মনশহরে তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব ৩২
মুশফিকা রহমান মৈথি
“কথা দিচ্ছি, ব্যাথা দিবো না”
অভদ্র পুরুষের কথায় লজ্জার ভার বাড়লো। মুখখানা লুকিয়ে নিলো বলিষ্ঠ বুকে। চোখ তোলার সাহস হলো না। অভ্রর মুখে বিজয়ী হাসি।
বাহিরে তখন ভাদের লাজহীন বর্ষার। পাতার উপর উদাসীন কুম্ভরাজীর নৃত্য চলছে। ভিজছে তৃষ্ণার্ত ধরনী। ঘরের ভেতর আলো আঁধারীর খেলা। বারান্দার থাই গ্লাসে পানির রেখা জমছে। ভেতরের দেওয়ালে লিখিত হচ্ছে প্রেমের উপকথা। অভ্র তার স্ত্রীর পেলব শরীরখানা আলতো করে বিছানাতে শোয়ালো। ভাব এমন যেন খুব ভঙুর, অতি দূর্বল কোনো প্রাণ, একটু অবহেলায়ই ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাবে।
ঐন্দ্রিলার নত মস্তক দুহাতে তুললো সে। খুব সময় নিয়ে দেখলো তার হৃদয়রাজ্ঞী লজ্জার ভিড়ে তিরতির করে কাঁপছে চোখের পাতা, চিকন রক্তিম ঠোঁটজোড়া শিহরণ জাগাচ্ছে অন্তস্থলে। মস্তিষ্ক হয়তো সবুরের চাবিকাঠি হারিয়ে ফেললো। মনের অবাধ্য কামনায় বুদ হলো সংযমী পুরুষ। দখলে নিলো চিকন ওষ্ঠজোড়া। বাধা দিল না ঐন্দ্রিলা। বরং তার সাথে সাড়া দিল। মনের দ্বিধাগুলোকে একপাশে “টাইম প্লিজ” বলে প্রশ্রয় দিল তার অভদ্র, গোঁয়ার পুরুষকে। ঐন্দ্রিলার প্রশ্রয়ে আরো আগ্রাসী হয়ে উঠলো অভ্র। ঐন্দ্রিলার বুকের ওড়নাটা একটানে খুলে ছুড়ে ফেললো মাটিতে। অধরজোড়াকে মুক্তি দিয়ে একজন তাকালো ঐন্দ্রিলার কোমল মুখখানায়। তার ছলছল নয়ন দেখে হুট করেই ছ্যাৎ করে উঠলো অভ্রর ভেতরখানা। গভীর স্বরে শুধালো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“তুই না চাইলে আমি এগোবো না”
অভ্রর এমন কথায় কাঁপা স্বরে ক্ষীণ গলায় ঐন্দ্রিলা শুধালো,
“তোকে বিশ্বাস করে ঠকে যাবো না তো?”
মোমের মৃদু হলদেটে আলোয় ঐন্দ্রিলার কান্নারত মুখখানা অভ্রের কাছে ঐশ্বরিক ঠেকলো। চোখের কোন থেকে গড়িয়ে পড়া অশ্রুগুলো যেনো মুক্তদানা। ঠোঁট ছোয়ালো সে সেই নেত্রপল্লবে। শুষে নিলো নোনা জল। গাঢ় স্বরে বললো,
“আজীবন তো বিশ্বাসের দুয়ারে ঠাঁই পেলাম না। একবার বিশ্বাস করেই দেখ”
“ঠকে গেলে?”
অভ্রর হাসির বিস্তৃত হলো। ফিসফিসিয়ে বললো,
“আমার গর্দান আর তোর হাত, সপে দিবো না হয়”
ঐন্দ্রিলার ঠোঁটে উন্মোচিত হলো নিষ্পাপ হাসি। “টাইম প্লিজ” বলা চিন্তার জোয়ারগুলো ভাটায় পরিণতি হলো। দুহাতে অভ্রর মুখাবয়ব খাতা আগলে ধরল। নিজ থেকে ওষ্ঠরেখায় নিজেকে সপে দিল ঐন্দ্রিলা। ঐন্দ্রিলার এমন কাজে হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো অভ্রর। নেশাগ্রস্থের মতো নিজের আধিপত্য জমালো সে। “এই নারী কেবল আমার” এই উক্তিটি বিস্তার করলো মন মস্তিষ্কে। একসময় ঠোঁট ছেড়ে নেমে গেলো গলঃদেশে। নিজের আধিপত্যের প্রমাণকে রক্তিম বর্ণে উজ্জীবিত করলো। ঘোরলাগা মাতালের মতো তার বিচরণ হলো ঐন্দ্রিলার দেহে। বিশাল দেহী মানুষটির ভারে নিষ্পেষিত হলো ক্ষীন নারীদেহ। জলন্ত অগ্নির তাপে গলন্ত মোমের মত মিশে রইলো ঐন্দ্রিলা। সেই সাথে প্রারম্ভ হলো এক নতুন অধ্যায়। বাহিরের ঝড়ো হাওয়া, বর্ষানৃত্য, বজ্রপাতের মাঝে মিলে গেলো কিছু সুখময় আর্তনাদের গল্প।
আদিমখেলা যখন শেষ হলো তখন ঐন্দ্রিলার ক্লান্ত শরীরটাকে আগলে বুকের উপর নিয়ে শুয়ে রইলো অভ্র। ঐন্দ্রিলা তখন ঘুম। তার ভারী নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে নগ্ন বুকে। লম্বার চুলের মাঝে বিশাল হাতখানা আস্তে আস্তে বিলি কাটতে লাগলো অভ্রর। কপালে চুম্বন এঁকে গাঢ় স্বরে বললো,
“আমার থেকে তোর মুক্তি নেই, ঐন্দ্রিলা। একবার যেহেতু মনশহরে নিমন্ত্রণ দিয়েছিস আর কোথাও যাচ্ছি না আমি। এখন থেকে তুই পুরোদস্তর আমার”
ঐন্দ্রিলার ঘুম ভাঙলো কাকডাকা ভোরে। অনিয়মিত বর্ষণ থেমেছে শেষরাতে। নির্মল বর্ষায় প্রকৃতি ধুয়ে সতেজরুপে হাসছে। মাথার কাছের জানালা দিয়ে প্রবেশ করছে শীতল হাওয়া। সেই সাথে মেঝেতে লুটোপুটি খাচ্ছে সোনারোদ। মোমগুলো গলে নিজে নিজেই নিভে গেছে। অবিন্যস্ত, বিশৃঙ্খল হয়ে স্তুপ আকারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে গোলাপের পাঁপড়ি। অভ্র তখন তার দেহের সমস্ত ভার নিয়ে গভীর ঘুমে লিপ্ত। ঐন্দ্রিলা চোখ মেলেই নিজের একান্ত পুরুষটিকে দেখলো। রুক্ষ্ণ, বদরাগী, অভদ্র পুরুষটিকে কি শান্ত, সুপুরুষ লাগছে! ঘুমিয়ে থাকলেই বুঝি এই মানুষটিকে এতো ভালো লাগে?
ঐন্দ্রিলা অনুভব করলো অভ্রর রুক্ষ্ণ চেহারার মাঝে কোথায় যেন সুপ্ত মায়া আছে। সে কি এই পুরুষের প্রেমে পড়ে যাচ্ছে? হয়তো যাচ্ছে, তাইতো এতো বদগুনের সমারহের মাঝেও এক অদ্ভুত আকর্ষণ খুঁজে পাচ্ছে। ঐন্দ্রিলা হাতখানা আলতো করে ছুয়ে দিল ঘুমন্ত মুখখানা। খাড়া নাক, নিকোটিনে পোড়া ঠোঁট, খসখসে অবিন্যস্ত দাড়ি, সব কিছুতেই যেন কাব্যিক মায়া। মুচকি হাসলো সে। অস্থিমজ্জায় আগুন জ্বালানো পুরুষের প্রেমে পড়া মোটেই ভালো কোনো কথা নয়। বরং তা স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর কিছু। তবুও প্রেমে পড়তে ভালো লাগছে। ভগ্ন, একাকী হৃদয়টা আরোও একবার জ্বলন্ত অগ্নিতে নিজেকে সপে দিতে চাইছে। হয়তো বিয়ের বন্ধনটাই এমন নির্মল। চিরশত্রুর প্রতিও মায়া জন্মায়, হৃদয় দূর্বল হয়।
ঐন্দ্রিলা খুব সাবধানে সরিয়ে দিল অভ্রকে। বিয়ের তো মাস দেড়েক হয়ে যাচ্ছে। এখন আর এই নব্বই কেজি ওজনের মানুষটিকে ভারী লাগে না। ঐন্দ্রিলা বিছানা ছাড়লো মিষ্টি এক ব্যাথা নিয়ে। বাথরুমের আয়নায় নিজেকে দেখলো। সারা শরীরে অভ্রর আধিপত্যের চিহ্ন। মন্দ লাগছে না। এই অনুভূতিটা নতুন কিন্তু বেশ মিষ্টি।
নিজ হাতে চা বানিয়ে আনলো ঐন্দ্রিলা। অভ্র এবং নিজের জন্য বানালো। ভাগ্যিস শ্বাশুড়িমার দর্শন হয় নি। আহাশ জার্মানী চলে যাওয়াতে মহিলা কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে আছেন। হয়তো রাতে ঘুমানও নি। এতে ভালোই হয়েছে। হয়তো সকাল সকাল ভেজা চুলে শ্বাশুড়ির সামনে ঘুরতে লজ্জা লাগতো ঐন্দ্রিলার। চা বানিয়ে ঘরে গিয়ে দেখলো ফাঁটা নোট এখনো ঘুম। ফলে দুষ্টু একটা বুদ্ধি মাথায় খেললো ঐন্দ্রিলার। আস্তে করে অভ্রর হাতটা হাতে দিল। তারপর কনিষ্ঠ আঙুল চুবিয়ে দিল গরম চায়ে। সাথে সাথে গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে উঠে পড়লো অভ্র। চোখে মুখে তীব্র আতংক। ব্যাথার ছাপ মুখমন্ডলে। হাঁপাচ্ছে সে। বিমূঢ় চোখে তাকিয়ে রইলো ঐন্দ্রিলার দিকে। ঐন্দ্রিলা হাসছে। প্রাণচ্ছ্বল হাসি। অভ্রর চোখ সরু হলো। আঙ্গুলখানা মুখের ভেতর চেপে ধরলো। জ্বলছে, লাল হয়ে গেছে রীতিমত। ঐন্দ্রিলা সেই চায়ের কাপটা রেখে নিজেরটা এগিয়ে দিল। নির্ভার, নিরোপরাধ স্বরে বলল,
“চাখানা খেয়ে উদ্ধার কর স্বামী মহোদয়”
অভ্র চায়ে চুমুক দিল। ঐন্দ্রিলা তার চুলের গামছাটা নেড়ে দিল। ভেজা চুল ইচ্ছে করে ঝাড়া দিল অভ্রর দিকে। ফলে পানির ছিটায় ভিজে গেলো সে। সকাল থেকে বউয়ের এমন যন্ত্রণার উদ্দেশ্য অভ্রর হাড় জ্বালানো। অভ্র রেগে গেলেই সে বাতিল খেলা থেকে। অভ্র তাই নির্লিপ্তভাবে চা খেলো। এমন ভাব যেনো প্রশান্ত মহাসাগরের স্রোত তাকে ভাসিয়ে দিলেও তার কিছুই যায় আসে না। ফলে আয়না থেকে কিড়মিড় করে তাকালো ঐন্দ্রিলা। মেকি রাগী স্বরে বললো,
“লজ্জা করে না তোর? কি অবস্থা করেছিস আমার”
“আমি কি করেছি?”
অবুঝ বালকের মতো প্রশ্ন। ঐন্দ্রিলা গলা উচু করে বললো,
“এই সব নিয়ে সবার সামনে যাব কি করে আমি? কলেজ কিভাবে যাব। দেখলে তো মনে হচ্ছ আমার বসন্ত হয়েছে”
“আহা হা, আমার নেকুপিসি”
বলেই নিজের পিঠ দেখিয়ে বললো,
“আমার পিঠের উপর তুমি যে নখের আলপনা করেছো আমি কিছু বলেছি? দেখলে মনে হচ্ছে কোনো বিড়াল খামছে দিয়েছে”
অভ্রর কথা শুনে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুড়লো ঐন্দ্রিলা। অভ্র মোটেই পাত্তা দিল না। অর্ধেক চা খেয়ে বললো,
“নাও বউ, তোমার আধা চা। প্রেম বাড়বে”
ঐন্দ্রিলা উঠে চা নেবার জন্য হাত বাড়াতে গেলেই খপ করে হাতটা ধরে ফেললো অভ্র। চায়ের কাপখানা সাইডে রেখে হ্যাচকা টান দিল সে। ফলে হুড়মুড়িয়ে ঐন্দ্রিলা বসে পড়লো তার কোলে। চিকন কোমড়খানা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে থুতনি ঠেকালো ঐন্দ্রিলার কাঁধে। মৃদু স্বরে বলল,
“সরি বউ। আর হবে না। এবারের মত ক্ষমা করে দিও”
“ন্যাকা”
“সত্যি বলছি। আর কষ্ট দিব না”
কথাটা শুনতেই কান গরম হয়ে গেলো। দুহাতে মুখখানা লুকালো ঐন্দ্রিলা। অভ্র স্বল্প হেসে বলল,
“তোর এই লজ্জা আমাকে শেষ করে দিবে, ঐন্দ্রিলা। তোর ধারণাও নেই, তোর এই লাজুক হাসিখানা আমাকে মাতাল করে দেয়”
ঐন্দ্রিলা উত্তর দিতে পারলো না। এতো লজ্জা শুধু এই অভদ্র ছেলেটার জন্য মানা যায়?
পিউয়ের মার সামনে বসে রয়েছেন সালাম সাহেব এবং সাবেরা। নীলাদ্রি অন্য একটি সোফায় বসা। সকাল সকাল সারাবাড়ি মাথায় করে ঘোষণা দিয়েছে আজ সে মেয়ে দেখতে যাবে। কারণ তার হবু স্ত্রী সবুজ পতাকা দেখিয়েছে। মেয়ে কে সেটা না বলেই একপ্রকার বগলদাবা করে নিয়ে এসেছে বাবা মাকে। এখন পিউদের বাসার সামনে আসতেই তারা বুঝতে পারলো মেয়েটা কে। নীলাদ্রি বলছে সে নাকি পিউকে ভালোবাসে না। অথচ বিয়ে সে পিউকেই করবে। সালাম সাহেব আর সাবেরা একপ্রকার কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে আছেন। পিউয়ের মাও অপ্রস্তুত এমন আচমকা আগমনে। পিউয়ের চক্ষুচরাগ গাছ। সে শুধু সকালে একটা ম্যাসেজ করেছে,
মনশহরে তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব ৩১
“আপনাকে আমি বিয়ে করবো”
কিন্তু এই ম্যাসেজের উত্তরে এই পাগল মা-বাবা সহ বাসায় আসবে সেটা কে জানতো? পিউ বাসায় কাউকে জানায় অবধি নেই। পিউয়ের মা কিঞ্চিত বিব্রত গলায় শুধালো,
“আপা হঠাৎ আমাদের বাসায়? কোনো সমস্যা?”
সাবেরা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো। মস্তিষ্কে কথা সাজালো। কিন্তু বলার সুযোগ হলো না। এর পূর্বেই নীলাদ্রি বলে উঠলো,
“আন্টি, আমরা পিউয়ের সাথে আমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছি”………………