মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৪৫

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৪৫
মুসতারিন মুসাররাত

-” প্রত্যাশা তোমার মধ্যে এখনো যথেষ্ট ম্যাচিউরিটি আসেনি। শুধু বাচ্চা জন্ম দিলেই হয় না। তাকে বড় করা, মানুষ করা সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। আমি মনে করি না তুমি এখন বাচ্চা সামলাতে পারবে। আরেকটা কথা আছে-‘আমাকে একজন সুশিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।’ কথাটা সত্যি। তোমার মধ্যে জানাশোনার অভাব আছে। তোমাকে পড়াশোনা করে জ্ঞানের বিকাশ ঘটাতে হবে। একদিকে তোমার বয়স কম, অন্যদিকে পড়াশোনাও বাকি। তোমার জন্য এখন বাচ্চা নেয়া উপযুক্ত সময় নয় প্রত্যাশা।”
প্রত্যাশা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে। নীরব একনাগাড়ে বলে যাচ্ছে,

-” বাচ্চা দু’জনের ভালোবাসায় যেমনি আসে, ঠিক তেমনি দুজনের ইচ্ছেতেও আসা জরুরী। সার্বিক দিক ভেবে আমি মনে করি___”
প্রত্যাশার বুকের ভেতর ঝড় উঠেছে। নীরব এভাবে বলবে কস্মিনকালেও ভাবেনি সে। কাঁপা ঠোঁটে ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করল,
-” কি?”
নীরব সোজাসাপ্টা বলল,
-” বাচ্চাটা অ্যাবরশন করাই বেটার।”
প্রত্যাশার বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠল। চোখ ভিজে এল মুহূর্তেই। অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,
-” নীর….ব।”
একহাতে মুখ চেপে ধরে প্রত্যাশা। কোনোরকমে ভেজা গলায় বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-” নীরব এটা আমাদের প্রথম বাচ্চা। অ্যাবরশন মানে তো খু”ন করা। নীরব আপনি নিজের বাচ্চাকে খু*ন করার কথা বলছেন। আপনি এতটা কঠিন আমি ভাবতে পারিনি।”
-” আমরা আবার বাচ্চা নেবো। তবে দু’জনের সিদ্ধান্তে, সঠিক সময়ে। আগে তোমার পড়াশোনা শেষ হোক। তোমার মধ্যে সিরিয়াসনেস আসুক।”
প্রত্যাশা সবেগে দু’পাশে মাথা নাড়ল। চোখ ভরা অশ্রু নিয়ে বলল,
-” আমি পারব না। এটা পা”প। আমি কিছুতেই এই পা”প করতে পারব না।”
নীরব কড়া গলায় বলল,

-” প্রত্যাশা আমি চাই না এখন বাচ্চাটা আসুক। আমার সাথে সংসার করতে চাইলে, আমি যা বলছি তাই করবে। বাড়তি কথা না বলে এখনই ডাক্তারের কাছে চলো। লেটস গো।”
ঘুমের মধ্যে অস্থিরভাবে নড়তে লাগল প্রত্যাশা। হঠাৎ ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। চোখ মেলে নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করে। বুকের ভেতর দ্রিমদ্রিম শব্দ হচ্ছে। হাঁপাতে লাগলো মেয়েটা। এতক্ষণে ঠাহর করে এটা স্বপ্ন ছিলো। একটু শুয়েছিলো আর চোখটা লেগে আসতেই দুঃস্বপ্নটা দেখে। ফোনে সময় দেখে রাত নয়টা চল্লিশ বাজে। নীরব রুমে নেই। সন্ধ্যায় বেরিয়েছে এখনো ফেরেনি বোধহয়। নীরবের মুখে এক ফোঁটা হাসিও দেখা যায়নি, কেমন নির্লিপ্ত আছে। স্বপ্নটা আবার সত্যি হবে না তো?
চোখেমুখে পানির ছিটা দিয়ে আলতো পায়ে রুম থেকে বেরোয় প্রত্যাশা। শাশুড়ির সাথে দেখা হতেই জিজ্ঞাসা করলেন,

-” নীরব কোথায় গিয়েছে? রাত দশটা বাজতে চলল এখনো ফিরল না যে?”
-” কী জানি, বলে যায়নি তো।”
-” ফোন দিয়েছিলে?”
-” নাহ।”
-” ফোন করে শোনো কখন ফিরবে। ওর ফিরতে দেরি হলে তুমি সবার সাথে খেয়ে নাও।”
তন্মধ্যে নীরব আসে। দুইহাত ভর্তি মিষ্টির প্যাকেটে। শর্মিলা ডায়নিংয়ে খাবার সাজাচ্ছিল। দেখেই বললেন,
-” ওমা নীরব তুই তো দেখছি মিষ্টির দোকান টাই তুলে এনেছিস। পা’গ’ল ছেলে এত মিষ্টি কেউ আনে।”
নীরব কিছু না বলে প্যাকেটগুলো রাখল। নীহারিকা বললেন,
-” ছোটো সবাইকে মিষ্টি দে। আর সকালে প্রতিবেশীদের বাড়িতে দেয়া যাবে।”
নীলাশা রুম থেকে বেরোতেই এসকল দৃশ্য তার চোখে পড়ে। বুক ফুঁড়ে তার দীর্ঘশ্বাস আর এক বুক না পাওয়ার আফসোস জমতে লাগল। মনে হচ্ছে কষ্টটা কগুণ বাড়ছে, এসব দৃশ্য তাকে বেশি পোড়াচ্ছে।

রাতের খাওয়া দাওয়ার পাঠ চুকিয়ে প্রত্যাশা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে বিনুনি করছিল। নীরব ফ্রেশ হয়ে এসে বেডে বসতে বসতে হালকা গলায় শুধাল,
-” ঔষধ খেয়েছো?”
-” হুঁ।”
-” মনে করে ঠিকঠাক সময় মতো ঔষধ খেয়ো। তোমার তো আবার ভুলে যাবার রোগ আছে।”
নীরবের শেষোক্ত কথাটা যে ত্যাড়া সুরে বলা তা প্রত্যাশা ধরতে পারল। আর পারল বিধায় রাগ হলো। হেয়ার ব্যান্ড চুলে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে রাগী গলায় বলল,
-” আপনি যে একটুও খুশি হোননি সেটা আপনার মুখ দেখে আর কথা শুনেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। লোক দেখাতে আর ছোটমা বলেছিল বিধায়ই মিষ্টি আনলেন। নিজ থেকে খুশি মনে তো আর আনেননি।”
একটু থেমে আকস্মিক প্রত্যাশা বলে উঠল,

-” নীরব আপনি কি সত্যিই চান না এই বাচ্চা? সন্ধ্যায় আমি এতকিছু বললাম, কিছুই বললেন না। এড়িয়ে গেলেন। তারপর সেই যে গেলেন মাত্র ফিরলেন।”
-” বাইরে হঠাৎ দু’জন ফ্রেন্ডের সাথে দেখা। অনেকদিন পর দেখা, কথাবার্তা বলতে বলতে একটু দেরি হয়ে গেল। আর বাচ্চা চাই না মানে কী বলতে চাইছো?”
প্রত্যাশা মিনমিনে স্বরে বলে,
-” কেনো জানি ভ’য় হচ্ছে। মনে হচ্ছে আপনি খুশি নন। যদি..যদি অ্যাবরশন করতে চান?”
নীরব ধ’ম’ক দিয়ে বলল,
-” পা’গল না হলে তুমি এমন ভাবনা আনতে পারো? অবশ্য তোমার মাথায় মাঝে মাঝে একটু-আধটু গোলমাল হয়। সেটা আমি জানি।”
প্রত্যাশা রাগী চোখে তাকাতেই নীরব হেসে ফেলল। হেসেই ঝটপট বলল,
-” স্যরি!স্যরি!”

প্রত্যাশা গাল ফুলিয়ে এড়িয়ে যেতে চাইলে নীরব ওর কব্জি ধরে টেনে সামনে দাঁড় করল। পরপর দুইহাতে কোমর জড়িয়ে একদম কাছে টেনে নিল। মাথাটা রাখল প্রত্যাশার বুকে। শক্ত করে জড়িয়ে ধীরেধীরে গভীর কণ্ঠে বলল,
-” শোনো প্রত্যাশা একটা ছেলের কাছে বাবা হওয়ার সুখবরের চেয়ে বড় আনন্দ আর কিছু নেই। এই সুখটা হুট করে, অপ্রত্যাশিতভাবে এলো বলে আমি অবাক হয়েছি। নিজেকে ধাতস্থ করতে আমার সময় লাগছে। তুমি জানো আজকের দিনটা আমার জীবনের অবিস্মরণীয় দিন হয়ে থাকবে। আমি কতটা হ্যাপি ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।”
উষ্ণ একটা হাত প্রত্যাশার মসৃণ নরম তুলতুলে পেট ছুঁয়ে গেল। প্রত্যাশা চোখবুঁজে ফেলল। নীরব আলতো করে হাতটা বুলিয়ে ফিসফিস করে বলল,

-” আমার র*ক্ত, আমার অংশ, তোমার গর্ভে। ভাবলেই আমার বুক ভরে যাচ্ছে আনন্দে। মনে একটুকরো শীতল প্রশান্তির স্রোত বইছে। নাম না জানা অনুভূতিতে আমি শিহরিত। আমার ফিলিংসটা আমি ঠিকঠাক ভাষায় প্রকাশ করে বোঝাতে পারছি না। পৃথিবীর সবচেয়ে হ্যাপি নিজেকে মনে হচ্ছে।”
প্রত্যাশার ঠোঁটে হাসি ফুটল। বুকের উপর জমা দুশ্চিন্তার পাথরটা নিমিষেই হাওয়ায় উড়ার মতো উড়ে গেল। প্রত্যাশার একটা হাত নীরবের চুলের ভাঁজে যায়। প্রত্যাশা হাঁফ ছেড়ে আলতো গলায় বলল,
-” উফ্! টেনশন হচ্ছিল। যাক এবারে টেনশন ফ্রি হলাম।”
নীরব মাথাটা তুলে প্রত্যাশার মুখের দিকে চাইল। মুখে হাসি নিয়েই বলল,

-” তবে আমার কিন্তু টেনশন বাড়ছে। আমার বাচ্চাটাকে ঠিকঠাক সামলাতে পারবে তো তুমি?”
-” আমি না পারি, আপনি তো আছেন।”
বিনিময় নীরব ঠোঁট ছাড়িয়ে হাসল। পরপর প্রত্যাশার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে টুপ করে পেটের উপর চুমু খায় নীরব। মিষ্টি আদুরে কণ্ঠে বলল,
-” হেই আমার ছোট্ট বেবি। মাই লিটল হার্টবিট তাড়াতাড়ি এসো। পাপা এখন থেকেই তোমার আগমনের প্রহর গুণা শুরু করে দিয়েছে। তোমাকে ওয়েলকাম জানানোর জন্য পাপা পুরো হৃদয়টা প্রস্তুত করে রেখেছি। তুমি আসলেই আমাদের পৃথিবীটা সম্পূর্ণ হবে।”
প্রত্যাশা হেসে ফেলল। নীরব ছোট ছোট চুমুতে ভরিয়ে দিল। শেষে একটা গভীর চুমু এঁকে দুষ্টু আদুরে ভঙ্গিতে বলল,
-” তুমি আমার অস্তিত্বের ধারাবাহিকতা। হেই লিটল হার্টবিট শোনো পাপার ভিতরে কিন্তু অজস্র এক্সাইটমেন্ট অলরেডি জমতে শুরু করেছে। তাড়াতাড়ি এসো। পাপা তোমাকে দুনিয়ার সব চুমু সব ভালোবাসা দিতে প্রস্তুত।”

বিছানায় শুয়ে নীলাশা। দু’চোখের পাতায় ঘুম নামছে না। হঠাৎ বলে উঠল,
-” নিভান আম্মু বাড়ি যাওয়ার কথা বলছিলো। আমি বরং কিছুদিন বাড়ি গিয়ে থাকি।”
নীলাশার মনের অবস্থা নিভান বুঝতে পারছে। গত কয়েকদিনের তুলনায় আজ যেন আরও বেশি ভেঙে পড়া, ক্লান্ত, বিমর্ষ লাগছে নীলাশাকে। অবশ্য লাগাটা অস্বাভাবিকও নয়। এই কষ্ট নিভানও জানে, এই অনুভূতির সাথে তারও পরিচয় আছে। অফিসে বসে সহকর্মীদের বাচ্চা নিয়ে হাসাহাসি, খুনসুটি শুনতে শুনতে তার বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠে। ওরা ফোনে বাচ্চাদের খবর নেয়, অফিস শেষে ছুটে বাড়ি ফেরে। এইসব তো নিভানেরও চাওয়া ছিল একসময়। কিন্তু নিয়তির নিষ্ঠুর হাতে সে স্বপ্ন ভেঙে গেছে।
প্রত্যাশাকে সামনে দেখলে নীলাশার কষ্ট আরও বাড়বে, ভেতর থেকে ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল। তাই নিভান মনেমনে বদলি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। নিভান নিম্ন স্বরে বলল,

-” অফিস থেকে যেকোনো সময় আমাকে বদলির নির্দেশ আসতে পারে। একবার নির্দেশ এলে বাসা দেখে তোমাকে নিয়ে যাবো। কিন্তু প্লীজ, আর মন খারাপ করে থেকো না। তুমি যদি সবসময় এমন মুখ করে থাকো, বলো তো, সেটা আমার ভালো লাগে নাকি? সত্যি বলো, ভালো লাগে?”
নিভানের বুকের উপর মাথাটা রেখে নীলাশা উদাস গলায় বলল,
-” প্রত্যাশাটা কত লাকি। আর আমি?”
মনে মনে তাচ্ছিল্য হেসে অবচেতনেই বলে নীলাশা,
-” সারাজীবন এর জন্য প্রত্যাশার থেকে পিছিয়ে গেলাম। হেরে গেলাম আমি। আমার মনেহয়, প্রত্যাশাকে সবসময় হেয় করা, ওকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার জন্যই প্রকৃতি থেকে শা”স্তি পাচ্ছি।”

তিন-চারদিন পর…
প্রত্যাশা দু’দিনের যায়গায় তিনদিন আছে ও বাড়ি। নীরব সকালে ফোন দিয়ে বলে–আজকে ব্যস্ত থাকবে। অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যাবে। তাই প্রত্যাশাকে আনতে যেতে পারবে না।
শুনে তো প্রত্যাশা খুব খুশি হয়। যাকগে সে আরো একটা দিন বেশি থাকতে পারবে। ন্যানো সেকেন্ডের মধ্যেই প্রত্যাশার সে খুশি উবে যায়। নীরবের পরবর্তী কথা থাকে– বাবা দুপুরে যাবে। বাবার সাথে চলে আসবে।
লোকটা আচ্ছা খারাপ লোক। বাড়তি একদিনও তার সহ্য হচ্ছে না। প্রত্যাশা না না করে। কাটকাট গলায় বলে– আপনি আসলে তবেই যাব। বাবাকে বলুন, এমনি ঘুরে যেতে। আমি আজ থাকব। যেতে-টেতে পারব না।
নীরব ভণিতা ছাড়া সোজাসুজি বলে– চলে আসবে।

প্রত্যাশা গাল ফুলিয়ে থাকে। আম্মু বুঝিয়ে বলে তারপর সে আসে।
এসেই রুমটা অগোছালো পায়। সোফায় নীরবের টিশার্ট, শার্ট-প্যান্ট পরে আছে। বিছানার চাদর ঘুচানো। বেডশিট তুলে কাচা বেডশিট টানটান করে পারল, পিলো কাভার ভরল। শার্ট-প্যান্ট গুছিয়ে পরপর বেডশিট ওয়াশিংমেশিনে দিয়ে আসে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে পারফিউম গুলো গুছিয়ে সবকিছু ঠিকঠাক করে রাখল। অবশেষে ফ্রেশ হয়ে বিছানার হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে শোয়।
আম্মু কয়েক রকমের আচার দিয়ে দিয়েছে। আচারের বয়ামটা পাশে রেখে খেতে খেতে ফোনটা হাতে নিয়ে নীরবের নম্বরে ভিডিও কল দেয়।

বউয়ের ভিডিও কল দেখেই হাতের ফাইল দূরে ঠেলে কল তুলল নীরব। প্রত্যাশার হাতে আমের মোরব্বা একটু মুখে নিতেই ফোনের স্ক্রিনে নীরবের ছবি ভেসে উঠল। প্রত্যাশা মিষ্টি হেসে লম্বা করে সালাম দিল,
-” আসসালামুয়ালাইকুম এএসপি সাহেব। খুব ব্যস্ত আছেন?”
-” ওয়ালাইকুমুস সালাম মাই মিসেস। উঁহু! এতক্ষণ ব্যস্ত ছিলাম। এখন সব ব্যস্ততা একদিকে আর বউ আরেকদিকে। আমি আবার বউয়ের দিকেই।”
প্রত্যাশা হেসে ফেলল। বলল,

-” লাঞ্চ করেছেন?”
-” হুঁ।”
-” তো বেবির পাপা ফিরছেন কখন?”
-” বেবির মাম্মা কী আমাকে মিস করছেন?”
-” নাহ।”
নীরব কণ্ঠে আফসোস মিশিয়ে ফাজলামো করে বলল,
-” ভেরি ব্যাড।”
প্রত্যাশা ঠোঁট প্রসারিত করে হাসল। নীর জিজ্ঞাসা করল,
-” কখন এসেছো?”
-” তিনটার দিকে।”

-” বাসায় ফেরার সময় তোমার জন্য কী আনব? আইসক্রিম বাদে অন্যকিছু বলবে কিন্তু।”
প্রত্যাশা ঠোঁট উল্টে ফেলল।
-” উম, লাগবে না কিছু।”
-” আচ্ছা যাও বলতে হবে না। তোমার ফেভরিট রসমালাই হলে চলবে?”
আরো কিছুক্ষণ কথাবার্তা শেষে কল কা*টে।

সন্ধ্যার নাস্তা বানাচ্ছে নীলাশা। প্রত্যাশা কিচেনের দিকে আসতেই নীহারিকা দেখে বারণ করলেন। কিচেন থেকেই সেই কথা নীলাশার কানে গেল। এসব কিছু নীলাশার কাছে আদিখ্যেতা মনে হচ্ছে। প্রত্যাশা আপুকে সাহায্য করবে বলে আসলো। প্রত্যাশা আসতেই নীলাশা বলল,
-” মা বারণ করল, আবার আসতে গেলি কেনো? যা রুমে গিয়ে শুয়ে থাক। তোরই তো কপাল।”
প্রত্যাশা গায়ে না মেখে বলল,
-” আপু দাও আমি পেঁয়াজ কুচি করে দিই। তোমার ঝাঁঝ লাগছে দেখছি।”
পেঁয়াজ কুচি করতে গিয়ে নীলাশার চোখ দিয়ে পানি বের হচ্ছে। হাতের উল্টোপাশ দিয়ে মুছে নিয়ে তাচ্ছিল্য হেসে বলল,

-” তোকে কাজ করতে দিয়েছি দেখলে বাড়ির সবাই আমাকেই কথা শোনাবে।”
কথাটা বলতে বলতে নীলাশা –‘আহ’ শব্দ করে ওঠে। ছু’রিতে আঙুল কে”টে যায়। মূহুর্তেই র*ক্ত বেরোতে থাকে। প্রত্যাশা আর্তনাদ করে ওঠে,
-” ইয়া আল্লাহ, হাত কে”টে নিলে তো। দাঁড়াও আমি ফাস্ট এইড বক্স আনছি।”
এই বলে দ্রুত রুমে যায় প্রত্যাশা। ফাস্ট এইড বক্স হাতে হন্তদন্ত পায়ে কিচেনে ঢুকতে গিয়ে ফ্লোর ভেজা ছিলো স্লিপ খায়। অল্পের চেয়ে পরতে পরতে দেয়াল ধরে নিজেকে সামলে নেয়। নীহারিকাও মাত্রই এসেছেন। এই দেখে অসন্তুষ্ট চাহনিতে চেয়ে হৈচৈ করে উঠলেন,
-” ইয়া মাবুদ, এখনি তো যাচ্ছিলে পরে। এইসময় এত দৌড়াদৌড়ি কেউ করে। তোমাকে নিয়ে আর এমনি এমনি তো টেনশন হয় না। কোনদিন কী অঘটন ঘটিয়ে বসো আল্লাহ জানে।”
প্রত্যাশা বুকে হাত দিয়ে দম ফেলে বলল,

-” কিছু হয়নি মা। ঠিক আছি আমি।”
নীলাশা আঙুল ধরে দাঁড়িয়ে। অনেকটাই কে”টেছে। নীহারিকা তাকে বলে উঠলেন,
-” আর নীলাশা তোমাকে বলি, কীভাবে কাজ করো? একটু কাজ করতে এসেই অকাম করে বসে থাকো। আরো ঝামেলার সৃষ্টি করো।”
শাশুড়ির কথা শুনে সমস্ত রাগ-ক্ষোভ গিয়ে প্রত্যাশার উপর বর্তায়। এখন মনে হচ্ছে — প্রীতি ঠিকই বলেছে সবার চোখের মণি প্রত্যাশাই হবে। বাচ্চা হয়নি, হবে তাই এই অবস্থা। বাচ্চা হলে তো মনেহয় তাকে কেউ দেখতেও পারবে না।
প্রত্যাশা এক টুকরো তুলোতে এন্টিসেপটিক লাগিয়ে নীলাশার আঙুল ধরতেই সে এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নিল। রুক্ষ স্বরে বলল,

-” সর তুই, নাটক করিস না। তোর নাটক আমার সহ্য হচ্ছে না। তোর এই ভালো মানুষি স্বভাব অন্যদের দেখাস, আমাকে নয়।”
প্রত্যাশা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। নীহারিকা বিরক্ত গলায় বলেন,
-” নীলাশা এটা কী ধরণের আচরণ? ছোট বোনের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে। শুধু আজ নয়, এর আগেও আমি লক্ষ্য করেছি। আমার নজর এড়ায়নি। তুমি প্রত্যাশার সাথে শুধু শুধু কেমন রুঢ় আচরণ করো। আমি আর ছোট জা। কখনো দেখছো এভাবে কথা বলতে? বাড়িতে সবার আচরণ কেমন, সেটা দেখেও তো শিখতে পারো। তোমার জন্যই এখন একটা দূর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল। আল্লাহ বাঁচিয়েছেন। তারপরেও তুমি…ছিহ। নিজের ছোট বোনের সাথে কেউ কখনো এরকম বিহেভ করে?”

নীলাশার ভেতরের রাগ-ক্ষোভ, ক্রোধ, হিংসা সব যেন একসাথে দপ করে জেগে উঠল। শাশুড়ি আগে কখনো এভাবে বলেনি। আজ বললেন। তাও শুধু… শুধুই প্রত্যাশার জন্যে। নিজেকে সামলাতে না পেরে নীলাশা চেঁচিয়ে উঠল,
-” কীসের ছোট বোন। ওর জন্মই হয়েছে আমার থেকে সবকিছু কেড়ে নেয়ার জন্যে। আমার আব্বু-আম্মুর আদরে ও উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। এখন আবার আমার শ্বশুরবাড়ির সবার কাছে আমাকে খারাপ বানাচ্ছে। নিজে প্রিয় হচ্ছে।”
চেঁচামেচি শুনে শর্মিলা প্রীতি এসে দরজায় দাঁড়ায়। নীহারিকা বললেন,
-” মনে হচ্ছে মাথা গেছে তোমার। তোমার আব্বু আম্মুর আদরে ও উড়ে এসে ভাগ কেনো বসাবে। কী বলছো না বলছো নিজেই জানো না। আশ্চর্য!”

প্রত্যাশা ছলছল চোখে চেয়ে। এত চেঁচামেচি মনে হচ্ছে তারজন্যই হচ্ছে। খারাপ লাগছে। প্রীতি মনেমনে ভাবছে– নীলাশা বলে দেয় না কেনো? এই মেয়ে এখনো চুপ আছে কেনো? আজব তো!
নীলাশার গাল গড়িয়ে জল পরছে। প্রীতি ওর দিকে তাকিয়ে ইশারায় ইন্সপায়ার করতে থাকে। এখনো চুপ দেখে প্রীতি ভাবে; এবারে সে নিজেই বলে দিবে কী? প্রীতির তো আবার পিছুটান নেই। যার কিছুই নেই, তার তো হারানোর ভ’য় নেই। এমনিও এ বাড়ির লোক তাকে তেমন পছন্দ করে না। যা ভাবার ভাবুক গে।
প্রীতি মুখ খুলবে তার আগেই নীলাশা বলে উঠল,

-” আমি ঠিকই বলছি। ও উড়ে এসেই জুড়ে বসেছে। প্রথমে আমার আব্বু আম্মুর কাছে আমার থেকেও ও প্রিয় হয়েছে। এখন আবার আমার শ্বশুরবাড়িতে সবার কাছে ও প্রিয় হচ্ছে। ও আমার জন্য অভিশাপ।”
নীহারিকা ধ’ম’কিয়ে উঠলেন,
-” নীলাশা। এবারে থামো। নিজের আপন বোনকে কেউ এতটা হিংসা করতে পারে তোমাকে না দেখলে জানতাম না।”
নীলাশা ভেজা কণ্ঠস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে,

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৪৪

-” প্রত্যাশা আমার আপন বোন নয়। ওর সাথে আমার কোনো র’ক্তের সম্পর্ক নেই। ও অন্যকারো পা’পের ফল। আমার আব্বু-আম্মু দয়া দেখিয়ে ওকে নিজের সন্তানের মতো করে বড় করেছে।”
প্রত্যাশা থমকে গেল। মনে হচ্ছে ভূমিকম্প হচ্ছে, পুরো পৃথিবী টলছে। আচমকা দু’পা পিছিয়ে যায় প্রত্যাশা। এতবড় কথা কেউ কখনো মিথ্যে, বানোয়াট বলে না। নীহারিকার মাথায় মেঘ বিনা বজ্রপাত হলো যেন।

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৪৬