মন দিয়েছি তোমাকে পর্ব ১৩

মন দিয়েছি তোমাকে পর্ব ১৩
নুজাইফা নূন

” সাইফানের সাথে দেখা করবি সিজদা? তুই যদি চাস তোর আর সাইফানের দেখা করার ব্যবস্থা করে দিতে পারি। নিজেদের মধ্যে কথা বলে নিতে পারবি।”
-” না মামু। এসবের কোনো প্রয়োজন নেই।”
-” যার সাথে সংসার করবি তাকে বিয়ের আগে একটা নজর দেখবি না?”
-” তুমি তো দেখছো।আমার আর ঘটা করে দেহোনের কোনো দরকার নাই মামু।”
-” আমি সাইফান কে সরাসরি দেখি নি।ফোনে সাইফানের ছবি দেখেছি।তোকে তো বলাই হয় নি সাইফান একজন আর্মি অফিসার।গায়ের রং একটু চাপা হলেও একজন সুদর্শন পুরুষ। তুই নিজে চোখেই দেখ বলে রাশেদ চৌধুরী নিজের ফোন থেকে সাইফানের ইউনিফর্ম পরা একটা ছবি সিজদার সামনে রেখে বললো,

-” কেমন?”
-”সিজদা একটু লজ্জা পেয়ে যেমন হয় হোক।এসব নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই মামু।”
-” রাদেশ চৌধুরী কিছু বলার আগেই বিথী চোধুরী বললো,
-” সমস্যা থাকার তো কোনো কথা না সিজদা। বড়লোক বাড়ির ব‌উ হবি।তোর চোখ তো এখন বড় বড় হয়ে গেছে।সাথে নির্লজ্জ বেহায়া ও হয়ে গিয়েছিস।মামার সাথে নির্লজ্জের মতো বিয়ের ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করছিস। ছিঃ সিজদা ছিঃ।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-” এখানে নির্লজ্জের কি দেখলে বিথী? এই কাজ টা তো তোমার করার কথা ছিলো। কিন্তু না। তুমি তো হিংসায় জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছো।সিজদার এতো ভালো পাত্রের সাথে বিয়ে হচ্ছে।এটা তুমি কিছুতেই মানতে পারছো না।তুমি চেয়েছিলে কোনো দারোয়ান বা ড্রাইভারের সাথে সিজদার বিয়ে দিতে। কিন্তু যখন দেখলে তোমার সেই চাওয়া পূরন হয় নি।তখন থেকেই তোমার চোখ জ্বলছে। আর মাত্র কালকের দিনটা। পরশু দিন মেয়েটা চলে যাবে।তাই দয়া করে এই দুইটা দিন অন্তত মেয়েটার সাথে একটু ভালো ব্যবহার করো।সিজদাকে বাড়ির কাজের মেয়ে না। নিজের মেয়ের চোখে দেখো।”

-” কোথায় আগরতলা আর কোথায় খাটের তলা? কার সাথে কার তুলনা করছো তুমি? আমার মেয়ের নখের সমান যোগ্যতা ও তোমার বোনের মেয়ের নেই।”
-” আসলে আমি একজন মেরুদন্ডহীন পুরুষ মানুষ।আমার উচিত … বাকিটা বলতে দেয় না সিজদা।সিজদা রাদেশ চৌধুরী কে থামিয়ে দিয়ে বললো,
-” থাক না মামু।আমার জন্য শুধু শুধু তোমরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া ক‌ইরো না।সিজদার কথা যেন বিথী চোধুরীর কাছে কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেওয়ার মতো মনে হলো।সে সিজদা কে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়।যার দরুন খাটের কোনার সাথে আঘাত লেগে সিজদার কপাল থেকে রক্ত বেরিয়ে আসে।সেদিকে খেয়াল নেই বিথী চোধুরীর।তিনি সিজদার দিকে ক্ষিপ্ত হয়ে এসে বলললো,

-” আমাদের মধ্যে যখনি কোন ঝামেলা হয়।সেটা তোকে ঘিরেই হয়। তুই যতো অশান্তির কারণ।”
-” রাশেদ চৌধুরী সিজদার কপাল দিয়ে রক্ত বের হতে দেখেই দৌড়ে এসে সিজদা কে নিচ থেকে তুলে নিয়ে খাটের উপর বসিয়ে দেয়।এদিকে ওদিক ফার্স্ট এইড বক্স খুঁজে না পেয়ে
দৌড়ে নিজের রুমে ফার্স্ট এইড বক্স নিতে ছুটে আসেন।রাদেশ চৌধুরী কে বিচলিত হয়ে সিজদার রুম থেকে বেরিয়ে যেতে দেখে সালেহা বেগম তড়িৎ গতিতে সিজদার রুমে প্রবেশ করে।সিজদাকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে সালেহা বেগমর কলিজা মোচড় দিয়ে ওঠে। সালেহা বেগম কি করবে বুঝতে পারে না।তাকে বিচলিত হতে দেখে সিজদা বললো,

-” আমার কিছু হয় নি খালা।সামান্য একটু কাইটা গেছে। তুমি চিন্তা ক‌ইরো না।ঠিক হ‌ইয়া যাবো।”
-” তোর কপাল ফাইটা তো রক্ত বাইর হইতাছে।তোরে ডাক্তারের কাছে ল‌ইতে হ‌ইবো।ডাক্তারের কথা বলতেই সিজদার চোখের সামনে গায়ে সাদা অ্যাপ্রোন , গলায় স্টেথোস্কোপ ঝোলানো সারজিসের গম্ভীর, থমথমে চেহারা টা ভেসে ওঠে।সারজিসের কথা মনে পড়তেই সিজদার অজান্তেই নিজের মুখে হাসি ফুটে উঠে।।”

-”সকাল নয় টা।হালিমা মঞ্জিলের সব সদস্যরা ব্রেকফাস্টের জন্য ডাইনিং টেবিলে বসে পড়েছে। কিন্তু সারজিসের দেখা নেই।সারজিস কে না পেয়ে হালিমা বেগম সারজিসের রুমে এসে দেখে সারজিস হসপিটালে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। হালিমা বেগম কে দেখে সারজিস হাত ঘড়ি পরতে পরতে বললো,
-” বাইরে কেন? ভেতরে এসো বিউটি ফুল লেডি।”
-” নিচে সবাই ব্রেকফাস্ট করছে। তুমি এখনো নিচে যাও নি কেন?”
-” আমি নিচে যাই নি সেটাও খেয়াল করেছো তুমি? আমাকে নিয়ে ভাবার সময় আছে তোমার?”
-” এভাবে বলছো কেন দাদুভাই?

-” আমার জন্য কখনোই কারোর কোনো সময় ছিলো না দাদু।মা যাওয়ার পর বাবাও যেন পর হয়ে গেলো।আমি কখন কোথায় যাই, কি করি, কি খাই না খাই সেগুলো দেখার সময় ছিলো না তার।সে তার বিজনেস নিয়ে ব্যস্ত থাকতো সবসময়।বাবা মনে করতো টাকায় সব।আমাকে লাখ লাখ টাকা দিতো।অথচ আমি ছিলাম ভালোবাসার কাঙ্গাল। ভেবেছিলাম আর কেউ আমাকে ভালো না বাসলেওআমার দাদু আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু তুমি ও আমাকে ভালোবাসো না দাদু।আসলে মা ছাড়া আমাকে কখনোই কেউ ভালোবাসে নি।যদি ভালোই বাসতে আমি তোমার একটা কথার অবাধ্য হবার জন্য আমাকে এভাবে দূরে ঠেলে দিতে পারতে না।এখন তোমার কাছে আমার থেকে ও সাইফানের মূল্য অনেক বেশি দাদু।”

-” তুমি ভুল ভাবছো দাদুভাই।”
-” সঠিক ভুল বিচার করার বয়স আমার হয়েছে দাদুভাই।”
-”আমি যে শুধু মাত্র আমার মানসম্মানের কথা ভেবে সিজদা কে সাইফানের সাথে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছি এটা না।আমি সিজদা কে নতুন একটা জীবন উপহার দিতে চেয়েছি।জানো দাদুভাই সিজদার বাবা একজন সিআইডি অফিসার ছিলেন।তিনি নিখোঁজ।মৃত বলা চলে।মা বেঁচে থাকতেও মৃত।মামা বাড়িতে কাজের লোকের পরিচয়ে বড় হয়েছে। মেয়েটাকে দেখেই আমার মায়া লেগেছে।আমি চেয়েছি তাকে ঐ নড়ক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে।বিয়ে ছাড়া সিজদা কে ঐ বাড়ি থেকে বের করার আর কোন উপায় ছিলো না। তাই আমি যেকোনো ভাবেই হোক বিয়েটা দিতে চেয়েছি।তোমাকে অনেক বার বলার পরেও তুমি রাজি হ‌ও নি।তাই সাইফানের সাথে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া। তুমি যদি বিয়েতে রাজি থাকতে তাহলে তো এসবের কোনো প্রয়োজন ছিলো না।”

-” থাক না দাদু।এসব শুনতে আমার ভালো লাগছে না ।আমি আসছি।”
-” আসছি মানে? ব্রেকফাস্ট করবে না।”
-” বাইরে থেকে করে নিবো।বাই বলে সারজিস হসপিটালের উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়ে।সারজিসের যাওয়ার পানে তাকিয়ে হালিমা বেগম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রুম থেকে বেরিয়ে এসে হালকা পাতলা নাস্তা সেরে তিনি ওবিয়ের শপিংয়ের জন্য বেরিয়ে পড়েন।।

-” হালিমা বেগম সিজদা কে নিয়ে মেট্রো শপিং মলে বিয়ের শপিং করতে এসেছে।সিজদার পরণে কালো বোরকা।চোখ দুটো অনেক মায়াবী দেখাচ্ছে।এতো বড় মলে কখনো আসা হয় নি সিজদার। শপিং মলে কলহ, লোকজনের সমাগম দেখে ভয়ে জড়সড় হয়ে যায় সিজদা। সালেহা বেগম সিজদার সাথে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু বাড়িতে অনেক কাজ থাকার দরুন তিনি আসতে পারেন নি। বিথী চোধুরী, ঐশ্বর্য চৌধুরী মা মেয়ে দুজন কেই হালিমা বেগম খুব একটা পছন্দ করেন না দেখে রাশেদ চৌধুরী তাদের কে সিজদার সাথে পাঠাতে চান নি। অগত্যা সিজদার একার‌ই আসতে হয়েছে। মির্জা পরিবারের সদস্যরা সবসময় মেট্রো শপিং মল থেকে কেনাকাটা করুন হালিমা বেগম কে খুব ভালো করে চেনেন তারা। মির্জা পরিবারের সদস্যদের সাথে খুব ভালো বন্ডিং তাদের।হালিমা বেগম কে আসতে দেখে শপিং মলের ম্যানেজার হালিমা বেগমের দিকে এগিয়ে এসে সালাম দিয়ে বললেন,

-” কাকিমা আপনি কষ্ট করে আসতে গেলেন কেন ? আপনার কি কি লাগবে বললে আমি আমার লোকেদের দিয়ে হালিমা মঞ্জিলে পাঠিয়ে দিতাম।”
-” স্বশরীরে শপিং মলে এসে ঘুরে ঘুরে শপিং করার মজাই আলাদা।”
-” সেটা অবশ্য ঠিক বলেছেন কাকিমা।এখন বলুন আপনার কি কি লাগবে?”
-” তোমাদের এখানকার বেস্ট বিয়ের কালেকশন দেখাও।”
-” ঠিক আছে কাকিমা । আপনারা আমার সাথে আসুন ।”

-” হালিমা বেগম সিজদার পা থেকে মাথা পর্যন্ত যা যা লাগে প্রয়োজনীয় সবকিছু কেনাকাটা করার পর মির্জা পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি সিজদার মামা , মামী , ঐশ্বর্য, এমনকি সালেহা বেগমের জন্য ও কেনাকাটা করেন। কেনাকাটা শেষ করে মল থেকে বের হতেই রাশেদ চৌধুরী সাথে দেখা হয়।তাকে দেখে হালিমা বেগম বললেন,
-” ভালোই হয়েছে তুই এসেছিস।অনেক হাঁটাহাঁটি করে আমার শরীর টা ঠিক লাগছে না।তুই সিজদা কে নিয়ে যা।”
-” আমি কি আপনাকে বাড়িতে পৌঁছে দিবো কাকিমা?”
-” না না। ড্রাইভার তো আছেই।তোর আর কষ্ট করে আমার বাড়ি পর্যন্ত যেতে হবে না। তুই বাড়িতে যা।আর হ্যাঁ সিজদা এখন তোর কাছে আমানত স্বরুপ। আমানতের খিয়ানত করবি না কিন্তু।”

-” ঠিক আছে কাকিমা।”
-” হালিমা বেগম সিজদার হাত দুটো নিজের মুঠোয় পুরে নিয়ে বললো,
-” নিজের খেয়াল রেখো সুন্দরী।”
-” আপনি ও‌ নিজের খেয়াল রাখবেন।”
-” হ্যাঁ রাখবো। তাছাড়া দুই দিন পরে তুমি তো আসছোই আমার খেয়াল রাখার জন্য।‌এই বুড়িটার খেয়াল রাখবে তো?”

-” অবশ্যই রাখবো ম্যাডাম।”
-” আবারো ম্যাডাম?কতোবার বলেছি আমাকে ম্যাডাম বলবে না।এবার কিন্তু কানের নিচে ঠাঁটিয়ে এক চড় মেরে দিবো।”
-”সিজদা মুচকি হেসে বললো আর কখনো ম্যাডাম বলবো না দাদিজান।”
-” এইতো লক্ষী নাতব‌উ আমার বলে হালিমা বেগম রাশেদ চৌধুরী,সিজদার থেকে বিদায় নিয়ে নিজের গন্তব্যে ছুটে চলেন।তিনি যেতেই রাশেদ চৌধুরী বললো,
-”সিজদা তুই এইখানে একটু দাঁড়া।আমি সামনের দোকান থেকে একটু আসছি। বেশি সময় লাগবে না। পাঁচ দশ মিনিটের মধ্যেই চলে আসবো।”

মন দিয়েছি তোমাকে পর্ব ১২

-” ঠিক আছে মামু। তুমি যাও।”
-” এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবি।এখান থেকে এক পাও নড়াবি না।”
-” ঠিক আছে বাবা ঠিক আছে।ঝড় , বৃষ্টি যায় হয়ে যাক না কেন আমি এখান থেকে এক চুলও নড়বো না বলে সিজদা স্টাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।।”

মন দিয়েছি তোমাকে পর্ব ১৪