ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৬৩

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৬৩
মিথুবুড়ি

‘গোধুলী লগ্নে প্রেমের গান। প্রকৃতি আজ সেজেছে নতুন রূপে। বাতাসেও প্রেম, প্রেম গন্ধ। প্রেমো, স্নিগ্ধ, শিহরিত
গাঁদাফুলের ঘ্রাণে মাতোয়ারা চারিধার। হৃষ্ট চিত্তে ম্যানশনের স্বচ্ছ, খোলা আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে চড়ুই ছানাগুলো ঝাঁক বেধে হাঁক-ডাক করে। চড়ুইয়ের কিচিরমিচিরকে ছাপিয়ে উঠেছে রমণীদের রিনঝিনে হাসি আর ফিসফিসে আলাপ। চারপাশ জুড়ে হলুদের আবরণ। পোড়া রোদে যেনো গলে গলে পড়ে সোনালি এক স্বপ্ন। পুরো ম্যানশন আজ ফুল আর আলোয় ভরা৷ সাদা ও হলুদের পর্দায়, গাঁদা আর বেলির গন্ধে তৈরি হয়েছে লগ্নের আসন।

‘সেই আসনের কেন্দ্রবিন্দুতে বসে আছে এলিজাবেথ।কনুইয়ের নিচে সাদা কুশন দেওয়া, লেহেঙ্গা হাঁটু অবধি তুলে রাখা। আশেপাশে গার্ডদের উপস্থিত গায়ে লাগার মতো নয়।গায়ে পিংক-হলুদের মিশেলে স্লিভলেস লেহেঙ্গা। মাথা-গলা-কানে কাঁচা ফুলের গহনা। পুরন্ত দুই ঠোঁটে মেহেদী লেগে আছে ঝলমলে অফুরন্ত হাসি। চারজন মেহেদী-শিল্পী একসাথে ব্যস্ত৷ দুজন পায়ে, একজন হাতে মেহেদী দিয়ে রাঙিয়ে তুলছে কনে কে। আরেকজন মেহেদী দিচ্ছে ইবরাতকে। সেও সেজেছে হলুদ লেহেঙ্গায়। হলুদের বাটিটি সামনে রাখা। তবে রিচার্ড এখনও ফেরেনি। তার অপেক্ষাতেই থেমে আছে মূল আচার। তবে এতে অবশ্য কেউ বিরক্ত নয়। কারণ সবার জানা হয়ে গিয়েছে লোকটা তার কথা রাখে। কথা অনুযায়ী তৃতীয়বারের মতো সে তার বঁধুকে ঘরে তুলছে সশ্রদ্ধ সম্মতিতে, সাড়ম্বরে। শহর জুড়ে ঘোষণা দিয়েছে লোকটা তার ভালোবাসার উৎসবের। সবটা যেন একটু বেশি, একটু জমকালো, একটু অনন্য করেই করা হচ্ছে আজ। যাকে বলে বাড়াবাড়ি করে, খুবই বাড়াবাড়ি।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘ক্ষণিক বাদেই আগমন ঘটল রিচার্ডের। সবসময়ের মতোই আজও পরনে কালো পোশাক। কালো প্যান্টের সাথে কালো শার্ট ইং করে পরা। বুক খোলা। দৃশ্যমান হয়ে আছে ঢেউ খেলানো সুঠাম বুক। কাচলে ঠৌঁটে আজ অন্যরকম ভাবসাব। নেই গাম্ভীর্যতা, নেই হিংস্রতা। রাশভারি মুখটাই অনির্বচনীয় উষ্ণ আলো। নিখিল কৃষ্ণ চোখে প্রাপ্তি আবহমান, নির্ভয়ের দীপ্তি। রিচার্ড গিয়ে টানটান হয়ে দাঁড়াল এলিজাবেথের সামনে। লাজুক মেয়েটা চোখ বুজে নিল নিবিড় নৈঃশব্দ্যে।পুরুষটির গা থেকে ভেসে আসা ডার্ক পারফিউমের স্মেলে শরীরের প্রতিটি লোমকূপে, শিহরণ জাগে। রন্ধ্রে, রন্ধ্রে আঁচড়ে পড়ে অযাচিত অস্থিরতা।
“আই ওয়ান্ট প্রাইভেসি।”

‘রিচার্ডের রাশভারি আওয়াজে ইবরাত ঠৌঁট কামড়ে হেসে মেয়েদের নিয়ে ভিতরে চলে গেল। সকলে চলে যেতেই রিচার্ড হাঁটু ভেঙে বসল এলিজাবেথের সামনে। পুরুষটি অভিভূত হল তার সর্বনাশা নারীর অমোঘ সৌন্দর্যে। হলুদের বাটি থেকে তর্জনীতে হলুদ নিল রিচার্ড। সন্তপর্ণে ছুঁইয়ে দিল এলিজাবেথের ললাটে। রুক্ষ, খসখসের আঙুলের তুহিন-তুষার স্পর্শে কেঁপে উঠল আড়ষ্ট রমণীর কায়া। শিরশিরে অনুভূতিতে নিভু চোখে চাইল এলিজাবেথ রিচার্ডের চওড়া তামুকে। সুতীব্র আবেগের তাড়নায় চোখের কোণ ভিজে উঠল। চোখের পানি মোছার অভিপ্রায়ে রিচার্ড চালাতে চাইলে এলিজাবেথ থামিয়ে দিল। দু’পাশে মাথা নাড়িয়ে ভেজা গলায় বলল,
“এটা খুশির অশ্রু।”

‘এক চিলতে হাসল রিচার্ড। তার হলুদ মাখা হাত ছুঁইয়ে দিল এলিজাবেথের গাল, গলা, হাত, পা, উদল। প্রথম হলুদের ছোঁয়া সে নিজ হাতে মেখে দিল পুরো কায়াতে। অতঃপর নিজ গাল ছুঁইয়ে দিল এলিজাবেথের গালের সাথে। হলুদ মাখিয়ে নিল সে নিজেও এভাবেই। রিচার্ডের ভারি, তপ্ত নিঃশ্বাসে কেমন হাঁসফাঁস লাগে এলিজাবেথের। অন্দরমহলে প্রেমের ঝড় ওঠে। দ্রিম, দ্রিম শব্দ ভাজতে থাকে বুকের ভেতর। বেসামাল অনুভূতির সম্মুখীন হয় সে। হিমশিম খেতে থাকে বুকের মাঝে জমা দানা, দানা, সুপ্ত অনুভূতিতে। দু’হাতে খামচে ধরে লেহেঙ্গার ভারি অংশ। মোলায়েম চিবুকখানা দু’হাতের আজলায় আলতো করে চেপে ধরল রিচার্ড। মৃদু স্নিগ্ধ কম্পন হল গাঢ় খয়েরী রঙে আচ্ছাদিত ওষ্ঠজোড়ায়।

“ঠৌঁট কাঁপা বন্ধ কর। বিয়েটা হয়ে নিক, তারপর।”
‘লজ্জায় কপোকাত রমণী তৎক্ষনাৎ কামড়ে ধরল ওষ্ঠপুট, কম্পন ঠেকানোর বৃথা প্রয়াসে৷ রিচার্ড নিস্প্রভ দ্বিধাহীন নজরে চেয়ে থাকে। চোখের পলক ফেলে না। অনুভূতির জোয়ারে ভাসছে অম্তকঃকরণ। এই লাস্যময়ী শীর্ণকায় নারীর স্পর্শে আবিষ্ট হয়ে পড়েছিল সে। যার এক চিলতে হাসি তার শক্ত, ঝংকৃত বুক চিঁড়ে ফুটিয়ে তুলেছিল প্রেমের ফুল। আজ সে তার বঁধু। যাকে সে জয় করতে পেরেছে ভালোবাসায়। নতুন করে, নতুন রূপে ঘরে তুলছে। যেটা অবধারিত হলেও ছিল দূর্বিষহ।
“এই পৃথিবীর সবচে সুন্দরী নারী আমার ঘরে, আমার বউ।”

‘মাথা তুলে না এলিজাবেথ। এবার খুব বিরক্ত হল রিচার্ড। লজ্জা পেলে নারীরা মাথা নিচু করে রাখে কেন? তারা কি জানে না, লজ্জায় তাদের কতটা সুন্দর অপূর্ব লাগে। তাদের লজ্জায় ভেজা রক্তিম গালজোড়া যে পৃথিবীর অপার্থিব সৌন্দর্যের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। কৌশলে গেল রিচার্ড।
“এখনও সময় আছে ভেবে দেখো।”
‘তড়াক মাথা তুলল এলিজাবেথ। তড়িৎগতিতে বলল,”মানে?”
‘রিচার্ড শুয়ে পড়ল এলিজাবেথের উরুর উপর মাথা রেখে। লম্বা পা গুলো ছড়িয়ে রাখল সবুজ ঘাসের উপর। এলিজাবেথের হাত মুঠোয় নিয়ে সরাসরি তাকাল ওর আঁখির মায়াভরা মৃগনয়নী চোখদু’টোতে। শংকিত কণ্ঠে বলল,
“এখনো সময় আছে ভেবে বল বিয়ে করবে কিনা! পরে প্রস্তাবে না তো?”
‘এলিজাবেথের ছটফট জবাব,”না।”
“আমি কিন্তু অনেক জ্বালাবো।”

‘এলিজাবেথের হাত হৃষ্ট চিত্তে ছুটল রিচার্ডের ঘন কালো কেশরাশিতে। সে নির্বিকারে জবাব দেয়,
“আচ্ছা।”
“রাতে একটুও ঘুমাতে দিব না।”
“আচ্ছা।”
“প্রতি রাতে জ্বালাবো !”
“আচ্ছা।”
“আমার আবারো একটা এরিদ কানয়াত চায়।”
“আচ্ছা।”
“একটা রিস্কা কায়নাত চায়!”
“আচ্ছা।”
“একটা ইস্কা কায়নাত চায়।”
“আচ্ছা।”
“আরো অনেককিছু চায়!”
“সব দিব।”
“আর একটা বিয়ে করতে চায়।”
“একবার করে দেখুন না শুধু।”

‘সঙ্গে সঙ্গে তীব্র আপত্তিতে ঝাঁঝিয়ে ওঠে রিচার্ডের গলা চেপে ধরল এলিজাবেথ। রিচার্ড হেসে উঠল। স্পষ্ট, জোরে, শব্দ করে। হাসতে হাসতে তার শরীর কাঁপছে অদ্ভুত এক মুক্তির মতো। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল এলিজাবেথ। চোখে বিস্ময়ের ঢেউ। বুকটা আচমকা কেমন ভারী হয়ে উঠল। এক লহমায় হাত চলে গেল বুকে। ধুকধুক শব্দ করা জায়গাটায় চেপে ধরল জোরে। এই প্রথম! এই প্রথম সে রিচার্ডকে হাসতে দেখল। চেপে রাখা কোনো বাঁকা ব্যঙ্গ নয়, কৃত্রিম ভদ্রতা নয়। একেবারে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া রকম হাসি, ঠিক তেমন। মনখোলা, টোল ফেলা এক হাসি। কি অপূর্ব! কি অচেনা সুন্দর! এতদিন যার চাহনিতে ছিল ঠান্ডা ছায়া। কণ্ঠে ছিল বরফের দেয়াল সে-ই আজ এমন উজ্জ্বল রোদ হয়ে উঠল এতদিন পর। এই দৃশ্যের সম্মুখীন না হলে তো কখনোই তার জানা হত না লোকটার বা গালে টোল পড়ে। এলিজাবেথ নিজের অজান্তেই ফিসফিস করে উঠল,
”পুরুষ মানুষের হাসিও বুঝি এতো সুন্দর হতে পারে?”

‘সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। চারদিকে এক অদ্ভুত মোহময় নীরবতা মেখে ঘন কালো আকাশটা ম্যানশনের খাড়া দূর্গের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। হাওয়ায় এখনও কাঁচা হলুদের গন্ধ। হলুদের প্রোগাম শেষ হয়েছে সবেমাত্র। রিচার্ড বেরিয়েছে বেশকিছু ক্ষণ আগেই। সে গিয়েছে ভেনুতে। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার জন্য রিসোর্ট বুক করা হয়েছে। এলিজাবেথের সারা শরীর দুধে মাখোঁ, মাখোঁ করছে। কেমন চ্যাট-চ্যাটে একটা ভাব গা গুলিয়ে আসার মতো। সে তড়িঘড়ি করে রুমে এসে দোপাট্টা কেবিনেটের উপর রেখে গিয়ে দাঁড়াল ভেনিটির সামনে। শরীর জুড়ে ক্লান্তির ভার। ঘুম পাখিটা বারবার ডানায় পাখা দিয়ে চোখের পাপড়িতে আঘাত করছে, ঘুমোতে বলছে। কিন্তু ঘুমের সময় এখন নয়। আজ রাতেই বিয়ে। এলিজাবেথ অলস ভঙ্গিতে একে একে খুলতে লাগল গায়ের গহনা। হঠাৎ তার চোখ থমকে দাঁড়াল নিজের বুকের উপরিভাগে। এক মুহূর্তের জন্য ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল এক চিলতে হাসি। মনে পড়ে গেল লোকটার কান্ড। তখন রিচার্ড মেহেদি দিয়ে সেখানে লিখে দিয়েছিল—”মিসেস কায়নাত।”

“মাই গর্জিয়াস রেড, আমাকে এক কথায় বর্ণনা কর।”
‘চিরায়ত গুরুগম্ভীর গলায় পিছন ঘুরল এলিজাবেথ। রিচার্ড দরজায় কাঁধ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এলিজাবেথ নির্বিক অবস্থানে থেকে অবিলম্বে আওড়ায়,
“সর্বনাশ।”
‘রিচার্ডের রাশভারী কপাল বিভক্ত হয় দুইভাগে। ভুরু কুঁচকে এলোমেলো হলো। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে চেয়ে বলে,
“হুহ?”
‘এলিজাবেথের সুগভীর চোখ দুটো আশ্লেষে জড়িয়ে রেখেছে রিচার্ডের পা থেকে মাথা পর্যন্ত। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেই সমুদ্র-নীল চোখজোড়ায়। বুকটা কেমন হিম হয়ে আসে লোকটার চেহারা দেখলেই। স্বচ্ছ, উদাস নীল চোখ যে বিদীর্ণ করে ফেলে তাকে। আর ওই কটা অবিন্যস্ত চুল, যা কার্নিশদ্বয়ে পড়েই থাকে অবহেলায়। সেগুলো যেন বরফে ঢাকা পাহাড়ের চূড়োয় গড়িয়ে পড়া নিঃশব্দ তুষার। ওইযে গালের ক্ষতচিহ্নটা তাকে টেনে নিয়ে যায় এক দুর্বার, দুর্মর আকর্ষণের গহ্বরে। ট্যাটু খচিত হাত, গ্রীবা, সুঠাম বুক, শরীর সব মিলিয়ে লোকটা যেনো এক চলমান শিল্পকর্ম। আরেকটিবার রিচার্ডের আপাদমস্তক ভালো করে দেখে নিয়ে এলিজাবেথ নিঃশ্বাস ফেলে ফিসফিস করল,
“আমার সর্বনাশ।”

‘ফিসফিসে কথাটাও রিচার্ডের কর্ণগোচর হল না। তার তো হাঙরের মতো শ্রবণশক্তি। তবুও এলোমেলো দৃষ্টি গিয়ে ঠেকল ঠিক সেই স্পর্শকাতর জায়গায়, যেখানে লেখা—”মিসেস কায়নাত”। অর্থাৎ তার মালিকানা। তার প্রোপার্টি। রিচার্ড শুষ্ক ঢোক গিলল। নিজের অনুভূতির কাছে নিজেকে এক মুহূর্তের জন্য দুর্বল মনে হল। নিজেকে আর সামলাতে পারল না। ডগডগে পায়ে ছুটে এল এলিজাবেথের কাছে। শক্ত হাতে খামচে ধরল মসৃণ কোমড়ের মোহনীয় বাঁক, অপর হাতে চেপে ধরল ঘাড়। এলিজাবেথের পিঠ ঠেকে গেল ঠাণ্ডা দেয়ালে। চকিতে তাকাল রিচার্ডের চোখে। লোকটার সেই চিরচেনা, সর্বনাশা দৃষ্টি। এই দৃষ্টি তার চেনা, বড্ডা চেনা। সে জানে এই ভয়ংকরী দৃষ্টি কিসের ইঙ্গিতপূর্ণ। ততক্ষণে এলিজাবেথের তলপেটে উড়ে গেল একঝাঁক প্রজাপতি। রিচার্ড যখন ঠোঁট এগিয়ে আনছে, এলিজাবেথ মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নিঃসাড় গলায় বলল,

“বিয়েটা হয়ে নিক?”
“দু’বার হয়েছে।”
‘রিচার্ডের হাত ততক্ষণে অনিয়ন্ত্রিত। ছুটতে চলেছে এলোমেলো পথ ধরে বেগতিক ঢেউয়ের সমান্তরাল তালে। এলিজাবেথ টের পায় তার লেহেঙ্গার ফিতার বাঁধন গুলো ধীরে ধীরে আলগা হয়ে যাচ্ছে। গভীরভাবে সে অনুভব করল অবাধ্য হাতের বিচরণ নিজ অস্তিত্বে। অনুভূত হল লোকটা কিভাবে ছলাকলা কৌশলে তাকে তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যাচ্ছে। ঝড় তুলছে তার নারীত্বে। ভারি হতে থাকে নিঃশ্বাস, দূর্বল হয় দৃঢ়তা। চিনচিনে ব্যাথায় শিউরে উঠে ক্ষণে, ক্ষণে। হঠাৎই রিচার্ড এক লহমায় টেনে খুলে ফেলল পিংক আর হলুদরঙা স্কার্ট টি। অতঃপর সঙ্গে সঙ্গে মিশিয়ে নিল নিজ অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সাথে একদম অষ্টেপৃষ্ঠে। তিরতির করে কাঁপতে থাকে এলিজাবেথ। কখন যে রিচার্ড তাকে কেবিনেটের উপর বসিয়ে দিল তা টেরও ফেল না ঘোরের মধ্যে। সম্বিৎ ফিরে তখন, যখন বেল্টের ধাতব অংশের ক্রাং শব্দ কর্ণগহ্বরে পৌঁছায়।
“একটু পর তো,,,
‘কথা সম্পূর্ণ করতে পারল না এলিজাবেথ। রিচার্ড দোপাট্টা টা হাতে তুলে নিল। অতঃপর ক্ষুব্ধ ভাবে দু’হাতের মুঠোয় চেপে ধরল এলিজাবেথের শীর্ণ হাতদুটো। হঠাৎই তার অধর হেলে পড়ল এক কোণে রহস্যময় হেসে। খুব কাছে, খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে হিসহিসিয়ে বলল,
“ইট’স টু লেট রেড।”
‘উদ্ধত ঠোঁটের শীতল আর্দ্রতায় কন্যার দেহ-দর্পণে উঠলো আলোড়ন। যেনো বর্ষার রাতে ঝরে পড়া কদম্বফুলের নিঃশব্দ কম্পন। শিউলি-গন্ধে ভরে উঠল তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে।শিহরনে পত্র-পল্লব কাঁপে যেভাবে, তেমনি কাঁপলো তার অস্তিত্ব। তনুর তারে বেজে উঠল দুর্বার কামনাব্যঞ্জনা। দেহজুড়ে জেগে উঠল নিঃশ্বাসে দগ্ধ এক বিস্ময়-দাহ। কণ্ঠস্বর জমে রইল গোপন গহ্বরে আর অনুভবের অতল স্রোতে। বিলীন হলো সব শব্দ, সব স্বত্বা।

“এই চোখে কি আছে?”
‘ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে এলো মেয়েলি স্বর,”এই চোখে আছে এক সমুদ্র প্রেম।”
‘লুকাস হাসল, “এই কালার জন্য?”
“গায়ের রং—সাদা, কালো তো গায়েই লেগে থাকে। তবে ভালোবাসাই একমাত্র জিনিস, যা হৃদয় ছুঁয়ে দিতে জানে। আর আমার কালার ভালোবাসা প্রতি মুহুর্তে, মুহুর্তে আমার হৃদয় ছুঁয়ে দেয়।”
‘সুইটির কথায় লুকাসের ঠোঁটে ছড়িয়ে পড়ল উদ্দাম আনন্দের ছায়া। সে মুগ্ধ হয়ে তাকাল সুইটির মায়াভরা মৃগনয়নী চোখ দু’টোর দিকে। মৃদু কণ্ঠে বলল,
“যতটা ভালোবাসি, তার একচিলতে প্রকাশও করতে পারিনি এখনও। তবু তুমি এমন গভীরভাবে অনুভব করো কীভাবে, পূর্ণিমা?”
‘ফোনের স্ক্রিনে স্পষ্ট ফুটে উঠল সুইটির লাজুক হাসি। সে ধীরে মাথা নিচু করল। বলল,

“ভালোবাসা প্রকাশের নয়, অনুভবের বিষয়।”
“তোমায় একটু বেশিই ভালোবাসি, পূর্ণিমা।”
“অমাবস্যার আঁধারে তলিয়ে যাওয়া একটা মানুষকে যদি কেউ নিঃশর্ত ভালোবাসে আর তার নাম ধরে আদরে ‘পূর্ণিমা’ ডাকে, তবে তাকে ভালো না বেসে থাকা যায়? খুব, খুব করে ভালোবাসি তোমায়, জনাব।”
“আসছি আমি। খুব শিগগিরই তুলছি তোমায় আমার ঘরে।”
‘সুইটি ঠৌঁট চেপে হাসল। সেই হাসির কারণ রহস্যময়। শুধু বলল,”আমি অপেক্ষায় রইলাম।”
“তোমার আর বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না গো পূর্ণিমা। অপেক্ষার এই পালা শেষের পথে। আমার মনে হচ্ছে, বস ভেতরে ভেতরে কিছু একটা প্ল্যান করছেন, আমাকে কিছু বলছেন না। তবুও, আশা রাখছি খুব শিগগিরই আমাদের মিলন ঘটতে চলেছে।”
‘হাসল সুইটি। ঠোঁটের কোণে লেপ্টে থাকা পূর্ণতার আভাসে মিশে ছিল এক অপূর্ব নিশ্চিন্তি। চোখে ভেসে উঠছিল অনাগত এক মিলনের আলপনা। লুকাস ফোনটা বিছানায় রেখে উঠে দাঁড়াল,”দাঁড়াও, তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। দেখাচ্ছি এখনই।”

‘বেডসাইড টেবিল থেকে জুসের গ্লাস তুলে নিয়ে কেবিনেটের দিকে এগোতে এগোতে দুই চুমুক খেলো লুকাস। গ্লাসটা রেখে কেবিনেটের ভেতর থেকে বের করল এক লাল টুকটুকে জামদানী শাড়ি। মুখজুড়ে উদ্ভাসিত হাসি। দগদগে সাদা দাঁতগুলো আনন্দে ঝিকিমিকি করছে। শাড়িটা হাতে নিয়ে বেডের দিকে এগোতেই আচমকা শরীর টলে উঠল। মুহূর্তেই পা থেকে মাথা পর্যন্ত যেন এক অদৃশ্য শীতলতা ছড়িয়ে পড়ল। হঠাৎ মুখ দিয়ে ফেনা বের হতে লাগল। নিঃশ্বাস আটকে আসছে। শরীরের প্রতিটি কোষ কেঁপে উঠছে ব্যথায়। রগগুলো যেন এক এক করে ফেটে যাচ্ছে। পরের মুহূর্তেই লুকাস মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। ভারী শব্দে কেঁপে উঠল কক্ষ। ফোনের ওপাশে সুইটি শিউরে উঠল। আতঙ্কিত কণ্ঠে ডাকল,
“হ্যালো! হ্যালো! কি পড়ল ওটা?”

‘কিন্তু ওপাশে ছিল শুধু নিস্তব্ধতা আর লুকাসের ছটফটানি। সাপের বিষক্রিয়া ততক্ষণে তার রক্তনালিতে ছড়িয়ে গেছে। ফেনায় ভেসে যাচ্ছে মুখ। চোখের মনি রক্তবর্ণ হয়ে উঠেছে। লুকাস উঠে দাঁড়াতে চাইলেও পারল না। তার শক্তিশালী দেহ ততক্ষণে নিস্তেজ। ছটফট করার সুযোগও মিলল না। খোলা চোখেই থেমে গেল তার সমস্ত যুদ্ধ।
‘এই সুস্থ, সবল বক্সার লুকাসকে সরাসরি মুখোমুখি যুদ্ধে হারানো সম্ভব ছিল না। তাই এই ছলনা। নিঃশব্দে শরীরে সাপের বিষ প্রয়োগ করে তাকে শেষ করে দেওয়া হল। অস্ত্র হাতে লড়াই হলে সে এখন রাজ করত যুদ্ধের ময়দানে। কিন্তু আজ? ছলনার কাছে হারল লুকাস। লুকাস চিরতরে চলে গেল। পৃথিবীর মায়া ফেলে, সুইটির ভালোবাসার বাইরে, এক গভীর নীরবতার দিকে। সুইটি জানতেই পারল না কিছু। লাল জামদানী আর গায়ে জড়ানো হল না। এই আখ্যানধর্মী রচনায় মিলন হল না তাদের। সে কাঁপা কণ্ঠে ডেকে যাচ্ছিল শুধু,

“হ্যালো? হ্যালো? এই কালা?”
‘কিন্তু মৃতেরা তো আর কথা বলে না। বাকশক্তি শুধু জীবিতদের জন্য। আর সেই জীবিতেরাই কৌশলে কেড়ে নেয় অন্যের বাকশক্তি, শ্বাস, স্বপ্ন। সুইটি এবার আর পারল না নিজেকে ধরে রাখতে। কান্নায় ভেঙে পড়ল। ডেকে যেতে থাকল বারবার,
“হ্যালো… হ্যালো… এই কালা? প্লিজ কিছু বলো !”

‘উপরে তাকাতেই চোখাচোখি হল দু’জনের। রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে এলিজাবেথ, নিচে রিচার্ড, হাতে ধূসর শপিং ব্যাগ। দৃষ্টির রেখায় টেনে আনল এক কোমল হাসি। তাদের ঠোঁটের কোণে লেপ্টে আছে পূর্ণতার আভাস,চোখে অনাগত ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি। রিচার্ড হেসে তাকাল তারপর নিঃশব্দে পা বাড়াল লুকাসের রুমের দিকে। পেছনে রয়ে গেল বিস্ময়ে অভিভূত এলিজাবেথ। তার চোখে ভাসে গর্বের নীরব দীপ্তি।
‘আজ তাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পেতে চলেছে। এই উপলব্ধির গভীরে সে টের পেল নিজের মূল্য। সে-ই এলিজাবেথ, যে এক সময় রিচার্ডের জীবনে ছিল নিঃশব্দ ছায়া আজ সে-ই রিচার্ডের আনন্দের কেন্দ্রবিন্দু। যে-রিচার্ড কোনোদিন কালো ছাড়া কিছু পরেনি, আজ তার গা-ঢাকা কোটের নিচে শুভ্র এক শার্ট। কেবিনেট সজ্জিত চৌষট্টি কালো শার্টের মধ্যেও আজ স্থান পেয়েছে সাদার কোমলতা। আর যে-রিচার্ড কখনো প্রাণ খুলে হাসেনি, আজ সে-ই হাসছে হৃদয়ের খোলা জানালায় দাঁড়িয়ে। একদিন বলেছিল সে—সেদিনই রঙ পাল্টাবে, সেদিনই প্রাণ খুলে হাসবে,যেদিন হবে তার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন। এলিজাবেথ অনুভব করল আজ সে-ই সেই আনন্দ। এই ভাবনায় বুকে বয়ে যায় এক উষ্ণ হাওয়া, ভালোবাসার এক অনন্ত পূর্ণতা।

‘রিচার্ড লুকাসের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে। কয়েকবার নক করার পরও ভেতর থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে ধীরে দরজাটা ঠেলে দিল ভেতরে।ভেতরে ঢুকেই থমকে গেল রিচার্ড। লুকাস মেঝেতে পড়ে আছে, মুখে জমাট বাঁধা সাদা ফেনা। দেহে নিথর নিস্তব্ধতা। রিচার্ডের হাত থেকে শব্দ করে নিচে পড়ল শপিং ব্যাগটা। ভেতর থেকে গড়িয়ে বেরিয়ে এলো একখানা শেরওয়ানি। আনন্দের পূর্বলিপি, যা মুহূর্তে রূপ নিল শোকের প্রতিচ্ছবিতে। সব কিছুই প্ল্যান করা ছিল। বিয়ে সম্পূর্ণ করে আজ ভোরের ফ্লাইটেই তারা উড়ে যেতো তামিলনাড়ুতে। সেখানে লুকাস আর সুইটির বিয়ের সকল আয়োজন করা হচ্ছে। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলেই তারা তিনজন একসাথে হানিমুনে প্যারিসে যেতো।
‘রিচার্ড বোকা নয়। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুঁয়ে গেল রুমের কোণ।
সবার আগে চোখ আটকাল জুসের গ্লাসে। গলা যেন হঠাৎ করেই শুকিয়ে এলো। শক্ত করে ঢোক গিলে রিচার্ড ডাকল,
“লোকা?”
‘কোনো সাড়া নেই। রিচার্ড আবার ডাকল একটু জোরে, একটু উদ্বিগ্নে,”লোকা?”
“লুকাস?”
‘তবু নিস্তব্ধতা। চোখ খোলা, অথচ প্রাণহীন দৃষ্টিতে শুয়ে আছে লুকাস। রাগ যেন হঠাৎ করে গড়িয়ে এলো রিচার্ডের গায়ে। রিচার্ড এবার গলা চড়িয়ে বলল,
“এই লোকা?”
‘তবুও চুপ লুকাস। রিচার্ড এক তেড়ে গেল লুকাসের কাছে। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে কাঁপা হাতে আঙুল বাড়িয়ে দিল নাকের কাছে। নেই! নিঃশ্বাস নেই! কোনো স্পন্দন নেই। রিচার্ডের মুখ মুহূর্তেই বিবর্ণ হয়ে গেল। অযাচিতভাবে গলা কেঁপে উঠল। চোখে জমে উঠল কিছু অস্পষ্ট ভয় ও ক্রোধের রেখা। রিচার্ড পরপর ঢোক গিলে ধীরে তীব্র কণ্ঠে শাঁসালো,

“লোকা, আই ওয়েল সুট ইউ, ব্রিথ রাইট নাও।”
‘কিন্তু সেই হুমকি বাতাসে মিলিয়ে গেল। লুকাস তখনও শুয়ে নীরবতার মাঝখানে। এরইমধ্যে রিচার্ডের কানে ভেসে এল সুইটির ক্রন্দন। মেয়েটা বারবার ডেকে যাচ্ছে। গলায় শুধু ভাঙা আশা। রিচার্ড তাকাল বিছানার ওপরে অবহেলায় পড়ে থাকা ফোনটার দিকে। কল চলছে এখনো, কান্না থেমে নেই। রিচার্ড হাত রাখল লুকাসের কাঁধে। এবার নরম গলায় বলল,
“লোকা, এই লোকা? তুমি নিঃশ্বাস আটকে রেখেছ, তাই তো?”
‘চোখের পাতা কাঁপে না। দেহে নেই কোনো সাড়া।
রিচার্ড অনবরত ঢোক গিলছে। সে বলে চলে,
“লোকা, উঠো। তোমার কিছুই হতে পারে না।”
‘থেমে যায় রিচার্ড, যেন নিজেকে বুঝিয়ে ওঠার চেষ্টা করে।
“আমি সুইটিকে কথা দিয়েছি, লোকা। আমি কখনো আমার ওয়াদা ভাঙিনি। তুমি উঠো। তোমাকে উঠতেই হবে। এসব নাটকের কোনো মানে হয় না। আজ সকালেই আমরা যাচ্ছি। তোমার বিয়ে, সব আয়োজন করা আছে। আমার দায়িত্ব পালনের আগেই তুমি কোথায় চলে যাচ্ছো?”

‘কিন্তু লুকাস উঠে না। সে শোয়েই থাকে নিস্তব্ধ, ঠান্ডা শরীরে। রিচার্ডের কণ্ঠ এবার জড়িয়ে আসে। কাঁপা শব্দে বলে,
“লোকা, মেয়েটা অপেক্ষা করবে। আমি কথা দিয়েছি,, আমি…
‘হঠাৎ করেই চিৎকার করতে থাকে রিচার্ড,
“লোকা! তোমার এখনো এত সাহস হয়নি, যে আমার কথা অমান্য করবে! আমি তোমাকে ঠিক দুই মিনিট দিচ্ছি। উঠো, এখুনি উঠো! নইলে আমি,,, আমি কিন্তু তোমাকে শুট করতে বাধ্য হবো! আমি তোমাদের এমন ট্রেনিং দিইনি। সামান্য বিষের বিষক্রিয়াই এভাবে হারিয়ে যেতে পারো না তুমি।”

‘ন্যাসো পাশ দিয়েই যাচ্ছিল। রিচার্ডের হুংকারে ছুটে এলো। দরজার চৌকাঠে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল রিচার্ড বিধ্বস্ত, পাথরের মতো বসে আছে। আর লুকাস নির্জীব দেহে শুয়ে আছে। মুখে ফেনার দাগ, ঠোঁটে নীলচে ছায়া। ন্যাসো দৌড়ে গেল লুকাসের কাছে। হাত রাখতেই যেন সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। কি ঠান্ডা। নিথর। বিষাক্ত নিস্তব্ধতা। মরুভূমির বুকে যেন হঠাৎ বৃষ্টি নেমে এলো। ভেঙে পড়ল ন্যাসো। মাথা রাখল প্রিয় বন্ধুর বুকে, তার বিশ্বস্ত সঙ্গীর বুকে। চোখে জমে থাকা বছরখানেকের কান্না আজ ঝরে পড়ছে।
‘রিচার্ড যেন আজ শিশু। ভয় পায়, বোঝে না, মানতে চায় না। সে আবারও চিৎকার করে উঠল,

“লুকাস?”
‘ন্যাসো ভেজা গলায় আওড়ায়,”লোকা আর উঠবে না বস।
ছেড়ে চলে গেছে আমাদের।”
“অসম্ভব।”
‘রিচার্ড ঝুঁকে টেনে ধরে লুকাসের হাত। ক্লান্ত, স্তব্ধ গলায় বলে,
“লোকা, অভিনয় করছ তাই না? দিনকে দিন তো পাক্কা অভিনেতা হয়ে যাচ্ছো! তুমি জিতলে, হ্যাঁ, অভিনয়ে তুমি সেরা। তাহলে এবার উঠো। আমার ভেতরে কেমন যেন হাহাকার হচ্ছে। এসব আমি নিতে পারি না। ছটফট করা, কাঁদা, পাগলামো করা, এসব আমার সাথে যায় না তুমি জানো।”
‘তবু লুকাস চুপ। রিচার্ড আবার বলে,

“এই লোকা? উঠবে না? এই বিয়ে নিয়ে তো সবচেয়ে বেশি এক্সাইটেড তুমি ছিলে! তুমি সাক্ষী হতে চেয়েছিলে আমার বিয়ের। কাল রাতেও এলিজাবেথকে কথা দিয়েছিলে, তুমি তার ভাই হবে। সে এতিম না। আমাদের সম্পর্ক তো পালটে গিয়েছে। লোকা নিঃশ্বাস নাও। আমার চলবে না তোমাদের ছাড়া। আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করো না, প্লিজ। প্লিজ উঠো। একটুখানি হাসো, রাগ করো, চিৎকার করো কিন্তু নিঃশব্দ থেকো না, লোকা, নিঃশব্দ থেকো না। তোমাকে আর আমার সাথে থাকতে হবে না। তোমাদের অনেকদূরে পাঠিয়ে দিব আমি। সুন্দর একটা জীবন দিব।”
‘ন্যাসো ধীরে মাথা তুলল লুকাসের বুকে রাখা মাথাটা।
সে গিয়ে তুলে নিল লুকাসের ফোন। স্ক্রিনজুড়ে এখনো কাঁদছে সুইটি। মেয়েটার চোখমুখ লাল। গলায় কি অসহায়ত্বের কান্না। ন্যাসো নত স্বরে বলল,
“লুকাস আর আমাদের মধ্যে নেই। ক্ষমা করো আমাদের, প্লিজ।”

‘তারপর যা হল তা যেন বিস্ফোরণ। রিচার্ড ছুটে এসে ফোনটা ছুঁড়ে মারল মেঝেতে। চেপে ধরল ন্যাসোর কলার,
“এইভাবে কি করে মরতে পারে? তোমরা জানো না, তোমাদের ছাড়া আমি কতোটা নিঃসঙ্গ?”
‘ন্যাসো হঠাৎ জড়িয়ে ধরল রিচার্ডকে। ছেলেটা শব্দ করে কাঁদছে। ভাঙা কণ্ঠে বুকের ভেতর ফুঁপিয়ে উঠছে একটা যুগের সমাপ্তি। রিচার্ড ধাক্কা দিয়ে আলাদা হল। তার ভেতরে কেমন দমবন্ধ যন্ত্রণা। সে ছুটে গেল লুকাসের দিকে। নির্জীব বন্ধুটার মাথাটা তুলে নিল নিজের কোলে। কাঁপা কণ্ঠে বলতে থাকে,,
“লোকা, উঠো। আমার ভাই নেই, লোকা। সে আমার কেউ না। তোমরাই ছিলে আমার পরিবার। আমার দ্বিতীয় পরিবার এই এতিমের সবটুকু পৃথিবী ছিলে তোমরা। আজ আমি সুখের দিকে পা বাড়াচ্ছি, তুমি না দেখে চলে যেতে পারো না। গেট আপ লোকা, প্লিজ।”

‘কিন্তু লুকাস কিছুই শুনতে পায় না। মৃতরা কখনো শুনতে পায় না। এই চূড়ান্ত সত্য মেনে নিতে হয় সবাইকে। আজ মেনে নিল রিচার্ডও। সে বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে ডাকল,
“ন্যাসো!”
“জি বস!”
“এরজন্য কি আমি দায়ী?”
“জি বস ”
‘রিচার্ডের চোখ রাঙালো। কণ্ঠ গর্জে উঠল তৎক্ষনাৎ,
“ছাড়ব না, কাউকে না আমি। সব ধ্বংস করে দেব।
ওর লাশ যেন এখানেই থাকে। লোকা তোমার শেষ গিফট নিয়ে আসছি আমি।”
‘লুকাসের খোলা চোখ দু’টো আলতো করে বন্ধ করে দিল রিচার্ড। অতঃপর নিঃশব্দে ঠৌঁট ছোঁয়াল কপালে। ফোঁস করে একটা দীর্ঘ শ্বাস নিল তীব্র, আগুনভরা এক প্রতিজ্ঞার মতো। তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ লুকাসের ফ্যাকাসের মুখে। দীর্ঘক্ষণ চেয়ে লুকাসের মাথাটা নিচে রেখে উঠে দাঁড়াল,

“আমি আসছি, লোকা।”
‘লিভিং রুমে আবারো মুখোমুখি দু’জন। এলিজাবেথ রেডি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সাথে ইবরাত। তারা এখন রিসোর্টে যাবে, যেখানে বিয়ে হবে। রিচার্ড’কে দেখে এলিজাবেথ এগিয়ে এল। উদগ্রীব কণ্ঠে জানতে চাইল,
“কি হয়েছে? আপনার চোখমুখ এমন লাগছে কেন?”
‘রিচার্ড হাত রাখল এলিজাবেথের কাঁধে। পিছন ফিরে ন্যাসোর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
“ওদের রিসোর্টে নিয়ে যাও।”
‘ন্যাসো নিজেকে সামলে নিয়ে মাথা নাড়াল। রিচার্ড একহাতে আঁকড়ে ধরল এলিজাবেথের নরম চিবুকখানা। শীর্ণ স্বরে বলল,
“লাল টুকটুকে বউ সেজে অপেক্ষা করবে আমার জন্য। কি পারবে না?”
‘এলিজাবেথের মন বলছে কিছু একটা হয়েছে। রিচার্ডের শূন্য অভিব্যক্তি তার কাছে ঠিক ঠেকছে না। তবুও সে নিঃশব্দে মাথা নাড়াল। রিচার্ড শব্দ করে চুমু খেল এলিজাবেথের ললাটে।
“আসছি আমি।”
‘অজানা উদ্বেগ চেপে বসল এলিজাবেথের ভিতরে। পিছন থেকে টেনে ধরল রিচার্ডের হাত। রিচার্ড গ্রীবা বাঁকিয়ে তাকাল এলিজাবেথের নির্মল চেহারায়। নিস্পৃহ চোখে চোখ রেখে ভারি কণ্ঠে বলল,
“হরিণের চোখ সুন্দর,তবুও বাঘ তার প্রেমে পড়ে না, শিকার করে খায়। তোমার এই দৃষ্টি আজ আমাকে যতই ঘায়েল করুক,আমাকে আটকাতে পারবে না। আমি আসছি।”
‘হনহনিয়ে চলে গেল রিচার্ড। হিম হয়ে আসে এলিজাবেথের বুক।

‘গভীর রাত। শহরের উপেক্ষিত কোণে একটি পোড়োবাড়ির অন্ধকার ঘরে রিচার্ড অপেক্ষা করছিল। স্বচ্ছ নীল চোখ দু’টোতে ছিল নিস্তব্ধ কঠোরতা। অথচ ভেতরে ছাইচাপা আগুনের মতো জ্বলছিল উন্মাদনা। রেহান— দুর্ভাগা যুবক কিছুই টের না পেয়ে পা রাখল সেই ঘরে। পা রাখার পর মৃত্যুর আগে আর আলো দেখেনি সে। দরজা বন্ধ হতেই রিচার্ড চিৎকার করে উঠল পশুর মতো। ঝাঁপিয়ে পড়ে রেহানের উপর। রিচার্ড চা”পা’টি”টা টেনে বের করল নিঃশব্দে পেছন থেকে। একটুও সময় না নিয়ে সোজা কণ্ঠনালির বরাবর বসিয়ে দিল কোপ। এক কোপেই রেহানের মাথা গড়িয়ে গিয়ে পড়ল মেঝেতে। রিচার্ডের চোখে তখন শুধু ভাসছিল লুকাসের মৃতদেহ। রিচার্ড তেড়ে গেল ছিন্ন মাথাটার দিকে। হাঁফাতে হাঁফাতে কোপাতে থাকল খু’লি”তে বারবার। হিংস্রতা দিয়ে নয়, বেদনাতাড়িত উন্মাদনায়। আর বলতে থাকল গলাচিরে,

“আমি আমার মায়ের লাশ দেখিনি,
আমি আমার বাবার লাশ দেখেছি।
আমি আমার সন্তানের লাশ দেখিনি,
আমি আমার ভাইয়ের লাশ দেখেছি!”
‘রিচার্ডের চোখে জ্বলছে অস্বাভাবিক লালচে ছায়ায়। চোখের দৃষ্টিও কেমন ঝাপসা। বাস্তব ও বিভ্রম মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। কোপের বেশিরভাগই পড়ছে ফাঁকা মেঝেতে। তবু থামছে না রিচার্ড। কুপিয়েই যাচ্ছে অনবরত আর অদ্ভুত ভাবে গোঙাচ্ছে।

‘তারপর শুরু হয় আসল নরক। রিচার্ড ছুটে গেল মাথা বিহীন রক্তস্নাত নির্থর দেহের কাছে। পা বিছিয়ে বসে পড়ল লাশের পাশে। হাত দিয়ে চিরে ফেলে রেয়ানের বুকের খাঁচা, হাঁড় ভেঙে ফাঁক করে তোলে। দৃষ্টি তখন শুধু স্থির রেহানের কলিজায়। থরথর করা সেই টুকরোটা নিজের হাতে টেনে তোলে আনে রিচার্ড। রক্ত টপটপ করে গড়িয়ে পড়ে তার কনুই বেয়ে। রিচার্ড নিঃশ্বাসে টেনে নেয় সেই তাজা মৃত্যুর গন্ধ। এরপর রেহানের দেহ টুকরো টুকরো করে কাটে। পায়ের পেশি, বাহুর মাংস,গলার চারপাশের স্নায়ু সব কেটে কেটে ছড়িয়ে দেয় ঘরের চারদিকে।

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৬২ (২)

দেয়ালে ছিটিয়ে দেয় রক্ত। আঁকে এক বিকৃত ছবি মৃত্যু আর উন্মাদনার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা শিল্পীর মতো। শেষে নিথর, হাড়সুদ্ধ মাংসের স্তূপটাকে দেখে একটু হেসে ওঠে রিচার্ড। অথচ তার চোখে কালো মেঘের ঘনঘটা। রক্তের তপ্ত স্রোত হতে উঠে দাঁড়ায় রিচার্ড। রক্তমাখা চা”পা’তি:টা চেপে ধরল দাঁতের মাঝে। চোখ থেকে আগুন বিচ্ছুরিত হচ্ছে দাউদাউ করে। রিচার্ড আবারো চা’পা”তি’টা গুঁজে রাখল পিছনে। অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে রেহানের খন্ড, খন্ড মাংসের টুকরো গুলো। ঠৌঁট নাড়িয়ে গুনল সে। পরপরই ঠৌঁটের কোণে ফুটে উঠল পৈশাচিক হাসি। হঠাৎ করে রিচার্ড উন্মাদের মতো মাথা শূন্যের তুলে চিৎকার করে উঠল। বুকের গহীন থেকে ক্ষতের আতর্নাদ চিৎকার দিয়ে বেরুলো,
“লোকা, আমার ভাই।”

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৬৩ (২)