ভুলোনা আমায় পর্ব ২

ভুলোনা আমায় পর্ব ২
মেঘাদ্রিতা মেঘা

ডাক্তার রিপোর্ট গুলো হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে বলেন,
একটা ব্যাড নিউজ আছে।
আমি কল্পর চোখের দিকে তাকাই,কল্পও আমার চোখের দিকে তাকায়।
তবে আমার কেন যেন মনে হচ্ছে কল্পের কোন সমস্যা নেই।যদি কোন সমস্যা থেকে থাকে,সেটা আমারই হবে।কল্পের না।
আমি কল্পের হাত টা শক্ত করে ধরলাম।

ডাক্তার বললেন দ্রিতা,আপনার জ*রায়ুতে একটু সমস্যা আছে।
আর সেই জন্যই আপনার বেবী কনসিভ হচ্ছেনা।
আপনার হাজবেন্ডের সব রিপোর্ট নরমাল।তার কোন সমস্যা নেই।
তবে আপনার ট্রিটমেন্ট এখন থেকেই শুরু করতে হবে।
এখন থেকে ট্রিটমেন্ট শুরু না করলে আপনার জীবনও ঝুঁকির সম্মুখীন হবে।
আর আপনি তাহলে আর কোন দিন মা ও হতে পারবেন না।
কথা গুলো শুনে আমি কল্পের হাত টা ছেড়ে দিলাম।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কল্প আমার দিকে অবাক হয়ে তাকালো।
এবার ও নিজেই আমার হাত টা শক্ত করে ধরে ডাক্তারকে বল্লো,আপনি ওর ট্রিটমেন্ট এর ব্যবস্থা করুন।
আমরা এখন থেকেই শুরু করবো ওর ট্রিটমেন্ট।
আমরা ডাক্তারের রুম থেকে বের হলাম।
বের হয়েই আমি হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলাম।
কল্প আমাকে শক্ত করে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বল্লো,
কিচ্ছু হবেনা তোমার।

সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে দেখো।
আমি কান্না করতে করতে কল্পকে বললাম,আমি কি মা হতে পারবোনা কল্প?
আমি কি তোমায় বাবা ডাক শোনাতে পারবোনা বলো?
_কে বলেছে তুমি মা হতে পারবেনা?
অবশ্যই পারবে।

আমরা দুজনই মা বাবা হবো।এবার তুমি একটু শান্ত হও।বাসায় যেতে হবে আমাদের।
আর খবরদার! বাসার কেউ যেন আজকের এই বিষয় টা সম্পর্কে না জানে।
তাহলে কিন্তু তোমার একদিন কি আমার একদিন।
চিকিৎসা করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে বুঝছো?
মন খারাপ করোনা।
কল্প আমাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাসায় নিয়ে আসে।
কিন্তু আমার মন তো মানেনা।

কেটে যায় কিছু দিন।
আমার ট্রিটমেন্ট চলছে।
আশেপাশের সবাই বলছে,সু খবর কবে পাচ্ছি?
আমি কোন উত্তর দিতে পারিনা।
কল্প আমাকে টাইম টু টাইম ওষুধ খাওয়ায়।
অনেক খেয়াল রাখে আমার।
একদিন রাতে কল্পকে আমি বলি,

_শোনো,
_হুম শুনছি।
_বলছিলাম কি, আর কত দিন আমার এই সমস্যার কথা তুমি সবার থেকে লুকোবে?
তাছাড়া একদিন না একদিন তো সবাই জানবেই।
_তত দিনে তুমি সুস্থ হয়ে যাবে।এত চিন্তা করোনাতো।
আমি চাইনা মানুষ তোমাকে নিয়ে কোন বাজে কথা বলুক।
আমি মানসিক আর শারিরীক ভাবে অসুস্থ বলে কল্প আরো কিছু দিনের ছুটি বাড়ায়।
যাতে আমার একটু ভালো লাগে।

দেখতে দেখতে আরো কিছু দিন কেটে গেলো।
আমার ট্রিটমেন্টের অনেক গুলো দিন হয়ে গেলো।
আজ ডাক্তার আবার কয়েকটা টেস্ট দিয়েছেন,জানতে যে ট্রিটমেন্ট এ আমার কতটা উন্নতি হয়েছে।
আমি টেস্ট গুলো করে কল্পের সাথে বাইরে অপেক্ষা করছি।

_কল্প!
_হুম।
_আজ যদি রিপোর্টে আসে আমি আর কোন দিন মা হতে পারবোনা।আর আমার সমস্যার কোন উন্নতি হয়নি।
বা যদি বলে আমি আর বেশি দিন বাঁচবোনা।
বাকি কথা গুলো কল্প আমাকে আর বলতে দেয়না।
ওর হাত দিয়ে আমার মুখ টা চেপে ধরে।
আর বলে,

আমার বাচ্চা কাচ্চা লাগবেনা কলিজা।
তুমি আর আমি বাচ্চা ছাড়াই বাকি জীবন কাটিয়ে দিবো।
আমার তুমি থাকলেই হবে।
আমার আর কিচ্ছু চাইনা।
আমি সেদিন বুঝেছিলাম,কল্প আমাকে কতটা ভালবাসে।
কিন্তু আমি জানি,কল্পের বাবা হবার অনেক শখ।আর প্রতিটা ছেলের ই এই ইচ্ছেটা থাকে।কেউ তাকে বাবা ডাকবে।
তাছাড়া কল্প বাচ্চাদের খুব ভালবাসে।

আর আমার কারণে যদি ও বাবা ডাক থেকে বঞ্চিত হয়,তবে আমি সেটা মানবো কি করে।
এসব ভাবতে ভাবতে রিপোর্ট চলে আসে।
আমরা রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাই।
ডাক্তার আমাদের বসতে বলেন।
তিনি রিপোর্ট গুলো দেখছেন।
রিপোর্ট গুলো দেখা শেষ হলে তিনি একবার কল্পের দিকে তাকান,আরেকবার আমার দিকে তাকান।
আমি ডাক্তারকে বলি,

রিপোর্টে কি এসেছে ম্যাম?
তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,
কথাটা কিভাবে বলবো বুঝতে পারছিনা।
তবে তুমি চাইলে এখন মা হতে পারো।
কিন্তু..
কল্পঃকিন্তু কি ডাক্তার?

ডাক্তারঃ মিঃ কল্প!আপনি যদি সন্তান চান তাহলে দ্রিতার জীবন ঝুঁকিতে পড়ে যাবে।
তবে ও এখন চাইলেই সন্তান নিতে পারবে।
কিন্তু যদি আপনি ওকে বাঁচাতে চান।ওকে পুরোপুরি সুস্থ দেখতে চান।

তাহলে ওর জ*রায়ু টা কে*টে ফেলে দিতে হবে।অতি শীঘ্রই একটা অপারেশন করতে হবে।
তাহলে আপনার স্ত্রী বেঁচে যাবে,পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে।কিন্তু কোন দিন আর মা হতে পারবেনা।
আর যদি অপারেশন না করেন,তাহলে আপনার স্ত্রী ধীরেধীরে মৃত্যুর দিকে এগুতে থাকবে।
এখন আপনার উপর সব কিছু মিঃ কল্প!
আপনি কি চান।
স্ত্রী নাকি সন্তান।

কল্প আমার হাতটা শক্ত করে মুঠোবন্দি করে ধরে,
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে এক নিশ্বাসে বলে দেয়,
_ডাক্তার আমার আমার স্ত্রীকে লাগবে।
আপনি অপারেশনের ব্যবস্থা করুন।
আমি এই মুহূর্তটাতে কোন কথাই বলতে পারছিলাম না।
আমার চোখ থেকে শুধু টপটপ করে পানি পড়ছিলো।
আর আমি ভাবছিলাম,
এই মানুষ টা আমাকে এত ভালবাসে কি করে?
ডাক্তার আমাদের বল্লেন,

আপনারা আগামী পরশুদিন আসুন।
আমি তাহলে সব ব্যবস্থা করে রাখবো।
আর দ্রিতা তুমি এই ওষুধ গুলো এই কয়দিন নিয়মিত খেও কেমন?
কল্পঃতাহলে আমরা আসি ডাক্তার।
আসসালামু আলাইকুম!
ডাক্তারঃওয়ালাইকুম আসসালাম।
আমি স্তব্ধ হয়ে যাই।
কল্প আমাকে ধরে বাসায় নিয়ে যায়।
আমার শশুড় বাড়ীর লোক জন কল্পকে জিজ্ঞেস করে আমার কি হয়েছে।
কল্প বলে একটু শরীর খারাপ লাগছে ওর।
রাত হয়ে যায়।
আমি সবার সাথে বসে খেতে যাইনা বলে কল্প আমার জন্য প্লেটে করে খাবার নিয়ে আসে।

_এই যে বউটা!
তাড়াতাড়ি উঠে বসো,খেয়ে তারপর ঘুমিওনে।
_আমার খেতে ইচ্ছে করছেনা কল্প!
_আমি নিজ হাতে খাইয়ে দিবো আমার বউটাকে,তবুও খেতে ইচ্ছে করবেনা?
আমি শোয়া থেকে উঠে বসে কল্পকে জড়িয়ে ধরলাম।
আর কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলাম,
আমার সাথেই কেন এমন হলো কল্প?
আমি তো ছোট্ট একটা রাজকন্যার স্বপ্ন দেখেছিলাম।
যার চোখ হবে তোমার মত।
হাসি হবে তোমার মত।

নাক টাও হবে তোমার মত।
শুধু ঠোঁট হবে আমার মত।
তাহলে কেন আমার সাথে এমন হলো?
আমার স্বপ্ন কি পূরণ হবেনা বলো?
আমি কিভাবে নিজের জীবন রক্ষা করতে গিয়ে তোমার আর আমার স্বপ্ন ধ্বংস করবো?
আমি পারবোনা।
আমি যাচ্ছিনা হসপিটালে।
আমি মা হবো।
আমার একটা মেয়ে লাগবে কলিজা।
আমাদের মেয়ে।
তোমার আমার মেয়ে।

_দ্রিতা,এমন করেনা।
আমরা একটা বাচ্চা এডপ্ট করবো হুম?
কত মানুষেরই তো বাচ্চা হয়না।
তারা কি সুখে আছেনা?
আমরাও সুখে থাকবো।
পারবেনা আমায় নিয়ে কাটিয়ে দিতে সারাটা জীবন?আমি শুধু তোমাকে চাই দ্রিতা।
আমার আর কিচ্ছু লাগবেনা।
কল্প আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে আর কথা গুলো বলছে।
আমিও কাঁদছি, আর ভাবছি ওর মত জীবন সঙ্গী পাওয়া আসলেই ভাগ্যের ব্যাপার।

_শোনো,আমরা যে অপারেশন করবো এটা কাউকে বলবেনা।আমি যখন আরেকবার দেশে আসবো,তখন যা বলার বলবো আমি সবাইকে।
এখন কিছু বলার দরকার নেই কাউকে ঠিক আছে?
অপারেশন হয়ে গেলে ৩ /৪ দিন তুমি আমি হসপিটালেই থাকবো।
তারপর আমরা তোমাদের বাসায় যাবো।
তুমি একটু সুস্থ হলে তারপর এই বাসায় আসবো।কেমন?আম্মুকে বলে যাবো তোমাদের বাসায় বেড়াতে যাচ্ছি।
হসপিটালের কথা কেউ যেন না জানে।
এবার খাবে আসো।
কল্প আমাকে জোর করে নিজে হাতে খাইয়ে দেয়।
এরপর ডাক্তারের কথা অনুযায়ী আমরা হসপিটালে যাই।কল্প ওর বাসায় বলে যায় আমরা আমাদের বাসায় বেড়াতে যাচ্ছি।
হসপিটালে বসে আছি আমরা।ডাক্তার আমাকে ডাকছেন।
_কল্প!
আমি কি সত্যিই যাবো?
তুমি কি ভেবে দেখেছো ভালো মত,
আজকের পর আমি আর…
_চুপ,কিছু বলতে হবেনা।
আমার শুধু তোমাকেই তোমাকেই লাগবে।
ভয় পেওনা হুম।
সব ঠিক হয়ে যাবে।

আমি ডাক্তারের কাছে যাবার আগে কল্পকে একবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।
কল্প আমার কপালে চুমু খেয়ে বল্লো,ভালবাসি।
কল্প আবার দেশের বাইরে চলে গেছে।

ভুলোনা আমায় পর্ব ১

এর মাঝে কেটেও গেছে অনেক গুলো দিন।আমিও আছি আমার মত।কল্প প্রতিদিন আমাকে ফোন দেয়,আমার খোঁজ খবর নেয়।আমাকে শান্তনা দেয়,আমাকে বুঝায়।আর বলে,খবরদার কেউ যেন কিছু না জানে,আমি না আসা পর্যন্ত।
এরপর হঠাৎ একদিন কল্পর মা কল্পকে ফোন দেয়।
আর কল্প তার ফোন রিসিভ করতেই সেন্সলেস হয়ে পড়ে যায়।

ভুলোনা আমায় পর্ব ৩