মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ২৯
মুসতারিন মুসাররাত
রাত্রি এগারোটা দশ। প্রত্যাশা জানালার গ্রিল দু’হাতে ধরে দাঁড়িয়ে। আকাশে কালো মেঘের ভেলা বাতাসের সাথে যেনো উড়ছে। মূহুর্তেই মিটিমিটি আলো ছড়ানো চাঁদটাকে গ্রাস করে নিল একদল মেঘেরা। প্রত্যাশার মনেও ঘনকালো মেঘ জমেছে। বিষণ্ণতায় ডুবে আহত হৃদয়ে ছলছল চোখে শুণ্যে তাকিয়ে মেয়েটা। কাল রাতে নীরবের বলা প্রতিটি কথা সূচের মতো বুকে বিঁধছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।
রুমের ভেতরটা অন্ধকার। ভেজানো দরজার ফাঁক ফোকর গলে আবছা আলো রুমে ঢুকছে। সেই আলোয় প্রত্যাশাকে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দেখে অধরার ভ্রু বেঁকে যায়। একহাতে সুইচ টিপে আলো জ্বালাতেই ঘরটা ফকফকা আলোয় ঝলমল করে ওঠে। চমকে ওঠে চকিতে ঘুরে তাকায় প্রত্যাশা। অধরা এগিয়ে এসে ভাতের প্লেট, গ্লাস বেড টেবিলে রেখে শুধালেন,
-” প্রত্যাশা? লাইট নিভিয়ে, ঘর অন্ধকার করে ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস যে?”
প্রত্যাশা তড়িঘড়ি করে চোখের জল মুছল। গলা সামলে আমতা আমতা করে বলল,
-” ই-ইয়ে মানে, জানালার পর্দা ঠিক করছিলাম।”
-” অন্ধকারে পর্দা ঠিক করতে গেলি?”
মা’কে কোনো কিছু বুঝতে দিতে চায় না প্রত্যাশা। তাই নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক দেখাতে মিথ্যে বলল,
-” শুতে যাচ্ছিলাম, তখন খেয়াল হলো। তাই…”
-” আচ্ছা হয়েছে হয়েছে। এবার আয় তো খেয়ে নে। সেই দুপুরে কী একটু খেলি, দেখলাম না। আবার এখন বলছিস পেট ভরা, খাবি না।”
প্রত্যাশা মুখটা ছোট করে বলল,
-” আম্মু খা….”
অধরা কথা কেড়ে নিলেন। শাসিয়ে উঠলেন,
-” একদম বেশি কথা বলবি না। আয় আমি খাইয়ে দিচ্ছি। তোর পছন্দের সর্ষে ইলিশ করেছি আজ। তোর না খুব পছন্দ!”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আম্মু শুনবে না তাই অগত্যা প্রত্যাশা বিছানার একপাশে চুপটি করে বসল। অধরা ভাত মাখিয়ে এক লুকমা তুলে গালের সামনে ধরলেন। মেয়ের মুখটা স্বাভাবিক লাগলো না। সন্দিহান কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
-” মুখটা ওমন শুকনো লাগছে, মন মরা ঠেকছে, কিছু হয়েছে কী? হ্যাঁ রে প্রত্যাশা সবকিছু ঠিক আছে তো?”
বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠল প্রত্যাশার। আম্মুকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে বলতে ইচ্ছে করল— আম্মু সবকিছু ঠিক নেই। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। উনি আমায় বিশ্বাস করলেন না। কত কী বললেন। আমি সেসব মেনে নিতে পারছি না। আমার ভেতরটা কষ্টে ছিঁড়ে যাচ্ছে। আমি কাউকে কিছু বলতেও পারছি না। ভ’য় হচ্ছে, সবাই আমাকেই দোষারোপ করবে, অবিশ্বাস করবে। কেউ আমায় বুঝবে না। আর আমি জানি না, আমি কীভাবে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করবো? আমার কী করা উচিত আমি সেটাও বুঝতে পারছি না।
নিজেকে সামলাল প্রত্যাশা। কথাগুলো বলতে পারল না। সবটা দু’জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাইল। দৃঢ় মনোবল আর বিশ্বাস নিয়ে মনটাকে শক্ত করল। কতটুকু শক্ত হলো জানে না। তবুও মন বলছে—- যেহেতু আমি জানি, আমি সজ্ঞানে কোনো অন্যায়, পাপ করিনি। তাই একদিন না একদিন সত্যিটা সামনে আসবেই। মিথ্যে বিলুপ্ত হবে। সেদিন অবিশ্বাস ভাঙ্গবে। তারপর ক্ষতও হয়তো শুকাবে। তবে শুকালেও ক্ষ’তের ফলে থেকে যায় যে একটা সুক্ষ্ম দাগ। সে দাগটা কী পুরোপুরি মিলানো সম্ভব?
পৃথিবীতে হাজারো কষ্ট-বেদনা, গুমরে ম*রা, ভেতরে ভেতরে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া, আড়ালে কান্নার স্রোত বয়ে ফেলা, এসব কিছুকে আড়াল করার একমাত্র হাতিয়ার—হাসি। হাসির আড়ালে সকল কষ্ট, যাতনা নিমিষেই অন্যদের অগোচরে রাখা যায়। সব কষ্ট ভেতরে ঠেসে প্রত্যাশা ফট করে ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে নিলো। বলল গমগমে স্বরে,
-” কই না তো, কিছু হয়নি তো। আর মন ম’রা লাগবে কেনো, এইতো আমি হাসছি, খাচ্ছি। ঠিকই তো আছে সব।”
নিজ হাত দিয়ে মায়ের হাতটা মুখের সামনে ধরল প্রত্যাশা। চটজলদি খাবার মুখে নিলো। অধরা হঠাৎ বললেন,
-” নীরব আজ ভেতরে এলো না যে? দেখা করেও তো যেতে পারতো।”
-” ইচ্ছে সাথে ছিলো। ইচ্ছেকে দিয়ে উনাকে অফিসে যেতে হবে। তাই নামলেন না।”
-” ওহ্।”
ফের কিছু মনে পড়ার ভঙিতে বললেন অধরা,
-” সেই সকালে এসে থেকে তোকে চুপচাপ দেখছি। বাইরেও বের হচ্ছিস না। আমি ভাবলাম ও বাড়ির কেউ কিছু বলেছে নাকি।”
প্রত্যাশা জোর করে মুখের হাসিহাসি ভাব ধরে রাখল। ব্যথাতুর হৃদয়টা ভেঙে যাচ্ছে নিঃশব্দে। তবুও বলল ভেঙে ভেঙে,
-” ও বাড়ির সবাই কত ভালো না? ওরা কিছু বলবে, আম্মু তোমার মাথা ঠিক আছে! ওনারা সবাই তো আমাকে কত আদর করে।”
অধরা প্রশান্তির সহিত হাসলেন। সায় দিয়ে বললেন,
-” হ্যাঁ নিভানদের ফ্যামেলিটা খুব ভালো। ছেলে ভালো, ফ্যামেলি ভালো, সবকিছু পজেটিভ দেখেই তো নিভানের বাবা বিয়ের প্রস্তাব দিতেই রাজি হয়ে গেলাম। নইলে কী আমার পা’গ’লি মেয়েটাকে এত তাড়াতাড়ি পরের বাড়ি পাঠাতে রাজি হতাম?”
প্রত্যাশার মুখটা নিমিষেই মিইয়ে গেল। আকস্মিক মনে উঠল— নীরব কীসের দয়া দেখিয়েছে?
মনে মনে উত্তর সাজাল। নিজেকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেই আওড়ায় —-আমি কোনো দিক থেকেই উনার যোগ্য নই। শুধুমাত্র বাবার কথায় বিয়েটা করে দয়া দেখিয়েছেন, উনি হয়তো এটাই বলতে চেয়েছেন?
কথাটা প্রত্যাশার বুকের এফোঁড়ওফোঁড় বিঁধে আছে। নিঃশ্বাস ভারি হয়ে এলো।
প্লেট রেখে হাত ধুয়ে মেয়ের রুমে ফের এলেন অধরা। দরজার ওপার থেকেই হাঁক ছেড়ে বলতে বলতে আসলেন,
-” প্রত্যাশা দ্যাখ তো, কোন ডিজাইনটা তোর মনে ধরে।”
প্রত্যাশা বিছানার হেডে গা এলিয়ে বসেছিল। সোজা হয়ে বসে মায়ের দিকে প্রশ্নবোধক চাউনিতে তাকাল। অধরা পাশে বসে ফোনটা ধরলেন মেয়ের সামনে। একটা একটা পিক বের করলেন আর জিজ্ঞেস করলেন—কোন ডিজাইনটা বানাতে দিবেন। প্রত্যাশা নির্বাক। ও কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। অধরা উৎসুক চোখমুখে বললেন,
-” ছবির ডিজাইন দেখে বল। ভেবেছি দুএকদিনের মধ্যেই গহনা বানাতে দিবো। যেগুলো আছে সেসব কেমন পুরোনো ডিজাইন মনেহয়। নতুন করে একসেট না বানালে চলে? আর হাতে বেশি সময়ও নেই। এই তো পরের সপ্তাহ থেকে তোর পরীক্ষা শুরু। দেখতে দেখতে, চোখের পলকে পরীক্ষার দিনগুলো চলে যাবে। তারপরই তো বিয়ের অনুষ্ঠান। তখন তাড়াহুড়োর মধ্যে ভালো হবে না, তাই এক্ষুনি ধীরেসুস্থে সব এগিয়ে রাখছি।”
থেমে ফের বললেন,
-” কালকে নীলা আসবে। ওর সাথে স্বর্ণকারের কাছে যাবো। তুই এখন বল কোনটা পছন্দ হলো?”
ফোনের স্ক্রিনে চোখজোড়া থাকলেও মন আছে শুণ্যতায়। প্রত্যাশার এসব কিছু ভালো লাগছিলো না। যেখানে নীরব নিজে বলেছে, সম্পর্কটা অনিশ্চিত। সেখানে বিয়ের অনুষ্ঠান, গহনা-গাটি সবকিছু প্রত্যাশার কষ্টকে দ্বিগুণ করল। ফাপরে পরার মতো শ্বাস ফেলল। বলল অধৈর্য হয়ে,
-” আম্মু, যেকোন একটা চুজ করো তো। আমার ভালো লাগছে না।”
অধরা কিছুটা হতাশ হলেন। মুখ গোজ করে বললেন,
-” তোর জন্য গড়াচ্ছি, তুই নিজে পছন্দ করবি না?”
যে সম্পর্কের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। সেখানে এসব নিয়ে আদিখ্যেতা করতে ইচ্ছে করল না। নিজেকে সামলে, বলল কোন রকমে,
-” এবারের মতো আমার পছন্দটা তোমার আর আপুর উপর দিয়ে দিলাম। তোমরা একটা পছন্দ করে নিও। তোমাদের পছন্দই আমার পছন্দ।”
অধরা বললেন,
-” আচ্ছা, ঠিক আছে। এইযে দেখালাম, হাজারবার পইপই করে বললাম। পাছে পছন্দ না হলে কিছু বলতে পারবি না কিন্তু।”
এই বলে অধরা উঠে দাঁড়ালেন। চলে যেতে শশব্যস্ত হলেন। তন্মধ্যে প্রত্যাশা শুণ্যে তাকিয়ে আচমকা অন্যমনস্ক হয়ে বলে উঠল,
-” আম্মু, একটা প্রশ্নের উত্তর দিবে? যা বলবে ভেবে সত্যি করে।”
অধরা চিন্তিত বদনে চাইলেন।
-” হুঁ, বলবো। তবে কী কথা?”
-” রাগের সময় যা বলা হয়, সেসবই কী মনের কথা থাকে? মুখ ফস্কে সত্যিটাই কী বেরিয়ে আসে?”
অধরা মেয়ের মুখের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। কিছু বোঝার চেষ্টা করলেন। না বুঝলেও কিছু অনুমান করলেন। পর মূহুর্তে পাশে বসে ধীরে ধীরে শান্ত গলায় বললেন,
-” না মা, সব কথা ধরে নিতে নেই। রাগের সময় মানুষ অনেক কিছু বলে ফেলে; যা তার মনেও ছিল না, এমনকি যার অর্থ কী, সেটাও ভাবে না। তখন মাথা গরম থাকে, হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। নিজের কথার ওজন বুঝে ওঠার মতো অবস্থায় থাকে না সে।”
একটু থেমে আদর করে প্রত্যাশার মাথায় হাত রাখলেন। মৃদু হেসে বললেন,
-” এইযে দেখিসই তো রাগ হলে ঝ’গড়ার সময় তোর আব্বুকে কীভাবে ঝাড়ি।”
থেমে সিরিয়াস ভাবে ফের বললেন,
-” তোর আব্বুকে রেগে অনেক কিছু বলে ফেলেছি জীবনে। কিন্তু তার মানে এই না, আমি সব সত্যি মনে করেই বলেছি। সম্পর্ক থাকলে রাগারাগি, ভুল বোঝাবুঝি হতেই পারে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ভালোবাসা শেষ হয়ে যায়। যা রাগের মাথায় বলা সেসবই সত্যি নয়। রাগের মাথায় বলা কথা ধরলে এই পৃথিবীর ৯০% নারী পুরুষের সংসার টিকতো না। রাগের সময়কার কথা না ধরে, ভালো ভালো বিষয় বড় করে ধরতে হয়। দেখতে হয় সে শুধু রাগই করে, নাকি তার ভালো, যত্ন, আগলে রাখা এসব ব্যাপারও আছে। সব মিলিয়ে একজনকে বাছবিচার করতে হয়। তারপর সিদ্ধান্ত নিতে হয়।”
নিজের জীবনের উদাহরণ টেনে মেয়েকে বুঝালেন অধরা। তবে জিজ্ঞেস করলেন না। মেয়ে বিয়ে দিয়েছে, স্বামী স্ত্রীর মনোমালিন্য হতেই পারে। কোনো সমস্যা হলে দুজনেই মিটমাট করে নিবে। মেয়ে যেহেতু নিজ থেকে কিছু বলছে না, তাই আগ বাড়িয়ে আর কিছু শুধালেন না। মেয়ের বুদ্ধি বাড়ুক, বুঝ আসুক, সুখে-শান্তিতে থাকুক — মনেমনে শুধু এই প্রার্থনাটুকুই করলেন।
প্রত্যাশার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে উঠল—-নীরবের কেয়ারগুলো। বিয়ের পর থেকে নীরবের এক্টিভিস্ট গুলো আওড়ালো। সেখানে সেই শুরু থেকে নীরবকে ওর প্রতি যথেষ্ট কনসার্ন কেয়ারিং পেয়েছে। সেদিন সবার সামনে নিজেকে খাটো করেছে, কথা শুনেছে। তবুও প্রত্যাশাকে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে দেয়নি।
প্রত্যাশার নিজের এক্টিভিস্টের খাতায় নিজেকে শুণ্যে পেলো। এখন অবধি নীরবের প্রতি কোনো দায়িত্ব পালন করেছে কী? আর পাঁচটা মেয়ের মতো স্ত্রী সুলভ আচরণটুকু কখনো শো করেছে কী? হয়তো ওভাবে সুযোগ আসেনি। তবে উনি যে সার্থককে পছন্দ করেন না তা বোঝানো হয়েছে, বলাও হয়েছে। তবুও প্রত্যাশা বোঝার চেষ্টাটুকু করা দূর আরো যেনো হেসে উড়ে দিয়েছিলো। ইশশ্! নীরবের সেই কথাটা শুনলেই তো আজ এতদূর আসে না। হয়তো এই সমস্যাটুকু আসতো না জীবনে।
রাত গভীর। বাড়ির সবাই ঘুমের অতলে তলিয়ে আছে। ঘুম নেই নীরবের চোখের পাতায়। হাতে কফির মগ। এইতো মাত্র সে নিজে বানিয়ে আনল। কফির মগে চুমুক দিচ্ছে আর ভাবছে। সিম সার্থকের এনআইডি দিয়ে খোলা। সিম বন্ধ থাকার জন্য সিমের মালিকের অবস্থান ট্্যাক করা যায়নি। তবে সিমটা সার্থকের নামে রেজিষ্ট্রেশন করা থাকায় সমীকরণ দাঁড়াচ্ছে—- সার্থক নিজেই কী তবে নীরবকে খাটো করতে, নীরব-প্রত্যাশার সম্পর্কে ফাটল ধরাতে ছবিগুলো পাঠিয়েছে?
যেহেতু সার্থক প্রত্যাশাকে পছন্দ করতো। তাই সবকিছুর নীল নকশাকারী স্বয়ং সার্থক হবে এটা অস্বাভাবিক নয়। এখন কুয়াকাটায় সেদিন কী ঘটেছিল? কীভাবে ঘটেছিলো? ঘটানো হয়েছিলো? সব উত্তর জানতে কুয়াকাটা যাওয়া জরুরী। অতবড় নামকরা বিলাসবহুল হোটেলের কোণায় কোণায় নিশ্চয় সিসিটিভি ক্যামেরা আছে। সেসব চেক করে যদি কিছু পাওয়া যায়।
এদিকে অফিশিয়াল ডিউটি থাকায়। সামনের দু-তিন নীরব খুব ব্যস্ত থাকবে। তাই দু-তিনের মধ্যে কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়। আবার এমন একটা ব্যাপার অন্যের উপর দায়িত্বও দেওয়া যায় না। নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপারটা নীরব নিজেই দেখবে। হোক একটু দেরি।
মাথার মধ্যে ভনভন করছে দুশ্চিন্তা। নীরবের নিজেকে এলোমেলো লাগছে। ভালো লাগছে না কোনো কিছুই। কোনো কিছুতেই এক দন্ড শান্তি মিলছে না। কিছু একটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। উফ্! প্রত্যাশার ক্রন্দনরত মুখটা চোখের সামনে ভাসছে বারবার।
ঠান্ডা, তেতো, স্বাদহীন শেষ কফিটুকু এক চুমুকে গিলে নেয় নীরব। চারিপাশের নিস্তব্ধতা গুমোট হয়ে মাথার ভেতর শব্দ তুলছে। আকস্মিক ভাবল প্রত্যাশার রেখে যাওয়া প্রশ্ন নিয়ে —–
-” উচ্ছৃঙ্খল, বেপরোয়া মেয়ের সংজ্ঞা কী?”
চোখ বন্ধ করে ভাবল। প্রত্যাশার মুখ ভেসে উঠল—
না, ওকে একেবারেই সেরকম বলা যায় না। ও চঞ্চল, আবেগপ্রবণ। বয়স অনুযায়ী একটু বেশিই ইম্যাচিউর বটে, কিন্তু উচ্ছৃঙ্খল, বেপরোয়া বলা যায় না। বুঝিয়ে বললে ও শোনে। তবে নিজের প্রতিই ও সচেতন নয়। প্রত্যাশা খুব সরল। সরলভাবে দুনিয়া দেখে। আর দেখে বলেই সবসময় বিপদের মধ্যে হেঁটে যায়। বারবার বিপদে জড়িয়ে পড়ে।
প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে ভাবে নীরব— ওর বয়স অল্প, কিন্তু অভিজ্ঞতার ঘাটতি যেমন অনেক। দুঃখের বিষয় ও কিছুতেই শিক্ষা নেয় না। নিজেই নিজেকে বিপদে ফেলতে উস্তাদ।
নীরব ক্লান্ত ভঙিতে চোখদুটো বুঁজে নিল। চেয়ারের হেডে কাঁধ এলিয়ে মনেমনে বলে ওঠে,
-” যদি সত্যিই ও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়, তবু এক ফোঁটা দোষ হলেও ওর আছেই। আমি ওকে কতবার বলেছি, সাবধান হতে। বুঝিয়েছি ইভেন বলেছি সার্থকের থেকে দূরে থাকতে। আজ আমার এই কথাটা অন্তত শুনলে, আজ এতবড় অঘটন ঘটে না।”
এই কথাটা মনে উঠলেই নীরবের প্রচন্ড রাগ হয়। তখন পজিটিভ চিন্তাগুলোও কেমন দূর্বল হয়ে আসে। ভেতর থেকে রাগ-ক্ষোভ হতাশা আবার বেরিয়ে এল,
-” একটা মেয়ের বেসিক কিছু কমন সেন্স থাকে, যা প্রত্যাশার নেই। একটা ছেলের চোখের ভাষা মেয়েরা খুব সহজেই পড়তে পারে। এটা বোঝার একধরনের সহজাত প্রবৃত্তি থাকে মেয়েদের। এদিকে প্রত্যাশা মাত্রারিক্ত নির্বোধের পরিচয় দিয়ে থাকে। ওর নিজের প্রতি কোনো রকম সতর্কতা নেই। কোনো প্রটেকশন নেই। বরং প্রত্যাশা এমন পরিবেশ তৈরি করে ফেলে, যেখানে অপরপক্ষ আরও এগিয়ে আসার সুযোগ পায়। একটু নিজের প্রতি দায়িত্ববোধ থাকলেও আজ এই পরিস্থিতি আসত না।”
সকাল থেকেই আষাঢ়ের আকাশ ভারী মেঘে ঢাকা। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হলো। বায়োলজির প্র্যাকটিক্যাল খাতায় স্বাক্ষর নিতে প্রত্যাশা কলেজে এসেছিলো। পরনে আকাশি-সাদা ইউনিফর্ম, পিঠে ব্যাগ, মাথার ওপর ব্যান্ড দিয়ে চুলগুলো ঝুঁটি করে বাঁধা। এক হাতে ছাতা ধরে ফুটপাত ধরে হাঁটছিল।
হঠাৎ ওর চোখ পড়ল— দেয়াল ঘেঁষে বসে থাকা এক পা’গ’লী মা তার কোলের ছোট্ট শিশুকে ছেঁড়া, ময়লা ওড়নার নিচে লুকিয়ে রাখছে। বৃষ্টির পানিতে যেন ভিজে না যায়। দৃশ্যটা হৃদয় ছুঁয়ে গেল। প্রত্যাশার মনে হালকা কষ্টের স্রোত বয়ে গেল। অস্ফুটে ‘আহারে’ বলে ছাতাটা পা’গ’লীর মাথার ওপর ধরে বলল,
-” এটা তুমি রাখো। একটু হলেও কাজে লাগবে।”
পাগ’লীটি কিছু বলতে পারল না, তবে তার চোখেমুখে ছড়িয়ে পড়ল একরাশ প্রশান্তি ও কৃতজ্ঞতার হাসি। একটু দূরের একটি টং দোকান থেকে প্রত্যাশা পাউরুটি আর কলা কিনে এনে দিয়ে ব্যস্ত হয়ে ফের হাঁটতে শুরু করল।
আজ দু-তিন হতে চলেছে না নীরব ফোন দিয়েছে আর না তো প্রত্যাশা। এরমধ্যে দুজনের দেখা, কথা কিছুই হয়নি। সবার সামনে স্বাভাবিক আচরণ করলেও ভেতরে ভেতরে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। নাম না জানা ব্যথায় হৃদয় দগ্ধ হচ্ছে।
বিষণ্ণ চিত্তে হাঁটছে প্রত্যাশা। রিকশার দেখা মিলছে না। বৃষ্টির শব্দ ততক্ষণে তীব্র হয়েছে; গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির জায়গায় এখন ঝমঝমিয়ে ঝরছে। ভিজে যাচ্ছিল প্রত্যাশা, অবশেষে এক চায়ের দোকানের ছাউনির নিচে দাঁড়াল।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বিরক্তিতে ‘চ’ শব্দ করে উঠল। হঠাৎ চোখ পড়ল সাদা জুতোর দিকে, এক পায়ের ফিতেটা খুলে গেছে। হাঁটু মুড়ে বসে ফিতা বাঁধতে লাগলো প্রত্যাশা। এমন সময় রাস্তার পাশে জমে থাকা কাঁদা পানির উপর দিয়ে ছুটে এলো একটি বাইক। ছিটকে উঠে কাদা পানি প্রত্যাশার পোশাকে আর মুখে লাগে।
প্রত্যাশা রাগি দৃষ্টিতে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। বাইকে তিনজন হ্যাংলা-পাতলা ছেলে। বাইকটা সামনে গিয়ে থামল। তারা হুড়মুড় করে ছাউনির তলায় ঢুকে পড়ল। প্রত্যাশা রাগে গজগজ করলেও মুখে কিছু বলল না।
ছেলে তিনটেকে দেখতেই বখাটে লাগছে, একজনকে অবশ্য চেনে প্রত্যাশা। ওদের সাথেই পড়ে, তবে নামকা ওয়াস্তে পড়ে। বখাটেপনাই করে বেড়ায়। ছেলেগুলো ঠোঁটে সিগারেট ধরিয়ে প্রত্যাশাকে স্ক্যান করতে থাকে। মূহুর্তেই সিগারেটের ধোঁয়ায় চারিপাশ ছেয়ে যেতে থাকল। সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে একজন হেরে গলায় গান ধরল, আরেকজন সিটি বাজাতে লাগালো। প্রত্যাশা খুকখুক করে কাশল। ওর অস্বস্তি হচ্ছে।
নীরবকে সিভিল ড্রেসে পাঠানো হয়েছে একজন ব্যবসায়ীর সাথে দেখা করতে, যে কিনা গোপনে মা’দক পা’চারের সাথে জড়িত বলে গোয়েন্দা সূত্রে সন্দেহ করা হয়েছে। পু’লিশ সরাসরি গ্রেপ্তার না করে আগে প্রমাণ সংগ্রহ করতে চায়। নীরব ক্লায়েন্ট সেজে সেই ব্যক্তির সাথে কফিশপে কফি খেতে খেতে কথার ছলে সন্দেহভাজনের থেকে তথ্য জোগাড় করছে।
বিদায় নিয়ে কফিশপের থেকে বের হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল নীরব। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। কালো প্যান্টের উপর কালো শার্ট ছেড়ে দিয়ে পড়া। চোখে কালো সানগ্লাস। কানে এয়ারপড। হাতঘড়িতে সময় দেখে কানের এয়ারপডটা নাড়ল। ফিসফিসিয়ে কিছু বলল। শেষে বলল,
-” তিনটার দিকে*** এলাকায় পুলিশ ফোর্স পাঠিয়ে দিতে হবে। সব রেডি রাখতে হবে।”
-” ওকে স্যার।”
এরমধ্যে আচমকা নীরবের দৃষ্টিজোড়া খানিকটা দূরে পড়ল। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল।
প্রত্যাশা একপাশে সিটিয়ে দাঁড়িয়ে। একজন হঠাৎ বলে উঠল,
-” কি আপু, বৃষ্টি ভালো লাগে? না কি ছায়া বেশি পছন্দ? নাকি ঝলমলে রোদ?”
আরেকজন ধোঁয়া ছেড়ে বলল,
-” আপু কিছু বলছেন না যে, কী খাবেন বলুন? এক্ষুনি অর্ডার করছি।”
তৃতীয়জন বলল,
-” ঠান্ডার দিনে হট-হট কিছু দে রে। আপুও হট হোক আমরাও…..”
প্রত্যাশার মুখ লাল হয়ে যায় রাগে। গর্জে ওঠে,
-” ভদ্র ভাষায় কথা বলুন।”
মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ২৮
ছেলেগুলো অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। একজন আরেকজনের কাঁধে হাত রেখে বলল,
-” ওরে ম্যাডাম রেগে গেছে দ্যাখ! আহারে।”
প্রত্যাশার ভীষণ খারাপ লাগলো। মনে হচ্ছে ভাগ্যই খারাপ। সবসময় সমস্যা ওর কাছে আসে না, ওই যেনো সমস্যার কাছে এগিয়ে আসে। কান্না পেল প্রত্যাশার এখানে এক মূহুর্তও দাঁড়াতে ইচ্ছে হলো না। বৃষ্টির মাঝে রাস্তায় নেমে পড়ল। লম্বা কদম ফেলে এগিয়ে যেতে নিয়ে হঠাৎ হাতে টান পড়ল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে…