মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৩১

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৩১
মুসতারিন মুসাররাত

ভোর চারটে পঞ্চাশ বাজে। হাসপাতালের করিডোর কাঁপছে ছুটে আসা স্ট্রেচারের চাকার শব্দে। মাথা থেকে রক্ত ঝরছে, আকাশি রঙের শার্ট লাল রঙে ভিজে একাকার। নীরবের নিথর দেহখানা পরে আছে। চোখের পাতা নিভুনিভু কিন্তু জ্ঞান নেই। দূর থেকে র*ক্তে মাখা নীরবকে দেখেই প্রত্যাশার মাথা ঘুরে গেলো। মূহুর্তে বুকের ভেতর গুমোট চিৎকার জমাট বাঁধে। এক হাতে মুখ চেপে ধরে, অন্য হাত আঁকড়ে ধরে পাশের চেয়ারের হেড। চোখ থেকে টপটপ করে জলের ফোয়ারা বইতে থাকে অবিরাম।

কুয়াকাটা থেকে ফিরছিলো নীরব। হঠাৎ ড্রাইভারের অসতর্কতায় দু’টো দূরপাল্লার বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। মূহুর্তেই বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে গোটা রাস্তা। ধাতব টুকরো, তাজা লাল টকটকে র*ক্ত। সব মিশে ছড়িয়ে পড়ে পিচঢালা রাস্তাজুড়ে। ঘটনাস্থলেই দু’জনের প্রাণ যায়, গুরুতর আহত হয় অনেকে। স্থানীয়দের সহায়তায় পুলিশ দ্রুত উদ্ধার কাজ শুরু করে। নীরবের কাছে এএসপি পরিচয়ের আইডি কার্ড পাওয়া যায়। সঙ্গে সঙ্গেই জানানো হয় ****পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে। সেখান থেকে যোগাযোগ করা হয় নীরবের পরিবারে। অ্যাম্বুলেন্সে করে নীরবকে শহরের নামকরা হাসপাতালে আনতে আনতে ফজর পেরোয়। ভোর আর অন্ধকারের মাঝখানে, আজ নীরব জীবন আর মৃ•ত্যুর এক সূক্ষ্ম রেখায় দাঁড়িয়ে।
প্রত্যাশা ঝরঝরিয়ে কেঁদে পাশে দাঁড়ানো অধরার দিকে একপল তাকিয়ে কান্নাভেজা কণ্ঠে শুধু বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-” আম্মু, নীর….”
কথাটুকু সম্পুর্ন না করেই ছুটে যেতে নেয়। তক্ষুনি অধরা হাত ধরে আটকিয়ে দেয়।
নীহারিকা বেগম এতক্ষণ ওয়েটিং চেয়ারে বসে আঁচলে মুখ চেপে কাঁদছিলেন, প্রলাপ করছিলেন। ছেলেকে অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যাওয়ার পথে পা’গলের মতো দৌড়ে গেলেন। গিয়ে ছেলের বুকের উপর পড়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। স্ট্রেচারে ধরা বয়েরা থেমে যায়। ওখানে নিভান ছিলো। সে আর ছোট চাচ্চু রাস্তায় দাঁড়িয়েই অস্থিরতায় পায়চারি করছিলো। নীরবের র*ক্তে মাখা মুখখানায় মমতায় মাখা হাতটা বারবার বুলাতে বুলাতে প্রলাপ করলেন,

-” আমার ছেলে, আমার বুকের ধন। আমার নীরব। ইয়া আল্লাহ, আমার জান নাও, তবুও আমার ছেলের জান ফিরিয়ে দাও। আমার সব আয়ু আমার ছেলেকে দাও। ইয়া মাবুদ, আমার বুক খালি করো না। আমার বুকের মানিক। আমার আব্বাটা।”
বলেই ছেলের র*ক্তে মাখা মুখেই চুমু খেতে লাগলেন। চাচ্চু নিভানকে ইশারা করে বললেন,
-” নিভান, ভাবিকে সরা।”
নিভানের চোখ ভেজা। বুকের পাঁজর ভেঙে যাচ্ছে। দুইহাতে মায়ের কাঁধ ধরল, বলল ভেজা গলায়,

-” মা…মা শক্ত হও কিচ্ছু হবে না। কিচ্ছু হবে না নীরবের। আমাদের নীরব আমাদের কাছেই ফিরে আসবে।”
নীহারিকার হৃদয় যেনো ছিঁড়ে যাচ্ছে। ছেলেগুলো তার কলিজার টুকরো যে। নীবিড় পর হওয়ার পরেও নীরব থাকায় অতটা বুঝতে পারেননি। নীবিড়ের ঘাটতি যে নীরবই পূর্ণ করেছে। নীহারিকা শাড়ির আঁচল তুলে নীরবের মুখের জমাট বাঁধা র*ক্ত মুছতে মুছতে কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
-” নীরব, নীরব বাবা আমার চোখ খোল। মা ডাকছে বাবা, কথা বল। কথা বল সোনা। আমার হৃদয় ছিঁড়ে যাচ্ছে যে, আমি পারছি না।”
নীহারিকার চুলের খোঁপা খুলে পিঠে এলোমেলো ছড়িয়ে পরেছে। নিভান মা’কে টেনে সরানোর চেষ্টা করে বলল,

-” মা সরো। নীরবকে ডাক্তার দেখবে, যেতে দাও।”
প্রত্যাশা এক ঝটকায় মায়ের হাত ছাড়িয়ে ছুটে যেতে লাগল। পরনে হালকা মিষ্টি রঙের কামিজের উপর সাদা পাজামা আর সাদা ওড়না। ছুটতে গিয়ে মাথার উপর থাকা ওড়না পড়ে গেল। প্রত্যাশা এসে থামল স্ট্রেচারের সামনে। কম্পিত ঠোঁটজোড়া দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে ফুঁপিয়ে ওঠে। সুক্ষ্ম অভিযোগ নিয়ে মনেমনে আওড়ালো,
-” হে খোদা, এসব কি হচ্ছে? রাতের স্বপ্নের মতো আজকের ভোরটা মিথ্যে হতে পারে না? হে আল্লাহ! ওনার সাথেই কেনো এমন হলো? ওনাকে সুস্থ করে দাও। পরিবারের কাছে সুস্থ শরীরে ফিরিয়ে দাও। জানটুকু ভিক্ষে দাও। আর কিছুই চাই না।’
প্রত্যাশা আচমকা নীরবের পরে থাকা হাতটা ধরল। হিম-শীতল ঠান্ডা হাতটা ধরতেই প্রত্যাশার কান্নার বেগ বাড়ল। নীরবকে আঁকড়ে ধরে বলতে ইচ্ছে করল,

-” নীরব আপনি না বলেছিলেন আপনার আমার সম্পর্ক যতদিন থাকবে, ততদিন আপনার আমার প্রতি দায়িত্ব থাকবে। নীরব আমাদের সম্পর্কটা তো এখনো আছে। তবে কেনো আপনি আমার দায়িত্ব পালন থেকে পালাতে চাইছেন? শুধু দায়িত্ব থেকে হলেও আমি আপনার সাথে থাকতে চাই। নীরব আমার যে আপনাকে অনেক কিছুই বলা হয়নি। আপনি কেনো এতবড় একটা দূর্ঘটনা ঘটালেন? প্লিজ, কিছু বলেন। আমার যে খুব কষ্ট হচ্ছে।”
নিভান মা’কে টেনে সরাল। নীহারিকা নিভানকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। নীলা পাশে দাঁড়িয়ে বারবার চোখ মুছছে। ডিউটি ডক্টর এসে পালস রেট চেক করে বললেন,

-” পালস রয়েছে, তবে অত্যন্ত ক্ষীণ। হেমোরেজিক শকে চলে যাচ্ছে পেশেন্ট। এক্সেসিভ ব্লিডিংয়ের কারণে ব্লাড প্রেসারও র‌্যাপিডলি ড্রপ করছে। ফাস্ট ওটি রেডি করতে হবে। ইমিডিয়েট সার্জারির প্রিপারেশন দরকার। স্যারের সাথে কথা হয়েছে, উনি রাস্তায় আছেন। যেকোনো মুহূর্তে পৌঁছে যাবেন। ব্লাড গ্রুপ অনুযায়ী ইমিডিয়েট ব্লাড অ্যারেঞ্জ করুন। এবং প্লিজ, আতঙ্কিত হয়ে কান্নাকাটি করে পরিবেশ আরও টেনসড করবেন না। বরং সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া করুন। এটাই এখন সবচেয়ে জরুরি।”
স্ট্রেচার টান দিলো। নীরবের হাতটা তখনো ধরে থাকায় প্রত্যাশা টান খেলো। নীরবের হাত থেকে নিজের হাতটা ধীরেধীরে ছুটে আসল। নীরবের হাতটা ঝুলতে থাকল। প্রত্যাশা সেদিকে অশ্রু সিক্ত নয়নে তাকিয়ে। অবচেতনে বলে ওঠে,

-” আপনি সুস্থ হোন। আমি আগের আপনাকে ফিরে পেতে চাই। আপনি বাঁচুন নীরব, আর আমি বাঁচতে চাই কেবল আপনাকে ঘিরেই।”
শফিক সাহেব এগিয়ে মেয়ের মাথায় হাত রাখতেই প্রত্যাশা বাবার বুকের উপর মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলো।
চেয়ারে বসে মাহবুব সাহেব বারবার চোখের পানি মুছছেন আর বিড়বিড় করে দোয়া ইউনুস পাঠ করছেন। বুড়ো মানুষটা শোকে পাথর বনে গিয়েছে।

অধরা সান্ত্বনা দিচ্ছে নীহারিকাকে। মায়ের মন যে মানছে যে। মায়ের বুক ফাটা আহাজারিতে হাসপাতালের করিডোর ভারি হয়ে যায়। প্রত্যাশা হাঁটুতে কনুই ঠেকিয়ে দুই হাতে মুখ চেপে ধরে। ওয়েটিং চেয়ারে ওরা সব বসে। এরমধ্যে নিভান সকল ফর্মালিটিজ পূরণ করে এসে প্রত্যাশাকে ডাকল,
-” প্রত্যাশা?”
প্রত্যাশার কানে পৌঁছাল না। নীলা জিজ্ঞেস করল,
-” নিভান কিছু দরকার?”
নিভান মাথা নেড়ে না বোঝাল। পরপর প্রত্যাশাকে ফের ডাকল,
-” প্রত্যাশা?”
ক্রন্দনরত মুখটা তুলে প্রশ্নাতুর চোখে চাইল প্রত্যাশা। নিভান হাত বাড়িয়ে বলল,

-” নীরবের ফোন আর ওয়ালেট। রাখো তোমার কাছে।”
একটু আগেই নীরবকে সাথে আনা একজন নিভানের হাতে এসব দেয়। মাহবুব সাহেব ওপাশ থেকে শুধালেন,
-” নিভান, র*ক্ত জোগাড় হয়েছে রে।”
-” হয়ে যাবে। চাচ্চু দিচ্ছে, আমি দিবো। আপাতত দুই ব্যাগ রেডি রাখি। তারপর আরো লাগলে লোক আছে।”
শফিক সাহেব বললেন,
-” নিভান, আমার পরিচিত লোক আছে, আরো লাগলে বলো আমি ফোন দিবো। আমি বললে তাদের সবাইই ছুটে আসবে।”

-” আপাতত দেখা যাক। লাগলে বলবো। আচ্ছা আমি এখন ব্লাড ব্যাংকে যাচ্ছি। এখানে সব ফর্ম পূরণ করেছি। নীরবকে ওটিতে নেওয়া হয়েছে। তোমরা চিন্তা করো না। ইনশা-আল্লাহ… সব ঠিক হয়ে যাবে।”
প্রত্যাশার চোখে এখনো ভাসছে নীরবের র•ক্তা•ক্ত শরীরটা। অল্প দিনের সম্পর্ক হলেও পবিত্র সম্পর্কের যে এতটা টান তা আগে বোঝেনি। আজ মনে হচ্ছে হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে যাচ্ছে, আত্মা ছটফট করছে। বুকের ভেতর কেমন এক ব্যথা দলা পাকিয়ে বসে আছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। নিভানের বাড়িয়ে দেওয়া ফোন আর ওয়ালেট দু’হাতে আঁকড়ে ধরল। মনে হচ্ছে এখানে মানুষটার স্পর্শ লেগে আছে। চোখে অঝোর বারিধারা কয়েক ফোঁটা ফোনের উপর পড়ল। প্রত্যাশা হাতটা বুকে চেপে ধরল। চোখের অশ্রু বিসর্জন দিয়ে নিঃশব্দে তার প্রাণ বায়ু, তার সুস্থতাটুকু উপরওয়ালার কাছে চাইল শুধু।

সার্জারি শেষ হতে হতে আটটা বেজে যায়। নিভান আর শফিক সাহেব ওটির সামনেই ছিলেন। সিনিয়র দু’জন সার্জনের সাথে ডিউটির সেই ডক্টরও বেরোয়। বাকিরা গটগট বেরিয়ে গেলেও ডিউটির ডক্টর থেমে বললেন,
-” সিজুয়েশন এখন স্ট্যাবল। মাথার ডান পাশে কপালের ওপরে কাঁচের টুকরো ঢুকে একটা গভীর ক্ষত তৈরি করেছিল। মস্তিষ্কের মেমব্রেনে হালকা স্ক্র্যাচ পড়েছিল, তবে ব্রেইন টিস্যুতে কোন স্থায়ী ক্ষ”তি হয়নি। এটাই সবচেয়ে রিলিভিং দিক। পায়ের হাঁটুর নিচে হাড়ে ফ্র্যাকচার হয়েছে। সেটা প্লেট দিয়ে সেট করা হয়েছে। দুটো অপারেশনই সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।”
নিভান কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ব্যাকুল স্বরে জিজ্ঞাসা করল,
-” ডক্টর, আমার ভাই একদম সুস্থ হবে তো। কোনো সমস্যা হবে না তো?”
ডক্টর অমায়িক কণ্ঠেই বলল,
-” দেখুন দু’টো অপারেশনই সাকসেস। আপাতত টেনশনের কিছু নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই পেশেন্টকে কেবিনে শিফট করা হবে। পেশেন্টকে এখন শুধু পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। পেশেন্টকে ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে, যাতে ব্রেইন সম্পূর্ণ রেস্টে থাকে। জ্ঞান ফিরতে সময় লাগবে, হতে পারে ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা বা তার বেশি। তবে এখনি কোনো আ’তঙ্কের কিছু নেই।”

ঘড়ির কাঁটা চারটের ঘরে। দশটার পরেই অতো লোকজনের ভিড় কমাতে দুএকজন থেকে বাকি সবাইকে যেতে বলা হয়। নিভান, নীহারিকা আর প্রত্যাশা আছে। দুপুরে অধরা খাবার রান্না করে স্বামীকে দিয়ে পাঠিয়ে দেন। তবে কারোরই খাওয়া হয়নি। যদিও চিন্তার কিছু নেই, তবুও অসুস্থ মানুষকে সামনে নিয়ে গলা দিয়ে খাবার নামে? আবার শর্মিলাও খাবার নিয়ে এসেছেন। বাড়ি ফাঁকা থাকে জন্য তখন আসতে পারেনি, অবশ্য ফোনে খোঁজখবর নিয়েছেন।
নীরবের কপালে ব্যান্ডেজ, পায়ে প্লাস্টার। স্যালাইনের ক্যানোলা বাঁ হাতে সেট করা। প্রত্যাশা দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে। কেবিন জুড়ে নীরবতা। শর্মিলা এসে এটাওটা বললেন। তবে শাশুড়ি মা এখন পর্যন্তও কিছু বলা তো দূর তাকায়ওনি। প্রত্যাশার নিজেকে অপয়া মনে হচ্ছে। আচ্ছা, শাশুড়িও কী তাকে এমনই ভাবছে?
কেবিনের পিনপিনে নীরবতা ভাঙল দরজা খোলার শব্দে। সবাই একসাথে বিস্ময়ে প্রশ্নবোধক চাউনিতে চাইল। প্রীতি নম্র স্বরে সালাম দিলো। শর্মিলা মনে মনে আওড়ালো— বাবা আজ সূর্য কোন দিকে উদয় হয়েছে? ভুল করে পশ্চিমাকাশে সূর্যোদয় হয়নি তো?
ইচ্ছে দৌড়ে এলো। নীহারিকার দিকে তাকিয়ে বলল,

-” দিদুন তুমি?”
সাথে সাথে বেডে নজর পড়তেই মুখটা ছোট করে বলল,
-” পাপা, পাপার কী হয়েছে? মাম্মা বলল পাপা অসুস্থ।”
এইবলে বেডের দিকে এগোল। নীরবের হাত ধরবে তার আগেই প্রীতি মেয়েকে টেনে নিল। ইচ্ছে ভেঙে ভেঙে জিজ্ঞেস করল,
-” মাম্মা, পাপার কপালে সাদা কী বাঁধা, পাপা ঘুমিয়ে কেনো?”
প্রীতি কিছু বলার আগেই শর্মিলা আদর করে কাছে টেনে বলল,
-” পাপার একটা ছোট্ট এক্সিডেন্ট হয়েছে সোনা। আঘাত লেগেছে, তাই ব্যান্ডেজ করা।”
প্রীতি নিজ থেকেই বলে উঠল,

-” আমার এক ফ্রেন্ড ফোনে নীরবের এক্সিডেন্টের কথা বলল। বাড়িতে নীরবের দূর্ঘটনার কথা বলতেই ইচ্ছে বায়না ধরলো, সে এক্ষুনি যাবে। ইচ্ছের জিদ তো আবার সাং•ঘা•তিক।”
নীহারিকা শুনল উত্তর করলো না। ইচ্ছে নীহারিকার শাড়ির আঁচল টেনে বলল,
-” দিদুন, পাপাকে ঘুম থেকে তোলো। পাপাকে বলো আমি আসছি।”
-” পাপা অসুস্থ সোনা। ইচ্ছে তুমি তো নিষ্পাপ, মাছুম বাচ্চা। তুমি একটু দোয়া করো তো। পাপা যেনো দ্রুত সুস্থ হয়ে যায়।”
নীহারিকার কথায় ইচ্ছে ঘাড় কাত করে বলে,
-” আচ্ছা।

ইচ্ছে আর আনিশা কেবিনের সাথে লাগোয়া বারান্দায় গিয়ে ছুটাছুটি করতে লাগলো। প্রীতি বেডে একপল চেয়ে প্রত্যাশার দিকে তাকায়। শর্মিলা প্রীতির সাথে টুকটাক কথা বলল। প্রীতি খুবই নম্রভাবে কথাবার্তা বলল।
নীরবের বেডের পাশে টুলে বসে নীহারিকা। শর্মিলা কাঁধে হাত রেখে বলল আস্তে করে,
-” ভাবি, বলছি বাড়ি চলো। আমার সাথে গিয়ে গোসল করে আবার আসবে। তোমার দেবরকে বলবো পৌঁছে দিতে।”
-” ছোটো পা’গল হয়েছিস তুই? আমার ছেলেটা এখনো চোখ খুলল না, আর আমি বাড়ি যাই।”
-” ডাক্তার তো বলেছে চিন্তার কিছু নেই। জ্ঞান ফিরতে একটু সময় লাগবে। বারো ঘন্টার বেশিও লাগতে পারে। গোসল না করলে তোমার তো আবার মাথা ছিঁড়ে যায়। এমনিতেই সেই রাত থেকে কান্নাকাটি করছো। তারউপর খাওয়া-দাওয়া নেই। এভাবে থাকলে তুমি না অসুস্থ হয়ে পড়ো। অসুস্থ হলে ছেলেকে আবার দেখবে কী করে? তোমাকেই তো আবার টানতে হবে। তাই বলছি চলো আমার সাথে।”

-” নীরবকে একা রেখে আমি কী করে যাই। না না না আমি যাব-টাব না। বাদ দে তুই।”
-” প্রত্যাশা আছে, নিভান আছে। ওরা থাকবে তো।”
হঠাৎ পাশ থেকে প্রীতি বলে উঠল,
-” মা, আমি সন্ধ্যা পর্যন্ত আছি। আপনি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন। ফ্রেশ হলে বেটার লাগবে।”
এই প্রথম প্রীতির মুখ থেকে মা ডাক শুনলেন। বিস্মিতই হলেন নীহারিকা! তবে বুঝতে না দিয়ে নির্বিকার রইলেন। বাইরে নিভান ছিলো সেও এসে মা’কে বোঝাল। অবশেষে রাজি হলো। তবে নিভানকে পইপই করে বলল,
-” নিভান খেয়াল রাখিস। এক মুহুর্তের জন্যও চোখ সরাস না বাবা। কোনো সমস্যা হলে বুঝতে পারলে সাথে সাথেই ডাক্তারকে ডাকবি।”

-” চিন্তা করো না তো মা আমি আছি।”
পরপর ‘আমি রিকশা দেখছি’ বলে নিভান নিচে যায়। বাসা এখান থেকে বেশি দূর নয়। শর্মিলা বের হবে তার আগে প্রত্যাশার সামনে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-” প্রত্যাশা আর কান্নাকাটি করো না সোনা। কিছুই তো খেলে না। তোমার আম্মু তো প্রয়োজনীয় জিনিস পাঠিয়েছে, ফ্রেশ হয়ে নিও ক্যামন?”
প্রত্যাশা কিছুই বলতে পারল না। প্রত্যাশার গালে হাত রেখে আশ্বাস, ভরসা দিয়ে বলল,

-” উফ্! বিপদ-আপদ তো আর বলে কয়ে আসে না মা। শুধু মনে করো আল্লাহ না করুক বেশি কিছু হয়নি, এই তো হাজার শুকরিয়া। তবুও যে অল্পের উপর দিয়ে গিয়েছে।”
তারপর প্রীতির দিকে তাকিয়ে অমায়িক গলায় বললেন,
-” প্রীতি তুমিও যেহেতু আছো দেখো একটু। প্রত্যাশা তো ছোটো, তুমি বড়। প্রত্যাশা অত বুঝতে নাও পারে। তুমি একটু বুঝিয়ে দিও, আর লক্ষ্য রেখো। নিভান তো আছেই।”
প্রীতি উত্তরে মৃদুস্বরে বলল,

-“ছোটো মা টেনশন করবেন না। মা না আসা পর্যন্ত আমি থাকব। আর নিশ্চয় খেয়াল রাখব।”
নীহারিকা সাথে সাথে বলে উঠলেন,
-” ছোটো এত জনেজনে আমার ছেলেকে দেখার কথা বলতে হবে না। যেই আল্লাহ বড় বিপদ কাটিয়ে দিয়েছেন, তিনিই আমার ছেলেকে রক্ষা করবেন, ভালো রাখবেন।”
এই বলে পা বাড়াতে গিয়ে আবার থামলেন। প্রত্যাশার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন,
-” এভাবে সবসময় সংয়ের মতো দাঁড়িয়ে থেকো না। হাতে ধরে দেখিয়ে বারবার যেনো বলে দিতে না হয়। তোমার স্বামীর ভালোমন্দ দেখার দায়িত্ব সবার আগে তোমার, পরে বাকিদের। কেবল চোখ ভিজিয়ে কিছু হয় না। বুঝে-শুনে একটু চালাক-চতুর হয়ে বুদ্ধি নিয়েও চলতে হয়।”
থেমে গলার স্বর একটু মিইয়ে ফের বললেন,

-” নীরবের পাশে থেকো, লক্ষ্য রেখো। নীরবের অসুবিধে হচ্ছে বুঝতে পারলে নিভানকে ডেকো। সিস্টাররা তো আসা-যাওয়া করছেই।”
প্রত্যাশা কলের পুতুলের মতন ঘাড় কাত করে বলল,
-” ঠিক আছে। আপনি চিন্তা করবেন না।”
নীহারিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
-” খেয়ে নিও তুমি। এমনিতেই হ্যাংলা পাতলা না খেয়ে প্রেশার লো হয়ে আবার মাথা ঘুরে পরে যাবে। সন্ধ্যায় বেয়াইকে আসতে বলো, রাতে বাড়ি গিয়ে থাকবে। তোমার তো আবার এক সপ্তাহ পরেই পরীক্ষা।”
শাশুড়ি মাকেও বুঝে উঠতে পারে না প্রত্যাশা। এই ঝারি মে”রে বলেন তো আবার মমতা আদর ঢেলে বলেন।
কেবিনে প্রীতি আর প্রত্যাশা। ইচ্ছে নিভানের সাথে করিডোরে হাঁটছে। এরমধ্যে একজন সিস্টার এসে প্রীতির দিকে তাকাল। প্রীতির পড়নে জলপাই রঙের থ্রি পিস। সুন্দর করে ওড়নাটা গায়ে জড়ানো। প্রীতির সামনে এগিয়ে সিস্টার বলল,

-” পেশেন্টের বাড়ির লোক? কী হোন পেশেন্টের?”
প্রীতি কপালে বিরক্তির ছাঁট ফেলে বলল,
-” হুম পেশেন্টর বাড়ির লোক। জ্বী বলুন…”
-” পেশেন্টের কী হোন?”
প্রীতি রুক্ষ স্বরে বলল,
-” বললাম তো পেশেন্টের বাড়ির লোক। কী বলবেন বলুন তো?”
নার্স এগিয়ে স্যালাইন নেড়েচেড়ে দেখল। কিছু বলতে গিয়ে থেমে প্রত্যাশার দিকে তাকিয়ে বলল,
-” আপনিও পেশেন্টের বাড়ির লোক?”
প্রত্যাশা মিহি স্বরে বলে,

-” জ্বী, আমি উনার ওয়াইফ।”
নার্স বলল,
-” ওহ্। তাহলে আপনাকেই বলছি। পেশেন্টের জ্ঞান ফিরলে জানাবেন। জ্ঞান ফেরার পর একটা ইনজেকশন পুশ করতে হবে। যদিও আমি কিছুক্ষণ পর পর এসেই চেক করে যাব জ্ঞান ফিরেছে কী না।”
-” ওকে।”
ফাইলটা হাতে তুলে বলল,
-” সন্ধ্যার মধ্যেই জ্ঞান ফিরলে রাতে খাবার দিতে পারবেন। স্যুপ জাতীয় তরল খাবার।”
-” থ্যাংকস।”

প্রীতির ফোন আসায় ব্যালকনিতে যায় কথা বলতে। প্রত্যাশা বেডের পাশে টুলে বসা। এক হাতে আলতো করে নীরবের ক্যানোলা পড়ানো হাতটা ধরে আছে। আর ভাবছে— নীরব বাড়িতে বলেছে কোনো একটা অফিশিয়াল কাজে সে কুয়াকাটা যাচ্ছে। প্রত্যাশার মনে প্রশ্নের উদয় হয়; এটা কী সত্যি? নাকি নীরবের কুয়াকাটা যাওয়ার কারন প্রত্যাশা?

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৩০

প্রত্যাশার ভাবনার ছেদ হয় আকস্মিক অনুভবে। হঠাৎ খেয়াল হলো, ছুঁয়ে থাকা নীরবের হাতটা কিঞ্চিৎ নড়ল বোধহয়। প্রত্যাশা চোখের ভারি পাতা তুলে নীরবের দিকে তাকায়। নীরব পিটপিট করে তাকাতে গিয়ে কোথাও একটা টান লেগে ব‌্যথায় চোখমুখ কুঁচকে নেয়। পরপর সামনে তাকাতেই দেখে একটা নিষ্পাপ ক্রন্দনরত মুখ। সাদা ওড়না মাথায়, গোলগাল মুখটা ফ্যাকাসে বিবর্ণ হয়ে আছে। নীরব ব‌্যথায় কুঁচকানো মুখচোখেই নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল সেদিকে।

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৩২