মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৭

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৭
মুসতারিন মুসাররাত

মাঝ দুপুরের একরোখা রোদের তেজে চারদিক কেমন ঝিমিয়ে পড়েছে। বাতাসটাও থমকে আছে। ঘরের ভেতরটা গুমোট। বাইরের হাঁসফাঁস করা গরমের উত্তাপ যেন জানালার ফাঁক গলে ঘরেও ঢুকে পড়ছে। সোফার এক কোণে হেলান দিয়ে বসে নিভান মনোযোগহীনভাবে ফোন স্ক্রল করছে। ওদিকে নীলা রা’গে ফুঁসছে। চোখেমুখে বি’র’ক্তি আর অসন্তোষ। পরনে হালকা গোলাপি-সোনালি পাড়ের শাড়ি, সঙ্গে মানানসই হালকা কাজের ব্লাউজ। মুখে প্রসাধনীর ছোঁয়া। খানিকক্ষণ ধরে বসার ঘরে পায়চারী করছে আর প্রত্যাশার উপর মে’জাজ চ’টছে নীলার। গরমের মধ্যে সাজগোজ ন’ষ্ট হয়ে যাচ্ছে অথচ প্রত্যাশার খবর নেই। অধরা একপাশে এসে নীলাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

-” প্রত্যাশার কাছে আরেকবার কল দিয়ে দ্যাখ না। যদি এবারে ধরে।”
নীলার ধৈর্যের বাঁধ এবার ভেঙে গেল। গজগজ করতে করতে রাগত কণ্ঠে বলে উঠল,
-” আর কতবার কল দিবো? তিন-চারবার কল দিয়েছি। বারবার রিং হয়ে কে’টে যাচ্ছে। তোমাদের আদরের রাজকন্যা কল তুলছে না। আমি আর পারব না এই কল-টল করতে। আমার অতো ঠ্যাকা পড়েনি।”
অধরা একরাশ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মৃদু স্বরে বলল,
-” ফোনটা হয়তো সাইলেন্ট করে ব্যাগে রেখেছে। রাস্তায়ই আছে হয়তো। তুই একটু চুপচাপ বস, প্রত্যাশা চলে আসবে এক্ষুনি।”
নীলা দেওয়াল ঘড়ির দিকে একবার তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে মায়ের মুখের দিকে বি’রক্ত ভঙ্গিতে চাইল। চোয়াল শক্ত করে বলল,
-” আমি পরীক্ষা দিয়ে তাড়াতাড়ি চলে এলাম। আর সে এখনো আসলো না। জানতো না, দুপুরে নিভান আসবে? আজ ও বাড়ি যেতে হবে। তা আজকে ওর কলেজে যাবার এত কী দরকার ছিলো, শুনি? দুপুর পেরিয়ে যাচ্ছে এখনো উনার খবর নেই। যত্তসব!”
অধরা মিনমিনে স্বরে কিছুটা সাফাই দেয়ার চেষ্টা করল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-” ও তো বলল, দুটো ক্লাস করেই দুপুরের আগেই চলে আসবে। কী একটা নোট দেবে আজ…”
মায়ের মুখ থেকে প্রত্যাশার হয়ে এইসব সাফাই শুনে নীলা আরও তেতে উঠল,
-” আম্মু, তুমিও না! ও যা বলে তাই অ’ন্ধের মতো বিশ্বাস করে নাও। এখনো বুঝতে পারো না! আসল কথা হলো; প্রত্যাশা ও বাড়ি যাবে না, তাই কলেজের অজুহাত দিয়েছে। এখন ঘাপটি মে°রে আছে। ফোনও ধরছে না। মুখে বলেনি ঠিকই, তবে আমি জানি। ও ইচ্ছে করেই এমন করছে।”
নিভান বলল,
-” আরে নীলা, তুমি একটু শান্ত হও। ফ্যানের নিচে এসে বাতাসে বসে থাকো তো। সমস্যা নেই, অপেক্ষা করি না হয়, ততক্ষণে প্রত্যাশা আসুক। কোনো ব্যাপার না।”
নীলার রাগ মুহূর্তে আরও বেড়ে গেল। প্রত্যাশার দেরি হওয়া নিয়েও কেউ কিছু বলছে না। এইযে প্রত্যাশা এখনো আসছে না, এই নিয়ে ও কিছু বলছে। এতে সবাই ওর উপরই বি’রক্ত হচ্ছে। নীলার মনেহয়; প্রত্যাশার জন্য যেন সবই মাফ। ওর এই উড়নচণ্ডী স্বভাব, ভুল-ত্রুটি, কিছুই কারো চোখে পড়ে না। এইভেবে নীলার ভেতর- ঈর্ষাপূর্ণ মনোভাবটা ঠিকরে বেরিয়ে এল। রাগ চাপা গলায় বলল,

-” আমি এক্ষুনি নীরবকে ফোন দিচ্ছি। বলে দেই–প্রত্যাশা আজ ও বাড়ি যাবে না। তাই এখনো কলেজ থেকে ফেরেনি, আবার কলও তুলছে না। আমরা চলে যাচ্ছি। বাবা কিছু বললে, তুমি এটা বলে দিও।”
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে নীলা ফোন হাতে তুলল। পাশে জামাই থাকায় অধরা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। শুধু বললেন,
-” আরেকটু দ্যাখ না।”
কিন্তু নীলা কিছু শুনল না। নিভানও এবার বি’র’ক্ত হলো। এ ক’মাসে সংসার করতে গিয়ে নিভান ঢের অনুমান করেছে; নীলাটা বেশ রাগি আর জেদি। নিভান হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে চুপচাপ রইল।

শহরের নামকরা সিটি কেয়ার ক্লিনিক। শান্ত দুপুরবেলা। ক্লিনিকের রিসিপশনের সামনে দু’জন পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে। তারা রিসিপশনিস্টের সঙ্গে নিচু স্বরে কিছু কথা বলছে। সেই থেকে সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে নীরব। গায়ে ঝকঝকে ইউনিফর্ম, কোমরে সার্ভিস রি’ভলবার, আর মুখে কঠিন এক গম্ভীর ভাব। এক হাত পকেটে গুঁজে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে। চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে চারপাশটা দেখছে। হঠাৎ পরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলানো, এক হাতে ফোন আরেক হাতে কপাল চুলকে সার্থক বলল,
-” আরে এএসপি সাহেব যে! তা এখানে হঠাৎ কী মনে করে?”
নীরবের গায়ে ইউনিফর্ম। বোঝাই যাচ্ছে ডিউটিতে আছে। আর কী জন্য এসেছে তা সার্থকের অজানা থাকার কথাও নয়। নীরব চোখ নামাল না। আগের মতোই সোজা দৃষ্টি রেখে গাম্ভীর্য ভরা কণ্ঠে বলল,
-” ডিউটি, ডক্টর। কেউ কেউ যেমন শুধু ডিউটি আওয়াজ দেয়, কেউ আবার সেটার মানে বোঝে। আমি বোঝাতে আসিনি। করতেই এসেছি। ডিউটিতে এসেছি।”
সার্থক ভাবল– এই নীরব আজীবনই ত্যাড়াই থেকে যাবে। উত্তরটাও ওকে ত্যাড়া সুরে দিতে হলো। সার্থক জোর করে ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি টেনে বলল,

-” যতই হোক আত্মীয় মানুষ তুমি, চলো আমার চেম্বারে বসবে। বলো কী অর্ডার করব, চা না কফি?”
-” এটা হসটপিটাল, বাসা নয়। আর এখানে আমি আতিথেয়তা গ্রহণ করতে আসিনি। আমার উপর বর্তানো দায়িত্বে আসছি।”
-” দায়িত্ব তো আমারও কম নয়, এএসপি সাহেব। তফাৎ হলো, আমার দায়িত্ব এখানে জীবন বাঁচানো। তোমারটা…হয়তো অ’পরাধ খুঁজে বার করা।”
-” অপরাধ থাকে বলেই জীবন বিপন্ন হয়, ডক্টর। আর সেই অ’পরাধ দমন করাই আইনের লোকের দায়িত্ব।”
-” সব দায়-দায়িত্বের ভাষা এক নয়, অফিসার। এখানে দেহটা আগে, অ’পরাধটা পরে।”
-” জানি, ডক্টর। তবে মনে রাখো, কখনও কখনও অ’পরাধটাই দেহের ভিতরে ঢুকে পড়ে। তখন ডাক্তারের ছু°রি আর পু’লিশের গু°লি— দুটোই দরকার হয়।”
সার্থক আর বাড়তি কথা না বলে আন্তরিকতা দেখিয়ে বলল,
-” বলো কীভাবে হেল্প করতে পারি? রোগী, নাকি রিপোর্ট? কী ব্যাপারে জানতে চাও?”
নীরব এক শব্দে বলল,

-” সব।”
ক্লিনিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে; গত এক মাসে ৫ জন রোগী ভুয়া রিপোর্টের ভিত্তিতে ভুল চিকিৎসায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। একজন মৃ°ত্যু মুখেও পতিত হয়। মৃ”তের ভাই কেস করে। কেসের তদন্তের জন্য পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা সরেজমিনে তদারকি করতে এসেছে। এরমধ্যে এএসআই তানভীর এসে বলল,
-” স্যার!”
নীরব তাকিয়ে জবাবে বলল,
-” হ্যা বলো।”
-” স্যার ক্লিনিকের যে মালিক তিনি অভিজ্ঞ ডাক্তার। তিনি একজন সিনিয়র ডাক্তার।”
তানভীরের এক সমস্যা আসল কথা না বলে ইয়া বড় দৃশ্যপট টানে। নীরব কপাল কুঁচকে তাকিয়ে ঠান্ডা স্বরে বলল,
-” আসল কথা বলো।”
তানভীর ঢোক গিলে বলল,
-” জ্বী, জ্বী স্যার বলছি। স্যার ক্লিনিকের মালিক দেশের বাইরে আছে। পরশু দেশে ফিরবে।”
-” ওকে। আর শোন, ল্যাবে গিয়ে খোঁজ নাও; রিপোর্ট তৈরি করে কে?….”
আরো কয়েকটা কথা বলে নীরব। তানভীর জবাবে বিনম্র ভাবে বলল,
-” জ্বী, স্যার। ঠিক আছে, ঠিক আছে।”

ওদিকে সার্থক চিলমুডেই আছে। ভাগ্যিস সে এই ক্লিনিকের একজন নতুন ডক্টর। ক’দিন আগে ক্লিনিকের মালিক শেয়ার নেওয়ার জন্য অফার করেছিলো। নিবে নিবে করছিলো, বাট নেয়নি। সার্থক মনেমনে ভাগ্যকে ধন্যবাদ জানায়। এখন তদন্ত করে যা হয় হোক গা। ক্লিনিক সিলগালা হলেও তার কিছু যায় আসবে না। সে অল্প ক’দিন হলো এখানে কনসালটেন্ট ডক্টর হিসেবে আসছে। নীরবকে উদ্দেশ্য করে সার্থক বলল,
-” আচ্ছা কোনো হেল্প লাগলে বলো। আমি এখন বাসায় যাচ্ছি। বাই।”
নীরব প্রত্যুত্তরে সৌজন্যমূলক বলল,
-” ঠিক আছে।”
হাতের ফোনটা অন করতেই একেএকে হটস অ্যাপে নোটিফিকেশন আসতে লাগল। আগে নজরজোড়া আটকাল বহুল প্রতীক্ষিত রাগি, রাগি অথচ মায়াবী মুখটিতে। পা দু’টো থেমে গেল জমিনে। চোখদুটো মোবাইলের স্ক্রিনে। সার্থক নিষ্পলক ফোনের স্ক্রিনের ছবিতে চেয়ে। কয়েকটা ছবি, একটাতে মুখ একটু স্পষ্ট, তাছাড়া বাকি ছবিগুলো এক সাইড নয়তো ঝাঁপসা। প্রত্যাশার ছবি , সাথে কোন কলেজে পড়ে, এবং বাড়ির ঠিকানাও দেওয়া মেসেজে। যেখানে প্রত্যাশার সাথে দেখা হয়েছিল, সার্থক লোক ঠিক করে; তার আশেপাশের সিসিটিভি ফুটেজ চেক করতে বলে। ডেট, টাইম আর মেয়েটি সম্পর্কে ধারণা দিয়েছিলো। মেয়েটিকে চেনা সহজ হয় স্কুটিটার জন্য। সিসিটিভি ফুটেজ থেকে ছবি কালেক্ট করে খোঁজ নিয়ে নাম, ঠিকানাসহ ছবি পাঠিয়েছে। সার্থক বিড়বিড় করে আওড়াল,

-” ইয়ানূর প্রত্যাশা। সো নাইস নেইম।”
নীরব ক্লিনিকের মেইন দরজা পেরিয়ে করিডোর ধরে এগোচ্ছিল। হঠাৎ চোখ পড়লো সার্থকের দিকে। সার্থক তখনো ফোনের স্ক্রিনে মুখ গুঁজে। নীরব তার পাশ দিয়ে গটগট করে হেঁটে যেতে থাকে। সৌজন্যমূলক আর বাক্যব্যয়ের একফোঁটাও আগ্রহ জাগেনা নীরবের ভেতর। ওদিকে সার্থক সে তো অন্য দুনিয়ায় চলে গিয়েছে। আশপাশের কিছুতে তার খেয়াল নেই। নীরব সার্থককে পাশ কাটিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে যায়। সোজা পার্কিং লনে আসে, যেখানে ওর বাইক রাখা। এমন সময় ফোনটা বেজে ওঠে। স্ক্রিনে নীলার নাম দেখে কপালে ভাঁজ পড়ে। ফোন রিসিভ করে প্রথমে শান্ত স্বরে সালাম দেয়। নীলা তাড়াহুড়ো ভরা গলায় বলে ওঠে,
-” নীরব, তুমি কি খুব ব্যস্ত?”
নীরব নম্র সুরে জবাব দেয়,
-” ভাবী, আপনি বলুন। সমস্যা নেই।”
নীলা বলে যেতে থাকে,

-” নিভান তো অনেকক্ষণ হলো এসেছে। আমি পরীক্ষা শেষে সেই কখন অপেক্ষা করছি। আর প্রত্যাশা এখনও কলেজ থেকে ফেরেনি। কথা ছিল দুপুরে আমরা রওনা হবো। কিন্তু ও এখনো আসেনি, ফোনও ধরছে না। নিভানের আবার অফিসের তাড়া। ও আমাদের নামিয়ে দিয়ে অফিসে যাবে। এখন প্রত্যাশাকে না আনলে তো বাবার কথাও রাখা হবে না। কী করি বলো তো? তুমি একটু বাবাকে বুঝিয়ে বলো, কেমন? আর প্রত্যাশা বোধহয় যেতে চাই….”
নীলার কথা সম্পূর্ণ শোনার আগেই নীরব বলল,
-” ভাবী আপনি ভাইয়ার সাথে চলে আসুন। আমি কিছুক্ষণ পরেই ফ্রি হবো। আমি প্রত্যাশাকে নিয়ে আসবো। ভাইয়ার কাছে কাইন্ডলি ফোনটা একটু…”
নীলা আকাশ থেকে পড়ার মতো অবাক হলো। কোথায় ভেবেছিলো নীরব অন্তত প্রত্যাশার এরুপ আচরণে রাগ প্রকাশ করবে। প্রত্যাশাকে নিয়ে অসন্তোষ কিছু বলবে। সেখানে কী না! নীরব যেচে বলছে, নিজে এসে নিয়ে যাবে। নীলার মুখটা থমথমে হয়ে যায়। বিরস মুখে নিভানের হাতে ফোন দেয়। নিভান ‘হ্যালো’ বলতেই এপাশ থেকে নীরব বলল,
-” ভাইয়া তুমি ভাবীকে নিয়ে আসো। প্রত্যাশা কলেজ থেকে ফিরলে আমি ওকে নিয়ে আসবো।”
নিভান স্বস্তির সুরে বলে,
-” আচ্ছা।”

প্রত্যাশার স্কুটিতে হঠাৎ করে সমস্যা হয়। অনেকটা পথ স্কুটি ঠেলে এক গ্যারেজে পৌঁছায়। ঠিক করতে একটু সময় লেগে যায়। ফোনটা ব্যাগে থাকায় নীলার কল বুঝতেই পারেনি। নীলা চলে যাওয়ার ঠিক মিনিট পাঁচেক পরেই প্রত্যাশা বাসায় ফেরে। অধরা প্রত্যাশাকে রাগ করতে থাকেন–একবার ফোন চেক করবে না, দেরি হচ্ছে জানিয়ে দিবে না। প্রত্যাশা ঠোঁট উল্টে সব বকা হজম করে নেয়। কিছুক্ষণ পর…প্রত্যাশা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কেবল ভেজা চুলে চিরুনি চালাবে। অধরা রাগি মুখাবয়ব করেই এগিয়ে আসলো। গম্ভীর মুখে খেতে ডাকল। আচমকা প্রত্যাশা অধরার গলা দু’হাতে জড়িয়ে ধরে আদুরে ভঙ্গিতে বলে,
-” ও আম্মু স্যরি, স্যরি, স্যরি। যাও… এমন আর হবে না। তাও রাগ করো না।”
মেয়ের এই আদুরে ভঙ্গিমায় অধরার রাগ আর টেকে না। মুখে হালকা হাসির রেখা নিয়ে বলল,
-” ভাগ্যিস নীরব সব সামলে নিল। যদি ও না আসতে চাইত, তাহলে তোর শ্বশুরের কাছে আমাদের কতটা ছোট হতে হতো। নিভানকে দিয়ে সেদিন কত করে বলিয়েছেন, আবার ফোনেও বলেছেন–তোকে যেন নীলার সাথে পাঠাই। শেষমেষ তুই না গেলে, ভদ্রলোক সত্যিই আ’হত হতেন।”

-” হয়নি তো। তাই আপাতত এই টপিক বাদ দাও।”
অধরা তোয়ালে হাতে নিয়ে মেয়ের ভেজা চুল যত্ন করে মুছতে থাকে। প্রত্যাশা চুলে হাত দিয়ে বলে উঠল,
-” আহ্ আম্মু, আস্তে মুছো তো। আমার লাগছে।”
-” চুল থেকে টপটপ পানি পড়ে পুরো বন্যা বয়ে যাচ্ছে। নিজে ঠিকঠাক মুছবে না, মুছতে গেলেও দিবে না।”
অধরা চুল মুছতে মুছতে মেয়েকে বেশ শাসানোর সুরে, এইসেই বলছে। ও বাড়িতে গিয়ে যেনো কোনো বা’দড়ামি না করে। একটু চুপচাপ থাকে। বিভিন্ন উপদেশ শেষে হ্যানোত্যানো বুঝ দেয় মেয়েকে। বেশ কঠোরভাবে বলল,
-” শোন, নতুন বউ,তাই কেউ কিছু বললে মুখেমুখে তর্ক করবি না একদম। সয়ে নিবি। কিছু বলার দরকার নেই।”
-” আমার মুখটা বন্ধ রাখা, আর রেডিওতে ভিডিও দেখা সমান কথা।”
অধরা চোখ পাকিয়ে তাকাল।

তিনটার দিকে নীরব আসে। অধরা জোর করলে হালকা কিছু খায়। বসার রুমে প্রত্যাশার জন্য অপেক্ষা করছে নীরব। আসার পর অধরাকে বলে– প্রত্যাশাকে একটু তাড়াতাড়ি রেডি হতে। ওদিকে প্রত্যাশা ধীরে ধীরে রেডি হচ্ছে। ওর মাঝে তাড়াহুড়ো নেই। নীরবের সামনে এখনো যায়নি। একেবারে রেডি হয়ে ড্রয়িংরুমে গিয়ে হালকা কাশার মত করল প্রত্যাশা। নীরব সেই শব্দে মাথাটা তুলে চাইল; গায়ে অফ হোয়াইট রঙের নরম গাউন, খোলা চুল ফ্যানের বাতাস লেগে উড়ছে। চোখে শুধু একটু কাজল, ঠোঁটে গোলাপি লিপবাম– যেন মেঘের ফাঁকে ফুটে থাকা ভোরের আলোর মতো। নীরবের দৃষ্টি আ’টকে গেল সেই কাজলপরা চোখের গভীরে। প্রত্যাশা মৃদুস্বরে বলল,
-” আমি রেডি।”

নীরব দৃষ্টি সরিয়ে উঠে দাঁড়াল। পরপর পিছুনে অধরা আর শফিক সাহেব আসেন। নীরব ভদ্রতা মেইনটেইন করে, অতঃপর বেরিয়ে বাসার সামনে রাখা বাইকে বসে। প্রত্যাশা মুখটা বেজার করে বিদায় নেয়। আজ কেনো জানি বাড়ি ছেড়ে ও বাড়ি যেতে ভীষণ কান্না পাচ্ছে। একদম বুক ফাটা কান্না আসছে। দাঁতে দাঁত চেপে কান্না সংবরণ করছে ও। কই এর আগেও তো গিয়েছে! তখন তো হাসতে হাসতে গিয়েছে, আপুকে আনতে। আগে না হয় থাকেনি, এবার বড়জোর দু’দিন থাকবে। চলেই তো আসবে। তাও মনটা মানছে না। কেমন কান্না পাচ্ছে। বাইক চোখের আড়াল হতেই শাড়ির আঁচল তুলে অধরা চোখের পানি মুছল। শফিক সাহেবেরও বুকটা শুণ্য শুণ্য লাগছে। ঘর আজ একদম ফাঁকা ফাঁকা, নিষ্প্রাণ ঠেকছে।
নীরবের থেকে খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে প্রত্যাশা বসেছে। শহরের ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে শা শা শব্দে বাইক ছুটছে। নীরব লুকিং গ্লাসে মাঝে মাঝে প্রত্যাশার ভার ভার মুখটা দেখছে। দু’জনের মাঝের নীরবতা ভেঙে নীরব প্রথমে নরম কন্ঠে বলল,

-” ধরে বসো।”
প্রত্যাশা ইতস্তত গলায় বলল,
-” ঠিক আছি।”
নিচের ঠোঁটের বাম পাশে দাঁত বসিয়ে নীরব কিছু ভেবে ফের বলল,
-” আচ্ছা ঠিক আছো…কিন্তু বাই এনি চান্স কিছু হলে তোমার আব্বু-আম্মু তো বলবে; জামাই মেয়ের যত্ন নিতে পারে না। প্রথম দিনেই এক্সি’ডেন্ট! তাই ভাবলাম, প্রথম দিনের জন্য একটু বেশি কেয়ারফুল থাকি। প্রথম দিনে কোনো রিস্ক নিতে চাচ্ছি না। পরে না হয়…তোমার ইচ্ছে মতো বসবে। তখন না হয় তোমার ইচ্ছেমত ঝুঁকি নেবো।”
প্রত্যাশা থতমত খায় নীরবের কথায়। ভাবল–লোকটা ভীষণ ধূরন্দর তো! তবে মুখে কিছুই বলল না ও। প্রত্যাশা লজ্জা আর দ্বিধায় একটু থেমে অবশেষে একহাত রাখলো নীরবের কাঁধে। হাত রাখার সঙ্গে সঙ্গে লুকিং গ্লাসে চোখাচোখি হয়ে গেল দু’জনের। নীরব দৃষ্টি সরিয়ে বাইক চালানোয় মনোযোগ দিলো।

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৬

ট্রাফিক সিগন্যালে লাল বাতি জ্ব’লতেই একে একে গাড়িগুলো থামতে থাকে। প্রীতি ইচ্ছেকে নিয়ে শপিংয়ে যাচ্ছিল। ইচ্ছে জানালা দিয়ে উৎসুক হয়ে পাশের গাড়ি দেখছিলো। এমন সময় ইচ্ছে চোখের পলক ঝাপটাল। প্রীতির বাহু ধরে ঝাঁকিয়ে বলল,
-” মাম্মা, মাম্মা, পাপা। উইযে পাপা।”
প্রীতি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। বাইকে স্পষ্ট নীরবকে দেখা যাচ্ছে। তবে মেয়েটার মুখ অন্যদিকে থাকায় দেখা গেল না। প্রীতি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। ইচ্ছে জানালার উপর ছোট্ট হাতে থা’প্প’ড়াতে থা’প্প’ড়াতে জোরেজোরে ডাকতে লাগল,
-” পাপা..পা..পা? এইযে পাপা..পাপা আমি।”

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৮