মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৩৪

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৩৪
মুসতারিন মুসাররাত

প্রত্যাশা বিছানা থেকে একটা বালিশ হাতে তুলে পা বাড়াতেই নীরবের কপালে ভাঁজ পড়ল। নীরব তৎক্ষণাৎ বলে উঠল,
-” প্রত্যাশা বালিশ রাখো। আমি জাস্ট মজা করে কথাটা বলেছি।”
-” জানি।”
-” তাহলে বালিশ নিয়ে কোথায় যাচ্ছো?”
-” আমি কাউচে ঘুমাব।”
নীরবের কপালের ভাঁজ মিলিয়ে এল। বলল আদেশ স্বরুপ,
-” বেশি কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ বেডে শুয়ে পড়ো।”

প্রত্যাশার বুকের ভিতরটা ভার হয়ে উঠল। কেন জানি মনে হলো, ওর ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো দাম নেই। আম্মু জোর করে গুঁজে দিয়ে গেল। হুঁশিয়ারি করে গিয়েছেন– কোনো কথার যেনো সৃষ্টি না হয়। প্রত্যাশার ভালো লাগলো না কথা বাড়াতে। নিঃশব্দে বিছানার এক কোণায় পিঠ ঘুরিয়ে শুয়ে পড়ল।
নীরব মেডিসিন খেয়ে, ফ্রেশ হয়ে এসে সবুজ রঙের ডিমবাতি জ্বালিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। নিস্তব্ধ ঘরে সেই আলোয় প্রত্যাশাকে দেখে তার বুক কেমন করে উঠল। মেয়েটা একদম গুটিসুটি মে*রে শুয়ে আছে, যেন নিজেকে সরিয়ে রেখেছে পুরো পৃথিবী থেকে। চোখ বন্ধ, নিঃশ্বাসের শব্দ পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

হঠাৎ করেই প্রত্যাশার পেটের ওপর হাত রাখে নীরব। প্রত্যাশা চমকে না উঠে, দাঁতে দাঁত চেপে পরে রইল। বুঝাতে চাইল গভীর তন্দ্রায় ডুবে আছে সে। দু সেকেন্ড খানেকের মাঝেই নীরব একটানে বউকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে কাছে টেনে নিল। প্রত্যাশা এবারে চোখদুটো কষে এঁটে রেখেই এক ঝটকায় নীরবের হাতটা পেটের উপর থেকে নামিয়ে দিল। নীরব জোড়ালো শ্বাস ফেলল। প্রত্যাশার হাতের উপর আলগোছে ডান হাতটা রেখে, কণ্ঠে এক সমুদ্দুর অপরাধবোধ মিশিয়ে বলল,

-” স্যরি, আ’ম রিয়েলি স্যরি।”
প্রত্যাশা দৃঢ় গলায় প্রশ্ন ছুঁ’ড়ল,
-” স্যরি, হোয়াট ফর স্যরি।”
নীরব চুপ হয়ে গেল। কিছু একটা যেন গলার কাছে আটকাল। প্রত্যাশার চোখে তাকাতে পারল না। মাথা নিচু করে বলল,
-” দ্যাট নাইট, আই বিহেভড রিয়েলি ব্যাডলি উইথ ইউ। রাগের মাথায় যা করেছি, তা একদমই ঠিক হয়নি। আই শুডন’ট হ্যাভ ডান দ্যাট। আই অ্যাম ট্রুলি স্যরি, প্রত্যাশা।”
চোখে টলটলে জল নিয়ে প্রত্যাশা নিরুত্তর রইল।প্রত্যাশার নিশ্চুপ , নিঃশব্দ চোখের জল নীরবের অপরাধবোধ বাড়াল ক’গুণ। নীরব অসহায় চাহনিতে প্রত্যাশার অশ্রুসিক্ত চোখে চোখ রাখল। বলল ব্যাকুল স্বরে,

-” প্লীজ প্রত্যাশা?”
প্রত্যাশার ছোট্ট হৃদয় ফুঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরোল। ব্যথাতুর মন নিয়ে ভারি গলায় বলল,
-” জানি না কে বা কারা, কীভাবে ওই ছবিগুলো তুলেছে? উদ্দেশ্যই বা কী? তবে এতটুকু জানতাম আমি নির্দোষ। আমি সজ্ঞানে ভুলেও ওমন কিছু করতে পারি না। আর সত্য প্রকাশ হবে, দেরিতে হলেও এতটুকু বিশ্বাস আমার ছিলো, আছে। তবে মাঝখানে ঘটে যাওয়া কিছু মূহুর্ত মস্তিষ্ক থেকে মুছে ফেলা অসম্ভব। ম*রে গেলেও কিছু কথা ভুলতে পারব না। হয়তো চাইলেও সম্ভব নয়। শরীরের ক্ষত ওষুধে যায়, থেকে যাওয়া শুকনো দাগ অয়েন্টমেন্টেও দূর করা যায়। তবে কথার আঘাতে হৃদয়ে তৈরি হওয়া ক্ষ’তের দাগ আদৌও মুছা সম্ভব?”

-” আমার ভুলে, নিজেকে সংযত রাখতে না পেরে তোমাকে যে আঘাত করে ফেলেছি, সেটা স্যরি বলাতে উঠে আসবে না। কথাগুলো যদি ফিরিয়ে নেয়া সম্ভব হতো, তবে আমি সেটাই করতাম। ভুল মানুষ মাত্রই হয়। কেউই ভুলের উর্ধ্বে নয়। লাইফের বড় ভুল ছিলো জাস্টিফাই না করেই সেদিন রাগে কন্ট্রোললেস হয়ে তোমার সাথে রুঢ় আচরণ করেছি। বিলিভ মি, ঠাণ্ডা মাথায় ভাবার পর আমার মধ্যে অপরাধবোধ জাগে।”
আঙুলের ফাঁকে আঙুল গলিয়ে প্রত্যাশার হাতটা আরেকটু শক্ত করে ধরে নীরব। বলল শান্ত, শীতল কণ্ঠে,
-” প্রত্যাশা, তোমার মনে কথার আঘাতে যে ক্ষত আমার দ্বারা তৈরি হয়েছে। সেটা ঠিক করার দায়িত্ব আমার। শুধুই আমার। তোমার মনের ক্ষ’ত মোছার অয়েনটমেন্ট আমি হবো। দাগ গুলো না উঠুক, ব্যথাটা যেন কমে সেই চেষ্টাই করব।”

বলতে বলতে প্রত্যাশার হাওয়াই মিঠাইয়ের মতন নরম মসৃণ গালে হাত রাখল নীরব। গালে আলতোভাবে হাত রেখে আকুল আবেদন ভরা কণ্ঠে বলল,
-” প্লীজ, পারডন মি। ভুলে যাও সবটা।”
-” সম্ভব?”
একরাশ হতাশা নিয়ে বলল নীরব,
-” জানি ভুলা অসম্ভব। তবুও এ__”

নীরবের কথায় দাড়ি টেনে দেয় প্রত্যাশা। গাল থেকে আস্তে করে নীরবের হাতটা নামিয়ে দিল। নিচু স্বরে বলল,
-” নীরব আপনি যে যায়গায় ছিলেন, আমি নিজেও সেই জায়গাটা ফেস করে এসেছি। আমিও আপনাকে অবিশ্বাস করে অনেক কিছুই বলেছি। নীরব আপনি আমার থেকে বড়, অনেক বেশি অভিজ্ঞ, হাইয়ার এডুকেটেড। নিঃসন্দেহে আপনার জানাশোনা, অভিজ্ঞতা আমার থেকে অনেক বেশি। একই ঘটনার প্রেক্ষিতে আপনাকে আমার সাথে কম্পিয়ার করলে পার্থক্য কী? আমাদের দু’জনের মধ্যে পার্থক্য কী রইল?”
নীরব বাকরুদ্ধ। উত্তর দিতে পারল না। প্রত্যাশা মনে মনে তাচ্ছিল্য হেসে বলল,

-” ও হ্যাঁ পার্থক্য অবশ্য আছে। একটা বিশাল পার্থক্য আছে। আমি আপনাকে আপনার পরিবারের সবার সামনেই অপমান করেছিলাম। আর আপনি আমাকে কারো সামনে ছোট করেননি। আপনি চারদেয়ালের মাঝে আমাকে অপমান করে যাচ্ছে না তাই বলেছেন। সেদিনের পর থেকে মনেহয় সবাই ঠিকই বলে, আপনি বাবার কথা রাখতেই আমাকে বিয়ে করেছেন।”
প্রত্যাশার গলা ধরে এল। নীরব চোখ তুলে প্রত্যাশার মুখের দিকে তাকাল। চোয়াল শক্ত করে জিজ্ঞেস করল,
-” সবাই মানে? কে কে, কী বলেছে তোমাকে? আমাকে বলো কে বলেছে তোমাকে এসব?”
প্রত্যাশা প্রীতির নাম নিলো না। স্রেফ বলল,

-” কে বলেছে সেটা বড় কথা নয়। আপনি নিজেই তো বলেছিলেন, ‘সব জেনেশুনে দয়া দেখানোই আমার ভুল হয়েছে’ তারমানে দাঁড়ায় আপনি আমাকে দয়া করেছেন। বিয়েটা করে দয়া করেছেন?”
নীরবের শব্দগুলো জড়িয়ে এল,
-” আ-আমি বলছি তো তখন আমার মাথা ঠিক ছিলো না। ওই দৃশ্যগুলো দেখে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলি। রাগের মাথায় কী বলেছি নিজেও জানি না।”
-” নীরব আপনাকে আমার ফ্যামেলি বলেছিল দয়া করতে? এমন না যে আমার আব্বু কন্যা দায়গ্রস্থ ছিলো। আমাকে ওই মূহুর্তে পাত্রস্থ করতেই হবে। আপনি যদি আপনার ফ্যামেলির চাপে পড়ে বিয়ে করেন; সেই দায় তো আমার না, না আমার ফ্যামেলির।”

-” প্রত্যাশা তোমার মনেহয় আমাকে দিয়ে জোর করে কিছু করানো যাবে? বিয়ের মতো জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমি চাপে পড়ে করব?”
একটু থেমে,
-” হ্যাঁ, সত্যি বললে বলব; বাবা তোমার-আমার বিয়ের কথা বললে আমি প্রথমে না করি। সেটা তোমার আমার এইজ গ্যাপের জন্যে। তারউপর তুমি অনেক ছোটো।এছাড়া তোমাকে বিয়ে করতে আমার দ্বিতীয় কোনো আপত্তি ছিলো না।”

প্রত্যাশা ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকালো। কেনো জানি ভীষণ কান্না পাচ্ছে। ছোট থেকেই সে কারো উপর রাগ করে থাকতে পারে না। নীলার সাথে সেকেন্ডে সেকেন্ডে ঝগড়া হতো, এখনো হয়। এমন না যে সে নীলার সাথে সবসময় মুখে মধু নিয়ে কথা বলে। সেও ত্যাড়া করে বলে। তবুও রাগ আগে প্রত্যাশাই ভাঙাতো। কিছু কিনলে দৌড়ে গিয়ে আপুকে দিতো। আপু তবুও ঝারি মা’রত। আম্মু তো বারবার বলতো—- প্রত্যাশা তোর লজ্জা নেই। তুই এত কিছুর পরেও কেনো ওর সাথে কথা বলতে যাস?
নীরবের করা অপমানও প্রত্যাশা ধরে রাখেনি। নীরবের এক্সিডেন্টের জন্য ওর নিজেকেই দায়ী মনে হয়েছে। ছুটে গিয়েছে, সবটা মনের এককোণে ঠেসে সবার সামনে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেছে। তবুও…এত কিছুর পরেও যখন কিছু কথা মনে ওঠে, তখন হৃদয়টা দুমড়েমুচড়ে যায়। চোখের কোল ঘেঁষে নোনতা পানি গড়িয়ে পড়ল। প্রত্যাশার দিকে আরেকটু ঝুঁকল নীরব। পরপর হাতের আঙুল দিয়ে চোখের পানি ফেলে দিল। প্রত্যাশার মুখটা আঁজলা করে ধরে নরম, কোমল গলায় বলল,

-” আই নো, সেদিন আমি খুব বেশিই বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি। রাফ বিহেভ করেছি। বাট স্টিল, আই’ম আস্কিং; ক্যান ইউ ফরগিভ মি?”
প্রত্যাশা ফুঁপিয়ে উঠল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে শুধু বলল,
-” আমি ঘুমাব। ঘুম পাচ্ছে।”
তারপর নিঃশব্দে উল্টোদিক ঘুরে শুলো। বালিশে মুখ গুঁজে নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিল। নীরব বড় একটা হতাশ শ্বাস ফেলে কপালের উপর ডান হাতটা আড়াআড়ি করে রাখল। সমস্ত রাগ-ক্ষোভ নিজের মেজাজের উপর বর্তাল। সেদিন যদি একটু ভাবতো, নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারত? উফ্! এক সমুদ্দুর আফসোস নিয়ে চোখের পাতায় ঘুম নামল না নীরবের। অস্বস্তি, অপরাধবোধে হাঁসফাঁস করল ভেতরটা।

ঘড়িতে সাতটা পঞ্চাশ বাজে। নীরবকে এড়িয়ে যেতেই মূলত সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে কিচেনে আসছে প্রত্যাশা। শাশুড়ি অবশ্য ওকে পড়ার কথা বলে রুমে যেতে বলে। প্রত্যাশা না গিয়ে কিচেনে টুকটাক সাহায্য করে।
নীহারিকাকে টেবিলে খাবার সাজাতে হাতে হাতে সাহায্য করছিল প্রত্যাশা। নীহারিকা একটা ট্রে-তে খাবার সাজিয়ে বলল,
-” প্রত্যাশা?”
-” হুঁ..”
-” নীরবের খাবার। যাও রুমে দিয়ে এসে তুমি খেয়ে নাও।”

প্রত্যাশা ঘাড় কাত করে হ্যাঁ সূচক প্রত্যুত্তর দিয়ে রুমে যায়। নীরব বেডের হেডেবোর্ডে হেলান দিয়ে এক পায়ের সাথে আরেক পা জড়িয়ে রেখেছে। হাতে তার আজকের পত্রিকা। খানিক আগে রুম থেকে মা’কে ডেকে পত্রিকা চেয়েছিল। ভেবেছিল মা রান্নায় ব্যস্ত থাকবে প্রত্যাশাকে দিয়ে পাঠাবে। কিন্তু তার সে ভাবনায় জল ঢেলে প্রত্যাশা পরিকে দিয়ে পাঠায়। নীরব পরিকে জিজ্ঞেস করে— তোর ছোট ভাবীমণি কোথায়? কী করে সে?
পরি উত্তর দেয়— ছোটো ভাবিমণি কাজ করতাছে। বড় খালাম্মা তারে কইল। সে আবার আমারে দিয়া ব্যাগার খাটাল। আমারে পাঠাইল।
নীরব একবার প্রত্যাশার দিকে তাকিয়ে ফের পত্রিকায় চোখ ফেরাল। প্রত্যাশা খাবার নামাতে নামাতে বলল,

-” আপনার নাস্তা।”
আর বাড়তি শব্দ উচ্চারণ না করে প্রত্যাশা পা চালায়। নীরব দারাজ গলায় বলল,
-” ওয়েট?”
প্রত্যাশা মুখের দিকে তাকাল না। দৃষ্টি ফ্লোরে রেখেই বলল,
-” হুঁ, বলুন।”
-” কাছে এসো?”
প্রত্যাশা ভড়কাল। তবে উপরে নিজেকে স্বাভাবিক রাখল, বুঝতে দিলো না। শুধু বলল,
-” মানে? আমার কাজ আছে।”
নীরব নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,
-” কাজ করতেই ডাকছি। আদর করতে নয়।”
প্রত্যাশা মনেমনে দু’টো গালি দিলো। নীরব ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,

-” যেহেতু সবাই জানে তুমি আমার সেবা করার জন্য এখানে আছো। পরীক্ষার প্রস্তুতি বাদ রেখে স্বামী সেবা করতে আসছো। তাই একটু ভালো করেই না হয় স্বামী সেবা করো। শুধু লোক দেখানো নয়।”
এই লোক চাইছে টা কী? অদ্ভুত! মনে মনে এসব ভেবে মাথা ঝাড়ল প্রত্যাশা। মুখে বলল,
-” কী করতে হবে, বলুন?”
-” খাইয়ে দিতে হবে।”
প্রত্যাশার চোখদুটো বড়বড় হয়ে যায়। বিস্ফোরিত চাউনিতে চেয়ে বলল,
-” কীহ! পারব না।”
নীরব পত্রিকা ভাঁজ করে একপাশে নামাল। ভ্রু নাচিয়ে বলল,

-” পারবে না মানে? আমার মাথায় এখনো ব্যান্ডেজ, পায়ে ব্যথা, ডক্টর মুভমেন্ট করতে নিষেধ করেছেন। তারপরও তুমি এটুকু সেবা করতে চাইছো না। নির্দয়ের মতো সরাসরি ‘পারব না’ বলে ফেললে।”
প্রত্যাশা ঝটপট প্রত্যুত্তরে বলল,
-” পায়ে ব্যথা, মুভমেন্ট করাতে বারণ। হাতে তো আর কোনো সমস্যা নেই। হাত নাড়াতে বারণ নেই। আর দিব্যি তো কাল রাতেও নিজ হাতেই খেলেন।”
নীরব নড়েচড়ে বসল। মৃদু গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
-” সমস্যা ছিলো না, এখন হচ্ছে।”
বিরক্তিতে প্রত্যাশার কপাল কুঁচকে গেল। স্রেফ বলে দিল,
-” সবকিছু থাকল। খেয়ে নিবেন।”
এই বলে প্রত্যাশা প্রস্থান করতে নিবে, ঠিক তখুনি নীরব বলল,
-” ওকে ফাইন। খাবার গুলো যেভাবে আছে, থাকুক সেভাবেই।”

প্রত্যাশা যেনো এবার ফ্যাসাদে পড়ল। খাবার ওমন থাকলে শাশুড়ি এসে দেখে আবার তাকেই না দোষারোপ করে বসে। অসভ্য লোকটা কীভাবে ঠাণ্ডা মাথায় স্বৈরাচারীতা করছে! ভেতরে ভেতরে গজগজ করতে করতে প্রত্যাশা বেডের একপাশে বসল। বলল,
-” বাহ্, এখন থেকেই স্বৈরাচারী স্বভাব দেখাতে শুরু করলেন। এটাই বাদ ছিলো।”
নীরব মুচকি হাসলো। বলল,
-” উঁহু, ভুল বললে। স্বৈরাচারীতা নয়, বউয়ের থেকে সেবা নিচ্ছি।”

প্রত্যাশা পরোটা ছিঁড়ে কালা ভুনায় ডুবাতে ডুবাতে শুকনো ঢোক গিলে ভাবল— এখনো যাকে মাঝে মাঝেই আম্মু খাইয়ে দেয়। সে কী না হাতির মতো একজনকে খাইয়ে দিবে। কী আশ্চর্য!
মুখটা পাংশুটে করে নীরবের মুখের সামনে খাবার ধরল। নীরব ঠোঁট কামড়ে ধরে বলল,
-” টেস্ট করে দ্যাখো। দ্যাখো ঝাল নুন পরিমাণমতো আছে কী না! আমি বেশি ঝাল খেতে পারি না।”
প্রত্যাশা অতীষ্ঠ চাহনিতে চেয়ে বলল,
-” আপনার মা রান্না করেছে। তাই সব ঠিকই থাকার কথা।”
-” তবুও টেস্ট করে দেখে দাও।”
কী জ্বা’লা! প্রত্যাশার রাগ হলো। এই লোক বাচ্চাদের থেকেও বেশি জ্বালাতন করছে। প্রত্যাশা মুখে দিয়ে চিবুতে চিবুতে বলল,

-” সব পরিমাণ মতোই আছে।”
তারপর নীরবের মুখের সামনে খাবার ধরতেই নীরব বড় করে হা করে খাবার মুখে নিল। গলাধঃকরণ করে প্রত্যাশার হাত থেকে খাবারের প্লেট হাতে তুলে নিতে নিতে বলল,
-” দাও, আমি নিজেই খাচ্ছি। পিচ্চি বউকে আর কষ্ট দিতে চাইছি না।”
প্রত্যাশা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ত্রস্ত প্লেট দিয়ে উঠে গেল।

ব্রেকফাস্ট টেবিলে মুখোমুখি বসে প্রীতি আর সার্থক। এমন দেখা খুব বেশি হয় না। বিশেষ করে সেদিনের ঘটনার পর দু’জনের কারোর সাথেই আর কথা হয়নি। কেউ কারো দিকে তাকায় না পর্যন্ত।
প্রীতি নিঃশব্দে ব্রেডে জেল মাখিয়ে মুখে দিল। খানিক পর নিজ থেকেই আচমকা বলে উঠল,
-” স্যরি ভাইয়া।”
সার্থকের হাতে ফ্রুটস জুসের গ্লাস। ঠোঁটে গ্লাস তুলতে তুলতে একবার চোখ মেলল প্রীতির দিকে। তবে কিছু বলল না। প্রীতি একটু চুপ থেকে ফের বলল,

-” অদ্রিকা আপু তোকে পছন্দ করে ভাইয়া।”
সার্থক এবারও নিঃশব্দ, নিরুত্তাপ। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। প্রীতি হালকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-” সৃষ্টিকর্তা যে কেনো সেইসব মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করায়, যারা ভাগ্যে নেই। অথচ তাদেরকেই ভালো লেগে যায়। উফ্! সেই পছন্দটাও কাঁটার মতো বুকে বিঁধে থাকে, সারা জীবন।”
-” ভালো লাগলে যে পেতেই হবে, এমন তো কোনো শর্ত নেই। কখনও কখনও ভালোবাসা মানে; দূর থেকে তার সুখে নিজেকে সুখী ভাবা। ভাগ্যকে মেনে নেওয়াটাও ভালোবাসারই এক রকম পরিণতি।”
কথাটা বলেই টিস্যু দিয়ে হাত মুখ মুছে উঠে দাঁড়াল সার্থক। এরমধ্যে মনা ইচ্ছের পিছুপিছু ঘ্যানঘ্যান করতে করতে নামল। অভিযোগ দিলো প্রীতির কাছে,

-” ম‌্যাডাম, ইচ্ছে কিচ্ছুতেই খাবার খাচ্ছে না।”
প্রীতি ধ’ম’কিয়ে উঠল,
-” ইচ্ছেএএএ…. দ্রুত খাবার খেয়ে নাও। স্কুলের টাইম হয়ে যাচ্ছে।”
ইচ্ছে ঘাড় ফুলিয়ে বলল,
-” আমি খাবো না, স্কুলেও যাব না। আমি দাদু বাসায় যাব। তোমরা বলছো নিয়ে যাবে, কই যাচ্ছো না কেনো? আমি এক্ষুনি যাবো।”
সার্থক উবু হয়ে ইচ্ছের ফোলা ফোলা গালে হাত রাখল। আদুরে গলায় বলল,
-” ইচ্ছে সোনা তুমি খেয়ে নাও। আমি তোমার জন্য আজ খেলনা আনব। অনেক…টেডি আনব, রিমোট কন্ট্রোল কার… তারপর __”
ইচ্ছে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,

-” আমার চাই না গাড়ি, চাই না টেডি। আমি দাদু বাসায় যাবো। আমি খাবো না, খাব না, স্কুল যাব না।”
প্রীতি রেগে কিছু বলবে। সার্থক থামিয়ে দিল। বলল হাসিমুখে,
-” ওকে লিটল প্রিন্সেস। তোমাকে আমি দাদু বাসায় নিয়ে যাবো। তুমি এবারে খেয়ে নাও তো ফাস্ট।”
-” সত্যিই?”
-” হুম, সত্যি।”
-” এক্ষুনি?”
-” না এখন কী করে….এখন না তোমার স্কুল আছে। আমারো তো হসপিটাল আছে।”
ইচ্ছের মুখ আবার ভার হয়ে এলো। সার্থক শব্দ করে ইচ্ছের গালে চুমু খেয়ে বলল,
-” আচ্ছা বিকেলে নিয়ে যাবো। খুশি?”
খুশিতে ঝুমঝুম করে ওঠে বলল ইচ্ছে,
-” থ্যাংকিউ মামা।”

দুপুরের পর ভাত ঘুম দিচ্ছে সবাই। যে যার রুমে। কেবল প্রত্যাশা ড্রয়িংরুমে বসে পড়ছে। কিছুটা অভিমান মনের কোণে পুষে মূলত নীরবকে এড়িয়ে চলতেই এখানে সে। ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে চারটের ঘর ছুঁয়েছে। এরমধ্যে নীলা এসে সামনের সোফায় বসল। প্রত্যাশা দুই হাতে বই সামনে মেলে আছে। নীলা ত্যাড়া সুরে বলল,
-” প্রত্যাশা, তুই পড়ছিস? নাকি আয়না ধরার মতো বই সামনে ধরে আছিস। কারন তুই যে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে পড়তি, পাশের বাড়ির লোকজনেরও কানের তালা ফেটে যেতো। তোর পড়ার ধরুন তো এমন ছিলো; গাছের পাতা সবুজ, গাছের পাতা সবুজ।”

প্রত্যাশা জবাব দিলো না। ইচ্ছে করল না।‌ মিনিট খানেক পর নীলা আবার চিরাচরিত স্বভাবে ব্যঙ্গাত্মক কণ্ঠে বলল,
-” তোর তো একদিক দিয়ে ভালোই হলো রে প্রত্যাশা। সারাবছর না পড়ে উড়নচণ্ডী হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছিস। এমনিতেই রেজাল্ট খারাপ আসতো। এখন তো ছুঁতো দিতে পারবি, বরের সেবা করতে গিয়ে ঠিকমতো পড়তে না পাড়ার জন্য রেজাল্ট খারাপ আসছে। কী কপাল তোর প্রত্যাশা, একদম টাইমিংটা দ্যাখ!”
প্রত্যাশা বইটা নিচের দিকে হালকা নামাতেই ওর চোখদুটো দেখা গেল। নীলার দিকে ভ্রু বাঁকিয়ে তাকিয়ে বলল,
-” আফসোস হচ্ছে তোমার?”
নীলা নির্বোধের মতন শুধাল,
-” আফসোস, কীসের আফসোস হবে?”

-” এইযে আমার রেজাল্ট খারাপ হলেও একটা ছুতো দিতে পারব। আম্মু বকবে না, বাকিরাও কিছু বলবে না। তুমি তো আর এই সুবর্ণ সুযোগ পাওনি। তাই ভাবলাম তোমার আফসোস হচ্ছে বুঝি!”
-” আমি কী তোর মতো গা’ধী মার্কা ছাত্রী ছিলাম নাকি? আ’জ’ব আমি ওমন__”
কথা কেড়ে নিয়ে প্রত্যাশা বলল,
-” মাঝে মাঝে তুমি এমন কথা বলো না, গাধারাও লজ্জায় পড়ে যায়।”
এরমধ্যে নীহারিকাকে আসতে দেখে দু’জনেই থেমে গেল। প্রত্যাশা একটু আতংকে ছিলো। রুম ছেড়ে এখানে পড়তে দেখে শাশুড়ি আবার কিছু সন্দেহ না করে। তবে নীহারিকা কোনো কিছু না বলে কিচেনে যায় বিকেলের নাস্তা বানাতে। শর্মিলাও খানিক পরেই কিচেনে যায়।
বেশ কিছুক্ষণ পর ডোরবেলটা বাজতে লাগলো। প্রত্যাশা কলম ঠোঁটের সাথে ধরে পড়া মনে করছিল। হঠাৎ নীহারিকার গলা এল,

-” প্রত্যাশা, দ্যাখো তো কে এল।”
প্রত্যাশা পেনটা বইয়ের ভাঁজে রেখে এগিয়ে গেল। কাঁধের একপাশে থাকা ওড়নাটা গায়ে ভালো করে জড়াল। দরজা খুলে সামনে তাকাতেই অপ্রস্তুত হয়। ইচ্ছে সামনে, পিছনে সার্থক দাঁড়িয়ে। প্রত্যাশা সাথে সাথে দৃষ্টি নামিয়ে ফেলল। সৌজন্যমূলকও কিছুই বলতে পারল না। শর্মিলা এগিয়ে আসতে আসতে জিজ্ঞেস করল,
-” প্রত্যাশা কে এসেছে?”
প্রত্যাশা ত্রস্ত ঘুরে দাঁড়াল। বলল,
-” ইচ্ছে।”
শর্মিলা ওদেরকে দেখেই অমায়িক হাসল। প্রত্যাশা তুরন্ত পা ফেলে চলে যায়। ইচ্ছে একগাল হেসে ‘ছোট দিদুন’ বলে কোমড় জড়িয়ে ধরে। শর্মিলা আদর করে। সার্থক সালাম দিয়ে বলল,
-” আন্টি ইচ্ছে থাকুক, রাতে আমি হসপিটাল থেকে ফেরার পথে ওকে নিয়ে যাবো। ও খুব জিদ করছিলো।”
শর্মিলা বলল,

-” ও মা সেকি তুমি ভেতরে আসবে না। তাই হয় নাকি। ভেতরে আসো। বসো, তারপর যেয়ো।”
এরমধ্যে ইচ্ছের গলার আওয়াজ পেয়ে নীহারিকা এগিয়ে আসেন। প্রত্যাশা বইগুলো তুলছিলো রুমে যাবে বলে। শাশুড়ির কথায় হাত থেমে যায়,
-” প্রত্যাশা একটু কিচেনে যাও তো। আমি আসছি।”
প্রত্যাশা হাঁফ ছেড়ে কিচেনে গেল। নীহারিকাকে দেখে নম্র স্বরে সালাম দেয় সার্থক। নীহারিকা সালাম নিয়ে বলল,
-” ভেতরে এসো।”
ছেলেটাকে উনার বেশ ভদ্রই মনেহয়। আর এভাবে গেলে খারাপ দেখায়, তাই সৌজন্যমূলক বলেন নীহারিকা।
শর্মিলা রুমে কোন একটা কাজে। নীলা তো ইহজনমের অলস। কাজের সময় তাকে পাওয়া যায় না। নীহারিকা নাস্তা রেডি করতে করতে প্রত্যাশাকে বলল,

-” ইচ্ছের মামা আছে ড্রয়িংরুমে। নাস্তাটা দিয়ে আসো।”
প্রত্যাশা কণ্ঠে অবাকতা নিয়ে বলে উঠল,
-” আমি!”
নীহারিকা ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল,
-” আলিশা বলে গেল শুনলে না, তোমার শ্বশুর ডাকছে। দেখি কী দরকার পড়ল তার আবার। তুমি বাকিটা রেডি করে দিয়ে এসো। আর পরীটাও হয়েছে দুনিয়ার ফাঁকিবাজ। আল্লাহর ত্রিশটা দিন ওর যেনো কোনো না কোনো সমস্যা লেগেই থাকে। এ বেলা নয়, ও বেলা ওর ছুটি লাগবেই।”
নীরবের ফোনটা বেজে উঠল। অধরার নম্বর দেখে কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ পড়ে। রিসিভ করে সালাম দিয়ে কথা বলার এক পর্যায়ে অধরা বলল,
-” প্রত্যাশাকে সেই কখন থেকে কল দিচ্ছি। রিং হয়ে বেজে বেজে কেটে যাচ্ছে। সকালে একবার কথা হয়েছে আর সারাদিন হয়নি।”

প্রত্যাশার ফোনটা টেবিলের উপর দেখে নীরব বলল,
-” ফোনটা বোধহয় সাইলেন্ট আছে, আপনি একটু লাইনেই থাকুন। আমি ওর কাছে দিচ্ছি।”
সার্থক টেবিলের উপর থাকা বইগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিলো। ইচ্ছে আনিশার সাথে সোফায় বসে মোবাইলে কার্টুন দেখছে আর গল্প করছে।
প্রত্যাশা কী করবে ঠাওর করতে পারছে না। শাশুড়ির কথা না শুনলে বেয়াদব ভাববে। আবার নীরব ওনাকে পছন্দ করে না। যার জন্য এত কিছু ঘটল। ওর প্রচন্ড অসহায় লাগল। ওর মনে হলো মেয়েদের কপালই পোড়া, এর মন রক্ষা করতে গেলে ওর মন রক্ষা হয় না। মাঝখান দিয়ে নীরিহ, নিরুপায় মানুষটিকেই দোষী হতে হয়। প্রত্যাশা প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে নাস্তার ট্রে নিয়ে গিয়ে টি-টেবিলে নামাল। নীরব রুম থেকে বেরিয়ে আসছিল। হঠাৎ পা জোড়া থমকে গেল। নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইল। চোয়াল শক্ত হয়ে আসে ওর। নীরব গম্ভীর গলায় বলল,

-” প্রত্যাশা?”
প্রত্যাশার পিলে চমকে উঠল। প্রত্যাশা মাথা তুলে তাকাল। যদিও ও এখান থেকে এক্ষুনি প্রস্থান করতো। নীরবকে দেখে ভ’য় জেঁকে ধরল, অজানা আশংকায় অস্থির হলো। নীরব হিম শীতল গলায় বলল,
-” রুমে আসো।”
প্রত্যাশা দুরুদুরু বুক নিয়ে এগিয়ে গেল। কাছাকাছি যেতেই নীরব এক অদ্ভুত কাজ করে বসল। প্রত্যাশার আঙুলের খাঁজে আঙুল মিশিয়ে কোমল স্বরে বলল,

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৩৩

-” কখন থেকে ডাকছি তোমায়? চলো দরকার আছে।”
সবকিছু যেনো প্রত্যাশার মাথার উপর দিয়ে গেল। বুঝতে কয়েক সেকেন্ড বিলম্ব হলো। মনে মনে গালি দিলো প্রত্যাশা। এএসপি সাহেব ফাজিল কম না। উনি নিশ্চয় তার শত্রুকে দেখিয়ে দিল, এতকিছুর পরেও তাদের সম্পর্ক ঠিক কেমন আছে!

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৩৫