ভূমধ্যসাগরের তীরে পর্ব ১৮

ভূমধ্যসাগরের তীরে পর্ব ১৮
লেখিকা দিশা মনি

মিষ্টি দাঁড়িয়ে আছে মার্সেই মেট্রো স্টেশনের সামনে। এলিস তার ফ্লাইটের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। তাই সে আজ প্যারিসের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিচ্ছে। সেখান থেকেই ঢাকার ফ্লাইটে নিজের মাতৃভূমিতে ফিরবে। মেট্রো স্টেশনে আমিনা ও ফাতিমা বিবি দুজনই মিষ্টির পাশে বিষন্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। আমিনা মিষ্টির উদ্দ্যেশ্যে বলল,
“তুমি আর কিছুদিন থাকলে কি খুব বেশি অসুবিধা হয়ে যেত মিষ্টি আপু? তোমাকে খুব মিস করব।”
মিষ্টি আমিনার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“আমিও তোমাকে খুব মিস করব, শুধু তোমাকে কেন, তোমার মা, তোমার ভাইয়া এই মার্সেই শহর সবাইকে আমি ভীষণ মিস করব। কিন্তু কি আর করব বলো? আমার পরিবারের সবাই যে আমার ফেরার অপেক্ষায় বসে আছে। তাদের কাছে তো ফিরতে হবেই ”
ফাতিমা বিবি নিজের চোখের জল মুছতে মুছতে বলেন,

“হ্যাঁ, মা। সেটাই, আমার তো তোমাকে যেতে দিতে একদম ইচ্ছা করছে না। কিন্তু তোমার পরিবারও যেন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। তাই তাদের জন্য হলেও তোমার নিজের দেশে ফেরা জরুরি। তবে আমাদেরকে ভুলে যেও না৷ মাঝে মাঝে যোগাযোগ করো আমাদের সাথে আর পারলে আবারো এই গরীবের বাড়িতে ঘুরতে এসো।”
মিষ্টি ফাতিমা বিবির কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলেন,
“আপনার কাছ থেকে আমি মায়ের মতো ভালোবাসা পেয়েছি। আপনার এই অকৃত্রিম ভালোবাসা আমি কখনোই ভুলব না৷ সুযোগ পেলে আবারো আসব। আপনিও আসবেন আমাদের দেশে।”
“একদিন যাব ইনশাআল্লাহ।”
এরইমধ্যে প্যারিস গামী মেট্রোরেল চলে আসে৷ এলিস সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে,
‘ঐ তো মেট্রোরেল এসে গেছে।’
মিষ্টি এদিক ওদিক তাকাতে থাকে৷ তার দুচোখ যেন কাউকে খুঁজছে। ফাতিমা বিবি সেটা খেয়াল করে বলেন,
“কাউকে খুঁজছ তুমি?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মিষ্টি কিছুটা সংকোচ প্রকাশ করে বলে,
“মিস্টার ইয়াসিন আল খলিলি কোথায়? সকাল থেকে তো ওনায় দেখছি না। গতকাল শেষবারের মতো দেখা হয়েছে। কিছুদিন থেকেই উনি এভাবে আমায় এড়িয়ে চলছেন।আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। উনি কি কোন কারণে আমার উপর মনোক্ষুণ্ণ হয়েছেন?”
আমিনাও বলে ওঠে,
“হ্যাঁ, তাই তো। আজ সকালে উঠে তো আমি ভাইয়াকে অনেক খুঁজলাম। কিন্তু কোথাও পেলাম না। কোথায় গেল ভাইয়া?”
ফাতিমা বিবি মিষ্টির মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,

“ইয়াসিনকে কিছু জরুরি কাজে কাল রাতেই মার্সেই শহরের বাইরে যেতে হয়েছিল অনেক রাতে। তুমি তখন ঘুমাচ্ছিলে তাই তোমায় আর জাগায় নি। ও আমাকে বলেছে তোমাকে সুস্থভাবে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করতে। সুযোগ পেলে ও একদিন তোমার দেশে গিয়ে তোমার সাথেও দেখা করবে বলেছে।”
ফাতিমা বিবির কথা শুনে মিষ্টি কিছুটা স্বস্তি পায়। অতঃপর বলে ওঠে,
“ওনার কাছে আমি সবসময় কৃতজ্ঞ থাকব। আজ আমি যে এখানে সুস্থভাবে দাঁড়িয়ে আছি তার পুরো কতৃত্বই ওনার। ওনার সাথে দেখা না করে যাওয়ায় ভীষণ খারাপ লাগছে।”
এলিস বলে,
“এত চিন্তা করবেন না। ভাগ্যে থাকলে আপনাদের আবার দেখা হবে। আচ্ছা, আপনি আর দেরি করবেন না। দ্রুত মেট্রোরেলে গিয়ে উঠে বসুন।”

মিষ্টি একবার সবার থেকে বিদায় নিয়ে নেয়৷ তার চোখেও জল চলে আসে। আমিনা ছোট বাচ্চাদের মতো কাঁদছিল। ফাতিমা বিবিও নীরবে অশ্রু ফেলছিল। সবাইকে বিদায় জানিয়ে মেট্রোরেলে একটি বসে পড়ে মিষ্টি। অতঃপর জানালার দিকে তাকিয়ে বলে,
“বিদায় মার্সেই..এখানে এসে অনেক নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছে। তার কিছু অভিজ্ঞতা ছিল সুমধুর আবার কিছু তিক্ত। তবে আমি সুমধুর স্মৃতিগুলোকেই মনে রাখতে চাই।”
বলেই সে চোখের জল মুছতে থাকে। কিছু সময় পরই মেট্রোরেলটা প্যারিসের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দেয়। মিষ্টি অবশেষে মার্সেই শহর থেকে ভীষণ দূরে চলে আসতে থাকে।

ছুটে চলা মেট্রোরেলের দিকে তাকিয়ে দূর থেকেই নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছিল ইয়াসিন। তার কষ্টের সব সীমা যেন আজ অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। মিষ্টি নামক মেয়েটা পরস্ত্রী, তাকে নিজের বন্ধুর মতো দেখে এসব জানে সে। তবুও তার প্রতি তৈরি হওয়া অনুভূতিকে মিথ্যা বলতে পারে না সে। ইয়াসিন ছুটে চলা মেট্রোরেলের দিকে তাকিয়েই বলে,
“আমাকে ক্ষমা করবেন মিষ্টি। আপনাকে বিদায় দেয়ার ক্ষমতা আমার নেই। আপনার সাথে দেখা করলে আমি আপনাকে আর যেতে দিতে পারতাম না। আপনাকে নিজের কাছে আগলে রাখার নিষিদ্ধ অনুভূতি যে তৈরি হয়েছে আমার মধ্যে। এত বড় পাপ আমি করতে পারতাম না। তাই আপনাকে নীরবে বিদায় দিলাম। ভালো থাকবেন, আপনার জীবনের সুখের আশা করি।”
ইয়াসিন এসবই ভাবছিল তখন হঠাৎ কেউ তার পিঠে হাত রাখে। ইয়াসিন নিজের চোখের জল মুছে পেছনে ফিরে তাকিয়েই দেখতে পায় নিজের বোন আমিনাকে। তাকে দেখে কিছুটা চমকে ওঠে। আমিনা ইয়াসিনকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,

“তুমি কেন মিষ্টি আপুকে কিছু বললে না ভাইয়া? তুমি কেন বললে না তুমি আপুকে ভালোবাসতে শুরু করেছ!”
“আমিনা!”
“আমি তোমার চোখের দিকে তাকিয়েই তোমার মনের কথা পড়তে পারছি। তুমি কতটা কষ্টে আছ। আমি কিছু দিন থেকেই সবটা খেয়াল করেছি। কাল রাতে যে তুমি লুকিয়ে আমাদের রুমে এসেছিলে অতঃপর মিষ্টি আপুর মাথার কাছে বসে যা যা বলেছ আমি তার সবটাই শুনেছি। কেন এমন করলে ভাইয়া? মিষ্টি আপুকে আটকানোর চেষ্টাও করলে না আর না তো তাকে বিদায় জানাতে এলে। এসব করে যে তুমিই সবথেকে বেশি কষ্ট পাচ্ছ?”
ইয়াসিন দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
“পৃথিবীর সকল অনুভূতি প্রকাশ করতে নেই বোন। বিশেষ করে কিছু অনুভূতি থাকেই এমন নিষিদ্ধ। মিসেস মিষ্টি অন্য কারো স্ত্রী তার প্রতি অনুভূতি থাকাই তো পাপ।”
“কিন্তু তার স্বামী তো মারা গেছে।”
ইয়াসিন কিছু একটা ভেবে বলে,
“সত্যিই কি মারা গেছে?।”
“মানে?”
“কিছু না।”
বলেই সে মুখটা সরিয়ে নেয়।

প্যারিস মেট্রো স্টেশনে পৌঁছে গেল মিষ্টি। অতঃপর ধীর পায়ে মেট্রোরেল থেকে নামল। মার্সেইয়ে নিজের চেনা পরিবেশ থেকে এখন অনেকটাই দূরে সে। মিষ্টি নিজের ট্রলি ব্যাগটা হাতে নিয়ে সামনের দিকে এগোতে লাগল। এই ব্যাগে তার যাবতীয় জিনিসপত্র রয়েছে। মেট্রোরেল থেকে বের হতে যাবে এমন সময় খেয়াল করল মেট্রোরেলে কিছু পুলিশ সবার জিনিসপত্র চেক করছে। মিষ্টি ব্যাপারটায় খুব একটা মাথা ঘামালো না। বাকি সবার মতো লাইন করে দাঁড়ালো। মিষ্টির পালা আসতেই তার ব্যাগ সার্চ করা হলো। মিষ্টি স্বাভাবিক ভাবেই দাঁড়িয়ে ছিল। তার ব্যাগ সার্চ করতে কর‍তেই হঠাৎ এক পুলিশ অফিসার আতকে ওঠেন৷ অতঃপর নিজের সহকর্মীকে কিছু একটা বলতেই সেই সহকর্মী মিষ্টির দিকে বন্দুক তাক করে। মিষ্টি তো ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। সে বুঝতে পারে না এর কারণ কি। এমন সময় সে দেখে তার ব্যাগ থেকে কিছু গ্রেনেড ও আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। মিষ্টি পুরোপুরি হতবাক হয়ে যায়। এসব তার ব্যাগে এলো কি করে?

ভূমধ্যসাগরের তীরে পর্ব ১৭

একজন মহিলা পুলিশ এগিয়ে এসে মিষ্টিকে ধরে বলে,
“তুমি কোন জ**ঙ্গী সংগঠনের সাথে যুক্ত বলো। তোমাদের পরিকল্পনা কি? আর তুমি কে? কোথা থেকে এসেছ। এসব অস্ত্র নিয়ে করছ।”
“আমি কিছু জানি না এসব অস্ত্র কোথা থেকে এলো। আমার কোন দোষ নেই।”
এমন সময় হঠাৎ করে পুরো মেট্রোরেলে একটা বিস্ফোরণের শব্দ হলো। চারিদিক ধোয়ায় ছেয়ে গেল। মিষ্টিও জ্ঞান হারালো সেই ধোয়ায়।

ভূমধ্যসাগরের তীরে পর্ব ১৯