মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৫৪

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৫৪
মুসতারিন মুসাররাত

সার্থক ব্যর্থ হয়ে মাহবুব সাহেবের দিকে এগোয়। হাতজোড় করে অনুনয়ের সুরে বলল,
-” আংকেল প্লীজ, একটিবার শুধু একটিবার দেখার সুযোগটা দিন। এই মুহূর্তে আমার বোনের মানসিক অবস্থাটাও একটু কনসিডার করুন। একটা মানুষ অনুতপ্ত হলে, তাকে সুযোগ দেয়া যায় না? মানুষ রাগে জিদে অন্ধ হয়ে অনেক ভুল করে বসে। সেই ভুলের মাশুলও তাকে গুণতে হয়। একটু অনেস্টলি ভাবলে দেখবেন, সবচেয়ে ক্ষতিটা কিন্তু আমার বোনেরই হলো। যদিও এটা ওরই কৃতকর্মের ফল। তবুও নিজের বোন তো, সহ্য করা যায় না।”
নীরব পাশ থেকে উচ্চস্বরে বলল,

-” তোমার বোনের ভুল কোনো সাধারণ মামুলি ভুল নয়। তোমার বোন একটা খু*নি।”
মাহবুব সাহেব ভেজা চোখজোড়া মুছে নিলেন। নিচু স্বরে বললেন,
-” নীরব থামো। হ্যাঁ, ও অপরাধ করেছে, অন্যায় করেছে। তবুও একজন মানুষ তার স্বামীকে শেষবারের মতো দেখার অধিকার রাখে। আমরা ওর সেই অধিকারটুকু কেড়ে নিতে পারি না।”
নীরব তৎক্ষণাৎ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে উঠল,
-” একজন খু*নির কোনো অধিকার থাকে না বাবা। ওর দেখার অধিকার নেই। সেই অধিকার ও নিজে শেষ করেছে। ও সাইলেন্ট কিলার, একজন অভিনেত্রীও। দিনের পর দিন আমার ভাইয়ের সাথে অভিনয় করে গেছে। ও একটা বিশ্বাসঘাতক, নীরবঘাতক। শি ইজ বোথ ডাইরেক্টলি অ্যান্ড ইন্ডাইরেক্টলি রেসপন্সিবল ফর নীবিড়’স ডেথ। সো নো মার্সি।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মাহবুব সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। গলার স্বর কঠিন করে বললেন,
-” নীরব আমি যা বলছি শুনো। সময় ন*ষ্ট হচ্ছে। একটা নজর দেখতে দিলে এমন কিছু হবে না। শেষবারের মতো শেষ দেখাটা রোধ করলে অন্যায় করা হবে। আশাকরি আমার উপর দিয়ে আর কিছু বলবে না তুমি।”
নীরব আঙুলগুলো পাকিয়ে মুষ্টিবদ্ধ করল। দাঁত চেপে বলল,
-” ওকে দয়া দেখাতে যেয়ো না বাবা। ও সহানুভূতি পাওয়ার যোগ্য নয়।”
মাহবুব সাহেব ছোটো ভাইকে ইশারা করতেই ছোটো চাচ্চু নীরব কে টেনে ওপাশে নিয়ে গেল। বাবার কথার উপর দিয়ে আর কিছু বলে বেয়াদবি করতে চাইল না নীরব। উল্টোদিক ঘুরে দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলাল।
এরমধ্যে মাহবুব সাহেব নিভানকে ডেকে উঠলেন,

-” নিভান?”
নিভান তাকাতেই বাবার নিঃশব্দে করা আদেশ বুঝে নিল। নিভান বাঁধনটা খুলতে থাকে। চোখের পানি টপটপ করে পড়তে লাগলো ওর। বুকের পাঁজর ভেঙে যাচ্ছে ভাই হারানোর বেদনায়।
সার্থক প্রীতিকে আগলে ধরে এগিয়ে আনে। মুখের উপর থেকে সাদা কাপড়টা সরিয়ে দেয়া হয়। আর সরিয়ে দিতেই ফর্সা মুখটা জ্বলজ্বল করে উঠল। দুই টুকরো সাদা কাপড় নাকে দেয়া, চোখের ঘন পাপড়ি মুদে আছে। একদম নিষ্পাপ দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে প্রশান্তির সহিত ঘুমে বিভোর।
প্রীতির বুকটা ধক করে উঠল। সেদিন হাসপাতালে হাত বাড়িয়ে ছুঁতে গিয়েও হাতটা নামিয়ে নিয়েছিল। অদ্ভুতভাবে আজ কেনো জানি একবার ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু, হায়! আফসোস! এই প্রথম মন থেকে ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে জাগলেও, ইচ্ছেটা পূর্ণ করার সাহস বা অধিকারবোধ কোনোটাই জোগাতে পারল না প্রীতি। চোখের কোল ঘেঁষে উষ্ণ নোনতা জল গড়িয়ে পড়ল নিঃশব্দে। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না প্রীতি। পাশে দাঁড়ানো ভাইয়ের বুকে মাথাটা গুঁজে নিল।

মাহবুব সাহেব ইশারা করতেই সার্থক বোনকে টান দিয়ে দূরে সরে গেল। চোখের পলকে খাটিয়া কাঁধে নিয়ে সবাই বেরিয়ে গেল। যতদূর দেখা গেল প্রীতির চোখদুটো ওই খাটিয়ার দিকে চেয়ে রইল। প্রীতি শব্দ করে কাঁদে না। শুধু নিঃশব্দে অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়ল। অবচেতন মনটা বলতে চাইল,
-” মাফ করে দিও নীবিড়। জানি, আমার শব্দগুলো তোমার কাছে পৌঁছবে না। তবুও বলতে চাই, আজ আমি অনুতপ্ত। আমার কারণে তুমি এত অকালেই চলে যাচ্ছ। আফসোস আমাদের মেয়েটার জন্য। তার পা’পী মা তাকে এতিম করল। বাবার স্নেহ ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করেছে। এ-ও জানি এত এত পা”পের কোনো ক্ষমা নেই। তবুও যে আমি আজ ক্ষমাপ্রার্থী।”

ছোট্ট ইচ্ছে অতকিছু বোঝে না। পাঁচ বছরের একটা বাচ্চা কীই-বা বুঝবে। নিভান তখন কোলে করে নিয়ে শেষবারের মতন বাবার মুখটা দেখিয়েছিল। বলেছিল– পাপাকে আদর করে দাও।
দিদুন ভেতরে চিৎকার করে কান্না করছিল। সবার কান্নাকাটি দেখে তার ছোট্ট মনটা খারাপ করছে। মিষ্টি মুখটা শুকনো করে ফ্যালফ্যাল চোখে কিছুপল বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মুখটা ভার করেই বড় পাপার কথা রাখতে হোক আর অদৃশ্য টানেই হোক ইচ্ছে বাবার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। উফ্! শেষবারের মতন ছুঁয়ে দেয় বাবাকে। শেষ আদরটুকু আঁকে
বাবার কপালে। আফসোস! বাবা টেরই পেলো না। অনুভব করতে পারল না।

ইচ্ছে মন খারাপ করে ভেতরে এককোণে দাঁড়িয়ে ছিলো। এরমধ্যে আনিশা বাইরে থেকে দৌড়ে আসে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
-” ইচ্ছে তোমার মাম্মা এসেছে।”
ইচ্ছের চোখ চকচক করে উঠল।
-” মাম্মা?”
-” হ্যাঁ তোমার মাম্মাকে দেখলাম।”
-” কোথায় মাম্মা? আমি যাব মাম্মার কাছে।”
আনিশা চোখদুটো সরু করে ঘনঘন বলতে থাকে,
-” তোমার মাম্মা বাইরে। জানো বাইরে পুলিশ আবার পুলিশের গাড়িও আছে।”

পরের কথাগুলো কানে পৌঁছায় না ইচ্ছের। মাম্মা বাইরে আছে শুনেই ও ছোটে।
প্রীতির আসা নিয়ে আত্মীয় স্বজনরা এটাওটা বলে ফিসফিস করছে। কেউ আবার মুখে যা আসছে তাই সামনের উপর বলে দিচ্ছে। নীহারিকার জ্ঞান নেই। ছেলেকে নেয়ার আগে মা’কে আরেকবার দেখানো হয়। সেই তখন জ্ঞান হারিয়েছেন। আত্মীয়-স্বজন মাথায় পানি দিচ্ছে।
প্রত্যাশা ওখানেই ছিল। এরমধ্যে নীলাশা এগিয়ে ইশারায় প্রত্যাশাকে ডাকল। প্রত্যাশা এগিয়ে একটু ফাঁকা জায়গায় দাঁড়াল। রুমভর্তি মহিলা মানুষে। নীলাশার চোখদুটো ফোলা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মৃদুস্বরে বলল,
-” শুনেছিস তো..”
কথার মাঝেই প্রত্যাশা নিচুস্বরে বলল,

-” হ্যাঁ শুনেছি। সবাই এখানে বলাবলি করছে। নীরব নাকি দেখতে দিচ্ছে না। উনাকে একটু বুঝিয়ে বলো দেখতে যেন দেয়। সবাই অনেক কিছুই বলবে এটা জেনেও যখন দেখতে আসছে, তখন নিশ্চয় মন থেকেই আসছে। আর আপু, আত্মীয় স্বজন মানুষগুলোও না কেমন মুখের উপর যাচ্ছে না তাই নাকি বলতিছে।”
-” হুম, অনেকেই অনেক কিছু বলেছে। আর বলার কথাই। যাগগে বাদ দেই। বাবা নীরবকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে দেখতে দিয়েছে। শোন যা বলার জন্য ডাকলাম, ইচ্ছে বাইরে ওর মায়ের কাছে গেছে। ইচ্ছে তো তোর কথা শোনে, তুই একটু নিয়ে আয় না। নিভানরা সবাই চলে গেছে। আর মনেহয় না ইচ্ছে আমার কাছে আসবে। তুই একটু যাবি?”
প্রত্যাশা মাথা নেড়ে বলল,
-” আচ্ছা, যাচ্ছি।”
মাথার উপর থাকা ওড়নাটা ভালো করে টেনে পা বাড়াল।

প্রীতিকে পুলিশের জিপে তোলা হবে। এরমধ্যে পিছুন থেকে বাতাসের সাথে ভেসে এল মিষ্টি কণ্ঠস্বর,
-” মাম্মা…..আআআআআআআ।”
বাঁধ ভাঙা ঢেউয়ের মতো ছুট্টে আসছে ইচ্ছে। যেন কোনো বেড়িবাঁধ, বাঁধা তাকে থামাতে পারবে না। মেয়ের কণ্ঠস্বর কর্ণযুগলে পৌঁছাতেই প্রীতি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। মেয়ে দৌড়ে এল। সামনে থামল। দুইহাত হাঁটুতে রেখে হাঁপাতে হাঁপাতে ঘনঘন বললো ইচ্ছে,
-” মাম্মা, ও মাম্মা… আমাকে রেখে তুমি এতদিন কোথায় গিয়েছিলে?”

মুখটা উঁচু করে মায়ের মুখের দিকে তাকাল। বাচ্চা মেয়েটার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে খুশির ঝিলিক দেখা গেল। প্রীতির চোখ ঝাপসা হয়ে এল চোখের বাঁধ ভাঙা বন্যায়। ইশশ্! কানে বাজছে, এত আদুরে ডাক—‘ মাম্মা, ও মাম্মা।’ প্রীতি নিজেকে সামলাতে পারল না। হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল। মেয়েকে একটানে বুকের সাথে চেপে ধরল। শব্দ করে ঝরঝরিয়ে কেঁদে উঠল। মায়ের কান্নার শব্দে ইচ্ছে ভড়কাল। ভীতু স্বরে জিজ্ঞাসা করল,
-” মাম্মা তুমি কাঁদছো কেনো? সবাই আজকে কাঁদছে। দিদুন, দাদুভাই, বড় পাপা, পাপা, মামণি সব্বাই। আমার না খুউব মন খারাপ হচ্ছে। একটুও ভালো লাগছে না। একটুও না।”

মাথা নেড়ে নেড়ে বলতে থাকে ইচ্ছে। প্রত্যাশা এতক্ষণে এসে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়েছে। ভেজা চোখে তাকিয়ে রইল। প্রীতি কান্নার বেগ থামিয়ে নাক টেনে নিল। মেয়ের আদুরে মুখটা দু’হাতে আগলে ধরে চুমু খেতে লাগল। সারা মুখে চুমু খেয়ে ভরিয়ে দিল। ইচ্ছে একের পর এক প্রশ্ন করছে। প্রীতি কিছুই বলতে পারছে না। গলায় যেন বেড়ি পড়ানো এমন ঠেকছে। ওদিকে বরাদ্দ সময় শেষের দিকে তাড়া দিচ্ছে। সার্থক এগিয়ে বোনের কাঁধের উপর হাত দিল। মৃদুস্বরে ডাকল,

-” প্রীতি?”
প্রীতির বুঝতে বাকি রইল না। শেষবারের মতন মেয়েকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরল। একদম চেপে ধরল। পরপর ছেড়ে দিয়ে মেয়ের ছোট্ট হাত দুটো এক করে ধরল। তারপর সেই হাতের উপর চুমু খেল। উঠে দাঁড়িয়ে কয়েক পা এগিয়ে গেল। ঠিক প্রত্যাশার সামনে দাঁড়াল। আচমকা প্রত্যাশার একটা হাত ধরে, সেই হাতের উপর ইচ্ছের হাতটা রাখল। প্রত্যাশা ভ্যাবাচ্যাকা খায়। প্রীতি একটাও শব্দ উচ্চারণ করল না। সোজা উল্টো ঘুরে লম্বা কদমে এগিয়ে যায়। ইচ্ছে পিছুন থেকে ডাকে,
-” মাম্মা, কোথায় যাচ্ছো মাম্মা? তুমি আবার চলে যাচ্ছ মাম্মা? দিদুন বলে তুমি অফিসের কাজে গিয়েছো? আমিও যাবো তোমার সাথে।”
প্রীতি আর ফিরে তাকায় না।‌ ইচ্ছের এবারে কান্না পাচ্ছে। ছুটে যেতে নিয়ে বাঁধা পায়। প্রত্যাশা ওর হাতটা ধরে আছে। ইচ্ছে হাত ছুটানোর চেষ্টা করতে করতে বলল,

-” মামণি ছাড়ো, আমি মাম্মার কাছে যাব।”
মূহুর্তেই জিপটা দূরে চলে যেতে লাগল। ইচ্ছের কান্নার বেগ বাড়ল। চিৎকার করে বলল,
-” মাম্মা…..ও মাম্মা…আআআআআ।”
নিমিষেই জীপটা ধুলো উড়িয়ে চোখের আড়াল হয়ে যায়। ইচ্ছে কাঁদতে থাকে। প্রত্যাশা আগলে ধরে বলে,
-” কাঁদে না সোনা। মাম্মা আসবে, কাজ শেষ হলেই আসবে।”
ইচ্ছে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-” মামা, মামা ওরা মাম্মাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? মামা আমি যাব মাম্মার সাথে।”
সার্থক এগিয়ে এল। ইচ্ছের কপালে চুমু খেয়ে বলল,
-” তোমার মাম্মার কাজ শেষ হলেই তোমার কাছে আসবে। সোনামণি তুমি না গুড গার্ল। আর গুড গার্লরা তো এভাবে জিদ করে না সোনা। তুমি তো মাম্মার ভালো মেয়ে। বলো ভালো মেয়ে না তুমি?”
ফুপাতে ফুপাতে মাথা নেড়ে -‘হ্যা’ বোঝায় ইচ্ছে।‌ সার্থক বলল,

-” ভালো মেয়ে হলে মাম্মার‌ কথা শুনবে। মাম্মা বলেছে; দাদু বাসার সবার কথা শুনে লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে থাকতে। এখন গুড গার্ল হয়ে মামণির সাথে ভেতরে যাও তো।”
আরো এটাসেটা বুঝিয়ে বলার পর ইচ্ছে নাক টেনে ফুপাতে ফুপাতে প্রত্যাশার সাথে ভেতরে আসে।
অদ্রিকা গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। সার্থক গিয়ে দরজা খুলে দিতেই ভেতরে বসে সে। সার্থক চুপচাপ ড্রাইভিং করছে। অদ্রিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-” ইচ্ছের জন্য খুব বেশি খারাপ লাগছে। বাচ্চা মেয়েটা খুব সাফার করবে।”
সার্থক দৃষ্টিজোড়া পিচের রাস্তায় রেখেই বলল,

-” ইচ্ছে এখানে খুব ভালো থাকবে। ওর ফ্যামেলি বাবা-মায়ের শুন্যতা টের পেতে দিবে না। নীরব আছে, তারপর বাড়ির প্রতিটি সদস্যও ইচ্ছেকে আগলে রাখবে। তবে যখন বড় হবে সব সত্য জানলে কষ্ট পাবে। মায়ের প্রতি এখন যে ভালোবাসাটা আছে, তখন হয়তো সেটা ঘৃ’ণা’য় পরিণত হবে। আফসোস! প্রীতি চাইলেই জীবনটা সুন্দর করে গুছিয়ে নিতে পারতো। রাগ, জিদ, বেপরোয়া ইগো ওকে ধ্বং*স করে দিয়েছে। এখন হয়তো টের পাচ্ছে। সব শেষ করে উপলব্ধি করার চার আনারও মূল্য নেই। যার জলজ্যান্ত উদাহরণ প্রীতি।”

সবাই একে একে ফিরতে নেয়। সাড়ে তিনহাত মাটির ঘরে ভাইকে একলা ফেলে যেতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। এতই কষ্ট প্রবল যে নীরবের পা দুটো যেন গেঁথে গেল। লাল টকটকে চোখজোড়া অশ্রুতে টলমল করতে থাকল। আকস্মিক নীরবের কানে বাজছে উচ্ছাস নিয়ে ভাইয়ের বলা কিছু কথা, কিছু মূহুর্ত। যা এখন ভাইয়ের স্মৃতি। রেজাল্ট দেয়ার পর উল্লাস নিয়ে বলেছিল নীবিড়,
-” এই নীরব তোর থেকে এবারে আমার সিজিপিএ বেশি। যদিও তুইও হ্যান্ডসাম সিজিপিএ তুলেছিস। তবুও তোর থেকে এবারে এগিয়ে কিন্তু আমি। তোর থেকে তিন মিনিট আগে হলেও পৃথিবীতে এসেছি। তিন মিনিটের হলেও বড় আমি। তাই রেজাল্টের মতন সবকিছুতে এভাবেই এগিয়ে থাকতে হবে, হুম।”
বলেই কলারে হাত রেখে ভাব নেয়ার অ্যাক্টিং করে নীবিড়। মায়ের মুখ থেকে শোনা কত সময়ের ব্যবধান দু’জনের ভূমিষ্ঠ হওয়ার।

ভাইয়ের খুনসুটি গুলো চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে নীরবের। আর করছে বলেই খুব পীড়া দিচ্ছে। নীরব ধপ করে কবরের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। শরীর কাঁপছে, চোখদুটোতে অঝোরে বর্ষণ নামছে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করল,
-” নীবিড় তুই বলেছিলি সবকিছুতে এগিয়ে থাকবি। কিন্তু এই এগিয়ে থাকা তো আমি কোনোদিনও চাইনি। আগে জানলে বলতাম; তুই সবসময় আমার থেকে পিছিয়ে থাকিস। দুজনের আসার ব্যবধান যদি তিন মিনিটই হয়, তবুও কেন এত দ্রুত ছেড়ে গেলি?”
নিভান ভাইয়ের পাশে বসে কাঁধের উপর হাতটা রাখল। ভেজা গলায় বলল,

-” নীরব, উঠ। ভাই বাসায় চল।”
আঁটকে রাখা কান্না এবার ছিটকে যেন বেরিয়ে এল। ঝরঝরিয়ে কেঁদে উঠল নীরব। এক ঝটকায় বড় ভাইকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। নিভানও নিজেকে সামলাতে পারল না। ভাই বিয়োগের বেদনার কান্নায় চারপাশ ভারী হয়ে উঠল।
বৃদ্ধা বাবা বুকে হাহাকার নিয়ে মরহুম ছেলের জন্য দোয়া করতে থাকলেন। এ ছাড়া যে আর কিছুই করার নেই। আত্মীয়-স্বজন এগিয়ে এসে ওদের দুইভাইকে সামলে নিয়ে ফিরতে থাকে।

কারো জন্য কোনো কিছুই থেমে থাকে না। যে যাওয়ার সেই যায়। রেখে যায় কেবল স্মৃতি, যা প্রিয়জনের বেদনা বাড়িয়ে দেয়। তবুও সময়ের সাথে সাথে মানুষের দুঃখ ফিকে হয়ে আসে। ব্যস্ততার ভিড়ে হারিয়ে যায় অশ্রুর ভারী মুহূর্তগুলো। এরই মাঝে কে”টে গেছে আড়াইটা মাস। বাড়ির শোকের ছায়া অনেকটা সরে গেছে। আগের মতো না হলেও সবাই ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে।

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৫৩

প্রত্যাশার সাড়ে সাত মাস চলছে। ঘড়িতে সন্ধ্যা সাতটা। ইবনে সিনা হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ওয়েটিং চেয়ারে প্রত্যাশা আর নীরব পাশাপাশি বসে। চেকআপের জন্য প্রত্যাশাকে আনা হয়েছে। গাইনোকলজিস্ট এটাসেটা টেস্ট দিয়েছে। টেস্টের জন্য স্যাম্পল হিসেবে ব্লাড, আর ইউরিন কালেক্ট করা হয়েছে। এখন আল্ট্রাসাউন্ড বাকি আছে।প্রত্যাশার হাতে ফ্রেশ এর মিনারেল ওয়াটার বোতল। মুখের সামনে ধরে দু ঢোক গিলে মাথাটা নীরবের কাঁধের উপর রাখল। শরীর দূর্বল লাগছে। অনেকক্ষণ বসে থেকে কোমরও ধরে গেছে। বিরক্ত সুরে বলল,
-” নীরব আর কতক্ষণ এভাবে বসে থাকব? আমার বিরক্ত লাগছে। তাড়াতাড়ি বলুন না।”
নীরব কিছু বলার আগেই আল্ট্রাসাউন্ড রুমে প্রবেশের জন্য প্রত্যাশার নাম ডাকা হলো।

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৫৫