মনে রেখ এ আমারে পর্ব ১৭

মনে রেখ এ আমারে পর্ব ১৭
রায়েনা হায়াত

গোসল সেড়ে এসে মাথায় ওড়না টেনে নিয়ে সবার মধ্যে বসে অন্তি। তন্ময় বার বার আড়চোখে তার দিকে তাকাচ্ছে। তা দেখে তাইমুর ফুঁসছে তবে নিজেকে সামলে নিচ্ছে। গল্পে গল্পে নাদিয়া বলে,
–‘আপনাকে কিন্তু শাড়িতে বেশি সুন্দর লাগে, ভাবী।’
অন্তি লজ্জামিশ্রীতি হাসি দেয়৷ তন্ময়ের বউও তাল মেলায়। পাশ থেকে তাইমুর বলে,
–‘এজন্যই বউকে শাড়ি পরতে দেইনি। যদি নজর লেগে যায়! ১০ টা ৫ টা একটামাত্র বউ বলে কথা।’
তার কথায় নাদিয়া আর তন্ময়ের বউ হেসে ওঠে। সায়মনও তাাইমুরকে পচায় তবে সে যে খুব একটা সহজ হচ্ছে না তা তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে। নাদিয়াই জিজ্ঞাসা করে,
–‘তা লাভ ম্যারেজ নাকি এ্যারেঞ্জ ম্যারেজ?’
এবারও জবাবটা তাইমুর দেয়,

–‘৫ বছরের প্রেম শেষে বিয়ে।’
অন্তি চোখ বড় বড় করে তাকায়। তন্ময় আর সায়মনও একে অপরের দিকে তাকায়। তন্ময়ের বউ থাকায় বেচারা কিছু বলতেও পারছে না। নিজের কপাল চাপড়াচ্ছে কেনো সে এখানে এসেছে ভেবে। নাদিয়া প্রশংসার সুরে বলে,
–‘বাহ্ ভাই, আপনি তো বড় কাজ করে ফেলেছেন!’
তাইমুর মিষ্টি করে হাসে৷ তা দেখে অন্তিও কৃত্রিম হেসে মাথাটা সামান্য তাইমুরের দিকে নিয়ে যায়। নিচু স্বরে বলে,
–‘কম হয়ে গেলো না?’
–‘আসলেই। ১০ বছরের পূর্ণতা বলা উচিত ছিল।’
অন্তি কটমট করে তাকায়। তাইমুর হাসছে। গল্পে গল্পে ধীরে ধীরে সময় কাটতে থাকে। খাওয়ার সময় আসলে অন্তি আর খালা মিলে আগে সবাইকে খেতে দেয়। অন্তি দাঁড়িয়ে থাকলে তাকেও বসতে বলে নাদিয়া। অন্তির হাত কেটে গেছে তাই সে পরেই খাবে। এ কথা বলতেই তাইমুর তাকে টেনে বসায়। ব্যস্ত ভাবে হাত টেনে কাছে নিয়ে ভালো মতো দেখে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

–‘সাবধানে কাজ করতে পারো না? কাটলো কিভাবে?’
অন্তি অবাক হয়ে তাকায়। সেদিন রাতে ঘুমের মধ্যে তুমি বললেও আজ ইচ্ছে করে বলেছে ভেবে আরও অবাক হয়েছে। তার মধ্যে এতো যত্ন তার হজম হচ্ছে না। সব কিছু শুধু দেখানোর জন্য? অন্তির খারাপ লাগে তবুও হাসি মুখে বলে,
–‘সামান্যই কেটেছে। ঠিক হয়ে যাবে।’
তাইমুর শোনে না। সবার সাথেই অন্তির প্লেটে নিজেই খাবার দেয়। অন্তি মানা করে তবে সে শোনে না৷ সবাইকে খেতে শুরু করতে বলে আবার সায়মনকে বলে,
–‘দোস্ত, আমার বউকে আমি খাইয়ে দিলে তোরা কিছু মনে করবি না তো?’
সায়মন জবাব দেওয়ার আগেই নাদিয়া বলে ওঠে,
–‘একদমই না। আপনি খাইয়ে দিন, ভাইয়া।’

তন্ময়ের বউও একই কথা বলে। তন্ময় দাঁতে দাঁত চেপে বসে আছে। তার ধৈর্যের বাধ কখন যেনো ভেঙে যায়! সে না পারছে অন্তিকে কিছু বলতে আর না পারছে এসব সইতে। খাবারও গলা দিয়ে নামছে না। তাইমুর যত্ন করে অন্তিকে খাওয়ানো শুরু করে। একই প্লেট থেকে নিজেও খায়। অন্তির বেশ লজ্জা লাগছিলো তবে তাইমুরকে এখন মানা করলে যদি তন্ময় খুশি হয়ে যায় এ ভেবে সেও চুপচাপ খাচ্ছে। হাজার হলেও তার একটা সময় সম্পর্ক ছিলো তন্ময়ের সাথে তাই তার মুখ দেখে বুঝতে বাকি নেই মনের মধ্যে কি চলছে! সেও বেশ মজা নিচ্ছে। হাসি-ঠাট্টায় খাওয়া-দাওয়া শেষ হয়। মেয়েরা একসাথে বসলে তাইমুর সায়মন আর তন্ময়কে নিয়ে ব্যালকনিতে যায়। তন্ময় তার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে আছে। তা দেখে তাইমুর হাসে। তবে শান্ত গলায় বলে,
–‘আমার বাড়িতে বসে আমাকেই চোখ দেখাচ্ছিস? দেখ, ডক্টর হিসেবে সার্জারীর হাতটাও কিন্তু আমার বেশ ভালো। তুই চাইলে চোখগুলো তুলে নিয়ে নতুন একটা বসিয়ে দিতে পারি। কি বলিস?’
তন্ময় চোয়াল শক্ত করে বলে,

–‘থ্রেট দিচ্ছেন আমাকে?’
–‘তুই যা ভাবিস, তাই। এখন তো শুধু বলতেছি, মন মতো উত্তর না পেলে করেও দেখাবো।’
এরপর সায়মনের দিকে তাকিয়ে বলে,
–‘তোর ভাই ভালো করেই জানে, তাইমুর যা বলে তা সুন্দর মতো করতেও জানে। ঠিক না, দোস্ত?’
সায়মন মাথা নাড়ায়। তার মুখে ভয়, অপরাধবোধের সংমিশ্রণ। তাইমুর তার কাঁধে হাত রেখে বলে,
–‘এবার বল, ৫ বছর আগে কি হয়েছিলো!’
জবাবটা তন্ময় দেয়,

–‘নতুন করে বলতে হবে কেনো? আপনি জানেন না?’
–‘জানি তবে সত্যটা জানি না। এখন সত্যটা বল!’
তন্ময় কিছু বলতে গেলে তাইমুর তাকে আটকে সায়মনের দিকে তাকায়। শান্ত তবে অদ্ভুত কণ্ঠে বলে,
–‘৫ বছর আমি অন্তির থেকে দুরে ছিলাম। তুই তোর বন্ধুত্ব অনেক আগেই শেষ করে দিয়েছিস। আশা করি আজ নতুন করে আবার বেইমানি করবি না। অন্তিকে এতো বছর পর পেয়েছি যখন তখন সব সত্যিটাও আমি জেনেই ছাড়বো। ভালো হয় তুই নিজে স্বীকার কর।’
সায়মন চুপ থাকে। তন্ময় আর তাইমুর তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তন্ময় দু’দিকে মাথা নাড়াচ্ছে তবে সায়মন তার দিকে তাকায়ও না। হতাশা আর অপরাধবোধ নিয়ে বলে,

–‘আমি জানি আমি বন্ধু হিসেবে ব্যর্থ। আমি তোর কষ্টের কারণ হয়েছি। কিন্তু আমি নিরুপায় ছিলাম। তুই তো জানিস আমার কোনো ভাই-বোন নেই। তন্ময়কেই সবসময় ছোট ভাই হিসেবে বড় করেছি। সেবার যখন আমি ফিরেছিলাম তোর সাথে অন্তির কথা বলাবো বলে সেদিনই তন্ময় জানিয়েছিলো ও অন্তিকে পছন্দ করে। আমি পুরো দোটানায় পড়ে গেছিলাম। কি করবো কিচ্ছু বুঝছিলাম না। যখন ওকে বললাম তুইও অন্তিকে পছন্দ করিস তখন ও কান্নাকাটি শুরু করে।’
সায়মন চুপ করে যায়। তাইমুর তাচ্ছিল্য করে হেসে বলে,

–‘তাই তুই ভাইয়ের ভালোবাসা বাঁচাবি ভাবলি, তাই তো?’
–‘হু। অন্য কোনো উপায়ও ছিলো না। তুই আমার জায়গায় থাকলে কি করতি?’
তাইমুর সহজ গলায় বলে,
–‘যা-ই করতাম, মিথ্যা বলতাম না। তারপর বল! অন্তির সাথের হাসাহাসির ছবিটা তুই-ই তুলেছিলি!’
সায়মন মাথা নাড়ায়। তাইমুর ফের শুধায়,
–‘তাহলে আমি যখন অন্তির সাথে কথা বলেছিলাম তখন ও আমাকে অতো কথা শুনিয়ে ছিলো কেনো? আর অন্তি কেনো বললো তোর সাথে ওর গত ৫ বছরে আর দেখা-ই হয়নি?’
–‘সেদিন অন্তি তোকে কিছুই বলেনি। ও অন্য একটা ছেলেকে ওসব বলেছিলো যেগুলো তুই মনে করেছিলি তোকে বলেছিলো।’

তাইমুরের প্রচন্ড রকমের রাগ হয়। তার কাছে সবটা পরিষ্কার হয়ে যায়। রাগ সামলাতে না পেরে সায়মনের কলার চেপে বসে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
–‘কি লাভ হইছে তোর? যার জন্য এতোকিছু করছিস সেই ভাই অন্তিকে ভালো রাখছে? থাকতে পারছে ওর সাথে? অন্তি আর আমি গত ৫ বছরই একে অপরকে ভালোবাসছি কিন্তু তোদের জন্য দুরে থাকতে বাধ্য হইছি।’
সায়মন অবাক চোখে তাকায়। সে জানতো না অন্তি তাইমুরকে ভালোবাসতো। তন্ময় সুযোগ বুঝে বলে,
–‘আপনাকে ভালোবাসলে আমার সাথে কি ছিলো ওর?’

মনে রেখ এ আমারে পর্ব ১৬

–‘তোর নাটক ছিলো ওর সাথে। আমি রেগে তোদেরকে খু’ন করার আগে চোখের সামনে থেকে যা।’
সায়মন নিজের পক্ষে কিছু বলে না। তন্ময় কিছু বলতে গেলে তার হাত টেনে বের হয়ে যায়। বাহিরে নাদিয়াদেরকে থাকতে বলে তারা আপাতত বিল্ডিং থেকে বের হয়ে যায়। তাইমুর ভেঙে পড়ে। সায়মন তার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো। ওর দিক থেকে হয়তো সে ঠিকই ছিল তবে তার সাথেও তো অন্যায়-ই হয়েছে। একটাবার সব খুলে বলতে পারতো! একটাবার অন্তির মতামত জানতে পারতো! অন্তি যদি তন্ময়কে চাইতো তবে তো সে ঠিকই দুরে সরেই থাকতো। এটুকু বিশ্বাসও কি তাইমুরের প্রতি তার ছিলো না?

মনে রেখ এ আমারে পর্ব ১৮