মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ১০
মুসতারিন মুসাররাত
প্রত্যাশা অপ্রস্তুত ভাব কা’টিয়ে পরপর মুখে হাসি টেনে এনে মজা করে বলল,
-” ওহ হো আনিশা! আমাকে এলার্ট করায়, তোমাকে তো একটা থ্যাংকস দেওয়া উচিত। চকলেট দিলে যে লো’ভ লেগে যায়, এটা তো একেবারেই জানতাম না! ধুর, কী বিপদই না হতো বলো?”
আনিশা গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে পাকা সুরে বলল,
-” হুম, আমি জানি তো সব। তাই তোমাকে বারণ করেছি।”
-” বাহ! তাহলে তোমাকেই আমার সিক্রেট গার্ড বানিয়ে রাখলাম। এভাবে সবসময় এলার্ট করবে, ঠিক আছে?
আনিশা গালে হাত রেখে ভেবে বলল,
-” ঠিক আছে। তবে এক শর্তে, আমাকে আইসক্রিম দিতে হবে।”
নিভান বলল,
-” এই আনি বুড়ি এবার ঘু’ষ হবে না? এখন আমি নিজে তোকে পু’লিশে দিবো।”
আনিশা নাকমুখ কুঁচকে বলল,
-” উফ্ফ! বড় দাদান, নতুন ভাবী তো ভালোবেসে দিবে। ভালোবেসে দিলে ঘু’ষ হয় না। শুনেছো তুমি?”
-” নিজের বেলায় সারে ষোলো আনা, না?”
ড্রয়িংরুমে গল্প আর নাস্তার আড্ডায় জমে উঠেছে আজকের সন্ধ্যা। নামাজ শেষে নীহারিকা চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে ড্রয়িংরুমে হাসিমুখে বসা ছেলে-বউমাদের দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা হঠাৎ হালকা কেঁপে উঠলো। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো অনিচ্ছা সত্ত্বেও। তন্মধ্যে কাঁধে কারো হাতের আলতো স্পর্শে খানিকটা চমকে পেছন ফিরে তাকালেন। শর্মিলা দাঁড়িয়ে। মুখে আলতো হাসি।
-” কিছু ভাবছিলে আপা?”
-” না তো..কিছু না। কেনো?”
শর্মিলা জানে, নীহারিকা কিছু লুকোচ্ছেন। সরাসরি বললেন না বটে, কিন্তু চোখের ভাষা বলে দিচ্ছে ভেতরের অস্থিরতা। সামনে তাকিয়ে শর্মিলা শান্ত স্বরে বলল,
-” ইশশ! এত বড় পরিপূর্ণ একটা সংসার। তবুও কোথায় যেন একটা শূন্যতা থেকে গেছে। নীবিড় আর ওর বউ-বাচ্চা থাকলে যেন পুরোটা ঠিক পূর্ণ হতো। তুমি যতই মুখে কিছু বলো না কেন, আজ তোমার চোখে ওর অভাবটা আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আপা।”
নীহারিকার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। কণ্ঠস্বর রুক্ষ হয়ে এল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-” তুই ভুল বুঝেছিস ছোট। আমার কখনোই ওর কথা মনে পড়ে না। ক’বছর আগেই মনের ভেতর থেকে মুছে ফেলেছি, আমার আরেকটা সন্তান ছিলো। যেদিন আমার অমতে বিয়ে করল, সেদিনই আমার কাছে ও পর হয়ে গেছে। তারপর আর যা যা করল, তাতে আমি নিশ্চিত–ওর কাছে পরিবার বলে কিছু ছিল না। বাবার জীবন সংকট মূহুর্তেও একবার ফিরে তাকাল না। মা”রা গেলেও মনেহয় না খাঁটিয়া ধরতে আসতো, জানাজাতে থাকতো, এক মুঠো মাটি দিতো। বউ আর শাশুড়ির জন্য যে ছেলে মা-বাবাকে ত্যাগ করে, তার জন্মদাত্রী বলতেও নিজেকে ঘৃ’ণা লাগে।”
শর্মিলা ধীরে ধীরে বলল,
-” আপা, ও ছোট ছিলো। কতই বা আর বয়স। একটা ভুল না হয় করেই ফেলেছে। কিন্তু সেই এক ভুলের জন্য সারাজীবন তুমি ওকে মাফ করবে না? আর আমরা চোখের সামনে যেটা দেখি আর যা জানি, সেটা সবসময় সত্যি নাও হতে পারে।”
-” কোনটা সত্যি না ছোটো? অমতে গিয়ে ওই মহিলার মেয়েকে বিয়ে করল। তারপর আমি রেগে বললাম কখনো যোগাযোগ করিস না। ও শুধু আমার রাগটাই দেখল, মায়ের মনটা বুঝল না। আর এখন শুনছি, ও ড্রা’গে আ’স’ক্ত হয়েছে। তবে আমি অবাক হই না। যে মেয়ের জন্য পরিবার ত্যাগ করল, সে তো এমনই একটা পরিবার থেকে এসেছে। শুধু কষ্ট লাগে, আমারই সন্তান আজ এক ব্যর্থ মানুষের নাম।”
একটু থেমে… শর্মিলার হাত দুটো চেপে ধরলেন নীহারিকা। কণ্ঠে করুণ অনুরোধ,
-” দয়া করে, কেউ আর ওর হয়ে আমার সামনে কিছু বলিস না।”
শর্মিলা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলেন। মনেমনে ভাবলেন–
-” আবিরের বাবা বলল, নীরব ওদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। আপা হয়তো সেটা জানে না। জানলে নিশ্চয়ই বাধা দিতো, তাই হয়তো নীরব বলেনি।”
আনিশার কোল্ড এলার্জি থাকার জন্য সম্প্রতি ডক্টর মোনাস-৪ ওষুধ দিয়েছে। কিন্তু সমস্যা একটাই, আনিশা বড়ি ছুঁয়েও দেখে না। ওর কাছে বড়ি যেন বি’ষের চেয়েও ভ’য়ঙ্কর! সিরাপ হলে তাও চোখ বুজে এক চামচ খায়। শর্মিলা খানিকক্ষণ ধরে মেয়ের সাথে পেরে না উঠে, হাল ছেড়ে রাগের মাথায় উঠে চলে যাচ্ছিল। প্রত্যাশা লাফিয়ে উঠে কাছে গিয়ে বলল,
-” আন্টি, প্লিজ ওয়েট। আমার একটু কারিশমা দেখুন তো! আমি এক্ষুনি আনিশাকে বড়িটা খাওয়িয়ে দিচ্ছি।”
শর্মিলা অবিশ্বাসের চোখে চেয়ে থাকলেও প্রত্যাশার দৃঢ় আত্মবিশ্বাসে বাধা দিল না। প্রত্যাশা ওষুধের পাতাটা নিয়ে একেবারে ডাইনিং টেবিলের ফলের ঝুঁড়ি থেকে একটা ব্যানানা নিয়ে বড়িটা মাঝ বরাবর চেপে রাখল। শর্মিলার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল,
-” বাহ, দারুণ তো! মাথায়ই আসেনি আমার! ও তো কলা খুব ভালোবাসে। এইভাবে যদি ওষুধটা খাওয়ানো যায়…তাহলে মন্দ হয় না।”
আনিশা সোফায় বসে ফোনে কার্টুন দেখছিল। প্রত্যাশা সামনে গিয়ে মিষ্টি গলায় বলল,
-” আনিশা, দ্যাখো তো আমি তোমার জন্য কত্তো মজার ব্যানানা এনেছি!”
আনিশা খুশিমনে হাতে নিল। এরমধ্যে সোফার এককোণে রাখা ফোনটা বাজতে লাগল। কোয়েলের কল দেখে প্রত্যাশা কথা বলতে একটু ফাঁকে যায়। তাড়াহুড়ো করে কথা শেষ করে এসে দেখে আনিশার খাওয়া শেষ। যাক বুদ্ধি কাজে লেগেছে দেখে প্রত্যাশা বেশ খুশিই হলো। প্রত্যাশা হাসিমুখে আনিশাকে জিজ্ঞেস করল,
-” আরেব্বাস! আনিশা এরমধ্যেই খাওয়া শেষ। তা পুরোটা খেয়েছিলে তো?”
টিভিতে স্পোর্টস দেখছিলো নীরব। প্রত্যাশা গলা খাঁকারি দিয়ে বেশ ভাব নিয়ে বলল,
-” উঁহুম..উহুম। দেখলেন তো আমার কারিশমা। আপনারা বাড়ি সুদ্ধ লোক যেটা পারছিলেন না, আমি মিনিটের মধ্যেই সেটা করে দেখালাম। তুড়ি বাজানোর মতো।”
আনিশা যখন কিচ্ছুতেই ওষুধ খেতে রাজি হচ্ছিল না। সেই সময় নীরবও একটা ছোট্ট চেষ্টা করেছিল–খেলনা, আইসক্রিম, চকলেট এনে দিবে বলেছিলো। কিন্তু আনিশা একটুও টলেনি। সে ওষুধ খাবে না মানে–খাবেই না। প্রত্যাশার চোখেমুখে উপচেপড়া ভাব। নীরবের দিকে তাকিয়ে ভাব নিয়ে মিটিমিটি হাসছে। তবে বিধিবাম! মুখের হাসি, তারপর ভাব নেওয়া, বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। আনিশা ঘাড় কাত করে বলল,
-” হ্যাঁ খেয়েছি তো। শুধু ব্যানানার বিচিটা ফেলে দিয়েছি।”
তর্জনী তুলে মেঝের এক কোণায় দেখাল– সেখানে গড়াগড়ি খাচ্ছে সেই কুখ্যাত বড়িটা। প্রত্যাশার মুখের হাসি সেকেন্ডেই গায়েব হয়ে গেল। ঠোঁটের ফাঁক গলে বেরিয়ে এলো এক অপ্রস্তুত স্বর,
-” অ্যা…”
আনিশা কাঁধ ঝাঁকিয়ে শান্তভাবে বলল,
-” হ্যাঁ।”
নীরব বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। পরপর প্রত্যাশার দিকে তাকিয়ে মেপে স্বল্প হাসল। সেই হাসিটা প্রত্যাশার কাছে একটা নির্দয় ব্যঙ্গ ঠেকল। নীরবের শান্ত দৃষ্টিজোড়া নিঃশব্দে প্রত্যাশাকে বলছিলো— কনফিডেন্স থাকা ভালো, তবে অভার কনফিডেন্স দেখানো ভালো নয়, ম্যাডাম।
নিশুতি রাতের নিস্তব্ধতা কাঁপিয়ে ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে বারোটা ছুঁয়েছে। নীরবের রুমে নিঃশব্দে বসে আছে প্রত্যাশা। বিছানার কিনারায় দুই হাত ঠেস দিয়ে বসে আছে। পা দুটো অনবরত দুলছে, যেন ভেতরের অস্থিরতা বাইরে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজছে। মাঝে মাঝে চোখ চলে যাচ্ছে ডিভানে বসে থাকা নীরবের দিকে। ল্যাপটপে মুখ গুঁজে কাজ করছে সে। নীরবের মুখাবয়ব দেখে মনে হচ্ছে–এই ঘরের অন্য কারো উপস্থিতি তার অনুভবেই নেই।
রাত যত গাঢ় হচ্ছে, প্রত্যাশার অস্বস্তি তত বাড়ছে। একটা বন্ধ ঘর, এক ছাদের নিচে, একই বিছানায়–একজন ছেলে মানুষের সাথে রাত কা’টাতে হবে। ভাবতেই যেন শরীরটা কেঁপে উঠল প্রত্যাশার। রাগ হচ্ছে নীরবের উপর। ও তো গেস্ট রুমেই থাকতে চেয়েছিল, কিন্তু ছোট আন্টি একরকম জোর করেই পাঠিয়েছেন এখানে। পা দুটো আরও জোরেজোরে দুলাতে দুলাতে গম্ভীর গলায় বলল প্রত্যাশা,
-” শুনুন?”
নীরব চোখ না তুলেই উত্তর দিল,
-” হুম, বলো।”
-” আপনি নিজ থেকে বলতে পারলেন না…।”
এতটুকু বলে প্রত্যাশা থামল। এবার নীরব তাকাল প্রত্যাশার দিকে। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
-” মানে?”
প্রত্যাশার কণ্ঠে একরাশ বিরক্তি,
-” মানে বুঝতে পারছেন না? আপনি বলতেই পারতেন, যে আমাদের একসাথে থাকার এখুনি দরকার নেই। আমি তো এখানে হানিমুন করতে আসিনি, শুধুই একটু ঘুরতে এসেছি। তাই যখন সংসার করতে আসি, তখন না হয়…”
নীরব ঠাণ্ডা গলায় জিজ্ঞেস করল,
-” তখন..তখন কী?”
প্রত্যাশার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতে বসেছে। বলতে ইচ্ছে করছে–‘তখন আপনার মাথা।’ কিন্তু নিজেকে সামলে ভদ্রতা বজায় রাখার শেষ চেষ্টাটুকু করল। আর কোন কথা না বলে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। ভারী গাউনটায় হাঁসফাঁস লাগছে। ব্যাগ খুলে প্লাজো আর লেডিস টি-শার্ট বের করল। ফ্রেশ হতে হবে। ব্যাগের জিপার একে একে খুলে তন্নতন্ন করে খুঁজেও ব্রাশের দেখা নেই। বিরক্ত গলায় নিজেকেই বলল,
-” ধ্যাত! ব্রাশটাই আনিনি দেখছি। আম্মুও না, কী দরকার ছিল একগাদা হেয়ার ব্যান্ড গুঁজে দেয়ার। দরকারি জিনিস নেই। বাড়তি জিনিসে ব্যাগ ভর্তি। ধূর, ভাল্লাগে না।”
ল্যাপটপ অফ করে শাটার নামিয়ে নীরব ওয়ারড্রোবের কাছে এগোল। ড্রয়ার থেকে নতুন বাড়তি ব্রাশ খুঁজে বের করল। এসব জিনিস একসাথে অনেকগুলো কেনে। তাই বেশ কয়েকটা এখনো আছে। একটা পিং কালারের ব্রাশ নিয়ে প্রত্যাশার দিকে বাড়িয়ে দিলো। বলল,
-” এটা নাও।”
প্রত্যাশা মুখশ্রীতে বিরক্তির রেষ নিয়েই শুকনো কণ্ঠে বলল,
-” থ্যাংকস।”
বিছানার হেডে হেলান দিয়ে এক পায়ের সাথে আরেক পা জড়িয়ে নীরব ফোন স্ক্রল করছে। প্রত্যাশা ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানার অপরপাশের এক কোণে বসল। এক প্রান্তে থাকা বড় কোলবালিশটা দেখে চোখ দুটো চকচক করে উঠল। ত্রস্ত কোলবালিশটা তুলে বেডের মাঝ বরাবর রাখল। কণ্ঠে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করল,
-” এইযে শুনুন! এইটা আমাদের মাঝের সীমান্ত। এর ওপারে আসা মানে যুদ্ধের ঘোষণা! বুঝলেন তো?”
নীরব চুপচাপ চেয়ে শান্ত স্বরে বলল,
-” এটাকে তো মনে হচ্ছে মিনি দেয়াল। বাই এনি চান্স, তুমি কী কোনো কারনে ভ’য় পাচ্ছো?”
ব্যাটাকে ভ’য় পেতে যাব কোন দুঃখে। তবে কথার ইঙ্গিত মোটেই সুবিধার ঠেকছে না। সাধে কী আর একে নীরব ঘাতক বলি! মনেমনে এসব ভেবে মাথা ঝাড়ল প্রত্যাশা। রাগিরাগি চোখে তাকিয়ে বলল,
-” আমি ভ’য় পাই না। তবে এই বর্ডারটা থাকলে দুজনেরই ভালো। আপনি তো নীরব-গম্ভীর। হুট করে গম্ভীর মুখ নিয়ে ঘুমের মধ্যে পাশ ফিরে এলে, অন্ধকারে গম্ভীর মুখটা দেখে ভয়ে জ্ঞানও হারাতে পারি। প্রথম রাতে এমন কান্ড হলে, সবাই আপনাকে দুষবে। ভাববে, কী না কী করেছেন….তাই বউ জ্ঞান হারিয়েছে।”
প্রত্যাশার মুখ থেকে এমন কথা শুনে নীরব তা’জ্জব বনে যায়। প্রত্যাশা উল্টোদিক ঘুরে দুম করে শুয়ে পড়ল। নীরব ফোন স্ক্রলে মনোযোগ দিলো। প্রত্যাশা শুয়ে উসখুস করতে থাকে। ওপাশ হয়েই মাথাটা হালকা ঘুরিয়ে ডেকে উঠল,
-” শুনুন?”
-” শুনছি। বলো..”
-” তখনকার মতো আবার বলে বসবেন না কিন্তু, আজ প্রথম রাত, কোনো রিস্ক নিতে চাচ্ছি না। বলা তো যায় না, ঘুমের মধ্যে চো’র-টোর এসে যদি চু’রি-টুরি করে নিয়ে যায় তোমায়। তাই কাছাকাছি থাকো। এরকম কোনো অজুহাত মোটেই দিবেন না, হুঁ। এরকম মনে হলে না ঘুমিয়ে জেগে জেগে পাহারা দিন।”
ও গড! মেয়েটার এই ইমম্যাচিউর কথাবার্তা শুনে একদিনেই মনে হচ্ছে– বাবার কথামতো অল্প বয়সী মেয়েকে বিয়ে করা মোটেই ঠিক হয়নি। নীরব সময় নিয়ে বলল,
-” ডোন্ট ওয়ারি! আপাতত এই ব্যাপারে নিশ্চিত থাকো। এএসপি নীরবের কাছ থেকে তার বউকে নেওয়ার সাধ্য আর সাহস কারোরই নেই। তাই এরকম অজুহাত দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।”
নীরব উঠে লাইট অফ করে হালকা সবুজ ডিম আলো জ্বালিয়ে দেয়। বিছানায় শুয়ে ঠান্ডা কণ্ঠস্বরে বলল,
-” অ্যাডভান্স উল্টাপাল্টা চিন্তা বাদ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়। গুড নাইট।”
কাক ডাকা ভোরে ঘুম ভাঙে প্রত্যাশার। জানালার পর্দা গলে সূর্যের চিকন আলোক রশ্মি রুমে ঢুকছে। প্রত্যাশা চোখ মেলে মস্তিষ্ক সজাগ হতেই, প্রথমে কোলবালিশ চেক করে। যাক, কোলবালিশটা মাঝেই আছে। উল্টো পাশ ঘুরে ঘুমন্ত নীরবকে একপল দেখল। কিছুক্ষণ চেয়ে থাকল। ভাবল– ওর জায়গায় আজ এখানে অন্য মেয়ে থাকলে, নিশ্চয় বউ বউ আরচণ করতো। এইযে নীরবের কপালের উপর কিছু চুল পরে আছে, আলতো হাতে সরিয়ে কপালে চুমু দিতো। উনিও উষ্ণ স্পর্শে জড়িয়ে ধরত।
এতটুকু ভাবার মাঝে একটু লজ্জা লাগল প্রত্যাশার। আবার পরপর রাগ হলো। ধ্যাত তেরি! অন্য মেয়ের সাথে ভাবছে কেনো? আর যাইহোক নিজের বরের সাথে অন্য মেয়ের কথা ভাবতে পারল না। নিজে যেমনই হোক, তবুও ওই পারফেক্ট বরের জন্য। অন্যকেউ নয়। দুঃস্বপ্নেও নয়। বরের সাথে পৃথিবীর কোনো মেয়েকেই শেয়ার তো দূরের কথা, ভাবাও যায় না। এইযে একটু ভাবছিলো–অন্য মেয়ে হলে… তাতেই নিজের উপর মেজাজ চটল প্রত্যাশার।
ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ব্রাশ করছে প্রত্যাশা। গালে জমা হওয়া টুথপেস্টের ফ্যানা গ্রিল দিয়ে থু করে ফেলবে, মাথাটা গ্রিলের কাছে নিয়েছে এমন সময়,
-” এটা কী?”
প্রত্যাশা ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল। নীরবের হাতে ব্রাশ। চোখমুখ শক্ত হয়ে আছে। ব্রাশটা প্রত্যাশার সামনে ধরে প্রশ্নটা করেছে নীরব। প্রত্যাশার ভ্রু কুঁচকে আসলো। তড়িৎ থুথু ফেলল। নীরবের দিকে কপাল গুটিয়ে চেয়ে বলল,
-” আরে… বাংলা সিনেমায় গাছের সাথে ধাক্কা লেগে চিৎ-পাটাং হয়ে পরে। তারপর জ্ঞান ফিরে পেয়ে বলে–আমি কে? মানে স্মৃতি হারিয়ে ফেলে। আপনিও কী তেমন ঘুম থেকে জেগে সব স্মৃতি হারিয়ে ফেললেন নাকি?”
নীরবের কপালে বিরক্তির ছাঁট গাঢ় হলো। প্রত্যাশার অতিরিক্ত কথায় অতীষ্ঠ চোখে চাইল। প্রত্যাশা গমগমে স্বরে বলল,
-” এটা তো ব্রাশ। আপনি চি…”
নীরব থামিয়ে দিল। ঠান্ডা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
-” আই নো, এটা ব্রাশ। বাট এটা কার?”
এতক্ষণে প্রত্যাশার টনক নড়ল। নিজের হাতের ব্রাশের দিকে একবার চাইল তো আবার নীরবের হাতের দিকে। চোখদুটো আকাশে উঠল ওর। গা গুলিয়ে আসলো। হড়বড়িয়ে বমি করে দিবে এমন ভাব করল। একহাতে পেট ধরল, অন্যহাতে মুখ চেপে
-” ওয়াক…”
শব্দ করল। মনে হলো পেটের সব যেনো এবার উগড়ে দিবে। বমি করে ভাসিয়ে দিবে। নীরব সামনে ছিলো, নিজেকে সেফ করতে দু’পা পিছিয়ে গেল। নিরাপদ দূরত্বে চোয়াল শক্ত করে দাঁড়াল। এতক্ষণ দিব্যি ওর ব্রাশ নিয়ে আরামসে ব্রাশ করছিলো। এখন যেই… উফ্! পেটে খাবার নেই তাই বোধহয় কিছু বেরুল না। তবে…ওয়াক…ওয়াক থামল না। নীরব ধ’ম’ক দিয়ে উঠল,
-” স্টপ।”
ধ’ম’কটা মনেহয় বমিবমি ভাব কাটানোর ওষুধ হিসেবে কাজে লাগল। মূহূর্তেই প্রত্যাশা মুখটা শুকনো করে সোজা হয়ে দাঁড়াল। হায় হায় করে আফসোস নামাল গলায়,
-” ইয়া আল্লাহ! আমি তো খেয়ালই করিনি। ওয়েট আপনার ব্রাশটা ধুয়ে দিচ্ছি।”
যতটা গা ঘিনঘিন করছিল, তার থেকে চৌগুণ অভিনয় করে প্রত্যাশা। নাহলে উনি তো আবার কেমন ভাববে। কিন্তু প্রত্যাশা তো আর ইচ্ছে করে এমন কান্ড করেনি। দোষ তো এই লোকের। সেইম ডিজাইন ব্রাশের শুধু কালার আলাদা। প্রত্যাশারটা গোলাপি ছিলো, নীরবেরটা আকাশী। রঙে এত ডিফারেন্ট থাকা সত্ত্বেও কী করে যে ভুল হলো। ধ্যাত ঘুমঘুম চোখে ব্রাশ হাতে নিয়েছিলো, তাই বুঝি এমন হয়েছে।
নীরব আর কিছুই বলে না। রুমে গিয়ে নতুন একটা ব্রাশ বের করে নেয়। প্রত্যাশা হাতমুখ ধুয়ে এসে আড়চোখে চেয়ে ভাবে,
-” যতসব ঢং। দু’দিন পরে ঠিকই ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে রাখবে। থুথু যুক্ত চুমু খাবে। আর এখন…এমন ভাব দেখাচ্ছে। আরে ভাই.. আমি কী আর ইচ্ছে করে…ইয়াক…”
ওয়াক..ওয়াক..করে বমি করবে করবে এমন ফের করতে থাকে প্রত্যাশা। নীরব ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে বলল,
-” এবারে ওয়াক..ওয়াক বন্ধ করো। সবাই আবার ভেবে বসবে– এক রাতের মধ্যেই তোমার বর, তার বউকে প্রেগন্যান্ট করে ফেলেছে।”
কথাটা প্রত্যাশার মাথায় ক্যাচ করতে কয়েক সেকেন্ড লেগে যায়। তোমার বর, তার বউ! উমম তারমানে বউটা প্রত্যাশা নিজে। বুঝতেই প্রত্যাশার চোখ বিস্ময়ে ঠাসা হয়। মিস্টার আনপ্রেডিক্টেবলও তো কোনো ভাবে কম যায় না। নীরব ওয়াশরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একপল পিছুনে ঘুরে তাকাল। ডাকল,
-” শুনো?”
প্রত্যাশা কোনো রকম মিহি স্বরে শুধু বলল,
-” হুঁ।”
-” ড্রেস পাল্টে বাইরে যেয়ো।”
মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৯
আর একটাও বাড়তি কথা না বলে নীরব ওয়াশরুমে ঢোকে। প্রত্যাশা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে থাকে। আয়নায় নিজেকে দেখে লজ্জা লাগল। টিশার্টটা বেশ ঢিলেঢালা। মুখ ধুতে গিয়ে পানি পরে সামনের দিকে লেপ্টে আছে।