মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ১৮

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ১৮
মুসতারিন মুসাররাত

নীরবের চোখের মণি স্থির, খুব কাছে থাকা রমণীর মুখপানে। প্রত্যাশা জিভ দিয়ে নিম্নোষ্ঠ ভিজিয়ে মিহি স্বরে বলল,
-” ছা…ড়ুন….”
বোঝা গেল না কথাটি নীরবের কর্ণকুহরে ঢুকল কী না। ওর দৃষ্টিতে এখনো সেই একরোখা স্থিরতা। একটুও না নড়ল, আর না তো চোখের পলক পড়ল। তন্মধ্যে আনিশা ব্যালকনির কোণ থেকে দৌড়ে আসল। মুখভর্তি হাসি নিয়ে দুইহাত এক করে করতালি দিল। ঝুমঝুম করে বলে উঠল,
-” ইয়েএএএ…. আমি জিতেছি! হুররেএএএ… নতুন ভাবি খুঁজে পাওনি!”
ওরা দু’জনই হকচকাল। নীরব ত্রস্ত প্রত্যাশাকে ছেড়ে দিল। প্রত্যাশা একটু গুছিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। আনিশার আকস্মিক প্রশ্নে দু’জনে আরেক দফা চমকায়! অপ্রস্তুত হয়। আনিশার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। হঠাৎ কোমরে দুই হাত রেখে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল,

-” তোমরা কী করছিলে গো?”
নীরব ক-পা এগিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল। মৃদুস্বরে কেশে হাতের ঘড়ি খুলতে থাকে। যেনো সবকিছু স্বাভাবিক এমন এটিটিউড নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখল। প্রত্যাশা একহাতে কাঁধের উপর দিয়ে সামনে রাখা চুল গুছিয়ে নেওয়ার ভঙি করল। পরপর জড়তা নিয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
-” ক-কই… কিছু না তো!”
আনিশা ভুরু কুঁচকে বিজ্ঞের মতন গোলগোল চোখ করে বলল,
-” ও…ও… নতুন ভাবি বুঝি আমাকে ভেবে ভুল করে ছোটো দাদানকে ধরে ফেলেছে! তাই না?”
প্রত্যাশা চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে থাকে। আনিশা দুষ্টু হাসি নিয়ে ফের বলল,
-” ভাবি ছোটো দাদানকে চো’র বানিয়ে ফেলেছে! ইয়েএএ! পুলিশকেই চো’র বানিয়িছো। ছোট দাদান না খেলেও চো”র হয়েছো। কী মজা!”
প্রত্যাশা ঠোঁট চেপে হাসতে হাসতে আনিশার গাল টিপে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-” হুম।”
পরপর আড়চোখে নীরবের দিকে তাকাল। নীরবের মুখভঙ্গি দেখে কিছু আন্দাজ করতে না পেরে ভেংচি কা’টে– মিস্টার আনপ্রেডিক্টেবল! কখন কী রিয়েকশন করবে? বোঝা দায়। একটু আগেই চোখের ভাষা অন্যকিছু বলছিল। আবার এখনই; গম্ভীর। যত্তসব। আরে ভাই…কখন এসেছি, একবার ফর্মালিটিজের জন্য হলেও তো জিজ্ঞেস করতে পারে। এটিটিউড দেখে বাঁচি না। অতঃপর আনিশাকে উদ্দেশ্য করে জোরেশোরে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল,
-” আনিশা, আন্টি তোমাকে খাওয়ার জন্য এক্ষুনি ডাকবে। চলো যাই।”
এই বলে আনিশার হাত ধরে বেরিয়ে গেল প্রত্যাশা।

দুপুরে ডায়নিংয়ে হরেক রকমের পদ। একপাশে শফিক সাহেব আর মাহবুব সাহেব। প্রত্যাশার ডানপাশে আবির, বাঁ-পাশে নীলা। ঠিক সামনে নীরব আর নিভান। নীহারিকা আর শর্মিলা পাতে পাতে খাবার সাজিয়ে দিচ্ছেন। হালকা গল্পগুজবের মাঝে চলছে খাওয়া। নীরবের সম্পুর্ন মনোযোগ খাওয়াতে। মাহবুব সাহেব হঠাৎ প্রসঙ্গ তুললেন,
-” শফিক ভাই, প্রত্যাশা মা তো আমাদের পরিবারের সঙ্গে অনেকটা মিশেই গেছে। মনেহয় না এখন বাড়ি ছেড়ে থাকতে কোনো সমস্যা হবে। ভাবছি, খুব দেরি না করে তাড়াতাড়িই আনুষ্ঠানিকতা করব। বাড়ির বউকে বাড়িতে আনব।”
শফিক সাহেব শান্ত গলায় বললেন,
-” আপনার কথায় দ্বিমত নেই ভাই। তবে…শুধু পরীক্ষার জন্য চাইছি একটুখানি স্থির সময় পাক। এ কটা দিন সময় চেয়ে নিলাম। তারপর সব আনুষ্ঠানিকতা হবে ইনশাআল্লাহ।”
মাহবুব সাহেব বললেন,

-” ঠিক আছে ভাইজান।”
নীহারিকা বললেন,
-” বিয়ে তো হয়ে গিয়েছে। আবার কিসের আনুষ্ঠানিকতার জন্য অপেক্ষা? বাড়ির বউ হিসেবে এভাবে আসছে-যাবে। পরীক্ষাটা শেষ হলেই একেবারে আসবে। ব্যস!”
প্রত্যাশা ভাতের লোকমা মুখে তুলতে তুলতে নীরবের দিকে তাকাল। নীরবকে নির্লিপ্ত দেখে মস্তিষ্কে চঞ্চলতা ভর করল। নীরবের মনোযোগ দিয়ে খাওয়াতে একটু ডিস্টার্ব করতে মনটা আঁকুপাঁকু করছে। মুখের উপর থাকা একগাছি চুল বাম হাতের তর্জনীতে পেঁচাতে পেঁচাতে একটা পা একটু বাড়ায়। উদ্দেশ্য নিঃশব্দে, সন্তর্পণে, নীরবের পায়ে সুড়সুড়ি দিবে। পা টা গিয়ে একটু ছোঁয়া লাগতে না লাগতেই…..অমনি সাথে সাথেই পা টেনে নিয়ে, ঝট করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় নিভান।
প্রত্যাশা মিটমিটে হাসি নিয়ে তখনও নীরবের দিকে চেয়ে। নিভানকে এভাবে খাওয়া বাদ রেখে দাঁড়াতে দেখে নীহারিকা জিজ্ঞেস করলেন,

-” নিভান কী হয়েছে? খাওয়া বাদ দিয়ে হঠাৎ উঠলি যে।”
নিভান উবু হয়ে টেবিলের তলায় উঁকি দিল। নীলা প্রশ্ন করল,
-” তোমার আবার কী হলো? খাওয়া ফেলে টেবিলের তলায় উঁকিঝুঁকি দিয়ে কী খুঁজছো?”
প্রত্যাশা জিভ কা’টল–এইরে মিস্টেক! নিভান সামনে তাকাতেই দেখে প্রত্যাশা মুখে একটা সরল হাসি নিয়ে চেয়ে। নিভান অনুমান করে নেয়। বসে এক গাল ভাত মুখে পুরে হালকা গলা নামিয়ে বলল,
-” না মানে দেখছিলাম, টেবিলের তলায় ছুঁয়াছুয়ি খেলছে কারা?”
নীলা নির্বোধের মতন জিজ্ঞেস করল,
-” কীহ?”
-” কিছু না, বিড়ালের মতো লাগল।”
প্রত্যাশার চো’রচো’র ভাবসাব দেখে নীরব বুঝে নেয়। এসব উল্টাপাল্টা দুষ্টামি প্রত্যাশা ছাড়া কারো নয়।

ঘড়ির কাঁ’টা রাত আটটার ঘর ছুঁয়েছে। প্রত্যাশা চোখদুটোয় কাজল টেনে পরপর ঠোঁটে লাল রঙের লিপিস্টিক দিচ্ছিল। এমন সময় পায়ের শব্দ শুনে তাকাতেই গায়ে সাদা টিশার্ট, ছাইরঙা ট্রাউজার, চুলগুলো একটু ভেজা ভেজা। নীরবকে রুমে ঢুকতে দেখল।
লাঞ্চ করে অফিস গিয়েছিল। খানিকক্ষণ আগেই ফিরে শাওয়ার নিয়ে ড্রয়িংরুমে ছিলো নীরব। একটু পর কেক কাঁ’টা হবে। প্রত্যাশা রুমে সাজুগুজু করছিল। প্রত্যাশার গায়ে গাঢ় নেভি ব্লু এর উপরে সাদা জিগ-জ্যাগ প্যাটার্নের সফট জর্জেট শাড়ি। চুলগুলো ছেড়ে দেওয়া। প্রত্যাশার আপাদমস্তক পরখ করে নীরব হাতের ফোনটা ওয়ারড্রবের উপর নামাল। পিছু ঘুরতেই দেখল দুইহাত বুকে গুঁজে মুখটা গম্ভীর করে প্রত্যাশা সামনে দাঁড়িয়ে। নীরব পাশ কে’টে যেতে নিলে প্রত্যাশা পথ আটকিয়ে প্রশ্ন করল,
-” কী সমস্যা আপনার?”
নীরব ভ্রু কুঁচকে প্রত্যাশার রাগি-রাগি মুখের দিকে তাকিয়ে নিরুত্তাপ থাকল। প্রত্যাশা উত্তর না পেয়ে ফের প্রশ্ন ছুঁ’ড়ল,

-” এভাবে এড়িয়ে যাচ্ছেন কেনো? কথা বলছেন না যে?”
-” কার সাথে?”
নীরবের হেঁয়ালিপূর্ণ প্রশ্নে প্রত্যাশা নাক ফুলিয়ে–পাড়ার ভাবিদের সাথে কথা না বলার কথা বলছি! মনেমনে বলে। মুখে বলল,
-” আপনার বউয়ের সাথে।”
-” বউ কী মনেকরে….আমি তার বর?”
প্রত্যাশার চোখ বড়বড় হয়ে যায়।‌ চেঁচিয়ে উঠল,
-” মানে!”
-” মানে সিম্পেল। বউ কখনো তার ব্যাপারে আমাকে কোনোকিছু জানানোর প্রয়োজনবোধটুকু রাখে না। তাই__”
-” আপনি এখনো রাগ করে আছেন? স্যরি বলেছি তো।”
নীরব উত্তর না দিয়ে বুকে হাত ভাঁজ করে দাঁড়াল। প্রত্যাশার মুখটা এইটুকুন হয়ে আসল। ম্লান স্বরে বলল,
-” জানেন আমার আম্মু বলে, আমার মনটা নাকি খুব নরম। হয়তো সত্যি! এইযে আমি যখন রিলাইজ করি, আমার উপর কেউ অভিমান করেছে, আমার জন্য কেউ হার্ট হয়েছে। তখন আমার খুব খা’রাপ লাগে।‌ যতক্ষণ না সবটা আগের মত হয়, ততক্ষণ আমার কিচ্ছু ভালো লাগে না।”

-” তুমি বলছো কেউ….উমম! মানে আমার জায়গায় অন্যকেউ হলেও, একই রকম হতো? তোমার এই কোনো কিছু ভালো না লাগার জন্য স্পেশালি আমি নই? আ’ম আই রাইট?”
-” এ মা, আপনি সব সময় কথা এভাবে ধরেন কেনো? আমি অতশত ভেবে বলিনি তো। আমার সত্যিই মন খারাপ করছে। আমি মন থেকে স্যরি বলছি।”
-” এভাবে নয়।”
-” এভাবে নয়? তাহলে কীভাবে?”
প্রশ্ন করে উত্তর আসার আগেই প্রত্যাশা ঝটপট বলল,
-” আপনি নিশ্চয় কানে হাত দিয়ে স্যরি বলতে বলছেন?”
নীরব ঠোঁট টিপে মুচকি হাসল। বলল,
-” শুধু কান ধরেই নয়। ইউ’ল হ্যাভ টু ডু আপ-ডাউনস ঠু।”
-” আপ-ডাউন..!”
প্রত্যাশা চোখ বড়বড় করে বিস্ময় নিয়ে বলল। নীরব জবাবে বলল,
-” হুম।”
প্রত্যাশা কিছুপল স্থির থেকে ঠোঁট উল্টে বলল,
-” আচ্ছা… ঠিক আছে।”

প্রত্যাশা দুইহাত কানে ধরে –‘ওকে’ বলে। তারপর চোখের পাতা নামিয়ে নিচু হবে….সেই মূহূর্তে নীরব এগিয়ে পেছন হতে প্রত্যাশার কোমড় দুই হাতে জড়িয়ে ধরে। প্রত্যাশা একটু হেলে যায়, নীরব ওর মুখটা প্রত্যাশার ডান গালের সাথে ছোঁয়ায়। নীরবের থুতনি গিয়ে ঠেকে প্রত্যাশার কাঁধে। নীরব নিঃশব্দে ঠোঁট ছড়িয়ে হেসে বলল,
-” থাক…থাক লাগবে না।”
প্রত্যাশার মুখেও হাসি। উষ্ণ স্পর্শ, সাথে শিরশিরানি, আর দমবন্ধকর অনুভূতি। নিজের কোমড় পেঁচিয়ে রাখা নীরবের হাতের উপর প্রত্যাশা দু’টো হাত রাখে। বলল,
-” আপনি মন থেকে বলছেন তো?”
প্রত্যাশার গালে গাল ঘষে বলল নীরব,
-” হুম মন থেকে। মেয়েদের নিউরনে নিউরনে দেখছি বুদ্ধি।”
-” মানে?”

-” এইযে শাড়ি পরে আমাকে ঘা’য়েল করে ক্ষমা চাইছো।”
প্রত্যাশা সামনে ঘুরে দাঁড়াল। নীরবের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
-” এ কদিন আগের মতো কথা বলছিলেন না কেনো?”
-” সবাই বলে দূরত্ব নাকি গুরুত্ব বাড়ায়। তাই দেখছিলাম, তোমার কাছে আমার গুরুত্ব কতটুকু?”
প্রত্যাশা দুই হাতে নীরবের গলা জড়িয়ে বলল,
-” তা মেপে-টেপে কতটুকু পেলেন?”
নীরব দুই আঙুল কাছাকাছি করে দেখিয়ে বলল,
-” এইটুকু….”
প্রত্যাশা মোটামোটা চোখ করে মেকি রাগ দেখাল। নীরব তৎক্ষণাৎ বলল,
-” উফ্! এভাবে তাকিয়ো না। তোমার এই দৃষ্টিতে আমি খু*ন হয়ে যাই। যে একবার তোমার এই মায়াবী চোখের রাগি দৃষ্টি দেখেছে, নির্ঘাত ঘায়েল হয়েছে।”
প্রত্যাশা ঠোঁট প্রসারিত করে হাসতেই একপাশে লুকোনো ছোট্ট গজ দাঁতটা উঁকি দিলো। নীরব চোখ আটকে ফেলল সেখানেই। নীরব ঠোঁটে আলতো হাসি টেনে বলল,
-” তোমার হাসির আসল সৌন্দর্যটা লুকিয়ে আছে তোমার ওই গজ দাঁতটায়। ওটাই তোমার হাসিকে করে তোলে মায়াময় আর প্রাণবন্ত। আর সেই হাসির ভেতরেই আমি খুঁজে পাই এক টুকরো নিঃশব্দ সুখ।”
প্রত্যাশা লজ্জায় রাঙা হয়ে দৃষ্টি নুইয়ে নেয়। নীরব প্রত্যাশার আরেকটু কাছে আসে। প্রথমে প্রত্যাশার কপালে চুমু খায়, তারপর নাকের ডগায়….তারপর ঠোঁট জোড়া র”ক্ত জবার ন্যায় রঙিন লিপিস্টিক রাঙানো ঠোঁটে নামে। কিন্তু সেই ঠোঁটজোড়া ছোঁয়ার আগেই প্রত্যাশা নিজের ঠোঁটের সামনে আঙুল দাঁড় করিয়ে দেয়। নীরবের চোখে আকুল আবেদন, প্রত্যাশা চোখের মণি ঘুরিয়ে –‘উহু’ শব্দ করে না সূচক বোঝায়। পরপর কাঠখোট্টা স্বরে বলল,

-” ওয়েট এএসপি সাহেব ওয়েট।”
-” আরো ওয়েট করতে হবে? বিয়ে করেছি এক মাসের বেশি। এখনো একটা লিপ কিস করতে পারলাম না। একটা কিসের জন্য কত বছর ওয়েট করতে হবে শুনি?”
প্রত্যাশা নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। হাসতে হাসতে বলল,
-” দেখা যাক। চলুন সবাই অপেক্ষা করছে হয়তো।”
এই বলে প্রত্যাশা এগিয়ে যাবে। তার আগেই নীরব থামিয়ে দিল। ওয়ারড্রবের উপর থেকে একটা বক্স নিয়ে বলল,
-” এটা তোমার জন্য ছোট্ট উপহার।”
প্রত্যাশা বিনিময় স্মিত হাসল। নীরব চুপচাপ চেইনটা হাতে নিয়ে প্রত্যাশার পিঠের চুলগুলো আলতো করে সরিয়ে দিল। ছোঁয়াটুকুতে প্রত্যাশার শরীর মৃদু কেঁপে উঠল। চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস আটকে রাখল। গলায় চেইন পরাতে পরাতে নীরবের আঙুল ছুঁয়ে গেল প্রত্যাশার নরম ত্বক। এক চিলতে ঠান্ডা স্পর্শে শিরশির করে উঠল প্রত্যাশা, কাঁধটা একটু কুঁচকে গেল। চেইনের ক্লিপটা আটকে প্রত্যাশাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল নীরব। অস্ফুট স্বরে বলল,
-” মাশা-আল্লাহ!”
প্রত্যাশার গাল লজ্জায় লাল হলো।‌ নীরব অন্য ছোট্ট বক্সটা প্রত্যাশার দিকে বাড়িয়ে বলল,
-” এটা আনিশার জন্য। ওর বার্থডেতে আমাদের পক্ষ থেকে গিফট। তুমি আনিশাকে দিয়ে দিও।”
-” কিন্তু আমি তো আনিশার জন্য গিফট কিনে এনেছি।”
-” ব্যাপার না… ওটাও দিও। এটা তোমার-আমার আমাদের পক্ষ থেকে।”
-” ওকে।”
দু’দিন আগে আনিশা শর্মিলার কাছে নুপুরের বায়না করছিল। যা নীরবের কানে এসেছিল। তাই ভাবে এটাতেই হয়তো আনিশা বেশি খুশি হবে। নুপুর কিনতে গিয়ে শো করে রাখা লকেটসহ চেইনটা প্রত্যাশার জন্য পছন্দ করে কেনে। তবে নুপুর ইচ্ছের জন্যও নেয়।

রাত বারোটা বাজতে চলছে। জানালার সফেদ পর্দার ফাঁক গলে চাঁদের আলো এসে পড়েছে রুমের কোণে। সাথে কৃত্রিম সাদা আলোয় রুমটা একদম ফকফকা, ঝলমল করছে। নিস্তব্ধ ঘরে চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।‌
নীরব সোফায় বসে। হাতের আঙুল ল্যাপটপে থাকলেও বেহায়া দৃষ্টি বারংবার আয়নার সামনে দাঁড়ানো রমণীর দিকে যাচ্ছে। ডিনার পর্ব শেষ হয়েছে অনেকক্ষণ আগেই। সবার সাথে গল্প-গুজব করে প্রত্যাশা মাত্র রুমে এসে, ফ্রেশ হয়ে হাতের চুড়ি খুলে একএক করে ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখছে।
নীরব ল্যাপটপ সাট ডাউন করে পরপর শাটার নামিয়ে দিল। উঠে হাতের ফোনটা নিয়ে বেড-টেবিলে নামিয়ে রাখল। প্রত্যাশাকে উদ্দেশ্য করে ত্যাড়া সুরে বলল,

-” এতক্ষণে ম্যাডামের গল্প শেষ হলো?”
-” হুম।”
কাঁধে আটকানো পিনটা খুলতে খুলতে প্রত্যাশা জবাব দিল। এমন সময় নীরব ওর হাত আটকে দিল। ঘাড়ে থুতনি রেখে জড়িয়ে ধরল। দু’জনের দৃষ্টি আয়নায় এক হলো। আয়নায় চোখ রেখেই নীরব বলল,
-” শাড়িতে তোমাকে বেশি সুন্দর লাগে! তাই বলছি, শাড়ি পড়েই থাকো।”
প্রত্যাশার থেকে উত্তর আসার আগেই নীরব তাড়া দিয়ে বলল,
-” চলো ঘুমাব। ঘুম পাচ্ছে।”
প্রত্যাশা নিজেকে ছাড়িয়ে বিছানায় বসল। বলল,
-” আরে ঘুমান। আমি কী বাঁধা দিয়েছি, নাকি বারণ করেছি? আপনার ঘুমে।”
নীরব ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল। লাইট নিভিয়ে নীল রঙের ডিম আলো জ্বালিয়ে দিলো। প্রত্যাশার পাশে বসতে বসতে বলল,

-” ইন্ডিরেকটলি দু’টোই করছো। বুঝতে পারছো না।”
প্রত্যাশা নাক-মুখ কুঁচকে চাইল। নীরব ওর দিকে ঝুঁকে আসে। প্রত্যাশা নিচের দিকে ঝুঁকল… এভাবে কয়েক সেকেন্ডর মধ্যেই প্রত্যাশার শরীর বিছানায় ঠেকল। নীরব ওর উপর ঝুঁকে। খুব কাছাকাছি। নীরবের নাক ছুঁয়ে গেল প্রত্যাশার নাকে। উষ্ণ নিঃশ্বাসে প্রত্যাশার দম বন্ধ হওয়ার জোগাড়। আবেশে নীরবের চোখ বুঁজে আসল। প্রত্যাশার দিকে আরেকটু মুখটা নামিয়ে নিল, সেই মূহূর্তে প্রত্যাশা মুখটা বাম পাশে ঘুরিয়ে নেয়। নীরবের মুখটা ডানপাশে বালিশ ছুঁয়ে গেল। প্রত্যাশা ওদিকে মুখ করে নিঃশব্দে লাজুক হাসল। নীরবও হেসে ফেলল। নীরব মৃদুস্বরে বলল,
-” প্রত্যাশা বি ইজি!”
প্রত্যাশার বুক রীতিমতো উঠানামা করছে। গভীর একটা শ্বাস টেনে নিল। তারপর আচমকা ও আস্তে করে বলে উঠল,
-” আমাদের বিয়েটা হুট করে হয়েছে। আমরা কেউই মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞেস করব করব করে করার সুযোগ পাইনি। আজ না করে থাকতে পারলাম না; বাবার কথা রাখতে… আপনি বোধ হয় বিয়েটা করেছিলেন? তাই না?”

-” হু টোল্ড ইয়্যু দ্যাট?”
-” আমার মনে হয়।”
নীরব আবারও জিজ্ঞেস করল। একটু গভীর স্বরে,
-” কেন মনে হয়?”
-” কারণ… আপনি আমার চেয়ে অনেক ভালো কাউকে ডিজার্ভ করেন।”
এক মুহূর্ত স্তব্ধতা। নীরব একহাতে প্রত্যাশার চিবুকে আলতো করে আঙুল রাখল।‌ পরপর মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
-” আই ডোন্ট বিলিভ ইন ডিজার্ভিং। আই বিলিভ ইন ডেস্টিনি।”
এক সেকেন্ড থেমে ফের বলল,
-” যা আমার জন্য নির্ধারিত ছিলো, আমি সেটাই পেয়েছি। আর আমি যেটা পেয়েছি, তাকে আমি বেস্ট মনে করি। তুমি আমার ভাগ্যে ছিলে, তারমানে তুমিই আমার শ্রেষ্ঠ পাওয়া।”
প্রত্যাশার চোখ ছলছল করে উঠল। নীরব ওর কপালে একটা উষ্ণ চুমু আঁকল। বলল গভীর স্বরে,
-” প্রত্যাশা তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী, আমি শুধু…আর শুধুই তোমাকে ভালোবাসি।”
দম ফেলল নীরব ফের বলল,

-” তোমাকে ভালোবাসার জন্য আমার কাছে আর কোনো ব্যাখ্যার দরকার নেই। আর রইল সৌন্দর্যের কথা। সৌন্দর্য তো শুধু চাহিদা বাড়ায়। আর মায়া; মায়া থেকে যায় শেষ নিঃশ্বাস অবধি।‌ আমি তোমার মৃগ নয়নের মায়ায়, তোমার গজ দাঁতের হাসির মায়ায়, তোমার কখনো ঝংকার তুলে হাসি বা কখনো রাগি রাগি লুকের মায়ায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছি। আমার চোখে তুমি সবচেয়ে ভয়ং’কর সুন্দরী! যার মাঝে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি।”
টলমলে চোখেও প্রত্যাশার ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি ফুটল। নীরব সেই হাসিমাখা মুখের দিকে তাকিয়ে আবেদনের সুরে ফিসফিস করে বলল,
-” ক্যান আই কিস ইয়্যু?”

প্রত্যাশা তৎক্ষণাৎ চোখের পাতা নামিয়ে ফেলল। মৌন সম্মতিতে নীরবের আবেগ, ভালোবাসা সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো উথালপাথাল ঝড় তুলল। নীরব বিলম্ব না করে নিজের ঠোঁটজোড়া স্থির করল প্রত্যাশার তিরতির করে কাঁপা ঠোঁটে। ধীরেধীরে ঠোঁটজোড়া আঁকড়ে ধরল প্রত্যাশার চিকন আকর্ষণীয় ঠোঁট। স্বর্গীয় অনুভুতির জোয়ারে আবেশিত হয়ে দু’জনের চোখ বুঁজে আসে। ভালোবাসার স্রোত শিরা-উপশিরা বেয়ে বয়ে যেতে লাগল। প্রত্যাশার শ্বাস হালকা কেঁপে উঠল। নীরব টের পেল সেই কাঁপুনি। নীরবের স্পর্শে নেই কোনো রুক্ষ, উগ্রতা। বরং আছে অদ্ভুত এক উষ্ণতা আর কোমলতা। সময় গড়াতে থাকে, প্রত্যাশার হাতের আঙুল ডেবে যায় নীরবের পিঠে। ঠোঁট ছেড়ে নীরবের মুখ প্রত্যাশার গলায় নামে। ছাড়া পেয়ে প্রত্যাশা শ্বাস টেনে নেয়। লজ্জায় আঁখি জোড়া মুদে আসে। ঘরের নিস্তব্ধতায় শুধুই শোনা যাচ্ছে দুই হৃদয়ের সমান্তরাল স্পন্দন। ঠিক এমন সময় যোগ হলো ফোনের রিংটোনের কর্কশ শব্দ। বাজতে থাকল নীরবের ফোন। প্রত্যাশার হাত তখনও নীরবের পিঠের টিশার্ট আঁকড়ে ধরা। প্রত্যাশা মৃদুস্বরে বলল,

-” নীরব আপনার ফোন…ফোন বাজছে।”
নীরবের কানে মনে হয়নি পৌঁছেছে। প্রত্যাশা ফের বলল,
-” নীরব…ফোন বাজছে।”
প্রত্যাশার শাড়ির আঁচলটা কাঁধ থেকে নামাতে গিয়ে নীরব বিরক্তি ‘চ: শব্দ কে’টে বলল,
-” ওহ্…শিট! শিট! শিট! ফোনটা সাইলেন্ট বা অফ করে রাখা উচিত ছিলো। ফোনটা খুব বি’রক্ত করছে দেখছি।”
প্রত্যাশা হাসল। ইশারায় ফোন তুলতে বলল। নীরব হাত বাড়িয়ে ফোনটা হাতে নিল। মনেমনে স্থির করে ফোন অফ করে রাখবে। যেই ফোনের পাশে চাপ দিয়ে পাওয়ার অফ করবে, তার আগেই স্ক্রিনে দৃষ্টি পড়তেই কপালে গাঢ় ভাঁজ পড়ল নীরবের। বিড়বিড় করল,

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ১৭

-” এত রাতে হসটপিটাল থেকে ফোন…”
নীরব ত্রস্ত বসে ফোন রিসিভ করল। ভেসে আসল,
-” মিস্টার নীরব, আপনাকে ইমার্জেন্সি এক্ষুনি হসটপিটালে আসতে হবে। প্লিজ, কুইক।”

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ১৯