ভূমধ্যসাগরের তীরে পর্ব ৪২
লেখিকা দিশা মনি
মিষ্টি বধুবেশে তৈরি হয়ে নিচ্ছে। কারণ আজ তার সাথে আসাদের বিয়ে হবার কথা। সুইটি চৌধুরী চান নি বেশি সময় নষ্ট করতে তাই আজকের দিনেই পারিবারিক ভাবে সাদামাটা আয়োজনে বিয়েটা সম্পন্ন করা হবে বলে ঠিক করেছেন তিনি।
আমিনা মিষ্টির পাশেই আছে৷ মিষ্টিকে সাজানোর পুরো কাজটাই সে সম্পন্ন করেছে নিজের বুকে পাথর চেপে৷ মিষ্টির সাজ সম্পন্ন হতেই আমিনা মুখে একটা মেকি হাসি দিয়ে বলে,
“বাহ, আপু। তোমাকে কি সুন্দর লাগছে। মিস্টার আসাদ তো আজ তোমায় দেখে পাগল হয়ে যাবে।”
আমিনার মনে লুকানো কষ্ট ঠিকই উপলব্ধি করতে পারে মিষ্টি। তাই সে কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না। এরমধ্যে সুইটি চৌধুরী সেখানে এসে বলেন,
“সাজগোজ হয়ে গেছে? ইশ, মিষ্টির ড্যাড যে কোথায়। সেই কখন গেছে মার্সেইয়ের ওল্ড মসজিদের ওখানে কাজি ডাকতে কিন্তু এখনো আসার কোন খেয়াল নেই। ধুর।”
বলেই তিনি আবার কাউকে একটা ফোন করে বাইরে ছুটে যান৷ তিনি চলে যাবার কিছু সময় পর আসাদ বরবেশে মিষ্টির রুমে চলে আসে৷ আসাদকে আসতে দেখেই আমিনার বুকটা হাহাকার করে ওঠে। লোকটাকে বরবেশে কতটাই না সুন্দর লাগছে। আমিনার মনে হঠাৎ করে একটা প্রশ্ন জেঁকে বসে।
“আচ্ছা,খুবই কি খারাপ হয়ে যেত, যদি এই লোকটা আমার জন্য এভাবে বর সাজত?”
নিজের মনে আসা এই প্রশ্নের জন্য নিজেই লজ্জিত হয় আমিনা। মনে মনে নিজেকে ঝাড়ি দিয়ে বলে,
“ছি ছি! এটা তো কেমন চিন্তাভাবনা আমিনা? আর কিছুক্ষণ পর লোকটা অন্য কারো স্বামী হবে। আর তুই কিনা তাকে নিয়ে এমন ভাবছিস!”
অতঃপর আমিনা আসাদকে বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“মিস্টার আসাদ, আপনারা কথা বলুন। আমি আসছি।”
বলেই সে বেরিয়ে যায়। আমিনার যাওয়ার পানে ব্যথিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আসাদ। মিষ্টি আসাদকে জিজ্ঞেস করে,
“কেমন লাগছে আমায় বউ সাজে?”
আসাদ একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
“তোমাকে তো সব সাজেই ভালো লাগে মিষ্টি। তোমার সৌন্দর্যের কোন তুলনা হয় না।”
“ধন্যবাদ।”
“আচ্ছা, তুমি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছ ভেবেচিন্তে নিয়েছ তো? কি হবে যদি তোমার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। যদি রাফসান শেষ মুহুর্তে এসে সত্যিটা স্বীকার না করে?”
“তাহলে আমাদের ভালোবাসা মিথ্যা প্রমাণিত হবে।”
“এখনো সময় আছে মিষ্টি। আবেগ দিয়ে না ভেবে বিবেক দিয়ে ভাবো। যদি রাফসান বিয়েটা না থামায় তাহলে কিন্তু আমাদের বিয়েটা করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না।”
মিষ্টি বলে,
“আমার বিশ্বাস আছে নিজের ভালোবাসার প্রতি। আমি জানি, রাফসান শেষ মুহুর্তে এসে বিয়েটা থামাবেই। এটা আমাদের ভালোবাসার পরীক্ষা, সারাটা জীবন তো আমি পরীক্ষা দিয়ে গেলাম। এবার ওর পালা। এবার রাফসানকে নিজের ভালোবাসার পরীক্ষা দিতে হবে।”
আসাদের চোখে দুশ্চিন্তা অনুভব করতে পারছিল মিষ্টি। তাই সে বলে,
“চিন্তা নেই। আমিনার সাথে তোমার মিলন হবেই৷ এই দায়িত্ব আমি নিলাম।”
বলেই মিষ্টি আয়নায় নিজেকে দেখায় মনযোগ দেয়। একটু পরই রাফা ছুটে আসে রুমে। তার সাথে রোকসানা শিকদারও আসে।
রাফা এসেই মিষ্টিকে দেখে বলে,
“ওয়াও মম, তোমাকে ব্রাইডাল লুকে একদম কুইনের মতো লাগছে।”
মিষ্টি হালকা হেসে রাফার গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
“তাই বুঝি?”
রোকসানা শিকদার এগিয়ে এসে বলেন,
“বৌমা..আমার কেন জানি ভীষণ ভয় হচ্ছে।”
“কেন মা? আপনি কিসের ভয় পাচ্ছেন? আপনি তো নিশ্চিত যে আপনার ছেলে রাফসান এখনো বেঁচে আছে এবং ইমানুয়েল পলই রাফসান। তাহলে এখানে ভয় কিসের? রাফসান বেঁচে থাকতে কিছুতেই আমার দ্বিতীয় বিয়ে হতে দেবে না। এই ব্যাপারে নিশ্চিত থাকুন।”
রাফাও বলে,
“হ্যাঁ, গ্রানি। মম আমাকে বলেছে আজ ড্যাডের সাথেই মমের বিয়ে হবে। তুমি এত চিন্তা করো না।”
রোকসানা শিকদার এবার একটু স্বস্তি পান। মিষ্টি বলে,
“আমি নিজের হাতে গিয়ে আমার আর আসাদের বিয়ের ইনভাইটেশন কার্ড মিস্টার ইমানুয়েল পলকে দিয়ে এসেছি৷ তাকে তো আসতেই হবে।”
মিষ্টিকে বিয়ের আসরে নিয়ে আসা হয়েছে। বিয়েতে সেরকম বাইরের কাউকে ডাকা হয় নি। শুধুমাত্র পরিবারের লোকজনই এখানে উপস্থিত। সাথে আশেপাশের কিছু প্রতিবেশী। শুধুমাত্র ইমানুয়েল পলের জন্যই আলাদা করে ইনভাইটেশন কার্ড বানিয়ে নিয়ে গিয়েছিল মিষ্টি। তাকে প্রধান অতিথি করেছিল নিজের বিয়েতে। কিন্তু সেই ইমানুয়েল পলেরই এখনো কোন আসার খবর নেই! মিষ্টি একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।
মিষ্টি ও আসাদকে পাশাপাশি বসানো হয়। কাজি সাহেবও ইতিমধ্যেই এসে উপস্থিত হয়েছেন। আমিনা একটু দূরে দাঁড়িয়ে সমস্ত কিছু দেখছে। নিজের ভালোবাসার মানুষটা এভাবে অন্য কারো হয়ে যাবে সেটা ভাবতেই তার দুচোখে জল চলে আসছে৷ তবুও সে অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছে। কেননা, আমিনা চায় তার মিষ্টি আপু ভালো থাকুক। নিজের সব আপনজনকেই তো সে হারিয়ে ফেলেছে। নিজের মা-ভাই সবাইকে। এখন তো শুধুমাত্র মিষ্টিই এমন একজন যার সাথে তার কোন রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও এমন এক আত্মিক বন্ধন আছে যা রক্তের সম্পর্কের থেকেও বেশি দৃঢ়। মিষ্টির জন্য তো সে হাসতে হাসতে নিজের জীবনও দিয়ে দিতে পারে। তার কাছে তো এটা কিছুই না।
রোকসানা শিকদার রাফাকে কোলে নিয়ে বিষন্নমনে দাঁড়িয়ে আছেন, মোর্শেদ চৌধুরীর চেহারাতেও বিষন্নতার ছায়া। এসব কিছুর মধ্যে যদি কারো চেহারায় আনন্দের আবেশ থাকে সেটা শুধুমাত্র সুইটি চৌধুরী। তার তো শুরু থেকেই রাফসানের সাথে মিষ্টির বিয়েটা একদম পছন্দ ছিলো না। এখন যখন রাফসানকে ভুলে মিষ্টি তার পছন্দমতো ছেলেকে বিয়ে করছেন তখন সুইটি চৌধুরীকে অনেক খুশি লাগছে। সুইটি চৌধুরী কাজি সাহেবের উদ্দ্যেশ্যে বলেন,
“তাড়াতাড়ি বিয়ে পড়ানো শুরু করেন কাজি সাহেব, শুভ কাজে বেশি দেরি করতে নেই।”
কাজি সাহেব বলেন,
“একটু ধৈর্য ধরুন, বিয়ে হলো সারাটা জীবনের মতো একটা পবিত্র বন্ধন। এতোটা তাড়াহুড়ো করার কি আছে? আমায় সবটা প্রস্তুত করতে দিন।”
“আসলে কি বলুন তো,আমার মেয়েটা সারাটা জীবন এত কষ্ট পেয়েছে যে আমি চাই এবার এই বিয়ের মাধ্যমে ওর সব কষ্ট দূর হোক।”
কাজি সাহেব কাবিননামা প্রস্তুত করছিলেন। এদিকে মিষ্টি উদগ্রীব হয়ে বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছিল। রাফসান এখনো আসে নি, অথচ তার তো এতক্ষণে চলে আসার কথা। মিষ্টির দুশ্চিন্তা বাড়ছে। তাহলে কি রাফসান সত্যিই আসবে না? তার ভালোবাসা কি তাহলে মিথ্যা প্রমাণিত হবে?
এদিকে কাজি সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করেন। মিষ্টির অস্বস্তি বাড়ছিল। সে আসাদের দিকে তাকায়। আসাদও নিরাশ চোখে তার দিকে তাকিয়ে।
আমিনা নিজেকে আর ধরে রাখতে না পেরে স্থান ত্যাগ করে। রোকসানা শিকদার মনে মনে বলতে থাকেন,
“কোথায় তুই রাফসান? তাড়াতাড়ি চলে যায়। এত বড় সর্বনাশ হতে দিস না। আজ যদি সত্যিই এই বিয়েটা হয়ে যায় তাহলে আমি তোকে কখনো ক্ষমা করবো না।”
এদিকে কাজি সাহেব মিষ্টিকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে ওঠেন,
“মা, এবার কবুল বলো।”
মিষ্টি হতবাক চোখে কাজি সাহেবের দিকে তাকায়। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে এখনো রাফসান আসে নি। মিষ্টির চোখ দিয়ে টপটপ করে অঝোর ধারায় পানি পড়তে থাকে। কাজি সাহেব বলেন,
“বুঝতে পারছি মা, বিয়ের সময় সব মেয়েদেরই কষ্ট হয়। কিন্তু এটা তো আল্লাহর তৈরি করা নিয়ম। কবুলটা বলে দাও। আমার আরো অনেক কাজ আছে। তাড়াতাড়ি কবুল বল।”
সুইটি চৌধুরী এগিয়ে এসে বলেন,
“কি হলো? কবুল বলে দেও মিষ্টি।”
মিষ্টির অশ্রু যেন আজ কোন বাধা মানছিল না। রাফসান আজ তাদের ভালোবাসাকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিলো। মিষ্টি বলে ওঠে,
ভূমধ্যসাগরের তীরে পর্ব ৪১
“পারবো না আমি এই বিয়ে করতে….পারবো না আমি..”
সুইটি বলে,
“বিয়েটা করে নে মিষ্টি। এমন কথা বলিস না।”
মিষ্টির মাথায় এবার হঠাৎ করে জেদ চেপে বসে।
“যদি রাফসান আমার ভালোবাসার মূল্যায়ন না করে তাহলে আমিও করব না। এই বিয়েটা আমি করবো।”
এমন ভাবনা থেকেই সে কবুল বলতে উদ্যত হয়।