মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৫৮

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৫৮
মুসতারিন মুসাররাত

-” মিস্টার নীরব, আপনার ওয়াইফের কন্ডিশন ক্রিটিক্যাল। পেশেন্টের শারীরিক কন্ডিশন দেখে মনেহয় না নরমাল ডেলিভারির স্ট্রেস নিতে পারবে। টুইন বেবির নরমাল ডেলিভারি পসিবল হবে না। আর অ্যাট দিস মিডনাইট কোনো সার্জন অ্যাভেইলেবল নেই। সো প্লিজ, প্রিপেয়ার ফর এনি ওরস্ট-কেস সিচুয়েশন।”
শব্দগুলো শ্রবণ ইন্দ্রিয়ে পৌঁছাতেই নীরবের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। লহমায় পুরো পৃথিবী যেন থমকে গেল ওর। শ্বাসটা আটকে আসছে। বাইরে থেকে নিজেকে নিস্তব্ধ রাখলেও ভেতরে তোলপাড় করা ঝড়ের সৃষ্টি হয়েছে নীরবের। শক্ত, আত্মবিশ্বাসী পুলিশ অফিসার নিজেকে এই মুহূর্তে একজন ভেঙে পড়া অসহায় স্বামী মনে হচ্ছে। এতটাই অসহায় যে বউ বাচ্চার এই ক্রিটিক্যাল মূহুর্তে কিছুই করতে পারছে না। নিজেকে ব্যর্থ মনে হচ্ছে।
হঠাৎই মস্তিষ্ক এক ফ্রেন্ডের কথা স্মরণ করিয়ে দিল। পুরনো এক ফ্রেন্ড গাইনোকলজিস্ট। যদিও দীর্ঘদিন যোগাযোগ নেই। তবুও এই শহরে থাকে এতটুকু জানা আছে। তার কাছে কল দেয়ার আগে নীরব ডক্টর অদ্রিকা আহসানের কাছে দ্বিতীয় আর শেষ বারের মত চেষ্টাটুকু করল। ফোনটা কানে চেপে অস্থির চিত্তে ঠোঁটজোড়া নিঃশব্দে নড়ল,

-” প্লীজ, পিক আপ দ্যা ফোন…।”
ডিউটির ডক্টর হতাশ গলায় বললেন,
-” পেশেন্টকে যদি সাড়ে বারোটার মধ্যে আনা হতো, তাহলে এতটা জটিলতা তৈরি হতো না। বারোটা পর্যন্ত ডক্টর অ্যাভেইলেবল পাওয়া ব্যাপার না। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে এই মুহূর্তে সকলে বিশ্রামে থাকে। প্রধান সমস্যা হলো ফোনে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না, বেশিরভাগই ধরছেন না। যাও বা দু-তিনজন ধরল, আসতে রাজি হচ্ছেন না। নিজস্ব প্রব্লেম এটাসেটা বলে কাটিয়ে দিচ্ছেন। তারপরেও আমরা ট্রাই করছি, দেখি সকালের আগেই কাউকে ম্যানেজ করা যায় কী না।”
আবার কল আসতেই সার্থক বিরক্ত কণ্ঠে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-” অদ্রি ধরবে?”
অদ্রিকা ঘুমঘুম স্বরেই বলল,
-” উফ্! ঘুমে চোখ মিলতে পারছি না এদিকে কে এই মাঝরাতে বিরক্ত করছে।”
-” তোমার কোনো পেশেন্ট হতে পারে।”
-” আচ্ছা, না কেটে দ্যাখো তো কে? আমার পেশেন্ট কী না।”
অদ্রিকার ফোন সার্থক ধরতে চাইছিল না, কিন্তু এই মেয়ে যে ঘুমকাতুরে তাই এক প্রকার বাধ্য হয়েই রিসিভ করে সার্থক। রিসিভ করার সাথে সাথে ওপাশ থেকে অস্থির, ব‌্যাকুল হয়ে একনাগাড়ে পুরুষালি কণ্ঠস্বর ভেসে এল,
-” আসসালামুয়ালাইকুম ডক্টর। আই অ্যাম এএসপি নীরব মাহবুব। আপনাদের ডক্টরস ক্লিনিকে আমার ওয়াইফকে এডমিট করা হয়েছে। আমার ওয়াইফের কন্ডিশন খুবই ক্রিটিক্যাল। টুইন বেবী, ডক্টর বলেছেন নরমাল ডেলিভারি হাই রিস্ক হবে। এই মুহূর্তে কোনো সার্জন অ্যাভেইলেবল নেই। প্লিজ, আই বেগ ইউ..কাইন্ডলি আসুন। ইটস আ লাইফ সেভিং ম্যাটার।”

নীরব নিজের পরিচয় দিয়ে শুরু করে, তারপর গলার স্বর শুনে সার্থক স্তব্ধ বনে যায়। ন্যানো সেকেন্ডে প্রত্যাশার মুখটা দু’চোখে ভেসে উঠল। আর উঠতেই কাল বিলম্ব না করে তড়িঘড়ি বলল,
-” ওকে ওকে, ডক্টর অদ্রিকা ইজ কামিং।”
নীরব স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলল,
-” থ্যাঙ্কস, থ্যাঙ্কস আ লট। প্লিজ হ্যাভ ডক্টর অদ্রিকা কাম অ্যাজ সুন অ্যাজ পসিবল। আমার ওয়াইফ আর বেবিদের জন্য এভরি সেকেন্ড ম্যাটার্স।”
সার্থক জোড়াল শ্বাস টেনে নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে হাসপাতালে কল করল। বলল,
-” ইমার্জেন্সি যে পেশেন্ট এসেছেন উনার কী অবস্থা?”
-” স্যার পেশেন্ট ইয়ানূর প্রত্যাশার কথা বলছেন?
-” জ্বী।”

-” স্যার ডেলিভারি কেস। টুইনস জন্য নরমাল ডেলিভারির রিস্ক নিতে চাইছি না। বাট…”
সার্থক থামিয়ে দিয়ে কণ্ঠে আদেশ নামিয়ে বলল,
-” এক্ষুনি ও.টি রেডি করুন। আপনাদের ম্যাডাম ফিফটিনস মিনিটের মধ্যেই উপস্থিত হবে। ও হ্যাঁ, অ্যানেসথেসিয়া ডক্টর আছে?”
-” স‌্যার এক্ষুনি যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি।”
-” না হলে আমাকে ফাস্ট জানান। আমি ম্যানেজ করে দিচ্ছি। এক সেকেন্ডও যেন ন’ষ্ট না হয়, মাইন্ড ইট?”
-” ঠিক আছে স্যার।”
অদ্রিকা ঘুমিয়ে থাকলেও সার্থকের কথা সে শুনতে পেল। তবে চোখে ঘুমের রেশ এতটাই যে কিছু বলতে পারল না। এরমধ্যে সার্থক ওর গায়ের উপর একটা হাত রেখে হালকা ধাক্কা দিয়ে ব্যগ্র কণ্ঠে বলল,

-” অদ্রি, ফাস্ট উঠো। এক্ষুনি হাসপাতালে যেতে হবে।”
অদ্রিকা চোখবুঁজেই ঘুম জড়ানো স্বরে বলল,
-” কে ফোন দিয়েছিল আমার পেশেন্ট? কী সমস্যা?”
-” তোমার পেশেন্ট নয়। তবে ইমার্জেন্সি কেস, সি-সেকশনে নিতে হবে। তাড়াতাড়ি উঠো।”
-” প্লীজ, বিরক্ত করো না। আজ দিনে পাঁচটা ও.টি ছিলো আমার। রাত সাড়ে এগারোটায় শেষ ও.টি টা করে বেড়িয়েছি। আজ পেশেন্টের চাপও বেশি ছিলো। আমি খুব টায়ার্ড। অন্য কাউকে একটু ম্যানেজ করে দাও না। বউয়ের উপর একটু তো রহম করো।”

সারাদিনের দৌড়াদৌড়িতে ক্লান্ত, তারওপরে কাঁচা ঘুম। অদ্রিকার ধ্যান যেন এখন ঘুমানোতেই সীমাবদ্ধ। ঘুমের চোটে বাকিসব তার মস্তিষ্ক ভালোভাবে সাড়া জাগাতে ব্যর্থ। সার্থক উঠে বসল। বেড টেবিলের উপর থেকে পানির বোতলটা হাতে নিয়ে অদ্রিকার চোখমুখের উপর ছিটিয়ে দিল। অদ্রিকা এবারে ধড়ফড়িয়ে ওঠে বসল। আচমকা পানি পড়ায় সে ভড়কে যায়। হাত দিয়ে চোখমুখের পানি মোছার চেষ্টা করে চেঁচিয়ে উঠল,
-” কী আশ্চর্য! পাগল হলে নাকি! পানি ছিটাচ্ছো কেনো?”
-” টু মিনিটস সময় দিলাম রেডি হতে। জলদি তৈরি হয়ে নাও। প্রত্যাশা হাসপাতালে, লেবার পেইন উঠেছে। মাঝরাতে ডক্টর ম্যানেজ করতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। তুমি এক্ষুনি যাচ্ছো, আর কোনো কথা নয়।”
অদ্রিকার চোখের ঘুম নিমিষেই কেটে গেল। ও ভ্রু কুঁচকে তাকাল। নিম্ন অধরে দাঁত চেপে বলল,
-” পেশেন্টটা প্রত্যাশা বলেই কী এতটা সিরিয়াস হচ্ছো? নাকি ইমার্জেন্সি বলে? কোনটা?”
সার্থক নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব দিল,

-” দুটোই।”
অদ্রিকা বেড ছেড়ে নামতে নামতে বলল,
-” হাজবেন্ডের না হওয়া প্রে..”
সার্থক বুঝে নেয় অদ্রিকা কী বলতে চাইছে। অদ্রিকাকে থামিয়ে দিতে বলল,
-” তোমার থেকে এই মুহূর্তে এই ধরণের কথাবার্তা একদমই আশাকরি না।”
অদ্রিকা ওয়াশ রুমে যেতে যেতে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল,
-” সার্থ শোনো, একজন ইমারজেন্সি পেশেন্ট, তারপর পেশেন্ট তোমার কাজিন আমি কিন্তু এই সূত্রেই যাচ্ছি। এছাড়া শুধু তোমার..”
সার্থক গলা চড়িয়ে বলল,
-” অদ্রি স্টুপিডের মতো কথা বলো না, প্লীজ।”

ব্যথায় মনে হচ্ছে জানটা এবার বেরিয়ে যাবে প্রত্যাশার। তীব্র ব্যথায় গলা কা*টা মুরগীর মতো ছটফট করছে। ফাঁকা হাতে বেড শিটটা শক্ত করে মুঠো করে ধরল, চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পরছে অনবরত। অকস্মাৎ এই মুহূর্তে জন্মদাত্রী মায়ের কথা মনে উঠল। সত্যিটা জানার পরেও মায়ের কথা মনে পরে না। ওই জঘন্য সত্যিটা কখনো মনে উঁকি দিলেও মায়ের প্রতি তীব্র ঘৃ*ণা হয়। ঘৃ*ণা হয় নিজের প্রতিও। মনেহয় অদৃশ্য থেকে চিৎকার করে বলে– তুই পাপ। তোর শরীরে পাপের র*ক্ত বইছে। সেই মূহূর্তে ঘৃ*ণাটা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। তবে আজকে এই কঠিন মূহুর্তে মনে হচ্ছে, তার পরিণতিও বুঝি তার জন্মদাত্রীর মতোই হতে যাচ্ছে। তাকে জন্ম দিতে গিয়ে সেই মেয়েটা প্রাণ হারিয়েছে। আজ কী তবে সেটারই পুনরাবৃত্তি ঘটবে?

প্রত্যাশার বুক কেঁপে উঠল। আজ নটা মাস দু’টো প্রাণ নিজের ভেতর বহন করছে, দুচোখে কত স্বপ্ন নিয়ে আজকের এই প্রতিক্ষিত দিনটার প্রহর গুনেছে। কত স্বপ্ন, কত আশা বুকে বাসা বেঁধেছে। ছোট প্রাণ দু’টোকে বুকে আগলে রাখবে, খুব আদর করবে। এই স্বপ্ন, এই আশা সব কী তবে অপূর্ণই রয়ে যাবে? বাচ্চাদের মুখটাও কী দেখা হবে না?
হাহাকারে প্রত্যাশার দম আঁটকে আসার উপক্রম। তবুও মায়ের মনটা চাইছে ছোট প্রাণ দু’টো যেন পৃথিবীর আলো দেখতে পায়। তারা যেন সুস্থ থাকে। মহান রবের কাছে এতটুকু প্রার্থণা করল প্রত্যাশা।
করিডোরে দেয়ালে ঠেস দিয়ে একপা দেয়ালের সাথে ভেঙে দাঁড়িয়ে নীরব। নিঃশব্দে ঠোঁট নড়ছে, দোয়া পাঠ করছে। আল্লাহকে বারংবার স্মরণ করছে। নিভান মাত্রই নীহারিকাকে নিয়ে আসল। নীহারিকা জিজ্ঞাসা করতেই শফিক সাহেব বলেন– ‘ডক্টর আসছে, রাস্তায় আছেন।’ এরমধ্যে দমে রাখা রাগটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল নীরবের। শ্বশুরকে উদ্দেশ্য করে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে ফেলল,

-” প্রত্যাশা নয়টার পর যখন বলেছে তখন আপনারা কোন আশায় বসেছিলেন? আমাকে ফোন করে জানাননি কেনো?”
শফিক সাহেব মাথাটা নিচু করে ফেললেন। জবাব দিতে ব্যর্থ হলেন। নীরব গলার স্বর অমন চড়াও রেখেই ফের বলল,
-” মেয়েকে নেয়ার জন্য তো উঠেপড়ে লেগেছিলেন। আজ আপনাদের গাফিলতির জন্য যদি ভালো ছেড়ে মন্দ কিছু হতো? তখন নিজেরদেরকেই বা কী জবাব দিতেন?”
নিভান ফট করে নীরবের কাঁধের উপর একটা হাত রাখল। চোখের ইশারায় থামতে বলল। পরপর বলল,
-” নীরব থাম ভাই। এখন এসব বললে ফিরে আসবে না। যা ভুল হওয়ার হয়েছে। মাঝেমধ্যে এরকম হয়ে থাকে। হয়তো কপালে এতটুকু ভোগান্তি লিখা ছিলো তাই এমনটা হয়েছে।”
নীরব তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল,

-” ভাইয়া প্রত্যাশা ব্যথায় ছটফট করছে, আমার বাচ্চাদের রেসপন্স পাওয়া যাচ্ছে না। এই ভোগান্তি, এই দুঃসময় আসতো না, যদি না ওনারা গাফিলতি করতো। কীসের আশায় ওনারা বসে ছিলো, আমার মাথায় ধরছে না।”
নীহারিকা বললেন,
-” নীরব থাম বাবা। আমি ফোনে বেয়াইনের সাথে কথা বলেছি। নয়টার দিকে প্রত্যাশা চিনচিনে ব্যাথার কথা বলে। বাচ্চা ডেলিভারির আগে মাঝে মাঝে এমন ব্যথা হয়ে থাকে। আবার ঠিক হয়ে যায়। বেয়াইনও সেরকমটাই ভেবেছিল তাই সিরিয়াসলি নেননি। আচমকা বারোটার পর থেকে পেইন বেড়ে যায়।”
নীহারিকা থেমে দম ফেলে বললেন,
-” যা হওয়ার হয়েছে এখন এসব বাদ দে। সবটা যেনো ভালো হয় এই দোয়াই করি। বেশি বেশি দোয়া ইউনুস পাঠ কর বাবা।”
আর বাড়তি কথা না বলে কেবিনে ঢোকেন নীহারিকা।

সার্থক গাড়ি থেকে নামল না। জানালার কাঁচ নামিয়ে মাথাটা বের করে শুধু বলল,
-” অদ্রি, আমি এখানেই আছি। কোনো সহযোগিতা লাগলে কল দিও।”
অদ্রিকা গম্ভীর মুখে হালকা মাথা নেড়ে সায় দিল। দ্রুত পায়ে ক্লিনিক ভবনের দিকে এগিয়ে গেল। চেম্বারে ঢুকে সাদা এপ্রোন গায়ে চাপাল। গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলিয়ে পাঁচতলার উদ্দেশ্য লিফটে চড়ল। সাথে একজন নার্স ছিলো। নার্স দরজাটা খুলে ধরতেই অদ্রিকা কেবিনে প্রবেশ করে। ভিতরে প্রবল ব্যথায় ছটফট করতে থাকা প্রত্যাশাকে দেখে খারাপ লাগল। এগিয়ে গিয়ে প্রথমে স্টেথোস্কোপটা প্রত্যাশার পেটের ওপর রাখল। কয়েক সেকেন্ড মনোযোগ দিয়ে শুনে বলল,

-” ডোন্ট ওরি, বেবিগুলো ঠিক আছে। হার্টবিট ক্লিয়ারলি ফিল হচ্ছে।”
নীরব একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। মাথা ঊর্ধমুখী তুলে নিঃশব্দে আল্লাহকে শুকরিয়া জানাল। একটা অজানা ভার বুক থেকে নেমে গেল।
অদ্রিকা একহাত বাড়িয়ে প্রত্যাশার মাথায় রাখল। অমায়িক গলায় বলল,
-” প্রত্যাশা, চিনতে পারছো আমাকে?”
ব্যথায় জান যায় যায় যায় প্রত্যাশার কোনোদিকে লক্ষ্য নেই। বাচ্চারা সুস্থ আছে, এটুকু শুনতেই বুকের উপর থেকে পাথর নেমে যায় ওর। তীব্র যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছে, তবু ভালো করে অদ্রিকার মুখের দিকে তাকাল। মাথা নেড়ে ক্ষীণ স্বরে বলল,

-” হ-হুউউ।”
অদ্রিকা মিষ্টি করে হাসল। আশ্বস্ত করতে বলল,
-” ভ’য় পেয়ো না। মা হতে গেলে একটু কষ্ট সহ্য করতে হয় যে মিষ্টি মেয়ে। তুমি তো খুব সাহসী মেয়ে। কোনো ভ’য় নেই। টুইন্স না হলে আমি কিন্তু নরমাল ডেলিভারিই সাজেস্ট করতাম। যেহেতু টুইন্স বেবি, আর প্রথম ডেলিভারি রিস্ক নিচ্ছি না।”
পেটের ওপর হাতে আলতো চাপ দিয়ে বলল,
-” ওয়েট ভালোই হয়েছে। তোমার শরীর স্ট্রেস নিতে পারবে না। এক্ষুনি সি-সেকশনে নিচ্ছি।”
নীরবের দিকে তাকিয়ে বলল অদ্রিকা,
-” মিস্টার নীরব, ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হবে। টেনশন করবেন না। ও.টি রেডি হলে প্রত্যাশাকে নিয়ে যাবে।”
এতক্ষণে নীরবের খেয়াল হলো, একে কোথাও দেখেছে। পরক্ষণেই তীক্ষ্ণ মস্তিষ্ক শিওর করল, হ্যাঁ একে সিসিটিভি ফুটেজে দেখেছিল। সার্থকের ফ্রেন্ড। বলাবাহুল্য সার্থকের বিয়ের খবর অজানা। নীরব মাথা মাথা নুইয়ে কৃতজ্ঞ গলায় বলল,

-” থ্যাঙ্কস আ লট ডক্টর। সময়মতো আসার জন্য।”
-” এটা আমার ডিউটি।”
পরপর নার্সকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-” পেশেন্টকে রেডি করে ও.টিতে আনো। আমি ও.টি তে যাচ্ছি। বাকিরা বোধহয় এতক্ষণে উপস্থিত হয়েছে।”

স্ট্রেচারে প্রত্যাশা। ও.টি তে ঢোকার আগে সবার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল। ওর কান্না দেখে সবাই নিজেকে সামলে বুঝ দিতে থাকল। নীহারিকা মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
-” প্রত্যাশা চিন্তা করো না কিচ্ছু হবে না। সবকিছু ভালোই হবে ইনশাআল্লাহ।”
অধরা শাড়ির আঁচল টেনে মেয়ের গাল মুছে দিলেন। প্রত্যাশা মায়ের একটা হাত আঁকড়ে ধরে কেঁদে উঠল। অধরার বুক ভেঙে যাচ্ছে কষ্টে। ঠোঁট মেলে কিছু বলবেন তার আগেই নার্স তাড়া দেয়। প্রত্যাশা মাথা তুলে নীরবের দিকে তাকাল। অধরা সরে দাঁড়ালেন। নীরব সামনাসামনি দাঁড়িয়ে প্রত্যাশার একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় ধরল। অন্যহাতে প্রত্যাশার চোখের পানি টোকা দিয়ে ফেলে দিল। মৃদুস্বরে বলল,
-” প্রত্যাশা, চোখের পানি ফেলো না। একদম ভ’য় পেয়ো না। আমাদের তো একটা গোটা জীবন বাকি।তোমার আমার একসাথে হাঁটার গল্প, স্বপ্ন গড়া, ছোট ছোট ঝগড়া, বড় বড় ভালোবাসা। আমি তোমার হাত ধরে একটা গোটা জীবন পার করতে চেয়েছি। প্লীজ, ভেঙে পড়ো না। আমাদের বাচ্চাদের নিয়ে সংসারটা পরিপূর্ণ করতে তুমি ফিরবে; আমার কাছে, আমাদের কাছে, ইনশাআল্লাহ।”

এরমধ্যে স্ট্রেচারে টান পড়ল। নীরবের হাতের মুঠোটা ধীরেধীরে আলগা হয়ে গেল। প্রত্যাশার হাতটা ছুটে যায়। প্রত্যাশার চোখদুটো ও.টি-র দরজার ওপাশে যাওয়ার আগ অবধি নীরবের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। নীরব চোখের পলক নামিয়ে আশ্বাস দিল। তারপর দুই আঙুল থুতনির সামনে ধরে বোঝাল হাসো। তোমার ওই হাসি মুখটা দেখতে চাই। কপালে তীব্র ব্যথার ভাঁজ নিয়েই ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটাল প্রত্যাশা। নীরব সেদিকে টলমলে চোখে তাকিয়ে বিনিময় জোরপূর্বক অধর কোণে হাসি টানল।

কোমরে ইনজেকশন পুশ করার সঙ্গে সঙ্গেই সব ব্যথা জাদুর মতো গায়েব হয়ে গেল। দীর্ঘ সময় ধরে যন্ত্রণায় ছটফট করা প্রত্যাশার শরীরটা হালকা, নিস্তেজ হয়ে এল। চোখ ঘুরিয়ে চারপাশে তাকাল। ঠান্ডা, ঝকঝকে ও.টি রুম। মাথার ওপরে আলো, পাশে স্টিলের ট্রেতে সারি সারি যন্ত্রপাতি, কাঁচি-চিমটা সব গুছিয়ে রাখা হচ্ছে।
অদ্রিকা নীল রঙের ডাবল এপ্রোন পরে নিয়েছে। মুখ ঢাকা, হাতে গ্লাভস। একেবারে প্রফেশনাল ভঙ্গিতে প্রত্যাশার পাশে এসে দাঁড়াল সে। ওপাশে আরেকজন ডাক্তার। অ্যানেসথেসিওলজিস্টও আছেন। নার্স বেডের পাশের বাটনে চাপ দিতেই প্রত্যাশার বুকের একটু নিচে স্ট্যান্ড উঠে এলো। তার ওপরে একটা পরিষ্কার তোয়ালে রাখা হলো। এক নার্স এসে প্রত্যাশার ডান হাতটা ধরল আলতো করে। প্রত্যাশার মন শান্ত রাখার জন্য অদ্রিকা মৃদু হেসে বলল,
-” তুমি কিন্তু সত্যিই অনেক সাহসী মেয়ে, প্রত্যাশা।”
নার্স মেয়েটা কোমল গলায় বলল,

-” মাথা নিচু করে রাখুন, চোখ বন্ধ করলে ভালো লাগবে।”
ক্যাচ ক্যাচ কা’টা’র শব্দ প্রত্যাশার কানে আসছে, পেটে একটা টানও অনুভব হচ্ছে। ঠোঁট দুটো কাঁপছে প্রত্যাশার। ওই কম্পিত ঠোঁটে নিঃশব্দে বিড়বিড় করে সূরা ফাতিহা পাঠ করছে ও।
কিছুপল পরেই বাচ্চার কান্না শোনা গেল। ছোট্ট একটা গলা, অথচ তীব্র স্পষ্ট। অদ্রিকা দুইহাতে তুলতেই পাশের নার্স দ্রুত হাত বাড়িয়ে কোলে নিয়ে পরিষ্কার করতে নেয়। পরমূহুর্তেই আরেকটা বাচ্চা তুলতে তুলতে বলল,
-” আলহামদুলিল্লাহ। প্রত্যাশা তোমার দুইটা ছেলে বেবি হয়েছে।”
প্রত্যাশার চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি ঝরছে। আনন্দ অশ্রুতে গাল ভিজে গেল। কয়েক মূহুর্ত পরপরই আরেকটা বাচ্চা তুলে আরেকজন নার্সের কোলে বাচ্চাটা দিতে দিতে বলল অদ্রিকা,
-” খেয়াল রেখো, এটা ছোট বাচ্চা হবে। প্রায় এক মিনিট দেরিতে এসেছে।”
এই বাচ্চাটা এখনো কাঁদছে না। সিস্টার বলল,

-” ম্যাডাম এ এখনো কাঁদেনি তো।”
অদ্রিকা বলল,
-” চেষ্টা করো। কাঁদবে, সময় নাও।”
পরপরই অদ্রিকা বলল,
-” মা’কে বাচ্চা দেখাও।”
ধবধবে ফর্সা নবজাতককে ধরা হলো প্রত্যাশার সামনে। ছোট্ট চোখ দুটি যেন কালো মার্বেল, ঠোঁট টকটকে লাল। প্রত্যাশার গালের পাশে গাল ছুঁয়ে দেয়া হলো। প্রত্যাশা ফুঁপিয়ে উঠল। ছোট্ট মুখটার দিকে তাকিয়ে হৃদয় ভরে উঠল। প্রত্যাশার হাত বাড়িয়ে আদর করতে ইচ্ছে করছে। পরক্ষণেই নার্স টান দিয়ে সরিয়ে নেয়।
ওদিকে নার্স উদ্বিগ্ন কণ্ঠে ছোট বাচ্চাটার পিঠ চাপড়ে বলল,
-” ম্যাডাম এ তো এখনো কাঁদছে না।”
কাঁদানোর সব কৌশল করা হচ্ছে, তবুও কাঁদছে না বাচ্চাটি। অদ্রিকা দক্ষ হাতে তার কাজ করতে করতে বলল,
-” চেষ্টা করো।”

প্রায় দশমিনিট পর ছোট বাচ্চাটা কাঁদল। আর কান্না শুরু করল তো করলোই থামছে না। প্রত্যাশা সবটা শুনছে। ও ভাঙা গলায় ফিসফিসিয়ে বলল,
-” ছোট বাচ্চাটাকে দেখব।”
নার্স এসে ছোট বাচ্চাটিকে সামনে ধরল। কাপড়ে মোড়া, চোখ আধা বুজে কাঁদছে সে। নাকটা টুকটুকে লাল হয়ে গেছে কান্নার দরুণ। প্রত্যাশার সামনে থেকে ফট করে সরিয়ে নেয়া হয়। ঔষধের প্রভাবে প্রত্যাশা একসময় ঘুমিয়ে পড়ে।
ও.টির দরজার সামনে সবাই দাঁড়িয়ে। নীরব কপালে হাত চেপে চোখবুঁজে দাঁড়িয়ে। দরজা খুলতেই বাচ্চার কান্নার শব্দ ভেসে এল। নার্সের কোলে সাদা তোয়ালের ভেতর বাচ্চা। এগিয়ে এসেই হাসিমুখে বলল,
-” জোড়া ছেলে বাচ্চা হয়েছে।”
সবাই একযোগে তাকাল। নীরব এগিয়ে এসে অস্থির গলায় জিজ্ঞাসা করে,
-” প্রত্যাশা… পেশেন্ট ইয়ানূর প্রত্যাশা কেমন আছে?”
-” সবাই ভালো আছে। বাচ্চাকে ধরুন।”

নীরব একটু থমকে গেল। পাশে অধরা, নীহারিকা দাঁড়িয়ে। চোখেমুখে অভিভাবকসুলভ প্রশান্তি ওর। কিন্তু তাদের সামনে প্রথমবার সন্তানকে কোলে নেওয়ার লজ্জা, সংকোচ নীরবকে পেছনে টেনে রাখছে। ও ইতস্তত করতে লাগল। দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগল। নীহারিকা ছেলের মনের অবস্থা টের পেতেই পাশ থেকে বলে উঠলেন,
-” নীরব, কোলে নে।”
নীরব হকচকিয়ে গেল,
-” আমি? মানে, এখন?”
নীহারিকা হেসে বললেন,
-” নে তুই। বাচ্চাটাকে আগে তুইই ধর। আমরা পরে নেবো।”

নীরব হাত বাড়াল। নার্স সাবধানে তোয়ালে মোড়া বাচ্চাটিকে তার কোলে দেয়। নীরবের হাত দু’টো কাঁপছে। অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। বাচ্চার গা থেকে গরম গরম কোমল একটা উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ল নীরবের বুকে। মনে হলো বুকের ভেতর কিছু একটায় জমে থাকা বরফ গলে যাচ্ছে। চোখের কোণে অজান্তেই পানি এসে ভিড়ল। ছোট্ট মুখ, কাঁপা কাঁপা ঠোঁট, চোখের কালো মণি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাচ্চাটি দেখছে। নিজের র*ক্ত, মাং*সের একটা প্রাণ স্পর্শ করছে। সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া নিজের অংশকে কোলে নিয়ে নীরবের চোখে আনন্দ অশ্রু চিকচিক করে উঠল। নীরব চেয়ে রইল বাচ্চাটির মুখের দিকে। অবচেতনে বলল,

-” আমার ছেলে, আমার র*ক্ত।”
পরপরই নীরব নার্সের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল।
-” আরেকজন? আরেকটা বেবি কই?”
-” বাচ্চাটার কান্না থামছে না, কান্না থামলেই দিবো।”
তন্মধ্যে আরেকটা বাচ্চাকে এনে বলল,
-” এই যে আপনাদের ছোট বাচ্চাকে নিন। কান্না থামছিলই না। যাক অবশেষে থামাতে পারলাম।”
অধরা সামনে ছিলো। অধরার কোলে দেয়া হয়। নীরব কোল থেকে বাচ্চাটাকে মায়ের কোলে দিলো।
নিভান ওখানেই ছিলো। সে গাল ছুঁইয়ে আদর দিল। বলল,
-” মাশা-আল্লাহ! দেখতে খুব কিউট হয়েছে।”
নীহারিকা বললেন,

-” কোলে নে।”
নিভান ঠোঁটে হাসি টেনে বলল,
-” এত ছোট ধরতেই ভয় হচ্ছে। পরে নিবো।”
নিভান দু’টো বাচ্চাকে নোটিশ করে বলে উঠল,
-” মা দ্যাখো একটা জিনিস, ছোটজনের কিন্তু নীরবের মতো জোড় ভ্রু, বড়জনের কিন্তু আলাদা। আর আমার কাছে মনে হচ্ছে দুজনে দেখতে একদম সেমও নয়।”
অধরাও বললেন,
-” হ্যাঁ একদম ঠিক ধরেছো। আমারও তাই মনে হচ্ছে।”
নিভান ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে ফোনে ছবি তুলতে থাকল‌। বলল,
-” নীরব দু’জনকে একসাথে কোলে নে।”
নীরব এক আঙুলে কপাল চুলকিয়ে হেসে বলল,
-” একসাথে দুজনকে? সামলাতে পারব না। এত ছোট, লাগবে ভেবে ধরতেই ভ’য় হয়।”
নীহারিকা বললেন,
-” আমি পাশে থাকছি।”
নীরবের দুই হাতের মাঝে দু’টো বাচ্চাকে রাখা হলো। পাশেই অধরা আর নীহারিকা দাঁড়িয়ে। নিভান ছবি তুলতে থাকল। বলল,

-” মা আপনারা হাত সরান, কিছু হবে না। বাবার কাছে সবচেয়ে নিরাপদ যায়গায় আছে ওরা।”
নীরব মাথাটা হালকা নিচু করে বুকের সাথে আগলে রাখা নাজুক প্রাণ দু’টোকে দু’চোখ ভরে দেখল। প্রাণ জুড়িয়ে এল। এত আনন্দ আগে কখনো হয়নি। এই অনুভূতি নতুন, অন্যরকম। নীরব মনেমনে বলল,
-” আজ থেকে জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হলো। যেখানে আমি আর প্রত্যাশা শুধু আমরা নই। আমাদের দুটো হৃদস্পন্দন আর নিঃশ্বাসও আছে। যারা আমাদের অংশ হয়ে এসেছে পৃথিবীতে। আর
এখন আমি শুধু নীরব নই, একজন বাবা। এই দুটো কোমল প্রাণ, আমার অস্তিত্বের সবচেয়ে নিখুঁত ব্যাখ্যা।
ভয়, দ্বিধা, ক্লান্তি সবকিছু ছাপিয়ে এখন শুধু একটাই চাওয়া; ওদের ভালো রাখা, ভালোবাসা দিয়ে গড়ে তোলা। আজ থেকে জীবন নতুন অর্থ পেল, নতুন দায়, নতুন ভালোবাসা। এই দুটি প্রাণ আমার চোখের মণি, আমার পৃথিবী। শুকরিয়া আমার রবকে, যিনি আমাকে পরিপূর্ণ করেছেন।”

পরেরদিন…
সময়টা চারটা নাগাদ। বাচ্চার কান্নার শব্দে সকলের মাথা ধরে আসছে। তাকে থামাতে গিয়ে বড়রা হয়রান হলেও বাচ্চাটি কাঁদতে কাঁদতে এতটুকু হয়রান হচ্ছে না। চোখদুটো বুজে উঙগা উঙগা করে সর্বোচ্চ ভলিউম দিয়ে কাঁদছে। প্রত্যাশা বিরক্ত হয়ে বলল,
-” আম্মু, মাথা ধরে যাচ্ছে তো। ওকে থামাও।”
অধরা বললেন,
-” কী করব, থামছে না তো। পাঁচ মিনিট চুপ থাকলে আবার শুরু করে।”
এরমধ্যে নীলাশা আসে। এগিয়ে গিয়ে মায়ের কাছে দাঁড়াল। বাচ্চার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
-” এত কাঁদছে কেনো?”
অধরা বললেন,

-” নীলা এসেছিস। দ্যাখ না ছোট বাচ্চাটার কেমন কান্না থামছেই না। একটু চুপ থাকলেই আবার শুরু করে।”
-” কোনো সমস্যা হয়নি তো? শিশু ডাক্তার দেখানো হয়েছে?”
-” হ্যাঁ, শিশু ডাক্তার দেখেছেন। কোনো সমস্যা নেই।”
প্রত্যাশা বেডে শুয়ে, হাতে স্যালাইন চলছে। এদিকে তাকিয়ে বলল,
-” এ তো প্রথমে কাঁদছিলোই না, তারপর থেকে ওইযে শুরু করল, বান্দা থামতেই চাইছে না। দুমিনিট থামলে আবার দশমিনিট কাঁদছে এমন।”
নীহারিকার কোলে বড় বাচ্চাটা। মাত্রই ফিড করানো হয়েছে। দু এক ফোঁটা যা পাচ্ছে সেটাই খেয়ে বাচ্চাটা ঘুমিয়ে থাকছে। নীহারিকা বললেন,
-” নীলাশা ধরো।”
নীলাশা মনেমনে খুশিই হলো। সে সাহস করে বলতে পারছিল না। হাত বাড়িয়ে নিয়ে ওপাশের বেডে কোলের মধ্যে নিয়ে বসল। বুকের ভেতর একটা শীতল শিহরণ বয়ে গেল। চোখদুটো ছলছল করে উঠল। আঙুল দিয়ে ঘুমন্ত বাচ্চাটার আঙুলের ভাঁজে একটা আঙুল গুঁজে দেয়। পরম যত্নে কপালে চুমু আঁকল। প্রত্যাশার ভাগ্য সুপ্রসন্ন মনে হলো, চাঁদের মতো দু’টো বাচ্চা। এদিকে সে একটা বাচ্চার জন্যই হাহাকারে ম*রছে। নীহারিকা জিজ্ঞাসা করলেন,
-” নিভান কই?”
-” আসছে, নিচে আছে ও। ফল কিনতে গেছে বোধহয়।”
-” নীরবকে তো দুপুরে জোর করে বাসায় পাঠালাম। সেই রাত থেকে দৌড়াদৌড়ি করছে, সকালে এখানে কী একটু মুখে দিল। বললাম বাসায় গিয়ে গোসল করে খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যায় আসিস। নীরব গিয়ে খেয়েছে, নীলাশা?”

-” আসার আগে নীরবকে লাঞ্চের জন্য ডাকতে গিয়ে দেখি ও ঘুমিয়ে পড়েছে। ডেকে খাওয়ার কথা বলতেই বলল, ভাবি পরে খেয়ে নিবো।”
-” ইচ্ছে কী করে? তাকে আনতে পারতে। সকালে ছোট এসেছিল তখন স্কুলে ছিলো বলে আনতে পারেনি। ভাবলাম তোমার সাথে আসবে হয়ত।”
নীলাশা জড়তা নিয়ে বলল,
-” ইচ্ছে দুপুরে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তাই আনতে পারিনি। আমাকে আবার সন্ধ্যার আগেই ফিরে রাতের খাবার রান্না করতে হবে ভেবে একটু তাড়াতাড়ি আসলাম।”
প্রত্যাশার মনেমনে রাগ হচ্ছে এখানে বাচ্চাদের কান্নায় অতীষ্ঠ হচ্ছে সে। সেখানে নীরব বাসায় গিয়ে দিব্যি আরাম করে ঘুমাচ্ছে। নীরবকেও এই মাছের হাঁটে এক্ষুনি আনতেই হবে। এই ভেবে প্রত্যাশা বলল,
-” আম্মু আমার ফোনটা কই?”
-” কী করবি?”
-” দরকার আছে দাও তো।”

অধরার কোলে সাদা রঙের সফট তোয়ালের ভেতর বাচ্চাটা। অধরা থামানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু কিচ্ছুতেই কিছু হচ্ছে না। কান্নার বেগ বাড়ছে বৈ কমছে না। প্রত্যাশা এবারে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,
-” এ এত কাঁদছে কেনো?”
-” ক্ষুধা পেয়েছে। ঠিকমতো দুধ পাচ্ছে না, তাই হয়তো।”
-” আরেকজন তো ঠিকই শান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে। লক্ষ্মী হয়ে আছে। যত ক্ষুধা কী এরই পেয়েছে, আশ্চর্য!”
প্রত্যাশার হাতের উপর বাচ্চাটাকে নামিয়ে বললেন অধরা,
-” ডাক্তার আজকেই বাইরের খাবার দিতে বারণ করেছেন। দু’টো বাচ্চা বুকের দুধে হয় নাকি। তবুও তারা বলছেন, কাল থেকে দিবেন।”
নীহারিকা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে উঠলেন,
-” বাচ্চার পেট ভরছে না জন্য কাঁদছে। ওরা বলছে, তিনদিন না খাইয়ে রাখব, তবুও বাচ্চা সুস্থ থাকবে। এক্ষুনি বাইরের খাবার দেয়া যাবে না। এদিকে কাঁদতে কাঁদতে যে বাচ্চার গলা বসে যাবে সে খেয়াল আছে।”
তিনটে আঙুল একসাথে মুখে পুরে চপচপ শব্দ তুলল বাচ্চাটা। প্রত্যাশা সেদিকে তাকিয়ে বলল,
-” আম্মু, এর অতিরিক্ত খাইখাই স্বভাব দেখছি। সেকেন্ডে সেকেন্ডে খাওয়ানো হচ্ছে তবুও এর খাইখাই স্বভাবটা কমছে না, বরং বাড়ছে।”
অধরা চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বললেন,

-” চুপ করবি। ও দুধ পাচ্ছে নাকি। এমনিতেই সিজারের দু-তিনদিন পর দুধ নামে। তারপর দুজন।”
যতক্ষণ প্রত্যাশার হাতের উপর বুকের সাথে রাখা যায় ততক্ষণ চুপ করে থাকে। সরালেই চোখবুঁজে গলা ফাটিয়ে কাঁদে। প্রত্যাশা ফের বলল,
-” ফোনটা দাও।”
প্রত্যাশা ফাঁকা হাতে ফোনটা নিয়ে নীরবের কাছে ডায়াল করল। রাত জাগা হয়েছে, তারপর ছোটাছুটি করায় ক্লান্ত ছিলো। গোসল নিয়ে একটু শুতেই চোখ লেগে যায় নীরবের। প্রত্যাশার কল দেখে তড়িঘড়ি রিসিভ করল। উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,
-” হ্যালো, প্রত্যাশা? কোনো সমস্যা?”
প্রত্যাশা সরাসরি বলল,

-” আপনার ছোট ছেলের খাইখাই বন্ধ করতে তাড়াতাড়ি দুধ নিয়ে আসুন। তার কান্নায় আমি অতীষ্ঠ, ওদিকে আপনি পালিয়ে রয়েছেন। বাসায় আরাম করে ঘুমাচ্ছেন। এটা বরদাস্ত করা যাচ্ছে না।
এক্ষুনি দুধ নিয়ে আসুন, নইলে আমি কিন্তু আপনার ছোট ছেলের মুখে ভাত পুরে দিবো।”
নীরব থম মে*রে গেল। নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,
-” খাইখাই এসব কী ওয়ার্ড প্রত্যাশা? আবার ভাত..”
-” অতশত জানি না, আপনি এক্ষুনি আসুন। আর ডক্টরের সাথে যোগাযোগ করে…”
-” আমি এক্ষুনি আসছি।”

শিশু ডাক্তার আজকেই বাইরের খাবার দিতে বারণ করেছিল। তবে যেহেতু দু’জন তাই বাধ্য হয়েই দিতে হবে। নীরব কিছুক্ষণ ভেবে অদ্রিকার সাথে ফোনে যোগাযোগ করে।
নীহারিকা মুখটা গম্ভীর করে অসন্তুষ্ট গলায় বললেন,
-” ছেলেটা বাসায় গিয়ে একটু বিশ্রাম করছিল, কী দরকার ছিলো এক্ষুনি ফোন দিয়ে ডেকে আনার! এখানে সবাই আছে, এমনি তো কোনো সমস্যা নেই। আর বাচ্চারা একটু-আকটু কান্না করেই থাকে।”

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৫৭

নীরবের একহাতে পলিব্যাগে বায়োমিলের কৌটা। অন্যহাতটা ইচ্ছের হাত শক্ত করে ধরা। ইচ্ছেকে নিয়ে লিফটে ওঠে। আর উঠতেই ইচ্ছে চেঁচিয়ে উঠল,
-” মামা!”
লিফটে সার্থক অদ্রিকা দু’জনেই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। ইচ্ছে মুখে হাসি নিয়ে গমগমে স্বরে ঘনঘন বলল,
-” জানো মামা আমার ছোট্ট ছোট্ট দুইটা ভাইয়া এসেছে, আমার সাথে খেলার জন্যে। বড় পাপা আমাকে ছবি দেখিয়েছে আর বলেছে, পুচকো দুইটা আমার ভাইয়া হয়। এইটুকুন এইটুকুন মুখ। খুউউউব কিউট!”

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৫৯

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here