ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৫৯
মিথুবুড়ি
‘হঠাৎ অতর্কিত আক্রমণে চমকে ওঠে এলিজাবেথ। কব্জিতে দানবীয়, পাথরের ন্যায় শক্ত হাতের চাপে টনটনে ব্যাথা অশ্রুসিক্ত হয় দু’নয়ন। রিচার্ডের সমুদ্রনীল চোখদুটোতে জমে উঠছে এক আগ্নেয়গিরির গর্জন। উগ্রতা ছাপিয়ে তা ভেঙে পড়ল এক হিংস্র পশুর মতো। গলা ঝাঁঝিয়ে উঠল,
“হাউ ডেয়ার ইউ! কী করেছ তুমি?”
‘এলিজাবেথ ব্যথায় চূর্ণ হয়, তবুও ঠোঁটে অটল এক দৃঢ়তা,
“যা করেছি, বেস করেছি।”
‘রিচার্ডের দেহ থমকে যায় এক মুহূর্ত। সঙ্গে সঙ্গে সে তার চিরচেনা পৈশাচিক রূপে ফিরে গিয়ে এলিজাবেথকে ঘুরিয়ে, হাত মোচড়ে ধরে চিৎকার করে ওঠে,
“রেড!”
‘চোখের কোণে জলের রেখা, তবু এলিজাবেথের ঠোঁটে এক নির্মম হাসি,
“আই নো ইট’স হার্ড টু লুজ হাসবেন্ড।”
‘পরিস্থিতি ভরাডুবির দিকে এগোতেই, ন্যাসো দৌড়ে এসে এলিজাবেথের দিকে যেতে থাকা ইবরাত’কে টেনে এনে রুমে নিয়ে গিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়। সে এগোতে চায় রিচার্ডের দিকে কিন্তু রিচার্ড হাত তুলে থামিয়ে দেয়। চোয়াল চেপে গলাটা ভারি করে বলে ওঠে,
“হাসবেন্ড-ওয়াইফের ম্যাটারে না এসে নিজের শ্বাশুড়ির রুহের মাগফেরাত কামনা কর। মহিলা সম্ভবত আর বাঁচতে চাইছে না।”
‘নতমুখে দাঁড়িয়ে যায় ন্যাসো। রিচার্ড সিসিটিভি ফুটেজে সবিতা বেগমের সকল কর্মকান্ড দেখেছে। রিচার্ড এবার এলিজাবেথের কানের কাছে মুখ এনে ঠান্ডা হাসি হেসে বলল,
“তুখোড় জ্ঞানী লোকের বউ জ্ঞানী হবে এইটা ঠিক। কিন্তু স্বামীর সাথে পাল্লা দিয়ে নয়। তুমি এখনো সেই ‘চালাক’ হতে পারোনি রেড।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘এলিজাবেথ চমকে ওঠে। রিচার্ড হাসতে হাসতে যোগ করে,
“সামান্য কিছু সম্পত্তি অনাথ আশ্রমে দান করে ভাবলে রিচার্ড কায়নাত’কে পথে বসিয়ে দেবে? ওহ রেড, কাম অন। ওটা তো শুধু ট্যাক্স ফাইলের একটা লাইন। আর তুৃমি ভাবলে সত্যি সত্যি রিচার্ড কায়নাতকে ধ্বংস করে ফেলবে? তুমি তো এখনো জানো না আমার সম্পত্তি কোথায় শুরু হয়, কোথায় শেষ। ইউরোপের বুকে আমার নামে থাকা ভিলা থেকে শুরু করে এশিয়ার শেয়ার মার্কেটে যে নাম ঘুরে বেড়ায়, সব তুমি মিস করেছো। আমার টাকা হংকংয়ের স্টকে নিঃশব্দে ওঠে। সুইজারল্যান্ডের কাচে প্রতিফলিত হয়, আর নিউ ইয়র্কে রাতের ট্রেডিংয়ে লাভ বাড়ায়। সত্যি বলছি রেড, তুমি একা বসে হিসেব কষতে পারবে না। কারণ আমার অ্যাসেট গোনার জন্য অ্যাকাউন্ট্যান্টরা সফটওয়্যার আপডেট করে। তুমি ভাবো আমি হেরে গেছি? না, আমি শুধু উৎসুক হয়ে দেখছিলাম, একটা মুরগির ছানার মতো তুমি কীভাবে দাবার বোর্ডে রাজাকে শিকার করতে যাচ্ছো।
‘আর বোকা তুমি ভাবলে কিছু দান-খয়রাত করে আমাকে কোণঠাসা করবে? তুমি তো জানোই না আমি কখনোই ক্যাশে খেলি না৷ আমি খেলি ইনফ্লুয়েন্সে। ব্যাংক, শেয়ার, প্রপার্টি এসব তো শুধু কাগজে থাকে। আমার নাম থাকে ট্রাস্টে, ফাউন্ডেশনে, ছদ্মনামে। আমি যখন নিঃশ্বাস নিই তখন একেকটা কোম্পানির শেয়ার ওঠে। আমি চোখ বন্ধ করলেই কারেন্সির মান পড়ে যায়। তুমি ভাবছো রিচার্ড কায়নাতের ক্ষয় শুরু হয়েছে? না রেড, এখনো তো সূর্য ডোবে না, কারণ আমার ছায়া পৃথিবীর ওপর ছড়িয়ে আছে। আর তুমি একটা অগোছালো আবেগের মানুষ, হাতে একটু দয়া নিয়ে এসেছো যুদ্ধ করতে। আমি হিম। আমার দয়া বরফ হয়ে কেটে ফেলে শিরা। তুমি হেরে যাবে রেড, কারণ আমি খেলে যাই আর প্রতিপক্ষ বোঝে না কখন সে গেমের অংশ হয়ে গেছে। আমি বাঁচতে দেই, কারণ মারাটা খুব তুচ্ছ কাজ।”
‘রিচার্ড এলিজাবেথ’কে ছেড়ে দেয়। হাতের মোচড় দেওয়া জায়গাটা ইতিমধ্যেই নীল হয়ে গেছে। এলিজাবেথ ভেজা চোখে রিচার্ডের দিকে তাকায়। রিচার্ড আবার কানে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল,
“সাময়িকের জন্য হেসে নাও। ভাবো, রিচার্ড কায়নাত হেরে গেছে। ভাবো, আমি ফুরিয়ে গেছি। নিঃশেষ। নিঃস্ব। অথচ এখনো যা আছে আমার— তা দিয়ে, যা গেছে, তা আমি প্রতিদিন দু’বেলা কিনে নিতে পারি। চুপচাপ। হিসেব না করে। দয়া না দেখিয়ে। তুমি হয়তো ভালোবাসায় খেলতে এসেছিলে রেড। আর আমি? আমি প্রতিপক্ষ তৈরি করি শুধু চোখে তাকিয়ে। মাই ফাকিং ডার্ক রেড, তুমি এখনো বুঝতে পারোনি, আমি হারি না।আমি শুধু খেলা পাল্টাই।”
‘এলিজাবেথ ছলছলে চোখে তাকিয়ে থাকে রিচার্ডের দিকে। যে মানুষটা কাল অবধি ছিল নিখাদ কোমলতার প্রতিমূর্তি আজ তার চোখেমুখে হিংস্রতা, কণ্ঠে ঝাঁঝ আর বিষ। রিচার্ড ঠোঁটের কোণে একটুখানি বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে হঠাৎ এক ভৌতিক সুরে গলা নামিয়ে বলল,
“Make me your Aphrodite,
Make me your one and only—
But don’t… make me your enemy, your enemy, your enemy.
I repeat, wifey, don’t make me your enemy.
If I burn the whole world for you, I can burn you too.”
‘শেষের কথাগুলো রিচার্ড উচ্চারণ করল ক্ষোভে চিবিয়ে চিবিয়ে যেন প্রতিটি শব্দেই শাস্তি লিখে দিচ্ছে।
ন্যাসো ছিল নীরব এক দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল দু’জনের মাঝখানে। এলিজাবেথের ঠোঁট কেঁপে উঠছে বারবার। শব্দরা যেন গলায় জমাট বেঁধে আসছে। তবুও সে চেষ্টা করল কণ্ঠের ফাঁক দিয়ে একটা কিছু বের করতে,
“আমি তো আপনার ভা…”
‘কথা শেষ হবার আগেই রিচার্ড হাত তুলে থামিয়ে দিল। কংক্রিট মিক্সারের মতো গর্জন করে বলল,
“ফাক! জাস্ট ফাক অফ রেড তোমার ওসব ভালোর জন্য।রিচার্ড কায়নাত জানে, কিসে তার ভালো হয়। আমি আলগা পিরিত দেখাতে পারি না, সহ্যও করতে পারি না। এজন্যেই কারোর সাথেই জমে না আমার।দেখো না, আমাদের সম্পর্কটাই এর প্রমাণ।,
‘একটু থেমে আবার বলল,
“ছপুরুষ মানুষ সফল হয়, পোশাক নোংরা করে—মাঠে, ঘামে, ধুলোয়, রক্তে। আর তোমরা? তোমরা নারীজাত, তোমরা শুধু ধ্বংস করতে জানো। ভালোবাসার ছলে, চোখের জলে, স্পর্শের ছুরিতে। তাই মর্ম বুঝবে না রেড।বোঝার আগে শেষ করে দাও।”
‘চুপ করে গেল চারদিক। শব্দেরা যেন হঠাৎ ব্যর্থ হয়ে যায় এই দুই হৃদয়ের ধ্বংসযজ্ঞের সামনে। রিচার্ড মোটেও রেগে নেই। তবুও অভিনয়ের সূক্ষ্মতার দিক থেকে সে এক দক্ষ কারিগর। বউ তার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে, তাই এখনই লাগাম টানার সঠিক সময়। রিচার্ডের প্রতিটা বাক্য যেন সূচালো তীর, যা সোজা গিয়ে বিঁধছে এলিজাবেথের ভেঙেচোরা হৃদয়ে।
“আপনি আমাকে এভাবে বলতে পারলেন?”বলেই হাতের পিঠ দিয়ে দুচোখের জল মুছে নেয় এলিজাবেথ। অতঃপর কম্পিত ঠৌঁট নাড়িয়ে কোনোরকমে বলল,
“আচ্ছা, স্যরি। আর কখনো আপনার জীবনে হস্তক্ষেপ করবো না।”
‘রিচার্ড আচমকা ধমকে উঠে ওঠে,
“সাট আপ, রেড! ইউ আর মাই ওয়াইফ। রিচার্ড কায়নাতের ওয়াইফ তুমি। তোমার ভুল? ওগুলো আমার চামড়ার নিচে সেলাই করা আছে। ভুল করেছো আবার করবে। বারবার করবে। কারণ তোমার ভুল আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। আমি চাই না কোনোদিন তোমার মুখে ‘স্যরি’ শব্দটা শুনতে। বুঝেছো? তোমার ক্ষমা আমার ক্ষতচিহ্নে প্যাচ লাগায় না। তাই নেক্সট টাইম যেনো না শুনি।”
‘এলিজাবেথ চুপ করে থাকে। নাক টেনে নেয় শুধু, তবুও কোনো উত্তর দেয় না। রিচার্ডের বুকের ভিতরে একটু অনুতাপ খচখচ করে উঠলেও সে প্রকাশ করল না তা। গম্ভীর গলায় জানতে চাইল,
“কে হেল্প করেছে তোমাকে?”
‘ন্যাসো তখনো দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছিল। তবে সেই হাসির স্থায়িত্ব ছিল স্বল্প।যখন এলিজাবেথ ধীরে বলে উঠল,
“ন্যাসো।”
‘আঁতকে ওঠে ন্যাসো। বুকের মধ্যে হিমে ছেঁয়ে যায়।
রিচার্ডের সন্দেহই সত্যি। এ কাজ এলিজাবেথের একার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তার চোখ রক্তগরম হয়ে ওঠে। রিচার্ড তেড়ে যায় ন্যাসোর দিকে।ন্যাসো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে, ঘাড় নাড়াতে থাকে দু’পাশে বোকার মতো। ঠিক তখনই এলিজাবেথ ঝাঁপিয়ে পড়ে রিচার্ডকে আঁকড়ে ধরে।
হুড়মুড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। বলেই চলল,
“আমি আপনাকে ভালোবাসি রিচার্ড কায়নাত!
আপনাকে একপলকের জন্যেও হারাতে চাই না, স্বামী।
মরে যাবো সত্যি যদি আপনি আমাকে ছেড়ে যান।
আমি চাই আপনি আর কখনো ইতালি না ফেরেন। প্লিজ…”
‘পৈশাচিক ক্রোধে জ্বলে উঠেছিল রিচার্ড, কিন্তু সেই ক্ষিপ্ততা যেন হঠাৎ কোথাও বিলীন হয়ে গেল বৃক্ষপটে ঝরে পড়া বৃষ্টির মতো শান্ত, ধীরে ধীরে। তবুও রিচার্ড নিজেকে সহজে ভাঙতে দিল না। এলিজাবেথকে আলতোভাবে সরিয়ে হনহনিয়ে উপরের দিকে চলে গেল রিচার্ড। ভেতরে কোথাও একটুকরো শীতলতা ছড়িয়ে দিয়ে।
‘রিচার্ড চলে যেতেই এলিজাবেথ হুড়মুড়িয়ে বসে পড়ল মেঝেতে। কান্নায় ভিজে গেল তার কণ্ঠ। শাড়ির আঁচলে মোছে চোখের কোণ। ন্যাসো ধীরে ধীরে এগিয়ে এল। হাঁটু গেঁড়ে বসল এলিজাবেথের সামনে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে।
“কান্না করছেন কেন ম্যাম?”
‘এ প্রশ্নে যেন কান্নার তোড় আরও বেড়ে গেল এলিজাবেথের। অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“এই দুনিয়ার কেউ বুঝবে না আমার কষ্ট। সবার চোখে আমি দোষী। আমি খেলছি দু’জন মানুষের জীবন নিয়ে।কিন্তু কেউ কি জানে-যে মানুষটা আমাকে নিঃস্বার্থে ভালোবাসে, আমি তাকে কখনো ভালোবাসতে পারিনি। আর যাকে ভালোবাসি তাকেও নিজের করতে পারছি না। ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছি আমি এই গোলকধাঁধায়।”
‘ন্যাসো ধীরে জিজ্ঞেস করল, “কেন পারছেন না?”
“আমার অতীত সেটা বাধা হয়ে আছে আমাদের মাঝে।
একটা রহস্যময় দেয়াল আমাদের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে।
যতবার কাছে যেতে চাই, ততবার সেই দেয়াল ঠেলে ফেলে দেয় আমাকে।”
‘ন্যাসো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “হয়তো বস জানে কিছু, যা আপনি জানেন না। তাই মাঝে দেয়াল তৈরি করেছে।”
“কিন্তু এতে তো উনি আমাদের মাঝে দুরত্ব বাড়াচ্ছেন। অভাগীর ভাগ্যে ভালোই বা কি হতে পারে? আমি চাই, সে সামনে আনুক আমার অতীত। আমি মুখোমুখি হতে চাই, জানতে চাই—আমার রক্তে খুনির রক্ত বইছে কেন?আমার ড্যাড কী করেছিলেন? কি রহস্য লুকিয়ে আছে আমার অতীতে?”
‘ন্যাসো কিছুক্ষণ ভেবে গম্ভীর গলায় বলল,
“আমি সাহায্য করব আপনাকে, ম্যাম। আপনার অতীতে ফিরে যেতে। আমি চাই না আপনার আর বসের মাঝে এমন দুরত্ব তৈরি হোক।”
‘এলিজাবেথ চকিতে তাকাল ন্যাসোর দিকে, “সত্যি?”
“সত্যি বলছি! আমি আমার বসকে কখনো হাসতে দেখিনি। মানুষটা ভয়ঙ্কর, বেপরোয়া—মৃত্যুকেও তাচ্ছিল্য করে চলত সবসময়। কিন্তু তাকে আমি বাঁচতে দেখেছি—শুধু আপনাকে ঘিরে। আমি সেই ভয়ংকর চোখে ভয় দেখেছি—আপনাকে হারানোর ভয়। ছটফট করতে দেখেছি তাকে, কাঁপতে দেখেছি, শুধু আপনার জন্য। অন্ধকার ঘরে নিজেকে টর্চার করতে দেখেছি—আপনার যন্ত্রণায় ভাগ বসাতে চেয়ে। আর এখন, সচক্ষে দেখছি লোকটা কিভাবে পাগলের মতো ছুটছে আপনার অতীতকে মুছে দিতে। কারণ তার পৃথিবীতে আপনি ছাড়া আর কেউ নেই। আপনি—তার একমাত্র শুদ্ধতা।”
‘ন্যাসো কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। চোখ নামিয়ে নিচু গলায় বলল,
“বস কিন্তু নারী প্রাচারের ব্যবসায় নেই, ম্যাম। সেদিন… জঙ্গলে যখন আপনাকে ঐসব মেয়েদের ভিড়ে বস প্রথম দেখেছিল, সেদিন কিছু একটা ভেঙে গিয়েছিল তার ভেতর। তারপরই সে সব ছেড়ে দেয়।”
‘এলিজাবেথ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ন্যাসোর দিকে।একটু থেমে নিঃশ্বাস নিল ন্যাসো। চোখে যেন দূর অতীতের ঘোলা ছবি।
“কারণটা জিজ্ঞেস করলে আজও চুপ থাকে বস। কিন্তু সব প্রশ্নের উত্তর মুখে বলা লাগে না, কিছু উত্তর চোখেই লেখা থাকে।”
‘নিঃশব্দে, ভয়ে গুটিসুটি মেরে রুমে ঢুকছিল এলিজাবেথ। কিন্তু হঠাৎ এক অপ্রত্যাশিত টানে কেঁপে উঠল তার শরীর। পিঠ ঠেকে গেল ঠান্ডা দেয়ালে। সামনে তাকাতেই দেখতে পেল রিচার্ড—চোখে ঝলকানো লালসা। এলিজাবেথ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল; এত তাড়াতাড়ি রিচার্ডের দৃষ্টি বদলে যাবে, তা কল্পনাও করেনি। সে শুকনো ঢোঁক গিলে ধরা গলায় বলল,
“আপনি না রাগ করেছিলেন?”
‘রিচার্ড যেন ছটফটিয়ে উঠল। বিলম্বহীন জবাবে তৎক্ষনাৎ বলল,”রাগ? বউয়ের উপর রাগ তো বোকারা করে।”
‘এলিজাবেথের কপাল ভাঁজ পড়ে। অথচ রিচার্ডের হাত ততক্ষণে পাকিয়ে ধরেছে তার কোমর। গলায় খানিকটা কোমলতা এনে রিচার্ড বলল,”বউয়ের সাথে রাগ করা মানেই লস। আমি সাকসেসফুল বিজনেস ম্যান৷ লসের পথে পা দিই না কখনো।”
‘সব কিছু যেন কেমন ভেসে যাচ্ছিল এলিজাবেথের মাথার ওপর দিয়ে। সে কপালের ভাঁজ গুছিয়ে জিজ্ঞাসা করল,
“লস? মানে কী রকম লস?”
‘হঠাৎ, রিচার্ডের ঠোঁট চাপা পড়ল এলিজাবেথেরলাল টকটকে ঠোঁটে৷ এক তীব্র কামড়ে কেঁপে উঠল এলিজাবেথ।
“আহহ!”
“এই যে, রাগ থাকলে কি পারতাম এমনটা করতে?”
‘রিচার্ডের চোখে খেলা করে এক তৃপ্তির শীতল দীপ্তি। হতবাক এলিজাবেথ কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিজেকে আবিষ্কার করল রিচার্ডের কোলে। টেরাস লাগোয়া ছোট কেবিনেটের ওকে বসিয়ে রিচার্ড একে একে বন্ধ করে দেয় সকল পর্দা। অতঃপর রিচার্ড এগিয়ে গেল ড্রয়ারের দিকে। হাত বাড়াল একটি বেল্টের দিকে। ঠোঁটের কোণে লেগে রহস্যমাখা এক বাঁকা হাসি। চোখে গোপনীয়তার ঘন কুয়াশা। এলিজাবেথ সংকুচিত গলায় জিজ্ঞেস করল,
“কি–কি করছেন?”
‘রিচার্ডের কণ্ঠে নেমে এল গভীর এক হাস্কি সুর,”বউয়ের উপর রাগ না রাখার বেনিফিটগুলো আজ প্র্যাকটিক্যালি দেখাব, রেড।”
‘চোখ বুজে এলিজাবেথ শুধু শ্বাস নিতে থাকে। সময় যেন থেমে থাকে ঠিক সেই মুহূর্তে।
‘Red is Lal,
you are my mal
look at my haal,
pyaar hogya tera naal
‘হাস্কি টোনে বলে হাতে বেল্ট পেঁচাতে পেঁচাতে এগিয়ে এল রিচার্ড। এলিজাবেথ কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার হাত পেঁচিয়ে জড়াল সেই বেল্ট। জবুথবু হয়ে কাঁপতে শুরু করল এলিজাবেথ। রিচার্ডের চোখে গভীর দৃষ্টি। রিচার্ড ধীরে ধীরে আরও কাছে আসে। ঠোঁটের ছায়া মেখে ফিসফিস করে বলল,
“আজ আমি অসভ্য হব রেড, খুব করে হবো।”
‘এলিজাবেথ ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে, শরীরটাকে শক্ত করে রাখে। কিন্তু কিছুই ঘটে না। ধীরে চোখ মেলে দেখে রিচার্ড দূরে দাঁড়িয়ে, বুকে হাত জড়ানো, ঠোঁটে এক বাঁকা তৃপ্তির হাসি।
“ছিঃ রেড, এত কিছু ভেবে ফেললে?”
‘লজ্জায় মাটির নিচে মিশে যেতে চায় এলিজাবেথ। রিচার্ড এগিয়ে আসে। বেল্ট খুলতে খুলতে বলল,
“রিচার্ড কায়নাতের বাসর হবে একটু আলাদা। একটু অন্যরকম। যেখানে থাকবে শুধু তোমার সম্মতি।”
‘এই বলে এলিজাবেথের কোমর শক্ত করে চেপে ধরে নিচে নামিয়ে দেয়। চমকে ওঠে এলিজাবেথ রিচার্ডের মধ্যে এই পরিবর্তন দেখে। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সে। রিচার্ড খানিক বিরক্ত হয় এভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে। এমনিতেই ইদানীং তার মন মেজাজ খুবই খারাপ। এলিজাবেথকে হালকা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়।
“এই বাল, সর!”
‘রসগোল্লার মতো বিস্ময়ে বড় হয়ে যায় এলিজাবেথের চোখ।
“ছিঃ, আমি তো আপনার বউ! আপনি আমাকে ‘বাল’ বলছেন?”
‘সিগারেটের ছাই ঝেড়ে রিচার্ড হেসে বলল,
“বাবু, সোনা ডাকলেও তো দোষ! শোনো মেয়ে, ‘বাবু, সোনা ডাকা মানেই বিছানায় ডাকা না। মনটা একটু পরিশুদ্ধ করো, আর স্বামীর মন বুঝে নিজেই বেডে আসতে শিখো।”
‘হতবাক হয়ে যায় এলিজাবেথ। এই লোকের সঙ্গে কথায় কখনো জিততে পারবে না। বাইরে দেখতে শক্ত অথচ ভেতরে এক অসম্ভব ঠোঁটকাটা মানুষ। এলিজাবেথ রাগে গজগজ করতে করতে হাঁটা দেয় দরজার দিকে।
“এলি জান!”
‘নিঃশ্বাস থমকে গিয়ে চকিতে পিছন ঘুরল এলিজাবেথ
তীব্র আকুলতায়। কি আছে এই ডাকে? এই শব্দগুলো যেন ডানা মেলে ছুটে আসে তার কর্ণকূহরে। সুখপাখির মতো নরম পালকে ঘিরে ধরে তার মন। অস্বস্তির খোলস ছাপিয়ে কোথা থেকে যেন এক আশ্চর্য রকমের ভালো লাগা গায়ে এসে বসে। কিন্তু এলিজাবেথের সে সুখস্নান রিচার্ডের চোখে ধরা পড়েনি কখনো।এলিজাবেথ বরাবরের মতোই আজও পারল না এই ডাকে সাড়া না দিয়ে থাকতে। সুতীব্র আবেগের তাড়নায় গা কাঁপে । শরীরের মৃদু স্নিগ্ধ কম্পনে অস্পষ্ট স্বরে আওড়ালো,
“হুমমম।”
‘রিচার্ডের কণ্ঠনালী বেয়ে এক চিলতে হাসির উদগীরণ ঘটল ঠৌঁটে। সে ভাবেনি এলিজাবেথ ফিরবে, প্রত্যুত্তর করবে। সহসাই এক উজ্জ্বলিত শিখা প্রজ্জ্বলিত হলো অভ্যন্তরে। অক্ষিপটে দ্বিধাহীন একগুঁয়ে দৃষ্টি বজায় রেখে ভণিতাহীন বলল,
“আরেকবার বল।”
“কি?”
“তখন যে বললে!”
‘এলিজাবেথ নিরুদ্বেগ ভাব নিয়ে বলল,”কতবার বলব এককথা?”
‘রিচার্ড দাপুটে গলায় বলল,”যতবার আমি চাই।”
“না।”
“রেড, আমি শুনতে চাচ্ছি।”
‘হঠাৎ এলিজাবেথের মাথার মধ্যে দুষ্টু পাকসেনারা হানা দেয়। ওষ্ঠপুটে খেলে গেল শয়তানি হাসি। সে লাজুকলতায় নুইয়ে পড়ে কিছুক্ষণ হাঁসফাঁস করে সবিনয়ে বলল,
“বলবো?”
‘রিচার্ডের স্বরে উত্তেজনা। দৃষ্টি নিবিড়। জানার আগ্রহবোধ অসীম। সে ছটফটিয়ে উঠল, “হুম! প্লিজ।”
‘হঠাৎ বৃষ্টির মতো, হঠাৎ করেই শক্ত হয়ে গেল এলিজাবেথের স্বর। সে রিচার্ডের চোখে চোখ দাঁতে দাঁত চেপে শুধালো,
“আই ফা’ক ইউ।”
‘আগত আশাহত জবাবে চোয়াল শক্ত হওয়ার বিপরীতে বাঁকা হেসে অধর এক কোণে হেলে পড়ল। রিচার্ড অধরে সেই হাসি ধরল রেখে দুই পকেটে হাত দিয়ে টানটান হয়ে দাঁড়াল। চোখে বিন্দুমাত্র অস্বস্থির লেশমাত্র নেই। কণ্ঠনালি যেন টইটম্বুর আত্মবিশ্বাস আর আত্মজ্ঞানে। রিচার্ড সন্নিকটে দাঁড়িয়ে থাকা তার ব্যক্তিগত নারীর দিকে তাকিয়ে পুরুষালী হাস্কি টোনে হিসহিসিয়ে বলল,
“অফকোর্স আই ওয়েল ফা’ক ইউ টু ওয়াইফি।”
‘ভরকে যায় এলিজাবেথ। লজ্জায় দুগাল রক্তিম৷ একেবারে গোধূলির রঙ যেন মেখে বসেছে ত্বকে। পা যেন জমে যায় মাটিতে। নত দৃষ্টিতে আঁটসাঁট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নিঃশব্দে।
রিচার্ড ধীরে এগিয়ে আসে। আলতো করে হাত রাখে এলিজাবেথের লাল হয়ে ওঠা গালে। বুড়ো আঙুলে মৃদু ঘর্ষণ ছুঁইয়ে দিয়ে হিসহিসিয়ে বলে ওঠে,
“আমায় দেখে লজ্জা পাবে, আবার আমার কাছেই এসে সেই লজ্জা ভাঙবে, রেড। কজ ইউ আর মাইন। মাই ফাকিং ডার্ক রেড।”
‘এলিজাবেথের তনুমন এক মুহূর্তে পুলকিত হয়ে ওঠে। পেটে অজস্র প্রজাপতি পাখা মেলে দেয়, বুকের ভেতর দ্রিম দ্রিম শব্দ যেন বজ্রনিনাদের মতো বেজে চলে। এক বুক ভালোবাসায় ভরে যায় হৃদয়ের আকাশ। রিচার্ড আরও ঝুঁকে আসে। ঠোঁটের কাছাকাছি এসে বলল,
“Say again, Red. Say again you love me.”
‘এলিজাবেথ আর এক মুহূর্তও দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। ছুটে চলে যায় সেখান থেকে চোখে বিস্ময়, বুকে আগুন, মনে এক রকম অনিবার্য টান।
‘খচখচ শব্দ—শুকনো পাতার উপর পা ফেলার। জায়গাটার চারপাশে যেন এক করুণ দীর্ঘশ্বাস লেগে আছে। জায়গাটা সরকারি গুরুস্থান। মেয়েদের প্রবেশ সেখানে নিষেধ। লাড়া ভিতরে ঢোকে না, শুধু গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। হাতে একগুচ্ছ সাদা গোলাপ। প্রেমের সবচেয়ে প্রিয় ফুল ছিল সাদা গোলাপ প্রথমেই দৃষ্টি যায় নেইম-প্লেটটায়—”প্রেম আহসান”। চোখের পাতা কেঁপে ওঠে লাড়ার। আর সে আগের লাড়া নেই। স্টাইলিশ ছায়া ফেলে গেছে সময়ের পেছনে। চোখের নিচে গাঢ় কালি, মুখে ক্লান্তির ছাপ।জেমসের বন্দিদশা থেকে আজ পালিয়ে এসেছে সে। এতদিন শরীরের ক্ষত শুকিয়েছে, মনটা শুকায়নি। আজ প্রেমকে দেখতে এসেছে লাড়া শেষবারের মতো। শক্ত গোছের লাড়া আজ ক্ষণিকের জন্যও নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। চোখে নোনাজল জমে ওঠে। ঠোঁট কাঁপে। লাড়া দাঁড়িয়ে থাকে দূরে, বাঁশের ঘেরা কবরটার দিকে তাকিয়ে। ওখানে শুয়ে আছে প্রেম চিরজীবনের জন্য। বৃষ্টিতে ভেজা ভেড়ায় শেওলার রঙ। যেতে না পারুক কাছে গলা চিরে বেরিয়ে আসে হাহাকার,
“তুই বেইমান, প্রেম! তুই কথা রাখিসনি। তুইও চলে গেছিস আমাকে ফেলে! তুইও দুনিয়ার সাথে হাত মিলিয়েছিস নাহ? আমি তোকে আজও বন্ধু হিসেবে ভালোবাসি, আজও তোকে খুঁজি প্রেম। চিঠিতে যেসব শর্ত রেখে গেছিলি, আমি রাখতে পারিনি। আমি কাঁদছি প্রেম, খুব বাজেভাবে কাঁদছি। ভেঙে পড়েছি, বুঝিস? তোকে দরকার আমার! ফিরে আয় না অফিসার… একবার শুধু হাত বাড়িয়ে দে, চোখের জলটা মুছে দে। যে দুঃখের কথা মাকে বলা যায় না, সে দুঃখের ওজন অনেক বেশি ভারী হয়। তুই তো জানতি আমার মা নেই, আমি এতিম। আমার সকল দুঃখের কথাও জানতি। তাও ক্যান একা ফেলে চলে গেলি হারামির বাচ্চা? আমি কার কাছে বলব আমার দুঃখ? আর কে-ই বা আছে আমার। শুয়োরের বাচ্চাদের জবাব দিয়ে যা।
‘তুই তো বলেছিলি, ‘সারাজীবন পাশে থাকবো’। কুত্তার বাচ্চা সেই কথা কেন দিয়েছিলি, যেটা রাখতে পারবি না? তুই মিথ্যা, তোর অস্তিত্ব মিথ্যা, তোর সকল কথা মিথ্যা। কুত্তার বাচ্চা আমাকে বাঁচার আশা দেখিয়ে আবারও মেরে ফেলেছিস তুই। খোদা তোকে কখনো মাফ না করুক। দাফন হোক তোর সকল মিথ্যা আশ্বাসের। তুই ফিরবি না কখনো, দাফন হোক সেই মিথ্যে আশার। তুই আজ শান্তিতে ঘুমোচ্ছিস মাটির নিচে, আর আমি দুনিয়ার আগুনে পুড়ছি! আমাকে আগুনে পুড়িয়ে তুই কিভাবে শান্তিতে ঘুমাচ্ছিস শালা, জবাব দে। এই, এই প্রেম, তুই কি আমার মায়ের সাথেও হাত মিলিয়েছিস? সবাই মিলে একটা চুক্তি করেছিস না—লাড়াকে শক্ত থাকতে দিবি না। তবু শুনে রাখ, আমি ভাঙবো না! এত সহজে না। আমি লাড়া, শক্ত আমি, আগুন আমি। লাড়ার আর কারো দরকার নেই এখন। লাড়া আজকের পর আর কোনোদিন কাঁদবে না। মরে যাবে, তবুও কাঁদবে না লাড়া। তোরা, এই দুনিয়া পাথর বানিয়ে দিয়েছিস লাড়াকে। আমি যাদের আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিলাম, তারা’ই আমাকে ফেলে দিয়েছে।
‘কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়ে লাড়া। চোখের জল গড়িয়ে পড়ে মাটিতে। তার নোনাজলে ভিজে ওঠে সেই নিষিদ্ধ ভূমি। হাতে ধরা সাদা গোলাপগুলো নিঃশব্দে রেখে দেয় মাটির উপর। ঝাপসা চোখে সবকিছু আবছা লাগছে। চেনা গন্ধও যেন আজ অচেনা। পাগলিনী হয়ে ওঠে সে। শুকনো পাতাগুলো এক এক করে সরিয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করে। তারপর আঙুল দিয়ে কাঁপা হাতে মাটিতে লিখল,
“মৃত্যুই সুন্দর, মৃত্যুতে মানুষের মন কাড়ে, মৃত্যুতেই মায়া বাড়ে।”
‘লাড়ার মনে হয় এই লেখার নিচেই প্রেম শুয়ে আছে। হয়ত প্রেমই লিখে গিয়েছিল কথাগুলো, অভিমানে। নিশ্চয়ই লেখার সময় হেসে হেসেই লিখেছিল ছেলেটা। সে তো সবসময় হাসত। ভেতরে যত কষ্ট থাকুক, প্রেমের মুখে ছিল সেই চিরচেনা হাসি। এই ভাবনায় লাড়ার বুকের ভিতর ঘূর্ণিঝড় উঠে—একটা কালবৈশাখী। সে উপুড় হয়ে পড়ে লেখাটার উপর। জড়িয়ে ধরতে চাই প্রেম’কে। শক্ত করে মিশিয়ে নিয়ে চাইল, একদম পাঁজরের সাথে। লাড়া হাউমাউ করে কাঁদে,
“অফিসার’রে… ফিরে আয় না! তোর মৃত্যু আমায় কাঁদাচ্ছে, খুব কাঁদাচ্ছে। আমার মায়ের মৃত্যুর সময় বুঝিনি, তুই বুঝিয়ে দিলি হারানো কাকে বলে। তোকে হারিয়ে বুঝলাম, তুই আমার জীবনের একমাত্র যত্ন ছিলি। তোর সাময়িক উপস্থিতিই আমায় স্বপ্ন দেখিয়েছিল হাজার বছরের। আজ তুই নেই, যত্ন নেই, স্বপ্ন নেই। আমি ভালো নেই প্রেম, একটুও ভালো নেই। জীবনে প্রেম না থাকলেও বন্ধুত্ব ছিল। আজ সেটাও নেই। দেখ, আমি একেবারে শূন্য। আমার জীবনে প্রেম নেই। তুই নেই। দুটো প্রেমই আমি হারিয়ে ফেলেছি, একসাথে। ফিরে আয় প্রেম। প্রেম, তুই তো একসাথে সমুদ্রের পাড়ে হাঁটতে চেয়েছিলি, আমাদের একসাথে হাঁটা হলো না। এখনও সময় আছে, ফিরে আয় প্রেম, একটুও বকব না আমি। একসাথে হাঁটব দুজনে, হাতে হাত ধরে৷
“আমি তোর লাশটা কেন দেখতে পেলাম না, প্রেম?” চিৎকার করে কাঁদে লাড়া। “কিসের এত অভিমান ছিল আমার ওপর? আমি তো তোরই ছিলাম, প্রেম। আজও আছি তোর কবরের পাশে বসে, শুধু একটু কাঁদার সুযোগ নিয়েই। দেখ না, প্রেম, আমার তো আর কেউ নেই। ঐ লোকটা—যে নিজেকে আমার বাবা বলে, সে তো মানুষ না… সে নরপিশাচ! বন্দী করে রেখেছিল আমায় কয়েদির মতো! তুই জানলে কাঁদতি, প্রেম। কষ্ট পেতি। ছুটে যেতি আমাকে মুক্ত করে আনতে।
‘তোর-আমার যাত্রাটা আরেকটু দীর্ঘ হল না কেন? একটু সময়, একটু ধৈর্য যদি দিতিস, আমি পালিয়ে যেতাম তোকে নিয়ে। তোর হাতে হাত রাখতাম। ছুটতাম না মরিচীকার পিছে। কিন্তু তুই চলে গেলি… আর তোর এই মৃত্যু আমায় কাফন ছাড়াই দাফন করে দিল, প্রেম।
‘লাড়া ফোঁপাতে থাকে। একটু পরপর ধড়ফড়িয়ে উঠছে আড়ষ্ট কায়া। ঝুরঝুরে মাটি থেকে নাক টেনে ঘ্রাণ নেয়। কণ্ঠ বুজে এলো কান্নায়। ফ্যাসফ্যাসে আওয়াজে বলল,
“তোমরা সবাই আমাকে এতো কষ্ট কেন দিচ্ছ, আমি হারিয়ে ফেলছি বাঁচার ইচ্ছেশক্তি। আমি তো বেশি কিছু চাইনি এই দুনিয়ার কাছে। একটু সুখ, আর একজন অরাধ্য পুরুষ চেয়েছিলাম। এই স্বার্থপর, জানোয়ারের বাচ্চা, অমনুষ্যত্বে ভরা দুনিয়াটা আমাকে তাও দিল না। শেষ পর্যন্ত আমার প্রেম’কেও কেড়ে নিল আমার কাছ থেকে।
‘ক্ষণিকের এই জীবনে কেউ কষ্ট পেতে আসে না। তাও প্রকৃতির একি নিয়ম? কেড়ে নেওয়ার মাঝে কি শান্তি আছে? যারা কাঁড়তে জানে, তারা কি হারানোর যন্ত্রণা অনুভব করেছে কখনো?”
‘লাড়া মাথা তোলে। চোখে জল, বুকভরা হাহাকার। স্বচ্ছ নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে গলা ছেড়ে চিৎকার করল,
“সবাই কাঁদিয়েছে আমাকে হে মৃত্যু, তুই শুধু একবার পাশে দাঁড়া, সবাইকে কাঁদিয়ে ছাড়বো আমি!”
‘আহাজারি করতে করতে খামচে একটুকরো মাটি তুলে নেয় লাড়া মুঠো করে চেপে ধরে বুকের সাথে।এই মাটিতেই তো প্রেম মিশে আছে। এই মাটির গন্ধেই তার জীবন ছিল একদিন। লাড়া চায় এই মাটির গভীরে ঢুকে প্রেমকে ছুঁয়ে থাকতে। লাড়া আজ কাঁদে। খুব করে কাঁদে। কারণ আজ তাকে থামানোর কেউ নেই। আর কেউ নেই যে পাশে বসে হেসে বলবে,”ডোন্ট ক্রাই লাড়া জান্স, আমি আছি তো।”সেই গালের টোল… সেই হাসি… সব হারিয়ে গেছে। চিৎকার করে কাঁদে লাড়া,
ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৫৮
“এই দুনিয়ার কাউকে মাফ করব না আমি। এই তোমরা আমাকে প্রতিবার যেভাবে ভেঙে দিয়েছ, সেই আঘাত আমার রুহু পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। আমি এতিম বলেই কি সব হারাতে হবে? মা নেই বলেই কি ভালোবাসা থাকবে না? আমি আর কাউকে আমার করব না, আর না! পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে ছাড়া থাকার ক্ষমতা প্রকৃতি আমাকে দিক।”
‘তারপর হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে।ফুলগুলো সেখানেই ফেলে রেখে ছুটে যায়, দৌড়ে পালিয়ে যায় লাড়া…এই নিষ্ঠুর পৃথিবী থেকে, সেই কবর থেকে,নিজের অসহায়ত্ব থেকে।