ভূমধ্যসাগরের তীরে পর্ব ৩৭
লেখিকা দিশা মনি
মিষ্টি রাফাকে বিছানায় শুয়ে দিয়েছে। মেয়েটা সবেমাত্র ঘুমালো। রাফার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে মিষ্টি। এমন সময় রোকসানা শিকদার আসলেন মিষ্টির রুমে। তিনি এসেই বলে উঠলেন,
“বৌমা।”
মিষ্টি উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“মা, আপনি। আসুন ভেতরে আসুন।”
রোকসানা শিকদার ভেতরে এসে রাফার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ও ঘুমিয়েছে?”
“হ্যাঁ, একটু আগেই ঘুমালো। সারাদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বেরিয়ে কেবল একটু শান্ত হলো।”
“জানো, বৌমা। আমার রাফসানও না ছোটবেলায় এমনই ছিল। এক দণ্ড কোথাও শান্ত হয়ে থাকত না। আমি তো একা ওকে সামলাতে হিমশিম খেতাম।”
রাফসানের কথা শোনামাত্রই মিষ্টির চেহারায় আধার নেমে এলো। রোকসানা শিকদার সেটা বুঝতে পেরে মিষ্টির কাছে এসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“তোমার কষ্টটা আমি বুঝি মা। আমার যে নিজেরও বুকটা ফেটে যায় নিজের ছেলেটার কথা ভাবলে। কিন্তু কি করবো বলো, ভাগ্যকে যে মেনে নিতেই হবে।”
মিষ্টি করুণ স্বরে বলে উঠল,
“আপনার ছেলে কেন এমন করছে মা? দীর্ঘ ৬ টা বছর ধরে এভাবে আমাদের সবাইকে কষ্ট দিচ্ছে ও। ও কি আর ফিরবে না আমাদের জীবনে? আজ আমার মেয়েটা ওর বাবার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত। আমি যে আর পারছি না, মা। এতদিন ধরে তো ধৈর্য ধরে আছি। এই আশায় আছি যে, একদিন হয়তো ও আবার ফিরে আসবে আমাদের কাছে।”
“মা, আজ তোমাকে একটা কথা বলছি মন দিয়ে শোনো৷ আমি মা হিসেবে এটা মেনে নিয়েছি যে, রাফসান আর ফিরবে না। তুমিও আমার কথা শুনো, রাফসানের ফেরার আশা বাদ দাও। তুমি নিজের জীবনটা আবার নতুন করে শুরু করে দাও।”
“নতুন করে শুরু করব মানে?”
“তোমার পুরো জীবনটা এখনো পড়ে আছে মা। কতই আর বয়স হয়েছে তোমার? জীবনটা কি এভাবেই কেটে যাবে?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মিষ্টি বুঝতে পারে রোকসানা শিকদার কি বলতে চাইছেন। তার কথার ধরণ বুঝেই মিষ্টি বলে দেয়,
“আমার জীবনে শুধু আর শুধু রাফসানের অস্তিত্ব রয়েছে। অন্য কারো না। প্রয়োজনে আমি নিজের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত ওর জন্য অপেক্ষা করে যাব।”
এমন সময় সুইটি চৌধুরী রুমে এসে বলেন,
“এভাবে আর কত? নিজের জীবনটা নষ্ট করো না তুমি।”
মিষ্টি কিছুটা রাগী স্বরে বলে,
“তুমি তার মানে মাকে এসব বিষয়ে উস্কে দিচ্ছ মম? কাজটা তুমি একদম ঠিক করো নি। তোমরা সবাই কান খুলে শুনে রাখো, আমি রাফসান ছাড়া অন্য কাউকে নিয়ে জীবন শুরু করার কথা ভাববো না।”
সুইটি চৌধুরী ও রোকসানা শিকদার দীর্ঘ শ্বাস ফেলেন। দুজনের মুখই মলিন হয়ে যায়। সুইটি চৌধুরী বলেন,
“বেশ, তোমার যা খুশি তুমি করো৷ আমি আর তোমাকে নিয়ে কিছু ভাবব না।”
বলেই তিনি বেরিয়ে যান৷ মিষ্টি কান্না করতে শুরু করে। মিষ্টিকে কাঁদতে দেখে রোকসানা শিকদার তাকে জড়িয়ে ধরেন। মনে মনে বলেন,
“আল্লাহ, তুমি কি একটুও মুখ তুলে তাকাবে না আমাদের দিকে? আমি নিজের জন্য তোমার কাছে আর কিছুই চাই না। শুধু এই অভাগী মেয়েটার জীবনে একটু সুখ দাও।”
দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখে আসাদ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। আমিনাও এদিক দিয়ে যাবার সময় আসাদকে দেখে। আমিনা ও আসাদের চোখাচোখি হতেই আমিনা চোখ সরিয়ে নিয়ে চলে যেতে চায়৷ এমন সময় আসাদ এগিয়ে এসে আমিনাকে বলে,
“কি হয়েছে তোমার? এভাবে চলে যাচ্ছ কেন?”
আমিনা বলে,
“আমার কিছু জরুরি কাজ আছে।”
“আমার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছ তুমি,তাইনা?”
আমিনা কিছু বলে উঠতে পারে না। বছর খানেক আগে, ফাতিমা বিবি মারা গেছেন৷ তার মৃত্যুর পর আমিনা একদম একা হয়ে পড়েছিল। আমিনার সেই নিঃসঙ্গতার সময়ে আসাদই তার সঙ্গ দিয়েছিল। তার পাশে থেকেছে বন্ধুর মতো৷ কিন্তু আমিনার মনে এর ফলে আসাদের জন্য অন্যরকম অনুভূতির তৈরি হয়েছে। আমিনা যখন থেকে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে তখন থেকেই চেষ্টা করেছে আসাদের থেকে দূরে থাকার। এসব ভেবেই আমিনা বলে,
“পালিয়ে বেড়াতে যাব কেন? আমার সত্যিই…”
আমিনা নিজের পুরো কথা শেষ করতে পারে না তার আগেই আসাদ হঠাৎ তার খুব কাছে চলে এসে বলে,
“তোমার চোখ দেখেই আমি তোমার মনের কথা বলে দিতে পারি, আমিনা। তাই আমার থেকে কোন কিছু লুকিয়ে লাভ নেই।”
আমিনার পক্ষে এরপর আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হয় না। সে ত্রস্ত পায়ে হেঁটে স্থান ত্যাগ করে।
চোখে একটা সানগ্লাস, মুখে মাস্ক পড়ে ভূমধ্যসাগরের তীরে দাঁড়িয়ে স্বচ্ছ জলরাশির দিকে তাকিয়ে আছেন ইমানুয়েল পল। তার দৃষ্টি স্থির। এমন সময় হঠাৎ করে পেছন থেকে কেউ তার নাম ধরে ডাকল। পল পিছনে তাকিয়েই দেখতে পেল তার সহকর্মী এলাকে। এলা এগিয়ে এসে বলল,
“কি ব্যাপার পল? তুমি এখানে আর আমি তোমাকে চারিদিকে খুঁজে বেড়াচ্ছি।”
“আমাকে? কিন্তু কেন?”
“কিছু জরুরি কথা ছিল সেই সি**রিয়াল কি***লারকে নিয়ে। আমি তার ব্যাপারে কিছু তথ্য জানতে পেরেছি।”
“কি জানতে পেরেছ?”
“যতদূর সম্ভব, সে একজন বাহাতি ব্যক্তি।”
“তোমার এটা কেন মনে হচ্ছে?”
“কিছু ভুক্তভোগীর ফরেনসিক রিপোর্ট দেখে এটা আমি বুঝতে পেরেছি।”
“বাহ, তাহলে এখন একটা কাজ করি, এই মার্সেই শহরে যত বাহাতি ব্যক্তি আছে সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করি, কি বলো?”
“হ্যাঁ, করাই যায়।”
বলেই দুজনে একসাথে হেসে ওঠে। এলা আবারো বলে ওঠে,
“তবে আমি বুঝি না, মার্সেইতে এসেছ থেকে তুমি ভূমধ্যসাগরের তীরে এত সময় কেন ব্যয় করো। কোন বিশেষ কিছু আছে নাকি এখানে?”
“তা আছে। এই ভূমধ্যসাগরের তীরেই যে মিশে আছে আমার অস্তিত্ব।”
“ঠিক বুঝলাম না।”
“চলো, এখন যাই এখান থেকে।”
এলা বলল,
“আচ্ছা, চলো।”
দুজনে একসাথে সেই স্থান থেকে চলে যায়।
মার্সেইয়ে নতুন সূর্যদয় ঘটেছে। দীর্ঘ একমাসের গ্রীষ্মকালীন ছুটির পর আজ রাফার স্কুল আবার খুলছে। সেজন্য মিষ্টি তাকে স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি করে দিচ্ছে। এদিকে রাফার মন ভীষণ খারাপ। কারণ স্কুলে যাওয়ার তার একদম ইচ্ছা নেই। এতদিন বাসায় থেকে তার বাসায় থাকারই অভ্যাস হয়ে গেছে। মিষ্টি কিছুটা শাসনের সুরে বলে,
“স্কুলে তোমায় যেতেই হবে৷ এভাবে বাসায় বসে থাকা একদম চলবে না।”
রাফা গাল ফুলিয়ে বসে থাকে। মিষ্টি রাফাকে তৈরি করে নিয়ে স্কুলে দিয়ে চলে আসে বাসায়।
রাফার স্কুলে টিফিনের সময় সে স্কুলের ক্যান্টিনে এসে চুপচাপ বসে থাকে।
এদিকে ইমানুয়েল পল রাফার স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সাথে কথা বলতে তার স্কুলে এসেছিল। কেননা, কিছুদিন আগে সেই সিরিয়াল কিলার তার উপরেও আক্রমণ করেছিল রাত্রিবেলা। যদিওবা ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে গেছিলেন।
তাকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে পল ক্যান্টিনে এসেছে কিছু খাওয়া দাওয়া করার জন্য। রাফার একদম সামনাসামনি এসে বসে সে। এদিকে রাফা মাথা তুলে অবাক চোখে পলের দিকে তাকিয়ে থাকে। পল সেটা খেয়াল করে বলে,
“হেই সুইটি পাই! কি দেখছ আমার দিকে?”
রাফা অবাক স্বরে বলে,
“ড্যাড!”
পল এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে,
“তোমার ড্যাডকে খুঁজছ?”
রাফা যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারে না। যাকে এতদিন ধরে সে ছবিতে দেখে এসেছে আজ কিনা তাকে সামনাসামনি দেখছে! রাফা বলে ওঠে,
“তুমি এতদিন কোথায় ছিলে ড্যাড? মম তোমাকে কত খুঁজে বেরিয়েছে জানো তুমি? মম সবসময় তোমার জন্য কান্না করে। সবসময় তোমার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে থাকে।”
ভূমধ্যসাগরের তীরে পর্ব ৩৬
“হেই সুইটি পাই! তোমার কোন ভুল হচ্ছে।”
“আমার কোন ভুল হচ্ছে না, তুমিই আমার ড্যাড।”
পল বুঝতে পারে না এই বাচ্চা মেয়েটা এমন কথা কেন বলছে। এরইমধ্যে এলা সেখানে এসে বলে,
“তুমি আমাকে না জানিয়ে বিয়ে করে নিলে পল?”