মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৫

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৫
মুসতারিন মুসাররাত

নীরবের মুখাবয়ব দেখে কিছুই বুঝে উঠতে পারল না প্রত্যাশা। লোকটা যেন পাথরের মূর্তি; নড়েও না, চড়েও না। শুধু শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। বিস্ময়, রাগ, বি’র’ক্তি–একটা ভাবও স্পষ্ট নয়। মনে হচ্ছে কোনো মুখোশ পরা মুখ, যার নিচে কী আছে বোঝা দুঃসাধ্য! এমন সময় রান্নাঘর থেকে অধরা বেরিয়ে প্রত্যাশাকে দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে দেখে এগিয়ে আসতে আসতে জিজ্ঞেস করলেন,
-” প্রত্যাশা, কে এল রে?”
প্রত্যাশা উত্তর দেবার আগেই অধরার চোখে পড়ল দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা নীরবকে।
-” আরে নীরব তুমি!”
অধরার কণ্ঠে চমকের সাথে একটা প্রশ্রয়মাখা উষ্ণতা। প্রত্যাশার দিকে বি’রক্ত চোখে চেয়ে বললেন,
-” প্রত্যাশা, এতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখেছিস কেনো ওকে? ভেতরে আসতে দে। এই মেয়েটাকে নিয়ে পারি না। তুমি ভেতরে এসো বাবা, এসো।”
শেষের কথাটা নীরবের দিকে চেয়ে হাস্যজ্জ্বল মুখে বললেন। নীরব এবার মাথা হালকা নিচু করে সালাম দিলো,

-” আসসালামুয়ালাইকুম, আন্টি।”
গলায় ভদ্রতার পরিপাটি ছাঁট, শরীরভঙ্গিতে রুচিশীল কার্টেসি। অধরা হেসে উত্তর দিলেন,
-” ওয়ালাইকুম আসসালাম বাবা, এসো, এসো।”
প্রত্যাশা একটু সরে গিয়ে পথ করে দিল। তবু চোখ নীরবের মুখ ছাড়ল না। মনে মনে জ্ব’লে উঠল—এই লোকটা কী! একটা মুখভঙ্গি তো করা যায়, রা’গ, রসিকতা, বি’রক্তি কিছুই নেই। সব যেন এক বিষণ্ন নিঃশব্দে ডুবে আছে। মিস্টার আনপ্রেডিক্টেবল! একে দেখে কিছুই বোঝা যায় না! ঠিক কী ভাবছে, কী করবে–সবই রহস্য!
নীরব পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকার সময় এক মুহূর্তের জন্য প্রত্যাশার সাথে চোখাচোখি হলো। চোখে কোনো ঝ’ড় নেই, তবু যেন এক ধরণের চুম্বকীয় টান–শান্ত অথচ গভীর। আকস্মিক প্রত্যাশার বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠল।
নীরব হাতের প্যাকেটগুলো টি-টেবিলের উপর নামাল। অধরার কণ্ঠে হালকা জড়তা, তবু কোমলতা ঝরল প্রতিটি শব্দে। বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-” এই সব আনার কী দরকার ছিল বাবা? নিভান তো একটু আগেই একগাদা ফল আর মিষ্টি নিয়ে এসেছে। আবার এত কিছু…”
নীরব মূহুর্তেই বুঝে নেয়—তারমানে ভাইয়া তাকে এখানে আনার জন্য…ফোনে ওরকম বলেছে। নীরব বিনয়ে ভরা এক চেহারা নিয়ে সোফায় বসল। কথোপকথনে সৌজন্যতার রেখা আঁকল,
-” ব্যাপার না আন্টি। সামান্য কিছুই তো…”
অধরা জিজ্ঞেস করলেন,
-” তোমার বাবা-মা কেমন আছেন? ভাই সাহেবকে আসতে বলা হয়েছিল, বললেন একটু ব্যস্ত…।”
-” জ্বী, আলহামদুলিল্লাহ, সবাই ভালো আছেন। আংকেলকে দেখছি না?”
-” তোমার আংকেল একটু বাজারে গিয়েছে বাবা। এসে পড়বে এক্ষুনি।”
একটু দূরে দাঁড়িয়ে, ঠোঁটের কোণে এক তুচ্ছ তাচ্ছিল্য হাসি টেনে প্রত্যাশা বিড়বিড় করল,
-” মিস্টার আনপ্রেডিক্টেবল হতে পারে হাইয়ার এডুকেটেড, বাট সম্পর্কের ভদ্রতা বোঝার বেলায় পুরোপুরি ব্যাকবেঞ্চার! শ্বশুর-শাশুড়িকে ‘আন্টি-আঙ্কেল’ বলে সম্বোধন করে কেউ? যদি আমার কাছে সম্পর্ক নিয়ে কোনো হ্যান্ডবুক থাকত, আমি নির্দ্বিধায় এক কপি ওনার হাতে তুলে দিতাম! হুঁ।”
চোখে নিখুঁত কটাক্ষ আর মনেমনে এক টুকরো তৃপ্তি নিয়ে এসব আওড়িয়ে নিজ রুমের দিকে পা বাড়াল প্রত্যাশা।

নীলা, নিভান আর নীরব পাশাপাশি চেয়ারে বসে, আর ঠিক তাদের বিপরীতে, শফিক সাহেবের পাশের চেয়ারে বসেছে প্রত্যাশা। নীরবের একেবারে সামনাসামনি। প্রত্যাশা এক হাতে খাবার মুখে তুলছে, আর আড়চোখে মাঝে মাঝেই তাকাচ্ছে নীরবের দিকে–চুপিচুপি, কিন্তু স্পষ্টভাবে লক্ষ্যযোগ্য। ডাইনিং টেবিলজুড়ে একধরনের হালকা, সম্মানসূচক পরিবেশ। শ্বশুর আর দুই জামাই ধীরে-সুস্থে খাচ্ছেন, মাঝে মাঝে দু-একটা কথা চালাচালি হচ্ছে। মূলত শফিক সাহেব কিছু বললে, তার জবাবে জামাইরা মাথা নেড়ে বা সংক্ষিপ্তভাবে উত্তর দিচ্ছে। তবে এই পুরো মুহূর্তে সবচেয়ে ব্যস্ত অধরা। ভালোবাসা আর আন্তরিকতায় জামাইদের পাতে বারবার কিছু না কিছু তুলে দিচ্ছেন। যেন তার জামাইরা একটু কম না খায়। যত্ন আর সৌজন্যে টেবিলজুড়ে একটা কোমল, ঘরোয়া উষ্ণতা ছড়িয়ে আছে। নিভান হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,

-” নীলার পরীক্ষা তো শেষ রবিবারে। সেদিনই ওকে নিতে আসবো। এদিকে বাবা হজে যাচ্ছেন সোমবার রাতের ফ্লাইটে। বললেন, রবিবার নীলার সঙ্গে যেন প্রত্যাশাকেও নিয়ে আসি।”
ভাতের প্লেটে থাকা শফিক সাহেবের হাতটা থেমে গেল। এক মুহূর্তের জন্য চুপ করে থেকে, মুখের খাবার দ্রুত গিলে নিয়ে অবাক গলায় বললেন,
-” প্রত্যাশা?”
-” মানে, বাবা চাচ্ছেন প্রত্যাশা যেভাবে আগেও যেত, সেভাবেই যাক। দু’একদিন সবার সঙ্গে ঘুরে-ফিরে আসবে। এতে সবার সঙ্গে জানাশোনা হবে, পরিবেশটা চেনাজানা হয়ে যাবে। যাতে করে পরবর্তীতে ওর কোনো অসুবিধে না হয়।”
-” হ্যাঁ…”
একটি মাত্র শব্দে সৌজন্য প্রকাশ করলেও শফিক সাহেবের চোখে-মুখে দ্বিধা স্পষ্ট। কী বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না! চোখাচোখি হতেই অধরা যেন মৌন ভাষায় স্বামীকে কিছু বোঝালেন। শফিক সাহেব স্ত্রীর চোখে নিভানের প্রস্তাবে সম্মতি পড়ে নিলেন। তাই আর আপত্তি না করে বললেন,
-” ঠিক আছে বাবা। ভাই সাহেব যেহেতু নিজে বলছেন, না করার উপায়ই বা কী? আচ্ছা।”
প্রত্যাশার মুখটা গম্ভীর হয়ে যায়। তার মনে পড়ে গেল বিয়ের দিন আম্মু-আব্বুর বলা কথা। দুজনেই বলেছিলেন, সে এখনই কোথাও যাবে না। তাদের সাথেই থাকবে। আম্মুকে যাব না বললে; এইসেই বলে বোঝাতে থাকবে। দু’একদিনেরই তো ব্যাপার। হ্যানোত্যানো বলবে। তাই প্রত্যাশা মনেমনে বুদ্ধি পাকাতে থাকে–কীভাবে আব্বুকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ম্যানেজ করবে। ওর বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট নেই ও বাড়িতে ঘুরতে যাওয়ার। আপুর শ্বাশুড়িকে ওর এলার্জি লাগে।

প্রত্যাশার রুমের বিছানায় নীরব বসে। পা দুটো আলতো ছুঁয়ে আছে মেঝেতে, পিঠ সোজা, চোখে অভ্যস্ত গাম্ভীর্য। হাতে ধরা ফোনে কিছু একটা স্ক্রল করছে, অথচ চেহারায় কোনো বিশেষ ভাব নেই। মনে হচ্ছে চারপাশের সবকিছু তার নিয়ন্ত্রণে, তবু মনটা কোথাও নির্লিপ্ত। প্রত্যাশা আর নীরবকে কথা বলার জন্য সুযোগ করে দিতে; অধরা প্রত্যাশাকে বলে– ‘নীরবকে বিশ্রামের জন্য ওর রুমে নিয়ে যেতে।’
প্রত্যাশা টেবিলের পাশে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে। দুই হাতের তালু ঘষছে। এক ধরনের অস্থিরতা জমে উঠেছে ওর ভেতরে। চোখের কোণ নীরবের দিকে যাচ্ছে, তো আবার হুট করেই সরিয়ে আনছে। নিজেই টের পাচ্ছে মনটা কেমন যেন এলোমেলো লাগছে। মাথায় উঁকি দিচ্ছে অদ্ভুত সব চিন্তা। অবচেতন মনটা হঠাৎ ভাবল– ফাঁকা রুম। নিরিবিলি পরিবেশে, একই রুমে শুধু তারা দু’জন। এখন নীরব কী বর বর আচরণ শো করবে? হাগ? বা কিস?

এই ভাবনা মাথায় আসতেই ওর একটা হাত ঝটিতি ঠোঁটের ওপর চলে যায়। চেপে ধরে রাখে, বুকের ভিতর ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। কথা নেই বার্তা নেই, এরকম কিছু হলে ও নির্ঘাত অক্কা পাবে। এরকম কিছু যাতে না ঘটে সেইজন্য ঠোঁটের উপর ধরা হাতটা এঁটে রাখল। যারা বেশি চুপচাপ অতি ডিসেন্ট এটিটিউড শো করে–তারাই আবার তলে তলে মিচকা শ’য়’তান হয়। না জানি কখন কী অঘটন ঘটায়। এইসব ভাবার কিছুপল পর সহসাই মনেমনে নিজেকে তিরস্কার করে প্রত্যাশা। অদৃশ্য হাতে মাথায় চাটি মে”রে বিড়বিড় করে– ধুর! কোত্থেকে কীসব ভাবনা আসছে!
নীরব ফোন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে প্রত্যাশার দিকে চাইল। নীরবের শান্ত চাহনিতে প্রত্যাশার বুকের ভেতর ছোটখাট ভূমিকম্প বয়ে গেল। নীরব শান্ত গলায় প্রশ্ন ছুঁ’ড়ল,
-” তুমি কি কিছু বলতে চাচ্ছিলে?
প্রত্যাশা চোখ কুঁচকে তাকায়। কী বলবে?–‘আপনাকে নিয়ে আজে বাজে চিন্তা করছিলাম’–এটা বলা যায়? নাহ্‌! স্রেফ মাথা নাড়ল। তড়িঘড়ি করে বলল,

-” ক-কই, কিছু না তো।”
এতটুকু বলে মুখের উপর থাকা চুলগুলো একহাতে কানের পিঠে গুঁজে নেয়। পরপর জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে বাইরের আকাশে দৃষ্টিজোড়া মেলে ধরল। কিন্তু মনটা তখনো ঘূ’র্ণিঝ’ড়ে। মনে হলো– নীরব কি তার মনের কথা কিছুমিছু বুঝে ফেলল নাকি? ইয়া আল্লাহ! একে কী সাধে মিস্টার আনপ্রেডিক্টেবল বলি!
-” ওহ্!” ছোট করে জবাব দিয়ে নীরব ফের ফোনে দৃষ্টি রাখে। ওদিকে প্রত্যাশা বেশিক্ষণ চুপচাপ স্থির থাকতে পারে না, এটা ওর এক সমস্যা। অনগড়ল কথা না বললে ওর শান্তি মেলে না। তবে এই মানুষটার সামনে কেমন যেন ওর সবকিছু গুলিয়ে আসছে। নীরবও কিছু বলছে না জন্য ও বোর হতে থাকে। বেশিক্ষণ মুখ বন্ধ করে থাকতে না পেরে আচমকা বলে উঠল,
-” আপনি বোধহয় আপনার নামের সাথেই বেশি খাপ খেয়ে যান।”
নীরব ফোনটা বেডে নামিয়ে রেখে সম্পূর্ণ মনোযোগ প্রত্যাশার দিকে ফেরাল। চোখে গভীর দৃষ্টি, ডান ভ্রু সামান্য উঁচু করে জিজ্ঞেস করল,

-” মানে?”
-” মানে একদম সোজা। যখনই আপনাকে দেখেছি চুপচাপ। খুব বেশি কথা বলেন না। যেন নিজেই নিজের ‘নীরবতা’ মেইনটেইন করে চলেন। ঠিক যেন আপনার নামের মতোই।”
নীরব কিছু না বলে নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকল। চোখে যেন একরকম জিজ্ঞাসা ও রহস্যের মিশেল। প্রত্যাশা হালকা হেসে অনগড়ল বলতে থাকল,
-” তবে দেখছি, এই জায়গায় আপনি আর আমি একদম বিপরীত। আপনি ‘নীরব’— নীরবতায় ডুবে থাকা, আর আমি ‘প্রত্যাশা’— প্রত্যাশাহীন। কারো কাছ থেকে কিছুই প্রত্যাশা করি না। একদম নামের উল্টো।”
প্রত্যাশা দাঁত বের করে হেসে ফেলল। নীরব ঠোঁটের কোণে একফোঁটা চতুর হাসি টেনে ধীর স্বরে বলল,
-” তুমি বলছো, কোনো প্রত্যাশা রাখো না। অথচ একটু আগেই তোমার চোখে স্পষ্ট দেখেছিলাম, তুমি চাইছিলে আমি কিছু বলি। সেটাও তো– ওয়ান কাইন্ড অফ এক্সপেক্টেশন।”
প্রত্যাশা অবাক! কীভাবে বুঝল সে! হ্যা চেয়েছিল…. তবে সে তো মুখে কিছু বলেনি। ভাবনার ঝাঁপটা সামলাতে না পেরে খানিকটা হকচকিয়ে বলে উঠল প্রত্যাশা,
-” এই যে! কখন আমি চাইছিলাম আপনি কিছু বলুন? একদম না‌ আপনার ভুল হচ্ছে নিশ্চয়।”
নীরব একরাশ বুদ্ধিদীপ্ত অভিব্যক্তি নিয়ে ভ্রু সামান্য কুঁচকে শুধু বলল,

-” ওও…তাই!”
-” হুম।”
তন্মধ্যে বেডের উপর থাকা ফোনে আলো জ্বলে উঠল। ফোন সাইলেন্ট থাকায় স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছিল কলার নেম। নীরব ফোনটা হাতে তুলে প্রত্যাশার দিকে তাকিয়ে বলল,
-” এক গ্লাস ঠান্ডা পানি…”
প্রত্যাশা দ্রুত মাথা নাড়ল,
-” নিশ্চয়, আনছি।”
কথা শেষ করেই পা বাড়িয়েছিল, ঠিক তখনই যেন হঠাৎ একটা অদ্ভুত টান লাগল মনে–পানি? কল আসার সাথে সাথে গলা শুকিয়ে গেল! ব্যাপারটা একটু বেশিই স্ট্রেইঞ্জ! নাকি ইচ্ছাকৃতই সামনে ফোনটা ধরল না? ব্যক্তিগত স্পেস? তাহলে কি ওপাশের মানুষটা… কোনো মেয়ে?
এই ভাবনা মাথায় আসতেই প্রত্যাশার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। চোখে মুখে রা’গ স্পষ্ট। আরে ভাই বিয়ের আগে যদি প্রেমট্রেম করে থাকিস, সেসব অতীতের কথা, মানা যায়। উদারমনস্ক মানুষ হয়ে সে অতীত মাফও করে দিতে পারি। কিন্তু এখনো যদি ফোনে ইটিসপিটিস চলতে থাকে, তবে তো বোঝাই যাচ্ছে; চরিত্রেই গ’লদ।
প্রত্যাশা মনের ভেতর দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল–এই লোকের একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে। ছবিটার আসল রহস্যটাও ফাঁস করতে হবে। এইজন্য হলেও ওই বাড়িতে যাওয়া জরুরী। এইজন্য হলেও রবিবারে ও বাড়ি যাবে; তাও একটা গোয়েন্দা মুডে। চিরুনি তল্লাশি হবে, সাবধানে। যদি এবার অদ্ভুত কোনো ছবি বা প্রমাণ পায়–তক্ষুনি ভাইরাল করবে দুই পরিবারে। আর তখন?

প্রত্যাশা চোখ বুজে কল্পনা করতে থাকে পরবর্তী দৃশ্য—আব্বু তখন নিশ্চয়ই এই লোকের সাথে সংসার করতে দিবে না। ওই বাড়িতে আর কক্ষনো যেতে দিবে না। অর্থাৎ, মাদার ইন ল মানে এলার্জি, খুঁতখুঁতে নীহারিকা আন্টিকেও সহ্য করতে হবে না। বিয়ে নামক বাঁ’শ থেকে মুক্তি! আহা, কী শান্তি!
ভাবতেই প্রত্যাশার মুখে পৈ’শাচিক এক আনন্দের হাসি খেলে যায়। দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে পানি আনতে যায়। ঝ’ড়ে’র গতিতে পানি আনবে, আর চুপিচুপি চেক করবে মিস্টার নীরব; কী কথা বলেন? আচরণে এত গোপনীয়তা কেন? লোকটার ফোনটাও একবার দেখে নিতে হবে। হয়তো কিছু মিলবে, হয়তো কোনো রহস্যের দোর খুলে যাবে। প্রত্যাশা আওড়ালো,
-” যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখো তাই। মোবাইলে টিকটক ভিডিও না হোক, হোয়াটসঅ্যাপে লুকানো প্রেম চ্যাট পাইলেও পাইতে পারো।”
ড্রয়িংরুমে পা রাখতেই প্রত্যাশার পা জোড়া থেমে যায়। কপালে প্রগাঢ় ভাঁজ পরল। কানে আসে,

-” অধরা তোকে কতবার বলেছিলাম একটা ছেলে নে। শুনলি না তো। এখনো সময় আছে; বলছি একটা বাচ্চা নে, যা তে পরে আফসোস না করিস। একটা মেয়ে দিয়ে হয়! একটা ছেলে ছাড়া চলে!”
সোফায় বসে আম্মুর ফুফু। এ পাড়াতেই বাড়ি। যখন-তখন চলে আসে। বুড়িটাকে দেখলেই প্রত্যাশার বি’র’ক্ত লাগে। মনে হচ্ছে বুড়িটার একএক করে আক্কেল দাঁত পরছে, আর তার সাথেসাথে আক্কেলও ঝরছে। দুই দুইটা মেয়ে বিয়ে দিয়েছে। আর ক’দিন পর নাতি-নাতনি আসবে। কোন আক্কেলে তাকে এখন বাচ্চা নিতে বলছে। আর ছেলে কী হাতের মোয়া নাকি? মন চাইল আর বানিয়ে ফেললাম। বেসাইজ হলেও ব্যাপার না, একটা হলেই হলো। যত্তসব! এসব ভাবার মাঝেই বুড়ির শেষের কথা আকস্মিক প্রত্যাশার মস্তিষ্কে নাড়া দিলো–‘ একটা মেয়ে দিয়ে হয়।’ মানে? প্রত্যাশার চোখে প্রশ্ন! ও সন্তর্পণে দাঁড়িয়ে রইল। আম্মুর উত্তর শুনবে।

কল রিসিভ করতেই প্রীতি বলল,
-” আজ ইচ্ছের সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে চেকআপের ডেট ছিল। ভাইয়ার চেম্বার সন্ধ্যায়। ভাইয়া ব্যস্ত থাকবে বিধায় যেতে পারবে না। আর ডক্টর তো বসেন আটটার পর। সিরিয়াল-টিরিয়াল মিলে ফিরতে দেরি হয়ে যাবে। তুমি ফ্রি আছো? মানে..”
-” নো ওরিজ্। আই উইল বি দেয়ার।”
-” থ্যাংকস।”
প্রীতি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকে। বলবে কি বলবে না দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকে। দোলাচলে ভুগতে ভুগতে শেষমেশ বলেই ফেলে,
-” আমি সকালে হসপিটালে গিয়েছিলাম। বাট আমার সাথে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। নীরব এসবের মানে কী?”
নীরব একেবারে শান্ত স্বরে বলল,
-” ডক্টর খান বলেছেন, পেশেন্ট কাউকে দেখলেই ওর মধ্যে একটা ইনসিকিউর রিঅ্যাকশন আসে। ও উত্তেজিত হয়ে পড়ে। সো ফর নাউ, ইট’স বেটার টু লিমিট কনট্যাক্ট। ফর হিজ সেক।”
প্রীতি তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল। বলল,

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৪

-” নীরব ওরা আমাকে অবধি দেখা করতে দিচ্ছে না। এটা কেমন কথা?”
নীরব নিরুত্তর। প্রীতি এক মূহুর্ত থেমে শক্ত গলায় বলতে থাকে,
-” তুমি ভাইয়ার ঠিক করা ডক্টর বাদ দিয়ে, নিজে অন্য ডক্টরের সাথে কনসাল্ট করলে। তার পরামর্শে হসটপিটালে অ্যাডমিট করলে। সবটা মেনে নিলাম। এখন ওখানে আমাকেও এলাউ করা হচ্ছে না। নীরব এবার তুমি খুব বেশিই বাড়াবাড়ি করছো না?”
-” আমাদের টার্গেট এন্ড একমাত্র চাওয়া হওয়া উচিত; ওর সুস্থতা। সুস্থতার জন্য যা করা দরকার আমি তাই করব। আর আমার মনেহয়, তোমার চাওয়াও এটাই হওয়া উচিত। অ্যাট লিস্ট ফর ইচ্ছে।”

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৬