মন দিয়েছি তোমাকে পর্ব ১
নুজাইফা নূন
-”চৌধুরী বাড়ির একমাত্র মেয়ে ঐশ্বর্য চৌধুরী কে দেখতে এসে বাড়ির কাজের মেয়ে সিজদা কে পছন্দ হয়েছে পাত্রের দাদি হালিমা বেগমের।তিনি ঠিক করে নিয়েছেন সিজদা ই হালিমা মঞ্জিলের বউ হয়ে যাবে।সিজদার মতো রুপবতী , গুণবতী , মায়াবতী মেয়ে খুব কম দেখেছেন তিনি।একটা মেয়ে হয়েও নির্লজ্জের মতো বারবার সিজদাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছেন তিনি। তবু ও যেন তার চোখের তৃষ্ণা মিটছে না।তার একমাত্র নাতি সারজিস মির্জার জন্য পাত্রী দেখতে এসেছে মির্জা পরিবারের সদস্যরা। তারা গাড়ি থেকে নামতেই একটা মেয়ে মিষ্টি কণ্ঠে সালাম দিয়ে বললো,
-” আপনাগো আইতে কোনো অসুবিধা হয় নি তো ?মেয়েটার কথা শুনে হালিমা বেগম সালামের উত্তর দিয়ে তার দিকে এগিয়ে আপাদমস্তক দেখতে লাগলো।মেয়েটার পরণে রং চটা সুতির থ্রি পিস।পুরো শরীর ঘেমে ভিজে একাকার হয়ে আছে।মাথায় ঘোমটা টেনে রাখা।মেয়েটার মুখের দিকে তাকাতেই কথা বলতে ভুলে যান হালিমা বেগম ।মনে হচ্ছে সে কোনো মানুষ না।পরীর সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে।বিধাতা যেন সমস্ত রুপ, লাবণ্য, মায়া ঢেলে দিয়েছেন মেয়েটার মুখে।ডাগর ডাগর অধিক বড় বড় পাপড়ি বিশিষ্ট চোখ, সরু নাক, পাতলা গোলাপী ঠোঁট ।মেয়েটার চোখদুটো দেখে পরিচিত মনে হয় হালিমা বেগমের।মনে হয় যেন এই মায়াবী চোখ দুটো আগে কোথাও দেখেছে।তার বড্ড ইচ্ছে হয় মেয়েটার চোখের পাপড়ি ছুঁয়ে দেখতে এগুলো আসল নাকি নকল?তিনি তার ইচ্ছা কে দমিয়ে রেখে বললেন,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-” কি নাম তোমার?”
-” সিজদা।”
-” বাহ্। তোমার নাম যেমন মিষ্টি।তেমনি তুমি ও দেখতে অনেক মিষ্টি।”
-” প্রতিত্তরে সিজদা মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে বললো, থ্যাংকু ম্যাডাম।আপনারা ভেতরে আহেন।”
-” হ্যাঁ যাচ্ছি বলে হালিমা বেগম ড্রাইভার কে বললো, রতন সব মিষ্টির প্যাকেট গুলো ভেতরে নিয়ে চল।রতন গাড়ির ডিকি থেকে প্যাকেট গুলো বের করতেই সিজদা এগিয়ে গিয়ে রতনের হাত থেকে প্যাকেট গুলো নিয়ে বললো,
-” এগুলো আমার কাছে দ্যান চাচা।আপনে কষ্ট কইয়া গাড়ি লইয়া আইছেন।এহন একটু দম লন।সিজদার সরলতা দেখে মুগ্ধ হন হালিমা বেগম।তারা ভেতরে প্রবেশ করতেই তাদেরকে সাদরে গ্ৰহন করেন বিথী চোধুরী। তাদের আদর আপ্যায়নে বিন্দু মাত্র ত্রুটি রাখেন নি তিনি।তিনি কোনো মতেই এই সম্বন্ধ হাত ছাড়া করতে চান না।তার স্বামীর বাল্যকালের বন্ধু ফারুক মির্জা । তাদের দুজনের বন্ধুত্ব আরো মজবুত করতে দুই বন্ধুর সম্মতিতে কনে দেখার আয়োজন করা হয়।বিথী চোধুরী তার স্বামীর মুখে শুনেছেন ছেলে একজন কার্ডিওলজিস্ট।দেখতে পুরোই হিরোদের মতো।
ইয়াং জেনারেশনের মেয়েদের ক্রাশ।আবার তাদের মস্ত বড় ক্যাটারিং এর ব্যবসা। এতো ভালো পরিবার যাতে হাতছাড়া না হয় এজন্য বিথী চোধুরী নামকরা বিউটিশিয়ান বাড়িতে নিয়ে এসেছেন মেয়েকে সাজানোর জন্য।নাস্তার পর্ব শেষ হলে ঐশ্বর্য কে পাত্রপক্ষের সামনে নিয়ে আসা হয়। ঐশ্বর্য সবাইকে সালাম দেওয়ার পরিবর্তে হ্যালো গাইস বলে সম্বোধন করে।কণ্ঠটা পরিচিত মনে হয় হালিমা বেগমের। কিন্তু মুখে ভারী মেকআপের জন্য ঠিক চিনতে পারেন না তিনি।
তিনি একাধারে ঐশ্বর্যের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিয়ৎক্ষণ। মিনিট কয়েক অতিবাহিত হবার পর ঐশ্বর্য কে চিনতে অসুবিধা হয় না তার।হালিমা বেগম একজন অ্যাডভোকেট। প্রতিনিয়ত কোর্টে যাওয়া আসা তার। কিছু দিন আগে কোর্ট থেকে বেরিয়ে গাড়িতে সমস্যা হবার জন্য রিক্সা করে বাড়ি ফিরছিলেন। রাস্তায় ফেলে রাখা ইটের সাথে ধাক্কা লেগে রিক্সাওয়ালা ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলার দরুন তার রিক্সা গিয়ে একটা সাদা রঙের গাড়ির সাথে লেগে যায়।রিক্সাওয়ালা কিছু বুঝে ওঠার আগেই গাড়ি থেকে অর্ধনগ্ন ড্রেস পরা একটা মেয়ে বেরিয়ে এসে তার গালে থা’প্পড় মে’রে দিয়ে বললো,
-” বাইন**** তোর কপালে চোখ নেই? দিলি তো আমার গাড়ি টা নোংরা করে। তুই জানিস আমার গাড়ির দাম কতো? অবশ্য তোর মতো ছোটলোকের বাচ্চাদের এসব গাড়ির দাম জানার কথা নয়।”
-” দু্ঃখিত ম্যাডাম।আমার ভুল হয়ে গেছে।আমি এক্ষুনি আপনার গাড়ি পরিষ্কার করে দিচ্ছি।”
-” তোর নোংরা হাত দিয়ে আমার গাড়ি স্পর্শ করবি না ছোটলোকের বাচ্চা।”
-” হতে পারেন আপনারা বড়লোক।তাই বলে বারবার ছোটলোকের বাচ্চা বলে অপমান করার কোন অধিকার আপনার নেই।”
-” তুই আমার মুখের উপর তর্ক করিস বলে থা’প্পড় দেওয়ার জন্য হাত উঠাতেই হালিমা বেগম রিক্সা থেকে নেমে ঐশ্বর্যের হাত ধরে বললেন,
-” এটা কোন ধরণের অসভ্যতা ? মানুষ মাত্রই ভুল করে। ছেলেটা তো বলছে সে ভুল করেছে।তারপর ও তুমি তাকে যা নয় তাই বলে অপমান করছো।তার গায়ে হাত তুলছো।এটা কিন্তু অন্যায়।”
-” ঐশ্বর্য তৎক্ষণাৎ হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, তুই চুপ থাক বুড়ি।এক ঠ্যাং কবরে চলে গেছে। কোথায় এখন ঘরে বসে তসবিহ গুনবি।তা নয় তো আমাকে ন্যায় অন্যায় শিখাতে আসছিস? যত্তসব থার্ড ক্লাস লোকজন। হালিমা বেগম কিছু বলতে যাবেন তার আগেই কোথা থেকে ঢিলেঢালা কালো বোরকা পরা একটা মেয়ে এসে বললো,
-” আপনে শান্ত হন আপামণি।আমি গাড়ি পরিষ্কার করে দিচ্ছি বলে মেয়েটা নিজের বোরকা দিয়ে গাড়ি পরিষ্কার করে দিয়ে রিক্সাওয়ালার কাছে হাত জোড় করে বললো,
-” আপা মণির হয়ে আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি।আপনে দয়া কইয়া কিছু মনে লইবেন না।”
-” হালিমা বেগম মেয়েটা কে দেখে তার দিকে এগিয়ে আসতেই মেয়েটা গাড়িতে উঠে যায়। চোখের পলকেই গাড়ি ছুটে চলে যায়।। পুরোনো কথা মনে পড়তেই হালিমা বেগমের কাছে সবটা স্বচ্ছ কাঁচের মতো পরিষ্কার হয়ে যায়। সেদিনের সেই বোরকা পরা মেয়েটা আর কেউ নয়। বরং সিজদা। এজন্যই সিজদার চোখ দেখে তার পরিচিত মনে হয়েছিলো। ঐশ্বর্য এখনো হালিমা বেগম কে দেখে নি।তার দৃষ্টি মেঝেতে সীমাবদ্ধ হয়ে রয়েছে।যেন তার মতো ভদ্র মেয়ে দুনিয়াতে দুটো নেই।বিথী চোধুরী মেয়ের নাটক দেখে মনে মনে হেসে ঐশ্বর্যের কাঁধে হাত রেখে বললো,
-” আমার মেয়ের ব্যাপারে কি আর বলবো ? সবটাই তো নিজ চোখে দেখছেন আপনারা।আমার মেয়ে কোন অংশে কম নয়।এই যে সব খাবার দেখছেন সব কিছু আমার মেয়ে নিজে হাতে রান্না করেছে। আপনাদের ক্যাটারিং এর ব্যবসা।সেইখানে বাড়ির বউ রান্না না জানলে হয় বলুন? তাই তো মেয়েটা সকাল থেকে আপনাদের জন্য রান্না বান্না করেছে। তাছাড়া আমার মেয়ে অনেক ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট।ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেয়েছে।এইটে বৃত্তি পেয়েছে।এসএসসি তে গ্লোল্ডেন প্লাস পেয়েছে।ইন্টারেও ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছে। অনেক গুনী মেয়ে আমার। চাঁদের খুঁত থাকলেও আমার মেয়ের কোন খুঁত পাবেন না।
আপনাদের থেকে ও অনেক ভালো ভালো ঘর থেকে আমার মেয়ের জন্য বিয়ের সমন্ধ এসেছিলো। কিন্তু আমার স্বামীর অনেক ইচ্ছা তাদের বন্ধুত্ব কে বেয়াইয়ের সম্পর্কে রুপান্তর করার। এজন্যই সবাইকে রিজেক্ট করে দিয়েছি আমি।আমার কাছে টাকার থেকে সম্পর্কের মূল্য অনেক বেশি।।”
-”মির্জা পরিবারের সবারই ঐশ্বর্য কে পছন্দ হয়। ফারুক মির্জা হালিমা বেগমের হাতে গয়নার বাক্স দিয়ে বললো,
-”আমি বলেছিলাম না আম্মা আপনার নাতির জন্য আমি হীরের মতো দামি রত্ম খুঁজে পেয়েছি। নিজে চোখেই তো দেখলেন ঐশ্বর্য মা কে।সবার মতো আপনার ও নিশ্চয় ঐশ্বর্য কে পছন্দ হয়েছে? পছন্দ হলে আর দেরি করবেন না। ঐশ্বর্য মা কে গয়নাগুলো পরিয়ে দোয়া করে দিন।সাথে বিয়ের দিনক্ষণ ও পাকা করে যাওয়াই ভালো। হালিমা বেগম তার কথার কোন প্রতিত্তর না করে সোজা কিচেনে চলে আসেন। কিচেনে সিজদা এঁটো বাসন পরিষ্কার করছে। তার পাশ থেকে বাড়ির হেল্পিং হ্যান্ড সালেহা বেগম বলছেন,
-” বড় ম্যাডাম ছোট ম্যাডাম দোনোডাই আস্ত নাটকবাজ। সকাল থেকে কষ্ট কইয়া এতো গুলো রান্না তুই নিজে হাতে করলি।অথচ ম্যাডাম কতো সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে মিথ্যে কথা কইয়ে দিলো তার মাইয়া নাকি এতো গুলো রান্না করছে। হুঁ যে মাইয়া জগ থেকে পানি ঢেলে খায় না।সেই মাইয়া নাকি এতো গুলো মাইনষের খাওয়োন রানবো।পোলার পক্ষের লোকগুলান ও অনেক ভালা।এমন একটা পরিবারে যদি তোর বিয়া হতো !”
-” বাদ দ্যাও তো সালেহা খালা। কোথায় আপামণি আর কোথায় আমি ? সে এই বাড়ির মালিক।আর আমি এই বাড়ির কাজের লোক।তার সাথে কি আমার তুলনা চলে কও?”
-” প্রতিত্তরে সালেহা খালা কিছু বলতে যাবে তার আগেই হালিমা বেগম সিজদার হাত ধরে টানতে টানতে ড্রয়িং রুমে সবার সামনে নিয়ে এসে বললো,
-” আমি ঐশ্বর্য কে না বরং সিজদা কে আমার নাতি সারজিস মির্জার বউ করতে চাই।।”
