ভূমধ্যসাগরের তীরে পর্ব ৩৬

ভূমধ্যসাগরের তীরে পর্ব ৩৬
লেখিকা দিশা মনি

হাতে একটা খাবারের থালা নিয়ে পুরো বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে মিষ্টি। ছুটে চলেছে ছোট্ট একটা বাচ্চা মেয়ের পেছনে৷ মিষ্টি অনেকক্ষণ ধরে ছোটার পর হাফাতে হাফাতে বলে,
“রাফা! মামনি আর দুষ্টুমি করো না। মমের কাছে এসো। এই খাবার টুকু খেয়ে নাও। মম কি তোমার সাথে ছোটাছুটি করতে পারে?”
এদিকে রাফা নিজের ফোকলা দাঁতের হাসি দিয়ে বলে,
“আমায় আগে ধরতে হবে তারপর আমি খাবো…”
বলেই আবারো ছুটতে থাকে।
মিষ্টি ক্লান্ত হয়ে থেমে গিয়ে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। চোখের চশমাটা ঠিক করে নিয়ে বলে,
“উফ! কি দস্যি মেয়ে। একদম আবার মতো হয়েছে৷ ওর বাবা যেমন সারাটা জীবন আমার থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াল ঠিক ও তেমনি..”

পুরো কথাটা শেষ করার আগেই কেন জানি মিষ্টির চোখে জল চলে এলো। ভূমধ্যসাগরের তীর ঘেষে বয়ে গেছে অনেক স্রোত। কালের পরিক্রমায় অতিক্রান্ত হয়েছে দীর্ঘ ৬ টি বছর। বছর ২১ এর মিষ্টি এখন পা দিয়েছে ২৭ এ! সাথে এসে জুটেছে ৬ বছর বয়সী ছোট্ট রাফার মা হয়ে ওঠার বিশাল দায়িত্ব। অথচ এত গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়ে রাফসান তার পাশে নেই। সেই যে ৬ বছর আগের এক বিস্ফোরণে মিষ্টির জীবন থেকে হারিয়ে গেল রাফসান তারপর থেকে এখন অব্দি সে আর ফেরেনি। রাফসানের জন্য অপেক্ষা করতে করতে মিষ্টির জীবনের অনেকগুলো দিন কেটে গেছে৷ তবে এখনো সে আশা ছাড়েনি৷ মিষ্টির বিশ্বাস, একদিন না একদিন তার রাফসান আবার ফিরে আসবে তার কাছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

হঠাৎ পিঠে কারো স্পর্শ পেয়ে পিছনে ফিরে তাকায় মিষ্টি। পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখতে পায় আমিনাকে। তাকে দেখেই নিজের চোখের জল মুছে নেয়। আমিনা মলিন হেসে বলে,
“এভাবে চোখের জল মুছে কি লাভ মিষ্টি আপু? নিজের মনের কষ্ট তো তুমি লুকাতে পারবে না।”
“তুমি তো জানো আমিনা। আমি নিজের দূর্বলতা কারো কাছে প্রকাশ করতে চাই না৷ কারণ এই কষ্ট গুলোই যে আমায় শক্তি দেয় সামনে এগিয়ে যাবার।”
এরইমধ্যে রাফাকে কোলে নিয়ে উপস্থিত হয় আসাদ। আসাদ এসেই বলে,
“এই যে! এঞ্জেল রাফাকে ধরে নিয়েছে। এখন রাফা তার মমের হাতে ভাত খাবে।”
রাফা খুশি হয়ে বলে,

“ইয়ে! রাফার এঞ্জেল রাফাকে ধরেছে! এবার এঞ্জেলকেও রাফার সাথে খেতে হবে।”
মিষ্টি এগিয়ে গিয়ে আসাদকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,
“তুমি না থাকলে যে রাফাকে আমি কিভাবে সামলাতাম ভেবেই আমি মাঝে মাঝে দীর্ঘ শ্বাস ফেলি জানো? তোমার মতো করে ওকে আর কেউ শান্ত করতে পারে না।”
আসাদ রাফার গালে একটা হামি দিয়ে বলে,

“আমার প্রিন্সেস রাফা বলে কথা। প্রিন্সেসকে তো তার এঞ্জেলই শুধু নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তাই না প্রিন্সেস?”
রাফা মাথা নাড়ায়। মিষ্টি এই সুযোগে রাফাকে খাইয়ে দিতে থাকে।
কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখেন মিষ্টির মা-বাবা সুইটি চৌধুরী ও মোর্শেদ চৌধুরী। মূলত মিষ্টি যখন স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, সে মার্সেই ছেড়ে কোথাও যাবে না তখন মোর্শেদ চৌধুরী ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে যান৷ অন্যদিকে সুইটি চৌধুরীও তার মেয়ের চিন্তায় চিন্তায় ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন যার ফলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়। সেই সময় মোর্শেদ চৌধুরী সুইটি চৌধুরীকে সুস্থ করার জন্য তাকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলতে বাধ্য হন।

সব শুনে সুইটি চৌধুরী মিষ্টির কাছে আসার জন্য জেদ করতে থাকেন৷ তাই তিনি সুইটি চৌধুরীকে নিয়ে মার্সেইতে চলে আসেন৷ তখন থেকে সুইটি চৌধুরী আর মোর্শেদ চৌধুরী এখানেই থাকেন। তবে শুধু তারা নন, রাফসানের মা রোকসানা শিকদারও এখানেই থাকেন এখন। বছর চারেক আগে রাফসানের বাবা রফিক শিকদার গত হয়েছেন। তারপর রোকসানা শিকদারের বড় ছেলে রাহুল তার স্ত্রী ফারিয়াকে নিয়ে আলাদা হয়ে যায়। তখন রোকসানা শিকদার ভীষণ একাকীত্বে ভোগেন। তাই তাকেও এখানে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন মোর্শেদ চৌধুরী। এখানে আসার পর নিজের নাতনী রাফাকে পেয়ে যেন রোকসানা শিকদারের একাকীত্ব দূর হয়। নিজের নাতনীর মাঝেই নিজের হারানো ছেলেকে খুঁজে পান রোকসানা শিকদার।
সুইটি চৌধুরী তার স্বামীকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,

“জানো, মাঝে মাঝে আমার মেয়েটার কথা ভেবে আমার ভীষণ খারাপ লাগে। ওর তো এখনো পুরো জীবনটা পড়ে আছে অথচ ও নিজের জীবনটা নিজের হাতে…”
মোর্শেদ চৌধুরী বলেন,
“তুমি তো জানোই এই ব্যাপারে সবকিছু। তবুও কেন বলছ বলো তো?”
“মায়ের মন, তুমি কি বুঝবে? আমার মেয়েটাকে আমি খুব ভালো করেই চিনি। ও হয়তো সবসময় হাসিখুশি থাকে, নিজের কষ্টটা প্রকাশ করে না। কিন্তু ওর মনে কি চলছে সেটা আমি ঠিকই বুঝতে পারি।”
আসাদের সাথে মিষ্টি ও রাফাকে হাসিখুশি থাকতে দেখে সুইটি চৌধুরী বলে ওঠেন,
“আচ্ছা, তুমি একবার মিষ্টির সাথে কথা বলে দেখো না, ও যদি আসাদের সাথে নিজের জীবনটা আবারো নতুন ভাবে শুরু করতে রাজি হয়।”

“তুমি কি পাগল হলে নাকি সুইটি? তুমি জানো মিষ্টি এসব শুনলে কেমন রিয়্যাক্ট করবে তবুও তুমি কিভাবে এই কথা বলছ?”
“তো কি করব আমি? তুমি দেখতে পাচ্ছ না, আসাদের সাথে থাকলে ওরা মা-মেয়ে দুজনেই কত হাসিখুশি থাকে। তাছাড়া আসাদের থেকে বেশি বিশ্বাসযোগ্য কাউকে কি আমরা পাবো? শুধুমাত্র বন্ধুত্বের টানে আসাদ এতদিন ধরে এভাবে মিষ্টির পাশে আছে। তবে আমি জানি, আসাদের মনে মিষ্টির জন্য অনুভূতি আছে। তুমি একটু বলেই দেখো না।”

“আমি পারবো না সুইটি। এটা আমার দ্বারা সম্ভব নয়।”
“বেশ, তুমি যদি কিছু না করো তাহলে যা করার আমাকেই করতে হবে। আমার মেয়ের সুখের বিষয়টা আমাকেই ভেবে দেখতে হবে।”
“দেখো, আবার এমন কিছু করো না যাতে মিষ্টি আবার রেগে যায়।”
“তোমাকে সেসব নিয়ে ভাবতে হবে না। আমার মেয়ের ভালোর জন্যই যা করা লাগে আমি তাই করবো।”

রাস্তা দিয়ে সো সো শব্দ করে এগিয়ে চলছে একটি ব্রান্ড নিউ টেসলা মডেল ৩ এর একটি গাড়ি। সেই গাড়ির ভেতরে বসে আছে এক সুদর্শন ব্যক্তি। বয়স তার ৩০ পেরিয়েছে। তবে চেহারা দেখে তা বোঝার উপায় নেই৷ এতটাই সতেজ শরীর তার। একটি পুলিশ স্টেশনের সামনে এসে গাড়িটা থামলো। গাড়ি থেকে নেমে এলেন সেই ব্যক্তি। অতঃপর প্রবেশ করলেন পুলিশ স্টেশনে।
পুলিশ স্টেশনের ভেতরে অপেক্ষারত ছিলেন একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর। তিনি হঠাৎ করে এভাবে অচেনা অজানা ব্যক্তিকে থানায় প্রবেশ করতে দেখে বলে উঠলেন,
“কে আপনি? আর এভাবে থানায় প্রবেশ করেছেন কেন? আপনি জানেন না, এই সময় সাধারণ মানুষের থানায় প্রবেশ করা নিষেধ।”

চোখ থেকে সানগ্লাসটি খুলে পুলিশ ইন্সপেক্টরকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করল আগন্তুক ব্যক্তি৷ তার বুকে ঝোলানো নেমপ্লেটে “এলিয়ট ডুপঁ” নামটা জলজল করছে। সে বলে উঠল,
“আপনি যার জন্য এখানে অপেক্ষা করছিলেন আমিই সেই!”
“মানে? আপনি ইমানুয়েল..”
“ইমানুয়েল পল। নাম তো শুনেছেন নাকি?”
এলিয়ট ডুপঁ দুদিকে মাথা নাড়িয়ে তড়িঘড়ি করে বলে ওঠেন,
“বসুন, স্যার।”
ইমানুয়েল পল বসে পড়ল। অতঃপর ইশারা করে এলিয়টকেও বসার নির্দেশ দিতেই তিনি বসে পড়েন। ইমানুয়েল পল এবার ডেস্কে উপর থাকা একটা ফাইল তুলে নিয়ে বলে,
“আপনি নিশ্চয়ই জানেন, উপর মহল থেকে আমায় কেন এখানে পাঠানো হয়েছে?”
“ইয়ে মানে..”

ভূমধ্যসাগরের তীরে পর্ব ৩৫

“ভনিতা না করে স্পষ্ট করেই বলুন। ইদানীং ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত এই মার্সেই শহরে ক্রাইম রেইট অনেক বেড়ে গেছে। যার জন্য আমার প্যারিস থেকে তড়িঘড়ি করে এখানে আসা। কোন জানি এক সিরিয়াল কিলার পরপর খু**ন করে যাচ্ছে অথচ তাকে ধরা যাচ্ছে না। এর আগেও এই শহরে একটা বিস্ফোরণ ঘটেছিল ৬ বছর আগে যাতে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। তারপর থেকে শহরের ক্রাইম রেট অনেক নিয়ন্ত্রণে থাকলেও এখন আবার আগের মতো ক্রাইম বাড়ছে। আর সেই ক্রাইম নিয়ন্ত্রণ করতেই আমি আবার ফিরে এসেছি। এছাড়াও পুরাতন আরো অনেক হিসাব মিলানো বাকি আছে।”

ভূমধ্যসাগরের তীরে পর্ব ৩৭