মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৩০

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৩০
মুসতারিন মুসাররাত

ঘাড় ঘুরিয়ে নীরবকে দেখে এক সেকেন্ডের মধ্যে বিস্ময়ে জমে গেল প্রত্যাশা। অবিশ্বাস্য চোখে একবার হাতের বাঁধনের দিকে চাইল, পরপর মুখ তুলে নীরবের মুখের দিকে। কোনো কিছু ঠাহর করার আগেই নীরব এক ঝটকায় টান দিয়ে প্রত্যাশাকে ছাউনীর তলায় নেয়। নীরবের গায়ের কালো শার্ট ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। ভেজা চুল থেকে টুপটাপ পানি ঝরছে। নীরব প্রত্যাশার হাত ছেড়ে চুল ঝাড়তে লাগল।
রিমঝিম বৃষ্টির শব্দ চারদিক ঢেকে রেখেছে ঠিকই, কিন্তু ছেলেগুলোর ভেতরকার শয়’তানি যেন মেঘের গর্জনের মতো গুঁড়গুঁড় করে উঠছে। একজন চোখমুখ কুঁচকে হেসে বলল,

-” এইযে ম্যাডাম একটু আগেই না খুব ভাব দেখালেন। আরে আমরা তো কেবল মুখ দিয়ে একটু ইয়ার্কি করেছিলাম মাত্র, এখন যে আরেকজন সোজা হাত ধরল। তাও কিছুই বললেন না। তখন যে খুব ভালো সেজে চেতে উঠলেন।”
সাথে সাথে প্রত্যাশাদের সাথে পড়া ছেলেটা বলে উঠল,
-” আরে মনেহয় ছোঁয়াতে সুখ পেয়েছে। আর এ বলবে কী! যে কী না কলেজ থেকে ট্যুরে গিয়ে হারিয়ে যায়। নাগরের সাথে সারাদিন কাটিয়ে…..”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

প্রত্যাশা অস্বস্তি, অপমানে জড়সড় হয়ে দৃষ্টি নুইয়ে নিল। এরমধ্যে ঠাস, ঠাস শব্দে চারিপাশ কেঁপে উঠল। নীরব দুটোর গালেই সজোরে চ’ড় বসায়। চ’ড় খেয়ে কথা হারিয়ে ছেলেটি ধড়ফড় করে একপাশে কাত হয়ে পরে। আরেকজন গালে হাত দিয়ে রা’গি দৃষ্টিতে তাকায়। সামনাসামনি বুক চওড়া করে নীরব দাঁড়াল। চোখদুটো রাগে লাল টকটক করছে, চোয়াল কঠিন করে বলল,
-” আরেকটা শব্দ বলবি তো দাঁত ভেঙে ফেলবো। মেয়ে দেখলেই তোদের মাথা খারাপ হয়ে যায়, না? অ’শ্লী’ল বলার জন্য জিভ লকলক করে? জিভ টেনে ছিঁড়ে মেয়েদের টিজ করার সাধ মিটিয়ে দিবো।”
তৃতীয়জন বুক টানটান করে এগিয়ে এসে বলল,
-” এই আপনে সাহস পান কই থেকে? আমার বন্ধুদের চ’ড় মারেন। কথা নাই বার্তা নাই গায়ে হাত তুলেন। আবার শাসাচ্ছেন, হিরোগিরি দেখাচ্ছেন?”

কফিশপের সামনে থেকে প্রত্যাশাকে লক্ষ্য করে নীরব। ছেলেগুলো যে টিজ করছিলো বোঝাই যাচ্ছিলো। দ্রুত আসে, এদিকে প্রত্যাশা কোনোদিকে না তাকিয়ে বৃষ্টির মধ্যেই চলে যেতে নেয়।
ছেলেটা সাহস দেখিয়ে তেড়ে আসতে নিতেই নীরব নাক বরাবর দিল এক ঘু’ষি। মূহুর্তেই গলগল করে র”ক্ত বেরোল। ছেলেটি একহাতে নাক চেপে ধরল। চোখ থেকে কালো সানগ্লাস খুলে শার্টের সাথে গুজল নীরব। তারপর কলার চেপে ধরে বলল,

-” ওকে নিয়ে মজা নিচ্ছিলি, না? টিজ করছিলি। এখন এই মুহূর্তে ওর পা ধরে ক্ষমা চাইবি। স্টুডেন্ট মানুষ তাই দয়া করে জেলে পুরলাম না। এবারের মতো দয়া করলাম।”
এই বলে কলার ধরেই প্রত্যাশার পায়ের কাছে ফেলল। প্রত্যাশা তো চমকে উঠে দু’পা পিছাল। নীরব বাকি দুটোর দিকে তাকিয়ে আঙুল নাচিয়ে ইশারা করে, ছুঁড়ে ছুঁড়ে বলল,
-” তোরা দু’টো দাঁড়িয়ে কেনো? বে’য়াদবির জন্য পা ধরে মাফ চা। বাঁচতে হলে যা বলছি ফাস্ট তাই কর।‌ কুইক।”
দু’জনের একজন শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে এক পা এগিয়ে কণ্ঠে তেজ নিয়ে বলল,
-” কোন হে চ্যাটের বা’ল তুমি? তোমার কথা শুনতে হবে। তিনজন মিলে ধরলে না পালানোরও সুযোগ পাবে না।”
নীরব শান্ত ভঙিতে পকেট থেকে ওয়ালেট বের করল। পরপর আইডি কার্ড বের করে সামনে ধরতেই ওদের গলা শুকিয়ে আসে। চৌদ্দ শিকে যাওয়ার ভয়ে প্যান্ট ভিজে যাওয়ার জোগাড় হলো। নীরব ধ’ম’কিয়ে উঠল,

-” সে স্যরি… ফাস্ট, বিফোর আই লুজ মাই পেইশেন্স।”
ধ’ম’কে কেঁপে ওঠে ওরা তিনজন হাঁটু মুড়ে প্রত্যাশার সামনে বসল।‌ মাথা নুইয়ে বলল,
-” স্যরি আপু, ভুল হয়েছে।”
নীরব কাটকাট গলায় বলল,
-” এভাবে নয় পা ধরে।”
নীরবের কথায় প্রত্যাশা স্তম্ভিত। ও ইতস্তত করছে। ছেলেগুলো নিরুপায়। পুলিশ ধরলে রক্ষে নেই, পুলিশের বারির কথা স্মরণ হতেই আত্মা শুকিয়ে এলো। সময় ন’ষ্ট না করে তিনটেই একসাথে হাত বাড়িয়ে প্রত্যাশার পা ধরতে গেলে প্রত্যাশা চট করে পিছিয়ে যায়। বলল তড়িঘড়ি করে,
-” এই থাক থাক পা ছুঁতে হবে না।”
নীরব এক হাত পকেটে গুঁজল। অন্যহাতে চুল ব্যাক ব্রাশ করতে করতে বলল,

-” উঁহু! এভাবে কোমল স্বরে আপু বলে স্যরি বললে চলবে না। মুখটা সর্বোচ্চ অসহায় বানিয়ে বল– আম্মা ভুল করেছি, মাফ করে দিন।”
প্রত্যাশার চোখ ছানাবড়া। নীরব নির্লিপ্ত। প্রত্যাশা একবার নীরবের দিকে তাকিয়ে ফের ছেলেগুলোর দিকে তাকাল। ওরা অসহায় মুখ বানিয়ে কাঁদো কাঁদো সুরে আপু থেকে আম্মাতেই আসলো,
-” আম্মা, মাফ করে দ্যান। ভুল হয়েছে আমাদের। দয়াকরে তাড়াতাড়ি মাফটা দিয়ে দিন।”
প্রত্যাশা হাত নেড়ে বলল,
-” হয়েছে হয়েছে, আর মাফ-টাফ চাইতে হবে না। করেছি মাফ।”
তিনটেই ঘাড় তুলে শুকনো ঢোক গিলে নীরবের দিকে তাকাল। একদম মিহি স্বরে ভ’য়ে ভ’য়েই বলল,

-” স্যার এবার যাই।”
-” যা। তবে আজকের কথা যেনো মনে থাকে। নেক্সট কখনো কোনো মেয়েকে অসম্মান করতে দেখলে সোজা লকাআপে ভরব। আর হ্যাঁ, আজকের থেকে শিক্ষা নিবি।”
ছেলেগুলো মাথা কাত করে সায় দিয়ে দ্রুত ওঠে দাঁড়ায়। তারপর তুরন্ত তিনজন বাইকে চেপে মূহুর্তেই প্রস্থান করে।
প্রত্যাশা রাস্তা বরাবর তাকিয়ে ছিলো, এরমধ্যে নীরব টিস্যু পেপার প্রত্যাশার সামনে ধরে। প্রত্যাশা প্রশ্নাত্মক চাউনিতে তাকায়। নীরব বলল শান্ত কণ্ঠে,
-” মুখটা মুছে নাও।”

মুখের ডানপাশে তখনকার কাঁদা পানি শুকিয়ে দাগ হয়ে আছে। প্রত্যাশা মুখ ফুটে কিছুই বলতে পারল না। নিঃশব্দে টিস্যুটা নিলো। প্রত্যাশার অবচেতন মনটা বলে উঠল— আসলেই উনাকে বোঝা আমার পক্ষে দুঃসাধ্য। আমার দেওয়া ওনাকে মিস্টার আনপ্রেডিক্টেবল নামটা যথার্থ।
নীরব ত্রস্ত কল লিস্ট থেকে কল লাগাল। রিসিভ হতেই ব্যস্ত স্বরে বলল,
-” তানভীর তুমি কোথায়?”
-” স্যার, আমি তিন রাস্তার মোড়েই আছি।”
-” আচ্ছা, তুমি যেহেতু ওখানে আছোই। আমার একটা হেল্প লাগবে। যত দ্রুত সম্ভব একটা অটো বা সিএনজি***** পাঠিয়ে দাও।”
-” ওকে স্যার।”
-” থ্যাংকস।”

কোনো এক অদৃশ্য জড়তায় প্রত্যাশা কিছুই বলতে পারল না। নীরবও কিছুই না বলে ফোন স্ক্রল করতে লাগলো। প্রত্যাশার তীব্র মন খারাপ হলো। হঠাৎ মনে প্রশ্ন জাগলো— এখানে আমি ছাড়া অন্য মেয়ে থাকলেও কী উনি একই রকম আচরণ শো করতেন? পাশে দাঁড়াতেন? নাকি আমি ওনার বউ বলে ওই ছেলেগুলোকে শা”স্তি দিলো! যদি এটাই হবে উনি কিছুই বলছেন না যে।
অভিমানী মন ভাবল — এখনো হয়তো ঘৃ’ণা করেন আমায়। তাই তো কিছুই বলছেন না।
এরমধ্যে একটা সিএনজি আসল। নীরব প্রত্যাশাকে ইশারা করে বলল,
-” যাও, ওঠো।”

তারপর ভাড়া মিটিয়ে দিলো নীরব। প্রত্যাশা সিএনজিতে উঠে বসল। নীরব ড্রাইভারকে আদেশ স্বরুপ বলে পরপর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে— ঠিকঠাক যেনো পৌঁছে দেয়। কোনো সমস্যা হলে খবর আছে। নীরব এপাশে সরে প্রত্যাশার দিকে একপল তাকাল। কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। তন্মধ্যে ভারী স্বরে হঠাৎ বলে উঠল প্রত্যাশা,
-” ঘৃ’ণাই যখন করেন, তখন এত ভালোবাসা দেখানোর কি দরকার ছিলো? এ__”
প্রত্যাশার কথার মাঝেই নীরব বলল,
-” ভালোবাসা দেখাইনি তো, এটা আমার দায়িত্ব ছিলো।
-” বাকিটা জীবন আমি কী শুধুই আপনার দায়িত্ব হয়ে রয়ে যাবো?”

-” যেদিন এই সম্পর্কটা থাকবে না, সেদিন আমার দায়িত্বটুকুও থাকবে না।”
প্রত্যাশার বুক কেঁপে উঠল। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে গেল।এরমধ্যে সিএনজি চলতে শুরু করে।
নীরব ফোন বের করে অনলাইনে টিকিট কাটল। আজ রাত বারোটার গাড়িতে কুয়াকাটা যাবে সে। যদি কোনো ক্লু পাওয়া যায়। তারপর সূত্র ধরে সবটা প্রুভ করা। ঠান্ডা মাথায় ভেবে নীরব একটা কথায় স্থির হয়— প্রত্যাশা সহজ-সরল, বোকাসোকা। তাই ওকে দিয়ে যে কেউ অনায়াসেই নিজের স্বার্থ হাসিল করে নিতে পারে।
নীরব এ-ও মনেমনে ভাবে—- প্রত্যাশার একটু শিক্ষা হওয়া দরকার। ওর সাথে এখনই মিশে গেলে, ও সব ভুলে যাবে। আদর পেলে মানুষ পূর্বের খুঁটিনাটি সব ভুলে যায়, কিন্তু অবহেলা শেখায় কোথায় ভুল হচ্ছিল, কারনটা কী ছিলো! ঠিক যেমন ঘা না লাগলে কেউ শরীরের দুর্বল জায়গাটুকু টের পায় না।

আষাঢ়িয়া বারিতে গাছগাছালি সিক্ত। গাছের সবুজ পাতা বেয়ে বৃষ্টির ফোঁটা টুপটাপ করে পড়ছে। নীলা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে, এক হাতে গ্রিল খুটছে আর অন্য হাতে ফোন ধরে কথা বলছে। নীলার মন ভার। ওপাশ থেকে নিভান বলল,
-” নীলাশা তুমি এত আপসেট কেনো হচ্ছো? এক্ষুনি টেনশনের কিছু হয়নি। আমাদের সামনে আরো দীর্ঘ সময় পরে আছে।”
-” ধূর, এবারে আশা করেছিলাম কিছু একটা হবে। তেমন কিছুই হলো না। এ মাসেও হতাশ হলাম।”
-” ব্যাপার না সামনে হবে।”
-” শোনো, আমি ভেবেছি আজকে আমরা ডক্টরের কাছে যাবো। চেকাপ করাবো।”
-” নীলা আরেকটু দেখি?”
নীলা তেতে ওঠে বলল,

-” না, না, নাহ। আমি আর দেখতে-টেকতে পারব না। তুমি তো দুপুরে আসছোই। সন্ধ্যায় আমাকে নিয়ে ডক্টরের কাছে যাবে। ব্যস!”
নিভান শান্ত গলায় বুঝিয়ে বলল,

-” নীলা শোনো, আমি আমার এক ডক্টর ফ্রেন্ডের সাথে আলোচনা করেছিলাম, সে গাইনোকোলজিস্ট। ওর কথায় যা বুঝলাম, অনেকে কোনো ফ্যামিলি প্ল্যানিং ছাড়াই প্রথম দিকেই কনসিভ করে। আবার অনেকের ছয়-আট মাস বা তারও বেশি সময় লেগে যায়। এটা নরমাল রেঞ্জের মধ্যেই পড়ে। এমনকি মেডিকেলি ধরা হয়; নিয়মিত ইন্টিমেন্ট এবং কনট্রাসেপশন ছাড়াই এক বছরের মধ্যে যদি গর্ভধারণ না হয়, তখন সেটা ইনফার্টিলিটি হিসেবে ভাবা যায়। আমাদের তো বিয়ে হয়েছে সাত মাসও হয়নি। তাই এই মুহূর্তে চিন্তা করার বা আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। আরেকটা মাস দেখে নিই। তারপর যদি না হয়, তাহলে অবশ্যই আমরা পরবর্তী ধাপে যাবো। কেমন?”

বান্ধবী তারপর ভাবি-টাবিদের থেকে শুনেছে নীলা বরেরাই বাচ্চা বাচ্চা করে পা’গল বানিয়ে দেয়। নীলা অধৈর্য হয়ে ভাবল — নিভান এর কোনো হেলদোল, আগ্রহ নেই। আর অধৈর্য হলো বলেই ঝারি মে’রে বলল,
-” কেমন গো তুমি, তোমার কোনো শখ আহ্লাদ নেই। তোমার ছোট এক ভাইয়ের পাঁচ বছর বয়সী এক মেয়ে। নীরব প্রত্যাশার কখন জানি খবর আসে; বাচ্চা হবে। এদিকে তুমি বড় হয়ে আঁটকুড়ে হয়ে থাকো। প্রত্যাশা মা হোক আমি হাঁ করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি।”
নিভান খুকখুক করে কেশে উঠল।‌ সামলে বলল,

-” নীলা তুমি কীসব বাচ্চামো কথাবার্তা বলছো! আশ্চর্য! কনসিভ করা নিয়েও তুমি মনেমনে প্রত্যাশার সাথে কম্পিটিশনে নেমেছো।”
নীলা কাটকাট গলায় বলল,
-” আমি অতশত জানি না। তুমি আসছো, আর আজই আমরা ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি। দ্যাটস ফাইনাল।”
নিভান হাসল। হেসে বলল,
-” ওকে ওকে জান। তবে আমার কী মনেহয় জানো?”
-” কী?”
নিভান ফাজলামির সুরে বলল,

-” ডক্টরের উচিত প্রেসক্রিপশনে মোটা দাগে লিখে দেওয়া —- আপনার বরকে বেশি বেশি আদর করার সুযোগ দিন। যখন আবদার করবে, না করা চলবে না। তাহলেই অতিসত্বর আপনি মা হতে পারবেন….”
নীলার গাল লজ্জায় লাল হলো। লজ্জা আড়াল করতে রাগ দেখিয়ে বলল,
-” নিভান, আজেবাজে কথা বাদ দিয়ে তাড়াতাড়ি কাজ সেরে আসো।”
-” নিশ্চয় জান। তুমি কিন্তু রেডি থেকো।”
-” ফা’জি’ল একটা।”
নিভানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই নীলা কল কা’ট’ল।

লাঞ্চ আওয়ারে শফিক সাহেব বাড়ি এসেছেন। অটো থেকে নেমে বাসায় ঢুকতে গিয়ে হালকা ভিজে গিয়েছেন। অধরা তোয়ালে এনে দিলেন। শফিক সাহেব তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করলেন,
-” প্রত্যাশা কী করে?”
নীলা টিভি দেখছিলো। বিড়বিড় করল— এসেই ওর কথা জিজ্ঞেস করা লাগে। যত্তসব, আদিখ্যেতা। আব্বু-আম্মুকে দেখে মনেহয় আমিই কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে। আর প্রত্যাশাই ওদের আপন পেটে ধরা মেয়ে।
অধরা ঘড়ির দিকে একবার তাকালেন তারপর দরজার দিকে। কিছুটা উদ্বেগ প্রকাশ করে বললেন,
-” প্রত্যাশা কলেজে গিয়েছে। এখনো ফিরল না। এত বৃষ্টি হচ্ছে, মেয়েটা কোথাও আটকে আছে না তো। একবার ফোন দিয়ে দেখো তো কোথায় আছে?”
শফিক সাহেব পকেট থেকে ফোন বের করলেন। চুলোয় তরকারি থাকায় অধরা ত্রস্ত কিচেনে গেলেন। কল দিবেন এমন সময় নীলা বলে উঠল,

-” ওইযে এসেছে।”
দরজাটা খোলা ছিলো। প্রত্যাশা বিবর্ণ মুখটা নিয়ে এগিয়ে আসছে। কপালের উপর থাকা ছোট ছোট চুলের ডগা বেয়ে টপটপ পানি পড়ছে। শফিক সাহেব মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-” প্রত্যাশা মা ভিজে গেছো দেখছি। যে বৃষ্টি হচ্ছে আসতে কোনো সমস্যা হয়নি? রিকশা পেয়েছিলে? বৃষ্টির দিনে রিকশা, অটোদের তো আবার হাইপ বেড়ে যায়। খালি বসে থাকবে, ভাড়া তো দ্বিগুণ বলবেই তারপরও তোষামোদ করতে হয়।”
প্রত্যাশা শুকনো হেসে বলল,

-” না আব্বু সমস্যা হয়নি।”
-” জলদি মাথা মুছে নাও। নইলে আবার জ্বর সর্দি হবে। সামনে পরীক্ষা এখন জ্বর-টর হলে বিপদ।”
তোয়ালে বাড়ালেন মেয়ের দিকে। প্রত্যাশা পিঠ থেকে ব্যাগ নামিয়ে সোফায় রাখল। তোয়ালে নিয়ে মাথা মুছতে লাগলো। শফিক সাহেব আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
-” প্রত্যাশা পরীক্ষার প্রিপারেশন কেমন? আজ ক’দিন তো সবসময় বই নিয়েই বসে থাকতে দেখি। তা এবারে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাবে তো।”

প্রত্যাশা উত্তর দিলো না। বাবার গা ঘেঁষে বসল। হঠাৎ বলে উঠল,
-” আমি জানি এই পরীক্ষার রেজাল্ট খুব ভালো হবে না। কারন আমি আগে কখনোই সিরিয়াস হইনি। তবে আব্বু আমি কথা দিচ্ছি এরপর থেকে পড়াশুনায় মনোযোগ দিবো, খুব খুব সিরিয়াস হবো। আমি পাবলিকে চান্স পাবো না, আমার সে মেধা নেই। আব্বু তুমি কী আমাকে প্রাইভেটে ভর্তি করাবে? আমি দূরে ভালো কোথাও ভর্তি হতে চাই। সেখানে আমার সম্পূর্ণ মনোযোগ দিবো, চেষ্টা করব। চেষ্টা করলে নাকি মানুষ সব পারে। আমি সেই চেষ্টাটুকু করতে চাই। কিন্তু প্রাইভেটে তো খরচ বেশি।”

নীলা শব্দ করে হেসে উঠল। বলল খোঁচা মে”রে,
-” এ আমি কী দেখছি। মনে হচ্ছে ভূতের মুখে রাম রাম শুনছি। ইয়া আল্লাহ! পড়াশোনায় সিরিয়াস হবি তুই? যেখানে আম্মু ছোট থেকে পিটিয়েও পারেনি। যেটুকু পড়েছিস ফেল ঠ্যাকাতে, ক্লাস বাই ক্লাস উঠতে। সে নাকি এখন শেষকালে এসে সিরিয়াস হবে। হাউ ফানি!”
শফিক সাহেব বির’ক্ত মুখে বললেন,

-” আহ্ নীলা মা হাসার কী হলো! আর ছোটবোনকে কোথায় আরো উৎসাহ দিবে, তা না হাসিঠাট্টা করছো।”
নীলা হাতের রিমোট দিয়ে টিভি বন্ধ করল। ঘুরে বসে সিরিয়াস গলায় বলল,
-” শোনো আব্বু আমার কথা মিলিয়ে নিয়ো। প্রত্যাশাকে প্রাইভেটে ভর্তি করে শুধু শুধু টাকা নষ্ট করা ছাড়া কিছুই হবে না। ও পড়বে, সেই পড়া দিয়ে কিছু করবে? ওকে অক্সফোর্ডে ভর্তি করলেও লাভ হবে না। কথায় আছে না যে লাউ সেই কদু। প্রত্যাশাটা আজীবন অমনই থাকবে।”

প্রত্যাশার চোখ ভিজে এলো। অধরা খুন্তি হাতে রান্নাঘরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে জোরেশোরে বললেন,
-” এসএসিতে গোল্ডেন, ইন্টারে প্লাস, অনার্স – মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে তুই মনেহয় খুব কিছু করে ফেলেছিস। প্রথমবার বিসিএস দিতে গিয়েই প্রিলিমিনারি থেকেই আউট হলি। এখন তো সেসবের চেষ্টাও বাদ দিয়ে সংসার করবি বললি। সেই সংসারটাও কতটুকু মন দিয়ে, সবার সাথে মিলেমিশে, সবার মন জয় করে করছিস শুনি?”
নীলার মুখটা ভোঁতা হলো। অধরা প্রসঙ্গ বদলিয়ে শফিক সাহেবকে বললেন,
-” শুনছো, বিরিয়ানির মসলা দেখছি নেই। একটু এনে দিবে তাড়াতাড়ি।”
শফিক সাহেব উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন,

-” নীলা মা ছাতাটা এনে দাও তো।”
নীলা মুখ কালো করে বলল,
-” প্রত্যাশার কাছেই তো ছাতা আছে। এখন ওরটা নিয়েই যাও।”
প্রত্যাশা বলে উঠল,
-” আমার ছাতা টা তো নেই।”
নীলা তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
-” নেই মানে। সকালেই তো নিয়ে বেরোলি।”
প্রত্যাশা আমতা আমতা করে বলল,
-” ওটা একজনকে দিয়েছি।”
সবশুনে শফিক সাহেব বললেন— ঠিক আছে, ভালো করেছো। অধরা ভেতর থেকে আরেকটা ছাতা আনতে গেলেন। নীলা নাকমুখ কুঁচকে বলল,

-” অন্যের টাকার কেনা জিনিস তো, কোনো দরদ নেই। তোর কী, একটা দিলে আব্বুকে বললে আরেকটা নতুন পাবি। অন্যের টাকা পয়সা দিয়ে হাতেম তাঈ সাজার অভ্যেস তোর যাবে না। নিজের কিছু দান করে দেখিয়ে দিস।”
প্রত্যাশা বলল,
-” আমার নিজের বলতে তেমন কিছুই নেই। তবে থাকলে, কেউ চাইলে আমি নিশ্চয় দিবো। যদি আমার সাধ্যের মধ্যে থাকে।”
নীলা ভেংচি কে’টে বলল,

-” আচ্ছা, আচ্ছা আজ যে বড় করে বললি, কোনোদিন সময় এলে দেখবো। দেখবো কতটা উদার আর মহৎ তুই।”
অধরা ছাতা স্বামীর হাতে দিয়ে দু’টোকে ধমক দিলেন। সবসময় তর্কাতর্কি। শফিক সাহেবকে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলেন,
-” বড় জামাইকে ফোন করে দাওয়াত দিয়েছো। ছোট জামাইকে আবার বলেছো তো? নাকি খেয়াল নেই!”
-” হ্যাঁ, দু’জনকেই ফোন করে বলেছি। তবে নীরব বলল— ও ডিউটিতে আছে। খুব ব্যস্ত। তাই আসা সম্ভব হবে না।”
কথাটা বলতে বলতে শফিক সাহেব বেড়িয়ে গেলেন। প্রত্যাশা ব্যাগ হাতে তুলে রুমে যাবে বলে দাঁড়িয়েছে। ও দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবে—- ওনাকে তো একটু আগেই ক্যাসুয়াল ড্রেসে দেখলাম। হয়তো আসবে না বলেই ডিউটির অজুহাত দিয়েছে।

একদিন পর..
মাঝরাতে দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙে প্রত্যাশার। অস্থির ঠেকছে। অস্থিরতায় কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে থাকে। গলাটা শুকিয়ে কাঠ গেছে। প্রচন্ড তেষ্টা পাচ্ছে। রুমের ওয়াটার বোতলটা ফাঁকা দেখে ডাইনিংয়ে আসে। জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে নজরে এলো, নীলা আম্মু-আব্বুর রুমের দরজার সামনে। ওদিকে চেয়ে গ্লাসটা হাতে নেয় প্রত্যাশা। নীলা কম্পিত স্বরে চেঁচিয়ে উঠল,
-” আ-আম্মু, আব্বু নিভান ফোন দিয়েছিলো।”
অধরা এগিয়ে এসে চোখেমুখে চিন্তার ছাপ ফেলে শুধালেন,
-” নীলা, কী হয়েছে? এত রাতে, কারো কোনো সমস্যা হয়েছে? নিভান ফোন দিয়েছিলো তোর শ্বশুরের কিছু হয়েছে? ভদ্রলোক ঠিক আছেন তো?”

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ২৯

প্রত্যাশা ভ্রু কুঁচকে ওদিকে চেয়ে। বোঝার চেষ্টা করছে। নীলা জোরেজোরে নিঃশ্বাস ফেলছে। ও বলল কোন রকমে,
-” আম্মু, নীরবের এক্সিডেন্ট হয়েছে।”
কথাটা শ্রবণ হতেই প্রত্যাশার মাথাটা যেন চক্কর দিলো। হাতটা কেঁপে ওঠে, হাত খসে গ্লাসটা ফ্লোরে পড়ে যায়। মূহুর্তেই কাঁচ ভেঙে মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পরে। শব্দ শুনে অধরা আর নীলা একসাথে ডায়নিংয়ে তাকায়।

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৩১