলে এলিজাবেথ একে একে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল রিচার্ডের গালে, কপালে, বাকে, চুলে। সব জায়গায় ভালোবাসার পূর্ণতা দিয়ে ভরিয়ে দিল। চোখের পানি ছড়িয়ে পড়ল রিচার্ডের মাথার পাশে। অতঃপর নিজের মাথা রিচার্ডের পাশে রেখে ঘুমিয়ে পড়ল এলিজাবেথ। বাকি শরীর ঠান্ডা ফ্লোরে পড়ে রইল। শুধু হৃদয়ের উষ্ণতা ছুঁয়ে থাকল রিচার্ডকে।
‘একটুখানি নিঃশ্বাসে নড়ল রিচার্ড। ধীরে ধীরে ফিরে তাকাল। রিচার্ড ঘুমাইনি। সে শুনেছে সব, অনুভব করেছে প্রতিটি শব্দ। রিচার্ড আলতো হাতে এলিজাবেথের কপালের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা বেবি হেয়ার সরিয়ে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করল,
“হারামে আরাম নেই, এলি জান।
তাই তো প্রথম দেখাতেই তোকে আমার জন্য হালাল করে নিয়েছিলাম। বিশ্বাস কর… আমার ছোঁয়ায় বিষ নেই, আছে শুধু ভালোবাসা।
‘সাবধানে এলিজাবেথকে কোলে তুলে দাঁড়াল রিচার্ড। তারপর ওকে নরম বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ভালোভাবে কম্ফোর্টারে মুড়ে দিল ওকে। পরপর কপালে দীর্ঘ, গভীর, নিঃশব্দ চুমু একেঁ দিল। আবার ফিরে গেল কাউচে।কিন্তু আর ঘুম হল না। কানে বাজতে থাকে এলিজাবেথের বলা প্রতিটা বাক্য। চোখে ভাসছে একটাই দৃশ্য,
“এলিজাবেথ।
“তার ভালোবাসা।
“তার ঘর।
“তার শান্তি।
‘মাঝে কেটে গেছে আরও দু’দিন। কিন্তু বদলায়নি কিছুই। রিচার্ড এখনও আগের মতোই এলিজাবেথকে উপেক্ষা করে চলে। ভোর হতেই বেরিয়ে যায়, ফিরেও খুব রাতে।একফোঁটা কথা নয়, একটুও চোখ রাখা নয়। এলিজাবেথ প্রতিদিনই অনেক কিছু করে রিচার্ডের জন্য। না খেয়ে অপেক্ষায় থাকে, প্রিয় খাবার বানায়। তবু প্রতিদিনই শুনতে হয়, “আমি খেয়ে এসেছি” তারপর নিঃশব্দে ঘুমিয়ে পড়া। এলিজাবেথের শত চেষ্টাও পারছে না রিচার্ডের সেই চাপা অভিমান ভাঙতে।
‘আজ শুক্রবার। ছুটির দিন বলে রিচার্ড ঘুমোচ্ছে একটু বেশি। সেই ফাঁকেই এলিজাবেথ ছুটে এসেছে রান্নাঘরে। আজ সে নিজের হাতে সকল ব্রেকফাস্ট বানাবে রিচার্ডের জন্য। তবে কিচেনে ঢুকেই এলিজাবেথ একটু থমকে গেল। সেখানে ইতোমধ্যেই উপস্থিত ইবরাত। কাল রাতে ওদেরও একটা মাঝারি সাইজের সংঘর্ষ হয়েছে । ন্যাসো একটাও কথা বলেনি সারারাত ইবরাতের সঙ্গে। তাই আজ ইবরাতও বোনের পথেই হেঁটেছে। রান্নাঘরের আবহাওয়া তাই একটু গরম, একটু ভারী। তবু তার মাঝে একটুকরো নরমতা। দুই বোন আজ রান্নায় ব্যস্ত হাতে প্রিয়জনদের পছন্দের পদ রান্না করছে। মুখে চাপা আড্ডা। ইবরাত রান্না ঘরের কোনো কাজেই দক্ষ না। এলিজাবেথের দেখানো পথ ধরে এগোচ্ছে কোনোরকমে।
“তোকে বললাম একটু রান্নাটা শিখিয়ে আমার সংসার আলোকিত করে দে, তুই শালি মরিচ কাটতে দিয়ে আমার হাতে আগুন ধরিয়ে দিলি।”
‘এলিজাবেথ চাপা হেসে ইবরাতের কাছ থেকে মরিচগুলো নিয়ে নিজে কাটতে লাগল। ওদিকে ইবরাতের অবস্থা কাহিল। অল্প কিছু পেঁয়াজ আর মরিচ কাটতেই চোখ থেকে পানি পড়ছে। এলিজাবেথ মিটিমিটি হেসে বলল,
“বিশ্বাস কর বোন তোর রান্নাটা খুব ভালো হবে।”
‘ইবরাত একের পর এক টিস্যু দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ডোন্ট কেয়ার ভঙ্গিতে বলল,
“বিশ্বাস তো সেদিনই ভেঙে গিয়েছিল, যেদিন দেখলাম কয়েলের ওপর মশা বসে আছে।”
‘ফিক করে হেসে উঠল এলিজাবেথ। তার হাসির শব্দে বিরক্ত হয়ে নাক-মুখ কুঁচকাল ইবরাত। কিচেন নাইফ হাতে তুলে নিয়ে ঝাঁঝ দেখিয়ে রাগ ঢেলে দিল গাজরের ওপর। বেচারা গাজর সেই রাগ সহ্য করতে না পেরে ছিটকে পড়ে গেল দূরে। আবারও হেসে ফেলল এলিজাবেথ, আগের চেয়েও জোরে। ইবরাত এবার হতাশ, গভীরভাবে হতাশ। মাথা চাপড়াতে চাপড়াতে বলল,
“ভাগ্যের চাকা নাকি ঘোরে, আমারটা মনে হয় লিক হয়ে গেছে। গাজরও আজকাল ছলনা করে আমার সঙ্গে।”
‘হাসতে হাসতে একহাতে মুখ চেপে ধরল এলিজাবেথ, “বোন, তুই থাম প্লিজ! পেট ব্যথা উঠে যাচ্ছে আমার।”
‘ইবরাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “অতিশোকে বাপ্পারাজের মতো পাথর হতে চেয়েছিলাম, অথচ দিলদারের মতো কমেডিয়ান হয়ে গেছি! এখন দুঃখের সময়েও সবাই মজা নেয় আমাকে নিয়ে।”
‘এলিজাবেথ ঠোঁট কামড়ে হেসে উঠা আটকাল। গম্ভীর চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“তা এত কষ্ট কীসের শুনি?”
‘এক নিমেষে মলিন হয়ে গেল ইবরাতের মুখ। দৃষ্টি নিচু করে চুপসানো গলায় বলতে থাকে,
“আমি বাচ্চা নিতে চাই এলিজাবেথ। আমার খুব শখ একটা বাচ্চার। কিন্তু উনি কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। বলে আমি এখনো ছোট। পরে, আরও কয়েক বছর পর। এসব নিয়েই তো কাল রাতভর ঝগড়া।”
‘হঠাৎ বিষণ্ণ এক সুর বেজে উঠল এলিজাবেথের মনের আঙিনায়। নিজের সন্তানের কথা মনে হতেই চোখের কোণে জল জমল নিঃশব্দে। ইবরাত তা টের পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে জিভ কেটে বলল,
“আহ! না না, এই সেন্টিমেন্টাল মোডে যাস না প্লিজ!”
‘তড়িঘড়ি প্রসঙ্গ পাল্টাতে গিয়ে এলিজাবেথের ফ্যাকাসে মুখের দিকে তাকিয়ে শিশুসুলভ ভঙ্গিতে বলল,
“একদম সেন্টিখুরের মতো মুখ বানিয়ে আমাকে ইমোশনাল করে দিস না প্লিজ, আমি এখনও স্বামীর কোলে কাটুন দেখতে দেখতে ভাত খাই!”
‘মন খারাপের মাঝেও এবার হেসে ফেলল এলিজাবেথ। ইবরাতের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে ভ্রু নাচাতে নাচাতে বলল,
“কোলে বসে শুধু কি ভাতই খাস, নাকি আরও কিছু…হুম হুম?”
‘আড়ষ্ট হয়ে গেল ইবরাত। মুখে লালচে আভা ফুটে উঠল। দুই হাতে মুখ চেপে ধরল সে,
“যা এলিজাবেথ! এসব কি বলিস! তোর মুখে এসব কথা একদমই মানায় না!”
‘হেসে হেসে উত্তর দিল এলিজাবেথ,
“সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে, এই কথাটা আমার জীবনের একমাত্র একাডেমিক সত্যি!”
‘ইবরাত কাছে এসে হালকা করে ধাক্কা দিল এলিজাবেথের কাঁধে, “হুম হুম! তার মানে তুইও করেছিস, তাই না?”
‘অবাক হয়ে তাকাল এলিজাবেথ, “করেছি মানে? কী করেছি?”
“ওটা!”
“কোনটা?”
“যেটা করে স্বামী-স্ত্রী?”
“কী করে স্বামী-স্ত্রী?”
“আরে, ওটা—রাতে যে করে।”
“আরে! কি করে রাতে?”
“যেটা করলে শরীর ফ্রেশ লাগে, মাথা ঠান্ডা থাকে।”
“আরে ভাই, কোনটা করলে?”
“যেটা আমি আর তুই দু’জনেই করেছি। আজ রাতেও করব।”
“আরে ভাই, কী করলাম সেটা তো বল!”
“যেটা না হলে রাত পার করা যায় না।”
“কি না হলে রাতে পার করা যায় না, বলবি তুই?”
“ঘুম।”
“এ্যাৎ?”
“হুমমমমম…”ভেবাচেকা খাওয়া এলিজাবেথের মুখের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিল ইবরাত। নিজের চিন্তার ওপর নিজেই ধিক্কার জানাল এলিজাবেথ। চোখ গরম করে তাকিয়ে আবার কাজে মনোযোগ দিল। চুপচাপ, লাজুক, অথচ ভেতরে ভেতরে ফোঁসা এক অগ্নিকণা।
‘রিচার্ডের ঘুম ভেঙেছে কিছুক্ষণ আগে। ঘুম থেকে উঠে এলিজাবেথকে রুমে না পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে নিচে এল। রান্নাঘর থেকে এলিজাবেথের গলার আওয়াজ ভেসে আসছে। চুপচাপ লিভিং এরিয়ায় গিয়ে সোফায় বসে পড়ল রিচার্ড। ম্যাগাজিন পড়ার ফাঁকে ফাঁকে এলিজাবেথকে আড়চোখে দেখছিল। কিচেনের ভিতর থেকে দৃশ্য স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। হঠাৎ ন্যাসো এসে রিচার্ডের পাশে বসে পড়ল। এক জনের হাতে পত্রিকা আরেক জনের হাতে ম্যাগাজিন থাকলেও, দু’জনের খাড়া কান ছিল একদম কিচেনের দিকে। দুই বোনের মধ্যে সম্ভবত কিছু একটা নিয়ে ঝগড়া বেঁধেছে। চাপা কণ্ঠ শোনা যাচ্ছিল। ন্যাসো কিচেনের দিকে কান বাড়িয়ে রেখেছে। রিচার্ড নিজেও! গভীর মনোযোগ দেওয়ার জন্য হাত থেকে ম্যাগাজিন রেখে দিল। ন্যাসোও তা দেখে পত্রিকা রেখে দিয়ে দুই হাঁটুর উপর কনুই রেখে মনোযোগ দিয়ে কিচেনের দিকে নজর রাখতে থাকে। রিচার্ড কপাল কুঁচকাল ন্যাসোর দিকে তাকিয়ে, পরক্ষণে সে নিজেও ন্যাসোর মতো বসে পড়ল। এবার দু’জনেই গভীর মনোযোগে তাদের বউদের মধ্যে কে জিতবে তা দেখছিল৷ ঠিক যেমন টিভির সামনে বসে খেলা দেখে।
‘হঠাৎ একপর্যায়ে এলিজাবেথ ধাক্কা মারল ইবরাতের কাঁধে। ইবরাত চোয়াল ফাঁক করে ক্ষুব্ধ চোখে তাকাল। এবার নিশ্চয়ই ইবরাতের পালা! হাত তুলবে এলিজাবেথের উপর। রিচার্ড আর এক মুহূর্তও বসে থাকতে পারল না। চিবুক শক্ত করে তেড়ে গেল কিচেনের দিকে। রিচার্ডের এভাবে চলে যাওয়া দেখে হা হয়ে যায় ন্যাসো। তত্ক্ষণাৎ সে ছুটল ঝড়ের বেগে। এলিজাবেথ হাসতে হাসতে কিল বসিয়েছিল ইবরাতের কাঁধে। ইবরাত নিজেও পালটা আঘাত করতে যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময়ই রিচার্ড প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে গেল এলিজাবেথের সামনে। রক্ত গরম চোখে তাকাল ইবরাতের দিকে। ইবরাত ভ্রুকুটি করল। তবে রিচার্ডের অপ্রত্যাশিত আগমন দেখে ভরকে গেল সাথে সাথে। কিছু বলার চেষ্টা করতে গেল, কিন্তু সে কথা ফসকে যেতে না যেতে ন্যাসো এসে ছুটে এসে ইবরাতকে কাঁধ তুলে নিল। সেই গতিতে এসেছিল, আবার সেই গতিতেই চলে গেল। ন্যাসো জানে রিচার্ডের মেজাজের খবর। এলিজাবেথ কিছুটা হচকায়ে গিয়ে রিচার্ডের দিকে তাকাল।
“এটা কি হল?”
‘রিচার্ড এক পলক এলিজাবেথের দিকে তাকিয়ে কোনো শব্দ না করে ফোঁস নিশ্বাস ছেড়ে বেরিয়ে গেল। তাজ্জব বনে গেল এলিজাবেথ। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সেখানেই।
‘সেই যে সকালবেলা বেরিয়েছিল রিচার্ড। তারপর আর সারাদিনে একবারও ফেরেনি ম্যানশনে। ফিরল একেবারে রাত এগারোটায়। সরাসরি গেল নিজের বেডরুমে। ভিতরে অন্ধকার। কপাল কুঁচকাল রিচার্ড। এলিজাবেথ রুম কখনোই অন্ধকার করে রাখে না। লাইট জ্বালাতেই চোখে পড়ল টেরেসের সাদা কাঁচঘেরা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এক রমণী। লাল শাড়ি পরা। মাথায় লম্বা ঘোমটা টানা, মুখ ঢাকা।
রিচার্ড এক ঝলক তাকাল সেদিকে। হাত থেকে গ্লাভস খুলতে খুলতে গম্ভীর গলায় বলল,
“ইবরাত, আমার বউকে রুমে পাঠিয়ে বাইরে থেকে লক করে দিও। শব্দ হতে পারে।”
”মণীটা চমকে উঠল। মুখটা আরও গুমট হয়ে গেল। কিছুক্ষণ নীরব থেকে মিনমিনে গলায় বলল,
“আমিই তো আপনার বউ…”
‘রিচার্ড কাঁধ ঝাঁকাল, ঠান্ডা গলায় বলল,”উমহু। আমার বউ এমন না।”
“তাহলে কেমন?”
“তার বর্ণনা আমার মুখে দেওয়া সম্ভব নয়। বেরিয়ে যাও, ইবরাত। আমার বেডরুমে অন্য নারীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ।”
‘ইবরাত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল। লজ্জা, ভয়, অপমান মিশে তার মুখ কুঁচকে উঠল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে এবার নিজের স্বরে বলল,”শুনি না… একটুখানি… তার বর্ণনা?”
‘রিচার্ড হয়তো একরাশ হাসল। গ্লাভস খুলে কেবিনেটের উপর রাখল। কোমর থেকে বন্দুকটা বের করে কেবিনেটের ভিতর রাখতে রাখতে বলল,
“আমার রেড, উচ্চতায় বেশ… বাকিদের থেকে আলাদা। তার গায়ের গঠনও ভিন্ন, আলাদা এক ছাঁদে গড়া।আমার রেড কখনো ডান পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ায় না। তার শাড়ির পাড় সবসময় মেঝের সঙ্গে লাগে। তার শরীর থেকে একটা মিহি ঘ্রাণ বের হয়… যে ঘ্রাণ আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে, টের পাওয়া যায় নিঃশব্দে। সে দূরে থাকলেও আমি অনুভব করতে পারি তার নিঃশ্বাসের শব্দ।”
‘ইবরাতের ভিতরে একরাশ ভালোলাগা জেগে উঠল। ধীরে মাথা থেকে ঘোমটা সরিয়ে পিছন ফিরে দাঁড়াল। রিচার্ডের কথাগুলো তার ভয়ের দেয়াল কিছুটা হলেও ভেঙে দিল।হেসে বলল,
“আপনি এতোটাও খারাপ না ভাইয়া।”
‘রিচার্ড কিছু বলল না। শুধু ঠোঁটে একচিলতে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠল। ইবরাত বেরিয়ে যাচ্ছিল রুম থেকে, হঠাৎ পেছন থেকে রিচার্ড বলে উঠল,
“আর হ্যাঁ, আমার ওয়াইফকে এক্ষুনি রুমে চাই।
এন্ড মাস্ট দরজাটা বাইরে থেকে লক করবে। আমি চাই না শব্দগুলো বাইরে যাক।”
‘ইবরাত থেমে দাঁড়াল। ঘুরে তাকাল রিচার্ডের দিকে। তার চোখে প্রশ্নের ছায়া, বোঝার চেষ্টা। সরল মনে ধীরে বলল,
“কিসের শব্দ ভাইয়া?”
‘রিচার্ড ঠোঁটে এক নিঃশব্দ হাসি টেনে, বুড়ো আঙুল দিয়ে কপালের কিনার ছুঁয়ে বলল,
“রুমে যাও। ন্যাসোকে পাঠাচ্ছি, ও বুঝিয়ে দেবে।”
‘আড়ষ্ট ইবরাত আর এক মূহুর্তও সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। এক দৌড়ে বেরিয়ে গেল সে। রিচার্ড শব্দহীন হাসল। শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে গলা উঁচিয়ে ডাকল,
“রেড।”
‘দরজার আড়ালে থাকা এলিজাবেথ চমকে উঠল। এলিজাবেথ আজ প্ল্যান করেই এই কাজটা করেছিল। শত চেষ্টা করেও যখন রিচার্ডের সাথে কথা বলতে পারছিল না, তখন থেকেই ঝগড়ার পায়তারা করতে থাকে সে৷ যদিও আগে থেকেই জানত রিচার্ড সবটা ধরে ফেলবে, তবে রিচার্ড যে এতো তাড়াতাড়ি সবটা ধরে ফেলবে সেটা ভাবেনি এলিজাবেথ।
“রেড, ভিতরে আসো।”
‘রিচার্ডের দ্বিতীয় ডাকে চমকে উঠল এলিজাবেথ। ভাবনার সুতো ছিঁড়ে শুষ্ক ঢোক গিলে মাথা নিচু করে রুমে ঢুকল সে। ঠিক তখনই পিছন থেকে দরজাটা ঠাস করে বন্ধ করে দিল রিচার্ড। হঠাৎই শক্ত করে চেপে ধরল এলিজাবেথের হাত। কোনোকিছু বোঝার আগেই তাকে টেনে বিছানায় ফেলে দিল। হতভম্ব এলিজাবেথ কিছু বলার আগেই রিচার্ড ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উপর। রিচার্ডের অর্ধেক শরীর তার শরীরের উপর ঝুঁকে এল। রিচার্ড এক হাতে চেপে ধরল এলিজাবেথেড কোমর, অপর হাতে মুঠো করল তার কব্জি। রিচার্ডের চোখে আগুন! কণ্ঠে চাপা রাগ! স্পর্শে হিংস্রতা।
“স্বামীর ঘরে পরনারীকে পাঠাচ্ছ? যদি আমি ছুঁয়ে দিতাম ওকে?”
‘কাঁপা কণ্ঠে এলিজাবেথ বলল,”আপনি যা ভাবছেন, আসলেই তেমন কিছু না… বিশ্বাস করুন।”
‘রিচার্ড থামেনি। হাতের গতি হয়ে উঠল আরও এলোমেলো, আরও বেপরোয়া। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,”আমি যদি ওখানে স্পর্শ করতাম? এখানে করতাম? এভাবেই করতাম…ব্যথা দিতাম… তখন?”
‘ব্যথায় মুখ কুঁচকে উঠল এলিজাবেথের। তবু গলায় কোনো ভয় ছিল না। প্রবল আত্মবিশ্বাসী স্বর,
“আপনি এমনটা কখনোই করতেন না। আমি জানি।”
‘রিচার্ড এক মুহূর্ত থেমে গেল। তার দৃষ্টিতে বিস্ময়। মেয়েটার গলায় এতখানি বিশ্বাস? সরে যেতে চাইলে এলিজাবেথ টেনে ধরল শার্ট। চোখ ভেজা, কণ্ঠ কাঁপা,
“ভুল করলে বলবেন, শুধরে নেবো…
তবুও কথা না বলে দূরে সরে যাবেন না প্লিজ।
আমি খুব কষ্ট পাই…।”
‘ক্রোধ তড়তড়িয়ে জ্বলে উঠল মাথায়। রিচার্ড আর এক মুহূর্তও নিজেকে ধরে রাখতে পারল না।টানতে টানতে এলিজাবেথকে নিয়ে গেল বাথরুমে। বাথটাব ভর্তি ঠান্ডা পানির ভেতর ওর মাথা চেপে ধরল রিচার্ড। এলিজাবেথ ছটফট করে, নিশ্বাস নিতে পারে না। হাত-পা ছুড়তে থাকে মরিয়া হয়ে। রিচার্ড গর্জে উঠল হিংস্র কণ্ঠে,
“কষ্ট হয়? খুব কষ্ট হয়?আমারও হয়…
যখন তোর মুখে কুত্তার বাচ্চাটার নাম শুনি!
মাথায় খুন চেপে বসে। শুধু ‘তুই’ বলে, আর আমি তোকে ছাড়া নিঃশ্ব বলেই এখনও মাটির নিচে ঠাঁই হয়নি তোর!”
‘হাত-পা নীল হয়ে আসছে এলিজাবেথের। সারা শরীর ভিজে ঠান্ডা হয়ে উঠছে। রিচার্ড তখনও ফনা তুলে আছে রাগে। শিথিল হতে থাকে এলিজাবেথের শরীর। এক ঝটকায় এলিজাবেথ’কে টেনে তোলে বুকের সঙ্গে চেপে ধরল রিচার্ড। এলিজাবেথ হাপাতে থাকে, শ্বাস নিতে গিয়ে বড় বড় শব্দ করে। রিচার্ডের বুক খামচে ধরে। শরীর কাঁপছে অবিরাম।প্রতিরোধের শক্তি নেই একফোঁটাও।রিচার্ড ওকে নিয়ে বসে পড়ল ঝর্ণার নিচে। পানিতে ভিজে যাচ্ছে দু’জনের শরীর। এলিজাবেথ ঘাপটি মেরে লেগে থাকে রিচার্ডের বুকে। মেয়েটা এখনও কাঁপছে।
“আজ থেকে পরপুরুষ তো দূরে থাক,
আমার বাপের নামও যেন না শুনি তোর মুখে!
পুঁতে দিব একদম!… নিঃশ্বাস বন্ধ করে দিব!”
‘এলিজাবেথ হেঁচকি তুলে কাঁদছে। ভয়ে, আতঙ্কে গলা দিয়ে শব্দই বেরোয় না। শুধু চোখ ভিজিয়ে মাথা নাড়ে চুপচাপ।রিচার্ডের হাতের হিংস্রতা ধীরে ধীরে শান্ত হয়। কান্নার আওয়াজটা তার রাগে জল ঢালে। পীড়া দেয় মেয়েটার কান্না। রিচার্ড হঠাৎ করে এলিজাবেথকে সোজা বসিয়ে তুলে দুই হাতে চেপে ধরল তার গাল। পাগলের মতো চুমু খেতে লাগল পুরো মুখজুড়ে।
“ডোন্ট ক্রাই, ওকে?ডোন্ট! তুমি জানো তো রাগ উঠলে আমি নিজের হুঁশে থাকি না… আমি পাগল হয়ে যাই…”
“আজ যদি আপনার হুঁশ না ফিরত, তাহলে আমি হয়তো এতোক্ষণ তিন হাত মাটির নিচেই থাকতাম… তাই না?”
‘রিচার্ড চমকে উঠল। বুকের ভিতর কেমন যেন লাগল।
চোখ বড় হয়ে এলিজাবেথের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর মুহূর্তেই ওর মাথাটা শক্ত করে চেপে ধরল নিজের বুকে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল,
“তুই কোত্থাও যাবি না…
আমাকে ছেড়ে কখনোই না…
পারবি না, আর আমি তোকে কখনোই যেতে দেব না… কোনোদিন না।”
‘দু’জন একসাথে রাত করে শাওয়ার নিয়ে বেরোল। তিনদিন পর আজ আবার নিজ হাতে শাড়ি পরিয়ে দিল রিচার্ড অসম্ভব যত্ন নিয়ে। তারপর ওকে কোলে তুলে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো। সোজা শুইয়ে দিল বিছানায়। ওষুধ খাইয়ে শরীর ছুঁয়ে দেখল অস্বাভাবিক গরম এলিজাবেথের শরীর। এলিজাবেথের পাশ ছাড়ল না রিচার্ড। বালিশের গা ঘেঁষে চুপচাপ বসে রইল। এলিজাবেথ তখনও নাক টানছে। চোখাচোখি হতেই রিচার্ড ভ্রু উঁচিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
“নো মোর ক্রাই। ঘুমাও।”
‘অভিমানী বিড়ালের মতো মুখ ফিরিয়ে শুয়ে পড়ল এলিজাবেথ। ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি খেলে গেল রিচার্ডের। এখনও মাঝে মাঝে ঝাঁকুনি দিচ্ছে এলিজাবেথের গা। মেজাজ হারাল রিচার্ড। হঠাৎ হেঁচকা টানে এলিজাবেথ’কে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিল রিচার্ড। শাসিয়ে বলল,
“ডোন্ট ক্রাই রেড। আর যদি কাঁদো, তাহলে এবার কিন্তু কাঁদার মতো জেনুইন রিজন দিবো আমি। ইউ নো আই’ম এ বেড বয়। দেখো, দরজাটাও লকড।”
‘কে যেন বুকে কষ্টের চোঁয়া ছুঁড়ে দিল। হঠাৎ হু হু করে কেঁদে উঠল এলিজাবেথ। রিচার্ড একদম হতচকিত। তড়িঘড়ি করে ওর কান্না থামাতে গেল।
“ওকে ওকে ওকে! কিছুই করব না, থামো প্লিজ! বলো, কী করতে হবে?”
‘চোখের জল, নাকের জল এক করে এলিজাবেথ বলল,”মেয়েরা কখনো পছন্দের মানুষের ইগনোর সহ্য করতে পারে না। এটা আপনারা ছেলেরা বুঝেন না কেন?”
“আচ্ছা! আচ্ছা! আর ইগনোর করব না। স্যরি ওয়াইফি। কী করলে ক্ষমা পাবে আমার এই অপরাধী মন?”
“আগের মতো আমার সব শর্ত মেনে চলতে হবে।”
‘রিচার্ড দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল,”ওকে। এখন কী?”
ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৫৫ (২)
‘এলিজাবেথ বিছানা থেকে আঙুল তুলল কাউচের দিকে,”তাহলে ওখানে গিয়ে শুয়ে পড়ো।”
‘থামল রিচার্ড। চোখ বন্ধ করে ঠোঁট চেপে ধরল। পরপর কয়েক দফা ফোঁস নিশ্বাস ছেড়ে এলিজাবেথের মাথার পাশের বালিশটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। যেতে যেতে বলল,
“ওকে, যাচ্ছি।”
‘রিচার্ড কাউচে গিয়ে শুয়ে পড়ল। এদিকে এলিজাবেথ মুখটা কম্ফোর্টারের নিচে লুকিয়ে ফিসফিসিয়ে হেসে উঠল। তার সেই মিটি মিটি হাসি বোধহয় পৌঁছে গেল রিচার্ডের কানেও। অন্ধকারের ভেতর সেও হেসে ফেলল না চাইতেও।