মনে রেখ এ আমারে পর্ব ১৩

মনে রেখ এ আমারে পর্ব ১৩
রায়েনা হায়াত

হৃদান ল্যাপটপে নিজের কাজ করছে। অবনী দ্বিধায় আছে কথাটা কিভাবে বলবে! আর হৃদান-ই বা কিভাবে নিবে? হৃদান খেয়াল করে অবনী খুঁত খুত করছে। হৃদান নিজের কাজ রেখে মনোযোগ দিয়ে তাকায় অবনীর দিকে। অবনীর তার দিকে মন নেই। সে অন্য ধ্যানে মগ্ন। হৃদান আকস্মিক অবনীর হাতে হাত রাখে। অবনী চমকে তাকাতেই সে জিজ্ঞাসা করে,
–‘কি হয়েছে?’
অবনী বড় একটা শ্বাস নেয়। ইতস্তত করতে করতেই বলে,
–‘একটা কথা বলি?’
হৃদান মাথা নাড়ায়। অবনী হৃদানের মুখোমুখি বসে। কণ্ঠস্বর নিচু করে বলে,
–‘যা বলতে যাচ্ছি তা শুনে আগেই প্লিজ রিয়েক্ট করবেন না। আমি জানি না কিভাবে বলবো! তবে বলাটা জরুরি।’
হৃদান প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কি এমন বলবে এই মেয়ে! অবনী কতক্ষণ হৃদানের দিকে তাকিয়ে ফট করে বলে বসে,

–‘নীলা তাইমুর ভাইকে পছন্দ করে।’
হৃদান চমকে ওঠে। মুখ দিয়ে জোড়ে বের হয়ে যায়, ‘কী?’
অবনী দ্রুত তার হাত চেপে ধরে। ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। হৃদান ব্যস্ত কণ্ঠে বলে,
–‘কিভাবে? আর কখন?’
অবনী একে একে সব খুলে বলে। তাইমুর যে অন্তিকে ৫ বছর আগে থেকেই পছন্দ করে তাও বলে। হৃদান সব শুনে থম মে’রে যায়। অবনী ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হৃদানের মুখপানে। হৃদান কতক্ষণ থমথমে মুখ নিয়ে বসে থাকে। এরপর চিন্তিত কণ্ঠে বলে,
–‘এটা ওর জন্য একদমই ঠিক না। আপনি আমাকে আগে কেনো জানাননি?’
–‘আমি জানাতে চেয়েছি। কিন্তু সুযোগটাই তো হয়ে ওঠেনি। তাছাড়া আমি বুঝতেছিলাম না ব্যাপারটা আপনি কিভাবে নিবেন!’
হৃদান দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আসলেই একের পর এক যা ঘটছে তাতে বলার মতো পরিস্থিতি ছিলো না। হৃদান নিজ থেকেই বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

–‘আমি শুধু নিজের বোনের কথা ভাবতে পারবো না। আবার বলা গেলে এটা আমার বোনের কথা ভাবা-ই। তাইমুর ভাই অন্তিকে যতটা ভালোবাসে তাতে করে কোনো ভাবে যদি নীলা তাকে পেয়েও যায় কোনো লাভ হবে না। দুজনের সংসার তো হবেই না, ভালোবাসাও পাবে না কখনো। আমি জেনে বুঝে নিজের বোনকে এমন একটা পরিস্থিতিতে ঠেলে দিতে পারবো না। তাছাড়া তাইমুর ভাই ৫ টা বছর অপেক্ষা করার পর আজ এসে নিজের ভালোবাসার মানুষকে পাচ্ছে। বাঁধা হয়ে দাঁড়ানোর প্রশ্নই আসে না।’
অবনী স্বস্তির শ্বাস ফেলে। হৃদানকে তার এজন্যই একটু বেশি ভালো লাগে। সে পরিস্থিতি, সম্পর্ক এগুলো খুব সুন্দর বোঝে। কোনো ব্যাপার খুবই ঠান্ডা মাথায় হ্যান্ডেল করতে পারে। অবনী মুচকি হাসে। শুধায়,
–‘নীলা যদি জানে কাল ওদের বিয়ে তাহলে তো আরেক কান্ড হবে।’
–‘জানবে না। আমি দেখে নিবো। আম্মাকে জানানোর দরকার নাই। পরে যখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, ওদের বিয়েটাও আয়োজনের সাথে হবে তখন ইনভাইট করলেই হবে। এখন অযথা ঝামেলার দরকার নেই।’

–‘কিন্তু আম্মা যদি রাগ করে!’
–‘আমি বুঝে নিবো ওটা। আপনি অত চিন্তা না করে ঘুমান।’
হৃদান অবনীকে চিন্তা করতে নিষেধ করলেও নিজেই চিন্তায় পড়ে যায়। এ কেমন জট লেগে গেলো! নীলাকে এখন বুঝালেও সে বুঝবে না। তাকে সময় নিয়ে বুঝাতে হবে। যেনো সবটা বুঝতে পারে। তবে তার আগে সরাসরি কথা বলতে হবে তাইমুরের সাথে।

বিয়েতে কাউকেই তেমন জানানো হবে না। তারপরও রেহেনা বেগম তার দেবর আর ভাইকে জানালেন সব। আনোয়ার সাহেবের ভাই একটু রাগ করলেন। তবুও ভাইয়ের শেষ ইচ্ছে ছিলো বলে মত দিয়ে দিলো। এখন কেউ আসবে না। যখন বিয়ের আয়োজন-অনুষ্ঠান বড় করে করা হবে তখন তাদের সবাইকেই দাওয়াত করা হবে। তাইমুর আজ হসপিটাল যেতে চেয়েছিলো। তার মা যেতে দিলেন না। তাইমুর বিরক্ত হয়ে রুমে বসে আছে। তহুরা বেগম এসে ব্যস্ত গলায় ডাকেন,
–‘জলদি আয়, বউয়ের জন্য শাড়ি গহণা তো কিনতে হবে!’
তাইমুর অলস গলায় বলে,
–‘আমি গিয়ে কি করবো? আর এমন বিয়েতে এতোকিছু করার কি আছে?’
তহুরা বেগম বেশ অবাক হলেন। ছেলের কপালে হাত ছুঁয়ে বলে,
–‘তোর কি জ্বর হয়েছে রে? এতোদিন বাদে তোরই তো পছন্দের মানুষের সাথে বিয়ে করছিস তাও মুখ এমন কেনো? নাকি অন্য কাউকে পছন্দ?’
–‘বললে বিশ্বাস করবে?’
–‘একদমই না।’

তাইমুর হতাশ শ্বাস ফেলে। তহুরা বেগম জীবনেও মানবে না সে অন্তিকে ভালোবাসে না। তহুরা বেগম তাকে জোড় করেই নিয়ে গেলেন অন্তিদের বাসায়। অন্তি তখন রেডি হচ্ছে। অবনী আর রেহেনা বেগম জোড় করেই তাকে পাঠাচ্ছে। সাথে হয়তো অবনীও যাবে। তাইমুররা আসলে অন্তির অনেক অস্বস্তিবোধ হয়। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে। তহুরা বেগম রেহেনা বেগমকেও আসতে বলে। তার এসবে মনে নেই। তাই সে মানা করে দেয়। রেহেনা বেগম বাড়িতে একা থাকবে ভেবে তহুরা বেগমও আর গেলেন না। তাইমুর, অন্তি আর অবনী, হৃদান যাবে শপিং-এ। অন্তির বিয়ে উপলক্ষে আজ হৃদান ছুটি নিয়েছে। ধরতে গেলে এ বাসারও একমাত্র পুরুষ আপাতত সে। অন্তি তার বোনের মতোই তাই তার বিয়ের সব কাজ তার ওপরই। বড় কোনো আয়োজন না হলেও বিয়ের জন্য মোটামুটি অনেক কাজ-ই থাকে। ৪ জন মিলে তাইমুরের গাড়িতে করেই রওয়ানা দেয়। তাইমুরের ইচ্ছে না থাকলে সে যাচ্ছে। সামনে তাইমুর আর হৃদান, পিছনে অন্তি আর অবনী। গাড়িতে উঠেই হৃদান বলে,

–‘শালিকা পিছে বসলে কেমনে হয়? সামনে এসে বসো!’
অবনী খোঁচা দিয়ে বলে,
–‘আরে না, আজ থাক! কাল থেকে তো দুজন একসাথেই থাকবে। আজ একটু দুরে দুরেই থাক।’
হৃদান বিড়বিড় করে বলে,
–‘৫ বছর তো ছিলোই। বেচারা!’
তাইমুর আধো আধো শুনতে পেয়েছে। চট করে ঘাড় ফিরিয়ে বলে,
–‘ভাই, কী বললেন?’
হৃদান থতমত খায়। হাসার চেষ্টা করে বলে,
–‘কই? কিছু না তো। কী বলবো?’
তাইমুর সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালে হৃদান জিভ কাটে। অবনী নিজেও কথা কাটানোর জন্য অন্য কথা তোলে। অন্তি বাহিরে তাকিয়ে আছে। তাইমুর মিররে তাকায় তার দিকে। মলে এসে প্রথমেই যায় শাড়ি কিনতে। তাইমুর দুরে দাঁড়িয়ে ফোন স্ক্রল করছিলো। তা দেখে অবনী তাকে টেনে আনে। বেনারসি তাকেই পছন্দ করতে বলে। তাইমুর একবার শাড়ির দিকে আর একবার অন্তির দিকে তাকিয়ে বলে,
–‘আমি এসব বুঝি না। তোমরাই পছন্দ করো।’
পাশ থেকে হৃদান বলে,

–‘ভাই, এই সুযোগ কিন্তু সবাই পায় না। আমিও আমার বিয়ের সময় বউয়ের জন্য নিজেই শাড়ি চুজ করছিলাম। তাই আপনিও যখন সুযোগ পায়ছেন তখন লুফে নেন।’
–‘বিয়েটা তো আমার একার না, অন্তিরও। আর যেহেতু ও বউ তাই ও নিজেই শাড়িটা পছন্দ করুক।’
এতক্ষণ অন্তি চুপ ছিলো। তাইমুরের কথায় সে চোখ তুলে তাকায় তার দিকে। তাইমুরও তার দিকে তাকিয়েছে। অন্তির চোখে চোখ রেখেই তাইমুর আবার বলে,
–‘তবে গাঢ় খয়েরীতে ওকে বেশি মানায়।’
অন্তি চমকালো, থমকালো। তাইমুর সেদিন এতোটা খেয়াল করেছিলো? পাশ থেকে হৃদান আর অবনী ‘বাহ বাহ’ করে ওঠে। দুজনেই চোখ সরিয়ে নেয়। অবনী বলে,
–‘তাইমুর ভাই তাহলে এতো খেয়াল করে অন্তিকে! হুম, ভালো ভালো।’

হৃদান আর অবনী মজা নিচ্ছে দেখে অন্তি মাথা নিচু করে নেয়। সামনে থাকা শাড়ি দেখানো মেয়েটা গাঢ় খয়েরী রঙের বেনারসিগুলো দেখায়। শাড়ির ওপর সামান্য কারুকাজ করা এমন শাড়ি নেওয়া হয়। মেয়েটা বলে,
–‘ম্যাম, আপনি চাইলে ট্রাই করে দেখতে পারেন। সে ব্যবস্থা আছে এখানে।’
অন্তি কিছু বলার আগেই তাইমুর বলে,
–‘ট্রাই করতে হবে না, আগেই ওর ট্রায়াল দেখা আছে। আপনি ঘোমটা দেখান!’
অবনী ঠোঁট গোল করে বলে ওঠে,
–‘ওহহহহ আচ্ছা!’
তাইমুর একবার তার দিকে তাকায় আর একবার হৃদানের দিকে। হৃদানকে বলে,
–‘ভাই, আপনার বউকে থামান।’

হৃদান আর অবনী একসাথে হাসে। শাড়ির কেনাকাটা শেষে জুতোর দোকানে যায়। তারপর যাশ গহণার দোকানে। ভারী কিছু নিতে অন্তি মানা করে দেয়। তাই হালকা কিছু গহণা নেওয়া হয়। কেনাকাটা শেষে ফেরার সময় অবনী আর হৃদান বলে তারা পর ফিরবে। অন্তি বলে,
–‘আম্মু অপেক্ষা করছে। একসাথেই যাই!’
–‘চলে আসবো। তোরা যা!’
তাইমুর আর অন্তি একাই গাড়িতে ওঠে। অন্তি এবার সামনে বসেছে। অবনী আর হৃদান ইচ্ছে করেই দুজনকে সময় দিলো। যেনো দুজনের মাঝে সামান্য হলেও কথা হয়। তারা চলে যায় অন্যদিকে। গাড়ি চলছে তার আপনগতিতে। অন্তি নিজেই প্রথমে জিজ্ঞাসা করে,
–‘মনের বিরুদ্ধে কেনো করছেন বিয়েটা?’
তাইমুর গাড়ি চালানো মন দিয়েই জবাব দেয়,
–‘মন বোঝার ক্ষমতা আপনার আছে?’
–‘না, নেই। তাই হয়তো আপনাকে বুঝতে পারি না।’
তাইমুর তাচ্ছিল্য করে হেসে বলে,
–‘পারবেনও না আপনি।’
অন্তি চুপ করে থাকে। বাকি রাস্তা দুজনে আর কথা বলে না। বিল্ডিং এর সামনে এসে গাড়ি দাঁড় করাতেই তাইমুর নেমে যেতে নেয়। অন্তি হুট করেই জিজ্ঞাসা করে,
–‘এতোদিন আপনি আসেননি কেনো, তাইমুর ভাই?’
অন্তির কণ্ঠে কিছু একটা ছিলো। তাইমুর চট করে তার দিকে তাকায়। চোখ দুটো ছলছল করছে। তাইমুর বোঝে না। অন্তির চোখের দিকে তাকাতেই তার হার্টবিট বাড়ে। ঢোক গিলে বলে,
–‘আপনি কি অপেক্ষা করেছেন?’
অন্তি জবাব দেয় না। চুপচাপ গাড়ি থেকে নেমে চলে যায়। তাইমুরের মাথায় অনেকগুলো প্রশ্ন জমা হয়। অন্তি তার জন্য অপেক্ষা করার মতো কোনো যুক্তিই নেই। তন্ময় আর অন্তির রিলেশনই তো প্রায় ৫ বছর হচ্ছে। তাহলে?

সন্ধ্যায় কাজী সাহেব আসেন। অন্তিকে শাড়ি পরিয়ে সামান্য সাজানো হয়েছে। মাথায় ঘোমটা টেনে সে নিজের রুমেই বসেছিল। তাইমুর একটা সাদা পাঞ্জাবি আর পাজামা পরেছে। সারাদিন কিছু মনে না হলেও এই মূহুর্তে তার প্রচন্ড রকম অস্থির লাগছে। অন্তির সাথে তার বিয়েটা হচ্ছে এটা সে বিশ্বাসই করতে পারছে না। সে তো সব আশা কবেই হারিয়ে ফেলেছিলো তবুও এ অসম্ভব ঘটনা ঘটছে ভেবেই তার হার্টবিট বাড়ছে। তার সামনেই কাজী বসে আছে। অন্তিকে আনার কথা বলা হলে অবনী আর তহুরা বেগম তাকে আনে। ঘোমটা টেনে মুখ ঢেকে দেওয়া হয়েছে। মুখ দেখা না গেলেও এ মূহুর্তে তাইমুর থমকে বসে আছে। আর মাত্র কিছু সময় তারপরই এই মেয়েটা তার হয়ে যাবে। তার মস্তিষ্ক বলছে বিয়েটা করিস না অথচ হৃদয় বলছে এই মেয়েটার জন্যই তুই এত বছর পুড়েছিস, এখন তাকে পেয়েও হারাবি? বিয়েটা করে নেয়। মন আর মস্তিষ্ক বরাবরই একে অপরের বিপরীত হয়। অন্তি ঘোমটার আড়াল থেকেই তাইমুরকে দেখে। তাইমুরের চোখে মুখের অস্থিরতা দেখে তার নিজেরও হাসফাস লাগে। চোখের পলকে যেনো সব ঘটে যাচ্ছে। কয়েক মিনিট পরই কাজী সাহেব প্রথমে অন্তিকে কবুল বলতে বলে। তিনটে বর্ণের অক্ষর অথচ অন্তির কাছে বড্ড ভারী লাগে। শক্ত করে নিজের শাড়ি চেপে ধরে সে। অবনী তার কানের কাছে বলে,

মনে রেখ এ আমারে পর্ব ১২

–‘কবুল বল।’
অন্তি চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নিয়ে প্রথমবারের মতো কবুল বলে। পরপর তিনবার বলার পর সে তখনো চোখ বন্ধ করে থাকে। তাইমুরের অবস্থা এর চেয়েও বেগতিক। তাইমুরের ওপর যেনো ভারী একটা পাথর রেখে দিয়েছে কেউ। কোনো রকমে ঢোক গিলে কাঙ্ক্ষিত শব্দটি উচ্চারণ করে। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে তারা আবদ্ধ হয়ে যায় অনাকাঙ্ক্ষিত এক সম্পর্কে, হালাল সম্পর্কে। সবাই সমস্বরে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে ওঠে। এরপর মোনাজাত করা হয়। এবার পালা বউয়ের মুখ দেখার। তাইমুর আর অন্তিকে পাশাপাশি বসিয়ে অবনী আনে একটা আয়না। অন্তির সামনে ধরে ঘোমটা তুলে দেয়। তাইমুর আয়নার দিকেই তাকিয়েছিলো। অন্তিকে দেখে চট করেই পাশে তাকায়। অন্তিও সে সময় তাকায়। চোখে চোখ পড়ে গেলে অবনী ঠোঁট কামড়ে হাসে। অবশেষে দুজন এক হলো। এবার হয়তো শুরু হবে প্রেমের নতুন অধ্যায়।

মনে রেখ এ আমারে পর্ব ১৪