ভূমধ্যসাগরের তীরে পর্ব ৩৮

ভূমধ্যসাগরের তীরে পর্ব ৩৮
লেখিকা দিশা মনি

রাফা তখনো অবাক চোখে তার বাবার মতো দেখতে মানুষটার দিকে তাকিয়ে ছিল। যেই লোকটাকে সারাজীবন ছবির মধ্যেই দেখে এসেছে আজ কিনা তাকে নিজের চোখের সামনে দেখছে। রাফা যেন বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। এদিকে ইমানুয়েল পল তার সহকর্মী এলার উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“তুমি ভুল বুঝছ এলা। আমি কোন বিয়েটিয়ে করি নি।”
এলা বলল,
“তাহলে এই মেয়েটা তোমায় ড্যাড বলছে কেন? ওহ,বুঝতে পেরেছি। ও তো গার্লফ্রেন্ডের মেয়ে তাইতো। আরে এতে এত লজ্জা পাওয়ার কি আছে। আজকাল তো এটা নর্মাল।”
“আরে না..ও আমার গার্লফ্রেন্ডের মেয়ে না।”
“তাহলে?”

“জানি না৷ আমি তো এই মেয়েটাকে চিনিও না।”
এদিকে ছোট্ট রাফা নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে পলকে বলে,
“ড্যাড, তুমি একটু অপেক্ষা করো। একটু পরই মম আমায় নিতে আসবে। মমকে দেখলেই তোমার নিশ্চয়ই সব মনে পড়ে যাবে।”
পল একটু বিরক্ত স্বরে বলে,
“আমার মনে হয়, তুমি অন্য কাউকে আমার সাথে গুলিয়ে ফেলছ সুইটি পাই। আর আমি এখানে অপেক্ষা করতে পারব না,আমার অনেক জরুরি কাজ আছে।”
বলেই পল উঠে দাঁড়িয়ে এলাকে বলে,
“লেটস গো।”
বলেই এলার হাত ধরে টানতে টানতে পল সামনে এগোতে থাকে। রাফার কৌতুহল দমে যায় না। তাই সে তাদের পেছন পেছন যেতে থাকে। পল দ্রুত এলাকে নিয়ে স্কুল থেকে বেরিয়ে যায়। এদিকে রাফা স্কুল থেকে বের হতে চাইলে স্কুলের গার্ডস রাফাকে আটকে দিয়ে বলে,
“ভেতরে যাও বাচ্চা, স্কুল ছুটির আগে বাইরে যাওয়া যাবে না।”
রাফা আকুতির সুরে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“প্লিজ, আঙ্কেল আমায় বাইরে যেতে দিন। আমার ড্যাড চলে যাচ্ছে।”
“আচ্ছা, তুমি ভেতরে যাও। স্কুল ছুটি হলে তোমার ড্যাড তোমায় আবার নিতে আসবে।”
ছোট্ট রাফা বুঝতে পারে না সে এখন গার্ডসকে কিভাবে বোঝাবে সমস্ত কিছু। তাই সে কান্না করতে শুরু করে দেয়। গার্ডস তো ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে। এরইমধ্যে স্কুল ছুটি হয়ে যায়। ছুটির ঘন্টা শোনামাত্রই রাফা ছুটে বাইরে চলে আসে কিন্তু আশেপাশে তাকিয়ে আর পলকে খুঁজে পায় না। এরইমধ্যে আসাদ রাফাকে নিতে চলে আসে। আসাদকে দেখামাত্র রাফা ছুটে গিয়ে বলে,
“এঞ্জেল, তুমি এসেছ মম আসেনি?”
“তোমার মম এসেছে তো। ঐ তো তোমার মম, তোমার জন্য কিছু টেডি কিনছে।”
রাফা দেখে তার স্কুলের সামনেই একটি দোকান থেকে টেডি বিয়ার কিনছে। রাফা এবার ছুটে যায় মিষ্টির কাছে। মিষ্টি রাফাকে এভাবে ছুটে আসতে দেখে কিছুটা শাসনের সুরে বলে,
“তোমাকে বলেছি না, রাস্তায় এভাবে ছোটাছুটি করবে না।”
রাফা হাফাতে হাফাতে বলে,

“মম, তোমায় জরুরি কিছু জানানোর আছে।”
মিষ্টি এবার রাফার দিকে ভালো ভাবে খেয়াল করে বলে,
“কি হয়েছে রাফা? তোমায় এমন লাগছে কেন?”
রাফা বলে,
“আমি আজকে ড্যাডকে দেখেছি!”
রাফার কথা শোনামাত্রই মিষ্টির হাত থেকে টেডি পড়ে যায়। সে হাটু গেঁড়ে বসে পড়ে রাফার সামনে। কাপা কাপা হাতে রাফার কাধে হাত রেখে বলে,
“কি বলছ কি তুমি? তোমার ড্যাডকে দেখেছ…”
রাফা মাথা নাড়ায়৷ আসাদ এগিয়ে এসে বলে,
“কি হয়েছে মিষ্টি?”
রাফা এবার মিষ্টি ও আসাদকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলতে শুরু করে। সব শোনার পর মিষ্টি রাফাকে বলে,
“কোথায় গেছে তোমার ড্যাড?”

“জানি না,মম। ড্যাডের সাথে একটা আন্টি ছিল সেই আন্টিটাকে নিয়ে ড্যাড স্কুল থেকে বেরিয়ে গেছিল। তারপর তো গার্ডসরা আমায় আর স্কুল থেকে বেরোতে দেয় নি তাই আমিও আর ড্যাডকে খুঁজতে পারিনি।”
রাফার কথা শুনে মিষ্টি পাগলের মতো ছুটতে থাকে। রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে থাকে,
“রাফসান! কোথায় আপনি? ফিরে আসুন প্লিজ। দীর্ঘ ৬ টা বছর ধরে আমি আপনার ফেরার আশায় বসে আছি৷ আর এতদিন পর আপনি এসে আমার সাথে দেখা না করেই চলে গেলেন! এত পাষাণ আপনি।”
বলেই মিষ্টি কাঁদতে থাকে৷ আসাদ এগিয়ে এসে মিষ্টির কাধে হাত রেখে বলে,
“মিষ্টি, নিজেকে সামলাও তুমি। এতটা ভেঙে পড়ো না। রাফা ছোট মানুষ, কি দেখতে কি দেখেছে। ওর কথায় এত গুরুত্ব দিও না।”
মিষ্টি নিজের চোখের জল মুছে বলে,

“না,আমার রাফাকে দেখে মনে হয় নি ও ভুল কিছু দেখেছে। একটা মেয়ে তার বাবাকে চিনতে ভুল করতে পারে না। আমাদেরকে রাফসানকে খুঁজে বের করতে হবে আসাদ।”
বলেই মিষ্টি রাফার কাছে গিয়ে বলে,
“আচ্ছা, তোমার ড্যাড হঠাৎ করে স্কুলে এলো কেন?”
রাফা বলে,
“আমি তো কিছু জানি না, মম। ড্যাড তো হঠাৎ করেই ক্যান্টিনে এসে আমার সামনে বসে পড়লো। আমি তো তাকে দেখেই অবাক হয়ে গেছিলাম।”
মিষ্টি বলে,
“কিন্তু স্কুলে তো এভাবে হঠাৎ করে বাইরের কেউ প্রবেশ করতে পারে না৷ তাহলে…”
মিষ্টি কিছু একটা ভেবে স্কুলের সামনে গিয়ে গার্ডসকে জিজ্ঞেস করল,
“আচ্ছা,স্কুলে কি আজকে বাইরের কেউ এসেছিল?”
গার্ডস বলল,
“হ্যাঁ, একজন পুরুষ আর একজন মহিলা বিশেষ অনুমতি নিয়ে প্রিন্সিপালের সাথে দেখা করতে এসেছিল।”
মিষ্টি আসাদকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,
“আমাদের এক্ষুনি প্রিন্সিপালের সাথে গিয়ে দেখা করতে হবে। ওনার সাথে কথা বললেই পুরো বিষয়টা স্পষ্ট হবে।”
আসাদ বলে,
“ঠিক আছে, চলো।”

আসাদ ও রাফাকে সাথে নিয়ে প্রিন্সিপালের অফিসের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে মিষ্টি। কিছু সময় অপেক্ষা করার পর স্কুলের একজন কর্মচারী বলেন,
“আপনারা এখন ভেতরে যেতে পারেন।”
মিষ্টি আসাদ ও রাফাকে নিয়ে দ্রুতগতিতে ভেতরে চলে যায়৷ রাফার স্কুলের প্রিন্সিপাল মিস্টার স্টিফেন মিষ্টি ও আসাদকে দেখেই বলেন,
“বসুন। কোন সমস্যা? হঠাৎ এভাবে দেখা করতে চাইলেন যে? রাফার কি স্কুলে কোন প্রব্লেম হয়েছে?”
মিষ্টি বলে,
“না, মিস্টার স্টিফেন। সেরকম কিছু না। আসলে অন্য একটা বিষয়ে কথা বলার জন্যই এখানে আসা।”
“কি বিষয়?”
“কিছু মনে করবেন না,আসলে আমি শুনলাম আজ স্কুলে একজন পুরুষ আর একজন মহিলা আপনার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন। তারা কারা সেটা কি আমরা জানতে পারি?”
মিস্টার স্টিফেন কিছুক্ষণ ভেবে বললেন,
“কেন বলুন তো? আপনি হঠাৎ এই বিষয়ে জানতে চাইছেন কেন?”

“আসলে রাফা বলছিল, যারা এসেছিল তাদের মধ্যে একজনকে নাকি ওর খুব চেনা চেনা লেগেছে। অনেকদিন আগে হারিয়ে ফেলা কারো সাথে নাকি রাফা সেই লোকটার মিল খুঁজে পেয়েছে,তাই জানতে চাওয়া।”
মিস্টার স্টিফেন কিছুটা অবাক হয়ে বলেন,
“ওহ, আচ্ছা। কিন্তু আমার সাথে তো ডিটেকটিভ এজেন্সি থেকে দুজন দেখা করতে এসেছিল।”
“ডিটেকটিভ এজেন্সি?”
“হ্যাঁ, আপনারা হয়তো জানেন না কিন্তু কিছুদিন আগেই রাতের বেলা কেউ একজন আমার উপর হামলা করেছিল। আমি সন্দেহ করছিলাম যে, এটা মার্সেই শহরের সেই সিরিয়াল কিলারটা হতে পারে যে একের পর এক খু/ ন করে চলেছে। আর সেজন্যই আমি এই বিষয়টা নিয়ে পুলিশে রিপোর্ট করেছিলাম। মূলত সেকারণেই ডিটেকটিভ এজেন্সি থেকে আমায় জিজ্ঞাসাবাদ করতে এসেছিল যে আমি সেই আক্রমণকারীর চেহারা মনে রাখতে পেরেছি কিনা। কিন্তু সেই আক্রমণকারী তো মাস্ক পড়া ছিল তাই তার চেহারা আমার দেখা হয়নি। এটুকুই বললাম, তারপর ওনাদের কফি অফার করলাম কিন্তু ওনারা কিছু না খেয়েই চলে গেলেন।”

ভূমধ্যসাগরের তীরে পর্ব ৩৭

মিষ্টির কাছে এবার ব্যাপারটা খটকা লাগে। মিস্টার স্টিফেন কফি অফার করতে খেল না আবার স্কুলের ক্যান্টিনে গেল সেখানেও খাবার না খেয়ে রাফা দেখা দিয়েই চলে গেল৷ তাহলে কি মূল উদ্দ্যেশ্য ছিল রাফার সাথে দেখা করা। তাহলে কি এটা রাফসানই? মিষ্টি বলে,
“যদি এটা সত্যি আপনি হন,তাহলে এত লুকোচুরি কেন? আমাকে সবটা জানতেই হবে।”

ভূমধ্যসাগরের তীরে পর্ব ৩৯