মন দিয়েছি তোমাকে পর্ব ২৩+২৪

মন দিয়েছি তোমাকে পর্ব ২৩+২৪
নুজাইফা নূন

-” কোথায় ঘুমাবো আমি?”
-” কেন খাটে?”
-” আমি খাটে থাকলে আপনি কোথায় থাকবেন?”
-” আমি ও খাটেই থাকবো।”
-” খাটে কথাটা শুনে মুখটা চুপসে গেল সিজদার।অজানা ভয়, শঙ্কায় গাঁয়ে কাঁটা দিয়ে উঠে তার। চোখের সামনে রত্মার চেহারা টা ভেসে উঠে।ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেয় সিজদা।সিজদার চোখে মুখে ভয়ের ছাপ লক্ষ করে সাইফান বললো,

-”তোমার চোখ মুখ বলে দিচ্ছে তুমি আমাকে কতোটা ভয় পাচ্ছো।আমাকে ভয় পাবার কোন কারণ নেই।আমি মানুষ পশু নয়।আজকে আমাদের বাসর রাত বলেই যে আমি তোমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বো । স্বামীর অধিকার আদায়ে তৎপর হয়ে যাবো। এমনটা নয় সিজদা। আমাদের বিয়েটা পারিবারিক ভাবে হয়েছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বিয়ের আগে আমরা কেউ কাউকে চিনতাম না ,জানতাম না। ইনফ্যাক্ট আমি তোমার ছবিটাও দেখি নি।আমি সবসময় চাইতাম আমার জীবনে যে আসবে সে কালো হোক, বেঁটে হোক ,দেখতে অসুন্দর হোক‌ কিন্তু চরিত্রহীন না হোক।দাদীজান যখনি তোমার কথা বলে আমি বিনা বাক্য রাজী হয়ে যায়।তাই দুজন দুজনকে চিনতে জানতে, মানিয়ে নিতে একটু সময় লাগবে। তুমি আমাকে স্বামী হিসেবে মেনে নিতে না পারলেও বন্ধু ভাবতেই পারো।আমি তোমার ভয়ের কারণ বুঝতে পারছি সিজদা ।তবে ভয়ের কোনো কারণ নেই সিজদা। নিজেকে মানিয়ে নিতে তোমার যতো সময়ের প্রয়োজন তুমি নাও।আমি তোমার মন ছোঁয়ায় আগে কখনোই তোমার শরীর ছুঁয়ে দেখবো না।তবে তোমার জন্য আমার মনের দরজা সবসময় খোলা থাকবে। তোমার যখন খুশি তখন আমার কাছে চলে এসো।আমি সাদরে তোমাকে গ্ৰহন করবো বলে সাইফান বিছানায় মাঝখানে একটা কোলবালিশ রেখে শুয়ে পড়লো।”

-” সিজদা ভাবতেও পারে নি সাইফান তার মতামত, ইচ্ছা, অনিচ্ছার এতো গুরুত্ব দিবে।সিজদার বুকের উপর থেকে যেন একটা পাথর সরে গেলো।সিজদা মনে মনে সাইফানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে প্লেট থেকে এক লোকমা খাবার তুলে মুখে নিয়ে চিবোতে চিবোতে বললো,

-” আমি তো স্বার্থপরের মতো একা একা খাইয়া ল‌ইতাছি। মানুষ টা কি খাইছে? মনে তো হচ্ছে খায় নি।এখানে দুইজনার খাবার র‌ইয়ে।তার মানে মানুষ টা না খাইয়া ঘুমাই গেলো‌?সিজদা খাবার ছেড়ে উঠে এসে সাইফানের বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে সাইফান কে কয়েকবার ডাকতে গিয়েও থেমে গেলো।সাইফানের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে সিজদার ডাকতে ইচ্ছে করলো না।আবার সাইফান না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে ভাবতেও খারাপ লাগলো।সিজদা কি করবে বুঝতে না পেরে হাত কচলাতে লাগলো।সাইফানের সবে মাত্র চোখ লেগে আসছিলো। সিজদার হাতের চুড়ির শব্দে ঘুম আলগা গেলো সাইফানের।সাইফান চোখ খুলতেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো সিজদা।সিজদা শুকনো ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বললো,

-” আপনি খাইছেন? রাত্রির বেলা না খেয়ে ঘুমানো ঠিক না।”
-” তোমার খাওয়া শেষ?”
-” না।আপনি উঠেন। খাবেন চলেন।”
-” সিজদা তার জন্য খায় নি ভাবতেই ভালো লাগলো সাইফানের।সাইফান ইচ্ছে করেই না খেয়ে শুয়ে পড়েছিল।সে দেখতে চেয়েছিলো তার জন্য সিজদার আদৌ কোন টেনশন হয় নাকি।সাইফান বিছানা ছেড়ে নেমে হাত ধুয়ে এসে খাওয়া শুরু করলো। খাওয়া দাওয়া শেষ করেই দুজনেই দু দিকে মুখ দিয়ে শুয়ে পড়লো।”

-” মাঝরাতে প্রচন্ড পেট ব্যাথায় ঘুম ভেঙ্গে গেল সিজদার।সিজদা চোখ খুলতেই বুঝতে পারলো তার মান্থলি সার্কেল শুরু হয়েছে।সিজদা প্রচন্ড ঘাবড়ে গেলো।মান্থলি ডেটের আরো বেশ কিছুদিন বাকি রয়েছে।এর আগেই মান্থলি সার্কেল শুরু হ‌ওয়ার কারণ বুঝতে পারলো না সিজদা।সিজদা বিছানা ছেড়ে নেমে লাগেজ থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকতে গিয়ে দেখলো সাদা সাদা টাইলসে ছোপ ছোপ দাগ ফুটে উঠেছে।সিজদা ওয়াশ রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে সেগুলো পরিষ্কার করবে ভাবতেই ওয়াশ রুমে চলে গেলো।প্রায় দশ মিনিট পর সিজদা ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে টাইলস একদম পরিষ্কার। কোথা ও কোনো দাগ নেই।

খাটের দিকে চোখ পড়তেই দেখলো সাইফান ও রুমে নেই।সিজদা জানে সাইফান‌ই এটা পরিষ্কার করেছে।সিজদা সাইফান কে যতো দেখছে ততোই অবাক হচ্ছে।একটা মানুষ এতো ভালো হয় কি করে? সাইফানের প্রতি সিজদার যে ধারণা ছিলো সেটা পাল্টে গিয়ে সাইফানের প্রতি সম্মান , শ্রদ্ধা যেন শতগুণে বেড়ে গেলো।এর‌ই মধ্যে সাইফান হাতে হট ওয়াটার ব্যাগ, পেইন কিলার নিয়ে রুমে প্রবেশ করলো।সাইফান কে দেখে লজ্জায় লাল হয়ে গেল সিজদা।সাইফানের চোখের দিকে তাকাতে পারছে না।লজ্জায় নুইয়ে পড়ছে।সে ভাবতেও পারে নি তাকে এমন একটা বাজে পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে।সিজদা কে লজ্জা পেতে দেখে সাইফান বললো,

-” এতো লজ্জা পাবার কিছু নেই। ইটস্ নরমাল। পেইন কিলার টা খেয়ে নাও।আর হট ওয়াটার ব্যাগ টা পেটের উপর রাখো।তাহলে বেটার ফিল করবে।”
-” এসবের কোনো দরকার নেই।আপনি শুয়ে পড়েন।আমার জন্য শুধু শুধু মাঝ রাত আপনার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলো।আমি সত্যিই দুঃখিত।”
-” তোমাকে তিন কবুল বলে বিয়ে করার সাথে সাথেই তুমি আমার না চাইতেও আমার সাথে জড়িয়ে পড়েছো। তুমি আমার স্ত্রী।আমার অর্ধাঙ্গিনী। এখন থেকে তোমার সুখ মানে আমার সুখ।তোমার দুঃখ,কষ্ট মানে আমার দুঃখ কষ্ট।তুমি যন্ত্রণায় ছটফট করছো,ঘুমোতে পারছো না।এটা দেখে ও চুপচাপ ঘুমিয়ে থাকতে বলছো আমাকে?আমি এতোটাও কাপুরুষ ন‌ই সিজদা। তুমি অসুস্থ্য।এতো না কথা বলে চুপচাপ যা বলেছি তাই করো।”

-” সাইফানের কথার পিঠে সিজদা কোন কথা না বাড়িয়ে ঔষধ খেয়ে চুপচাপ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পেটের উপর হট ওয়াটার ব্যাগ রাখে। কিছুক্ষণ পর সিজদা একটু বেটার ফিল করলে ঘুমোনোর চেষ্টা করে। কিন্তু ঘুম আসে না। সিজদা বিছানার এপাশ ওপাশ করতে থাকে দেখে সাইফান সিজদার দিকে মুখ করে বললো,
-” তুমি চাইলে আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে পারি।দেখবে ঘুম চলে আসবে।সিজদা প্রতিত্তরে কিছু বলে না দেখে সাইফান আবারো বললো,

-” চুপ করে থাকা সম্মতির লক্ষণ।আমি কি ধরে নিবো যে তুমি আমাকে অনুমতি দিচ্ছো।”
-” সিজদা ছোট করে উত্তর দেয় হুঁ।সাইফান যেন সিজদার হুঁ বলার অপেক্ষাতেই ছিলো।সিজদা হুঁ বলতেই সাইফান এক হাতের উপর ভর করে সিজদার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।জীবনের প্রথম বার কোনো পুরুষের এতো কাছাকাছি এসেছে সে।সাইফানের স্পর্শে সিজদার শরীর শিউরে উঠলো। দাঁড়িয়ে গেলো শরীরের সমস্ত লোমকূপ। আবেশে চোখ বন্ধ হয়ে এলো তার। মিনিট কয়েক অতিবাহিত হবার পর সিজদা ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালো।।”

” ফজরের আযানের মিষ্টি ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠেছে চারিপাশ।দূরের মসজিদ থেকে সাইফানের কানে‌ ভেসে আসছে ,
“আসসালাতু খইরুম মিনান নাওম।”
-” সাইফান তড়িৎ গতিতে বিছানা ছেড়ে ওয়াশ রুমে চলে যায়।প্রায় সাত মিনিট পর সাইফান ওযু করে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই তার চোখ বিছানায় বিড়াল ছানার মতো গুটিসুটি মেরে শুয়ে সিজদার দিকে যায়।আযানের কিছুক্ষণ আগে ঘুমিয়েছে সিজদা।ঘুমন্ত সিজদা কে বড্ড মায়াবী লাগছে সাইফানের কাছে।ইচ্ছে করছে সিজদার কপালে নিজের অধর ছুঁয়ে দিতে।সাইফান সিজদায় দিকে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসে।সিজদার কপালে নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে দিতে গিয়েও কিছু একটা ভেবে সিজদার গায়ে কাঁথা টেনে দিয়ে সাইফান গায়ে সাদা পাঞ্জাবি জড়িয়ে,মাথায় টুপি দিয়ে মসজিদের উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়ে।।”

-” সাইফান রুম থেকে বের হতেই চোখ খোলে সিজদা।সিজদার অনেক সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস।যার দরুন অনেক আগেই ঘুম ভেঙ্গেছে তার। কিন্তু রাতের ঘটনার পর সাইফানের মুখোমুখি হতে লজ্জা লাগছিলো তার।তাই তো ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার পরেও ঘুমের ভান ধরে পড়ে ছিলো সিজদা।সাইফান যখন সিজদার কাছাকাছি এসেছিলো সিজদার বুকের ভেতর যেন কালবৈশাখী ঝড় শুরু হয়ে হয়ে গিয়েছিলো।সিজদার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো।মনে হচ্ছিলো যেন এই মুহূর্তে সে দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলেছিলো সিজদা।সেসব কথা মনে পড়তেই লজ্জায় লাল হয়ে যায় সিজদার মুখ।সিজদা দু হাতে নিজের মুখ ঢেকে নিয়ে বললো,

মন দিয়েছি তোমাকে পর্ব ২২

-” ইশ্! কি লজ্জা ।কি লজ্জা। মানুষ টা আমার এতো কাছাকাছি ছিলো? ডাক্তারবাবুর মতো ইনি ও বড্ড ভালা মনের মানুষ।মাত্র কয়েকঘণ্টার পরিচয় মানুষ টার সাথে।অথচ আমার কত্তো খেয়াল করছে।
মনে হচ্ছে কতো বছরের চেনা জানা ।বড্ড আপন আপন লাগছে মানুষ টাকে।আমার মতো অভাগীর জীবনেও এমন একটা মানুষ আইবো আমি কখনোই ভাবতে পারি নি।আমার যে ডর লাগতেছে।এতো সুখ স‌ইবে তো আমার কপালে?”

মন দিয়েছি তোমাকে পর্ব ২৫