মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৬
মুসতারিন মুসাররাত
-” অ্যাট লিস্ট ফর ইচ্ছে—এই কথার মানে কী, নীরব? তুমি একচুয়েলি কী মিন করতে চাইছো? তুমি বলতে চাইছো আমি নীবিড়ের মঙ্গল চাই না? আমি চাই না ও সুস্থ হয়ে উঠুক! সত্যিই কি তাই ভাবো?”
নীরব ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,
-” আমি কোথাও বলেছি এমন কিছু?”
প্রীতি ফাঁকা ঢোক গিলল। কণ্ঠটা একটু কাঁপল,
-” স-স-রাসরি না বললেও, তোমার কথাগুলোতে সেই ইঙ্গিতই লুকোনো। আর নীবিড়ের সঙ্গে আমার দেখা করতে না দেওয়া; তোমার মুখে না বলা কথাটাই যেন নিঃশব্দে চিৎকার করে প্রমাণ দিচ্ছে।”
-” অ্যা গিল্টি কনশান্স নিড্স নো অ্যাকিউজার।”
দমে রাখা রাগটা এবার দপ করে জ্ব’লে উঠল। প্রীতি এক প্রকার চেঁচিয়ে বলল,
-” নীর.অ.অ..ব। তুমি কিন্তু বারংবার আমার দিকেই ইঙ্গিত দিয়ে আসছো। কোনো প্রুভ ছাড়া এভাবে আমাকে দোষারোপ করার রাইট তোমার নেই।”
-” আই জাস্ট কোটেড অ্যা প্রভার্ব। হুয়াই আর ইউ টেকিং ইট সো পার্সনালি?”
প্রীতি চোখ বুজে নিজেকে সামলান। কোনো রকমে বলল,
-” ইচ্ছে ডাকছে, আমি রাখছি। বাই।”
বাড়তি কথা না বলে প্রীতি ফোন রাখে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
প্রত্যাশাকে খানিকটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে দেখে অধরা হকচকাল। তড়িঘড়ি করে বলে উঠল,
-” আরে ফুফু কী বলো না তুমি! দুইটা মেয়ে বিয়ে দিয়েছি। এখন তো অপেক্ষা, কখন নাতি-নাতনি কোলে আসে। আল্লাহ আমাকে দুইটা দারুণ মেয়ে দিয়েছেন, এ নিয়েই আমি সন্তুষ্ট। আর কোনো আফসোস নেই আমার।”
কথার মাঝেই অধরা বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে চোখে-ইশারায় কিছু বোঝানোর চেষ্টা করল। এ বিষয়ে আর কিছু যেনো না বলা হয়। প্রত্যাশা কপালে খাঁজ ফেলে বো’কা বো’কা চেয়ে ভাবছিল। ঠিক তখনই অধরা ডাকল,
-” প্রত্যাশা, ওখানে দাঁড়িয়ে যে। কিছু বলবি?”
মাথা নেড়ে জবাবে বলল,
-” না আম্মু।”
প্রত্যাশা বৃদ্ধার কথা নিয়ে আর মাথা ঘামাল না। বুড়িটার বয়স হয়েছে। কী করে? কী বলে? নিজেই ঠাহর করতে পারে না। এইতো রোজরোজ ছেলেদের বউয়ের সাথে ক্যাচাল করে, না খেয়ে এখানে-ওখানে এসে ছেলেদের বউয়ের চর্চা করে বেড়ায়। সাথে ছেলেদের নিয়েও তার আফসোসের শেষ নেই। আবার অন্যকে বলে কী না– ছেলে ছাড়া চলে। যত্তসব। এসব ভেবে মনেমনে মাথা ঝাড়া দিয়ে প্রত্যাশা ফ্রিজের দিকে এগোল। বলল,
-” ঠান্ডা পানি লাগবে।”
ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির বোতলটা বের করে গ্লাসে ঢালছিল প্রত্যাশা। অধরা কিচেনে যায়, বৃদ্ধার জন্য নাস্তা আনতে। বৃদ্ধা নানি পান চিবোতে চিবোতে হঠাৎ কণ্ঠে কৌতুক, মশকরা মিশিয়ে বলে উঠলেন,
-” হ্যাঁ রে প্রত্যাশা, সোয়ামি নিয়ে ঘরে খিল এঁটে বসে আছিস। সোয়ামি তোকে একা একাই দেখতে হবে বুঝি? আমাদের একটুখানি চোখে দেখারও সুযোগ দিবি না!”
-” বিয়ে করেছি নিজের জন্য, হাটে বাজারে খুচরো দেখানোর জন্য না। সোয়ামি তো আর পাড়ার ফেয়ার দেখানোর পোস্টার না; যে সবাইকে দেখিয়ে বেড়াব, হুঁ।
প্রত্যাশাও উল্টো মজার ছলে ঠাসঠাস বলে দিলো। বৃদ্ধা শাড়ির আঁচল তুলে পান খেয়ে টকটকে করা ঠোঁট জোড়া মুছলেন। বললেন,
-” দ্যাখ, বেশি করে তুইই দ্যাখ।”
এক মূহুর্ত থেমে হঠাৎ চামড়া ঘুচানো বদনখানিতে সিরিয়াস ভাব ফুটিয়ে বললেন,
-” আর শোন, শুনেছি দু’দিন পর শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছিস। সেখানে গিয়ে মুখের উপর ঠাসঠাস কথা বলিস না। রয়েসয়ে কথাবার্তা বলবি। দাঁত কেলিয়ে সবার সামনে গজ দাঁতটা দেখিয়ে বেড়াস না আবার।”
প্রত্যাশা বি’রক্ত হয়ে ‘চ’ শব্দটা টেনে বলল,
-” তোমার যে কটা দাঁত আছে সেগুলো তো পান খেয়ে-খেয়ে একেবারে তরমুজের বিচির মত কালো করে ফেলেছো। ইয়াক! তোমার থেকে আমার গজ দাঁতটা তাও ঢের ভালো।”
প্রত্যাশার বুঝে আসে না, তার গজ দাঁতটা নিয়ে এদের এত হেডেক কেনো? বিশেষ করে এই বুড়িটা প্রায়ই গজ দাঁত নিয়ে বলেই থাকে। প্রত্যাশা ঠোঁট ফাঁক করে একেবারে বাচ্চাদের মতো হাসি দিয়ে সব দাঁত দেখিয়ে বলল,
-” ইইইইইইইই…এইভাবে শ্বশুরবাড়ির সবাইকে দেখাব। তোমার কী সমস্যা?”
-” ভালোর জন্য বললুম, আর তুই উল্টো রেগে যাচ্ছিস! পাড়ার লোকজন তো নতুন বউ দেখতে আসে না, আসে খুঁত ধরতে। যখন মুখের উপর বলে দেবে তখন বুঝবি। তাই আগেই সতর্ক করলুম।”
-” তোমার মতো টাইপের প্রতিবেশীদের থোড়াই কেয়ার করবে প্রত্যাশা!”
এই বলে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ মনে পড়ল,
-” ইয়া আল্লাহ! ওদিকে এএসপি সাহেবের প্রেমালাপ শেষ হয়ে গেল না তো। যত দোষ বুড়িটার। দিলো তো দেরি করিয়ে। উফ্! অসহ্য।”
হন্তদন্ত পায়ে, হাতের কাঁচের গ্লাসে টলমল পানি নিয়ে প্রত্যাশা রুমে ঢুকল। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ছিল নীরব, নিঃশব্দে বাইরের দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ পাশ ফিরতেই–ব্যস্ত পায়ে আগত প্রত্যাশার সঙ্গে মুখোমুখি ধা’ক্কা। মুহূর্তের মধ্যে গ্লাস কেঁপে উঠল। আর ঠাণ্ডা পানি ছলকে পড়ল নীরবের সাদা শার্টের বুক জুড়ে। শার্টটা ভিজে গিয়ে গা-লাগা হয়ে গেছে। প্রত্যাশা আ’ত’ঙ্কে জমে গেল–‘এইরে উনি এখন ধ’ম’ক না দিয়ে বসে।’ জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে ভ’য়ে কাঁপা গলায় দ্রুত বলে উঠল প্রত্যাশা,
-” স্যরি! স্যরি… আমি সত্যিই খেয়াল করিনি!”
নীরব একহাতে শার্ট ঝাড়তে ঝাড়তে তাকায় প্রত্যাশার মুখপানে। নীরবের মুখে কোনো বি’র’ক্তি নেই, বরং কণ্ঠ নিঃসৃত হলো এক ধরণের শান্ত সুর,
-” ইটস ওকে।”
প্রত্যাশা ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইল নীরবের শান্ত, সংযত মুখটার দিকে। নীরব গ্লাসটা নিতে হাত বাড়ালে, হঠাৎ করেই আঙুল ছুঁয়ে যায় আঙুলে। প্রত্যাশার ঠান্ডা আঙুলে উষ্ণ আঙুলের ছোঁয়া লাগতেই; প্রত্যাশার শরীরজুড়ে কাঁপুনি খেলে গেল। মুহূর্তটা যেন একটু থেমে যায়। এক অদ্ভুত নিরব অনুভব ছড়িয়ে পড়ে দু’জনের মাঝখানে। চোখে-মুখে অপ্রস্তুত ভাব। কিন্তু অদৃশ্য কোথাও রয়ে গেল–এই অনিচ্ছাকৃত ছোঁয়ায় কিছু ছিল। প্রত্যাশা জমে বরফ হয়ে মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। নীরব গ্লাস মুখে তুলে কয়েক ঢোঁক পানি খেয়ে নিল। মুখে কিছুই না বলে আচমকা একহাতে প্রত্যাশার কোমল একটা হাত ধরে; এতে যেনো প্রত্যাশার চক্ষু চড়কগাছ। প্রত্যাশা তড়িৎ মাথাটা তুলে নীরবের দিকে তাকায়। নীরব নির্লিপ্ত ভঙিতে ডান ভ্রু কিঞ্চিৎ উঁচু করে প্রত্যাশার বিস্মিত চক্ষুতে তাকিয়ে গ্লাসটা ধরিয়ে দিল। প্রত্যাশার হৃদপিণ্ড যেন আচমকা দৌড়ে চলল, কোন নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই। নীরব প্রত্যাশার বিস্ময়ে ঠাসা মুখের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা স্বরে বলল,
-” থ্যাংকস।”
পরপর মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে এক আঙুলে কপাল চুলকিয়ে; প্রত্যাশার চোখে চোখ রেখে শান্ত গলায়,
-” বাই, টেইক কেয়ার।”
বলে লম্বা পা ফেলে প্রস্থান করে নীরব। সব সময় মুখর থাকা প্রত্যাশা এবার একেবারে নিশ্চুপ। কিছু বলতে যেনো ভুলে গেল। শব্দ খুঁজে পেল না মুখে। শুধু বিস্ময় আর অনুরণনে ভরে রইল মেয়েটার চোখ-মুখ। কিছুপল পর সম্বিৎ ফিরে পেতেই ঘোর কা’টে প্রত্যাশার। ভাবল—‘তখনকার আজগুবি ভাবনা একেবারেই নিছক ছিলো না। এএসপি সাহেব তো সাং’ঘাতিক! বাপ্রেহ,কী সাং’ঘা’তিক! সাধে কী আর মিস্টার আনপ্রেডিক্টেবল বলি। প্রথম দিনেই হাত ছুঁয়েছে। এরপরের বার যে ঠোঁট… প্রত্যাশা চোখ বুজে নেয়। না নাহ…যতটা ভদ্র ভেবেছিলাম, ততটাও নয়। সুযোগের সদ্ব্যবহার ভালোই করতে জানে দেখছি।’
পরেরদিন….
আজকের বিকেলটা মেঘাছন্ন, সাথে হালকা বাতাস। আবহাওয়াটা দারুণ নাতিশীতোষ্ণ। প্রাইভেট শেষ করে স্যারের বাসা থেকে গল্প করতে করতে বেরোচ্ছিল প্রত্যাশা ও তার বন্ধুদের ছোট্ট দল—হ্যাপি, কোয়েল আর সে নিজে পাশাপাশি হাঁটছে। ঠিক সামনে রোহান আর নাহিদ। আগে-পিছে আরও কয়েকজন ছেলে-মেয়ে। প্রতিদিনকার মতোই হাসি-ঠাট্টা, ঠেলা-ধাক্কা, আর গল্পে জমে উঠেছে চারপাশটা।
এমন সময় প্রত্যাশার ফোনে ভাঁজ খোলা চিঠির মতো একটা মেসেজ নোটিফিকেশন। ফোন অন করেই চোখ পড়তেই, ‘অচেনা বালক’ নামের আইডি থেকে মেসেজ রিকোয়েস্ট নজরে এল। খোলামাত্রই প্রথমেই ‘হাই’ তারপরেই বিশাল প্রেমপত্র! হঠাৎ করেই কেউ নিজের মনের জমে থাকা রোমান্টিকতা যেনো ঢেলে দিয়েছে ইনবক্সে। প্রত্যাশা হো হো করে হাসতে হাসতে গলা চড়িয়ে পড়ে শোনাতে লাগল। শেষের দিকে ছিলো,
-” প্রত্যাশা, প্লিজ একটা রিপ্লাই দিও। তোমাকে আমি খুব ভালোবাসি। তোমাকে না পেলে বাঁচব না।”
এই শোনামাত্র পুরো দল হেসে কুটিকুটি। রোহান মশকরা করে পিছনে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল,
-” দোস্ত, জীবন বাঁচানো ফরজ! একটা রিপ্লাই দে জলদি!”
প্রত্যাশা চোখ গরম করে বলল,
-” আহারেএএ! নিজেই কতক্ষণ বাঁচি ঠিক নেই। এক মিনিট পর আমি থাকব কিনা, তার গ্যারান্টি নাই! আর কই থেকে উজবুক এসে বলে; তোমাকে ছাড়া বাঁচব না! হায়রে প্রেম! এসব ‘আ’জা’ইরা’রে যদি হাতের কাছে পেতাম, এক থা’প্পড়ে দাঁত গুনত!”
বন্ধুরা তো একদফা মজা লুটে নিল। হাসি থামতেই চায় না। নাহিদ বলল,
-” এইসব ইনবক্স রোমিওদের জন্য আলাদা হাসপাতাল খোলা দরকার!”
বন্ধুরা আরো কিছু হাসি ঠাট্টা শেষে যে যার মত বিদায় নেয়। বন্ধুদের থেকে বিদায় নিয়ে স্কুটিতে চেপে বসল প্রত্যাশা।
মিনিটখানেক ধরে ট্রাফিক সিগন্যালে আ’টকে আছে প্রত্যাশা। স্কুটির হ্যান্ডেলে হাত রেখে বি’র’ক্ত চোখে লাল বাতির দিকে তাকিয়ে আছে। তন্মধ্যে একহাত দূরত্বে এসে দক্ষ হাতে ব্রেক কষে একটা কালো বাইক।
প্রত্যাশা বিরক্তিতে ‘চ্’ শব্দ করে মুখ বাঁকায়, ঘাড়টা খানিকটা ঘোরাতেই চোখ বড়বড় হয়ে যায়। বাইকার আর কেউ না—স্বয়ং মিস্টার আনপ্রেডিক্টেবল।
একই শহরে বাড়ি হওয়ায় এই এক সমস্যা। শপিং বলো, বাইরে ঘুরতে আসা, যখন-তখন শ্বশুড়বাড়ির লোকের সাথে দেখা হওয়ার থাকে প্রবল সম্ভাবনা। আম্মু তো পইপই করে বারণ করেছে স্কুটি চালাতে। রিকশা করে কলেজ- প্রাইভেট যেতে আসতে বলেছে। না জানি শ্বশুড়বাড়ির লোকজন কবে কী বলে-কয়ে বসে। কিন্তু প্রত্যাশা শুনলে তো!
এই জায়গাটাতে দীর্ঘ সময় জ্যাম পরে। নীরব চোখেমুখে একরাশ বি’র’ক্তি নিয়ে দুইহাত দিয়ে মাথার হেলমেটটা খুলে হ্যান্ডেলের সাথে ঝুলিয়ে রাখল। পরপর একহাতে ঘন সিল্কি চুলগুলো ব্যাক ব্রাশ করে নেয়। প্রত্যাশার দৃষ্টি জোড়া চম্বুকের মতো নীরবের দিকে টানছে; চেইক শার্টের উপরে গাঢ় নীল রঙের ডেনিম শার্টের বাটন খোলা। হাতার আস্তিন কনুই অবধি গোটানো। ফর্সা হাতে কালো হাতঘড়ি। চুল স্টাইলিশ ভাবে সামান্য উঁচু আর ব্যাকব্রাশড।
বলার অপেক্ষা রাখে না ক্যাজুয়াল লুকে নীরবকে খুবই আকর্ষণীয় লাগছে। নীরব নিম্নাষ্ঠে দাঁত চেপে ঘাড়টা কিঞ্চিৎ ঘোরাতেই ভ্রু কুঁচকে যায়। গাঢ় চোখে সাইড গ্লান্স ছুঁড়তেই দু’জনের চোখে চোখ। মুহূর্তটা যেন স্থির হয়ে এল। নিম্নাষ্ঠে শক্ত করে দাঁত চেপে প্রত্যাশার দিকে তাকিয়ে নীরব। প্রত্যাশা চোখের পলক ঝাপটাল। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলল। তবে নীরবের এভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে প্রত্যাশা একটু মনেমনে গদগদ হলো। ভাবল– মিস্টার আনপ্রেডিক্টেবল নিশ্চয় আজ আগ বাড়িয়ে কথা বলবে। প্রত্যাশা দৃষ্টি নত করে আঙুলে গুটিয়ে মুখের সামনের একগাছি চুল পেঁচাতে থাকে— বদনখানিতে একটু ভাব, আর একটু আশা মিশিয়ে। অপেক্ষায় থাকে।
কিন্তু নীরব দৃষ্টি সরিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করে স্ক্রল করতে শুরু করে। নীরবকে নির্বিকার দেখে প্রত্যাশার মুখটাই এবার শুকিয়ে যায়। মনেমনে একটা ঝাঁঝালো ‘হুহ’ বেরিয়ে আসে। লোকটার কি একটুও খেয়াল নেই? বিয়ে করা বউ তার! তারপর আত্মীয়ও তো। একহাত দূরত্বে, অথচ বিন্দুমাত্র কার্টেসি নেই! ভালো-মন্দ কিছুই বলছে না। রা’গে মুখ গরম হয়ে ওঠে প্রত্যাশার। প্রত্যাশা ভাবে; সেও আগ বাড়িয়ে কিছু বলবে না। এভাবে মিনিট পেরিয়ে গেল। প্রত্যাশার রাগ কমল না বরঞ্চ বাড়ল। আচমকা প্রত্যাশার মনে পড়ে যায় শিল্পী মমতাজের সেই বিখ্যাত গানটা। প্রত্যাশা ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রল করতে করতে আড়চোখে নীরবের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে গাইল,
-” দেখলে তারে মনে হয় বড়ই ভোলাভালা
আমার লাগি পরাণে তার দেয় না কভু দোলা।
মুরব্বিরা কইল সবাই–নো টেনশন, নো চিন্তা,
পাইছো জীবনে দারুণ একটা পোলা!
পোলা তো নয়, সে তো আ°গু°নে°র গোলা…
পোলা তো নয়–একখান আ°গু°নের গোলা!”
নীরবের কানে শব্দগুলো পৌঁছল কী না? মুখাবয়ব দেখে তা ঠাওর করা গেল না। নীরব ফোনটা পকেটে পুরে ত্রস্ত হেলমেটটা মাথায় চাপিয়ে নিল। সামনের সারির গাড়িগুলো একে একে গতি নিতে শুরু করেছে। নীরব বাইকে চাবি ঘোরাতেই প্রথমে কিছুই হলো না। আবার চেষ্টা করল–দুবার, তিনবার। তবু ইঞ্জিন চালু হয় না। ঠিক তখনই পাশ থেকে প্রত্যাশা ঠোঁটের কোণে এক টুকরো বাঁকা হাসি নিয়ে ছুঁড়ে ছুঁড়ে বলল,
-” এএসপি সাহেব, হেল্প লাগবে নাকি? চাইলে লিফট দিতে পারি।”
ওর কণ্ঠে ব্যঙ্গ, আবার একটু চ্যালেঞ্জের সুরও। নীরব একচোখে তাকিয়ে হাসল না, বি’রক্তও হলো না। বরং ধীর পায়ে আবার পা দিয়ে ক্লাচ টিপল, এইবার ইঞ্জিন গর্জে উঠল। নির্ভার শব্দে ভেদ করল নিস্তব্ধতা। তারপর প্রত্যাশার দিকে না তাকিয়েই দৃঢ় অথচ ঠান্ডা কণ্ঠে বলল,
-” নীরব কারো হেল্পের প্রয়োজন অনুভব করে না। তবে কেউ যদি হেল্পের জন্য প্রপোজ করে–তাকে সে ভোলে না। মনে রাখে।”
একটা মুহূর্ত থেমে বাইক ছুটিয়ে দিল নীরব। প্রত্যাশা ঠোঁট উল্টে বলল,
-” ধূর! আজকের জন্য ইঞ্জিনটা একটু চালু না হলে খুব কী ক্ষ’তি হতো? ব্যাটার ভাবটা একটু দমানোর জন্য হলেও; খুব করে চাইছিলাম বাইক যেন চালু না হয়। ধ্যাত তা আর হলো কই?”
প্রত্যাশা এসব ভেবে আ’হত হয়ে ধীর সুস্থে স্কুটি চালু করে, এগোবে। এমন সময় ঝ’ড়ের গতিতে নীরবকে বাইক নিয়ে ফিরে আসতে দেখে ও থমকে গেল। রোডের একপাশে ছিলো স্কুটি তাই অন্য যান চলাচলে সমস্যা হচ্ছিল না। নীরব ঠিক সামনে এসে ব্রেক কষল। একটা আইসক্রিম বক্স প্রত্যাশার দিকে বাড়িয়ে বলল,
-” এটা, রাখো।”
মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৫
চোখ-মুখে কিঞ্চিত বিস্ময় নিয়ে প্রত্যাশা তাকাল। গাল দু’টো অটোমেটিক ফুলে উঠল। মনে হলো; আমাকে দেখে এএসপির এতই ছোট মনেহয়। আইসক্রিম ধরিয়ে দিচ্ছে।
পরপর প্রত্যাশা স্বগোতক্তি করে মনেমনে ঝাঁঝালো স্বরে আওড়ালো,
-” ও প্রত্যাশা তোর কপাল তাও একটু হলেও ভালো। রসকষহীন এএসপি তোর হাতে আইসক্রিমের জায়গায় যে ললিপপ ধরিয়ে দেয়নি। এই তো ঢের বেশি।”