ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৫৮

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৫৮
মিথুবুড়ি

‘কাল রাত খুব ভোরে ম্যানশনে ফিরেছে কপোত-কপোতী। রিচার্ড সকাল সকালই বেরিয়ে গিয়েছে, ঘুমাইনি একটুও। ইদানীং কোনো এক কারণে রিচার্ড খুবই চিন্তিত। বিগত কয়েক রাত তার চোখে ঘুম নেই। যখন, তখন বেরিয়ে যাচ্ছে, ফিরছে অনেক রাত ধরে৷ সারা শরীর থাকত রক্তে ভিজে। এলিজাবেথ জানতে চাইলেও কোনো উত্তর মেলেনি। বরাবরই রিচার্ড এড়িয়ে গিয়েছে তাকে। ধ্বংসযজ্ঞ আর পাপাচারে নিবিষ্ট এক অন্তহীন মরিচীকার জীবনে না জানি নতুন করে কোন প্রয়লঙ্কারী ঝড় ঘনিয়ে আসছে।

‘এলিজাবেথের ঘুম আজ দেরি করেই ভাঙল। এ’কদিনে এলিজাবেথ বেশ ভালোই শাড়ি পরা শিখে গিয়েছে। একদম শাওয়ার নিয়েই নিচে নামল এলিজাবেথ। তবে লিভিং এরিয়ায় পা রাখতেই ভ্রু জোড়া কুঁচকে ওঠে। লুকাস দগদগে ক্রোধ নিয়ে বসে আছে সোফায়। অভিব্যক্তিতে গোমড়ামুখো ভাব খানিকটা থাকলেও চোখে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, যেন দাউদাউ করে জ্বলছে। কালরাত্রিতে যেন অমাবস্যার মধ্যরাতে আঁধার নেমেছে। এগিয়ে গেল এলিজাবেথ।
“লোকা কি হয়েছে? মুখটা এমন লাগছে কেন?”
‘এলিজাবেথকে দেখামাত্র যেন লুকাসের ভিতর যেন জ্বালা মাখা হুংকার দিয়ে উঠল। ঠৌঁটগহ্বরের ফাঁক গলিয়ে কণ্ঠনালী হতে উদগীরণ হয় জ্বালাময়ী উচ্চারণ,
“কাল রাতে আপনারা কোথায় গিয়েছিলেন?”
‘লুকাসের ঠৌঁটের কোণ নিচে নেমে যায় অভিমানী নিরবতায়। এলিজাবেথ কিছুটা আশ্চর্য হল অতর্কিতে লুকাসের এহেন প্রশ্নে। তখনও বুঝতে পারে না লুকাসের কথার আড়ালে থাকা লুকায়িত অভিমানের কারণ৷ সে হালকা হেসে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আমরা তো একটু বের হয়ে,,,,,বাক্য সম্পূর্ণ করার আগেই লুকাস গর্জনমিশ্রিত রুক্ষ গলায় বলে ওঠে,
“আমি কেন ছিলাম না, সেই আমরা তে। ন্যাসো যেতে পারলে আমি কেন নয়?”
“আমরা তো কাপল গিয়েছিলাম ভাইয়া।”
‘লুকাস, এলিজাবেথ দু’জনের গ্রীবা বাঁকিয়ে পিছন তাকাল। ইবরাত তাদের দিকেই আসছে। লুকাসের নাকের পাটায় বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। ইবরাত এসে দাঁড়াল এলিজাবেথের পাশে। এলিজাবেথ একঝলক তাকিয়ে দেখল বোনের চোখের নিচের লেপ্টে যাওয়া কাজল। ঠৌঁট চেপে হেসে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল সে।
“ওটা তো কাপল ট্রিপ ছিল ভাইয়া।”
‘গরম তেলের মধ্যে যেন পানি ঢেলে দিল ইবরাত। ফুস করে ছ্যাত করে ওঠে লুকাস। চাপা গর্জনে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“আজ আমার সুইটি দেশে নেই বলে, সবকিছু থেকে এভাবে বঞ্চিত হবো আমি? না এটা আর পারা যাচ্ছে না। আমি এক্ষুনি সুইটিকে কল দিচ্ছি।”

‘দুই বোন ঠৌঁট চেপে হাসে লুকাসের মেজাজ দেখে। লুকাস পকেট হাতড়ে ফোন বের করে সঙ্গে সঙ্গে সুইটি নামক সে কনটাক্টে চাপল। কয়েকবার রিং হওয়ার পর কল রিসিভ হল। রিসিভ হতেই লুকাস তড়িঘড়ি করে করে ফোন কানে তুলে ইবরাত, এলিজাবেথের দিকে রক্তিম চোখে চেয়ে উত্তেজিত গলায় আওড়াতে থাকে,
“হ্যালো, সুইটি জান। আমি আর অপেক্ষা পারছি না। চারপাশের এই তুচ্ছতাচ্ছিল্য আমি আর মেনে নিতে পারছি না। কিছুতেই পারছি এসব সহ্য করতে। আজ আমার কেউ নেই বলে এরা আমাকে পাত্তা ই দিচ্ছে না। আর কোনো কথা না, আমি আজই টিকিট কেটে দিচ্ছি, কালকের ফ্লাইটে তুমি দেশে আসবে।”
‘এক শ্বাসে কথাগুলো বলে নিঃশ্বাস ফেলল লুকাস। ফোন কেটে নির্ভার মুখে তাকাল দুই বোনের দিকে। ওরা মুখে হাত চেপে হাসছিল। লুকাস তাকানো মাত্র হাত সরিয়ে গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করে। ইবরাত কাইঁকুই করে জিজ্ঞেস করল,

“কি হল লোকা? চেহারাটা এতো মলিন দেখাচ্ছে কেন? আপনার তো খুশি হওয়ার কথা।”
‘লম্ব করে ভেতরে জমিয়ে রাখা নিঃশ্বাস গুলো ছেড়ে দিল লুকাস। পরপর ঠান্ডা, বির্বণ স্বরে বলল,
“আমার চেহারাটাই ওমন। ছোট বেলায় রাশিয়ান ছিলাম, বড় হওয়ার পর হয়ে গেছি নাইজেরিয়ান। তাই সবসময় মলিন মনে হয়।”
‘ফিক করে হেসে ফেলল ইবরাত লুকাসের কথায়। এলিজাবেথ শাড়ির আঁচল মুখে চেপে হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করে,
“কণ্ঠটাও তেমন শুনাচ্ছে। কি হয়েছে লোকা? মন খারাপ?”
“মন খারাপ মানুষের হয়, আমার না।”
‘মাঝখানে ফোরন কাটল ইবরাত। চমকপ্রদ হয়ে ছুঁড়ে দিল অদ্ভুত প্রশ্নবান, “তাহলে আপনি কি লোকা?”
‘লুকাস কেমন এক অদ্ভুত ভঙ্গি ধরে ক্লান্ত স্বরে বলল,”আমি মানুষ না, আমি হলাম ডিপ্রেশন হোক ভাল্লাগেনা বিন মুড সুয়িং ইবনে মন খারাপ।”

‘ঘর জুড়ে শুধু রিনঝিনে হাসির ঝংকার। হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা দুই বোনের। লুকাস মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে এক কোণে। আজ তার মন খারাপের সাথে কপালটাও খারাপ। বহু কসরতে হাসি থামিয়ে এলিজাবেথ লুকাসের মনের ভেতরটা কিছুটা আন্দাজ করে পেরে নরম গলায় জানতে চাই,
“সুইটি কি বলেছে, আসবে?
‘লুকাস মাথা নিচু করে রেখেছে। নিভু স্বরে প্রত্যুত্তর করে,”ঝড় হচ্ছে এখন। আসা সম্ভব নয়।”
‘এবার হাসি থামল ইবরাতের। সে আক্ষেপের স্বরে বলে,”আহারে।”
শান্তনা গ্রহনের বিপরীতে প্রতিবাদী গলায় হঠাৎ ঝড়ের তীব্র নিন্দা জানালো লুকাস,
“যে-ই ঝড় আমার সুইটিকে উড়িয়ে আমার কোলে এনে ফেলতে পারে না, সেই ঝড় আমি মানি না।”
‘আবারও হাসিতে ফেটে পরল দুই বোন। ভেংচি কাটে লুকাস। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে হতাশ গলায় সে আওড়ায়,
“কার সাথে মিশব ভাই। সবই জোড়া, জোড়া।”

‘থেমে ফের ঠৌঁট বাঁকিয়ে বলে,
“শুধু আমার সুইটি একবার আসুক দেশে। তারপর পায়ের নিচে গ্রামীণ সীম লাগিয়ে বলল “চল বহুদূর।” তখন শুধু দেখবে, আর জ্বলবে।
‘ওদের হাসি যেন আজ থামবে না বলে ওয়াদা করেছে। আজব তো। মানুষের কষ্টে কি কেউ এভাবে হাসে? কোথায় মানবতা, কোথায় সহানুভূর্তিতা? লুকাস এবার চরম বিরক্ত হয়ে এলিজাবেথকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“এতো না হেসে নিজের স্বামীর দিকে একটু নজর রাখবেন। বসের পিছনে কিন্তু লম্বা সিরিয়াল।”
‘অনুভূত হল সুপ্ত কোমল হৃদয়ের ভেতর একটা লাল টুকটুকে বোম্বাই মরিচ বিস্ফোরিত হয়েছে। যার ঝাঁঝ মূহুর্তেই ছড়িয়ে পরল শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ভয়াবহ স্নায়ু ক্রিয়া শুরু হয়। এলিজাবেথ ক্রোধে থরথর করা কণ্ঠে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

“যারা আমার বরকে চায়, তাদের সামনে দাড়িয়ে ওনাকে চুমু খাবো আমি।”
‘ওদের কথোপকথনের মাঝখানে চায়ের ট্রে হাতে এসে দাঁড়াল সবিতা বেগম। ইবরাত এক পলক মায়ের দিকে তাকাল। মহিলার শরীরটা অনেকটাই ভেঙে গেছে গত ক’দিনে।তবুও চোখের তেজ একটুও নিভেনি। অনুশোচনার লেশমাত্র নেই মুখে। কালও ইবরাত মাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কিছুই শোনেনি সবিতা বেগম। উল্টে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেছিল। তবু ইবরাত সহ্য করেছিল। মায়ের পায়ে লুটিয়ে পড়ে কেঁদেছিল সে৷ সব ভুল স্বীকার করে রিচার্ডের কাছে ক্ষমা চাইতে অনুরোধ করেছিল তাকে। ইবরাত জানে এই বন্দিদশা থেকে মুক্তি মিলবে না যতক্ষণ না সবিতা বেগম নিজে মাথা নত করে। তবে সব অনুরোধ ব্যর্থ। মহিলা কাল শুধু ইবরাতকে চড়ই মারেনি, ইবরাতের আত্মবিশ্বাসটাও ভেঙে দিতে চেয়েছিল। তবু ইবরাত হাল ছাড়েনি যতক্ষণ না সবিতা বেগম ন্যাসোকে নিয়ে কুৎসিত কথা বলা শুরু করে। সেই মুহূর্তে ইবরাত আর সহ্য করতে পারেনি। চুপচাপ সরে আসে মায়ের সামনে থেকে। তখন থেকেই আর সামনে যায়নি। সব কথা মনে পড়তেই মুখ ঘুরিয়ে নেয় ইবরাত।

‘চা হাতে লুকাসের দিকে এগিয়ে গিয়ে কাপ ধরিয়ে দেয় সবিতা বেগম। তারপর এলিজাবেথের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুড়ে দেয় এলিজাবেথের চোখে। অতঃপর চায়ের ট্রে থেকে এক কাপ তুলে এলিজাবেথের দিকে এগিয়ে দেয়। তবে সেই হাতেই ছল। চায়ের কাপ ফেলার ভঙ্গিতে এলিজাবেথের শরীরে ঢেলে দেওয়ার চেষ্টা করতে যাচ্ছিল
কিন্তু তার আগেই সজাগ এলিজাবেথ কৌশলে তার হাত উল্টে দেয়। গরম চা পড়ে সবিতা বেগমের কুঁচকানো ত্বকে। ছ্যাত ছ্যাত শব্দে চিৎকার করে ওঠেন তিনি। কাপটি ছিটকে পড়ে মেঝেতে। বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে ঘর। সবিতা বেগম মাটিতে পড়ে ছটফট করতে থাকেন। ঘটনা এত দ্রুত ঘটে যে সবাই থমকে যায়। এলিজাবেথ ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ায় সবিতা বেগমের সামনে। ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে রুষ্ট কণ্ঠে বলল,

“সাবধান চাচি। আমি আর আপনার সেই রান্নাঘরের কোণে পড়ে থাকা এলিজাবেথ নই। আমি এখন এই রাজ্যের সর্বশক্তিমান রাজার আদরের রাণী। ভুলে যাবেন না এই দুষ্টু রাজা কিন্তু তার রাণীর জন্য সব করতে পারে।”
‘সবিতা বেগম আবারও এলিজাবেথের দিকে তেড়ে যেতে চাইলে, লুকাস বিদ্যুতের মতো এগিয়ে এসে ঢাল হয়ে দাঁড়াল মাঝখানে। তার অস্ত্রের নল স্থির হয়ে স্থাপিত হলো মহিলার কপালের ঠিক মাঝ বরাবর। শিউরে উঠলেন সবিতা বেগম। থেমে গেলেন এক পা আগানোর আগেই।লুকাস এক ঝলক তাকাল ইবরাতের ছলছলে চোখের দিকে। তারপর এক গভীর নিশ্বাস ফেলে মুখ ফেরালেন মহিলার দিকে। গলায় যেন বরফের ধার।
“বসের অনুপস্থিতিতে তার স্ত্রী আমার হেফাজতে। এই দায়িত্ব আমি শুধু পালন করি না, প্রয়োজনে লৌহহস্তে রক্ষা করি। মরার আগ্রহ না থাকলে বিদায় নিন এক্ষুণি।”

“তোমার উপর মা হিসেবে না, মানুষ হিসেবেও আর মায়া হয় না আর।” কান্নায় থরথর করা গলায় বলে ইবরাত কাঁদতে কাঁদতে সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে চলে যায়। মেয়ের মুখের কথাগুলো যেন বিষণ্ন সন্ধ্যায় বিদ্ধ হওয়া কোনো বর্শার ফলার মতো এসে বিঁধে যায় সবিতা বেগমের বুকের গভীরে। তিনি আর কিছু বলেন না। নিঃশব্দে মাথা নিচু করে ক্লান্ত মানুষের মতো পিছু হটে চলে যান। চোখের পাতা তখন ভার হয়ে আসে না বলা এক অভিমানে।
“কি ব্যাপার, প্রিন্সেস এলিজাবেথ ম্যাডাম৷ খুব তো চালাক হয়ে গিয়েছেন, হুঁ?”
এলিজাবেথ জোর করে হাসে লুকাসের কথায়। প্রশ্নের পারদে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ল,
“বাহ এতো ভীমরতি! অবশেষে নামটা বদলালেন বুঝি? সেই ‘ডাস্টবিন কুমারী’ তো আর নেই?”
:লুকাস ভ্রু কুঁচকে ঠোঁট বাঁকায়,”তখন বলতাম কারণ তোমার রুচি ছিল তলানিতে। এখন একটু উন্নতি হয়েছে তাই বলি না। অবশেষে খাঁটি সোনার মূল্য বুঝতে শিখেছ।”

“ওহ তাই নাকি? তা শুনি সেই খাঁটি সোনা কে?”
“কে আবার হবে? অবশ্যই আমার বস!” লুকাস বুক ফুলিয়ে বলে। ওনার মতো হ্যান্ডসাম, ড্যাশিং পুরুষ এই গ্রহে দ্বিতীয় কেউ নেই। দেখেছ তুমি নিজে কখনো?”
“ইচ্ছে হয়নি তো,তাই খুঁজে দেখিনি। আপনি বলছেন যখন সময় বের করে খুঁজব।”
‘লুকাস কপালে হাত ঠেকিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলতে থাকে,
“না না, মাফ চাই! বস যদি শুনে ফেলেন তবে ঈদের আগেই আমায় কুরবানি দিবেন, উইথআউট কুরবানী ঈদ!”
‘নিশ্ছিদ্র হাসির মাঝে এলিজাবেথের চোখের কোণে জমে উঠেছিল এক বিন্দু জল। হঠাৎ করেই আবির্ভাব ঘটে রিচার্ডের,সাথে ন্যাসো। এমনিতেই মেজাজ চটে ছিল রিচার্ডের। এরিমধ্য আসতেই মুহূর্তের দৃশ্যপটে ধরা পড়ে এলিজাবেথের আঁচলে চোখের জল মুছছে আর লুকাসের গর্জনতুল্য অট্টহাসিতে হাসছে। পায়ের রক্ত যেন উথলে উঠে চড়াও হয় রিচার্ডের মস্তকে। সিগারেটের পুড়ে যাওয়া শেষাংশ আছড়ে ফেলে ঝড়ের বেগে গিয়ে লুকাসের গলা চেপে ধরে। এমন এক ভয়ঙ্কর দৃঢ়তায় যে পেশীবহুল লুকাস পর্যন্ত দমকে দুই কদম পিছিয়ে যায়। বজ্রনিনাদে ফেটে পড়ে রিচার্ড,

“কুত্তার বাচ্চা সাহস কোথা থেকে পেলি ওকে কাঁদানোর! গেঁড়ে দেব বলে দিলাম।”
‘ন্যাসো হতবাক দৃষ্টিতে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে। এলিজাবেথ ছুটে এসে রিচার্ডকে দু’হাতে টেনে সরাতে থাকে।
“আরে আশ্চর্য কি করছেন?এই পাগলামি বন্ধ করুন! ছেড়ে দিন ওনাকে।”
‘ঝাঁঝালো কণ্ঠে ধমক দিয়ে এলিজাবেথ রিচার্ডকে সরিয়ে আনে। রিচার্ডের নিঃশ্বাস ভারী এখনও৷ যেন ক্ষিপ্ত হৃদয়ের তপ্ত বাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছে চারপাশ। জোরে জোরে ঘন শ্বাস ফেলছে। এলিজাবেথ রিচার্ডের চোখে চোখ রেখে কঠোর স্বরে বলে,

“আপনার ক্রোধ আপনার শত্রু, মি. কায়নাত। আপনি এই আগুনে বারবার জ্বালিয়ে ফেলেন আপনজনদের। যা ভাবছেন বাস্তব তার ধারে কাছেও নেই। শান্ত হোন আপনি।”
‘রিচার্ডের দৃষ্টিতে উগ্রতা। রক্তিম চোখে তাকায় এলিজাবেথের দিকে৷ তবে এলিজাবেথের চোখের ধৈর্যবৃক্ষ তাকে ঘায়েল করে। এলিজাবেথ গম্ভীর স্বরে নির্দেশ দেয়,
“রুমে যান। আমি আপনার জন্য কফি আনছি।”
‘রিচার্ড কিছু বলতে গিয়েও গিলে নেয় কথাগুলো। দৃষ্টিহীন চোখে হনহনিয়ে উঠে যায় সিঁড়ি বেয়ে। এলিজাবেথ এবার ধীরে লুকাসের দিকে এগিয়ে যায়। লুকাসের চোখে অনাহূত অপমানের ছায়া। স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে রিচার্ডের দিকটায়। চিকচিক করছে জল চোখের কোণে। এলিজাবেথ কাঁপা কণ্ঠে বলে,
“লোকা প্লিজ, ওনার ব্যবহারে আহত হবেন না। আমি ওনার হয়ে ক্ষমা চাচ্ছি।”
‘লুকাস কোনো জবাব না দিয়ে নিঃশব্দে পেছন ফিরেই চলে যায়। যেন পালাতে চাইছে এই দুঃসহ মুহূর্ত থেকে। ন্যাসো নিঃশব্দে তার পিছু নেয়।

‘এলিজাবেথ রুমে ঢুকতেই কানে আসে শাওয়ারের নিরবচ্ছিন্ন ধারার শব্দ। রিচার্ড ওয়াশরুমে। সে নিঃশব্দে একবার বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কফির মগ নামিয়ে রাখে টেবিলে। অতঃপর নিঃশব্দে গুছিয়ে রাখতে শুরু করে রিচার্ডের এলোমেলো জামাকাপড় গুলো। লোকটা অসম্ভব অগোছালো। কেবিনেট খুলতেই একপ্রকার বিস্ফোরিত হয় এলিজাবেথের ধৈর্য। অন্তঃসারশূন্য বিশৃঙ্খলার এমন নিদর্শন কেবল রিচার্ডই রেখে যেতে পারে।
অপটু বিরক্তিতে শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে পরিষ্কার কাপড় এক সাইডে রাখে, ধোয়ার উপযুক্ত আলাদা করে রাখে। হঠাৎই পিছনে দরজার শব্দ। রিচার্ড বেরোয়। মাথায় তোয়ালে, চুলগুলো ভেজা। মুখে উদ্ভট গানের অদ্ভুত ছন্দ,
“I party like a rockstar
Look like a movie star
Play like an all-star
*— like a ——-”

‘এলিজাবেথের শরীর কেঁপে ওঠে বিস্ময়ে। দ্রুত আঁচলটা কাঁধ থেকে নামিয়ে নেয় যেন মুহূর্তেই শরীর ছারখার করে দিচ্ছে আগুনের ফুলকি। কান দিয়ে গরম লাবা বের হচ্ছে।
রিচার্ড একবার আড়চোখে দেখে এলিজাবেথের কাচুমাচু মুখাবয়ব৷ তারপর বাঁকা হেসে ট্যারেসের দিকে পা বাড়াল। আজ সে আগেভাগেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। প্রতিদিনই তার ঘরের শত্রু একখানা খাবারের টোপ ফেলে আর সে নিরীহ শিকারির মতো গিলতে গেলেই বিস্ফোরিত হতো তার বউ। মুখের সামনে থেকে কেড়ে নিতো খাবার। তাই আজ এই সাবধানতা, এই বর্ম।
“আপনি এতো এলোমেলো কেন?”
‘রুম থেকে ভেসে আসে এলিজাবেথ ঝাঁঝালো, বিরক্তিমাখা কণ্ঠস্বর। রিচার্ড ক্রুর দৃষ্টিতে কিছু পর্যবেক্ষণ স্বতস্ফুর্ত কদমে করে রুমের দিকে পা বাড়াল আবারও। এলিজাবেথ রিচার্ডের জামাপ্যান্ট গুলো ভাজ করে রাখছে। নাকের পাটা টানটু,একরাশ বিরক্তিতে ভরা। রিচার্ড ভাজ করা একটা শার্ট নিয়ে গায়ে পরিধান অবস্থায় প্রত্যুত্তর করল জলদগম্ভীর গলায়,

“হয়তো তুমি গুছিয়ে দিবে বলেই।”
‘এলিজাবেথ চোখ গরম করে তাকাতেই চমকপ্রদ হল রিচার্ড। কফির মগ হাতে তুলে নিল।
“নাগিনের মতো এতো রূপ পাল্টাও কিভাবে? এখন চোখ গরম করে তাকাচ্ছ, আবার কাছে গেলেই কাঁপাকাঁপি শুরু করে দাও।”
‘এলিজাবেথ ভাঁজ কথা কাপড়গুলো কেবিনেটে গুছিয়ে রাখতে রাখতে বলল,
“আপনার আমার জীবনে এসে সাপের মতো ঠাস ঠুস ছোবল বসাতে পারেন আর আমি রূপ পাল্টালেই নাগিন?”
‘রিচার্ড কফিতে তৃতীয় চুমুক দিয়ে বক্র হেসে বলল,”ছোবল না। দুষ্টু মিষ্টি ভালোবাসার ছোবল দেওয়ার জন্য বিয়ে করেছি। এছাড়া আর কাকে বিয়ে করতে তুমি?”

“আমি এমন ছেলেকে বিয়ে করতাম, যার বুকের উপর পা রাখতে পারতাম কোনো ভয় ছাড়ায়।”
“উফফ! ডার্লিং দ্যাট ওয়েল বি দ্য গ্রেট ভিউ এন্ড কম্ফোর্ট পজিশন।”
‘ভ্যাঁবাচেকা খেয়ে গেল এলিজাবেথ। শরীর জুড়ে বৈদুত্যিক তরঙ্গ খেলে গেল। কর্ণকূহরে রিচার্ডের কথা পৌছানো মাত্রই তড়াক ফিরল রিচার্ডের দিকে। রিচার্ড মিটিমিটি হাসছে। হাসিটা বরাবরের মতোই দেখা দিল না দন্তপাটে। তবে চোখ দেখে আন্দাজ করা যাচ্ছে লোকটা হাসছে।
“আপনার মুখে কি ভালো কথা নেই?”
“কে বলেছে নেই? আমার মুখের সাথে আমার চাঁদও যথেষ্ট ভালো। যদি ভালো না হতো, তাহলে তোমার অবস্থা এতোক্ষণে খারাপ থাকত।”

‘এলিজাবেথ সঙ্গে সঙ্গে একটা জামা ছুঁড়ে মারল রিচার্ডের মুখে। যদিও সেটা ক্যাচ করে ফেলে রিচার্ড সাথে সাথে। হঠাৎ নিচ থেকে শিস বাজানো শব্দ আসে। রিচার্ড হেঁটে গেল ট্যারেসে।এলিজাবেথ রাগে গজগজ করে গায়ে কম্বল মোড়া দিয়ে শুয়ে পড়ল। মনে মনে একশো, ছাব্বিশ টা গালি দিতে থাকে রিচার্ড কায়নাত নামক ভদ্র জনিত অসভ্য লোক কে৷ হঠাৎ রিচার্ডের ডাক পরল।
“রেড, কাম।”
‘এলিজাবেথ সাড়া দেয় না। শক্তপোক্ত হয়ে শুয়ে থাকে আপাদমস্তক ঢেকে। রিচার্ড আবারও ডাকল,
“ওয়াইফি,কাম হিয়ার।”
‘নো রেসপন্স। বজ্রপাতের মতো গম্ভীর রিচার্ডের কণ্ঠ,
“আমি আসতে বলেছি৷”
‘এবার চুপ থাকল এলিজাবেথ। বাধ্য হয়ে রুমে এলো রিচার্ড। আগুন বর্জন করল কথায়, চোখে জ্বলছে ক্রোধের অগ্নি। বিষাক্ত ঠান্ডা টোনে বলল,
“এলিজাবেথ তুমি কি উঠবে? এখন আমাকে যদি বেডের কাছে যেতে হয়, তাহলে কিন্তু সারাদিনেও তুমি বেড থেকে উঠতে পারবে না।”

‘হুড়মুড়িয়ে ওঠে বসল এলিজাবেথ। সন্তুষ্টি লাভ করে বাঁকা হাসল রিচার্ড। হুট করে এসে এলিজাবেথকে কোলে তুলে নিল। তাল সামলাতে না পেরে রিচার্ডের কলার খামচে ধরে এলিজাবেথ। রিচার্ড গমগমে পা ফেলে ওকে নিয়ে গেল ট্যারেসে, একদম শেষ কিনারায় রেলিঙের কাছে। হঠাৎ এক বিস্ফোরিত আওয়াজে কুঁকড়ে যায় এলিজাবেথ। হতবিহ্বল হয়ে রিচার্ডের উতপ্ত খরখরে মরুভূমির পানে তাকাতেই দেখতে পেল তার ঠৌঁটের কোণে হাসি। রিচার্ড ইশারা করল নিচের দিকে তাকাতে। এলিজাবেথ নিচে তাকিয়েই থমকে গেল। বিস্ময়ে বড় হয়ে উঠল ওর চোখদুটি। নিচ থেকে ইবরাত আর ন্যাসো একসাথে চিৎকার করে উঠল,

“Congratulations for your new brand car!”
‘এলিজাবেথ যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। বেলুনে মোড়া এক লাল ল্যাম্বরগিনি ভিনেনো। ইবরাত, ন্যাসো উপরে তাকিয়ে উচ্ছ্বাসে ভেসে যাচ্ছে। এলিজাবেথ নিথর বিস্মিত, অভিভূত। যেন এক স্বপ্নের ঘোরে। রিচার্ড ধীরে ওকে নামিয়ে দিল কোলে থেকে। তারপর হঠাৎই এলিজাবেথের চোখের সামনে তুলে ধরল একটা চকচকে চাবি। মুহূর্তেই সমস্ত স্ফুলিঙ্গ জমাট ক্রোধ গলে গেল অশ্রুতে। ছলছলে চোখে এলিজাবেথ তাকাল রিচার্ডের দিকে। রিচার্ড আজ প্রথম মৃদু হাসল ওর কান্নার সামনে। নরম হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে আলতো করে মুছে দিল জল।সেই কুখ্যাত গ্যাংস্টার বস আজ কণ্ঠে আনল স্নেহের কোমলতা

“নো মোর ক্রাই জান । এখন থেকে শুধু হাসবে, উড়বে,পুরো শহর চষে বেড়াবে। আমার এলি জান মুক্ত পাখির মতো ডানা মেলে উড়বে। যত ঝড়, যত বিপত্তি আমি সামলে নেবো। তুই শুধু উড়িস, হাসিস, বাঁচিস।”
‘শিরশিরে এক অনুভূতিতে নিভু চোখে চাইল এলিজাবেথ। রিচার্ড ওকে নিয়ে গেল রুমে। বিছানায় বসিয়ে বেডসাইড কেবিনেট থেকে বের করল এক মোটা ফাইল। হঠাৎই এসে হাঁটু গেড়ে বসল এলিজাবেথের সামনে।একহাতে তুলে নিল ওর হাতটা। প্রথমে একটি ফোন, তারপর একটি ব্ল্যাক কার্ড, অতঃপর পাসপোর্ট তুলে দিল এলিজাবেথের হাতে।
সবশেষে দিল সেই ফাইলটি। এলিজাবেথের চোখে লেগে আছে কৌতূহলের দীপ্তি। রিচার্ড চোখে চোখ রেখে মাথা নাড়ল। বলল খুলে দেখতে। মেয়েটা ফাইল খুলল৷ হাত কাঁপছে উত্তেজনায়। হঠাৎ শিউরে উঠল এলিজাবেথ। চকিতে তাকাল রিচার্ডের দিকে। রিচার্ড হেসে দু’হাতের মুঠোয় ভরে নিল ওর মুখটা।
“আমি কখনোই তোমাকে বন্দী করতে চাইনি, চেয়েছি নিজের করে নিতে। এখন তুমি আমার।স্বাধীন তুমি। জিলো আপকি জিন্দেগী।”

‘এলিজাবেথের আঁখিদ্বয় টইটম্বুর। আবারও তাকাল হাতের ভার্সিটির এডমিশনের ফর্মে। পাশেই বসে আছে এক সীমানাহীন নিরাপত্তা। অকস্মাৎ সব ফেলে দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঝাঁপিয়ে পড়ল রিচার্ডের বুকের ভেতর। হুড়মুড়িয়ে কেঁদে ফেলল। রিচার্ড ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল নিজের বুকে নিঃশব্দে, নিশ্চুপে, নিঃশর্তে। ভেজা নাক অনবরত রিচার্ডের শার্টে মুছে যাচ্ছে। সে কিছু বলল না। শুধু পাশে বসে থাকল এক অটল আশ্রয় রূপে। দীর্ঘক্ষণ পর মাথা তুলে তাকাল এলিজাবেথ। দ্বিধাহীন চোখে তাকিয়ে থাকে এলিজাবেথ রিচার্ডের পানে।
‘রিচার্ডের চওড়া মুখে আজ এক অচেনা প্রশান্তি। ওষ্ঠে লেগে থাকা চঞ্চল হাসি যেন নিভৃত কোনো আভাস। এই মানুষটাকে সবাই দেখে এসেছে গম্ভীর, কঠিন মুখে। লোকটা যেন কঠিন কথা ছাড়া কিছু জানেই না। শুধুমাত্র এলিজাবেথই জানে এই লোকটাই যে কতোটা ঠোঁটকাটা, ঝগড়াটে আর মারাত্মক রকমের দুর্বিনীত! এক সময় সম্পর্কটা ছিল আগুনে ভরা। তীব্র, তিক্ত, দগ্ধ করা। আর এখন? এলিজাবেথ আবার নাক টানল। রিচার্ড নিঃশব্দে ঝুঁকে এল। এক গভীর, নিগূঢ় চুম্বনে স্পর্শ করল ওর কপাল। শুধু কপালেই নয়, যেন এলিজাবেথের সমস্ত সংশয়েই রেখে গেল এক আশ্বাস।

“হুঁশ! এভাবে কাঁদার জন্য এসব করিনি। আজ থেকে কখনো যেন এই চোখে কালো মেঘ না দেখি। কখনো যেন না দেখি রাতে বালিশের নিচে মুখ দিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে।”
‘এলিজাবেথ ফ্যাসফ্যাসে আওয়াজে বলল,”ওভারথিংকার ‘রা চাইলেও কখনো ভালো থাকতে পারে না৷”
‘রিচার্ড শক্ত কাঠকাঠ কণ্ঠে বলে,”I’ll fuck the though out of your brain”
‘কান্নার ফাঁকেই হেসে ফেলল এলিজাবেথ। ঠোঁট কামড়ে হাসিটা চেপে রাখতে চাইল, পারল না। হঠাৎ রিচার্ড একটানে ওকে তুলে নিল কোলে। গলায় এক অচেনা গাম্ভীর্য এনে বলল,
“তোর মরতে পারব ,তোর জন্য মারতেও পারব।
শত্রুর সামনেও হাঁটু গেড়ে বসব যদি তুই চাস, যাতে করে তারা আমাকে সহজেই মেরে ফেলতে পারে। আই ডোন্ট ফাকিং কেয়ার এবাউট মি। আমি মৃত্যুকে ভয় পাব না, যতক্ষণ তুই আছিস আমার প্রসঙ্গে। ইউ আর মাইন, রেড। জাস্ট মাইন।”

‘এলিজাবেথের ঠোঁটে ফুটে উঠল প্রশান্তিময় এক ঝলক। লোকটার মধ্যে কত কী বদলে গেছে!অথচ কিছুদিন আগেও তো বলেছিল,’উমহু, মরতে পারব না, তবে মারতে পারব।’ আর আজ? সেই রিচার্ড এমন কথা বলছে? এলিজাবেথের ঠোঁটের কোণ থেকে গলে পড়ল প্রাপ্তির এক নির্মল হাসি। যেটা মিশে গেল আকাশে, বাতাসে, নিঃশ্বাসে।
‘রিচার্ড মুহূর্তেই ফিরে গেল তার সেই চিরচেনা রূপে। ঠান্ডা, হিসেবি, শক্তপ্রাণ। সে কখনোই চায় না নিজের কোনো দুর্বলতা প্রকাশ পাক।
“কিস মি, রেড।”
‘এলিজাবেথ চমকে তাকাল তার দিকে। তবে দ্বিতীয়বার বলার প্রয়োজন পড়ল না। রিচার্ডের সংস্পর্শেই তো শরীর শিরশির করে ওঠে প্রতিবার। আলতো করে ছুঁয়ে দিল রিচার্ডের গাল। রিচার্ডের মুখে অসন্তুষ্টির ছায়া।
“ছ্যাৎ রেড! তুমি জানো আমি কত টাকার মালিক?
আর তুমি কিনা আমাকে এমন ফকিরের মতো চুমু দিচ্ছো?”

‘ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হাসল এলিজাবেথ,”আসলে তো জানি না আপনি কত টাকার মালিক। একটু বলুন না, প্লিজ।”
‘রিচার্ড হেসে ফেলল,”আই হ্যাভ ইউরোকার্ড গোল্ড।”
‘চোখ বড় হয়ে গেল এলিজাবেথের। তবে কিছু বলার আগেই রিচার্ড আঁচড়ে ফেলল ওকে বিছানায়। নিজেও ঝুঁকে এল ওর উপরে। আজ আর গ্যাংস্টার বস কোনো ভূমিকা রাখল না। কোনো কথা নয়, কোনো প্রশ্ন নয় শুধু অধরে অধর মিলিয়ে গেল নিরুপম এক সংবেদনে। এলিজাবেথ বাঁধা দিল না। শুধু চোখ বুঁজে এক দীর্ঘ সাই ছেড়ে দিল। যেন আত্মসমর্পণ যেন, অব্যক্ত প্রতীক্ষার অবসান।
‘নির্দিষ্ট সময়ের পর মুখ তুলল রিচার্ড। একগুঁয়ে, তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল এলিজাবেথের চোখে। এলিজাবেথের বুকের ভেতর যেন এক অজানা ঝড় হঠাৎ করে তাণ্ডব শুরু করল। রিচার্ডের সেই ঘোর লাগা নীল চোখে বেশি ক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না সে। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে জড়িয়ে আসা নিঃশ্বাসে কাঁপা কণ্ঠে বলল,
“এভাবে তাকাবেন না, প্লিজ। ঐ নীল চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আমার ভেতর ঝড় তুলে দেয়।”
‘রিচার্ড ধীরে ধীরে ঝুঁকে এল। ঠোঁট ছুঁয়ে গেল এলিজাবেথের কানের লতিকায়। এক চুম্বনের ফাঁকে ফিসফিস করে বলল,
“আর আমার হাতের বিচরণে তোমার প্রতিটা রন্ধ্র জ্বলে উঠবে আগুনে।”

‘গুলির বিকট শব্দে ঘুম ভেঙে উঠল এলিজাবেথ। দরদর করে ঘামছে সারা শরীর। ছুটে গেল ট্যারেসে। চোখের সামনে দেখতে পেল লনের ঘাসে গড়িয়ে পড়েছে রক্তের বন্যা। রিচার্ড দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা রক্তাক্ত লাশের মাঝখানে। পায়ের নিচে পিষে যাচ্ছে মানুষ। তার ঠোঁটে লেগে আছে এক পৈশাচিক, ঠান্ডা হাসি। কয়েকজনের হাত-পা কাটা। এখনও জীবিত। তাদের পরিণতিও সময়ের অপেক্ষা মাত্র। এলিজাবেথ আর এক মুহূর্ত দেরি না করে দৌড়ে গেল ইবরাতের রুমের দিকে। দেখতে পেল দরজাটা বাইরে থেকে আটকানো। নিশ্চয়ই ন্যাসো বন্ধ করে গেছে।রুমটা সাউন্ডপ্রুফ,ইবরাত কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। এলিজাবেথের রুমের ট্যারেসের কাঁচ খোলা ছিল বলে, সে শুনতে পেয়েছে সব। মৃত্যুর কণ্ঠরোধে ছটফট করা লোকগুলোকে দেখে এক আশ্চর্য মায়া গ্রাস করল এলিজাবেথকে। এলিজাবেথ জানে রিচার্ড এখন যে রূপ ধারণ করেছে তাকে থামানো সহজ হবে না। এলিজাবেথ ছুটে গেল নিজের রুমে। আলমারি উল্টে খুঁজে বের করল একটা লাল জামদানি শাড়ি। তারপর টান দিয়ে বের করল একটা নতুন ফাইল। রেখে দিল বিছানার ওপর। শাড়ি হাতে নিয়ে ঢুকে গেল ওয়াশরুমে।

‘বিগত কয়েকদিন ধরে রিচার্ড যেন উন্মাদ। পাগলের মতো খুঁজে চলেছে কাউকে। কিন্তু তার খোঁজ নেই। হদিস নেই। ক্ষোভে ফুঁসতে থাকা রিচার্ড রাগ ঝাড়ছে নিরীহদের উপর। জেমসের কয়েকজন গুপ্তচর, যারা রিচার্ড সম্পর্কে তথ্য পাচার করত তাদের মৃতদেহ পড়ে আছে নিঃশব্দে। রক্ত লেগে আছে রিচার্ডের বুটে। জেমস এখনও অদৃশ্য। ছায়ার মতো। রিচার্ডের চোয়াল কাঁপছে রাগে। রিভলভারে আঙুলের চাপ বাড়ছে। ঠিক তখনই নুপুরের ঝংকার।রিচার্ডের চোখ স্থির হয়ে গেল সামনের দিকে। এক মুহূর্তের মধ্যেই বদলে গেল তার মুখ। এগিয়ে আসছে এলিজাবেথ। ধীরে, অভিজাত ভঙ্গিতে। ঘন লাল রেশমি চুল থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে গাল বরাবর। সকালের রোদ ওর ত্বকে যেন সোনা ছড়িয়ে দিয়েছে। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। হাতে ধরা একজোড়া রুপোর নুপুর। নাচিয়ে নাচিয়ে এগিয়ে আসছে। রিচার্ড ঘুরে তাকাল ন্যাসোর দিকে। নির্বাক আদেশে ন্যাসো বুঝে গেল এবার জায়গা ছেড়ে দিতে হবে। সে লোকজন নিয়ে লাশ সরিয়ে ফেলল তৎক্ষনাৎ। এলিজাবেথ এসে দাঁড়াল ঠিক রিচার্ডের সামনে। তার এক পা এসে স্থির হলো রিচার্ডের হাঁটুর উপর। শাড়ির পাড় খানিকটা তুলে বলল,

“স্বামী পরতে পারছি না। একটু পরিয়ে দেন না?”
‘রিচার্ডের চোখে তখন পলক নেই। এক নিঃশ্বাসে তাকিয়ে আছে। ধীরে ধীরে এলিজাবেথের হাত থেকে নুপুর নিয়ে সে পরিয়ে দিল পায়ে। পরেই এলিজাবেথ বসে পড়ল রিচার্ডের উরুর উপর। রিচার্ড এলিজাবেথকে নিজের শরীরে টেনে নিল একদম কাছাকাছি, গায়ের সঙ্গে গা মিশিয়ে। কানের কাছে মুখ এনে জিজ্ঞেস করল,
“আজকে কি চাই?”
‘এলিজাবেথ কোনো ভণিতা করল না। ঠোঁটের কোণে ছায়া রেখে বলে উঠল,
“সম্পত্তি।”
“সম্পত্তি?”
“হ্যাঁ। ইতালির সকল সম্পত্তি আমার চাই।”
‘রিচার্ড হেসে ফেলল। মাথা নাড়িয়ে বললশ”আমি আছি, এটাই তো সব তোমার।”
‘এলিজাবেথ ঘুরে রিচার্ডের গলায় হাত জড়িয়ে ধরল। বাচ্চাদের মতো ঠোঁট ফোলাল।

“খুব কি বেশি কিছু চেয়ে ফেলেছি স্বামী?”
‘রিচার্ড জানে এই মিষ্টতার ভিতরে লুকিয়ে আছে এলিজাবেথের ছল, তার কৌশল। তবু, আজ সকালটা নরম।
সেই কোমলতাতেই সায় দিল সে। সকাল সকাল বউয়ের এতো আবেদনময়ী রূপ দেখার পর কি না করা যায়?মাথা নাড়িয়ে বলল,
“একদমই না।”
‘এলিজাবেথ সঙ্গে সঙ্গে শাড়ির কুণ্ডলী থেকে বের করল একটি দলিল। বলে দিল,
“তবে সাইন করুন।”
‘রিচার্ড কিছু না বলে দলিল হাতে নিল। চুপচাপ সই করে দিল। শুরু হয়ে গেল এক নতুন খেলার, এক নতুন ধ্বংসের অদৃশ্য দিনপঞ্জি।

‘রিচার্ড দেওয়া ঠিকানায় পৌঁছায় লুকাস। কাল রাত থেকে সে কোথায় যেন ছিল৷ কারোর ফোন ধরেনি, ম্যানশনেও ফেরেনি। ন্যাসো অসংখ্যবার কল করেছিল তবে কোনো সাড়া মেলেনি। অথচ রিচার্ড একবার ফোন করতেই রিসিভ করে। রিচার্ড তাকে একটি জায়গার ঠিকানা পাঠায় আর সময়মতো সেখানে হাজির হয় লুকাস। ঘরের ভিতর গম্ভীর পরিবেশ। রিচার্ড অভিব্যক্তি শক্ত,কাঠকাঠ । পাশে বিয়ান ও ন্যাসো। বিয়ান ল্যাপটপে কাজ কিছু করছে,রিচার্ড ঝুঁকে দেখছিল স্ক্রিন। লুকাসের উপস্থিতি টের পেয়ে সোজা হয় রিচার্ড। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করেন,
“আমার উপর রাগ?”
‘চিরচেনা ছটফটে লুকাস আজ মুখে কিছু না বলে মাথা নাড়ে। রিচার্ড আবারও বলেন,
“অভিমান?”
‘আবারও মাথা নাড়ে লুকাস। দৃষ্টি নিচু, কণ্ঠ নিঃশব্দ। হঠাৎ রিচার্ড তাকে এমনভাবে ডাকে যেভাবে বহুবার ডেকেছে বস হিসেবে। ঠিক যেভাবে এতো জীবন ডেকে এসেছে,,
“লোকা?!”

‘চমকে মাথা তোলে লুকাস। দেখল রিচার্ড দু’হাত বাড়িয়ে রেখেছে তার দিকে। মুহূর্তেই গলে যায় সমস্ত রাগ, অব্যক্ত অভিমান। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে রিচার্ডকে। রিচার্ড আলতো করে লুকাসের পিঠে চাপড়ে বলল,
“আই ওয়াজ আউট অফ মাই কন্ট্রোল, ব্রো।”
“ইট’স ওকে, বস।”
‘ন্যাসোও এগিয়ে এসে অংশ নেয়। তিনজন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে থাকে কিছুক্ষণ। পাশে বসে থাকা বিয়ান তাকিয়ে থাকেন তাদের দিকে। মুখে এক প্রশান্ত, অমায়িক হাসি।
‘তিনজনে মুখোমুখি বসে আছে। হঠাৎ রিচার্ড লুকাসের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“বিয়ে করতে চাচ্ছো?”
‘লুকাস তড়িঘড়ি করে মাথা নাড়াল। স্পষ্ট এক উত্তেজনা তার চোখেমুখে। রিচার্ড পকেট থেকে একটা টিকিট বের করে লুকাসের দিকে বাড়িয়ে দেয়। লুকাস লুফে নেয় সেটি, চেহারায় খুশির ঝলকানি। কিন্তু সেটা স্থায়ী হয় না বেশিক্ষণ যখন চোখে পড়ে গন্তব্য রাশিয়া। রিচার্ড গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
“জাস্ট ফিনিশ অল অফ দেম। মিশনে সাকসেস করে ফিরে আসো। একসাথে আবার তিনজন বিয়ে করব।”
‘লুকাসের মুখের রং ফ্যাকাশে হয়ে যায়। ভেবেছিল কি হলো আর কি। কিন্তু আদেশ যে আদেশ। রিচার্ড চোখ নামিয়ে নেয় আর বলে,

“একটু পরেই ফ্লাইট। বেরিয়ে পড় এখনই।”
‘লুকাস থমথমে মুখে উঠে দাঁড়ায়। দরজার দিকে এগিয়ে যায়। ঠিক তখনই ন্যাসোর ফোনে প্লে হতে থাকে একটা নিউজ ইতালিয়ান ভাষায়।
[ব্রেকিং নিউজ: ভিনসেনশো ক্যাসানোর হঠাৎ মৃত্যুতে তার সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মালিক রিচার্ড কায়নাত, সম্পূর্ণ সম্পত্তি অনাথ আশ্রমের নামে দান করেছেন। তিনি জানান, তিনি আর ইতালি ফিরবেন না—বাংলাদেশেই স্থায়ী হচ্ছেন।]

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৫৭

‘লুকাস তড়াক পিছন ফিরে তাকায়। রিচার্ডের সমুদ্র-নীল চোখ দু’টোতে তখন অগ্ন্যুৎপাত জমে উঠছে। পাশে বসে থাকা ন্যাসো সিঁটিয়ে গেছে। রিচার্ডের বিস্ফোরণের ভয়ে গুটিয়ে আছে। কিন্তু লুকাসের ভিতরে এক আশ্চর্য শান্তি। ছোট ছোট পায়ে বেরিয়ে যায় সে দরজা পেরিয়ে। আপনমনেই বলে ওঠে,
“এতো খুশি আমি জীবনেও হইনি।”

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৫৯