মনশহরে তোমার নিমন্ত্রণ শেষ পর্ব (২)
মুশফিকা রহমান মৈথি
বাসায় আসতেই দেখা গেলো বসার ঘরে সবাই থমথমে মুখে বসে আছে। অভ্র সহজ গলায় শুধালো,
“কি হয়েছে?”
“ঐন্দ্রিলা বাসায় নেই। কোথাও পাচ্ছি না। ও বাড়িতেও যায় নি। কোথায় গেছে কেউ জানে না। ফোন দিচ্ছি কখন থেকে ফোনটাও বন্ধ। আমার তো ভয় করছে”
কাননের কন্ঠে তীব্র দুশ্চিন্তার ছাপ। তার উজ্জ্বল, সুন্দর মুখখানা শুকিয়ে গেছে। শ্বশুরের সাথে কথা বলে নিজের ঘরে এসে বসতেই তীব্র ভাঙ্গচুরের শব্দ কানে এলো। ভরদুপুরের এমন বিকট শব্দটা কোথা থেকে আসছে! আজকাল হুট করেই বানরের উপদ্রব হয়েছে এই এলাকায়। এই তো সেদিনের কথা পশ্চিমের রব্বানীদের বাড়ির সাথে এমন দুপুরের সময় কোথা থেকে একদল বানরের আগমন হলো। একা বানর নয়, একেবারে আত্মীয়-স্বজন, গুষ্টি নিয়ে আগমন। মোট সাতটা বানর। দাপাদাপি, লাফালাফি করে একাকার অবস্থা। তাড়ানোর উপায় নেই। কি সাংঘাতিক ব্যাপার! কাছে গেলেই খামছি দেয়।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ছাদটা এখন পুরোই বানরের দখলে। রব্বানীদের বাড়ির নতুন নাম এখন “বানরমহল”। বানরগুলো কি এখন তার বাড়িতে এসেছে দখলের জন্য? ভয় পেলেন কিঞ্চিত কানন। একটু সংকোচ হল। ইদ্রিশ সাহেব বাসায় নেই। উনি থাকলে সাহস পাওয়া যেত। অভ্রও নেই। উপরের ঘরে ঐন্দ্রিলা একা। মেয়েটা ভীষণ ভয় পেতে পারে। ফলে ভয় গিলে বানর অনুসন্ধানে উপরে আসলেন তিনি। উপরে গিয়ে প্রথমে গেলেন অভ্রর ঘরে। দরজাটা ভেজানো। হালকা ধাক্কা দিতেই খুলে গেলো। ঘরের অবস্থা দেখে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকলেন কানন। ঘূর্ণিঝড়ের পরবর্তী বিধ্বস্ততা বুঝি একেই বলে।
ঘরে কেউ নেই, ঘরের প্রতিটি জিনিসের ভঙ্গুর অংশ আত্মচিৎকার করে জানান দিচ্ছে ঐন্দ্রিলার অন্তস্থলের ঘূর্ণিঝড়ের। কাননের বুকে কু ডাকলো। তার সুন্দর করে গুছানো সংসারের টলমলে অবস্থা যেনো খুব নিপুন ভাবে আঁচ করতে পারলেন তিনি। সাথে সাথেই ফোন করলেন অভ্রকে। কিন্তু পোঁড়া ফোনটা বন্ধ। চিন্তায় গলা শুকিয়ে এলো কাননের। অপেক্ষা করলেন। এক ঘন্টা, দু ঘন্টা। কিন্তু ঐন্দ্রিলার খবর নেই। ফোনটাও ফেলে গেছে। ইদ্রিস সাহেব ফিরলে জানালেন সবকিছু। ইদ্রিস সাহেব স্ত্রীর নির্বুদ্ধিতায় বেশ বকাবকিও করলেন। অবশেষে খোঁজ খবর নেওয়ার অধ্যায়ের সূচনা হলো আনুষ্ঠানিক ভাবে। ও বাড়ি খোঁজ নিতেই জানা গেলো ঐন্দ্রিলা আসে নি। ভয়ের মেঘ গাঢ় হলো। চিন্তার কুহেলিকা ঘন হল। কি করবে বুঝতে পারছে না তারা। সাবেরা কঠিন মুখে বসে আছেন। কানন অপরাধীর মতো এতটা সময় বসে ছিলেন। অসুস্থ বউমা কাউকে না জানিয়ে কোথায় চলে গেছে? অবশেষে অভ্রর আগমণ ঘটলো।
কাননের কথা মস্তিষ্কে আন্দোলিত হলো অভ্রর। অনুধাবন করতে সময় লাগলো। অভ্র কোনো কথা না বলেই নিজের ঘরের দিকে ছুট দিলো। ঘরে প্রবেশ করতেই তার মুখ রক্তশুন্য হয়ে গেলো। চূর্নবিচূর্ন ঘরটা দেখে আন্দাজ করতে কষ্ট হলো না আসলে কি ঘটেছে। ঐন্দ্রিলার রাগ সহ্য করেছে এই জড় বস্তুগুলো। কিন্তু রাগের উৎসটুকু মস্তিষ্কে ধরা দিচ্ছে না। অভ্র এমন কিছু করে নি যাতে ঐন্দ্রিলা ক্ষিপ্ত হবে। মায়ের সাথে তার সম্পর্ক ভালো। শ্বাশুড়ির সাথে সম্পর্কটা এখন কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। তবে এই তান্ডবের হেতু কি?
তার চেয়ে প্রথমে ঐন্দ্রিলার ঠিকানা জানা প্রয়োজন। ঐন্দ্রিলার শূন্যতা চাবুকের মতো আঘাত করছে অভ্রকে। অন্তস্থলে চিনচিনে ব্যাথা মস্তিষ্ক অবশ করে দিচ্ছে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় লাগছে তার। মেঝেতে এখনো ঐন্দ্রিলার রক্তের দাগ। মেয়েটি আঘাত পেয়েছে, নিশ্চয়ই স্যাভলন লাগায় নি। কোথায় খুঁজবে? পিউ ছাড়া ঐন্দ্রিলার বান্ধবী নেই এর ঘরে। পিউ এখন বান্দরবানে। ওবাড়ি যায় নি সে। মাথাতা মোটেই কাজ করাতে পারছে না অভ্র। উচাটনে অন্ধকার লাগছে সব। ঠিক সেই সময়ে ইদ্রিস সাহেব এলেন। ফোন এগিয়ে উৎকুন্ঠিত গলায় বললেন,
“বিল্লাল তোমাকে খুঁজছে”
“পরে কথা বললো”
“ঐন্দ্রিলার ব্যাপারে কিছু বলতে চায়”
সাথে সাথেই ফোনটা হাতে নিলো। ওপাশের মানুষটি ম, চ বর্গীয় গালি দিয়ে ঝাঁঝালো স্বরে শুধালো,
“কই ছিলি তুই?”
“ঐন্দ্রিলার সম্পর্কে কিছু বলতে চাইছিলি। সেটা বল আগে। ফাও প্যাচাল পাড়তে ইচ্ছে বা আগ্রহ কোনোটাই নেই”
“ঐন্দ্রিলার সাথে তোর কথা হয় নি? ও দোকানে এসেছিলো তোকে খুঁজতে”
“কখন?”
“দুপুরের একটু পর”
“ধ্যাত্তেরি, ও কি কিছু বলেছে তোকে?”
“নাহ, কিছু বলে নি। কিন্তু এখানে ক্যাচাল হয়েছে”
“কি ক্যাচাল?”
বিল্লাল একটু সময় নিলো, তারপর সবটা খুলে বললো। বিল্লালের কথা শেষ হলে স্তব্ধ বসে রইলো অভ্র। স্বীকার না করলেও এই ভয়টা সর্বদা কন্ঠস্থি চেপে ধরে থাকতো। বিয়েটা সে দাদার শর্তে করেছে এটা সত্য। তিক্ত সত্য। ভালোবাসার অনুভূতিটা প্রাচীন হলেও এই সত্য থেকে মুখ ফেরানোর ক্ষমতা অভ্রর নেই। দাদার শর্তবিহীন তাদের গল্পটা হয়তো কোনো পরিত্যাক্ত স্টেশনের চেয়ারের মতোই পড়ে থাকতো। অভ্রর মনে ঐন্দ্রিলার হৃদয়ের নরপতি হবার ইচ্ছেটা হৃদয়ের এক কোনায় পড়ে থাকতো হয়তো। দূর থেকে বিমুগ্ধ নয়নে তাকে দেখতো কিন্তু ছোঁয়ার স্পর্ধা করতো না হয়তো। হয়তো!
এই ঘটনা যদি আগে ঘটতো, অভ্র থাকতো বেপরোয়া। আগের মতো নির্লিপ্তভাবে ঐন্দ্রিলার অভিসম্পাত মেনে নিতো। বরাবরের মতো সে থাকতো দায়সারা। কিন্তু যখন থেকে নিজের অনুভূতিগুলোকে আলিঙ্গন করলো অভ্র তখন থেকেই কুৎসিত সত্যটাকে ভয় পেতে শুরু করলো অভ্র। অন্তরে কাঁটা দিলো ঐন্দ্রিলার অভিশাপ পাবার আশংকা। ঐন্দ্রিলার চোখে নিজের জন্য ঘৃণা যে তাকে অবর্ণনীয় যন্ত্রণা দিতে পারে সে সম্পর্ক হৃদয় ধারণা দিলো। এর চেয়ে সাংঘাতিক ভীতি যা তাকে কাবু করতে লাগলো তা হলো ঐন্দ্রিলার শূন্যতা। সেই ভয় এখন বাস্তবিক রুপ ধারণ করেছে। নিজের উপর তীব্র রাগ হলো অভ্রর। নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। ঘরময় আরেকবার চাইলো সে। তার ঐন্দ্রিলা নেই, তার রাজ্য আজ রিক্ত। পৃথিবীটা এতোটা যন্ত্রণাময় লাগছে কেনো? জীবনটা এতো অভিশপ্ত ঠেকছে কেনো? অসহায় চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
“বাবা, ঐন্দ্রিলা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে”
নিজের দাম্ভীক, অহংকারী ছেলেকে দ্বিতীয়বার পরাস্ত অবস্থায় দেখলেন ইদ্রিস সাহেব। ছেলেটার দম্ভ চুরমার হয়ে গিয়েছে। কিন্তু শান্তি লাগছে না যেনো? হয়তো মানুষের স্বাভাবিক সত্তাই আমাদের মন-মস্তিষ্কের অভ্যস্ত থাকে, যতই মনের তীব্র বাসনা হোক ভিন্নতা আমরা সইতে পারি না।
পাহাড়ের বৃষ্টি স্রষ্টার অনন্য দৃশ্যপট। আকাশের মেঘেরার তখন ধীরলয়ে নেমে আসে পাহাড়ের চুড়ায়। তারপর জলনৃত্য। প্রকৃতিও সেই নৃত্যে নিজেকে মিশিয়ে ফেলে। এই অলৌকিক সুরম্য দৃশ্য দুচোখ মুদে উপভোগ করছে পিউ। থানচি উপজেলার রেমাক্রি খালের গায়েই নীলাদ্রির দোতালা কটেজ। সম্পূর্ণ কাঠের কটেজটি। নিচে একটি রুম এবং রান্নাঘর। সিড়ি বেয়ে উপরে উঠলে পাশাপাশি দুটো রুম। রুমের সামনে টানা বারান্দা। বারান্দায় সারিবদ্ধ টব। তাতে নানা পাহাড়ি ফুল। কুরুক ফুলের ডালটি ফুলের ভারে নুয়ে পড়েছে। শ্বেতকাঞ্চন ফুটবে ফুটবে করছে। বিমখানায় মাথা এলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পিউ। থানচিকে ধীরে ধীরে আপন করে নিয়েছে সে।
চাকমাদের ভাষা সে বুঝে না। তবে নীলাদ্রির এসিসট্যান্ট এবং এই কটেজের কেয়ারটেকার অজয়ের বদৌলতে সে কিছুটা হলেও শিখছে। যেমন ভাতকে তারা বঁই বলে। “আমার বঁই খাম” অর্থ আমি ভাত খাব। আমার খিদে নেই হলো “আমার ভাঙ্গা নে”। আমি ভালো আছি বোঝাতে বলতে হয় “আমার অংগো অংগর”। পিউয়ের বেশ মজা লাগে। আপাতত সে তিনটে লাইনই বলতে পারে। বাকি ভাঙ্গা ভাঙ্গা কিছু শব্দ বলতে পারে। পুরো কথোপকথনের জন্য নীলাদ্রি আর অজয়ের সাহায্য তার চাই। সে যতটা কঠিন ভেবেছিলো পাহাড়ে থাকা তত কঠিন নয়। বরং প্রকৃতিকে প্রাণ খুলে উপভোগ করা যায়। এই যেমন বর্ষার এই স্নিগ্ধতা ইট পাথরের শহরে কোথায় পাবে? শ্বেতকাঞ্চনের মিষ্টি গন্ধ কি নিজের ঘরে পেতো?
“কফি চলবে?”
প্যাকেট কফি বানিয়ে এনেছে নীলাদ্রি। নিশ্চয়ই চৌবাচ্চার অংকে মাথা ধরেছে নীলাদ্রির। পিউ মিষ্টি হেসে বলল,
“এদিকে আসুন”
কাঠের রেলিং এ কাপজোড়া রাখলো নীলাদ্রি। পিউ দু হাত মেলে তাকে আলিঙ্গনের আমন্ত্রণ জানালো। নীলাদ্রিও অসহায় বিলাইছানার মতো তাকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ গুজলো। কাতর স্বরে বললো,
“এভাবেই থাকি কিছুসময়?”
“থাকো”
এমন সময় অজয়ের কন্ঠ কানে এলো,
“স্যার, হাঁচর নিচে আস”
নীলাদ্রি বিরক্ত হল। কোথায় একটু বউয়ের আদর উপভোগ করছিলো, এই অজয়ের শান্তি নেই। নীলাদ্রির পিছু পিছু পিউও নামলো সিড়ি বেয়ে। নিয়ে আসতেই চোখ চরাগগাছ হলো। অস্পষ্ট স্বর বেড়িয়ে এলো,
“ঐন্দ্রিলা”
ঐন্দ্রিলা কাউকে কিছু না জানিয়ে একা একা এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে। তাকে বিধ্বস্ত লাগছিলো। হাতে একখানা হ্যান্ডব্যাগ ছাড়া কিছু নেই। কাপড়টাও ঘরে পড়ার। চোখজোড়া ফুলে আছে। ক্লান্তি মুখে। সে কোনো ফোন নিয়ে আসে নি। কি করে পথ চিনে এতটা দূর এলো সেই চিন্তা সর্বপ্রথম এলো নীলাদ্রির মাথায়। কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে পড়লো, গত বছর এবং তার আগের বছর মোট দুবছর ঐন্দ্রিলা এখানে এসেছিলো। তবুও মেয়েটা সাংঘাতিক কাজ করেছে। যদি পথে কিছু হয়ে যেত? পাহাড়ে মানুষ উদবাস্তুর মতো আসে না, আসে একেবারে আটঘাট বেঁধে। সে কিছু বলতেই চাচ্ছিলো কিন্তু ঐন্দ্রিলা ক্লান্ত স্বরে বললো,
“আমি একটু ঘুমাবো, শরীরটা খুব ক্লান্ত লাগছে”
পিউ তাকে কেবিনে নিয়ে গেলো। পায়ের জখমী অবস্থা নজর এড়ালো তার। ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে মলম লাগিয়ে দিয়ে শান্ত স্বরে বললো,
“যখন ভালো লাগবে আমাকে খুলে বলিস কি হয়েছে”
“ও বাড়ি থেকে ফোন আসলে প্লিজ বলিস না আমি এখানে এসেছি”
পিউ আর প্রশ্ন করলো না। বান্ধবীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে সে অবগত। বিশ্রাম নিক। সময় হলে সবটা জানতে পারবে।
ঐন্দ্রিলা ঘর ছেড়ে বের হলো তিনদিন পর। এই তিনদিন খাওয়াদাওয়া ঘরেই করেছে। নিজেকে পৃথিবী থেকে আড়ালে রাখতেই যেনো স্বাচ্ছন্দবোধ করছিলো সে। বাহিরে বের হলেই তিক্ততা তাকে কাবু করছিলো। না চাইতেও অভ্রর প্রতারনা তাকে আঘাত করছিলো। দোকান থেকে বের হবার পর প্রথম যে জিনিসটা অনুভব হয়েছিলো তা হলো তার যাবার জায়গার অভাব। ভাগ্যবশত ব্যাগে টাকা ছিলো আর নীলাদ্রির আবাসস্থলের পথখানা পরিচিত ছিলো। সারাটা রাস্তা শুধু শুন্যচোখে দেখেছে এই উদার ধরণীতে। আপন মানুষ ব্যাতীত এই ধরণী খুবই কলংকিত ঠেকে। একাকীত্ব মানুষের সবচেয়ে বড় অভিশাপ।
চেয়ার টেনে বসলো ঐন্দ্রিলা। নীলাদ্রি সূঁচালো নয়নে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তার চোখে মুখে তীব্র আকাঙ্খা সত্য জানার। পিউ ঐন্দ্রিলার প্লেটে খিঁচুড়ি বেড়ে বললো,
“খেয়ে নে”
ঐন্দ্রিলার অরুচি হচ্ছে। খেতে ইচ্ছে করছে না। অনেক ক্ষুধা অথচ খাবার দেখলেই অনীহা চলে আসে। চারপাঁচবার বমিও করেছে সে। হয়তো এতো বড়ো জার্নিটা শরীর নিতে পারছে না। সেদিন দুপুরের পর থেকে কিছুই খায় নি সে। সেই না খাওয়া অবস্থাতেই জার্নি করেছে। এই তিনদিন ঔষধও খাওয়া হয় নি। ঔষধ গুলো বাসায় ফেলে এসেছে। নামও জানে না। অভ্র জানে। সব কিছু ঘুরে ফিরে অভ্রতেই আটকে যাচ্ছে। নীলাদ্রি গম্ভীর স্বরে বললো,
“মা ফোন করেছিলো। তোকে না পেয়ে হন্নে হয়ে খুঁজছেন তারা”
“ওহ”
“তুই এখনো বলবি না কি হয়েছে?”
ঐন্দ্রিলা খিঁচুড়ি নাড়া চড়া করতে করতে একরাশ অনীহা নিয়ে বললো,
“আমি ফিরবো না”
“কেনো?”
হতভম্ব হলো নীলাদ্রি। সহজ গলায় উত্তর দিলো ঐন্দ্রিলা,
“মিথ্যে মিথ্যে সংসার খেলা ভালো লাগছে না। ক্লান্ত লাগছে। একটু জিরিয়ে নেই”
পিউ তীক্ষ্ণ স্বরে বললো,
“মিথ্যে সংসার তো তোর নয় ঐন্দ্রিলা”
“এই ভুল ধারণা আমার এতোদিন ছিলো। ভেঙ্গে গেছে”
পিউ কিছু বলতে চাইলে নীলাদ্রি তার হাত চেপে ধরলো। শান্ত স্বরে বললো,
“যতদিন ইচ্ছে, তুই থাক এখানে”
অভ্রর অবস্থা পাগলপ্রায়। গত পাঁচদিন যাবৎ ঐন্দ্রিলাকে পাওয়া যাচ্ছে না। পাঁচটা দিন, একশ বিশ ঘন্টা, মিনিটে হিসেব করলে তা সাত হাজার দুশো মিনিট। সেকেন্ডের হিসেব জানা নেই অভ্রর। শুধু এটুকু জানে সে অকথিত নরকে বাস করছে। পৃথিবীটা তার কাছে অগ্নিগ্রহের মত ঠেকেছে। এই পাঁচটা দিন পথহারা পথিকের ন্যায় শুধু ঐন্দ্রিলাকেই খুঁজছে। থানা, হাসপাতাল, মর্গ কিছুই বাকি রাখে নি। কিন্তু ফলাফল শুন্য। যাযাবরের সে শুধু এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঐন্দ্রিলাকে। খাওয়া-দাওয়ার কোনো খবর নেই। যখন বাসায় ফিরে তখন তাকে পরাজিত সৈনিকের ন্যায় মনে হয়, পরিশ্রান্ত, কাবু, দূর্বল। ওজন কমে গিয়েছে হয়তো। জানে না অভ্র। শুধু এটুকু জানে জীবনে বিতৃষ্ণা ছেয়ে গেছে। তিক্ত লাগে সবকিছু। নিঃশ্বাস তো নেয় কিন্তু সে মৃতপ্রায়, ম্লান। ঘরে এসে ঐন্দ্রিলার ওড়নাটা জড়িয়ে শুয়ে থাকে। গন্ধটুকু মিলিয়ে গেছে। প্রতিটি কোনার স্মৃতিগুলো গলার কাঁটার মতো বিঁধছে। বেঁচে থাকা এতোটা কষ্টের হবে কখনো ভাবে নি।
ফোন বাজছে অভ্রর। থানা থেকে ফোন এসেছে? আবার কোনো লাশ পেয়েছে কি তারা? এই অবধি তিনবার এমন আতংকিত ফোন এসেছে। নিঃশ্বাস আটকে যায় এমন ফোনে। মনে হয় কেউ গলা চিপে ধরেছে। মর্গে যেয়ে স্বস্তি মেলে, না ঐন্দ্রিলা নয়। এখন আবার তেমন অনুভূতি হচ্ছে। কাঁপা হাতে ফোনটা ধরলো। ওপাশ থেকে চিকন কন্ঠ এলো,
“হ্যালো, অভ্র তোর সাথে কথা আছে”
জানালার ধারে হাটুতে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে ঐন্দ্রিলা। বৃষ্টিতে সদ্য ফোঁটা শ্বেতকাঞ্চন ফুলটা ভিজছে, যেনো কোনো অবাধ্য কিশোরী। বৃষ্টিটা মোটেই ভালো লাগছে না ঐন্দ্রিলা। স্মৃতিগুলো কেমন জীবন্ত হয়ে যাচ্ছে। সেই বৃষ্টিভেজা রাত, ঐন্দ্রিলার নিদারুন আত্মসমর্পন। পূর্ণিমার সেই আকন্ঠ ডুবে যাওয়া। অভ্র উষ্ণ বুকে ঠাঁই নেওয়া, উজার করে ভালোবাসার আকুতি জানানো সবকিছুতে এখন তিক্ততা অনুভূত হয়। অভ্রর অধিকারবোধ, যত্ন, স্নেহ সবকিছুই নিছক স্বপ্ন মনে হচ্ছে, সেই সাথে তীব্র হাহাকার কাবু করে দিলো কঠিন সিদ্ধান্তকে। স্বপ্নের এতো সুন্দর হওয়া পাপ, মহাপাপ।
দরজায় কড়া নাড়ছে কেউ। পিউ হয়তো। মেয়েটা ভয় পাচ্ছে। বান্ধবীর হৃদয়ভাঙ্গন তাকে বিচলিত করছে। ঐন্দ্রিলা বুঝতে পারছে। তাই তো একটু পর পর খোঁজ নেওয়া। ঐন্দ্রিলাও বাঁধা দিচ্ছে না। শান্তিতে থাকুক সবাই। পৃথিবীর দুঃখগুলো নাহয় তারজন্য তোলা থাক। মুঠোভর্তি দুঃখ অন্তরে পুষে অন্তর কঠিন হোক। দরজা ঠেলে কেউ ঢুকলো। ঐন্দ্রিলা পিছু চাইলো না। সে পাহাড়ের চুড়ায় জমায়িত মেঘ দেখতে ব্যস্ত। পিউ চলে যাবে কয়েকপল বাদে। কিন্তু গেলো না। মানুষটি তাকিয়ে আছে তার দিকে। ঐন্দ্রিলা না ফিরেই বললো,
“কিছু বলবি পিউ?”
“ঐন্দ্রি”
মনশহরে তোমার নিমন্ত্রণ শেষ পর্ব (১)
আকুতিময় চিরচেনা স্বরখানা শুনতেই টলমলিয়ে উঠলো অন্তর। পেছনে ফিরতেই স্তব্ধ হয়ে গেলো ঐন্দ্রিলা। সামনের মানুষটিকে ভোলার জন্য এতোটা দূরে পাড়ি দেওয়া সে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আকুল চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই চোখজোড়ায় তীব্র তৃষ্ণা, আকুলতা, যন্ত্রণা। এমন মূর্ছানো লাগছে সুঠামদেহী ছেলেটাকে। কাছে আসতে নিলেই ঐন্দ্রিলা শীতল স্বরে বললো,
“তুই চলে যা অভ্র……”