ভিলেন ক্যান বি লাভার শেষ পর্ব

ভিলেন ক্যান বি লাভার শেষ পর্ব
মিথুবুড়ি

‘শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কেবিনের সামনে বিমূর্ত মূর্তির মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন মিস এলিসা। স্টেইনলেস স্টিলের দরজার ফাঁকে বসানো কাচের ক্ষীণ রেখা বেয়ে এক দৃষ্টিতে তিনি তাকিয়ে আছেন শয্যাশায়ী এলিজাবেথের দিকে। গুলির আঘাত এলিজাবেথের দেহে বড় ক্ষতি না করলেও, অদৃশ্য এক সর্বগ্রাসী ভাইরাস তার শরীরকে করে তুলেছে প্রায় নিষ্ক্রিয়। সেইসাথে এক অমোঘ বাস্তবতা “লকড-ইন সিনড্রোম” জড়িয়ে ফেলেছে তাকে এক ভয়াবহ নিস্তব্ধতায়।

এলিজাবেথ এখন এক জীবন্ত কল্পনাপটের বাসিন্দা, যেখানে সে নিজেই চায় না তার জ্ঞান ফিরে আসুক। চিকিৎসাশাস্ত্রের সকল জ্ঞান এখানে অসহায়। চিকিৎসকদের কণ্ঠে অনুচ্চারিত জানান দেয়,
“পেসেন্টের জ্ঞান ফিরবে কেবল তখনই, যখন সে নিজে তা চাইবে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘সে-ই অমাবস্যার ঘন অন্ধকার রাত পেরিয়ে আজ বারো দিন। রিচার্ড ও এলিজাবেথকে হাসপাতালে আনার পরপরই শুরু হয়েছিল তড়িৎ চিকিৎসা। চিকিৎসাধীন অবস্থায় এলিজাবেথের দেহে ধরা পড়ে এক ভয়ংকর ভাইরাস—যা তাকে বন্দি করে রাখার সময়ই জেসম তার শরীরে প্রবেশ করিয়ে দেয়। একইসাথে এক বিস্ময়কর তথ্যও সামনে আসে।এলিজাবেথ গর্ভবতী। রিচার্ড নিজেও ছিল গুরুতর অসুস্থ। আগেরবার ট্রাক দুর্ঘটনায় মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়ে সাময়িকভাবে সুস্থ হলেও, হঠাৎ করেই ঘটে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ। টানা এগারো দিন পর তার জ্ঞান ফেরে। আর জ্ঞান ফিরে যখন জানতে পারে এলিজাবেথ গর্ভবতী নিজেকে পাগলের মতো আঘাত করেছিল সে। যদিও সেদিন রিচার্ড এলিজাবেথের পেটের পাশে শুট করেছিল, গুলিটি মাংস ছিঁড়ে বেরিয়ে যায় এবং অলৌকিকভাবে গর্ভস্থ শিশুর কোনো ক্ষতি হয়নি। তবুও রিচার্ডের ভেতরে গুমরে মরছিল অপরাধবোধ আর ভয়।

যদি এবারও বাচ্চার কিছু হয়ে যেত?
‘ভারী পায়ের ডগডগে পদচ্ছাপে সংবিৎ ফিরে পায় মিস এলিসা। বুদ্ধিভ্রংশের মতো স্থির দৃষ্টিতে ঘাড় তুলে সম্মুখের সুদীর্ঘ উচ্চতার দাম্ভিক পুরুষটার দিকে তাকাতেই অবলোকন হয় জোৎস্নাভেজা নীল চোখে ধূমায়িত জ্বালামুখের নীরবতা৷ জড়োসড়ো হয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিলেন মিস এলিসা। দীর্ঘদিন চেতনাহীন থাকা পরও সুবলিত অবয়বে নিরন্তর রয়ে গিয়েছে এক ধারালো সৌষম্য সৌন্দর্য অঙ্গসৌষ্ঠব্যে। এই নিয়ে তৃতীয় সাক্ষাৎ এই মানুষটার সাথে কোনো এক অজানা কারণে, হাঁটুর বয়সী এই মানবকে মিস এলিসা খুব ভয় পান। তার কণ্ঠ, গুরুগম্ভীর গলায় উচ্চারিত প্রতিটি ভারিক্কি বাক্য, ধারালো বাক্যে ইঙ্গিতপূর্ণ খোঁচা, দৃষ্টিতে অমাবস্যার মতো কালো আগুন, দাঁতে আঁটা নিঃশব্দ যুদ্ধঘোষণা, বুকের সমুদ্রসদৃশ সহনশীলতা সবকিছুই যেন
তলোয়ারের ধারসম প্রতিজ্ঞা৷ সেই সাথে বাঁ কাঁধে যুক্ত ভারি অপরাধের বোঝা আনত স্নানমুখটিকে, আত্মগ্লানিতে আরও পিষে দেয়।

‘মানবটি তৃপ্তির সুরে বিদঘুটে হাসি দিল তাঁর শোকাহত রূপ দেখে। স্বভাবসিদ্ধ কালো পোশাকে আবৃত রিচার্ড চিরচেনা ভঙ্গিতে একহাত পকেটে গুঁজে, চোখে ইস্পাতের ন্যায় ধারালো আধিপত্য বজায় রেখে বলল,
“এখানে কেন এসেছেন?”
‘শান্তমূর্তি এবার বিষাদের দাগ লেগে থাকা মুখে পুরুষমূর্তির দিকে তাকাল ছলছলে নয়নে। কণ্ঠে অধীর আকুলতা নিয়ে, চাপা কান্নায় কাঁপা গলায় বললেন,
“ও আমার মেয়ে।”

“শি ইজ মাই ওয়াইফ অ্যান্ড দ্য সুন-টু-বি মাদার অব আওয়ার আনবর্ন বেবি। এছাড়া ওর আর কোনো পরিচয় নেই।”
‘রুক্ষ গলায় চিবিয়ে চিবিয়ে বলা কথাগুলো বিষমাখা তীরের মতো গিয়ে বিঁধল মিস এলিসার পাঁজরে। তবুও সে নির্বাক। সে যা করেছে, তারপর আর তার প্রতিবাদ করার মতো এক বিন্দুসম জায়গা নেই। নতমুখে স্রেফ বললেন,
“আমার বুকে শুট করতে তোমার হাত একটুও কাঁপল না?”
‘রিচার্ডের সপাট চোস্ত জবাব,”আমার ওয়াইফের জীবনে কাছে আপনি কিছুই না। জাস্ট নাথিং।”
“সেজন্য আমাকে শুট করে দিলে! একটুও হাত কাঁপেনি? ভাবোনি তোমার এই কাজে পরবর্তীতে ওর রিয়াকশন কেমন হবে?”

‘রিচার্ড বাম-ডানে মাথা লুকাল। ঠৌঁটের কোণে ক্রূর হাসি টেনে বলল,
“উঁমহু, একটুও কাঁপেনি। বরং আপনাকে না মারলে আমার বউ মরে যেতো। শ্বাশুড়ি মরলে কিছুই আসবে যাবে না। উলটে বউ মরে গেলে অনেককিছু হবে। আমি বাঁচতে পারতাম না। আর সবচে বড় কথা আমার ভালোবাসা? সেটা? আপনাকে মারা ছাড়া আমার কাছে আর কোনো অপশনই ছিল না মিস এলিসা।”
“সম্পর্কে আমি তোমার শ্বাশুড়ি হই।”
‘রিচার্ড হাসল, “ওহ্, জাস্ট ফা’ক অফ মিস এলিসা।”
‘অপমানে থিতু হয়ে পড়ল মিস এলিসার মুখখানা। যদিও সে সম্মানের যোগ্য না। যেখানে সম্মানের স্থান অর্জন করা হয়নি, সেখানে সম্মান আশা করা বোকামি।
“কি হলো এখনও এখানে দাড়িয়ে আছেন কেন? আপনাকে এখনও মুক্ত রেখেছি বলে বেশি বাড় বাড়বেন না মিস৷ নতুন কোনো মতলব আঁটছেন?”

‘কট্টর প্রশ্নবাণে দ্বিধাজড়িত চোখদুটো ঘোর বিস্ময় নিয়ে তাকাল রিচার্ডের বাজপাখির মতো শাণালো দৃষ্টিতে। থমথমে কণ্ঠে বললেন,
“এখন, আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি, তা,,
‘অন্যের কথার মাঝে দাড়ি বসিয়ে রিচার্ড নিজে বলতে শুরু করল,”ভুলবোঝাবুঝির চ্যাপ্টার বাদ দিলাম। আপনার হাতে আর মাত্র সময় চারমাস। নেহাৎ, আমি আমার ওয়াইফকে কথা দিয়েছি, ওর জন্মদিন সবথেকে বেস্ট গিফট দিবো আমি, নইলে এতোক্ষণে আপনাকে আমি,,। আমার বোকা হরিণী জানবেও না, তার জন্মদিনের সবচে বেস্ট গিফটটা কতটা ভয়ংকর। খবরদার বলে দিচ্ছি, ও যেন এসবের ব্যাপারে কিছু না জানে। আমাদের চুক্তি অনুযায়ী, ওর জন্মদিনের পর যেন আপনার ছায়া আর আমাদের ওপর না পড়ে। কোথায় গিয়ে সুইসাইড করবেন, দ্যাটস ইওর চয়েজ। আমি মারলে আপনার মৃত্যুটা খুবই নৃশংস হতো, তাই ব্যাপারটা সহজ করে আপনার হাতেই তুলে দিলাম।”
‘মিস এলিসার চোখের কোল ছাপিয়ে শ্রাবণের ধারা নামল। তাকে এখন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আপাত ক্ষোভে গজগজ করে উঠল রিচার্ড৷ তেজালো ক্ষিপ্তস্বরে বলে উঠল,

“আপনার শরীরে কেবল আমার স্ত্রীর রক্ত রয়েছে বলে বেঁচে গেলেন। নয়ত, আপনার স্থান এতোক্ষণে তিনহাত মাটির নিচে হতো। সামনে থেকে সরুন। আপনাকে এই মুহূর্তে পিষে ফেলতে ইচ্ছে করছে।”
“ওর জ্ঞান ফেরার পর সত্যিটা জানতে চাইলে?”
“রিচার্ড কায়নাত কাউকে জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না। ওর চোখে আমার প্রতি ঘৃণা মানিয়ে যায়, কিন্তু অন্য কারও সামনে ভেঙে পড়বে তা রিচার্ড কায়নাত কোনোভাবেই সহ্য করতে পারবে না। দয়া করে বেরিয়ে যান। আমার স্ত্রী আর অনাগত সন্তানের ওপর আপনার অশুভ ছায়া পড়ুক, তা আমি কখনোই চাই না।”
‘এরূপ তীব্র কটাক্ষে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন মিস এলিসা। আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালেন না সেখানে৷ ঝরঝর করে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে বেরিয়ে গেলেন। সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে না পেরে এলিসা পালিয়ে গেলেও, এখনো অজানা রয়ে গেছে বহু সত্য। কারণ, গল্প তো এখনও শেষ হয়নি।

১. মিস এলিসা কীভাবে জেমসের কাছে এলেন—
একজন মানুষ সবচেয়ে বেশি দুর্বল থাকে তখনই, যখন সে নেশাগ্রস্ত। লাড়া যখন রিচার্ডের জন্য উন্মাদ হয়ে উঠছিল, সেই সময় জেমস শত্রুতা ভুলে একপ্রকার মাথা নত করে ফাদারের কাছে যায়। সেদিন দু’জনে একসঙ্গে অনেক ড্রিঙ্কস করে। ফাদার অতিরিক্ত নেশাগ্রস্ত হয়ে জেমসকে মিস এলিসার কথা বলেন, জানিয়ে দেন সেই মাটির নিচের গোপন ঘরের অবস্থানও। এরপর, ফাদারের মৃত্যু ঘটে। অন্যদিকে, রিচার্ড একে একে জেমসের সবকিছু ধ্বংস করে দিচ্ছিল। ঠিক সেই সময়ই জেমস নিঃশব্দে, সুকৌশলে, মাটির নিচ থেকে মিস এলিসাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে নিজের কাছে একটি ভিন্ন খেলায় নামার জন্য।

২. ল্যাব থেকে রিপোর্ট কীভাবে গায়েব হলো এবং তা শেষমেশ এলিজাবেথের হাতে কীভাবে পৌঁছাল—এর পেছনেও ছিল জেমসের ছায়া। সবাই যখন সেকেন্ড অপশন রেখে এগোচ্ছিল, তখন জেমস রেখেছিল থার্ড অপশন। সে চেয়েছিল রিচার্ডের রক্ত পর্যন্ত পৃথিবী থেকে মুছে ফেলতে। তাই তাকবীরকেও সে নিজের নিশানায় রাখে।
৩. রিচার্ড কেন মিস এলিসাকে গুলি করেছিল?—দীর্ঘদিন বন্দিদশায় থাকার পর মুক্তি পাওয়া মিস এলিসা তখন জেমসের প্রতিটি কথা সত্য ভেবে বসেন। তিনি বিশ্বাস করেন, এলিজাবেথের কারণেই তার স্বামী মারা গিয়েছে এবং তাকেও এতদিন ধরে আটকে রাখা হয়েছিল। সেই ক্ষোভই ধীরে ধীরে জমে ওঠে মেয়ের প্রতিও। তাই তিনি জেমসের সাথে হাত মিলিয়ে সেদিন এলিজাবেথকে কল করে সেই বিল্ডিংয়ে আসতে বলেছিল, যেখানে ছিল ভয়ংকর
মৃত্যুর ফাঁদ।

৪. রিচার্ড কেন মিস এলিসাকে শুট করে??—রিচার্ড ছিল অত্যন্ত সজাগ। যখন সে জানতে পারে এলিজাবেথ সেই কনস্ট্রাকশন বিল্ডিংয়ে যাচ্ছে, তখনই সে পথিমধ্যে সোর্স লাগিয়ে পুরো জায়গাটি নাড়িনক্ষত্র নিজ নখদর্পনে নিয়ে নেয় এবং জানতে পারে সেখানে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হবে। তখনই মহান আল্লাহতালা প্রদত্ত দৈবগুণ,’উর্বরদক্ষ রিফ্লেক্স ইন্দ্রিয়দ্বারা’ পুরো ষড়যন্ত্র বুঝে ফেলে রিচার্ড। প্রচণ্ড ক্রোধে, প্রতারণা ও বিপদে জর্জরিত হয়ে, সে তখন মিস এলিসাকে গুলি করে বসে। যদিও তখনই নিচ থেকে ন্যাসো ও লুকাস এসে মিস এলিসাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। আর রিচার্ড এলিজাবেথকে নিয়ে বিল্ডিং থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। যার ফলে শেষ পর্যন্ত কারোর প্রাণহানি ঘটে না।

‘ এবার খোলাসা করা যাক—জেমসের থার্ড অপশন ঠিক কী ছিল। প্রথম চাল ছিল এলিজাবেথকে কিডন্যাপ করে কোথাও আটকে রাখা, আর সেই অনুপস্থিতির বিষে তিলে তিলে রিচার্ডকে ধ্বংস করা। দ্বিতীয় চাল—মিস এলিসাকে সামনে রেখে এলিজাবেথকে মানসিকভাবে গুঁড়িয়ে দেওয়া, যাতে এলিজাবেথের হাত ধরে রিচার্ডকে সেই বিল্ডিংয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া যায়। তারপর এক ভয়াবহ ব্লাস্টে শেষ করে দেওয়া হয় তাদের। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল তৃতীয় অপশন। জেমস জানত, রিচার্ড অত্যন্ত চালাক। তার রিফ্লেক্স, তার ইন্দ্রিয় সবসময় সজাগ। অতএব, রিচার্ড যদি একবার আসল চাল ধরে ফেলে, তাহলে সে কিছুতেই মিস এলিসাকে ছেড়ে দেবে না। আর এখানেই এলিজাবেথের প্রতি রিচার্ডের দুর্বলতাকে অস্ত্র করে তুলতে চেয়েছিল জেমস। প্রাণপ্রিয় স্ত্রীর খুনিকে যেমন রিচার্ড ছাড়বে না, তেমনি এলিজাবেথও তার মায়ের খুনিতে ছাড়বে না৷

‘জেমস জানত—যদি রিচার্ড নিজের হাতে মিস এলিসাকে শুট করে, তাহলে এলিজাবেথ কখনোই তাকে ক্ষমা করবে না। নিজের মায়ের খুনি হিসেবে রিচার্ডের প্রতি জন্মাবে ঘৃণা। এটাই ছিল জেমসের আসল খেলা। তৃতীয় চালে ছিল তাকবীরও। আর তাই তো জেমস সেদিন ম্যানশনে পাঠিয়েছিল সেই ল্যাব টেস্ট রিপোর্ট, ঠিক এলিজাবেথের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য। রিপোর্টটি দেখে এলিজাবেথের হাত কেঁপে উঠেছিল, আর সেই কাঁপা হাত থেকেই রিপোর্টটি পড়ে গিয়েছিল মেঝেতে। সেখান থেকেই শুরু এক নতুন আগুনের ছড়াছড়ি। যা শেষ করে দিয়েছে একটি প্রাণ,
যা অনুতাপের গ্লানিতে প্রতিনিয়ত পোড়াচ্ছে এক মাতৃ মন,যা ভুলবোঝাবুঝি আর অভিমানের দেয়াল তুলে
দুজনের মাঝে রেখে দিয়েছে এক শীতল দূরত্ব ভালোবাসার চিহ্নহীন প্রান্তরে।
‘ফুসফুসভর্তি গরম নিঃশ্বাস ধীরে ধীরে দীর্ঘশ্বাসে রূপ নিচ্ছিল। সেই প্রলম্বিত নিশ্বাসের ছন্দে রিচার্ড এগিয়ে যাচ্ছিল কেবিনের দিকে। ঠিক তখনই এক চিকিৎসক তাকে পথরোধ করে বললেন,

“স্যার, অনুগ্রহ করে ফেস শিল্ড ও সুরক্ষা পোশাক পরে নিন। আপনি সংক্রমিত হতে পারেন।”
“আই ফাকিং নিউ ইট,” ঠান্ডা কণ্ঠে বলে অনড় পায়ে কেবিনের দরজার ভেতরে ঢুকে গেল রিচার্ড।
‘এলিজাবেথের চারপাশ ঘিরে স্বচ্ছ পলিথিনের পর্দা একটা নিরাপত্তার খাঁচা মতো করে। চিকিৎসকেরা গর্ভস্থ শিশুর কথা ভেবে কোনো কঠিন ওষুধ প্রয়োগ করছেন না, চলছে কেবল সেলাইন। নাকের ভিতর ঢোকানো একটি সরু নল, জীবনের ক্ষীণ সঞ্চার। ভাইরাসের প্রভাব সীমিত।তাই সন্তান নিরাপদ থাকবে বলেই আশাবাদী সবাই।সব প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে রিচার্ড নিঃসংকোচে সামনে এগিয়ে যায়। পলিথিনের পর্দা সরিয়ে সে দাঁড়াল ভালোবাসার সামনে৷
‘ভেজা কাগজের মতো ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করেছে গোলাপ বর্ণের আভিজাত্যপূর্ণ সুশ্রী মুখশ্রী। কবুতরের ন্যায় মখমলে পলকা দেহখানা সাদা বিছানার সাথে মিশে গিয়েছে দীর্ঘ বারো দিনের শয্যায়। সূর্যের তেজস্ক্রিয় রশ্মির ন্যায় লালচে কুন্তলরাশি দুপাশে বেনি গেঁথে রাখা। কলিবর্ণের ওষ্ঠযুগল আজ নীলাভ, নেই সেই পদ্ম কমল হাসি। প্রকৃতির মতো প্রফুল্ল প্রাণ আজ নির্জীব, নিস্তব্ধ।

‘জড়বৎ মূর্তির মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল রিচার্ড। অতন্দ্র, নির্বিকার দুটি চোখে ঘুমন্ত রমণীর দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে ফেলল এক গভীর নিঃশ্বাস। রিচার্ড ধীরে ধীরে ঝুঁকে পড়ল এলিজাবেথের উপর। কাঁধ ঝুঁকতেই পুরনো ব্যথাটা টেনে উঠল রগে, তবু মুখভঙ্গিতে এক বিন্দুও প্রকাশ নেই। বুকের বাঁদিকে যন্ত্রণার খোঁচা খুবই তীব্র অথচ নিঃশব্দ। কেউ তা টের পায় না। রিচার্ড ঠোঁট বাড়িয়ে নৈঃশব্দ্যে ছুঁয়ে দিল এলিজাবেথের কোমল কপোল। এক দীর্ঘ, সর্বনাশা চুমুতে ঢেলে দিল জমে থাকা সব অস্থিরতা। তারপর দাম্ভিক পুরুষটা তার ভারী, দখলদার সুরে, চিরপরিচিত কোমলতা নিয়ে ডেকে উঠল,

“এলিজান?”
‘এই নিদারুণ কোমল সুরও তার ঘুম ভাঙাতে পারল না। গভীর নিদ্রার অতলে তলিয়ে আছে সে। অথচ সে সবটাই শুনতে পায়, অনুভব করে৷ তবু সাড়া দেয় না। নারীদের এই এক অদ্ভুত চরিত্র। হৃদয়ে অভিমান জমে উঠলে তারা আর কান্নায় ভাঙে না, জাস্ট নিঃশব্দে চুপ হয়ে যায়।
‘রিচার্ড ফিসফিস করে বলল,”স্যরি জান, তখন মনে হয়েছিল—আমি তোমাকে ছাড়া মরতেও পারব না। তোমাকে শুট করার কোনো ইচ্ছেই আমার ছিল না রেড।”

‘ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল রিচার্ড। বেডসাইড টুলটা টেনে এনে বসল এলিজাবেথের মাথার কাছে। একটু আগেও তার কড়া চোয়ালের আড়ালে যে শীতল রাগ ঝিলিক দিচ্ছিল, তা দেখে মিস এলিসা খানিকটা ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। অথচ এখন,মাত্র কিছুক্ষণের ব্যবধানে ভেতরে পা রাখতেই সেই মুখটাই স্নান হয়ে গেছে এক নিঃশব্দ বেদনাতে। রিচার্ড কোটের পকেট থেকে কুঁচকানো, ময়লা কয়েকটা কাগজ বের করল। এগুলো প্লাটফর্মের সেই বয়স্ক লোকটা দিয়ে গিয়েছে এবং যাওয়ার পূর্বে বিনীতভাবে বলে গিয়েছেন চিঠিগুলো সম্পর্কে যেন এলিজাবেথকে অবগত করা হয়। রিচার্ড খুব ভালো করে জানে এই চিঠিগুলোর প্রেরক কে। সে গভীর শ্বাস টেনে ঠৌঁট নেড়ে চিঠিগুলো পড়তে আরম্ভ করল,

প্রিয় শখের নারী,
তারিখ : ১৮/৭/২৫
‘শুরুতেই বলাবাহুল্য, এলোমেলো মস্তিষ্কের অগোছালো লেখাগুলো বুঝে নিও। আজকের আবহাওয়া আমার ভেতরকার মতোই উত্তাল। হাত কাঁপছে, পায়ে অসহ্যকর ব্যাথা। বাচ্চাদের মতো পা দু’টো বিছিয়ে পাগল বেসে প্লাটফর্মে বসে আছি। হাতে একটা বলপেন আর অনেকগুলো সাদা কাগজ। লিখতে বসেছি এক কলুষিত হাতে। অথচ কলমে ভাষা খুঁজে পাই না। কী লিখব?ছোট্ট এক হৃদয় প্রবালের মতো কোমল অনুভূতির অতল জোয়ারে ভেসে চলেছে নিরন্তর। তবে শুরু করি আমার রাণীকে নিয়ে। না, সে কোনো রাজপ্রাসাদের রাণী নয়, সে আমার মনের রাণী।

তার রূপের মাধুর্যে চোখ জুড়িয়ে যায় অথচ ভাষা হারিয়ে ফেলে তার নাম খুঁজতে গিয়ে। কী বলে ডাকব তাকে? রাণী, মহারাণী, রাজরাণী, নাকি রাজকন্যা? কারণ, এতদিন এই নশ্বর পৃথিবীতে থেকেও এমন সৌন্দর্য কি কখনো দেখেছি আমি? মানুষ কি আদৌ এতটা সুন্দর হতে পারে? আমার উত্তর সোজা একবাক্যে—’না’। আমার এলোকেশীর রূপ যেন স্বর্গের এক অপার্থিব উপহার। তো, আজ এমন একজন মানুষের জন্য চিঠি লিখব, যার হৃদয়ের কুঞ্জবনের আমি নেই। কখনোই ছিলাম না। অথচ, আমার সেথায় সে ছাড়া পাইল না স্থান আর কেউ। তাকে যতটা দিয়ে গেলাম, সে ততটাই এড়িয়ে গেল। কত স্নিগ্ধ তুমি, কত ধূর্ত তুমি—কি নিদারুণভাবে আমায় এড়িয়ে যাও তুমি। স্রষ্টা সাক্ষী, আমার ভালোবাসায় ছিল না কমতি, তবুও পরিশেষে হলো আমার প্রাপ্তি। ভালোবাসার ক্ষয়ে, ক্ষয়ে আজ কি ভয়ংকর ক্ষতির সম্মুখীন আমি। তবু নেই আফসোস। ভালোবাসায় হয় না লাভ ক্ষতির বিজনেস।

‘এলোকেশী, তুমিই সেই নারী, যাকে দেখার পর আর কারো দিকে নজর যাইনি। তোমার আগমন ছিল সুনামির ঝড়ের মতো। যার তাণ্ডবে, বিষাক্ত কষ্টে ভেঙে গেল আমার একত্রিত বছরের নির্ভরযোগ্য গড়া হৃদয়। সঙ্গী হতে চেয়েছিলাম, অথচ পরিণত হলাম তার ভালোবাসার নিঃশব্দ, ব্যথিত রাজসাক্ষীতে। এলোকেশী,তোমার পরশে আমার প্রাণ পাথর হয়েও গলে গেল, তবে আমার নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় তোমার মন গললো না কেন? যতটা আমি দিয়েছি, ততটাই তুমি এড়িয়ে গেলে, তবু কেন তোমার হৃদয়ে আমার স্থান হলো না এলোকেশী? কতোজনে চেয়েও পাইনি, আর তুমি পেয়েও পায়ে ঠেলে দিলে অন্যের আশায়। যাকে ভালোবাসি তাকে হারালাম, যে ভালোবাসে তাকে যন্ত্রণায় পুরাইলাম। সহজ ছিল না তোমাকে অন্য কারো সাথে দেখা। তবুও দেখতে হয়েছে। দেখলে আফসোস বাড়ে এমন কিছুর দিকে তাকাতে নেই, কিন্তু তোমার বেলায় তা আমি মানতে পারতাম না এলোকেশী।

‘এলোকেশী,আমি জানি এই দুনিয়ার মানুষের কাছে আমি খুবই ঘৃণিত এক ব্যক্তি। পরপুরুষের স্ত্রীকে পাগলের মতো ভালোবেসেছি আমি। কিন্তু কি করব বল? ভালোবাসার ওপর তো আর কারো হাত থাকে না। তোমাকে ভুলে যাওয়ার ক্ষমতা থাকলে আমি সত্যিই ভুলে যেতাম, বিশ্বাস কর এলোকেশী। তবে আমি যে বড্ড দূর্বল না পাওয়া প্রেমে।মৃত্যু অনিবার্য জেনেও যেমন জন্ম নিলাম, তেমনি তোমাকে পাবো না জেনেও তোমাকে চাইলাম। কিন্তু ভাগ্য আমার সঙ্গে ছিল না। তোমাকে পাওয়ার জন্য যে যুদ্ধে নেমেছিলাম, যুদ্ধের শেষ প্রান্তে এসে দেখী, শক্র পক্ষের মহারানী তুমি। হাহাহা কি সৌভাগ্য আমার।

‘বুঝলে এলোকেশী, আমি হলায় ভৃঙ্গরাজ৷ সবচেয়ে অবহেলিত ফুল হচ্ছে ভৃঙ্গরাজ। তবুও সে কত সুন্দর হেসে থাকে সর্বদা। তেমনি আমি হেসে গেলাম, অথচ আমার ভিতরটা দেখল না কেউ। তোমার নিষিদ্ধ শহরে আমি কেবল প্রবেশ পথের অনুসন্ধানকারী ছিলাম। জীবনের আকাশে তুমি শুকতারা হয়ে ধরা দিয়েছিলে—আর আমি, প্রতিবারই হাত বাড়িয়ে তোমায় ছুঁতে গিয়ে শুধু হেরে ফিরে এসেছি। আমি হয়ত তোমার জীবনের সেরা মানুষ নই, কিন্তূ একদিন তুমি আমার নাম শুনে হেসে বলবে পাগলটা অন্যরকম ছিল। তোমার জন্য ভীষণ মায়া হয় এলোকেশী, তুমি এমন একটা মানুষ হারালে যার উদ্দেশ্যই ছিল কেবল তোমাকে ভালোবাসা।

অবুঝের মতো কথা বলছি না? হ্যাঁ, বলছি। ভালোবাসার জোর থেকেই বলছি। আচ্ছা এলোকেশী, মনের শব্দ তো আরশ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। আর তুমি আমার ঠৌঁটের শব্দগুলোও বুঝলে না। আমার গোটা এক জীবনের আফসোস— সবাই জানল, শুধু তুমিই জানলে না, ঠিক কতটা ভালোবেসেছিলাম তোমায়৷ তোমাকে একজন পেয়েছে মানে, আরেকজন কত বিভৎস ভাবেই না হারিয়েছে। এই জন্মের সবচে বড় ভুল ছিল তোমাকে ভালোবাসা। পরের জন্ম বলতে যদি কিছু থাকে, আমি সেই ভুল আবারও করতে চাই। আজ এ পর্যন্তই, এলোকেশী। বৃষ্টির টুপটাপ শিশিরবিন্দু এসে পড়ছে ব্যান্ডেজের ওপর।রক্তের ছোপছোপ দাগ ফুটে উঠেছে তাতে। ব্যথা এমন গভীরে ঢুকে গেছে, আর বসে থাকা যায় না। আজ উঠেই পড়লাম, এলোকেশী।

তারিখ : ১৯/৭/২৫
‘যদি সেদিন জানতাম, ওটাই ছিল আমাদের শেষ দেখা, তোমাকে আমি আর দেখতে পাবো না, বিশ্বাস কর এলোকেশী—বুক ছিঁড়ে তোমাকে লুকিয়ে রাখতাম। হতাম একটু কঠোর। জোর করে হলেও রেখে দিতাম। কষ্ট পেতে কার ভালোলাগে বল?তোমার শূন্যতা এখন প্রতিটি হাড়ে ব্যথা হয়ে বাজে।
এলোকেশী… তুমি কোথায়?
ফিরে এসো, একটিবার।
আমি যে বড্ড একা।
আমাকে বাঁচাও…
আমি আস্তে আস্তে মরে যাচ্ছি…
তারিখ: ২০/৭/২৫

‘এই ব্যস্ত শহরে সবই মেলে—চায়ের ধোঁয়া, সিগনালের শব্দ, জেগে থাকা বিলবোর্ড,,,সব, সব সব। শুধু আমার এলোকেশীর দেখা মেলে না! শেষ রাত। আজানের ধ্বনি শোনা যায় না এ শহরে। কিন্তু পাঁজরের ভেতরে হাহাকারের শব্দে আমার ঘুম আসে না। তুমি কোথায়, এলোকেশী? আর ঠিক কতটা অপেক্ষা করলে, একবার… মাত্র একবার দেখা পাবো তোমার?
তারিখ : ২০/০৭/২০২৫

‘জানো এলোকেশী, আজ না ওরা আমাকে খুব মেরেছে। তোমার পোস্টার ছাপানোর সময় একজনের সাথে ধাক্কা লাগে। আমার তো একটা পা নেই,ঠিকভাবে হাঁটতে পারি না। ধাক্কাটা ভুলবশত হলেও লোকটা ছিল উঁচু শ্রেণীর নাকউঁচু বদমেজাজী। বুটজুতোর আঘাত গুলো যখন, আমার চোয়ালে এসে পড়ছিল, তখন আমার শুধু একটাই কথা মনে হয়েছিল—আমি বোধহয় তোমাকে আর দেখতে পাবো না। আমার বাঁ হাতের কনিষ্ঠ আঙুল ভেঙে গিয়েছে এলোকেশী। তবু আমি থেমে থাকব না। তোমাকে আমি খুঁজে বের করবোই। আজ রাতটা হয়ত না ঘুমিয়ে পার করতে হবে। পায়ে-হাতে অসহনীয় ব্যাথা, গায়ে জ্বর। প্লাটফর্ম থেকেও আজ বের করে দিয়েছে একজন পুলিশ।
‘আচ্ছা এলোকেশী, ভাগ্য যদি আগে থেকেই নির্দারণ করা থাকে, তবে কেন আমাদের ভুল মানুষের সাথে দেখা হয়?”
‘রিচার্ড থামল। অজানা কারণে তার চোখ রক্তিম হয়ে উঠেছে। সে সঙ্গে, সঙ্গে ফোন বের করে কিছু একটা করল। পরপর কয়েকবার দম নিয়ে আবারও পড়তে শুরু করল,
তারিখ : ২১/০৭/২০২৫

‘ভোর পাঁচটা। তুমিও চাইলে না, আমিও আর পিছু নিলাম না। কিন্তু ভুলতেও পারলাম না। তুমি তুফানের মতো এসেছিলে আমার জীবনে, আমি নিয়তির মতো থেকে গেলাম পাশে। আবারও বলছি—তোমার জন্য ভীষণ মায়া হয়, তুমি এমন একটা মানুষ হারালে যার উদ্দেশ্যই ছিল কেবল তোমাকে ভালোবাসা..।
তারিখ : ২২/০৭/২০২৫
‘সময়, সকাল পাঁচ ঘটিকা। তোমায় আজও খুঁজে পেলাম না, আমিও ঘুমোতে পারলাম না।
তারিখ : ২৩/০৭/২০২৫
‘সে যখন পথ চলে, আমার বুকে ঢেউ উঠে। সে যখন ফিরে তাকায়, আমি থমকে দাঁড়ায়।’
তারিখ : ২৩/০৭/২০২৫
‘অংশ নও, তুমিই পূর্ণতা। বিচ্ছিন্ন আমি,চাষ করি শূন্যতা।’
তারিখ : ২৩/০৭/২০২৫

‘প্লাটফর্মে আজ তুলনামূলক ভীড় কম। সম্ভব বন্ধের দিন আজ। এখন আর আমার দিনক্ষণের খোঁজ নেওয়া হয়না। আজ তোমার খুঁজতে বের হতে পারিনি এলোকেশী। খুব করে স্যরি এলোকেশী। তোমাকে কাছে পাওয়ার আরেকটি দিন পিছিয়ে গেল। মধ্যেরাত থেকে গায়ে প্রচন্ড জ্বর। তলপেটেও অসহ্যকর ব্যাথা। কাল ডাস্টবিন থেকে খাবার কুড়িয়ে খেয়েছিলাম, খাবারগুলো খুব সম্ভবত পঁচা ছিল। যদিও ক্ষিদের তাড়নায় আমার নাকে কোনো গন্ধই লাগেনি। আমি তৃপ্তির সাথে খেয়েছিলাম। বলতে পারো বহুদিন পর পেট ভরে খেয়েছি। পায়ের অবস্থা দিনকে দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। ওষুধ খাওয়া হচ্ছে না,না বিশ্রাম নেওয়া হচ্ছে, শুধু পাগলের মতো ছুটছি। এবার হয়ত পচন ধরবে। কেমন একটা বিশ্রি গন্ধ আসে ব্যান্ডেজের ভেতর থেকে। মানুষের মন মরে গেলে আর দেহের চিন্তা করে না। আমিও করিনা।

‘জানো, এই শহরের কিছু মানুষ খুব ভালো আর অমায়িক। সকলে তোমাকে চিঠির লেখার পর আমি যখন কাঁপছিলাম, তখন একজন এসে আমার গায়ে চাদর চড়িয়ে দিয়ে গেল। একজন দাদু আছেন। রোজ বিকেল হলেই আসেন, আমার জন্য খাবার নিয়ে আসেন। যদিও আমি নিতে চাই না। আসলে কখনো হাত পাতবার কিংবা কারোর কাছ থেকে নিয়ে খাওয়ার অভ্যাস ছিল না তো, তাই। লোকটা নিতান্তই একজন ভদ্রলোক। তাঁর খুব ইচ্ছে, তোমাকে দেখবে। তোমাকে খুঁজে পেলে উনার সাথে দেখা করতে নিয়ে যাবো। কেমন? লোকটা আমাকে খুবই স্নেহ করে। আবার মাঝেমধ্যে পাগলও বলে। আচ্ছা এলোকেশী, আমি কি সত্যি পাগল? আমার খুব কান্না পাচ্ছে এলোকেশী। সবাই আমাকে কেনো পাগল বলে? আমি পাগল না। আমি তো শুধু পাগলের মতো ভালোবেসেছি। পাগলের মতো ভালোবাসলেই কি মানুষ পাগল হয়ে যায়?

হ্যাঁ, স্বীকার করছি—আমার কনফেশনটা অনেক দেরিতে এসেছে। চার বছর আগে যদি সাহস করে বলতেই পারতাম মনের কথা, তাহলে হয়ত আজ তুমি আমারই হতে। কিন্তু এখন, শুধু না-পাওয়ার দায়ে কি ভালোবাসার মানে ফুরিয়ে যাবে? তুমি নেই বলেই কি আমি পাগল? এখানে সবাই আমাকে তাচ্ছিল্য করে, পাগল ভাবে,আর আমি? আমি কেবল সেই অপমান গিলতে গিলতে মনের ভেতর তোমার মুখটাই আঁকড়ে ধরে থাকি। খুব গায়ে লাগে আমার। আমার পজিশন তো ছিল উঁচু পর্যায়ে। এলিট শ্রেণীর আমি আজ কোথায়! একসময় আমার অবস্থান ছিল অনেক ওপরে, সেখানে মন্ত্রী-মিনিস্টার-রাও আমাকে সালাম দিয়ে কথা বলত। কোথাও বের হলে আগেপিছে থাকত শতশত গাড়ি, কত প্রটোকল! আর এখন? এখানে সাধারণ পুলিশও ঘাড় ধাক্কা দিয়ে প্ল্যাটফর্ম থেকে নামিয়ে দেয় পাগল বলে। এই অপমানে তোমাকে ভুলতে গিয়ে জানো, শতবার মৃত্যুর কথা ভেবেছি। কিন্তু মন! এই মন তো তোমায় ছাড়ে না, শুধুই তোমার নাম ধরে কাঁদে।
আমি নিরুপায়…

ক্ষমা করো আমায়।
আমি শুধু ভালোবেসেছিলাম।
তারিখ : ২৪/০৭/২০২৫
‘অভেদ্য নীরবতায় গুমরে মরা, বিকলাঙ্গ অনুভূতির আর্তনাত গুলো কি কখনোই তোমার কানে পৌঁছাতো নাহ?’
তারিখ : ২৫/০৭/২০২৫
‘যেদিন প্রথম তোমাকে লাল শাড়িতে দেখেছিলাম, আমার ভেতরটা যেন ফেঁটে যাচ্ছিল। এখনও ফেটে যাচ্ছে, যখনই মনে পড়ে—লাল শাড়ি তুমি অন্য কারোর জন্য পরেছিলে। তুমি এলিজাবেথ ইমরা এরিন, তাকবীর দেওয়ানের জন্য লাল শাড়ি পরোনি।’
তারিখ : ২৭/০৭/২০২৫

‘শুনেছি যারা লেখালেখি করে তারা নাকি কবি হয়, আজ এই কবি কি লিখবে? যেখানে কবি ব্যর্থ, গল্প অসম্পূর্ণ, সে অন্য কারো! আজকের চিঠিটা তুলনামূলক খুব বড় হবে এবং আমার জীবনের শেষ চিঠি হবে। অনেক বড় একটা স্বীদ্ধান্ত নিয়েছি আমি। সত্যি বলতে আর সম্ভব হচ্ছে না। এবার একটা রফাদফা করা খুব দরকার। তাছাড়া, আমার কাছে লেখার মতো কাগজও আর নেই। কালকের বৃষ্টিতে আমার অনেকগুলো চিঠি ভিজে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। অবশিষ্ট কাগজগুলোও ক্ষিপ্ত প্রকৃতির শীতল হাওয়ায় উড়ে গিয়েছে। অবশিষ্ট যে-ই কাগজটা রয়েছে, তা দিয়েই আজ কাজ চালিয়ে নিবো। আমার শরীর আর দিচ্ছে না গো এলোকেশী। পেটে ক্ষুধা আছে কিন্তু খাবার নেই। আমি অনুভব করছি, আমার পায়ের মাংসে পচন ধরছে। বিদঘুটে গন্ধ আমার নাকে আসে। আমি শুধু স্তব্ধ চোখে চেয়ে দেখি, দিনকে দিন কীভাবে রসাতলে যাচ্ছে আমার পা। ফিরে যাওয়ার পথ আছে কিন্তু আমি ফিরত চাই না। তাই, আজ সব বলব আমি। কিচ্ছু লুকাবো না।

‘আচ্ছা এলোকেশী, আমায় ভালোবাসলে না কেন?ফেরাউন এতো বড় জালেম হওয়ার শর্তেও ‘আছিয়া তার সাথে থেকে গেলো’ তবে কি আমি তার চেয়েও খারাপ ছিলাম? আমি তো ফেরাউনও না, আর নও তুমি আছিয়া। আমার মনে সৃষ্টিকর্তার জন্য ছিল অগাধ বিশ্বাস। আমি মানুষটা অনেক খারাপ হলেও নিশ্চয়ই একটু ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য ছিলাম, তাই না? আর সত্যি কথা জানো কি? আমি খুব বোকা। বিয়ের মতো পবিত্র সম্পর্কই টিকে না। সেখানে তুমি তো আমাকে ভালোই বাসোনি। তাও আঁধার পথে আলোর দিশারীর মতো তোমার ভালোবাসার আশায় নিজেকে তিলে, তিলে শেষ করলাম। জানো এলোকেশী, আমি না খুব কাঁদতাম। বাচ্চাদের মতো কাঁদতাম তোমাকে পাওয়ার জন্য। আমি আব্বার পায়ে ধরে কান্না করে বলেছিলাম মিস এলিসাকে ছেড়ে দিতে। বিশ্বাস কর, আমি চেয়েছিলাম তোমাকে সুন্দর একটা জীবন দিতে। ঠিক যতটা সুন্দর হলে, প্রাপ্তির আনন্দমাখা অশ্রুতে ভিজে যায় আঁখিপল্লব। জানো, আমার চোখ দিয়ে এখনও অশ্রু ঝরছে। কেন ঝরছে তা আমি জানি না। তুমি তো আমার নও! তবুও কেনো! কেনো! কেনো!? এই কেনোর উত্তর আমি আজও খুঁজে পায়নি। তবে, এটা জানি, আমার চিঠিটা পড়ো সময় তুমি কান্না করবে। কি, কাঁদবে না?

‘আবারও থামতে হলো রিচার্ডকে। বুকের ওপর যেন অদৃশ্য এক পাথর চেপে বসেছে। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। কতটা আকুলতা নিয়ে সেই লোকটা চিঠিটা লিখেছিল, যে কায়নাতের মতো দৃঢ়চেতা মানুষকেও স্তব্ধ করে দেয়! রিচার্ড তাকাল এলিজাবেথের দিকে। দেখল চোখের কার্নিশ বেয়ে নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। আজ আর কেন যেন রাগ হলো না তার। নিঃশব্দে বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে অশ্রু মুছে দিয়ে আবারও পড়ে যেতে লাগল সেই চিঠির প্রতিটি পৃষ্ঠা… প্রতিটি হাহাকার….

‘আমার কখনোই কেউ ছিল না। তাই শেষ সময়েও কাউকে আশা করিনা। বাপ? সেইই তো ধ্বংস করল। মা? নিজের না। জৈবিক মা? নিজের হাতে মারলাম। জৈবিক পিতা? চোখেই দেখলাম। আফসোস!! বোন? বেচারি তো জন্মই নিতে পারল না। ভাই?সেও স্বীকার করেনি, আমিও পারিনি। ভালোবাসা? যে হৃদয় চেয়েছিলাম, তা হয়ে গেল অন্য কারো। সংসার?আমি সাজালাম, কিন্তু হলো কই? টাকা-পয়সা? অনেক আছে! সম্পত্তি? অঢেল! রাজরীতি?ওটা তো সময়ের সাথে কথা কয়! সময়? সে তো আমার সবচেয়ে বড় শত্রু। সবশেষে—আমি একদম একা।
‘রাজনীতির মাঠ একদিন আমার নামেই কাঁপত। কত লোক, কত তদারকি। বাপরে বাপ! ‘ভাই, ভাই’ বলে গলা শুকিয়ে ফেলত অনেকে, বয়সে বাপ-সম লোকও পায়ে পড়ে সালাম করত। ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকত শুধু একটুখানি দেখা পাবে বলে। আমার দানেই অনেকের চুলায় আগুন জ্বলত,তখন আমিই ছিলাম তাদের স্বপ্ন, তাদের আইডল। প্রতিটি সমাবেশে নাম উঠলেই জনতার কণ্ঠে বজ্রধ্বনি “তাকবীর দেওয়ান! আইডল অফ আইডল!” আর আজ? আমার নামটাও কেউ মনে রাখে না। জানো এলোলেশী আমার না খুব করে মনে হয়, আমি মরলেও কেউ জানাজা পড়াবে না।

আমার কবরে মাটি দেওয়ার মানুষ থাকবে না। ঠিকই বলেছিল এন্ড্রু কিশোর,
“আমি কত জনরে কত কি দিলাম,
যাইবার কালে একজনারো দেখা না পাইলাম…”
‘রিচার্ড কাগজটা পাশে রেখে দু-হাত দিয়ে মুখ চেপে কতক্ষণ বসে রইল। চোয়াল বেয়ে বেরিয়ে আসছে এক অজানা উত্তাপ। তা কি রাগ, না শোক, না অনুতাপ? নিজেকেই শক্ত করে ধরে কয়েকবার দম টানল সে। তারপর আবারও তুলে নিল চিঠিটা। সত্যিই তো… লোকটা জানাজাও পেল না৷ অনেকগুলো শব্দ ছড়ে গিয়েছে। হয়ত চোখের জলে, হয়ত বৃষ্টির জলে। সজল চোখে রিচার্ড পড়ে গেল সাদা পৃষ্ঠার মসৃণ জমিনে লেখা হাহাকারগুলো,
‘দেওয়ার খাতায় পৃষ্ঠা ফুরালো, প্রাপ্তিতে? একেবারে শূন্য। গোল গোল দুটি ফাঁকা বৃত্ত। তবে জানো, একটা ভালো খবর আছে। প্লাটফর্মে কিছু মুখ চেনা হয়ে গেছে।সেই বৃদ্ধ লোকটা প্রতিদিন এসে গল্প করে। কেউ কেউ খাবার দেয়, কেউ কয়েন ফেলে যায়। কিন্তু আমি তো থাকবো না আর। আমি যে কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। তাই আজ গেয়ে উঠলাম,

“আমার সঙ্গের সাথী কেউ হইলো নারে…
রইবোনা আর বেশি দিন তোদের মাঝারে,
হাইরে ডাক দিয়েছে দয়াল আমারে…”
‘কেন কেউ আমাকে চুজ করল না এলোকেশী? আমার দিকেই কেন এতো অবহেলা? জন্মের পর থেকেই যেন আমি ছিলাম অতিরিক্ত। না চাওয়া, না মানা, না বুঝে ফেলা এক অস্তিত্ব। জন্মের পর মা-বাবা যদি একটু নজর রাখত,শুধু একটু চোখে চোখ রেখে বলত, “তুই আমাদের, তুই কায়নাত বংশের। দেওয়ান বংশ তোর জন্য অভিশাপ” তাহলে হয়ত আজ জীবনটা এতো কঠিন হতো না। হয়ত আমিও হাসতাম, হয়ত আমিও কাউকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে শিখতাম। কিন্তু আজ, আমি শুধুই এক প্রশ্নচিহ্ন।যে নিজেকেই খুঁজে পায় না, আর অন্যদের কাছে তো ছিলামই না। জানি আমার চিঠিটা অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কি করবো বল? অনুভূতি চেপে রাখা গেলেও সংক্ষিপ্ত করা যায় না। দুইদিনের এই দুনিয়ায়, আমরা আড়াইদিনই বুকের কোণে কষ্ট পুষে রাখি। তারপরও স্বপ্ন দেখি কেউ একদিন আমাদেরও, আমাদের মতো করেই ভালোবাসবে। মানুষের মুখ অনেক, মন ক’টা? এই অভিনয়ের শহরে, গান গাওয়ারও তো আর ফুরসত নেই… তবুও দুটো লাইন গাইলাম কেমন,,

❝দেখো আলোয় আলো আকাশ,
দেখো আকাশ তারায় ভরা..
দেখো যাওয়ার পথের পাশে ছোটে হাওয়া পাগলপারা ।
এত আনন্দ আয়োজন, সবই বৃথা আমায় ছাড়া।❞
‘জানো এলোকেশী?আমি হেদায়েত চেয়েছিলাম। ভাবলাম, এই উছিলায় হলেও যদি তোমাকে ভুলে যাই! সেজদায় পড়ে চোখের পানি শুকিয়ে ফেলেছি,বারবার বলেছি,”খোদা,শুধু একবার ভুলিয়ে দাও,কসম করে বলছি, আর কখনো কাউকে ভালোবাসব না।”কিন্তু না, ভাগ্য কখনোই আমার হয়ে কথা বলেনি। আমি যা চেয়েছি, পেয়েছি তার উল্টোটা। যেখানে মানুষ সেজদায় পড়ে জান্নাত চায়, সেখানে আমি শুধু তোমাকেই চেয়েছি তোমাকে, বারবার, বারংবার। আবার সেখানেই লুটিয়ে পড়েছিলাম তোমাকে ভুলে যাওয়ার জন্য। কেমন অবুঝ আমি, লক্ষ করেছ? তাই আর ভুলে যাওয়ার কথা বলিনি কখনো। খোদার দরবারে দাঁড়িয়ে নিজেকেই ধোঁকা দিতে পারিনি। ভুলিনি, ভুলিনি তোমায়। কষ্টকেই সঙ্গী করে নিয়েছি চিরদিনের মতো। তুমি হলে জান্নাতের পরি, আর আমি জাহান্নামের নর্দমায় পড়ে থাকা এক পাপী কীট। আমাদের ফারাকটা শুধু পৃথিবীর না—আকাশ-পাতালের। খোদা কি পারে না একবার,শুধু একবার আবারও তোমার সামনে আমাকে এনে দাঁড় করাতে? আমাদের আবার দেখা হোক । তখন আমি আর ওই হতভাগা মানুষটা থাকব না। তখন আমি হবো সত্যিকারের এক ভালো মানুষ হবো। শুধু তোমার জন্য,শুধু তোমার সামনে দাঁড়ানোর যোগ্য হয়ে আসব।

‘আমি খুব কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এলোকেশী।
তোমার শূন্যতা আমাকে বাঁচতে দেয় না, একটা ছোট বাচ্চার কান্না আমাকে ঘুমোতে দেয় না। ক্ষমা করে দিও প্রিয় শখের নারী। তোমার বিশ্বাস আমি রাখতে পারিনি। কি করেছি সেটা না-ই বা বললাম আজ। শুধু এইটুকু বলি,আমি আত্মগ্লানির দাবানলে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছি। তোমার সঙ্গে দেখা হওয়া তাই খুব দরকার। একটা বিশাল পাপের জন্য ক্ষমা চাইতে চাই, তোমার মুখ দেখে চক্ষু শীতল করে এই জীবন থেকে বিদায় নিতে চাই শান্তিতে। জানো, প্রত্যেক আত্মহত্যাকারী জানে পরের জীবন হয়ত আরও যন্ত্রণাময়,তবুও আমরা আত্মহত্যার পথ বেছে নিই। কারণ, মানসিক অশান্তির চেয়ে শারীরিক কষ্ট সহনীয়। আমরা বাঁচতে চাই বলেই মূলত মরে যেতে চাই। তুমি শুধু একবার দেখা দাও, তারপর যা হবার হোক।

‘সমাপ্তি মানেই তো শেষ নয়, এলোকেশী। সমাপ্তি মানেই এক নতুন শুরু,এক নতুন পরিণতি, যেখানে আর কেউ বাধা হবে না আমাদের মাঝখানে। এই জন্মে দূরত্ব পেরোতে পারিনি,তাই ওপারে আমি অপেক্ষা করব। তুমি আসবে না? অজস্র পাপীর ভিড়ে আমায় খুঁজে বের করার দায়িত্ব দিয়ে গেলাম তোমায়। বিশাল দায়িত্ব কিন্তু। পরেরবার তুমিই হবে আমার মুক্তি। তখন কিন্তু দূরত্ব মেটানোর দায়িত্ব তোমার, তখন আর কোনো তৃতীয় ব্যক্তি থাকবে না। থাকব শুধু “আমরা”।

আমি চাই, আমার আগমন হোক সবার আগে। তোমার দু’চোখে আমিই ভাসি প্রথম। সেখানে রিচার্ড কায়নাত নামক কারোর অস্তিত্ব না থাকুক। ওপারে থাকুক শুধু এক অচেনা ভালো মানুষ, যাকে তুমি চিনে নিতে পারো হৃদয়ের ছোঁয়ায়। সেথায়,শুধু অমরত্ব পাক এলোকেশী আর তার ভালো মানুষের ভালোবাসা।

‘এইবেলায় এসে রিচার্ডের কণ্ঠস্বর খুবই নিচু হয়ে গিয়েছিল। যা শুধু সে-ই শুনেছে। শেষটুকু এভাবেই পড়ে গেল,,,,
‘ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি ছিল অপার টান।যদি প্রকৃত বাবার ঘরে আমার বেড়ে ওঠা হতো, তবে হয়ত আমি হয়ে উঠতাম এক খাঁটি শিল্পী। বাবা হয়ত আমার স্বপ্নকে ডানা দিতেন,তাজুয়ার দেওয়ানের মতো নিজের সুবিধার্থে আমায় রাজনীতির কাদায় টেনে নামাতেন না। জানো, এলোকেশী,চার বছর সময় নিয়ে তোমার জন্য একটা গান লিখেছিলাম। আমার একটা ডায়েরি ছিল। যার প্রতিটি পাতায়, প্রতিটি ছন্দে শুধু তুমিই ছিলে। সেই ডায়েরিটাও হয়ত দেওয়ান মঞ্জিলের আগুনে ছাই হয়ে গেছে। তুমি জানো না এলোকেশী, আমি কতটা একা ছিলাম। আর সেই একা আমি যখন তোমার সান্নিধ্যে আসি, ধীরে ধীরে একটুখানি আশ্রয়ের স্বপ্ন দেখতে শিখি। ইচ্ছে ছিল কোনো এক চাঁদনী রাতে, মাঝ নদীতে একটুকরো নৌকায় তোমায় নিয়ে ভাসব।আর তখন একখানা গান গেয়ে আমার অসহায়ত্ব তোমার হাতে তুলে দিবো,

❝ছাইড়া গেল স্বজন, সুজন—
তুমি তবু পাশে।
তোমার মতোন এমন ক’রে
আর কে ভালোবাসে?
তোমার কায়া, বড় মায়া,
বটের ছায়া চোখে—
আগলে রাখো বন্ধু আমায়
এই দুনিয়া থেকে।
ও বেহুলা…
আমি মরলে,
আমায় নিয়ে ভাসাইও ভেলা❞,,,কিন্তু মেয়ে তুমি তো আমাকে জীবন্তই ভাসিয়ে দিলে। বিশ্বাস কর, এলোকেশী তোমায় যখনই ওর পাশে দেখতাম,মনে হতো আমার ভেতরটা কেউ যেন দুমড়ে-মুচড়ে ছিঁড়ে ফেলছে। আমি ছটফট করতাম, একজন মৃগীরোগীর মতো…চোখ উলটে যেত, বুক ধড়ফড় করত। ঔষুধে শান্তি আসতো না,ঘুম আসতো না,শুধু রাত জেগে,,,, চার দেয়ালে আমার চিৎকার বারবার আঘাত করত। আর প্রতিটি দেয়ালে লেগে থাকত আমার আর্তনাদের ছায়া। লিখে আর কতটুকু বোঝায় তোমায়? চোখ থেকে ঝরা প্রতিটি অশ্রুতেই গাঁথা ছিল একেকটা উপন্যাসের শিরোনাম।

‘সংক্ষিপ্ত করি এবার। আর একটুখানি জায়গা আছে। হাতেও প্রচণ্ড ব্যথা করছে। আজ আর কিছু লুকাবো না, সব সত্য বলে যাবো। তোমাকে বলা মিথ্যেগুলোর ভেতরে আরও একটা মিথ্যে ছিল—আমার হার্টে কোনো রোগ ছিল না। আমি হসপিটালে যেতাম ঠিকই, কিন্তু সেটা হার্টের জন্য না; আমি চাইতাম আমার অতীত মুছে ফেলতে। কারণ, যখনই সেই অতীত আমার চোখের সামনে ভেসে উঠত, আমি আর মানুষ থাকতাম না। অচেনা হয়ে যেতাম নিজের কাছেই। তাই স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছিলাম সব। বেইন ট্রান্সপ্লান্ট নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেছি শুধু এই একটা আশায়—তোমার সঙ্গে একটা শান্ত, নির্ভেজাল জীবন গড়বো। আমি চাইনি, তুমি আমার ভেতরের অন্ধকারটা দেখো। আমি চাইনি, তুমি আমার জন্য কাঁদো। আমার বিশ্বাস ছিল সবাইকে ভুলে গেলেও আমি তোমাকে চিনতে পারব। কিন্তু ভাগ্য… আমার সহায় হলো না। যেদিন অপারেশন হওয়ার কথা ছিল, আমি স্বপ্ন দেখছিলাম—সব ছেড়ে তোমাকে নিয়ে পালিয়ে যাবো কোনো দূরদেশে, যেখানে থাকবে না রিচার্ড কায়নাত, থাকবে না তাজুয়ার দেওয়ান। অথচ তার আগের দিনই হসপিটালে বিস্ফোরণ! আমার দুই বছরের প্রস্তুতি, স্বপ্ন, সংগ্রাম—সব এক মুহূর্তেই ছাই হয়ে গেল।

‘যদি কোনোদিন মনে হয়, তুমি তার কাছে যথাযথ সম্মান পাচ্ছো না তখন এই চিঠির নিচে দেওয়া উকিলের সঙ্গে যোগাযোগ করো, এলোকেশী। আমি জানি, সে তোমায় ভালোবাসে, গভীরভাবে। তবু যদি তার ভালোবাসায় কোনোদিন অভাব অনুভব করো, দয়া করে নিজেকে হারিয়ে ফেলো না। তুমি এক পবিত্র ফুল, যার গায়ে অবহেলার ধুলো লাগা উচিত নয়। আমি আমার ব্যক্তিগত উকিলের কাছে বলে রেখেছি—তুমি গেলে, সে তোমাকে সব বুঝিয়ে দেবে। তাকবীর দেওয়ানের সমস্ত সম্পত্তি তোমার নামে করে দিয়েছি, এলোকেশী। আর হ্যাঁ, ওর শরীরের একটি অংশও তোমার জন্য রেখে গেলাম। গতকাল আমি আমার একটি কিডনি তোমার নামে ডোনেট করে দিয়েছি ওই ভদ্রলোকের সাহায্য নিয়ে। তুমি না জানলেও, আমি জানতাম আমাদের ব্লাড গ্রুপ এক। আমরা একসাথে জীবন পার করিনি ঠিক, কিন্তু আমার একটুখানি অস্তিত্ব যেন তোমার ভেতরে বেঁচে থাকে। আমার কিছু চাওয়া আছে, এইটুকু অবদার রাখবে তো?

১. আমার কবরটা যেন হয় আমার মা-বাবার মাঝখানে। একটুখানি আদর চাই তাদের এই জীবনের শেষে গিয়েও।
২.করুণা করেও যদি হয় একবার এসো আমার কবরে।
যদি হৃদয়ে টান না-ও জাগে, তবে এনে লাগিও তোমার প্রিয় বেলি গাছটা। ফুল ফুটলে, ফুলের গন্ধে বিভোর হয়ে ছুটে এসো একদিম। তখন যেন তোমার পরনে থাকে লাল শাড়ি—শুধুই আমার জন্য।”
৩. তোমার স্বামীকে মন থেকে ভালোবেসো। সে আমার চেয়েও কঠিন সময় পার করেছে জীবনে। তার জীবনের অর্ধেক কেটেছে একা, আঁধারে। না পাওয়ার কষ্ট বাদ দিলে, সে ছিল আমার থেকেও দুর্ভাগা। যেদিন জানতে পারলাম, সে আমার ভাই, মনটা কেমন করে উঠেছিল। একটু খোঁজ নিয়ে যখন ওর অতীতটা জানতে পারলাম, অজান্তেই চোখ ভিজে উঠেছিল। মা-বাবাহীন জীবনে বেড়ে ওঠা আমার ভাইকে কখনো অবহেলা করো না, এলোকেশী। আমরা এক রক্তের হলেও ভিন্ন গোছের মানুষ। আমি হয়ত আমার যন্ত্রণা প্রকাশ করতে পারি, কিন্তু ও পারে না। আর তাই ওর কষ্টটাই বেশি, যা বোঝার ক্ষমতা অনেকেরই নেই। সবশেষে, এটুকুই চাওয়া—তোমরা সুখী হও।

‘তবে এটুকু স্বীকার করতেই হবে তোমার স্বামীর ভালোবাসায় ছিল এক রকমের তীব্রতা, ছিল এমন কিছু, যা হয়ত আমার ভালোবাসার থেকেও বেশি শক্তিশালী ছিল। না হলে, তুমি তো তার প্রেমে পড়তে না। এই জন্মে আমি সবচেয়ে গভীর শিক্ষা পেয়েছি একটাই—সম্পর্কে তৃতীয় কারও কোনো স্থান নেই। আর সেই সত্যটা তোমার স্বামী আমায় নির্মম স্পষ্টতায় শিখিয়ে দিয়েছে।

‘চিঠির শেষ প্রান্তে এসে এই বেহায়া আমি, আজও নিলজ্জের মতো আবারও বলছি,”ভালোবেসেছি, ভালোবাসি, ভালোবেসে যাবো”। হ্যাঁ, আমি ভালোবাসি তোমাকে৷ ঠিক যতটা তুমি তোমার স্বামীকে ভালোবাসো, ততটাই গভীর, নিখাদ আমার ভালোবাসাও তোমার প্রতি।তোমার ভালোবাসায় যদি খাদ না থাকে, তবে তাকবীর দেওয়ানের ভালোবাসাতেও এক বিন্দু খাদ নেই। শেষ অনুরোধ ‘ঘৃণা করো, তবু মনে রেখো আমায়। ভুলে যেও না আমায়, যেমন করে আমরা সুখের দিনে সৃষ্টিকর্তার কৃপা ভুলে যায়। তুমি যখন এই চিঠিটা পড়বে, তখন হয়ত আমি আর থাকব না। অপ্রত্যাশিত জীবনের প্রত্যাশিত মৃত্যুকে আমি সাদরে গ্রহণ করলাম। আর বলব না, এলোকেশী বাঁচাও! আমাকে বাঁচাও তুমি! বুক জ্বলে যাচ্ছে, পুড়ে যাচ্ছে। আমাকে বাঁচাও তুমি,,,আর বলব না। অতঃপর,

❝খোদা কি তোমার, আমার মিলন
লিখতে পারত না?❞
ইতি,
ব্যর্থ পুরুষ,
‘রিচার্ড স্তব্ধ, শান্তমূর্তির মতো বসে রইল কিছুক্ষণ। লোকটা কি সত্যিই তাকে ভাই বলে মেনে নিয়েছিল শেষ সময়ে? বুকটা হঠাৎই ভরে উঠল এক অজানা উষ্ণতায়। কিন্তু সেই আনন্দেই হঠাৎ ধাক্কা দেয় এক নিষ্ঠুর স্মৃতি। লোকটার শেষ ইচ্ছেগুলো অপূর্ণই রয়ে গেল। তার কবরও দেওয়া হয়নি বাবা-মায়ের পাশে। জানাজাও হয়নি। এই ব্যস্ত শহরে কে-ই বা সময় করে তার জানাজা পড়াবে? ন্যাসো আর লুকাস তখন ব্যস্ত হসপিটালে দৌড়াদৌড়িতে। তাদের কাছে তাকবীর দেওয়ান শুধু একটা দায়িত্বহীন বোঝা। কোনোরকমে মাটিচাপা দিয়ে শরীরের পচন ঠেকানোর জন্য।
‘এই প্রথম রিচার্ড বোবা হয়ে যায়। কিছু বলার মতো শব্দ খুঁজে পায় না। শুধু বুকের ভেতর জমে উঠছে এক অসম্ভব অস্থিরতা। যেটা কেবল অনুভব করা যায়, প্রকাশ নয়। হঠাৎ রিচার্ড ওঠে দাঁড়াল। ঝুঁকল এলিজাবেথের ওপর। তার রুক্ষ নাক ঠেকল এলিজাবেথের কপালে। মেপে মেপে কথা বলা লোকটা আজ হঠাৎ করেই ফুঁপিয়ে উঠল কথার শুরুতেই। এলিজাবেথকে নিজের পেশল শক্ত বাহুবেস্টনে আঁকড়ে ধরে দলা পাকানো কণ্ঠে বলে উঠল,
“এলিজান, আমার জান, প্লিজ উঠে পড়ো। এই জানোয়ারটা বাঁচবে না তোমায় ছাড়া। হ্যাঁ, আজ বলছি, নিজেকে ভেঙেচুরে বলছি—আমি তোকে ছাড়া বাঁচব না এলিজান। বেঁচে থাকার জন্য তোমাকে আমার খুব প্রয়োজন। এতো অভিমান করে না রে জান। একটু চোখ খুলে দেখ না, একটা মানুষ কিভাবে তিলে, তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমাকে আরেকটা সুযোগ দাও, রেড প্লিজ। আমি নতুন, সুন্দর একটা জীবন চাই। আমাদের প্রেম হয়েছে, সংসার হয়নি মিসেস কায়নাত। এভাবে সবটা শুরুর আগে শেষ হতে দিও না।”

‘টপ করে দু’ফোঁটা শীতল অশ্রু গড়িয়ে পড়ল এলিজাবেথের চোখের পাতায়। হ্যাঁ, রিচার্ড কায়নাত কাঁদছে আজ এতো বছর পর। অস্বাভাবিকভাবে চিৎকার না করে কাঁদছে এক ভয়াবহ নিঃশব্দে। জীবনের বারবারের ধাক্কায় যে হৃদয়টা একসময় পাথরে পরিণত হয়েছিল, আজ সেই পাথর গলে জল হয়ে যাচ্ছে। সেই হৃদয়ে একদিন রুশরমণীর কোমল ছোঁয়ায় ফুটেছিল প্রেমের প্রথম ফুল। আর আজ, সেই প্রেমই যখন তাকে নির্বাক নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে, তখন রিচার্ড আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। ভেঙে চুরে, নিজেকে তুলে ধরল এক ছিন্নভিন্ন বাস্তবতায়। নিঃশেষ শরীরটা শক্ত করে চেপে ধরে বুকের সঙ্গে আর ফোঁপাতে ফোঁপাতে কাঁপা গলায় বলে যেতে লাগল ক্রন্দনরত স্বরে,
“তুই ছাড়া আমার ক্ষতগুলো দেখানোর মতো কেউ নেই রে এলিজান। প্লিজ উঠ না। কষ্ট হচ্ছে রে জান… খুব কষ্ট।”
‘অভিমানী কন্যা তবুও নড়ল না একচুল। রিচার্ড ছুটে গেল ওর পেটের কাছে। যদিও এখনো ভেতরে প্রাণের নাড়াচাড়া টের পাওয়ার মতো হয়নি, তবুও সে কান পাতল পেটের ওপর। চুমু বর্ষিত হতে থাকল কাঁপতে থাকা ঠোঁট থেকে। পেটে কাত হয়ে মাথা রেখে এলিজাবেথের দিকে তাকিয়ে ভাঙা স্বরে বলতে লাগল,

“আমার এরিদ, রিস্ক, ইস্ক তোর এখানে আছে জান।
তুই চোখ খোল এলিজান। আমি একটা খুব সাধারণ, খুব সুন্দর সংসার চাই। তুই কি খুব রাগ করে আছিস? এতটা অভিমান? রিচার্ড কায়নাতকে কষ্ট দিতে চাইছিস তুই? ঠিক আছে, ওদের লাগবে না। আমি বাপ হতে চাই না… আমি শুধু তোকে চাই এলিজান। শুধু তোকে…”
‘রিচার্ড আজ ছন্নছাড়া। কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে সে আবারও ছুটে গেল এলিজাবেথের কাছে। পুরো মুখে পাগলের মতে চুমু খেতে, খেতে বলতে থাকে,
“আই রিয়েলি লাভ ইউ, রেড৷ অনেক ভালোবাসি আমার এলিজান। জান রে, এভাবে আমাকে শেষ করে দিস না। চোখ খোল, আমার সাথে রাগ কর। তবুও এভাবে ঘুমিয়ে থাকিস না। ভেতরে যে কি হচ্ছে, তা বোঝাতে আমি ব্যর্থ। তুই না বোঝলে আর কে বুঝবে, বল?”

‘এতেও যখন কাজ না হয়, তখন আর কোনো কূলকিনারা পেল না রিচার্ড। আজ সে বড্ড অধৈর্য। লোকটার হাত থরথর করে কাঁপছে। সে পকেট থেকে রিভলবার বের করে নিজ কপালে চেপে ধরল। অশ্রুসিক্ত চোখে নিস্তব্ধ, আয়েশ করে ঘুমন্ত এলিজাবেথের দিকে তালিয়ে চিৎকার করে বলল,
“এই আল্লাহর বান্দি এই, চোখ খোল। তুই আমাকে ছাড়া মরতেও পারবি না। তুই চলে গেলে আমি কি নিয়ে বাঁচব? আমার বাঁচার আর কোনো উৎস নেই। বোকা পেয়েছিস আমাকে? আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে যাবি, আর আমি নাটক দেখব?চোখ খুল, নয়ত আমি নিজেকে শুট করব।”
‘রিচার্ড কাউন্ট ডাউন শুরু করল,”১.২.৩..ঠাসসসসসসস।
——-
‘ন্যাসো আর লুকাস রিসেপশনে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ গুলির বিকট শব্দে কেঁপে উঠল পুরো ফ্লোর, সাথে তাদের বুকও। তারা দৌড়ে এলো কেবিনের সামনে। কেবিনের কাছে যেতেই পা যেন জমে গেল জায়গায়। যে-ই দৃশ্যটা দেখল,তার কোনো সাধারণ দৃশ্য নয়। রিচার্ড কায়নাত তার ভাইরাসে আক্রান্ত স্ত্রীকে পাঁজা কোলে নিয়ে বেরিয়ে আসছে। চারপাশের লোকজন আতঙ্কে ছুটছে উল্টো দিকে। একজন নার্স এগিয়ে এসে মুখে মাস্ক চেপে ধরে, কাঁপা গলায় প্রশ্ন করল,
“একি! এই অবস্থায় আপনি ওনাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?”
‘রিচার্ডের কণ্ঠে দুর্দম দৃঢ়তা,
“আমার ওয়াইফ, আমার সাথে তার রাজপ্রাসাদে থাকবে।”
‘ন্যাসো আর লুকাস স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রিচার্ডের চোখের দিকে। সেখানে তারা দেখল অশ্রু। হ্যাঁ, এই প্রথম লোকটাকে কাঁদতে দেখল তারা৷ যে লোক বাবার কবরের পাশে গিয়েও কাঁদে না, সন্তানের মৃত্যুতেও যার চোখ শুকনো ছিল, আজ সে কাঁদছে! অজান্তেই তাদের চোখও ভিজে উঠল। তারা দু’জন এগিয়ে গিয়ে ঈগলের ডানার মতো ছায়া হয়ে দাঁড়াল বসের পাশে। রাজা চলেছে তার অসুস্থ রাণীকে নিয়ে রাজপ্রাসাদে আর দুই অনুগত রক্ষাকবচ, নিঃশব্দে তার পাশে হেঁটে চলেছে।

‘প্রেম যেমন ধর্ম, জাত, কূল কিছুই মানে না। তেমনি এক অতি সাধারণ মেয়ে ভালোবেসে ফেলেছিল এক হৃদয়হীন গ্যাংস্টারকে। তার ভালোবাসা ছিল নিখাদ, নিঃস্বার্থ, এতটাই গভীর যে, আরেকজন কোমল হৃদয়ের পুরুষের স্নেহেও গলল না তার হৃদয়। কিন্তু প্রেম যখন প্রতিদিন আঘাত হয়ে ফিরে আসে, যখন ভালোবাসার বদলে জোটে রহস্যের পর রহস্য, ছলনা, বিশ্বাসঘাতকতা, তখন একসময় ব্যথাও আর ব্যথা থাকে না। জমতে জমতে সে ব্যথা রূপ নেয় এক ঠান্ডা নিস্তব্ধতায়। এভাবেই আজ এলিজাবেথ ব্যাথাহীন। না, সে আর কাঁদে না। না অভিমান করে, না অভিযোগ। মেয়েরা কোমল। তারা শুধু চায় একটু ভালো থাকা, একটু প্রশ্রয়, একটু ঘর। আর এত রহস্য, এত ছলনার খেলায় সে ক্লান্ত। তাই সে আর উঠল না। সে শুধু ঘুমোয় এক গভীর, শান্ত, অব্যক্ত ঘুমে। যেখানে আর কেউ তাকে ব্যথা দিতে পারবে না।

‘এলিজাবেথকে ম্যানশনে রেখে চিকিৎসার সব ব্যবস্থা করে রিচার্ড গাড়ি নিয়ে রওনা দিল। গোধূলির নরম আলোয় পৌঁছে গেল ইতালির সবচেয়ে বৃহৎ কবরস্থানে। গাড়ি থেকে নামার আগে ভুল করেনি কালো পলির ব্যাগটা হাতে নিয়েই নেমেছিল। রিচার্ড সরাসরি গিয়ে দাঁড়াল এক নির্জন কবরের সামনে। তাকবীর দেওয়ান ছাড়া সেখানে আর কারোর নামই খোদাই করা নেই। থাকবে কীভাবে? লুকাস ন্যাসো ওরা কেউই জানত না রিচার্ডের বাবা-মায়ের নাম।
‘কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ল রিচার্ড। সমাধিফলকের একপাশে পাথর দিয়ে ঘষে নিজের হাতে লিখে দিল তার আসল বাবা-মায়ের নাম। অতঃপর ব্যাগ থেকে বের করল একটি ছোট্ট বেলি ফুলের চারা। এই শহরে তা খুঁজে পেতে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি, তবু পেরেছে রিচার্ড। নিজের হাতে চারা গাছটা রোপণ করল তাকবীরের কবরের পাশে।
‘একদৃষ্টিতে কবরের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে মৃদু কণ্ঠে বলে উঠল,

“সন্তানের খুনি কখনো ভাই হতে পারে না। তবুও, তোর একটা শেষ ইচ্ছে আমি পূরণ করব।”
‘কে জানে কেন, গাছটা কেন লাগালো সে। তারপর আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। উঠে দাঁড়িয়ে হনহনিয়ে হেঁটে চলে গেল রিচার্ড। কবরস্থান থেকে সরাসরি চলে গেল রিচার্ড একটি ছোট্ট মসজিদে। গাড়ি থেকে নেমেই পায়ের জুতো ও মোজা খুলে হাঁটা দিল ওযুখানার দিকে। রিচার্ডকে তখন ওভাবে হঠাৎ বেরিয়ে যেতে দেখে ন্যাসো আর লুকাসও নিঃশব্দে তার পিছু নিয়েছিল। কিন্তু যখন দেখল রিচার্ড ওযু করে মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করছে তখন আর এগোয়নি তারা। নিজের নিয়মে চলা, জবাবদিহির ঊর্ধ্বে থাকা মানুষটা আজ সৃষ্টিকর্তার দরজায় মাথা নত করছে।
‘লুকাসের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে ন্যাসো বলল,

“ভালবাসা! এমন এক যাদু, যা পশুকেও মানুষ বানিয়ে ফেলে!”
‘তারা চলে গেল। মাগরিবের সাত রাকাত নামাজে রিচার্ড নিয়েছিল পুরো চল্লিশ মিনিট। যখন মসজিদ থেকে বেরোল, চারপাশে নিস্তব্ধতা। শুধু বাতাসে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল তার দীর্ঘ মোনাজাতের শেষ প্রার্থনাগুলো,
“ইয়া আল্লাহ, দিস ভিলেন হ্যাজ প্রুভেন দ্যাট ইভেন আ ভিলেন ক্যান বি আ লাভার। নাও, প্লিজ গিভ মি আ চ্যান্স টু প্রুভ দ্যাট আ ভিলেন ক্যান অলসো বি আ গুড হাসবেন্ড এন্ড দ্য বেস্ট ফাদার। ইয়া আল্লাহ, আই ওয়ান্ট মাই ওয়াইফ ব্যাক। টেক মাই লাইফ, বাট আই ওয়ান্ট হার।”

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৬৬

‘সব পথ যখন বন্ধ হয়ে যায়, তখনো একটি পথ খোলা থাকে সেটি হলো খোদার দরবার। সেই দরজায় ফিরে আসা মানেই আশার সম্ভাবনা। রিচার্ড চোখের জল মুছে গাড়ির দিকে এগোচ্ছিল, এমন সময় তার ফোনটা বেজে ওঠে। কল রিসিভ করতেই চোখের কোণ আবারও ভিজে উঠল। কালচে ঠোঁটটায় ফুটে উঠল এক ব্যতিক্রমী হাসি, বাঁ গালে খেলে গেল সৌন্দর্যের আলো। রিচার্ড দৌড়ে ছুটে গেল গাড়ির দিকে। ঠৌঁটের কোণে লেপ্টে আছে পূর্ণতার আভাস , চোখে অনাগত পূর্ণের চিহ্ন। দোয়ার শক্তি বুঝি এমনই? রিচার্ড ছুটে চলেছে এক অদৃশ্য টানে। পিছনে রেখে গেল একটি মাত্র বাক্য—❝Yes, Villain can be a lover❞

সমাপ্ত