ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৯
মিথুবুড়ি
‘সময়ের অমোঘ প্রবাহ বয়ে যায়। সেই সুন্দর সকালের পর আজ সাতদিন। রিচার্ড কোথায় যেন হঠাৎ করে লাপাত্তা হয়ে গিয়েছে। সেই দিন সকালে যে বের হলো,তারপর আর ফেরেনি । এতে অবশ্য কারোর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। বরংচ রিচার্ড না ফেরায় সবথেকে খুশি এলিজাবেথ। মনেপ্রাণে সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া করছে আর কখনো যেন না ফিরে। কোনোদিনও যেন সেই নরখাদকের মুখ না দেখতে হয়।
‘এলিজাবেথ কিছুদিন ধরে নিস্তব্ধ এক শান্তির মাঝে দিন কাটাচ্ছে। লোমহর্ষক রাতগুলোর হিংস্র ছায়া আপাতত দূরে। কারো ক্ষোভ বা অত্যাচারের শিকার হতে হচ্ছে না। তবে মুক্তি পায়নি বন্দি জীবনের শেকল থেকে। রিচার্ড যদিও নিজে বাগানবাড়িতে নেই, তবুও রেখে গিয়েছে তার দুই বিশ্বস্ত সেনাপতির একজনকে—লুকাস। তার দায়িত্ব একটাই এলিজাবেথ যেন রুম থেকে বাইরে পা রাখতে না পারে। রিচার্ডের কড়া নিষেধাজ্ঞা লুকাসের হাত-পা বেঁধে রেখেছে। এলিজাবেথের রুমের দরজা সবসময় বাইরে থেকে লক থাকে। খাবারও রুমেই পৌঁছে দেওয়া হয়।
‘এই সাতদিনে লুকাসকে একবারও চোখে দেখেনি এলিজাবেথ। রেশমা লুকাসের কাছে অনুরোধ করেছিল এলিজাবেথ’কে একটু বাইরে বের করতে দেওয়ার জন্য। বারবার চার দেয়ালের মাঝে আটকে থাকতে থাকতে এলিজাবেথের দমবন্ধ লাগছ। কিন্তু লুকাস রিচার্ডের নির্দেশ অমান্য করার সাহস করেনি। রিচার্ডের আদেশ যেন একটা অদৃশ্য শেকলের মতো লুকাসের হাতে পায়ে বেঁধে রেখেছে।যে শেকল ছিঁড়ে ফেলার ক্ষমতা তার নেই।
‘লুকাস আজ ইচ্ছে করেই সোফার মধ্যে শুয়ে চোখ বুজে আছে। যেন বোকার জাত নারী ভাবে সে ঘুমিয়ে আছে। যেই ভাবা সেই কাজ। রেশমা লুকাসের ঘুমের সুযোগ নিয়ে গুটি গুটি পায়ে উপর থেকে এলিজাবেথ কে নিয়ে আসে নিচে। এলিজাবেথ’কে বাইরে বের করার স্বার্ধ তার নেই তবে যথাসম্ভব চেষ্টা করছে এলিজাবেথের বন্দি দশা দূর করতে। রেশমার সাথে গুটি গুটি পায়ে এলিজাবেথ সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে এলো। নিচে আসতেই লুকাস কে দেখে রেশমা কে পিছন থেকে ফিসফিসিয়ে ডাকল এলিজাবেথ।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘রেশমা ফিরে তাকালে এলিজাবেথ চোখের গোল সুগভীর, নিকষ কালো মনি ঘুরিয়ে লিভিং এরিয়ার দিকটায় ইশারা করল। যেখানে সোফায় লুকাস ঘুমিয়ে আছে। রেশমা তাকাল সেদিকে,পরপর এলিজাবেথের দিকে তাকিয়ে চোখে আস্বস্ত করে তড়িঘড়ি করে কিচেনে ছুটে গেল। নিশি’কে দিয়ে চটজলদি টেবিল সাজিয়ে ফেলল। উদ্দেশ্য আজ এলিজাবেথ’কে আর পাঁচ’টা সাধারণ মানুষের মতো ডাইনিং টেবিলে বসিয়ে খাওয়াবে। এই ক’দিনে রেশমা আর এলিজাবেথের মধ্যে খুব সখ্যতা গড়ে ওঠেছে। এলিজাবেথ যেমন প্রতি মুহুর্তে মুহুর্তে রেশমা মা, রেশমা মা বলে মুখে ফ্যাঁনা তুলে দেয়, রেশমাও ঠিক তেমনি মেয়ের মতো দেখ ভাল করে এলিজাবেথের।
‘এলিজাবেথের পায়ের এবং হাতের ক্ষত এতোদিনে শুকিয়ে গিয়েছে। হাতের সেলাই রেশমা ই কেটেছে। শারীরিক ভাবে এখন পুরোপুরি সুস্থ এলিজাবেথ, মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত হলেও। এলিজাবেথ খুবই সর্তকতার সহিত নগ্ন পায়ে নিশ্চুপ পদচিহ্ন ফেলে এগিয়ে যেতে থাকে। হঠাৎ কি মনে করে পিছন তাকাতেই লুকাস তড়িঘড়ি করে আবার চোখ বুজে ফেলল। ঠৌঁট চেপে স্মিত হাসল এলিজাবেথ। হ্যাঁ এখন সেই ফ্যাকাসে, নীলচে ঠৌঁটের আগায় মাঝেমধ্যে হাসির স্পষ্ট ঝলকানি দেখা যায়। লুকাস এলিজাবেথ’কে টেবিলে বসতে দেখে ঠৌঁট গোল করে গরম শ্বাস ফেলে ওদের পিছ দিয়ে ঘুরে শুয়ে থাকল ঘুমের ভান ধরে। এতে করে সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না।
‘এলিজাবেথ মনে মনে ভাবতে লাগল—এই কঠিন খোলসের আড়ালে এক শিশুর মতো কোমল একটা মন আছে, যা পাপের অতল গহ্বরে তলিয়ে গেছে। এত গভীরে যেখানে কোনো ডুবুরি পৌঁছাতে পারে না। ওর মনে এলো রিচার্ডের কথা। অজান্তেই নয়, ইচ্ছাকৃতই মনে করল এবার। এতদিন ধরে কতবার শাওয়ার নিয়েছে, কতবার সাবানের মোটা স্তরে নিজের ত্বক ঘষে লাল করে ফেলেছে, তবু রিচার্ডের পারফিউমের সেই গাঢ় গন্ধ মুছতে পারেনি।
‘গলা, গাল, ঠোঁট আর পেটের কালচে দাগ যেন এক অনন্ত স্মৃতিচিহ্ন হয়ে থেকে গেছে। প্রতিটি দাগ বারবার মনে করিয়ে দেয় সেই হিংস্র মানুষটির কথা। ভাবতেই বুকের মধ্যে এক অদ্ভুত বিষাক্ত শীতলতা নেমে আসে। কানে বাজতে থাকে সেই ভয়াবহ রাতগুলোর আর্তনাদ। মনে পড়ে কেমন করে সে বারবার কেঁদেছে, আকুতি করেছে। তবে তার অসহায় কান্না রিচার্ডের কঠোর মনকে একটুও নরম করতে পারেনি। প্রতিটি মুহূর্ত যেন ভেতরের শান্তিকে আরও তছনছ করে দিচ্ছে। এলিজাবেথ ভাবতে চেয়েছিল অন্য কিছু, কিন্তু ঘৃণা আর যন্ত্রণার সেই পুরোনো সুর ফিরে আসে, বদ্ধ পাগলের মতো ওকে আচ্ছন্ন করে। এলিজাবেথ আর কিছু ভাবল না। নিজের মন থেকে সবকিছু সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করল। যদিও জানত সেই স্মৃতির দাগ কখনো মুছে যাবে না।
‘ আজ অনেকদিন পর এলিজাবেথ পছন্দের খাবার খাচ্ছে। রেশমা সকাল সকালই বেশি করে ঘি দিয়ে কাচ্চি রান্না করেছে এলিজাবেথের জন্য। খাবারের ঘ্রানেই এলিজাবেথের মন পুলকিত হয়ে উঠল। বারবার বলার পরও রেশমা এলিজাবেথের সাথে খেতে বসেনি। যতই মায়ের সম্পর্কে এলিজাবেথ তাকে আবদ্ধ করুন না কেন। একজন মুনিব আর মালকিনের মধ্যে বিশাল লম্বা লাইন থাকে । রেশমা পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এলিজাবেথ’কে পরিবেশন করে খাওয়াচ্ছে। অনেক বছর পর তৃপ্তি সহকারে নিজের পছন্দের খাবার খেতে পারছে এলিজাবেথ। হঠাৎ করেই গলায় খাবার আঁটকে গেল।রেশমা চটজলদি পানি এগিয়ে দেয় এলিজাবেথের দিকে। পিঠে হাতের তালু দিয়ে ঘষে দিচ্ছে আলতো করে। চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে আসে এলিজাবেথের। রেশমা পেলব হাতে লোচনের পানি মুছে দিল। নিদারুণ কোমল হয়ে মাতৃ স্বরে বললেন,
“আস্তে খাবে তো। দেখলে চোখ দিয়ে কীভাবে পানি ঝড়ছে এখন।”
‘কাঁপা কাঁপা চোখের পাতা মেলে মাথা উপরে তুলল এলিজাবেথ। তাকাল সরাসরি রেশমার মুখে। খাদযুক্ত কণ্ঠে ভেঙে ভেঙে আওড়ালো,
“আমি কাঁদছি রেশমা মা।”
‘কথাটা সোজা গিয়ে বিঁধল রেশমার বৃক্ষপটে। তার গভীর চোখ দু’টো আশ্লেষে জরিয়ে রেখেছে এলিজাবেথের পা থেকে মাথা পর্যন্ত। দুহাতের আজলায় চেপে ধরল দু’টি নরম গাল। সবিনয়ে জিজ্ঞেস করল,”বাড়ির জন্য মন খারাপ হচ্ছে ?”
‘দু’পাশে মাথা নাড়ায় এলিজাবেথ,”না। চাচার জন্য। আমার কোনো বাড়ি ছিল না রেশমা মা।”
‘এলিজাবেথের পরিবার সম্মন্ধে কিছুই জানে না রেশমা। এলিজাবেথ কখনও মুখ ফুটে কিছু বলেনি। রেশমা যতটুকু ধারণা করতে পেরেছে ভালোবাসার অভাবে ছিল খুব। মেয়েটা ভালোবাসার কাঙ্গাল খুবই । রেশমার ধ্যান ভাঙল এলিজাবেথের কথায়।
“জানো রেশমা মা আমার চাচারও কাচ্চি খুবই পছন্দ। তবুও চাচা নিজে অল্প খেয়ে বাকিটুকু আমার জন্য রেখে দিতো। আমি পরে লুকিয়ে লুকিয়ে খেতাম।”
“তোমার চাচি তোমাকে পেট ভরে খেতে দিত না?”
‘কান্নার তোড় বাড়ল এলিজাবেথের। নির্নিমেষ তাকিয়ে থেকে দু’পাশে মাথা নাড়াল। আঁতকে ওঠে কপাল দু-ভাঁজে বিভক্ত হলো রেশমার। নিষ্পলক তাকিয়ে থাকল ঠৌঁট ভেঙে কাঁদতে থাকা এলিজাবেথের দিকে। জিভ দিয়ে ঠৌঁট ভিজিয়ে এলিজাবেথের পাশে বসল রেশমা। দু’হাতের আজলায় চেপে ধরা দু’টি গালে ছোট করে চুমু খেয়ে বুকের সাথে মিশিয়ে নিল এলিজাবেথ কে।
“এই যুগেও এমন মানুষ আছে যে খাবারের জন্য কষ্ট দেয়? ছিঃ আমার ভাবতেই ঘৃণা হচ্ছে।”
‘এবার হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু থাকল এলিজাবেথ। ভিতরে শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতগুলো নতুন করে ব্যাথা দিতে শুরু করেছে। এলিজাবেথের কান্নার শব্দ লুকাসের কান পর্যন্ত গেল। ভ্রু কুঁচকে সোজা হয়ে বসল,তাকাল এলিজাবেথের দিকে। রেশমা কান্না থামানোর চেষ্টা করল এলিজাবেথের । কিচেন থেকে নিশি এসে পাশে দাঁড়ালো রেশমার। চোখেমুখে উদ্বিগ্নতা,উৎকণ্ঠা। ভয়কাতুরে চোখে এদিকসেদিক তাকিয়ে দেখছে রিচার্ডের কোনো লোক আছে কিনা। ভয় পাচ্ছে এলিজাবেথ কান্না করার কারণে তাকেও যদি মেরে ফেলা হয় সেদিনের মেডগুলোর মতো। শুকনো ঢোক গিলতে থাকে বার বার।
“কান্না থামাও মা আমার। এভাবে কান্না করে না।”
‘গতি হারায় হৃদস্পন্দন৷ বুক থেকে মাথা তুলে এলিজাবেথ। গলা কাঁপছে, তবুও বলল,” আ আজ আমি বলতে চায়। বলে আমার ভিতরে জ্বলতে থাকা আগুনের লেলিহানে পানি ঢালতে চায়। চাপা কষ্টগুলো যে শেষ করে দিচ্ছে আমাকে ভিতরে ভিতরে। আমি পারছি না আর সত্যিই পারছি না।”
‘গলায় কুন্ডলী পাকিয়ে থাকা দলাগুলো শক্ত ঢোক গিলে পিষে ভিতরে ঠেলে দিয়ে নিজেকে কঠিন করল এলিজাবেথ। বলতে থাকল, “আমাকে নিয়ে সকলের মনে অনেক কৌতুহল নাহ ? আমার অন্যরকম চেহারা, চুল তাই না?”
‘অপরদিকে আটতলা বিল্ডিংয়ের ছাদে সূর্যের তির্যক রশ্মি কাচ ভেদ করে এসে পড়েছে এক অনন্য সুদর্শন পুরুষের ওপর। কালো ট্রাউজারের নিচে তার শক্তপোক্ত, সুঠাম দেহ উন্মুক্ত। সকালে নিজের শরীরচর্চায় ব্যস্ত রিচার্ড। পাশে বসে ন্যাসো তার প্রতিটি বুক ডাউন গুনছে নিঃশব্দে।
“একশো তেইশ… একশো চব্বিশ.”
‘ঠিক তখনই রিচার্ড থেমে গেল। ল্যাপটপের স্ক্রিনে ভেসে ওঠা লাইভ ফিডে এলিজাবেথের কণ্ঠ শুনল। বাগানবাড়ির ডাইনিং এরিয়ার লাইভ ফুটেছে চলছে ল্যাপটপের স্ক্রিনে। হঠাৎই রিচার্ডের ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটে উঠল। এবারের চালান নিয়ে সাম্প্রতিক ঝামেলাগুলো মাথায় ঘুরছিল রিচার্ডের। এবার বেশ চাপই নিতে হচ্ছে। কিছু রাজনীতিবিদ রিচার্ডের সাথে নারী পাচারের ব্যবসায় যুক্ত হতে চেয়েছিল। কিন্তু রিচার্ড সেই প্রস্তাবে রাজি হয়নি। শেয়ার করে ব্যবসা করা তার নীতি নয়। এই রাজ্যে সে একাই রাজা, আর মন্ত্রী? সেই জায়গাও তার নিজের। ক্ষমতা ভাগাভাগি করার কোনো ইচ্ছা রিচার্ডের নেই।
‘এটাই ছিল সমস্যা। বড় বড় রাজনীতিবিদরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। একজন বিদেশি ইতালি থেকে উড়ে এসে তাদের শহরে এমন অবিচ্ছেদ্য রাজত্ব কায়েম করেছে, তা তাদের সহ্য হচ্ছিল না। ক্ষোভে তারা পুলিশের পুরো একটা দল রিচার্ডের পেছনে লেলিয়ে দেয়। কিন্তু ফলাফল শূন্য। পুলিশি চাপ, রাজনীতিক ষড়যন্ত্র কোনো কিছুই রিচার্ডের গায়ে আঁচড়ও কাটতে পারেনি। এত বছর ধরে নিজের গড়া সাম্রাজ্যকে সুরক্ষিত করতে শত্রুরা যা-ই করুক, রিচার্ড সবসময় একধাপ এগিয়ে থেকেছে। এবারও তাই।
‘বড়দিনের মতো স্বয়ং মাঠে নেমে পড়েছিল রিচার্ড। আর তখনই দেখিয়ে দিয়েছিল নিজের আসল রূপ। প্রতিটি শত্রুকে ভয়ংকরভাবে শেষ করেছে। প্রতিশোধ ছিল নির্দয়। যা কারও কল্পনারও বাইরে। যারা রিচার্ড কে থামানোর চেষ্টা করেছিল, তাদের সবাইকে নিজে উপহার দিয়েছে একের পর এক ভয়ংকর মৃত্যু।পুলিশের পক্ষে কিছুই করা সম্ভব হয়নি। কারণ রিচার্ড কখনোই কোনো প্রমাণ রেখে কাজ করে না। তার প্রতিটি পদক্ষেপ নিখুঁত এবং পরিকল্পিত। এই কারণেই অল্প সময়ের মধ্যেই ইতালির মতো বড় শহরে নিজের সাম্রাজ্য তৈরি করে ফেলেছে।
‘প্রেমও বারবার চেষ্টা করেছে রিচার্ডকে ধরার, কিন্তু প্রমাণের অভাবে রিচার্ড কে কাবু করা সম্ভব হয়নি। এতদিন ধরে পুলিশ গুপ্তচর লাগিয়ে রেখেছিল রিচার্ডের পিছনে। তাই কারণেই রিচার্ড বাগানবাড়ি যায়নি এতদিন। তবে আড়ালে লুকিয়ে থাকার মানুষ সে নয়। বরং প্রকাশ্যেই শত্রুদের একে একে শেষ করেছে অত্যন্ত কৌশলে। রিচার্ডের হিংস্রতা, নৃশংসতা, আর পৈশাচিক মনোভাবের শিকার হয়েছে সবাই। রিচার্ডের সাইকোপ্যাথিক মস্তিষ্ক কাজ করে এক শিকারির মতো৷
‘রিচার্ড নতুন করে বুক ডাউন দিতে শুরু করল। ঘামে ভেজা চুলগুলো কপালের সঙ্গে লেপ্টে গেছে। আর চুলের ফাঁক গলে সরু সরু ঘামের ধারা গাল বেয়ে নিচে গড়িয়ে পড়ছে। পুরো শরীর ঘামে চ্যাটচ্যাট করছে।শরীর থেকে নির্গত ঘামের শীতলতা সত্ত্বেও তাতে যেন একধরনের অদৃশ্য উষ্ণ বাষ্প উঠছে। গলার পাশে চিকন নীলচে রগগুলো সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে৷ দুইশো বুক ডাউন শেষ করার পর রিচার্ড নিজের শরীরের পুরো ভার দু’হাতের তালুতে চাপিয়ে শূন্যে ভাসিয়ে রাখল। শরীরের সমস্ত ওজন হাতের ওপর পড়ার কারণে তার গৌড় বর্ণের শিরা-উপশিরাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ঘামের রাস্তা উল্টো পথে ছুটছে। অপর পাশের বিল্ডিং থেকে কেউ দেখলে মনে করবে খালি গায়ে কাউকে উল্টো ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
‘রেশমা নিস্প্রভ তাকিয়ে থাকল এলিজাবেথের দিকে। এলিজাবেথের প্রথম বাক্য অর্হনিশে যেতেই কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ পড়ল। লুকাস পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এলিজাবেথের উপর।
“আমি রাশিয়ান। জন্ম, বেড়ে ওঠা সবই রাশিয়ার মাটিতে। অথচ এখন ভাগ্যের খেয়ালে আমি এখানে। শুনে অবাক হচ্ছেন নিশ্চয়ই আমি রাশিয়ান হলে ওরা আমার চাচা-চাচি হয় কীভাবে? হ্যাঁ ওরা আমার আপন চাচা-চাচিই। কারণ আমার মম একজন রাশিয়ান হলেও আমার ড্যাড ছিলেন একেবারে খাঁটি বাঙালি।
ড্যাড ছিল সাংবাদিক৷ সাহসী, নির্ভীক, আর বেপরোয়া স্বভাবের। অল্পদিনেই তিনি নিজের ক্যারিয়ারকে শক্তপোক্ত করে গড়ে তুলেছিল। আন্তর্জাতিক নানা ইস্যু নিয়ে কাজ করার জন্য ড্যাড প্রায়শই বিভিন্ন দেশে যেতো। এরকমই একসময় একটি ডকুমেন্টারি বানানোর জন্য ড্যাডের রাশিয়ায় যেতে হলো। সেখানেই পরিচয় হয় মমের সঙ্গে।
‘মম ছিল একজন পেশাদার সঙ্গীতশিল্পী। ড্যাডের নজর আটকে গিয়েছিল তার মায়াবী কণ্ঠে। মম যখন যে কোনো বার বা স্টেজ শোতে গান করতো ড্যাডও নিয়মিত সেখানে চলে যেতো শুধু মমের গান শুনতে। প্রথমে তাদের বন্ধুত্ব, তারপর সেটা রূপ নেয় গভীর ভালোবাসায়। এক ভিনদেশীর প্রেমে মম এতটাই ডুবে গিয়েছিল যে নিজের ধর্ম পরিবর্তন করতেও দ্বিধা করেননি। কিছুদিনের সম্পর্কই তাদের জন্য যথেষ্ট ছিল। তারা বিয়ে করে নিজেদের ভালোবাসাকে সামাজিক স্বীকৃতি দেয়। সেই বিয়ের ফলস্বরূপ আমি। দুই সংস্কৃতির মিশেলে গড়ে ওঠা একটি জীবন। রাশিয়ার শীতল মাটি আর বাংলাদেশের উষ্ণ রক্তের মেলবন্ধন।
‘বিয়ের পরপরই মম প্রেগন্যান্ট হয়ে যায়। আমি যখন মমের পেটে তখনই তিনি মম তার পরিবারকে বিয়ের কথা জানায়। এতদিন কেউই কিছু জানত না। কিন্তু সেই খবর ঝড় বয়ে আনেছিল। মমের পরিবার এই বিয়ে কোনোভাবেই মেনে নেয়নি। তাদের দৃষ্টিতে ড্যাডের সামাজিক অবস্থান ছিল খুবই নিচু যা তাদের জন্য অপমানের কারণ। ওরা মমের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করতে থাকে ডিভোর্স দিতে হবে, আমাকে পৃথিবীতে আসার আগেই গর্ভপাত করতে হবে। কিন্তু মম ছিল দৃঢ়। ভালোবাসার কাছে কোনো বাঁধা বা শর্ত ছিল না তার। তাই পরিবার মম কে ত্যাজ্য করে।
‘এত কিছু সত্ত্বেও মম ড্যাডের হাত ছাড়েননি। নিজের ভালোবাসাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে মম সমস্ত সম্পর্ক, পরিচিতি, আর জীবনের এক বিশাল অধ্যায় পেছনে ফেলে চলে আসে। পেশাগত জীবনে মম তখন খুবই সফল ছিল। সুর আর গানে মমের ক্যারিয়ার উজ্জ্বল ছিল। সেই সাফল্যের ওপর ভর করেই মম আর ড্যাড মিলে রাশিয়ায় ছোট্ট একটা বাড়ি কিনে নতুন জীবনের সূচনা করেন। দুজনের ভালোবাসায় ভরা সংসার পূর্ণতা পায় আমার আগমনে। তাদের পৃথিবী তখন দুজন থেকে হয়ে যায় তিনজনের। ভালোবাসার এই নতুন অধ্যায় সব কষ্টের ক্ষত মুছে দিয়েছিল।
‘আমি তাদের কোলজুড়ে পৃথিবীতে এলাম৷ ওদের জীবনে এক নতুন আলো জ্বলে উঠল। ড্যাডের দিকে দাদু-দাদি বিয়েটা শুরু থেকেই মেনে নিয়েছিল। আমার জন্মের পর থেকে দাদু আমাকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। বারবার ড্যাডকে চাপ দিতো আমাকে দেশে নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু তখন আমি খুব ছোট ছিলাম তাই ড্যাড রাজি হননি। ড্যাড একা দেশে যেতো সবাই কে দেখতে। কিন্তু আমি ছিলাম সবার চোখের মণি। আমাকে ছাড়া যেন ড্যাডের মন কোথাও লাগত না। কাজে গিয়েও সে বারবার ভিডিও কল দিত শুধু আমাকে দেখার জন্য। বলত, “আমার ঘরে চাঁদ জন্ম নিয়েছে।”
‘মম আমার জন্য গান গাওয়া প্রায় ছেড়ে দিয়েছিল। তার সমস্ত মনোযোগ তখন কেবল আমাকে ঘিরে। ড্যাড মমের চোখে আমি ছিলাম তাদের ছোট্ট পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু। যখন আমি দুই বছরে পা দিলাম ড্যাড সিদ্ধান্ত নেয় আমাদের সবাইকে নিয়ে দেশে যাবে। ড্যাডের কাজের জন্য বিভিন্ন জায়গায় যেতে হতো,তাই ড্যাড ভয় পেতো যে মম একা আমাকে সামলাতে পারবে না। অনেক বোঝানোর পর মমও রাজি হয়ে যায়। ভালোবাসার এই অমোঘ টানে মম আবারো নিজের দেশ রাশিয়া ছেড়ে ড্যাডের সঙ্গে বাংলাদেশে চলে আসে। দুই সংস্কৃতির মিশেলে গড়া আমাদের এই ছোট্ট পরিবার তখন এক নতুন অধ্যায় শুরু করল।
‘দেশে ফিরে কিছুদিন খুব ভালোই কাটছিল। আমি হয়ে উঠি সকলের চোখের মনি। বিশেষ করে আমার লাল চুল আর ফর্সা গড়ন সবাইকে মুগ্ধ করে রেখেছিল। আশেপাশের মানুষরা দূর-দূরান্ত থেকে এসে আমাকে দেখতে আসত। মম-ড্যাড আমাকে সবসময় আগলে রাখলেও আমাকে খারাপ নজরের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারিনি।একদিন আমার চাচাতো ভাই শিহাবের মামা বেড়াতে আসে আমাদের দাদু বাড়িতে। তখন আমি ছিলাম দুই বছরের একটা শিশু। সেইসময় তার নোংরা, কুৎসিত নজরে আমি পড়ে গেলাম। একদিন যখন মম আমার জন্য দুধ গরম করতে কিচেনে গিয়েছিল ফিরে এসে দেখে শিহাবের মামা আমাকে অশালীনভাবে ছুঁচ্ছে।
‘সেদিন বাচ্চা আমি কিছু না বুঝেও অঝোরে কান্না করেছিলাম। মম নিজের চোখে মেয়ের সেই অপ্রতীতিকর দৃশ্য দেখে নিজের রাগ, ঘৃণা আর বিষণ্ণতা চেপে রাখতে পারেনি। নিজেকে সংযত রাখতে না পেরে শিহাবের মামার ওপর হামলে পড়েছিল মম। মম এতটাই গা হিংস্র হয়ে গিয়েছিল যে মারতে মারতে শিহাবের মামাকে রক্তাক্ত করে ফেলে। বটি দিয়ে কুপিয়েছিল ঐ নোংরা লোকটাকে। তখন মমের চোখে ছিল এক ভয়ঙ্কর প্রতিশোধের জ্বলন্ত আগুন। আর আমি শুধু এক শিশুর মতো কাঁদছিলাম জানতাম না কেন সেই দিনটা এত ভীতিকর হয়ে উঠেছিল।
‘ড্যাড সবটা শোনার পর সেই নোংরা মানুষটাকে পুলিশে ধরিয়ে দেয়। কিন্তু তাতেও মমের মনের ভয় আর ভীতি দূর হয়নি। সেই ঘটনার পরদিনই মম আমাকে নিয়ে রাশিয়ায় ব্যাক করে। কেউই মমকে আটকে রাখতে পারেনি। মমের সেই সিদ্ধান্তের পর থেকেই চাচির মনে আমার প্রতি একটা চাপা ক্ষোভ জন্ম নেয়। দিন গড়ায়, মাস পেরোয়, বছর যায়। ড্যাড নানান চেষ্টা করে মমকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য, কিন্তু কোনো কিছুতেই মম রাজি হননি। একসময় ড্যাড নিজেও বুঝে যায় আমার জন্য বাংলাদেশ সেভ নয়। আমার রূপই আমার ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়াবে একদিন।
‘মমের নাম ছিল এলিসা। মম ছিল অপূর্ব সুন্দরী গ্রিক দেবীদের মতো। মমের সেই সৌন্দর্য ই আমার মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে। আমার লাল চুল আর উজ্জ্বল গড়ন মমের কাছ থেকেই পাওয়া। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমার সৌন্দর্য বাড়তে থাকে আর সেইসঙ্গে ড্যাডের দুশ্চিন্তাও। ড্যাড শুধু ভাবতো কীভাবে আমাকে এই পৃথিবীর নোংরা দৃষ্টি থেকে আড়াল করবে। আমাকে আর মমকে একা রেখে দেশে আসার সাহসও ড্যাড পেতো না। সারাক্ষণ মনের কোণে ভয় লুকিয়ে থাকত—আমার রূপই যেন আমার জীবনের কাল না হয়ে দাঁড়ায়।
‘অবশেষে বাধ্য হয়ে ড্যাড সাংবাদিকতার চাকরি ছেড়ে দেয়। মমের সাহায্যে রাশিয়ায় নতুন একটা চাকরি নেয়। তারপর থেকে আমাদের জীবন এক নতুন পথে এগিয়ে যায়। একে অপরের ভালোবাসায় পূর্ণ, নিরাপদ একটা পরিবার ছিল আমাদের। সেই জীবন ছিল আমার জন্য এক স্বপ্নের মতো। যেখানে বাবা-মায়ের স্নেহ আর যত্ন আমাকে ঘিরে রেখেছিল। আমার বারো বছরের জীবন তখনো মম-ড্যাডের আশ্রয়ে সুরক্ষিত ছিল। তাদের ভালোবাসা এত গভীর ছিল যে আমাকে পাওয়ার পর আর দ্বিতীয় সন্তানের কথা ভাবেনি। আমার চারপাশ ছিল এক সুখের পৃথিবী, যেখানে মম-ড্যাড আমাকে ছাড়া কিছুই কল্পনা করতে পারত না।
‘কিন্তু হঠাৎ একদিন আমাদের জীবনে নেমে আসে এক কালো রাত। ড্যাড তখন রাশিয়ায় থাকলেও বাংলাদেশের একটি কেস নিয়ে গভীর স্টাডি করছিল। কিছুদিন ধরে ড্যাডের মুখে চিন্তার ছাপ দেখা যাচ্ছিল কিন্তু সে ব্যাপারে মম কিছুই জানতো না। ড্যাড ছিল স্বভাবতই দায়িত্বশীল। তাই কোনো ঝামেলায় মমের কাঁধে ফেলতো না। এক রাতে ড্যাড বাংলাদেশের প্রাক্তন সহকর্মীদের সঙ্গে ভিডিও কলে মিটিং করছিল। কয়েকদিন আগেই ড্যাড আমেরিকা গিয়েছিল সেই কেসের সূত্র ধরে। মিটিংয়ে সেই বিষয়ের কথাবার্তা ই হচ্ছিল। ড্যাড খুব মনোযোগ দিয়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছিল। ঠিক তখনই ফোনে একটি ইমেল আসে। সেই রাতই হয়ে দাঁড়ায় আমাদের সুখী পরিবারের এক ভয়াবহ ট্র্যাজেডির সূচনা।
‘কোরিয়ার আইন অনুযায়ী কোনো অপরাধের পনেরো বছরের মধ্যে যদি আসামি শনাক্ত না হয়, তবে কেসটি চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হয়। ঠিক এমনই এক কেসে পনেরো বছর আগে একজন খুনি একটি ছোট মেয়েকে নৃশংসভাবে রে/প করে হত্যা করে পালিয়ে যায়।
পনেরো বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর কেসটি আইনি নিয়মে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। তখনই খুনি নির্লজ্জভাবে প্রকাশ্যে ফিরে আসে। কিন্তু পুলিশ কিংবা প্রশাসন কেউই তার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছিল না।
এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক অজানা ব্যক্তি সে রাতে পরিচয় গোপন রেখে আমার ড্যাডের কাছে সাহায্য চায়। “খুনি প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর মেয়েটির পরিবার ন্যায়ের জন্য চিৎকার করছে। কোরিয়ার প্রশাসন নিষ্ক্রিয়, কিন্তু আপনি একজন আন্তর্জাতিক সাংবাদিক। আপনি যদি কেসটি ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যাটফর্মে তুলে ধরেন, তাহলে হয়তো মেয়েটির পরিবার সুবিচার পাবে।” সাথে মেয়েটির খুনের বর্ণনা পাঠিয়েছিল।
‘সেই রাতে মেয়েটির খুনের ভয়াবহ বর্ণনা শুনে ড্যাড স্তব্ধ হয়ে ঘুমন্ত আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। ঘুমন্ত আমি কে বুকের সাথে চেপে ধরেছিল। অনুভব করছিল যদি মেয়েটির পরিবারের জায়গায় তার নিজের পরিবার থাকত? সেই যন্ত্রণা তীরের ফলার মতো বিদ্ধ করেছিল ড্যাডকে। সেই রাতেই ড্যাড সিদ্ধান্ত নেয় যে করেই হোক, কোরিয়া যাবে। মেয়েটির পরিবারকে সুবিচার পাইয়ে দেবে। সত্য আর ন্যায়বোধের প্রশ্নে ড্যাড সবসময় আপসহীন ছিলেন। মম সর্বদা ড্যাডের কাজকে সমর্থন করতো। সেই রাতেও মম ড্যাডের সাহসিকতাকে সম্মান জানায় এবং এই বেপরোয়া সিদ্ধান্তে বাধা দেয়নি। কিন্তু সেদিন ই হয়তো ড্যাডের মনে হয়েছিল এটাই তার শেষ রাত। সারা রাত আমাকে বুকের মাঝে শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছিল। তার হাতের উষ্ণতায় ছিল শূন্যতার ভয় আর অন্তরের সমস্ত ভালোবাসা। হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, আর কোনোদিন ফিরবে না।
‘পরদিন রাতের ফ্লাইটেই কোরিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় ড্যাড আমাকে ঘুমন্ত রেখে। কারণ আমি জেগে থাকলে ড্যাডের পক্ষে আমাকে ছেড়ে যাওয়া কখনোই সম্ভব হতো না। আমার চোখের জল নাকি সোজা গিয়ে বিঁধত ড্যাডের বুকে। ঘুম থেকে উঠে ড্যাডকে না পেয়ে ছুটে গিয়ে মমের আঁচল ধরে খুব কান্না করেছিলাম। মমও আমার আড়ালে কান্নায় ভেঙে পড়ত, তবুও আমার সামনে শক্ত থাকার ভান করত। বলতো,”তোমার ড্যাড খুব শিগগিরই ফিরে আসবে, তোমার কাছে।” সেই কথা শুনে আমার ছোট্ট মন শান্ত হতো।
‘কিন্তু কিছুদিন পর থেকেই সব বদলে যায়। ড্যাডের নাম্বার সুইচ অফ দেখাতে শুরু করে। প্রথমে মম কিছুটা চিন্তিত হলেও নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে থাকে। যে ড্যাড আমাকে না দেখে এক মুহূর্তও থাকতে পারত না, সে কেন যোগাযোগ বন্ধ করে দিল? মম নানা উপায়ে ড্যাডের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।
‘এরপর ধীরে ধীরে মমও নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। গভীর রাতে আমাকে বুকে চেপে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদত। আমি মমের বুকে মাথা রেখে বোঝার চেষ্টা করতাম কী হচ্ছে আমাদের জীবনে। কত রাত আমরা নির্ঘুম কাটিয়েছি, একলা ঘরে শুধু চোখ ভরা জল আর অব্যক্ত অপেক্ষা নিয়ে। প্রতিটা মুহূর্তে মনে হতো ড্যাড হয়তো দরজা খুলে হঠাৎ ঘরে ঢুকবে। হাঁটু গেড়ে বসে দু’হাত ছড়িয়ে বলবে, “পাপার প্রিন্সেস কোথায়?” আমরা দু’জনেই সেই আশায় প্রতিনিয়ত নিজেদের সান্ত্বনা দিতাম। কিন্তু বাস্তবতা ছিল নীরব, শূন্য এবং আরও নির্মম।
“হ্যাঁ, ড্যাড ফিরেছিল… তবে লাশ হয়ে।” এলিজাবেথের কণ্ঠ ভেঙে আসে। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পরে। “রেশমা, জানো মা, ওরা ড্যাডের বুক চিড়ে কলিজা তুলে নিয়েছিল। ড্যাডকে এত নৃশংসভাবে খুন করেছিল যে তার লাশটাও আর মানুষ বলে চেনা যায়নি।”
‘একটু থেমে এলিজাবেথ গলা শুকনোভাবে আরও বলে, “ড্যাডের সেই ক্ষত-বিক্ষত লাশটাও আমাকে দেখতে দেয়নি কেউ। পুলিশদের নিষেধ ছিল। আমি শুধু দূর থেকে দেখেছি কফিন তার ভেতরে আমার ড্যাড।”
‘এ কথাটা বলে এলিজাবেথ ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।
“ড্যাডের লাশ দেখে মম আমার সামনেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গিয়েছিল মাটিতে। আমি দৌড়ে গিয়েছিলাম মমকে ধরতে। কিন্তু পুলিশরা আমাকে কাছে যেতে দিল না। আমার ড্যাড, আমার সবকিছু… তাকে শেষবারের মতো দেখতে চেয়েছিলাম। তাও দেখালো না। সেদিন আমার কান্না কেউ শুনতে চায়নি। কারও বুকেও একটুকু জায়গা হয়নি আমার জন্য। শুধু লাশ, অন্ধকার, আর অনন্ত নীরবতা।”
‘এইটুকু বলে বুকে হাত চেপে হাঁপাতে থাকে
এলিজাবেথ। নিশি একটু পরপর নাক টানছে। শক্ত হৃদয়ের অধিকারী লুকাসও স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে ক্রদনরত এলিজাবেথের দিকে। রেশমা নিস্প্রভ তাকিয়ে আছে এলিজাবেথের পানে,তারও চোখের পাতা ভেজা। এলিজাবেথ আবারও বলতে শুরু করল,
“ড্যাডের মৃত্যু মম কখনোই মেনে নিতে পারেনি। মানসিকভাবে একেবারে ভেঙে পড়ে। মমের পরিবার তখনও একবারের জন্য মমকে দেখতে আসেনি, কোনো সমবেদনা জানায়নি। পুলিশও খুনিদের ধরতে ব্যর্থ হয়। সবকিছু যেন স্থবির হয়ে গিয়েছিল। একদিন ড্যাডের কাছে যাবো বলে বায়না ধরলাম। বাচ্চাসুলভ কান্নাকাটি, চিৎকার। সেদিন মম আর সহ্য করতে পারেনি। নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আমার গায়ে হাত তোলে। প্রথমবার! আমার মুখ চেপে ধরে চিৎকার করতে থাকে পাগলের মতো। মমের সেই আচরণে আমি আরও ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কান্নার তোড় দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল। মমের ধৈর্য পুরোপুরি ফেটে যায়। নিজের জ্ঞানশূন্য অবস্থায় বালিশ চাপা দিয়ে আমার মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করে। আমি শ্বাস নিতে না পেরে হাত-পা ছুঁড়ছিলাম। পৃথিবীটা কেমন ঝাপসা হয়ে আসছিল।
‘যখন আমার কোনো সাড়াশব্দ না পায় তখন মমের হুঁশ ফিরে। মুখ থেকে বালিশ সরিয়ে আমার নীল হয়ে যাওয়া মুখ দেখতে পেয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে মম। পাগলের মতো প্রতিবেশীদের দরজায় দরজায় গিয়ে ধাক্কাতে থাকে। স্থানীয় কয়েকজনের সাহায্যে আমাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়। ভাগ্যের জোরে সেদিন বেঁচে গিয়েছিলাম। কিন্তু অপরাধবোধ মমের ভিতর থেকে যায়নি। আমাকে হসপিটালে রেখে মম বাড়ি ফিরে আসে। আমাকে রেসকিউ করা আঙ্কেল রাতে আমাকে নিয়ে বাসায় ফিরলে দেখতে পায় রক্তাক্ত অবস্থায় মম’কে। মম সুইসাইড করে সেদিন। এতোদিন যাকে শেষ সম্বল মনে করে বেঁচে ছিল আজকে তারই মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল তা মেনে নিতে পারেনি মম।
‘কিন্তু এখানেই থেমে থাকে না। দিন দিন মমের পাগলামি বাড়তে থাকে। হুটহাট অকারণেই কাঁদত, হাসত। সারারাত বারে পড়ে থাকত। নেশা করে বাড়ি ফিরত রোজ রোজ। আমি মম’কে দেখে ভয় পেয়ে কান্না করলে খুব মারতো আমাকে। আবার হুঁশে ফিরলে আমার সারা মুখ চুমুতে ভরিয়ে দিত, বুকের সাথে চেপে ধরে কান্না করতো চিৎকার করে। যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবো আমি। একা থাকতে না পারা আমাকে দিনের পর দিন পুরো বাসায় একা থাকতে হতো। স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায় আমার। চঞ্চল আমি হুট করেই শান্ত হয়ে গেলাম ।
‘একদিন হুট করেই মম সিদ্ধান্ত নেয় কোরিয়া যাবে। যেভাবেই হোক নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে হলেও ড্যাডের খুনিকে খুঁজে বের করবে। কিন্তু আমার জীবন ঝুঁকিতে ফেলতে চায়নি মম। দশ বছর পর মম দেশে ফিরে। ততোদিনে আমার দাদা-দাদু মারা গেছে। মম চাচার কাছে আমাকে রেখে গিয়েছিল ভরসা করে।
সেদিনও বুঝতে পারিনি আর কোনোদিন মমকে দেখতে পাবো না। ছোট মাথায় ভাবতে পারিনি মমও ড্যাডের মতো সারাজীবনের জন্য হারিয়ে যাবে। জানতাম না, সেদিন বিদায়ের মুহূর্তটাই ছিল আমার জন্য শেষ দেখা।
‘চলে যাওয়ার সময় মম গাড়িতে ওঠেও থেমে যায়। দৌড়ে ছুটে আসে আমার দিকে। চাচা তখন আমাকে শক্ত করে ধরে রেখেছিল, কারণ আমি মমের কাছে যাওয়ার জন্য চিৎকার করে কাঁদছিলাম। মম এসে এক টানে আমাকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়। শেষ আলিঙ্গনে ভেঙে পড়েছিলাম আমরা দু’জনেই। পথের মানুষও সেদিন দেখেছিল মমের কান্না। কী অসহায়ভাবে মম আমাকে বুকের সাথে চেপে ধরে কেঁদেছিল! সারা মুখ চুমুতে ভরিয়ে দিয়েছিল, যেন মুহূর্তগুলো জমিয়ে রাখতে চেয়েছিল চিরতরে। যাওয়ার আগে গভীর ভালোবাসায় আমার কপাল ছুঁয়ে বলেছিল, ‘মম ওয়েল কাম ব্যাক সুন বেডা।’ কিন্তু ড্যাডের মতো মমও কথা রাখেনি। কেউই আর ফিরে আসেনি। একসময় আশা ছেড়ে দিয়ে নিজের জীবনের করুণ বাস্তবতা মেনে নিলাম। মম আর ড্যাডের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে বড় হয়ে উঠলাম। যেন ওরা একটুও দূরে নেই। অথচ সত্যিটা বড্ড নিষ্ঠুর।”
‘বারো বছর বয়সে আবারো সেই কুৎসিত নজরের শিকার হই। চাচাতো ভাই শিহাব সুযোগ পেলেই আমার গায়ে হাত দিত। সংবেদনশীল জায়গাগুলোতে ছুঁয়ে দিতো।শুধু চাচার জন্যই বারবার বেঁচে যেতাম। অন্যথায় হয়তো আর পেরে উঠতাম না। চাচি মমের কথা রেখেছিল, তবে অন্যভাবে। আমায় দেখে রাখত খুব ভালো করে দেখে রাখত। বারবার এসে দেখে যেত কাজ ঠিকমতো করছি কিনা। রাতে ঘুম ভেঙেও এসে দেখে যেত রান্নাঘরের মেঝেতে শুইয়েছি কিনা। মমের দেয়া কথাগুলোকে যেন শাস্তি হিসেবে প্রয়োগ করছিল।
‘আমার রূপের প্রশংসা সবার মুখে শুনে চাচির ভিতরে এক অন্যরকম হিংস্র আগুন জ্বলত। সেটা মেনে নিতে পারত না। তাই প্রতিদিন আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। পড়াশোনা বন্ধ করে দিল। বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিল। একসময় আমাকে ঘরবন্দি করে রাখল। স্কুলে গিয়েও কিছুদিনের মধ্যে এলাকাবাসীর নজরে পড়ে গিয়েছিলাম। সেটাও চাচির ক্রোধের আগুনে নতুন ইন্ধন জুগিয়েছিল। চাচাও তেমন কিছু বলত না। কারণ তিনিও জানতেন এই এলাকায় এমন সৌন্দর্য যে পাপের মতো চোখে লাগে সবার।
‘বাজে, বখাটে ছেলেরা বিরক্ত করতেই থাকত। চাচাও ড্যাডের মতোই আমার রূপের ভয় পেত। ভয় পেত যে আমি যেন আরেকবার বিপদে না পড়ি, যেন কেউ আমাকে খারাপ চোখে না দেখে। চাচা আমাকে বই খাতা কিনে এনে দিত পড়ার জন্য, কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে চাচির কাজের তালিকাও এত বেশি ছিল যে আমি কখনো সেগুলো শেষ করে পড়ার সুযোগই পেতাম না। রাশিয়ান স্কুল আর বাংলাদেশের স্কুলের পড়াশোনার মধ্যে অনেক পার্থক্য ছিল। আমি অনেক এগিয়ে ছিলাম। আমার এক বছরের ছোট চাচাতো বোন ইবরাত কে আমি পড়াতাম।চাচি সেটা দেখত তাই মাঝে মাঝে আমাকে পড়ার সুযোগ দিত। তবে সেটা শর্তসাপেক্ষ ছিল শুধু যদি সব কাজ শেষ করতে পারি তবেই পড়ার সময় পেতাম।
‘পড়ার প্রতি আগ্রহ ছিল আমার ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু কাজের জন্য কখনোই পড়ার সময় পেতাম না। সব কাজ শেষ করে রাতে রান্নাঘরের এক কোণায় মোমবাতি জ্বালিয়ে পড়তাম। চাচা তা দেখে চুপ করে চোখের পানি ফেলত কিন্তু কিছু বলতে পারত না চাচির জন্য। কারণ চাচি কিছু বললেই মরে যাওয়ার ভয় দেখাত। চাচা সবসময় আড়ালে কাঁদত কিন্তু মুখে কিছু বলত না।
‘চাচির অসংখ্য কটু কথা, বোনের অপমানজনক কথাবার্তা, ভাইয়ের অশুচি দৃষ্টি—সবকিছু সহ্য করেও আমি বেঁচে ছিলাম একমাত্র আশায় মম একদিন ফিরে আসবে। মম তো আমাকে কথা দিয়েছিল। তাই আমি নিজেকে শক্ত করে ধারণ করেছিলাম কারণ মমের ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি ছিল আমার জীবনের একমাত্র আলো। কিন্তু দিন গড়িয়ে রাত হলো, মাসের পর মাস, বছর চলে গেল, তবুও মম ফিরে আসেনি। বারবার হতাশ হয়েও আমার মনের কোণে সুপ্ত আশার আলো জ্বলছিল।মম আসবে, কারণ সে কথা দিয়েছিল।
‘এভাবেই এসব সংগ্রামে আমার মনটা ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে উঠল। নিজের হাতে খেতে না পারা আমি কাটা হাত দিয়েও রান্না করেছি, এক কাপড়ে দিন পার করেছি, মেঝেতে শুয়ে শুয়ে বছরের পর বছর কাটিয়ে দিয়েছি। এই সমস্ত কষ্টের মধ্যে, একদিন আমি অনুভব করলাম, আমার বুকের ভেতরে সমুদ্র সমান আফসোস জমে উঠেছে। এই আফসোস যখন প্রশ্রয় পেলে তা আমাকে ধীরে ধীরে তলিয়ে নিয়ে যাবে, নিঃশেষ করে দিবে। তাই আমি কান্না করা বন্ধ করে দিলাম। বাইরের আলো দেখার আর কোনো আশা আমার মধ্যে ছিল না। রাজকন্যা থেকে আমি একসময় নিজেকে চাকরানীর মতো এক জায়গায় মানিয়ে নিয়েছিলাম।
‘সেদিন থেকে আমি না পাওয়া আফসোেসকে উড়িয়ে দিলাম। ভেবে নিলাম সুখ হয়তো আমার জন্য না, আমি বিধ্বংসী এক অস্তিত্ব। যেগুলো আমি পাইনি সেগুলো যদি পেতাম তাহলে আরও বেশি কষ্ট পেতে হতো।
সেদিনের পর থেকে আমি আত্মহত্যার চিন্তাগুলো মাথা থেকে মুছে দিলাম। হয়তো একদিন কেউ আসবে আমার জীবনে সুখের আলো নিয়ে, ড্যাডের মতো রাজকুমার, আর মমের মতো আমি হতে পারব ত্যাগী। মম আমাকে দু-হাত ভরে দোয়া দিবে আমরা সবকিছু ভুলে শুধুমাত্র একে অপরকে চাইব। এটাই হয়তো এক মিথ্যা শান্তনা কিন্তু যে মিথ্যা আমাকে ভালো থাকতে দেয়, সে মিথ্যাকে আমি চোখ বুজে ভালোবাসি কারণ তা আমার নিয়তির মতো।
‘এলিজাবেথের ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠে শেষের কথাগুলো বলার সময়। রেশমা ঠোঁট কামড়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছিল। ঠিক তখনই পায়ের শব্দ শোনা যায়। একজন দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসছে। সবাই ভয়াকাতুরে চোখে পেছনে ফিরে তাকায় দেখতে পায় রিচার্ডকে, পিছনে ন্যাসো। ন্যাসোর হাতে ল্যাপটপ, ঠান্ডা ও স্থিরভাবে এগিয়ে আসছে রিচার্ড।এলিজাবেথের শরীরে শিউরে ওঠে রিচার্ডকে দেখে। রিচার্ডের মুখে কোনো পরিবর্তন নেই,অভিব্যক্তি একদমই স্বাভাবিক, শান্ত। লুকাস ভয়ে গভীর শ্বাস ফেলে।গর্জনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল কিন্তু রিচার্ডের আচরণ তার সব চিন্তা ভুল প্রমাণ করে দেয়। রিচার্ড কিছু না বলেই এগিয়ে সিঁড়ির দিকে যেতে থাকে।
‘হঠাৎ থেমে যায় রিচার্ড, পেছনে ফিরে না তাকিয়েই, শুধু এক শব্দে এলিজাবেথ কে ডাকল।
“রেড।”
‘এলিজাবেথের উত্তরের অপেক্ষা করল না রিচার্ড। রুষ্ট গলায় বলল, “ইফ লাইফ ফা/কস ইউ হার্ড, জাস্ট মোন।”
‘সাথে সাথেই রিচার্ড সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেল যেন কিছুই হয়নি। ন্যাসো থতমত খেয়ে গিয়ে কোন দিকে না তাকিয়ে সরাসরি গেস্ট হাউজে চলে গেল। এলিজাবেথের চোখের পানি অচেনা এক গতিতে শুকিয়ে গিয়েছিল। কান থেকে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। তপ্ত শ্বাস ফেলে এলিজাবেথ বাকি খাবারগুলো শেষ করল৷ এলিজাবেথ হাত ধুয়ে টেবিলে বসতে যাবে তার আগেই রিচার্ড ঝড়ের মতো এসে ওকে কোলে তুলে নিল। আচরণে এলিজাবেথের চোখ ছানাবড়া হয়ে এক মুহূর্তে দম আটকে আসে। রিচার্ড সরাসরি এলিজাবেথ কে রুমে নিয়ে চলে গেল। ঠান্ডা ঢোক গিলতে থাকে এলিজাবেথ। একেবারে রুমে নিয়েই নামালো রিচার্ড।
‘রিচার্ডের পরণে এখনো সেই কালো শার্ট। উপর থেকে শুধু কোট টা খুলে ফেলেছে। হঠাৎ গলায় ঠান্ডা কিছুর স্পর্শ পেয়ে সম্বিত ফিরে পায় এলিজাবেথ। এতোক্ষণ চোখমুখ খিঁচে রেখেছিল ভয়ে । রিচার্ডের গরম নিশ্বাস আঁচড়ে পড়ছে এলিজাবেথ কাঁধে। একদম খুব নিকটে এসে কাঁধের উপর ঝুঁকে গলায় কিছু পরিয়ে দিচ্ছে রিচার্ড। অজান্তেই এলিজাবেথের হাত চলে যায় গলায়। রসগোল্লার মতো গোল গোল চোখগুলো বেরিয়ে আসার উপক্রম। রিচার্ড এলিজাবেথের কানের লতির কাছে মুখ নিয়ে হাস্কি স্বরে অস্পষ্ট ভাবে আওড়ায়,
”বি এ গুড গার্ল অ্যান্ড ইউ উইল শিউরলি গেট এভরিথিং ইউ ডিজায়ার।”
‘বলে তৎক্ষনাৎ ওয়াশরুমে চলে যায় রিচার্ড। এলিজাবেথের চোখ থেকে এখনও বিস্ময়তা কাটছে না। কুটিল হাতে এখনো ধরে রেখেছে গলায় মধ্যে লেপ্টে থাকা সরু চিকন চেইন, যেটার মধ্যে ঝুলানো রিচার্ডের সেই রিংটা। যা রিচার্ড দিয়েছে তাকে মাত্রই, দিয়েছে অন্ধকারের অভিশপ্ত মহারাজ, বিষাদ রাজ্যের রাজা। খুব সুন্দর ভাবে মানিয়েছে এলিজাবেথের গলায় চেইনটি। দুধে-আলতা চামড়ায় চেইনটি তেমন না ফুটলেও রিংটি মুক্তা ঝিনুকের মতো ফুটে রয়েছে।
“আমি ভালোবাসি বা ঘৃণা করি—মাঝামাঝি কিছুই নয়। উদারতাকে মানি, কৃপণতাকে ঘৃণা করি।”
‘ধ্যান ভাঙে এলিজাবেথের। পিছন ফিরে দেখল রিচার্ড ওয়াশরুমের দরজায় কাঁধ ঠেঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। উন্মুক্ত শরীর। এই প্রথম রিচার্ডের সমুদ্র নীল চোখে চোখ রেখে কথা বলল এলিজাবেথ। কথার পারদে বলল,
“এটা তোফা না ,,,,,,
‘বাক্য পরিপূর্ণ করতে পারল না এলিজাবেথ। তার আগেই থামিয়ে দেয় রিচার্ড। বজ্রপাতের মতো গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“ধরে নাও তোফা রাতের জন্য। ভালোবাসা আমার জন্য অচেনা শব্দ।”
‘বিষন্ন অনুভূতির মিলনে চুপসে গেল মাত্রই ক্ষুদ্র অনুভূতির জোয়ারে ভাসতে অম্তকঃকরণ। আবারও নিজের জায়গা ও ভোগের পাত্রী ভেবে চোখ ভিজে এলো। রিচার্ড নিস্প্রভ দ্বিধাহীন নজরে তাকিয়ে দেখতে থাকল এলিজাবেথের কান্না। তবুও পৈশাচিক, বিধ্বস্ত মস্তিষ্কে কোনো সাড়া ফেলল না।
“ইউ লুক লাইক আ স্কুল গাল রেড।”
‘অদ্ভুত প্রশ্নবান তেড়ে আসে রিচার্ডের কাছ থেকে। কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ পড়ল এলিজাবেথের। চোখ খুলে ফিরে তাকাল রিচার্ডের দিকে। রিচার্ডের দু’চোখে সন্দেহ সংকুচিত হলো, এক কাঁধ ওয়াশরুমের দরজায় ভর দিয়ে বুক বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। রিচার্ডের পেটানো শরীরে একপলক তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিলল এলিজাবেথ অতঃপর তড়িঘড়ি করে মুখ ফিরিয়ে নেয়। শক্ত গলায় বলল,
“আই’ম নট।”
‘রিচার্ডের গুরুগম্ভীর গলা, “ডাজ দিস মীন ইউ আর অ্যান অ্যাডাল্ট?”
“আই’ম টুয়েন্টি বাই,দ্যা,ওয়ে। নট নাইনটিন।”
“আর ইউ ?”,,,, এক পা এক পা করে এগোতে থাকে রিচার্ড। কণ্ঠস্বর ধীরে ধীরে গ্রাস হতে থাকে পুরুষালি কামনায়। গুটিয়ে যেতে থাকে এলিজাবেথ। জিভ দিয়ে ঠৌঁট ভিজিয়ে বলল,
“মাই বার্থডে ওয়াজ ফিউ ডেইজ এগো।”
“আই ওয়েল বি থার্টি ওয়ান।”
“ওহ।”
‘রিচার্ড এসে এলিজাবেথের শরীর ঘেঁষে দাঁড়ায়। রিচার্ডের সংস্পর্শে স্তম্ভিত হয়ে যায় এলিজাবেথ। বুক শুকিয়ে এলো। রিচার্ড একহাতে এলিজাবেথের পেট পেঁচিয়ে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল। এলিজাবেথের মাথা ঠেকল রিচার্ডের চওড়া বুকে। রিচার্ড অনড়ভাবে ঝুঁকে থাকল এলিজাবেথের কাঁধে। দৃষ্টি লাস্যময়ী নারীর আবেদনময়ী অনুরূপ সংকীর্ণ অংশে। আজ কিছু সময় দিল এলিজাবেথ’কে কাঁপা-কাঁপি জন্য।
“সো, ইউ’র পারফেক্ট নাও, হাহ? নো মোর সিকনেস রাইট? আই’ম তো স্টার্ভিং রেড।”
‘পেচাঁনো হাত ঘুরিয়ে এক ধাক্কায় এলিজাবেথ’কে বেডে ফেলে দিল রিচার্ড। থুবড়ে পড়া মুখ তুলে তাকাতে তাকাতে রিচার্ড ঝাপিয়ে পড়ল এলিজাবেথের উপর। হামলে পড়ার সময় হঠাৎ এলিজাবেথের চোখ যায় রিচার্ডের কানের পাশটায়। চোখ বড় বড় হয়ে নিশ্বাস আঁটকে আসে এলিজাবেথের।
‘গাড়ি চলছে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্য। ন্যাসো ড্রাইব করছে, পাশের সিটে লুকাস বার বার ফ্রন্ট মিরর দিয়ে রিচার্ড কে দেখছে। তারা জানে না কোথায় যাচ্ছে তারা। রিচার্ড ট্যাবে কি যেনো ঘাটাঘাটি করছে সেই কখন থেকে। গলা খাসকি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে নিল লুকাস। আমতাআমতা করতে থাকে।
” ইয়ে-মানে কোথায় যাচ্ছি বস?”
“মরতে।”
‘ট্যাবের টিকে দৃষ্টি রেখেই নিরুদ্বেগ ভাব নিয়ে বলল রিচার্ড। বুক শুকিয়ে এলো লুকাসের। সে মারতে পারলেও মরতে ভয় পায়। রিচার্ড এবার মাথা তুলে তাকায় লুকাসের উৎকন্ঠিত অবয়বে । পরপর জলদগম্ভীর গলায় বলল, “যাবে না?”
‘লুকাসের তাৎক্ষণিক জবাব, “জ্বি বস। অবশ্যই যাবো।”
ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৮
‘বাঁকা হাসে রিচার্ড। লুকাসের টিকে একটা টিকিট এগিয়ে দিয়ে রুষ্ট গলায় বলল, “বাকিটা যাওয়ার পর বলে দিবো।”
‘পরপর ন্যাসোর দিকে তাকিয়ে বলল,
“ন্যাসো আমাদের এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিয়ে যা বলেছি সরাসরি সেই কাজে যাবে ওকে।”
‘মাথায় নাড়ায় ন্যাসো। লুকাস টিকিটের দিকে তাকাতেই বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেল, আবার কিছুটা ভালোলাগাও কাজ করল শক্ত হৃদয়ে । রিচার্ডের দিকে তাকিয়ে বলল,”বস আপ,,,,
“আমি অন্য কাজে যাবো।”
‘আর কোনোরূপ প্রশ্ন করে না লুকাস। চেহারার সন্তুষ্টির ছাপ ফুটে উঠল। রিচার্ড ট্যাব থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বাইরে তাকাল। মাথায় অনেক প্রশ্ন তবুও ঠোঁটের আগায় জড়ো হয়েছে রহস্যের ঘনঘটা।