ভূমধ্যসাগরের তীরে পর্ব ৩৫

ভূমধ্যসাগরের তীরে পর্ব ৩৫
লেখিকা দিশা মনি

মিষ্টির চোখ খুলতেই সে নিজেকে আবিষ্কার করে হাসপাতালের একটি নীরব কেবিনে। চারিদিক থেকে আসা ফিনাইলের তীব্র গন্ধ তার অসহ্যকর ঠেকছে। মিষ্টি আচমকা তখনকার পড়ে যাবার ঘটনা মনে করে। আতকে উঠে বলে,
“আমার সন্তান! ওর কিছু হয় নি তো?”
বলেই একপ্রকার কাঁদতে শুরু করে। এমন সময় আমিনা আসে মিষ্টির কাছে। সে কেবিনের বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল। মিষ্টির কান্নার আওয়াজ শুনে আমিনা চলে এসেছে। আমিনা এসেই মিষ্টিকে বলে,
“তুমি কাঁদছ কেন আপু?”
মিষ্টি বলে,

“আমি সিঁড়ি থেকে পড়ে গেলাম..তারপর চারিদিকে রক্ত..আমার সন্তান কেমন আছে? ও ঠিক আছে তো?”
আমিনা হালকা হেসে বলে,
‘আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া আদায় করো আপু। তোমার একটি মেয়ে হয়েছে আর সে একদম সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থায় আছে। আমরা তো প্রথমে ভয়ই পেয়ে গেছিলাম কারণ ডাক্তার বলেছিল তোমার অবস্থা বেশি ভালো না তাই বাচ্চাটা নাও বাঁচতে পারে। কিন্তু শেষ মুহুর্তে ঠিক যেন মিরাক্কেল ঘটল আর বাচ্চাটা একদম সহি সালামত পৃথিবীতে এলো।’
আমিনার কথা শুনে যেন মিষ্টির কাঁধ থেকে বিরাট একটা বোঝা নেমে যায়। মিষ্টি বলে,
“আমার মেয়ে ঠিক আছে…”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আমিনা মিষ্টির এই খুশি দেখে ভীষণ আনন্দিত হয়। মিষ্টি বলে,
“কোথায় আমার মেয়ে? আমি ওকে দেখতে চাই। ওকে স্পর্শ করতে চাই।”
“তোমার মেয়েকে আপাতত বেবি কেয়ার ইউনিটে রাখা হয়েছে। আসলে তোমার প্রেগ্ন্যাসির কিছু জটিলতা থাকায় ডাক্তাররা কোন ঝুঁকি নিতে চায় নি। চিন্তা করো না, শীঘ্রই তোমার সন্তানকে তুমি দেখতে পাবে।”
মিষ্টি কিছুটা আশ্বস্ত হয়। আমিনা হঠাৎ করে মিষ্টিকে জিজ্ঞেস করে,
“কিন্তু তুমি সিঁড়ি থেকে কিভাবে পড়ে গেলে আপু? এত রাতে সিঁড়ির কাছে কি করছিলে তুমি?”
মিষ্টি বলে,

“আমি জানালা দিয়ে একজন ছায়ামূর্তিকে দেখতে পেয়েছিলাম। কে সেই ছায়ামূর্তি সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্যই নিচে নামা কিন্তু নিচে নামতে গিয়েই..তবে পরবর্তীতে আমি একটা চেনা কন্ঠস্বর শুনতে পাই। কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব।”
এমন সময় মিষ্টির কেবিনে প্রবেশ করে একজন যুবক। অতঃপর সে গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,
“কেন সম্ভব নয়? এই যে আমি।”
মিষ্টি অবাক চোখে যুবকটির দিকে তাকায়৷ আমিনাও ভ্রু কুচকে তাকায়। মিষ্টির উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“এই যুবকটিই তো তোমাকে এখানে হাসপাতালে নিয়ে আসতে আমাদের সাহায্য করেছে আপু। এমনকি ইনিই তোমায় রক্ত দিয়েছেন। তুমি কি চেনো এনাকে?”
মিষ্টি বলে,

“ও হলো আসাদ। আমার স্কুল, কলেজ ও ভার্সিটি জীবনের সেরা বন্ধু। কিন্তু ও এখানে কি করছে?”
আসাদ ধীর পায়ে এগিয়ে এসে বলে,
“একজন বন্ধুর বিপদে আরেক বন্ধু এগিয়ে আসবে এটাই তো স্বাভাবিক, তাই না?”
“কিন্তু তুমি বাংলাদেশ থেকে ফ্রান্সে কিভাবে এলে আসাদ৷ আর আমার উপর গোপনে নজরই বা রাখতে কেন? এর আগেও আমি বহুবার খেয়াল করেছি কেউ গোপনে আমার উপর নজর রাখতো৷ সেটা কি তুমিই ছিলে?”
আসাদ মাথা নাড়িয়ে বলে,
“হ্যাঁ, আমিই তোমার উপর এতদিন গোপনে নজর রাখছিলাম।”
“কিন্তু কেন?”
“কারণ তোমার বাবা আমায় এই দায়িত্ব দিয়ে গেছেন।”
“ড্যাড!”

“হ্যাঁ, তুমি হয়তো জানো না কিন্তু আমিও এখন এই সন্ত্রাস দমন মিশনে অংশ নিয়েছি। আঙ্কেলের মাধ্যমেই মূলত আমার এই মিশনে যোগ দেয়া। আর মিস্টার রাফসান শিকদারের নিখোঁজ হবার পর মূলত তাকে রিপ্লেস করার জন্যই আমার ফ্রান্সে আসা। আমি এখানে আসার পরই আঙ্কেল আমায় দায়িত্ব দেন তোমার উপর নজর রাখার। কেননা, উনি তোমায় নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। তুমি যেভাবে জেদ দেখিয়ে বাংলাদেশে ফিরে না গিয়ে এখানে থাকার সিদ্ধান্ত নিলে আর চারিদিকে কত শত্রু লুকিয়ে থাকতে পারে সেই নিয়ে তোমার কোন আন্দাজও নেই। মূলত এই কারণেই তোমাকে নিরাপত্তা দিতে আমি গোপনে তোমার উপর নজর রাখি।”
আমিনা বলে ওঠে,

“ওহ আচ্ছা। এজন্য আপু প্রায়শই বলতো য যে কেউ তা উপর নজর রাখতো। আপু তাহলে ঠিকই ধরেছিল।”
এদিকে মিষ্টির চোখে আধার নেমে আসে। এতদিন তার মনে ক্ষীণ আশা ছিল যে হয়তোবা রাফসানই গোপনে লুকিয়ে তার দিকে নজর রাখছে। কিন্তু আজ যে তার সব আশা নিমেষেই শেষ হয়ে গেল। রাফসান কি তাহলে তার থেকে এতোটাই বিছিন্ন হয়ে গেল? আর কি সে কখনোই রাফসানের দেখা পাবে না?
এহেন ভাবনা মনে আসতেই মিষ্টির চোখে জল চলে আসল। এমন সময় একজন নার্স একটা ছোট বাচ্চাকে কোলে নিয়ে মিষ্টির কেবিনে এলো। সে এসেই বাচ্চাটিকে মিষ্টির কোলে তুলে দিয়ে বলল,
“এই নিন, আপনার মেয়ে।”
মিষ্টি কাপা কাপা হাতে তার মেয়েকে কোলে তুলে নিল। মেয়েটি এখন পরম আবেশে ঘুমাচ্ছে। মিষ্টি তার নরম গালে চুমু খেল। তার কানে কানে বলল,

“তুমি একদম চিন্তা করো না। তোমার মা সবসময় তোমার পাশে আছে। তোমার বাবার অভাব পূরণ করব। জানি না, তোমার বাবা কবে আসবে আমাদের কাছে ফিরে। তবে আমরা তার জন্য অপেক্ষা করব। আমি নিশ্চিত তাকে একদিন আমাদের কাছে ফিরতেই হবে।”
আমিনা উৎসুক হয়ে মিষ্টিকে বলে,
“আপু তোমার মেয়ের জন্য কোন নাম ভেবেছ? ”
“নাম?”
“হুম। ওর নাম কি রাখা যায় বলো তো?”
মিষ্টি তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমি চাই ওর নামের সাথে ওর বাবার নামের মিল থাকুক। তাই আমি ওর নাম রাখবো “রাফা” ”
ফাতিমা বিবি কেবিনে প্রবেশ করতে করতে বলেন,
“বাহ, বেশ৷ সুন্দর নাম রেখেছ তুমি নিজের মেয়ের।”
মিষ্টি রাফাকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে বলে,
“জানেন, ওকে আমি যতবার দেখছি ততবারই আমার রাফসানের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। একদম নিজের বাবার মতোই হয়েছে ও।”

ফাতিমা বিবি বলেন,
“এতোটা ভেঙে পড়ো না মিষ্টি। তুমি এখন একজন মা হয়েছ। এখন তোমায় আরো সাহসী হতে হবে।”
এরইমধ্যে হঠাৎ করে আসাদ বলে ওঠে,
“তোমায় এখন বাংলাদেশে ফিরতে হবে মিষ্টি।”
মিষ্টি হতবাক স্বরে বলে,
“এসবের মানে কি?”
“আঙ্কেল আর তোমাকে নিয়ে কোন ঝুঁকি নিতে চান না। এতদিন তোমার সব জেদ উনি মেনে নিয়েছেন কিন্তু এখন আর না। তাছাড়া, এখন শুধু তোমার একার ব্যাপার না। তোমার মেয়ের ব্যাপারও এখানে জড়িয়ে আছে। তোমাকে এখানে এভাবে একলা ফেলে রাখতে পারি না আমরা। তাই তোমাকে দেশে চলে যেতে বলেছেন উনি

মিষ্টি তীব্র জেদ দেখিয়ে বলে,

“আমি আগেও বলেছি এখনো বলছি যতদিন না রাফসানের কোন খোঁজ পাব ততদিন আমি এই মার্সেই শহরের বাইরে একটা পাও রাখব না। আমি নিশ্চিত রাফসান একদিন না একদিন আমার কাছে ফিরবেই। আমার জন্য, আমাদের সন্তানের জন্য ওকে ফিরতেই হবে।”
আমিনা বলে,
“আপু, তুমি একটু ভেবে.. ”
” আমি সব ভেবেই বলছি।”
আসাদ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
“তাহলে তুমি নিজের জেদেই অটল থাকবে? বেশ, তবে একটা কথা শুনে রাখো, এখানে থাকলে চাইলে তোমায় সম্পূর্ণ নতুন পরিচয়ে থাকতে হবে। এই মিশন থেকে তোমায় নিজেকে সরিয়ে নিতে হবে, এছাড়া তুমি যে রাফসান শিকদারের স্ত্রী এই কথাটাও গোপন রাখতে হবে। নাহলে তোমার আর তোমার সন্তানের জীবনে বিপদ নেমে আসবে।”
“কি বলছ তুমি এটা আসাদ?”
আমিনা বলে,

ভূমধ্যসাগরের তীরে পর্ব ৩৪

“উনি ঠিকই বলছেন আপু। আমি গোয়েন্দা সংস্থার সাথে যুক্ত থাকায় ব্যাপারটা বুঝতে পারছি। এখন তোমাদের জীবনের ঝুঁকি অন্য সময়ের থেকে অনেক বেশি।”
মিষ্টি তার মেয়েকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বলে,
“আমার মেয়েকে রক্ষা করার সব দায়িত্ব আমার। ওর উপর আমি কোন বিপদের আঁচ লাগতে দেব না। নিজের স্বামীকেও আমি খুঁজে বের করবো। তার জন্য আমায় যা করতে হয় আমি তাই করবো।”

ভূমধ্যসাগরের তীরে পর্ব ৩৬