মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৮

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৮
মুসতারিন মুসাররাত

ট্রাফিক সিগন্যালের লাল আলোটা এখনো জ্ব’লছে। বাইকটা সামান্য কাঁপছে, নীরব একদৃষ্টে সামনে তাকিয়ে। পাশে বসা মেয়েটার মুখ অন্যদিকে। মাথাটা এমনভাবে ওপাশে করে রেখেছে, শুধু পিঠজুড়ে থাকা ঘনকালো চুলগুলো দেখা যাচ্ছে। প্রীতি গাড়ির জানালা দিয়ে এক ঝলক স্পষ্ট নীরবকে দেখতে পেল। কোথাও একটা অদ্ভুত ধা’ক্কা খেলো। ইচ্ছে জানালার কাঁচে হাত ঠুকতে ঠুকতে ডেকে যাচ্ছে,

-” পাপা…..পাপা…।
ওদিকে নীরবের দৃষ্টি সামনে। গাড়ির উইন্ডোজ বন্ধ থাকায় ইচ্ছের ডাক, বাইরে আসছে না। প্রীতি চোখ সরাতে পারছে না। কৌতুহলী হয়ে নির্নিমেষ চেয়ে। নীরবের পাশে বসা মেয়েটার মুখটা দেখতে ইচ্ছে করছে। মেয়েটা কে? মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে একের পর এক প্রশ্ন। ভাবল–নীরবের পাশে… ও কি তবে..উমম! তবে কী মেয়েটা নীরবের গার্লফ্রেন্ড?”
এরই মধ্যে সিগন্যাল সবুজ হলো। বাইকের হালকা গর্জনে নীরব গতি বাড়াল। আশেপাশে না তাকিয়ে বাইক সোজা এগিয়ে গেল। মেয়েটা তখনো মুখ ফেরালো না। ইচ্ছেদের কারও চলতে থাকল। এদিকে ইচ্ছের মন ছটফট করছে। ফর্সা আদুরে মুখটা শুকিয়ে গেল। প্রীতির হাত ধরে নাড়া দিয়ে বলে উঠল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-” মাম্মা, মাম্মা.. ডাকো পাপাকে। পাপা গেল তো।”
বাইকটা সিগন্যাল পেরিয়ে ভিড়ের আড়ালে মিলিয়ে যায়। জানালার কাঁচে ছোট্ট হাত রেখে ইচ্ছে পিছু ফিরে তাকায়, আবার মায়ের দিকে। আবদারের সুরে কয়েকবার বলে—পাপাকে ডাকতে। প্রীতি বি’র’ক্ত হয়ে ধ’ম’কিয়ে উঠল,
-” ইচ্ছে__এএ……একদম বি’র’ক্ত করবে না। চুপচাপ থাকো।”
মায়ের ধ’মকে ইচ্ছের ভেতরটা কেঁপে ওঠে। পাপা তার ডাক শুনলো না, ফিরে তাকাল না— এই অভিমানে ইচ্ছের বুক ভেঙে যাচ্ছে। মায়ের ধ’মকে কান্না আর আটকাতে পারল না। কান্নারা বাঁধনহারা হয়ে উপচে পরল। ইচ্ছে ছোট্ট দুই হাতে চোখ ডলতে ডলতে, ঠোঁট উল্টে শব্দ করে কান্নাজুড়ে দিলো।
প্রীতির তীব্র রাগ হলো। ইচ্ছের এই কান্না এখন সহজে থামবে না। শপিং করতে যাচ্ছিল, সেটাও এখন মাটি হবে। মনেহচ্ছে ইচ্ছেকে আনাটাই ভুল হয়েছে। বাসায় রেখে আসলেই বেটার হতো। প্রীতি মেয়ের মিনিট পাঁচেক ক্ষণের কান্নাতেই অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। হাতের ফোনটা আনলক করে ডায়ালে গিয়ে নীরবের নম্বরে কল করে।

নীরব বাইকের গতি কমিয়ে ফোন হাতে নিল। প্রীতির কল দেখে ভ্রু কুঁচকাল। এয়ারপড বের করে কানে গুঁজে ‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে প্রীতি কিছুটা ঝাঁঝালো স্বরে বলে উঠল,
-” ইচ্ছে খুব জ্বা’লাচ্ছে। তুমি কী মানবতা দেখাতে আসতে পারবে? উফ্! এখন মনে হচ্ছে, ইচ্ছে যেমন ছিলো তেমনই না হয় থাকত। আর পাঁচটা বাচ্চার থেকে আলাদা, অস্বাভাবিকভাবেই বেড়ে উঠত। শুধু শুধু সাইকিয়াট্রিস্টের কথামতো তোমার হেল্প নিয়ে ওকে স্বাভাবিক করার প্রসেসটা রং ছিলো। এখন আমাকে রীতিমত সাফার করতে হচ্ছে।”
প্রীতির কণ্ঠে ত্যাড়া সুর। জবাব দেওয়ার ইচ্ছে হলেও নীরব নিজেকে সামলে নিল। শান্ত গলায় শুধু বলল,
-” আই উইল ট্রাই।”
-” ওকে।”
প্রত্যাশা শুধু নীরবের বাক্যটা শুনল। সরল মনে অফিশিয়াল কল-টল হবে ভেবে মাথা ঘামাল না।

বিশালাকার একতলা বাড়ি। অফ-হোয়াইট রঙের দেয়াল, রোদের আলোয় যেন মোলায়েম ঝিলমিল। বাড়ির এক পাশে সবুজে ঘেরা বাগান, অন্যপাশে সুইমিংপুল। সামনের অংশে জোড়া রঙিন ফুল গাছের বাহার। প্রবেশপথের ঠিক সামনে বাইক থামায় নীরব। সুনসান পরিবেশ। হেলমেট খুলে ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় প্রত্যাশার দিকে। ঠান্ডা, গভীর চোখে চেয়ে বলল,
-” গেট ডাউন।”
প্রত্যাশা বিনিময় হালকা মাথা নাড়িয়ে নেমে দাঁড়াল। নীরব ত্রস্ত পায়ে হাঁটা ধরল। প্রত্যাশা এদিক-ওদিক একপল চেয়ে পিছুপিছু এগোল। এতক্ষণ বাইকে বসে যেটুকু আনইজি হচ্ছিল তা যেন নিমিষেই হাওয়ায় উড়ে যেতে লাগল। শুধুই আত্মীয় পরিচয়ে নয়, এবার এ বাড়ির ছোট বউ হিসেবে এসেছে। এতে প্রত্যাশার মধ্যে প্রথমে একটু নতুন অনুভূতি জাগলেও, কেমন একটা লাগলেও, ধীরেধীরে তা মিলিয়ে গিয়েছে। বর্তমানে এ নিয়ে ওর মাঝে না আছে বিশেষ কোনো হেলদোল, আর না তো কোনো মাথাব্যাথা। নেহায়েৎ আম্মু পইপই করে হাজারটা বারণ, নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে দিয়েছে, তাই একটু চুপচাপ থাকার চেষ্টা করে চলেছে। নীরব বেল চাপতেই কয়েক মূহুর্তের মধ্যেই পরী [বুয়া] এসে দরজা খুলে দেয়। নীরবের পিছনে প্রত্যাশাকে দেখে জ্বলজ্বল করে উঠল ওর চোখদুটো। উত্তেজনায় গলা চড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠল,

-” খালাম্মা! খালুজান! ছোডো খালাম্মা! কই গেল সবাই? ছোডো ভাইজান তো ভাবি রে নিয়া আইছে! তাড়াতাড়ি আইসেন সবাই!”
পরীর চেঁচানোতে নীরব একপলক শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো পরীর দিকে। সেই দৃষ্টিতেই পরী যেন মাটিতে গেঁথে গেল। ঠোঁট দুটো অল্প ফাঁক হয়ে রইল। ছোটো ভাইজানকে সে বা’ঘের মত ভ’য় পায়। আজ নতুন বউ আসছে, তাই উত্তেজনায় একটু বাড়াবাড়িই করে ফেলেছে। বুঝে গেল–এতো জোরে চেঁচানোটা ঠিক হয়নি। ভাইজান এখন রামধমক না দিলেই হয়! কিন্তু অবাক করে দিয়ে নীরব কিছু বলল না।
ড্রয়িংরুমে বসে সিরিয়াল দেখছিল শর্মিলা। চেঁচামেচি শুনে তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে এলেন। শর্মিলাকে দেখে প্রত্যাশার মুখে ঝলমলিয়ে উঠল হাসি। শর্মিলাও একগাল হেসে আদুরে গলায় বললেন,

-” আরে প্রত্যাশা! কেমন আছো?”
প্রত্যাশা মিষ্টি হেসে বলল,
-” প্রিয় ছোটো আন্টি, আমি খুব খুব ভালো আছি! আগে বলো তুমি কেমন আছো?”
শর্মিলা খুব মিশুকে স্বভাবের, আর নরম দিলের মানুষ। প্রত্যাশার সাথে দু’জনের ভালো বনে। শর্মিলা এগিয়ে এসে স্নেহভরে এক হাতে প্রত্যাশার কাঁধ জড়িয়ে ধরে বললেন,
-” এইতো মা, আলহামদুলিল্লাহ আছি। আগে তুমি দেখে বলো তো, তোমার পুরনো ছোটো আন্টি আগের মতোই আছি কিনা! নাকি বদলে গেছি!”
প্রত্যাশা মুচকি হেসে চোখ টিপে বলল,
-” আরে আন্টি! একদম আগের মতোই আছো। শুধু দেখছি, গলায় একটু বেশি মায়া আর আদর লেগেছে এই.. এতটুকুই!”
শর্মিলা গালভর্তি হেসে বললেন,

-” এই দুষ্ট মেয়ে! তোমার কথার জবাব দেওয়া যায়? চলো চলো ভেতরে চলো।”
প্রত্যাশা হাস্যজ্জ্বল মুখে পা বাড়ায়। নীরব শর্মিলাকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করল,
-” ছোটো মা, মা কোথায়?”
-” আপা তো রুমেই আছে। কেনো কিছু দরকার নীরব? আমাকে বল আমি….”
কথার মাঝেই নীরব বলল,
-” না ছোটো মা, তেমন কিছু নয়। মা’কে দেখতে পাচ্ছি না তাই…। আমার একটু দরকার আছে। আর্জেন্ট যেতে হবে। আমি যাচ্ছি। মা জিজ্ঞেস করলে জানিয়ে দিও।”
-” আচ্ছা, আচ্ছা।”
-” এই তো এলি, ভালো করে ভেতরে পা রাখলি না আবার কোথায় চললি?”
থমথমে মুখ আর গম্ভীর কণ্ঠে কথাটা বলতে বলতে এগিয়ে এলেন নীহারিকা। তাঁর উপস্থিতি টের পেতেই প্রত্যাশার মুখের হাসি মুহূর্তে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। নীরব উত্তরে বলল,

-” মা, একটু দরকার আছে। সন্ধ্যার আগেই ফিরব।”
নীহারিকার মুখের রেখায় মুহূর্তেই বি’রক্তির ছাপ প্রকট হয়ে উঠল। কঠিন দৃষ্টিতে প্রত্যাশার দিকে তাকালেন। সমস্ত ক্ষোভ যেন এসে বর্তাল মেয়েটির উপর। এই মেয়েটার জন্যই তো ছেলেকে কাজ ফেলে তড়িঘড়ি ফিরতে হয়েছে। আবার এই গরমে ছুটোছুটি করতে হবে। তখন যদি নীলার সাথে চলে আসতো। তাহলে তো আর এই বাড়তি ঝামেলা হয় না। সাধে কী আর মেয়েটাকে পছন্দ হয় না! উফ্! এইসব আচরণের জন্য মেয়েটাকে মনে ধরে না। নীলা এসে বলল–কলেজের নাম করে কোথায় বন্ধুদের সঙ্গে স্কুটি রেসে মেতে উঠেছে, আল্লাহ জানে। ফেরেনি, ফোনও ধরছিল না। নিভানের সেকেন্ড আওয়ারে অফিসে ফেরার জন্য প্রত্যাশাকে ফেলেই শেষমেষ চলে আসতে হলো।
নীলার কাছ থেকে এসব শোনার পর থেকেই নীহারিকার মেজাজ চ’টে আছে। নীহারিকা ভাবেন–যতই হোক, এখন ও এ বাড়ির বউ। ওর সাথে এ বাড়ির সম্মান জড়িয়ে আছে। এখনো যদি একটা দামড়ি মেয়ে হয়ে ওভাবে স্কুটি নিয়ে সারা শহর চষে বেড়ায়। তারউপর এক দল ছেলে বন্ধুসহ, এরকম হলে সোসাইটির লোকজন নানান কথা বলবে। মেয়েটার বাবা-মা হয়তো এসব কিছু প্রশ্রয় দেন। কিন্তু তিনি, এসব চুপচাপ মেনে নেবেন না। মেয়েটাকে আদব-কায়দা শেখাবেন। উড়নচণ্ডী জীবনযাপন আর অগোছালো আচরণের ইতি টানাবেন।

হঠাৎ কিছু মনে পড়ার সাথে সাথে শর্মিলা তৎক্ষণাৎ বলে উঠলেন,
-” দাঁড়া, দাঁড়া নীরব। যেভাবেই হুট করেই হোক না কেন, বিয়ে তো হয়ে গেছে তোদের। আর বিয়ের পর এই প্রথম প্রত্যাশা এ বাড়িতে এসেছে। এক কাজ কর, একটু দাঁড়া। দু’জনকে একসাথে মিষ্টি খাওয়াতে হবে। এটা কিন্তু রেওয়াজ।”
নীরব বিরক্ত সূচক ‘চ’ আওড়িয়ে বলল,
-” ছোট মা, থাক না। যা রিচুয়াল আছে করো সমস্যা নেই। তবে আমাকে বাদ দাও।”
শর্মিলা হইহই করে উঠলেন,
-” এই না… না। তাই বললে চলে নাকি। যা হবে একসাথেই। একটু দাঁড়া বাবা। যতই হোক নতুন বউ, মিষ্টি মুখ না করালে চলে।’
নীরব খানিক অনিচ্ছা নিয়েই নরম হল। ড্রয়িংরুমের হৈচৈ এ বিরক্ত হয়ে নীলা রুম থেকে বেরিয়ে মাত্র আসলো। এসব দৃশ্য দেখে মুখ বাঁকাল। শর্মিলা নীলাকে দেখেই বললেন,

-” নীলাশা মা, মিষ্টি নিয়ে আসো তো। একটু তাড়াতাড়ি করো মা।”
নীলা মুখে কিছু না বললেও ভেতরে ভেতরে সা’পের মতো ফোঁসফোঁস করতে থাকে। গজগজ করতে করতে ভাবল– আরে, মাত্র এসেছে, আর এতেই ওকে নিয়ে এদের আদিখ্যেতা দেখে গা জ্ব’লছে। কোথাকার রাজকন্যা এসেছেন। এখন তারজন্য কী না আমাকে মিষ্টি নিয়ে যেতে হবে! উফ্! এখন হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছি। সেদিন বিয়েতে; প্রত্যাশাকে ফোর্স করা আমার বড় বো’কামি ছিলো। কোন ভুলে যে শ্বশুরের কাছে ভালো সাজতে গিয়ে নাচতে নাচতে বিয়েটাতে রাজি হয়েছিলাম। আমার আব্বু-আম্মুর ভালোবাসায় ,আদরে যেভাবে ভাগ বসিয়েছে। ঠিক সেভাবে আমার শ্বশুর বাড়ির লোকদেরকেও ও আমার থেকে কেড়ে নেবে। বুঝি না ওর ভাগ্য এত সুপ্রসন্ন হয় কীভাবে? কিছু না থেকেও সব পেয়ে বসে ও।
নীলা গোমড়া মুখে মিষ্টির ট্রে নিয়ে যায়। শর্মিলা হাসিমুখে নীহারিকাকে বললেন,

-” আপা, তুমি শুরু করো।”
নীহারিকা এগিয়ে এসে প্রথমে ছেলের মুখে একটা মিষ্টি দিলেন। তারপর প্রত্যাশার মুখের সামনে মিষ্টি তুলে বললেন,
-” নাও।”
প্রত্যাশা ছোট করে হা করে মিষ্টিটা মুখে নেয়। নীহারিকা তীক্ষ্ণ চোখে প্রত্যাশার দিকে চেয়ে রষকষহীন স্বরে বললেন,
-” সংসারে থাকতে হলে কথা-বার্তায় ভদ্রতা লাগে, আদব-কায়দা লাগে। মিষ্টি করে কথা বলা, মানুষের সাথে সম্মান রেখে চলা–এইগুলো বড় গুণ। আশাকরি সবসময় মিষ্টির মতো মিষ্টিভাষী হবে। মুখে সবসময় কথার খৈ ফুটবে না। মুখে মধু না থাকলে মানুষ সম্মান দিতে জানে না। তাই..”
তড়িঘড়ি করে গালের মিষ্টিটুকু গিলে নীহারিকার কথা কেড়ে নেয় প্রত্যাশা। মুচকি হেসে বলল,

-” শুধু মধু থাকলে তো আবার পিঁপড়া বসে। তখন আবার পিঁপড়া তাড়ানোর হ্যাপা। তাই আমি কি করি জানেন? মধুর সাথে একটু-আধটু বি°ষও রাখি। তবেই না পিঁপড়া দূরে থাকে, সবই ঠিকঠাক থাকে।”
নীরব মিষ্টি খেয়ে তৎক্ষণাৎ টি-টেবিল থেকে পানির গ্লাস তুলে নিয়ে ঢকঢক করে পানি খাচ্ছিল। প্রত্যাশার প্রথম দিকের কথাশুনে বেচারা বেষম খেতে বসছিলো। অল্পের চেয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে ত্রস্ত পায়ে বেরিয়ে গেল। শর্মিলা ঠোঁট টিপে হাসলেন। প্রত্যাশার এমন ঠাসঠাস কথা বলা শাশুড়ির যে পছন্দ হবে না তা নীলা বেশ বুঝে নেয়। মনেমনে খুশিও হয়। নীহারিকা চোখ রাঙিয়ে বললেন,
-” এই কথাগুলা শিখেছো কোথায়? কেবলই না বললাম কথা বার্তায় ভদ্রতা বজায় রাখতে হয়।”
প্রত্যাশা হেসে প্রত্যুত্তরে বলল,
-” এক মায়ের সংসার থেকে শিখেছি। সমস্যা নেই এখন আস্তে আস্তে আরেক নতুন মায়ের সংসার থেকে সব শিখে নেবো।”
নীহারিকার মুখের আদল কিছুটা পরিবর্তন হয়ে আসলো। একটু নরম স্বরে শুধালেন,
-” তোমার বাবা-মা কেমন আছেন?”

কিছুক্ষণ পর….
বাড়ির সবার সাথেই প্রত্যাশার দেখা সাক্ষাৎ প্রায় শেষ। আবির কোচিং থেকে ফিরে প্রত্যাশাকে দেখে একদফা মজা লুটে, টিপ্পনি কা’টতে ভোলেনি। বেয়াইন এখন নতুন ভাবি একটু আধটু রসিকতা না করলে চলে। এ বাড়ির জুনিয়র সদস্য ছটফটে চঞ্চল, দুষ্টু আনিশা। তবে দেখতে ভারি মিষ্টি। এর সাথে তো প্রত্যাশার গলায় গলায় ভাব। ড্রয়িংরুমে প্রত্যাশার কোলের উপর বসে আছে। প্রত্যাশা মজার মজার গল্প বলে শোনাচ্ছে, তো আবার ডাশকষ সিংহ, বুলবুলি খেলছে।
মাহবুব সাহেব সিঙেল সোফায় বসে প্রতিবেশী এক মহিলার সাথে কথা বলছেন। নীহারিকা এসে মহিলাটিকে নাস্তা দিলেন। প্রত্যাশারা একটু দূরে টিভির ওদিকে থাকা সোফায় বসে। ওখানে নীলাও আছে। বসে ফোন স্ক্রল করছে। নীহারিকা আড়চোখে ওদিকে চাইল–এখানে একজন প্রতিবেশী আসছে; পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো। নতুন বউ, একটু চুপচাপ থাকবে। তা না আনিশার সাথে খিলখিলিয়ে হাসছে। এসব ভেবে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললেন নীহারিকা। প্রতিবেশী শেলী বেগম কিছু কথাবার্তা শেষে বললেন,

-” মাশা-আল্লাহ মাহবুব ভাই, আপনার দুই ছেলের বউই মিষ্টি দেখতে হয়েছে। ভালোই করেছেন এক বাড়ি থেকে দুই মেয়ে এনে। আগে থেকেই চেনাজানা, পরিচয় ছিলো। নিশ্চয় বড় বউয়ের আচার-ব্যবহার, তারপর পরিবারের ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েই ছোট মেয়েকেও বউমা করে আনলেন।”
নীহারিকার মুখে হাসি নেই। মাহবুব সাহেব কিছু বলার আগেই শেলী বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
-” আমার ছেলেটার জন্য একটা ভালো সমন্ধ এসেছিল। ছবি দেখে পছন্দও হয়েছিলো। পাকা কথা বলব, বলব এমন অবস্থা। মেয়েটি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক, দেখতে শুনতেও মন্দ না। কিন্তু খোঁজখবর নিয়ে জানলাম; মেয়েটা নাকি অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছে। কারো সাহায্যে পড়াশোনা করে চাকরি পেয়েছে। বুঝতেই পারছেন…এমন পরিচয়হীন মেয়ে কি আমাদের বাড়ির বউ হওয়ার যোগ্য? তাই আর আগাতে পারিনি। গরীব হোক তবুও পরিচয় থাকলে এগোনো যেতো। তাই ঘটককে একেবারে না করে দিয়েছি। ঠিক করেছি না ভাই?”
নীহারিকা বেগম সহসাই বলে উঠলেন,

-” ভাবী ঠিকই করেছেন। বংশ-পরিচয় ছাড়া একটা মেয়ে। কে জানে তার র’ক্তে কী বইছে! বাবা-মার ঠিক ঠিকানা নেই, কেমন স্বভাবের ছিলো, কী চরিত্রের ছিলো কেউ জানে না? কে জানে, কোনো পা’প কাজের ফল নয় তো? আমি তো কখনোই চাইব না…কারোর ঘরের বউ এরকম এক অনিশ্চিত অতীত নিয়ে আসুক। না করে ভালোই করেছেন।”
মাহবুব সাহেব হালকা গলা পরিষ্কার করে গম্ভীর স্বরে বললেন,
-” দুইজনের কথাই শুনলাম। তবে একটা কথা বলি; মানুষ জন্মসূত্রে পরিচয় নিয়ে জন্মায়, কিন্তু চরিত্র গড়ে ওঠে নিজের কর্ম আর মনুষ্যত্ব দিয়ে। যে মেয়ে এত প্রতিকূলতার মধ্যেও মানুষের মতো মানুষ হয়েছে, নিজে লেখাপড়া করে শিক্ষক হয়েছে, সে তো সমাজের কাছে উদাহরণ হওয়ার মতো।”
শেলী বেগম ইতস্তত গলায় বলল,

-” কিন্তু সমাজ কী বলবে, মাহবুব ভাই? সবাই যখন জানবে পরিচয়হীন। বংশপরিচয় শুনলে সবাই ভ্রু কুঁচকাবে।”
-” ভাবী, সমাজ তো অনেক কিছুই বলে। সমাজকে খুশি রাখতে গিয়ে কতকত ভালো মানুষ অবহেলিত হয়েছে। আর এই অনাথ হওয়াটা কি তার দোষ? কোনো কারনে বাবা-মার থেকে বঞ্চিত হয়েছে, আশ্রয় দেয়নি আত্মীয়-স্বজন। তাতে তো তার মানবিক মূল্য কমে যায় না। বরং, বেঁচে থাকার জন্য যে লড়াই সে করেছে, সেটাই তার পরিচয়। মানুষ ভালো হলে তার র’ক্তের পরিচয় দরকার নেই।”
নীহারিকা নাকমুখ কুঁচকালেন। স্বামীর কথা পুরোপুরি মানতে পারলেন না। বললেন,
-” তুমি যাই বলো না কেনো আমার কাছে তো–একটা পরিচয়বিহীন মেয়ে মানে ভবিষ্যতে হাজারটা প্রশ্ন, অসম্মানের ব্যাপার। কে জানে সে আসলে কার না কার র’ক্ত! দূষিত র°ক্তও তো হতে পারে। একই র’ক্ত বহন করে সেও যে ভবিষ্যতে ওমন ধাঁচের হবে না, এর গ্যারান্টিই বা কী?”
মাহবুব সাহেব শান্ত কিন্তু দৃঢ় গলায় বললেন,

-” নীহা, কারো অতীত তার নিয়তি হতে পারে না। চরিত্র হচ্ছে মানুষের আসল পরিচয়। আর পাপ র°ক্তে বহন হয়–এ ধারণা অজ্ঞতা ছাড়া কিছু নয়। দো’ষ করলে দো’ষী, ভালো করলে প্রশংসা। এই হওয়া উচিত। জন্ম, বংশপঞ্জি দিয়ে নয়।”
মাহবুব সাহেব এক মুহুর্ত থেমে ফের বললেন,
-” মানুষ হওয়াটাই আসল। পরিচয় বড় নয়; মনুষ্যত্ব বড়। ছেলের জীবনসঙ্গী হওয়ার যোগ্য সেই, যার মন সৎ, আর চরিত্র নিষ্কলুষ। সৌন্দর্য, অর্থ সম্পদ এগুলোও বড় নয়। নির্ভেজাল একটা মনই বড় সম্পদ। আর সংসারের সুখ- শান্তির জন্য এমন একটা নির্ভেজাল মনের মেয়েই দরকার।”
শেলী বেগম কিছুটা বিব্রত মুখে সায় দিয়ে বললেন,
-” ঠিকই বলছেন, ভাই। আসলে আমরা এভাবে ভেবে দেখি না তো।”

নীহারিকার মুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, স্বামীর কথায় তিনি সহমত নয়। ওনার ভেতর কিছুটা দ্বিমত রয়ে গেল। তবে প্রতিবেশীর সামনে আর তর্কে জড়ালেন না। ওদিকে সব কথা শুনল, আর আড়চোখে সবটা লক্ষ্য করল নীলা। ভাবল– আব্বুকে তো ছোট থেকেই খুব লয়াল জানতাম। ভেবেছিলাম আর যাইহোক প্রত্যাশার ব্যাপারটা বিয়ের সময় অন্তত শ্বশুরবাড়ির গুটি কয়েকজনকে হলেও জানিয়ে বিয়ে দিবে। বিশেষ করে শ্বশুড়-শাশুড়ি, আর জামাইকে তো মাস্ট জানাবে। কিন্তু মায়ের [নীহারিকা] কথাশুনে তো মনে হচ্ছে; কিছুই জানেন না। আরেব্বাস! মা জানলে পরে তো বিয়েই হয় না দেখছি। নীরবও কী তবে কিছুই জানে না?

আচ্ছা, যখন প্রত্যাশার ব্যাপারে নীরব সবটা জানবে, তখন ওর রিয়্যাকশন কেমন হবে? ও কী ওরকম পরিচয়বিহীন একটা মেয়েকে নিজের বউ হিসেবে মানতে পারবে? ইগোতে লাগবে না? শুনেছি সত্যি কখনো চাপা থাকে না। কখনো না কখনো তো থলের বেড়াল বেরিয়ে আসবেই। তখন কী হবে? এইভেবে তো আমি খুব এক্সাইটেড! তবে যাইহোক, আব্বু-আম্মু মোটেই এটা ঠিক করেনি। এ্যট লিস্ট, নীরব আর আমার শ্বশুড়-শাশুড়িকে চুপিচুপি জানানো উচিত ছিলো। উফ্! আম্মুটাও না, আমাকে দিয়ে ওয়াদা করে রেখেছে। নাহলে কবেই প্রত্যাশার আহ্লাদ ছুটাতাম। আমার আদরে, আমার সবকিছুতে উড়ে এসে জুড়ে বসায়।

কিছুক্ষণ পর….আবির দুই হাতে একগোছা পাকা সবরি কলার ফানা ধরে এগিয়ে আসতে আসতে ডেকে উঠল,
-” বড় মা… কোথায় তুমি? এই যে বাগানের কলাগাছের কলা পেকে একেবারে সোনালি হলুদ রং হয়ে গিয়েছে। পাখিরা তো একের পর এক লুটেপুটে খাচ্ছিল। বড় বাবা বললেন কে’টে নিতে। তাই তোমার অনুমতি না নিয়েই একেবারে কে’টে নিয়ে চলে এলাম।”
নীহারিকা সামনে এগিয়ে বললেন,
-” ভালো করেছিস।”
তারপর আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলেন,
-” ওখানে রাখ, সবাই খাবে।”
আবির কলার ফানাটা টি-টেবিলের উপর নামিয়ে, দু’হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,

-” বেয়াইন প্লাস নতুন ভাবি আর পুরানো ভাবি; দু’জনকেই বলছি, আমাদের বাগানের একদম গাছপাকা ফল। খেয়ে দেখুন, একেবারে মধুমিষ্টি। কষ্ট করে বাগানে ঢুকে, কলার গাছে বসা পাখিদের সাথে ঝ’গড়া করে এনে দিলাম। তার বিনিময়ে একটা ছোট্ট জা খুঁজে দিলে মন্দ হয় না।”
নীহারিকা চোখ পাকালেন। আবির তৎক্ষণাৎ দুষ্টুমির হাসি হেসে চোখের ইশারায় ‘ক্ষমা চেয়ে নিলাম’ ভঙ্গি করল। প্রত্যাশা মজা করে বলল,
-” শুধু জা কেনো, একবারে পায়েসও এনে দিতে পারি। তুমি চাইলে ফুড পান্ডা থেকে এখনই অর্ডার করে দিচ্ছি।”
নীহারিকা নীলাকে বললেন,
-” নীলাশা খেয়ে দ্যাখো খুব মিষ্টি।”
আগে বলায় বেশ খুশিই হলো নীলা। নীহারিকা প্রত্যাশার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-” তুমিও নাও।”
প্রত্যাশা মৃদু মাথা নাড়ল। শর্মিলা আনিশার জন্য খাবার নিয়ে আসলো। এসে প্রত্যাশাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-” প্রত্যাশা নাও।”

প্রত্যাশার একটু ইতস্তত লাগছিল। তবে সবাই বলায় হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে ছিঁড়তে থাকল। ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলল,
-” ওয়াও! জোড়া কলা। শুনেছি জোড়া কলা খেলে নাকি টুইনস বেবি হয়। আমার তো টুইনস বেবির খুব শখ। আমি তো এটাই খাব।”
এইবলে প্রত্যাশা হাতে নিয়েছে। এরমধ্যে আচমকা নীহারিকা প্রত্যাশার হাত থেকে কে’ড়ে নিলেন। প্রত্যাশা তাজ্জব! ভ্রু কুঁচকে মনেমনে আওড়াল,
-” আরেব্বাস! মাদার ইন ল তো দেখছি– বাংলা সিনেমার দ’জ্জা’ল শাশুড়ি রিনা খানকেও ফেল মে’রে দিল। নতুন বউয়ের হাত থেকে প্রথম দিনেই খাবার কেড়ে নিল।”
প্রত্যাশার ভাবনার ভাঙন ঘটালেন নীহারিকা। হালকা অপ্রস্তুত গলায় বললেন,
-” জোড়া কলা খেতে হয় না। অন্যটা বেছে নাও।”

শর্মিলা ভাবলেন–আপাও না, মাঝেমাঝে একেবারে বাচ্চাদের মতো বিহেভ করে বসে। ওটা তো এমনিএমনি সবাই কথার কথা বলে থাকে। প্রত্যাশা ছোট, ওরকম শুনেছে, তাই হয়তো বলেছে….।
নীহারিকা এবারে নিজে হাতে তুলে প্রত্যাশার দিকে বাড়িয়ে নরম গলায় বললেন,

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৭

-” এটা নাও। একটা, দু’টো নয়; এই বাড়িতে হাজারটা বাচ্চা আসুক। তবে আর যেনো কখনো জমজ না হয়। শত সন্তানের জন্ম দিও, সমস্যা নেই মা। তবে আর জমজ বাচ্চা চাই না।”
প্রত্যাশা বিস্মিত চোখে চেয়ে অস্ফুটস্বরে বলে ফেলল,
-” শত সন্তান! অতগুলো জন্ম দিতে গেলে আমি সুস্থ থাকব তো!”

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৯