ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৫৯ (২)

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৫৯ (২)
মিথুবুড়ি

“হেই বেবিগার্ল।”
‘ক্রিং’ শব্দে ভেসে এল নোটিফিকেশন। এলিজাবেথ রিচার্ডের শার্টটা হাত থেকে নামিয়ে চোখের কোণে জমা পানিটুকু মুছে ফোনটা হাতে তুলে নিল। স্ক্রিনে চোখ পড়তেই ভ্রু জোড়া কুঁচকে গিয়ে চিন্তার ভাঁজ গাঢ় হয়ে উঠল। এই ফোন রিচার্ডের দেওয়া। তাকবীরের স্মৃতিচিহ্ন সেই ফোনটাকে রিচার্ড নিজ হাতে পিষে ফেলেছিল। নতুন এই ফোনে রিচার্ড ছাড়া আর কোনো নম্বর নেই। অপরিচিত কারো থেকে এমন অদ্ভুত মেসেজ আসার প্রশ্নই ওঠে না। সম্ভবত সিমটাও রিচার্ড নিজেই কাস্টমাইজ করে তৈরি করিয়েছে। নইলে একমাসে একবার হলেও তো অপরিচিত নম্বরের কল আসত! আর রিচার্ড কায়নাত নিশ্চয়ই সকল সিকিউরিটি মেইনটেইন করেই তার বউকে সিম দিয়েছে। রিচার্ড এখন ভিয়েতনামে, আজ ছাব্বিশ দিন হলো। কেন গিয়েছে তার উত্তর আজও অজানা এলিজাবেথের কাছে। অল্প ক’টা বারই কথা হয়েছে এতোদিনে। বাকিটা সময় কেবল এলিজাবেথের একপাক্ষিক চেষ্টা আর রিচার্ডের নীরবতা। ন্যাসো রয়েছে রিচার্ডের সাথে আর লুকাস এখনও রাশিয়ায়।

‘এলিজাবেথ অনুভব করে নিয়েছে এই মিশন কোনো সাধারণ অভিযান নয়, ভয়ানক কিছু। ভয়, উদ্বেগ আর শূন্যতা মিলে তার দিনগুলোকে শুষে নিয়েছে। চোখের পানি ফুরিয়েছে, তবু বিষণ্ণতা যায়নি। রিচার্ডের শার্ট বুকে চেপে ধরে তার ঘ্রাণ মেখে কেঁদে রাত কাটিয়েছে,পার করেছে দিন। আজও কাটাচ্ছিল। তবে আজ ভিন্ন। আজ রিচার্ড ফেরার কথা। তিনদিন আগে ক্ষীণ এক মেসেজে জানিয়েছিল সে। তারপর আর কোনো খবর নেই। আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষা করছিল এলিজাবেথ। তবুও এর ভিতর অপ্রত্যাশিত এই অদ্ভুত মেসেজ তাকে ভেতর থেকে ক্ষেপিয়ে তুলল। চিবুক শক্ত করে ভ্রু জোড়া আরো কুঁচকে কিবোর্ডে দ্রুত আঙুল চালাল এলিজাবেথ,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আপনি কে?”
“আর ইউ সিঙ্গেল?”
‘সোজাসাপটা জবাবের বিপরীতে পাল্টা প্রশ্ন আসতেই মেজাজ আরো চটে গেল। এলিজাবেথ দাঁতে দাঁত পিষে লিখল,
“নোপ। আই’ম গ্যাংস্টার আ ওয়াইফ।”
“তার মানে আমাদের এখন তার জন্য একজন ভালো ডিভোর্স লয়্যার খুঁজতে হবে, কজ আই ওয়ান্ট ইউ বেবি।”
‘এলিজাবেথের চোয়াল ফাঁক হয়ে যায় বিস্ময়ে। সে তড়িঘড়ি করে লিখল,”ওয়াহ! এত্তো কনফিডেন্স?”
“ইয়েস মাই গর্জিয়াস ওল্ফ”
‘অকস্মাৎ এলিজাবেথের ভ্রু জোড়া কুঁচকে সন্দেহের ছাড়া ফুটে উঠে মুখে। এলিজাবেথ ঠৌঁট কামড়ে কিছু ভাবল। পরক্ষণেই হঠাৎ অধর কোণে রহস্যময় হাসি ফুটে ওঠে। ঠৌঁটের আগায় জড়ো হয় রহস্যের ঘনঘটা। সে কুটিল হাতে ধীরে ধীরে লিখল,

“আই ডোন্ড নিড আ ম্যান।”
‘ওপাশ হতে তৎক্ষনাৎ রিপ্লাই,”আই নো ডার্লিং, বাট ইউ আর দ্য ওয়ান আই নিড।”
“হেই মিস্টার, ফ্লার্ট হচ্ছে?”
“হোয়াট দ্য হ্যাক, ফ্লার্ট হবে কেন? হলে আমাদের মাঝে অন্যকিছু হবে।”
‘এবার এলিজাবেথের কপালে ভাঁজ, চিন্তায় ভারি। শুকনো ঢোক গিলে লিখল,”মানে?”
“হৃদয়, হৃদয়ের সংযোগস্থলে আসলে যে অঘটন ঘটে আরকি।”
‘এলিজাবেথ যদিও দ্বিধাদ্বন্দে আছে তবুও গম্ভীর ভাবে লিখলে গেল,
“আপনি জানেন আমার হাসবেন্ড কে? জানে মেরে ফেলবে আপনাকে তার স্ত্রীর সাথে অশালীন কথা বলার অপরাধে।”
‘ওপাশ থেকে ভেসে এল নিরুদ্বেগ জবাব,”আই জাস্ট কেয়ার এবাউট ইউ বেবি।”
“হি ওয়েই কিল ইউ।”
“আই ক্যান ডাই ফর ইউ সুইটহার্ট।”
“দ্যাটস ফাকিং বুলশিট।”
“দ্যাটস ট্রু।”
“আই ওয়ান্ট প্রুভ।”
“লাইক?”

“ব্লাড, এইটুকু সেন্ড করে এলিজাবেথ আরও কিছু লিখতে যাচ্ছিল তার আগেই রিপ্লাই আসে,”জাস্ট আ মিনিট।”
‘কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই অপর প্রান্ত থেকে একটা ছবি এলো। কৌতূহলী এলিজাবেথ ছবিটায় ক্লিক করল। পর মুহূর্তেই শরীর কেঁপে উঠে ভয়ে ফোনটা হাতছাড়া হয়ে মেঝেতে পড়ে গেল। ছবিটিতে ছিল একখানা রক্তমাখা হাত।তাজা কাটা ক্ষত থেকে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত ঝরছে, তালুর চামড়া ফেঁটে গেছে গভীরভাবে। বোঝাই যাচ্ছে কোনো ধারালো কিছু দিয়ে জায়গাটা মাত্রই কাটা হয়েছে। একটুও সময় নষ্ট না করে এলিজাবেথ নম্বরটা সঙ্গে সঙ্গে ব্লক করে দিল। তার সন্দেহ ছিল এটা নিশ্চয়ই রিচার্ডের কাজ। তাই এতক্ষণ কৌশলে কথা বলে তাকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছিল। কিন্তু এই ঘটনার পর এলিজাবেথের মধ্যে আর কোনো আগ্রহ রইল না।

‘তবে এলিজাবেথের মন থেকে সেই খচখচে অস্বস্তিটা কিছুতেই যায় না। কে এমন সাহস দেখাতে পারে, জানে সে গ্যাংস্টারের স্ত্রী তবুও এতটা দুঃসাহস? ধাতস্থ হয়ে এলিজাবেথ আবার ফোনটা হাতে তুলে নেয়। ঢুকে পড়ে রিচার্ডের একাউন্টে। মেসেজ পাঠাতে যাচ্ছিল কিন্তু আচমকা রিচার্ডের প্রোফাইল ছবি চোখে পড়ে। বুকের ভেতর দুকদুক শুরু হয়। বহু বছর পর রিচার্ড প্রোফাইল বদলেছে। এলিজাবেথ ছবিতে ক্লিক করে বড় করে দেখে। বিস্ময়ে চোখ আটকে যায়। এ যেন এক নতুন রিচার্ড. ভিন্ন রূপে, ভিন্ন ছায়ায়। ঘন লম্বা চুলের পরিচিত ছায়া আর নেই। এখন চুল ছোট করে কাটা। এমন ছোট যে চিমটি দিলেও ঠিকঠাক ধরা যাবে না। এলিজাবেথ খানিকটা চমকপ্রদ হল। ছোট চুলেও বুঝি কাউকে এতো নজরকাড়া লাগে? ছবিটা একটা মিরর সেলফি। তার ভেতর একধরনের উগ্র বিদ্রোহ মিশে আছে। সেই গ্যাংস্টার বস আজ যেন আরও বেশি ভয়ংকর, আরও বেশি আকর্ষণীয়।

‘রিচার্ডের গায়ে Calvin Klein-এর কালো টি-শার্ট, হাতের মাংসপেশী পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। এলিজাবেথ টের পায় লোকটা নতুন করে ট্যাটু করিয়েছে। বা হাতের কাঁধ থেকে কব্জি পর্যন্ত আঁকা ভয়ংকর শিল্প। ব্লু জিন্সের সাথে টি-শার্টটা ইং করে পরা। এক হাতে ফোন ধরা, অন্য হাতের বুড়ো আঙুল একটু ভাব নিয়ে পকেটে গুঁজে রাখা। আয়নার সামনে গ্রীবা কিছুটা হেলিয়ে সটান দাঁড়িয়ে, ফোনের চাপের হাতের গাঢ় বর্ণের শিরাগুলো ফুলে উঠেছে। গলায় বেশ মোটা সিলভার চেইন আর কানে বরাবরের মতো ইয়ারপিন্চ। এখনকার ছোট চুল আর দৃঢ় চোয়াল রিচার্ডকে গ্যাংস্টারের পাশাপাশি স্পেশাল ফোর্সের সদস্যের মতো লাগাচ্ছে। মুখে কোনো বিশেষ অভিব্যক্তি নেই, তবু শূন্য চোখের গভীরে জমে থাকা ক্রোধের পাহাড় স্পষ্ট।

‘এলিজাবেথ একটু জুম করে দেখে রিচার্ডের ভ্রুতে তিনটি সেলাইয়ের দাগ। গা শিউরে ওঠে। মুহূর্তের মধ্যেই একগাদা অনুভূতি ভাসিয়ে দেয় তাকে। পুরো মুখশ্রী রয়েছে অনেক ক্ষতের চিহ্ন। কিছু দগদগে, কিছু শুকিয়ে যাওয়া। এলিজাবেথ দ্রুত হাতে মেসেজ পাঠিয়ে দেয় ‘Criminal Husband’ নামে সেভ করা রিচার্ডের একাউন্টে,
“Baby, can you call me back? I miss you… It’s so lonely in my mansion.”
‘রিচার্ড নিজের হাতে নিজেই ব্যান্ডেজ বাঁধছিল। ক্রিং শব্দে টেবিলের উপর রাখা ফোনটা হাতে তুলল। পাশে রাখা অন্য ফোনের স্ক্রিন এখনও জ্বলজ্বল করছে। স্পষ্ট কিছুক্ষণ আগের সেই কনভারসেশন। এলিজাবেথের মেসেজ দেখামাত্র রিচার্ডের মুখের ব্যথার ছাপ মিলিয়ে গেল। হাতে জমে থাকা রক্ত ঝেড়ে ফেলে ব্যান্ডেজ না করেই টাইপ করতে শুরু করল,

“I am in Bangladesh now. It’s an urgent meeting. I will come back at night. Take a deep nap, wifey.”
‘এলিজাবেথ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রিপ্লাই দেখেই। বুক থেকে যেন একটা বারি পাথর নেমে গেল৷ সে লিখল,
“How long are you going to be?”
‘রিচার্ড টাইপ করল,”3 hours.”
‘এলিজাবেথ মিটিমিটি হেসে টোকা দিল,”So rude of you. I’m done.”
‘রিচার্ডের কপাল কুঁচকে উঠল। সাথে সাথেই লিখল,”Wtf, rude?”
“I don’t like your tone.”

‘রিচার্ডের হাত থেকে এক ফোঁটা গরম রক্ত গড়িয়ে পড়ল ফোনের স্ক্রিনে। সে পরপর কয়েকবার ভারী নিশ্বাস ফেলল। চিবুক শক্ত করতে গিয়েও পারল না। বক্র হাসি হেসে সেই রক্তের উপর দিয়েই টাইপ করল,
“I will be mansion in three hours my beautiful f**king dark red.”
‘ঝিলিক দিয়ে উঠল এলিজাবেথের মুখাবয়ব। সে এক লাফে বিছানায় পড়ল।ফোনটা অবহেলায় ছুঁড়ে দিয়ে মুখ গুঁজে হাঁটু তুলে নাচতে লাগল আনন্দে। ঠিক তখনই আবারও ভাঁজ খুলে এল মেসেজের শব্দ। ফোন হাতে নিয়েই দেখতে পেল রিচার্ড একটা ভয়েস মেসেজ পাঠিয়েছে। প্লে করতেই অভ্যন্তরে যেন তরঙ্গ বয়ে গেল।
“What’s up, my girl?”

‘রিচার্ডের সেই ভারী, গুরুগম্ভীর হাস্কি স্বর। এলিজাবেথের কাছে এই কণ্ঠের নিজস্ব এক ওজন আছে। মাতাল করা রেশ মেখে থাকে প্রতিটি শব্দে। কেমন কেমন যেন অনুভূত হয়, যখন রিচার্ড এই টোনে কথা বলে। লোকটার সবকিছুতেই বিশেষ আর্কষণ। বিশেষ করে দৃষ্টি আর কণ্ঠস্বর। নিজেকে ধাতস্থ করে এলিজাবেথ কয়েকবার গলা খাঁকারি দিল। চেষ্টা করল রিচার্ডের টোনে কথা বলার। তারপর সেও একই ভঙ্গিতে একটা ভয়েস পাঠাল,
“What’s up, daddy?”
‘রিচার্ড ফিচলে হাসল। আর কোনো জবাব না দিয়ে আবারও মিটিংয়ের ফাইলগুলোর পাতায় চোখ বোলাতে লাগল। এদিকে এলিজাবেথ উঠে বসল। মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে লাগল হাজার প্রশ্ন। একটু ভেবে এলিজাবেথ আবারও রিচার্ডকে মেসেজ পাঠাল,
“What’s your favourite hobby, Mr. Kaynat?”
‘রিচার্ড কাজের ভিতর থাকা অবস্থাতেও এক মুহূর্ত দেরি না করে লিখল,
“Stalking.”

‘এলিজাবেথ চুপচাপ উঠে দাঁড়াল। কেবিনেটের ভেতর তন্নতন্ন করে খুঁজে বের করল একটা অফ-শোল্ডার রেড সিল্ক ভেলভেট গাউন। দরজাটা ভেতর থেকে টেনে বন্ধ করে ধীরে ধীরে গা থেকে শাড়িটা খুলে মেসেজ পাঠাল,
“Oh, I am changing.”
‘সাথে সাথে উত্তর এলো,
“I am watching.”
‘ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে চেয়ে না দেখেই টাইপ করল রিচার্ড। স্ক্রিনের ওপর থেকে তার দৃষ্টি এক মুহূর্তের জন্যও সরে না। এলিজাবেথ ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল দেয়ালের কোণের সিসিটিভি ক্যামেরার দিকে। যা আন্দাজ করেছিল তাই। এই অদৃশ্য লোকটা আর কেউ নয়—রিচার্ড কায়নাত। সে যেখানেই থাকুক সারাক্ষণ নজরে রাখে এলিজাবেথকে। দু’জন আলাদা শহরে থাকলেও এক মুহূর্তের জন্যও তার দৃষ্টি সরে না এলিজাবেথের দিক থেকে। এলিজাবেথ জানে যদি সে অন্য কারও সঙ্গে কথা বলে, রিচার্ড কায়নাতের তা অজানা থাকবে না। আর এলিজাবেথ এটাও জানে রিচার্ড তা জানতে পারলে এত ঠান্ডা থাকবে এমনটা ভাবাই ভুল। কুটিল হাসি ফুটল এলিজাবেথের ঠোঁটে। ফোনের প্লেলিস্ট থেকে একটা গান ছেড়ে দিল। এবার ধীরে ধীরে, নিঃশব্দে, ব্লাউজের হুকগুলো খুলতে শুরু করল।

‘He is a sucker with a gun (gun, gun, gun)
I know you told me I should stay away
I know you said he’s just a dog astray
He is a bad boy with a tainted heart
And even I know this ain’t smart
But mama, I’m in love with a criminal
And this type of love isn’t rational, it’s physical
Mama, please don’t

‘এলিজাবেথ গানের সঙ্গে ঠোঁট মেলাতে থাকে আর ড্রেস চেঞ্জ করে। অন্যদিকে রিচার্ড ঘেমে একাকার। যতটা সম্ভব নিজেকে শক্ত করে রাখতে চায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর না পেরে ল্যাপটপ বন্ধ করে দেয়। সে খুব ভালো করেই বুঝতে পারে তার বউ তাকে ধরে ফেলেছে। আগেরবার এলিজাবেথ যে খেলাটা খেলেছিল, এবার রিচার্ডও ঠিক তেমনটাই করতে চেয়েছিল৷ তবে এখন বউ তার জন্য মারাত্মক ডেঞ্জারাস। এলিজাবেথ নিজের কাজে নিজেই হতবাক হয়ে পড়ে। লজ্জা লাগে তার, নিজেও আর পারল না। চলে যায় ওয়াশরুমে। এখানে কোনো ক্যামেরা নেই। ভিতরে গিয়েই ফিক করে হেসে দেয় এলিজাবেথ, তবে হঠাৎ মনে পড়ে সেদিনের কথা। মনে পড়তেই আড়ষ্টতায় ঘিরে ধরে তাকে। সেদিনের পর পরেই, পরের দিন সকালেই, রিচার্ড জানায় যে সে ভিয়েতনাম যাবে। এলিজাবেথের মন খারাপ হলেও সে প্রকাশ করেনি।

‘বিকেলে এলিজাবেথ লনে গিয়েছিল। তাকে লনের দিকে আসতে দেখেই সকল গার্ডরা সরে গিয়েছিল। সেই বিষন্ন বিকালে, নিজেকে প্রকৃতির মাঝে বিলিয়ে দিয়েছিল এলিজাবেথ। ঘাসের উপর শুয়ে সকল কিছুর হিসাব মেলাচ্ছিল। অকস্মাৎ ম্যানশন প্রাঙ্গনের আকাশে একটা হেলিকপ্টারের দেখা মেলে। হঠাৎ, হেলিকপ্টার থেকে পড়ে যায় একটা প্যারাসুটে কালো একটা বাক্সের মতো। মাটি থেকে কিছু উপরে থাকতে বাক্সটা ব্লাস্ট হয়। বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে এলিজাবেথ। হঠাৎ অনুভব করে, ঝরা পাতার মতো তার শরীরের উপর কিছু পড়ছে। মুহূর্তেই তার মাথা ঢাকা পড়ে যায়। চোখ খুলে শরীর ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াতেই বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে যায় এলিজাবেথ। লনের সবুজ ঘাস ঢাকা পড়ে গেছে টাকার নিচে। পুরো বিস্তৃত জায়গা জুড়ে শুধু টাকা আর টাকা। এলিজাবেথ চমকে খাবলে এক মুঠো টাকা হাতে তুলে নিল। এগুলো বাংলা নোট নয়, মিশ্র নোট রয়েছে এখানে।

এলিজাবেথের হাতে মুঠোতেই উঠে এসেছে KHD, BHD, JOD, CHF, USD। নোটগুলোতে চোখ বুলাতেই চমকে ওঠে এলিজাবেথ। এতোগুলা দেশের টাকা, এই প্রথম একসাথে দেখছে সে। তাও নিজের পায়ের নিচে। পুরো বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান কারেন্সির নোট এগুলো।

‘এলিজাবেথকে আরো অবাক করে দিয়ে উপরের দিক থেকে এবার বৃষ্টির মতো টাকা ঝড়তে থাকে। এলিজাবেথ উপরের দিকে তাকাতেই দেখতে পায় হেলিকপ্টারটা ধীরে ধীরে নিচে নামছে। আর রিচার্ড লেন্ডিং স্কিডের উপর দাঁড়িয়ে টাকা ছুঁড়ে দিচ্ছে তার দিকে, ঠিক যেভাবে কবুতরকে ছিটিয়ে গম দেওয়া হয়। এলিজাবেথ সেদিন খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছিল রিচার্ড কেন এসব করছিল। রিচার্ড সেদিন নিজে এলিজাবেথের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল, সামান্য কিছু সম্পত্তি দান করে রিচার্ড কায়নাত’কে পথে বসানোর কথা চিন্তা করা এলিজাবেথের কতটা বোকামি ছিল। এলিজাবেথের বিস্মিত চোখে তাকিয়ে চোখ টিপল রিচার্ড। হঠাৎই সে অধর কোনে বাঁকা হাসি টেনে গলা ছেড়ে গান ধরল। হেলিকপ্টারের পাখার শব্দের স্পষ্ট শোনা না গেলেও এলিজাবেথ আন্দাজ করতে পেরেছিল রিচার্ড কি গান গাইছিল, আর হাত ভরে টাকা ফেলছিল তার উপর। লোকটা তাকে টাকা দিয়ে মুড়ে ভুল ধরিয়ে দিলেও গানের লিরিক্সে অনেক কিছু বুঝিয়ে দিয়েছিল। সেদিন রাগ হয়নি এলিজাবেথের, বরং এর মাধ্যমে আরও অনুভব করেছিল রিচার্ডের নিখাদ ভালোবাসা।

“Ni tu vekhdi taan ja, hale hoi shuruaat
Tere pichhe ki-ki karda
Ni main tere layi kamavaan paisa, tere ‘te udavaan paisa, Baby, mera jee karda ”
‘সেদিন কাহিনি এখানেই শেষ হয়নি। হেলিকপ্টারটা আরেকটু নিচে নামে। হঠাৎ রিচার্ড একটা ভারী সুটকেস ছুঁড়ে ফেলে এলিজাবেথের সামনে। চোখের ইশারায় ইঙ্গিত করে সে যেন সেটা নেয়। এরপর শব্দের ঝড় তুলতে তুলতেই উড়ে যায় হেলিকপ্টার। এলিজাবেথ যেন এখনো ঘোরের মধ্যে। ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে সুটকেসটা খুলতেই দ্বিতীয়বারের মতো তার চোখ বিস্ফারিত হয়ে ওঠে। ডায়মন্ডের দুর্বিষহ ঝলকানিতে চোখ কুঁচকে যায়। কয়েকটা বড়সড় হীরে সরাতেই দেখা গেল বিশ্বের সবচেয়ে নামকরা ব্যাংকের সাদা-সাদা ব্ল্যাঙ্ক চেক। প্রতিটিতেই রিচার্ডের রাজকীয় স্বাক্ষর। যেমন:

— UBS (Switzerland)
— Credit Suisse (Switzerland)
— JPMorgan Chase (USA)
— HSBC (UK)
— Goldman Sachs (USA)
‘সেই সাথে ছিল ড্রাগন গ্রুপের সমস্ত ডকুমেন্টস। আর সবচেয়ে নিচে সোনালী খামে একটা চিঠি রাখা। সেখানে মোটা অক্ষরে লেখা ছিল,
“সময়? সেটা আমি কিনে ভেঙে খাই। তুই শুধু টাকা উড়াবি, ঠিক যেমন মরুভূমিতে ধুলো উড়ে যায়। কামানোর চিন্তা, হিসাবের চিন্তা সব আমার। শুধু কুত্তার মতো বিশ্বাসঘাতকতা করবি না।”
“রিচার্ড কায়নাত যেমন তোমার লাশের খাটিয়া কাঁধে তোলার অধিকার অর্জন করেছে, তেমনই তোমাকে ভালো রাখার দায়ও নিজের হাতে নিয়েছে। আমি আমার সমস্ত অর্পণ করেছি তোমার পদতলে, এখন তোমার পালা বিশ্বস্ততার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার।”
‘সবশেষে অশ্লীল অথচ গর্বিত ইংরেজি বাক্য,
“I Am The Ruthless Trillioner You Can’t Even Dream Of!,,, Money talks Baby Money Talks”

‘রিচার্ড নিজের ডেস্কে বসে ফাইলগুলোতে চোখ বুলাচ্ছিল। হঠাৎ করেই বাইরে থেকে ভেসে এলো চিৎকার-চেচামেচি। মেয়েলি কণ্ঠস্বর। এটা অস্বাভাবিক। আঠারো তলার এই অফিসে কোনো নারী কর্মচারী নেই। কেবল পুরুষেরা। ভ্রু কুঁচকে রিচার্ড দ্রুত মনিটরের সিসিটিভি ফুটেজে চোখ রাখে। দেখে লাড়া একজন গার্ডের সাথে ধস্তাধস্তি করছে। বিধ্বস্ত, ভীত, অগোছালো লাগছে তাকে।রিচার্ড ইন্টারকমে গার্ডকে নির্দেশ দিল,”তাকে ভিতরে আসতে দাও।”
‘লাড়া যেন হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল রিচার্ডের কেবিনে।
রিচার্ড লাড়াকে দেখেও না দেখার ভান করে মন দিয়ে ফাইল গুছাতে থাকে। লাড়া থমকে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে ডেস্কের সামনে দাঁড়ায়। চোখেমুখে কান্নার ছাপ। গলায় জমাট বাঁধা বিষাদ। শব্দেরা বারবার থমকে যাচ্ছে কণ্ঠে। শেষমেশ কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে ফিসফিসিয়ে ডাকে,

“রিদ! ”
‘রিচার্ড একটুও তাকায় না, কণ্ঠে কঠোরতা এনে বলল,
“কল মি মিস্টার কায়নাত।”
‘লাড়া ঠোঁট কামড়ে একফোঁটা হাসি ঝরায়। তবে তাতে কোনো আলো নেই। চোখে ঘন ছায়া জমে আছে।
এক টুকরো নিঃশ্বাসে ভাঙা ভাঙা গলায় বলে ওঠে,
“পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর আর কোমল অনুভূতি হলো কারো প্রেমে পড়া, আর সবচেয়ে কুৎসিত অনুভূতি হলো সেই মানুষটার ভালোবাসা না পাওয়া।”
‘রিচার্ড তখনও মাথা তুলল না। শীতল গলায় বলল,
“অনুভূতিকে সামলে রাখতে শিখলে জীবন সহজ হয়। যেখানে ভালোবাসা নেই, সেখানে প্রত্যাশা রাখা বোকামি।”
‘লাড়ার চোখে জমে থাকা কান্না চকচক করে ওঠে।প্রাণহীন স্বরে বলল,

“ভুল করে ভালোবেসেছিলাম। সেই ভুলের মাশুল আজও নিজের মনকেই দিয়ে যাচ্ছি।”
‘রিচার্ড কোনো জবাব দিল না। লাড়া নিজেই বলল,
“আমি হার মানলে, আমার গল্প এখানেই শেষ!”
‘চোখ তুলল রিচার্ড। নিরেট ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করল,
“হুয়াই ডু ইউ লাভ মি?”
“কজ ইউ আর দ্যা মোস্ট হ্যান্ডসাম এন্ড রিচেস্ট ম্যান আই হ্যাভ ইভার সিন।”
‘দৃষ্টি তৎক্ষণাৎ ফিরিয়ে নিল রিচার্ড। টাই ঠিক করে হাতে থাকা রোলেক্সের ঘড়িতে সময় দেখে জলদগম্ভীর গলায় বলল,
“মুভ অন, লাড়া।”

“মুভ অন?” হঠাৎই তাচ্ছিল্যের হাসি ঝরিয়ে উঠল লাড়া।হাসতে হাসতে চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল, তবুও থামল না তার হাসি। ধ্বংসযজ্ঞ আর পাপাচারের অন্তহীন মরুভূমিতে নিমজ্জিত হয়ে আজ নিঃস্ব সে। হাসি থামিয়ে রিচার্ডের চোখে চোখ রেখে ফিসফিস করল,
“তুমি তো আমার হবেই না, তাহলে যে আমার ছিল তাকে কেন কেড়ে নিলে, রিদ? তোমাকে ভালোবেসে আমি এমন কোন পাপ করেছিলাম, যে আমাকে নিঃস্ব করে দিলে?”
‘রিচার্ড উঠে দাঁড়াল। এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখল লাড়াকে।
মাটিতে লেপ্টে থাকা পোশাক আর ভগ্ন কণ্ঠস্বরই বলে দিচ্ছিল লাড়া ভিতরে ভিতরে ভেঙে পড়েছে। রিচার্ড বুঝতে পারে লাড়া এই মুহুর্তে কোথা থেকে এসেছে। একটা দীর্ঘ ভারী নিশ্বাস ফেলল রিচার্ড। টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে নিস্তরঙ্গ কণ্ঠে বলল,
“তাকে তোমার আগেই সতর্ক করা উচিত ছিল, লাড়া।
রিচার্ড কায়নাতের অস্তিত্ব যারা মুছে দিতে চায়, তাদের অস্তিত্ব সে রাখে না।”
‘লাড়া হেসে উঠল। হাসির ফাঁকে চোখের জল মুছে উদ্ভাসিত দৃষ্টিতে তাকাল রিচার্ডের দিকে। ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠে বলল,

“কখনো কখনো খুব করে ইচ্ছে হয় পরিণতিতার মতো জিজ্ঞেস করি আমায় ভালোবাসলে না কেন, রিদ?”
“অন্যের স্বামীকে ভালোবাসা নিন্দনীয় কাজ।”
‘লাড়া ক্ষীণ হাসি হেসে বলল,”ভালোবাসায় সবাই মহৎ হতে চায়, আত্মত্যাগের গল্প গড়ে… কিন্তু খারাপ কয়জন হয়? আমি হয়েছি, স্বেচ্ছায় হয়েছি। নিজের সমস্ত ইমেজ পুড়িয়ে দিয়েছি শুধু তোমাকে ভালোবাসার জন্য। আর সেই লোকটা তুমি, রিদ। তবুও বুঝলে না আমায়। ইতালিতে আমার সাম্রাজ্য ছেড়ে ছুটে এসেছিলাম শুধুমাত্র তোমার জন্য, রাণী না হই, দাসী হয়ে হলেও ঠাঁই চেয়েছিলাম তোমার চরণে। তবে তুমি? যতটা দিয়ে গেলাম, ততটাই এড়িয়ে গেলে।”
‘রিচার্ড তপ্ত শ্বাস ফেলে কিছু বলতে যাবে তার আগেই লাড়া ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ে। অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে,
“জানিনা কোথায় যাবো, কী করবো… কোথায় গেলে মনের ভেতর হওয়া এই বিশ্রী যন্ত্রণা মুছে ফেলতে পারবো? কাউকে বোঝাতে পারছি না আমি ভালো নেই। এত কষ্ট, এত যন্ত্রণা,আর নিতে পারছি না। এবার আমায় পথ দেখাও, রিদ, না হলে ধৈর্য এনে দাও। আমি ভেঙে পড়ছি।”

‘রিচার্ড ক্রান্ত পায়ে এগিয়ে যায়। নারী তার কাছে বরাবরই ছিল বিধ্বংসী। তাদের কান্না বিষের মতো ছড়িয়ে যেত তার স্নায়ুতে। অথচ এক লাস্যময়ীর প্রেমে পড়ে তার সেই ধারণা ভেঙেছে। শক্ত হৃদয়ে জমাট বাঁধা সুপ্ত অনুভূতিগুলো আজ যেন ছুটে আসছে তাণ্ডব হয়ে। পৈশাচিক মস্তিষ্ক যতই চাইছে সেই অনুভূতিগুলোকে অস্বীকার করতে, তারা ততই দপদপ করে জ্বলছে তার ভেতরে। তামাকের মতো মনও মাঝেমধ্যে ঝড় তোলে, আবার সেই ঝড় ফিরে আসে সেই নারীর কাছেই। তীক্ষ্ণ, গুরুগম্ভীর, অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো তার মস্তিষ্ক আজও মানতে নারাজ এই দুর্বলতাকে। আত্মসমর্পণ করতে চায়নি, অথচ তবু শেষ পর্যন্ত সে হার মানে। নারী আর তার কাছে বিষ নয়। নারীর কান্না এখন তার ভেতরটা পোড়ায়। লাড়ার অশ্রু দেখে আজ তার মনেও জন্ম নিয়েছে একফোঁটা অনুশোচনা। রিচার্ড গিয়ে বসে লাড়ার সামনে।চেনা কঠোরতার বদলে কণ্ঠে ফুটে ওঠে এক গভীর খাদ। ধীরস্বরে বলল,

“লাড়া, উঠো। আমি তোমায় ছুঁতে চাইছি না।”
‘লাড়া বিহ্বলিত দৃষ্টিতে তাকায় রিচার্ডের দিকে। রিচার্ডের মুখে নেই কোনো গর্জন, নেই কোনো রূঢ়তা।
স্রেফ কঠিন নিরেট স্বরে বলল,
“আমি আমার স্ত্রী, এলিজাবেথ ইমরা এরিন-কে খুব ভালোবাসি। আই’ম ম্যাডলি ইন লাভ উইথ হার। তাকে ছাড়া আর কোনো নারীর জন্য আমার হৃদয়ে কোনো জায়গা নেই। আমাকে ক্ষমা করো, লাড়া।”
“কেন আমি নয়, এলিজাবেথ ই?”
‘রিচার্ড শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
“এই সংক্ষিপ্ত জীবন আমি এক নারীর দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। চাইনি, তবুও আমার দৃষ্টি সেখানেই থমকে গিয়েছিল। সে আর কেউ না,সে আমার স্ত্রী।

তার মতো রূপ আর কারও নেই, না ছিল কখনো, না হবে। হয়তো একদিন জন্মাবে তারই গর্ভে, আমাদের ভালোবাসার মিশেলে ফুটে উঠবে এক ফুল। সে হবে এই পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্বোত্তম সুন্দরী।”
‘লাড়া কিছুক্ষণ নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল রিচার্ডের দিকে।
সে আর কী বলবে? কিছু বলার থেকেও যেন নীরবতাই ছিল যথার্থ। কান্না গুলো গিলে নিয়ে ধীরে উঠল লাড়া, সঙ্গে উঠল রিচার্ডও। জোর করে হাসি টেনে লাড়া বলল,
“ডোন্ট ওয়ারি রিদ, আশা করি আমার ছায়া তোমাদের মাঝে ফাটল আনবে না। আমি এখন বোঝাতে পারি হারানোর মানে কী। ভালো থেকো।”
‘রিচার্ড সৌজন্যমূলক হাসিতে মাথা নেড়ে সাড়া দিল।দুজনেই একসাথে বেরিয়ে এল কেবিন থেকে। রিচার্ডের মিটিং শুরু হবে এখনই। কনফারেন্স রুমের সামনে দাঁড়িয়ে লাড়া একগাল হাসি ছড়িয়ে বলল,
“লাভার্স না হতে পারি, বন্ধু তো হতে পারি?”

‘রিচার্ড হাতে হাত মেলাল না, কেবল বলল,”হোয়াই নট!”
‘লাড়ার বুকের ভেতর হালকা একটা চাপা কষ্ট জমে উঠল।রিচার্ডের চোখ হঠাৎ সরে গেল সামনের দিকে। ঠোঁটে ফুটে উঠল এক রহস্যময় হাসি। রিচার্ড এবার হাত বাড়াল। লাড়া চমকে উঠল, তবুও হেসে বলল,”থ্যাঙ্কস হ্যান্ডসাম”বলে হাত মেলাতে যাবে তখনই দূর থেকে ভেসে এলো তীব্র এক চিৎকার,
“Shut up, he is mine.”
‘Louis Vuitton এর হিলের শব্দে ক্রিং ক্রিং করে এগিয়ে আসে এলিজাবেথ। তার চলনে ছিল এক রহস্যময় অনবদ্য আভা যেন প্রতিটি পদক্ষেপেই সময় থমকে যাচ্ছিল। সরাসরি রিচার্ডের কব্জির মধ্যে হাত ঢুকিয়ে গা ঘেঁষে দাঁড়ায় এলিজাবেথ। লাড়া কিছুটা অবাক হয়ে তাকাল। রিচার্ড মাথা ঘুরিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসল। এলিজাবেথ লাড়ার বাড়িয়ে দেওয়া হাতের দিকে চোখ মেলল। অতঃপর অকারণেই নাক-মুখ কুঁচকে গিয়ে, নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল,
“My feet are hurt, honey.”

‘রিচার্ড গালের ভিতর জিভ ঘুরিয়ে তার হাসি চাপা রেখেই এলিজাবেথের সামনে বসে পড়ল। সমস্ত উপস্থিতি ভরা চোখে বিষ্ময়। একে অপরকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে দেখছে। তাদের কাজের হাত থমকে যায়। আকাশ থেকে চাঁদ ধসে পড়ার মতো চমকপ্রদ হয়ে আছে তাদের আঁখিদ্বয়। লাড়া অবাক দৃষ্টিতে দেখল রিচার্ড কি নিদারুণভাবে এলিজাবেথের পা থেকে হিল খুলে হাতে নিয়ে এলিজাবেথকে কাঁধে তুলে নিল। রিচার্ড সোজা হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকাল। তখনই লক্ষ্য করল সকল এমপ্লয় তাদের দিকে তাকিয়ে। রিচার্ড এলিজাবেথের দিকে তাকায়। এলিজাবেথের কাঁধ উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখল।
সঙ্গে সঙ্গে চিবুক শক্ত হয়ে গেল রিচার্ডের। এলিজাবেথ’কে উল্টো দিক ঘুরিয়ে আড়াল করে দাঁড়িয়ে সকলের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলল,

“Everyone is fire, I don’t wanna see anyone in my office.”
‘বলেই রিচার্ড হনহনিয়ে চলে গেল। লাড়া সেদিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তার চোখে যেন এক নিঃসীম দূরত্ব ছিল। রিচার্ডের কাঁধে এলিজাবেথ, রিচার্ডের হাত শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরে রেখেছে এলিজাবেথের কোমড়। সবটাই সে দেখল অদ্ভুত ভাবে। আর দাঁড়াল না লাড়া।কষ্টের পাহাড় সযত্নে বুকে লুকিয়ে আলগোছে বেরিয়ে গেল সে।এদিকে সকল এমপ্লয়দের মুখে ভয় আর হতাশার ছাপ। তাদের এক ঝলক দৃষ্টি আজ তাদের জীবিকা, তাদের ভরসার উৎসকেই যেন কেড়ে নিল।

‘এলিজাবেথ পা ছুঁড়ে মারতে থাকে, অঝোরে ঘুষি পড়তে থাকে রিচার্ডের পিঠে। রিচার্ডের নাকে মৌ মৌ পোড়া গন্ধ ভাসছে আর ঠোঁটের কোণে এক বাঁকা হাসি জমে গেছে। এদিকে এলিজাবেথ রাগে ফুঁসছে।
“অসভ্য লোক! নামান আমাকে! এগুলোই আপনার মিটিং, না?”
‘রিচার্ড তুষ্ট হাসিতে ঠোঁট ভিজিয়ে রাখল। সে স্পষ্ট অনুভব করছে নিজের বউয়ের ভেতরের সেই অনল জ্বলন। কেবিনের দিকে হেঁটে যেতে যেতে রিচার্ড নরম অথচ তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
“ডোন্ট ওয়ারি, রেড। আই’ম নট লোকাল বাস । ইঞ্জিন গরম না হলে গাড়ি চলে না যেমন,তেমনি আমি আকর্ষিত হই কেবল একজনেরই প্রতি। আর তার ছোঁয়ায়ই আমার ভেতর উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে আর পুরো পৃথিবী থেমে যায় শুধু তার একটিমাত্র উপস্থিতিতে।”

‘কিন্তু রিচার্ডের এই প্রেমময় দর্শনও এলিজাবেথের ক্রোধ প্রশমিত করতে ব্যর্থ হলো। সেই মুহূর্তে রিচার্ডের ফোন বেজে উঠল। রাশিয়া থেকে কল আসার কথা। রিচার্ড আর দেরি করল না, এলিজাবেথকে কাঁধ থেকে নামিয়ে দিল। ওর হিল জোড়া এনে পায়ের কাছে রেখে কানে ফোন তুলে একটু সাইডে সরে গেল। এলিজাবেথ দ্রুত হিল পরে নিল। কৌতূহলী চোখে আশেপাশে তাকাতে লাগল। আজ প্রথমবার রিচার্ডের অফিসে এসেছে সে। ভিতরের লাক্সারিয়াস সাজসজ্জা দেখে খানিক মুগ্ধ হলো। তবে মুগ্ধতার মাঝেও চোখে পড়ল এখানেও সেই সিগনেচার রং, কালো। সবকিছুই ঢেকে আছে এক গাঢ়, গভীর কালোতে।
“হেই বিউটিফুল লেডি, হু আর ইউ?”

‘এলিজাবেথ চমকে পিছনে তাকাল। দেখতে পেল কয়েকজন সাহেব টাইপের লোক এগিয়ে আসছে।
এলিজাবেথ তাড়াতাড়ি চুলগুলো সামনের দিকে এনে কাঁধে ছড়িয়ে ঢেকে দাঁড়িয়ে পড়ল। শরীরটাও আঁটসাঁট করে রাখল।লোকগুলোর দৃষ্টিতে একটা অদ্ভুত অস্বস্তি আছে, ভালো ঠেকছে না তার কাছে। ওরা রিচার্ডের বিজনেস পার্টনার । কাতার থেকে এসেছে আজকের মিটিংয়ে যোগ দিতে। লোকগুলো এলিজাবেথের কাছে এসে দাঁড়ায়। নানান রকম প্রশ্ন ছুড়ে দিতে থাকে একের পর এক। এলিজাবেথের চোখ আকুল হয়ে রিচার্ডকে খুঁজছে। কিন্তু রিচার্ড আশেপাশে নেই। চারদিক থেকে প্রশ্নের ঝাঁপটা এলিজাবেথকে অস্থির করে তুলছে। সে শুধু আইঢাই করছে মাঝে মাঝে জোর করে হেসে মাথা দোলাচ্ছে।

‘ ফোন কেটে রিচার্ড এগিয়ে এলো। হঠাৎ দূর থেকে
এলিজাবেথ দেখতে পায় এলিজাবেথ হাসছে লোকগুলোর সঙ্গে, তবে তার হাসিতে স্পষ্ট অস্বস্তির ছায়া। মুহূর্তেই রিচার্ডের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। যেন কোনো অশুভ অভিশাপের অদৃশ্য ছায়া নেমে এলো তার চোখে-মুখে।
“আই’ম সো টায়ার্ড, সো অনলি থ্রি রাউন্ডস ফর টুডে ওকে ওয়াইফি?”
‘বলে এগিয়ে এল রিচার্ড। হেয়ার কাটের জন্য স্পেশাল ফোর্সের প্রশিক্ষিত যোদ্ধার মতো লাগছে৷ এলিজাবেথ চমকে তাকাল। রিচার্ডের এই নতুন রূপ তাকে আরো গভীরভাবে আকর্ষণ করে। দৃষ্টি বারবার টেনে নিতে থাকলেও রিচার্ডের কথায় লজ্জায় সারা শরীর শিউরে উঠল এলিজাবেথের। রিচার্ড এসে গা থেকে কোট খুলে এলিজাবেথের কাঁধে জড়িয়ে দিয়ে কোমরে হাত পেঁচিয়ে দাঁড়াল এলিজাবেথের পাশে। চারপাশের লোকগুলোর চোখে-মুখে বিস্ময়ের রেখা। একজন সাহস করে প্রশ্ন করল,
“হু ইজ শি, মিস্টার কায়নাত?”
‘রিচার্ড কোমরের টানটা বাড়িয়ে এলিজাবেথকে আরো কাছে টেনে নিল। আন্তরিক এক হাসি ছড়িয়ে বলল,
“মাই ওয়াইফ।”

‘বলতে না বলতেই যেন ম্লান হয়ে গেল তাদের মুখাবয়ব।
একজন কৃপণ হাসি নিয়ে এলিজাবেথের দিকে হাত বাড়াতেই রিচার্ডের গর্জন ছড়িয়ে পড়ল,
“Touch her, and I will make you wish you were never born.”
‘লোকটা থতমত খেয়ে গেল রিচার্ডের হঠাৎ স্ফুলিঙ্গ ছড়ানো রোষ দেখে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে সেই স্ফুলিঙ্গে কেরোসিন ঢালার উদ্দেশ্য এলিজাবেথ কুটিল হাসি দিয়ে কাউকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল,
“You look so handsome, mister.”

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৫৯

‘রিচার্ডের চোয়াল মটমট করে উঠল। সে চোখ বন্ধ করে মাথা উঁচু করে দু’পাশে ঘাড় ঘুরিয়ে ক্রোধ সংযমে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করল। শেষমেশ রাগের আঁচর সহ্য করতে না পেরে কঠিন করে চেপে ধরল এলিজাবেথের হাত।
“ওয়াইফি, লেটস গো হোম। বেডরুম আমাদের ডাকছে। ইউ নিড পানিশমেন্ট।”
‘বলে রিচার্ড এলিজাবেথকে টেনে নিয়ে গেল কেবিনের দিকে।পেছন থেকে মিটিংয়ের কথা তুলতেই রিচার্ড শক্ত গলায় ছুড়ে দিল,
“ক্যান্সেল।” তারপর শব্দ করে কেবিনের দরজা বন্ধ করে দিল ।

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৫৯ (৩)